কলেজ আর গুলমোহর গাছ

রাজু দেবনাথ

শোন এবার ভাবছি ঝিলামকে বলে দেব। মনে মনে প্রেম রেখে মনটা পোড়া কার্বাইড করে লাভ নেই।

কথাটা বলল সৌম্য। আমি সৌম্য অনিমেষ রুষা এরা চারজন কলেজে হরিহর আত্মা। কলেজ ক্যান্টিনে আমাদের বেশি দেখা পাওয়া যায়, ক্লাসে কম। শুক্রবার দিন আমাদের ক্লাস কম থাকে তাই বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা চলে। কিছুদিন হল সৌম্য ঝিলাম নামের কলেজের একটা মেয়েকে ওর ভাষায় মারকাটারি ভালবেসে ফেলেছে। এমন অবস্থা যে আর কদিন পর নাকি গলগল করে কবিতা বেরোবে মন থেকে। তখন নেরুদা তেরুদা সব উড়ে যাবে ওর সামনে। 

” বলে ফেল তো, আমাদেরও ফালতু এই এক হ্যাজানি শুনতে ইচ্ছা করে না রোজ আর। “

আমি বললাম। দিনে চব্বিশবার এই এক কথা শুনলে বিরক্ত লাগে। সৌম্য একটু মুষড়ে পড়ল মনে হয় শুনে। 

” ভাই একটা কথা বলার ছিল। “

অনিমেষ সৌম্যকে বলে উঠল। সৌম্য সেরকম পাত্তা দিল না ওর কথায়। 

” সর্বনাশ, রিতমের কথা একদম শুনবি না। ওর এই প্রেমের ব্যাপারে যা করে সব ভুল হয়। দেখেছিস তো ওর কী হয়েছে। এইসব বলাবলির চক্কর ছাড়। “

রুষার কথায় আমি কটমট করে রুষার দিকে তাকালাম। হ্যাঁ হয়েছে, হয়েছে আমার ব্রেকআপ কুড়ি দিন আগে কলেজ ফেস্টে, তো? ব্রেকআপ একদম স্বাভাবিক জিনিস। অনেকদিন ধরে বরং প্রেম করলেই ব্যাপারটা অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায়। তবে আমার কোনও দোষ নেই। কলেজ ফেস্টে নাচতে গিয়ে আমাদের ক্লাসমেট মোহনার পা হঠাৎ মচকে গিয়েছিল। আমি তাই মোহনার পা কোলে তুলে বরফ ঘষে দিচ্ছিলাম। মনে কোনও পাপ ছিল না আমার। পারভার্ট কথাটা শুনে পাশে তাকিয়ে দেখি আইরিশ দাঁড়িয়ে আছে। আমি বোঝাতে গিয়েছিলাম যে ও যেটা ভাবছে সেটা নয় কিন্তু আইরিশ বরাবর কম কথার মেয়ে তাই শুধু একটা চড় মেরে বুঝিয়ে দিয়েছিল, বেশি কথা খরচা করেনি। ভাগ্যিস চড় মারাটা কেউ দেখেনি নাহলে আমার খবর হয়ে যেত কলেজে। তারপর থেকে ফোন ফেসবুক সব ব্লক। অনেক চেষ্টা করে এখন না পাওয়াটা মেনে নিয়েছি অনেকটা। 

” এই ওঠ বাড়ি যাব। অনেক আড্ডা হল আর ভালো লাগছে না। “

অনিমেষ বলে উঠল।  

” বাকি ক্লাস? “

আমি জিগ্যেস করলাম। অনিমেষ মাথা নাড়ল, মানে করবে না। আমারও বেশিক্ষণ কলেজে থাকতে ইচ্ছা করে না। অন্য ডিপার্টমেন্ট হলেও কলেজ তো এক। দিনে পাঁচবার করে আইরিশের মুখোমুখি হতে হয়। আর আইরিশ একরাশ ঘেন্না নিয়ে আমার দিকে তাকায়। আমার বুকের কষ্টটা গলা বেয়ে উঠতে চায় তখন। ইচ্ছা করে ছুটে গিয়ে আইরিশকে জড়িয়ে ধরে ওর গায়ের ল্যাভেন্ডার গন্ধটা শরীরে জমিয়ে চুমু খাই। কিন্তু এইসব হলিউড সিনেমায় হয়। আমার জীবনটা যে কেন হলিউড সিনেমা হল না। 

” এই সৌম্য, আনোয়ারের দোকানে আইসক্রিম খেতে যাবি? “

রুষা উঠতে উঠতে সৌম্যকে জিগ্যেস করল। 

” না না এই নভেম্বরের বিকেলে আইসক্রিম খাই,আর দুম করে ঠাণ্ডা লেগে যাক। “

সৌম্য এই বলে নিজের বাইক আনতে চলে গেল। কদিন ধরেই সৌম্যর প্রতি রুষার ব্যবহার আমাকে অবাক করছে। আমার ভুল হতেও পারে। নারীচরিত্র বোঝা হেভি চাপ। সৌম্য বাইক নিয়ে এল। 

” চল না চল না। “

রুষা সৌম্যর কানের ঝি ঝি পোকা নাড়িয়ে দিচ্ছে একেবারে। 

” না যাব না। যা তো। “

সৌম্য একটু ঝাঁজিয়ে বলে উঠল। রুষার চিকচিকে চোখটা দেখে সৌম্য বুঝল বলাটা একটু কড়া হয়ে গেছে।

” উফ, এই দেখো আচ্ছা চল, কিন্তু আমি খাব না আইসক্রিম। “

সৌম্যর কথাটা শেষ হওয়ার আগেই রুষা হেসে সৌম্যর বাইকে লাফিয়ে উঠে পড়ল। সৌম্য আমাকে আর অনিমেষকে হাত দেখিয়ে চলে গেল। আমাদের কলেজের ক্যাম্পাসে একটা গুলমোহর গাছ আছে, তাতে লাল ফুল ধরে থাকে সবসময়। আইরিশ ওর চকলেট রঙের চোখ নিয়ে মাঝেমাঝে এই গাছের নিচে এসে দাঁড়ায়। আমার কেমন উদাস লাগে দেখলে, ইচ্ছা করে সেই ফুল কুড়িয়ে আইরিশকে দিয়ে বলি তোমার জন্য এই ফুল ফুটেছে।

” পুরো গন কেস ভাই। অবস্থা হাতের বাইরে। “

অনিমেষের কথার খেই ধরতে আমার একটু সময় লাগল। বাস্তবের মাটিতে এসে পড়লাম। 

” কি হাতের বাইরে? “

আমি না বুঝে প্রশ্ন করলাম।

” আরে রুষা, পরে বলব। চল বেরোই এবার। “

আমি আর অনিমেষ কলেজ গেট থেকে বেরোতে যাব এমন সময় দেখলাম আইরিশ আর ঝিলাম আসছে। আইরিশের সাদা কুর্তিটা মনে হল এই নভেম্বরে বরফ এনে ফেলেছে আমার চারিদিকে। আমার শীত করছে। আমি মাথা নিচু করে নিলাম। পাশ থেকে একটা কথা শুনলাম, পারভারট। আমার খুব গুলমোহর গাছটা হতে ইচ্ছা করল সেই মুহূর্তে। 

” তোর মতো পারভারটের সাথে থাকলে আমার কিছু হবে বলে মনে হয় না। চল সোমবার দেখা হবে। ”

অনিমেষ হেসে বলল। অনিমেষের কথায় ওর দিকে তাকালাম। অনিমেষের আবার কী হবে? কার সাথে কে জানে? আমি আর অত ভাবলাম না। পার্ক স্ট্রীটের নভেম্বরের বিকেলের রোদটা অসাধারণ। আর কদিন পর থেকে বড়দিনের আমেজ এসে কড়া নাড়বে পার্ক স্ট্রীটে। আমি কয়েকটা সস্তার বাবল গাম কিনলাম। বাস রাস্তাটা চিবোতে চিবোতে যাওয়া যাবে। 

                                                                      ২

” অনিমেষ তোর মোবাইলটা দে। গুলমোহর গাছটার একটা ছবি তুলব। ঝিলাম আজ আসেনি তাই মনটা কেমন উদাস কবি কবি লাগছে। “

সোমবারের বিকেলে ক্লাসের ফাঁকে আমরা ক্যাম্পাসে একটু আড্ডা দিচ্ছিলাম। এর মধ্যে সৌম্য অনিমেষের মোবাইলটা চাইল। 

” কেন তোরটা দিয়ে তোল। “

অনিমেষ বলল। 

” আরে তোরটায় একটা ন্যাচারাল ব্যাপার আসে। আমারটায় সেই ফিল আসেনা। দে না। বেশি হ্যাজাস না। “

সৌম্য প্রায় কেড়ে নিয়ে নিল অনিমেষের ফোন। 

” একটা ফোটো তুলব আর ঝিলামকে ডেডিকেট করে কবিতা লিখে ফেলব বুঝলি। গাছের ফুলের সাথে কবিতা হেভি যাবে। “

আমি একবার রুষার দিকে তাকিয়ে নিলাম। দেখলাম মেয়েটার মুখটা একদম চুপসে গেছে। অনিমেষ ঠিক বলেছিল একদম গন কেস। 

” ভাই সৌম্য, সেই কথাটা শুনলি না? “

অনিমেষ একটু মিনমিন করে কথাটা বলল। 

” দাঁড়া আগে কাছে গিয়ে একটা ছবি তুলে আসি। এসে শুনছি। “

সৌম্য অনিমেষের ফোনটা নিয়ে গুলমোহর গাছের দিকে এগিয়ে গেল। আমি সবে চোখ বুঝে আইরিশের চোখটা ভাবছিলাম এমন সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। সৌম্য দেখি দৌড়ে এসে অনিমেষের কলার ধরে দাঁড় করিয়েছে।

” তোর ফোনে ঝিলামের মিস ইউ মেসেজ এল কেন বল শালা। “

আমি তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে ছাড়িয়ে দিলাম সৌম্যকে। কিন্তু কথাটা আমারও কানে গেছে।

” কীসব বলছিস তুই? মাথা খারাপ হল নাকি? “

আমি ঝাঁজিয়ে বলে উঠলাম সৌম্যকে। 

” ঠিকই বলছি আমি, এই দেখ। “

সৌম্য এই বলে আমার মুখের সামনে অনিমেষের ফোনটা ধরল। আমি দেখলাম ঝিলামের ছবি সেখান থেকে মেসেজ এসেছে মিস ইউ অনি। বুঝলাম এবার যুদ্ধ লাগবে। যুগে যুগে এরকম যুদ্ধ লেগে এসেছে।

” লোকের মেসেজ পড়া খারাপ। “

অনিমেষ একটু মিনমিন করে বলে উঠল। বেচারা আর বলবেই বা কী?

” মেসেজ তোমার পে…।”

রুষা সৌম্যর বাজে কথা শেষ করতে দিল না।

” কি পাগলামো করছিস সৌম্য? ঝিলাম অনিকে পছন্দ করে আমি জানি। “

” তুই ও জানিস? বাহ, রিতম তুইও জানিস তাহলে। “

সৌম্য রাগ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল। আমি সাথে সাথে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম আমি জানি না। 

” আমি তো বলার চেষ্টা করেছি। তুই পরে শুনব, এই তাই করে কাটিয়ে দিয়েছিস। “

অনিমেষ বলল। সৌম্য একটু সময় নিল নিজেকে সামলানোর। 

” আমি বুঝতে পারছি না শেষে তোকে কী দেখে ঝিলাম পছন্দ করল? “

সৌম্য মাথা নিচু করে বলল। একটা বেকায়দায় পড়া গেল। আমি কার হয়ে কথা বলব বুঝতে পারছি না। 

” তুই তো কিছুই বুঝিস না, এই যে রুষা তোকে পছন্দ করে তুই বুঝিস? “

এইবার সৌম্য আবার একটা শক খেল। এই বয়সে এক ঘণ্টায় এত চাপ সৌম্যর মন নিতে পারলে হয়। অনিমেষ কথাটা শেষ করা মাত্র দেখলাম সৌম্য হাঁ হয়ে গেলো। আর রুষা পাশে রাখা ব্যাগটা নিয়ে ছুট লাগাল। আমি এখনও বুঝতে পারছি না কি করব। 

” রুষা আমাকে মানে তুই আমাকে মানে আমাকে রুষা? “

দেখলাম সৌম্যর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। মনের উপর হেভি চাপ গেলে কথা এরকম জড়িয়ে যায়। আইরিশ আমাকে যেদিন বলেছিল আমার হাসিটা খুব মিষ্টি আমারও ওইদিন কথা জড়িয়ে গেছিল। 

” হ্যাঁ তোকে রুষা। “

অনিমেষ শান্তভাবে কথাটা বলল। সৌম্য ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে গেল। সে যাক রাস্তায় ঘুরে একটু গাড়ির ধোঁয়া না খেলে মাথা খুলবে না ওর। পূর্বরাগের লক্ষণ এসব। 

” রিতম বেরোই রে আমি। একটু কাজ আছে। “

অনিমেষও উঠে পড়ল।

” ঝিলামের ব্যাপারটা বল ভাই। কি করে কি হল। “

আমি এইসব গল্পে শোনার সুযোগ ছাড়ি না। 

” সময় করে বলব বুঝলি অনেক গল্প। “

অনিমেষ হেসে চলে গেল। আমি ঘড়ি দেখলাম প্রায় পাঁচটা বাজে। গুলমোহর গাছটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম আজ সেখানে চকলেট রঙের চোখ নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। আমার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। 

” আরে দাদা একটু চেপে দাঁড়ান না। “

আমি গুঁতিয়ে গাঁতিয়ে একটু জায়গা করে নিলাম বাসে। শীতকাল আসতেই এই পার্ক স্ট্রীটে বাসে এত ভিড় হয় বলার নয় এই চলবে জানুয়ারি অবধি। লোকের পিকনিক ঘোরার বাই চাপে যেন। 

” বাস থামান বাস থামান। এই এত ভিড়ে আমি যাব না। “

বাসে আমার একটু আগে থেকে কথাটা এসেছে। কথাটা আমার মনের উপর দিয়ে মাখন কাটা ছুরির মত কাটা দিয়ে গেল। আইরিশের গলা। আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলাম একটু। ততক্ষণে বাস থেমে গেছে। আমি প্রায় এসে গেছি বাসের গেটের সামনে। আইরিশ তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে দেখলাম একটু পা মচকে ফেলল। আর ব্যাথা এসে লাগলো আমার বুকে। আমি সামনের যে কজন ছিল তাঁদের গুঁতো লাথি ঘুসি দিয়ে বদলে কটা খিস্তি খেয়ে নেমে পড়লাম বাস থেকে। আইরিশ ফুটপাথে বসে পাটায় হাত বোলাচ্ছে। আমার ইচ্ছা হল ছুটে গিয়ে পাটায় হাত বোলাই। কিন্তু ওইখানে জীবন আর সিনেমার তফাৎ। 

” কি হল খুব লেগেছে নাকি? “

আইরিশ আমার কথায় চমকে উঠল একটু। চকলেট রঙের চোখের কোনায় যেন একটু বাষ্প জমে উঠল। আবার পরক্ষণে সামলে নিল নিজেকে আইরিশ।

” আসলে বাস থেকে নামতে…… “

” আমি দেখেছি তোমাকে ওই বাসেই ছিলাম আমি। “

আমি সাহস করে আইরিশের পাশে গিয়ে বসলাম। বুঝতে পারছি এখন আমাকে সাহস জোটাতেই হবে। 

” দেখেছো যখন তাহলে দেখ কোথাও বরফ পাও নাকি। “

আইরিশ একটু ধমকে বলে উঠল। বহুদিন পর আইরিশ পারভারট ছাড়া আমাকে কিছু বলল। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে তাড়াতাড়ি পাশে একটা আইসক্রিম দোকান থেকে বরফ নিয়ে আসলাম।

” আমি লাগিয়ে দি? “

কাঁপা কাঁপা গলায় আমি প্রশ্ন করলাম। 

” দাও, তোমার তো আবার অভ্যাস আছে মেয়েদের পায়ে বরফ ঘষার।  “

বলে আইরিশ একটু রাগ রাগ গলায় নীল স্কারট তুলে নূপুর পরা গোড়ালিটা এগিয়ে দিল আমার দিকে। আমি শুকনো গলায় দেখলাম শহরের সব গাড়ি ফ্ল্যাটগুলো গুলমোহর গাছে বদলে যাচ্ছে। আমি তাঁর নিচে বসে আইরিশের পায়ে বরফ ঘষে দিচ্ছি। শহরের রাস্তা ভরে গেছে গুলমোহর ফুলে। একদম সিনেমার মতো।

+ posts

One Comment on “কলেজ আর গুলমোহর গাছ”

Leave a Reply to Debapriya Guha Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *