ব্ল্যাক ম্যাজিক

শুভজিৎ চট্টোপাধ্যায়

মাথার পেছনটা কেমন চ্যাট চ্যাট করছে। রক্তটা জমে জেলির মত হয়ে গেছে। অসহ্য যন্ত্রণা মাথায়, গায়ে। কিন্তু উঠতে তো হবেই। কেউ তো নেই ঘরে যে ডাকবো। হস্টেলে এমনিতেই এখন খুব কম ছাত্র। আর আমার এখন এত জোর নেই যে চিৎকার করবো।

আস্তে আস্তে উঠে বসলাম। একটু ধাতস্থ হয়ে দেওয়াল ধরে ধরে উঠেই পড়লাম। শাওয়ারটা চালিয়ে মাথাটা দিয়ে দিলাম জলের তলায়।

উফফ কি কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আরামও লাগছে।

এভাবেই একদিন আমিও শেষ হয়ে যাবো। জানি না আর কতদিন। তবু যেকদিন বাঁচা যায় এসব সহ্য করে!

◆◆◆◆◆◆◆

তিন সপ্তাহ আগে

এই ছোট শহরটা খুব সুন্দর। কানাডার একপ্রান্তে এই সেন্ট ক্যাথরিন শহরটা পরিচিত ব্রোক ইউনিভার্সিটির জন্য। শহরের কেন্দ্রে জনবসতি কম কিন্তু বেশ কিছু হোস্টেল আছে। আমিও সেরকমই একটা হোস্টেলে থাকি। ক’দিন আগেও গমগম করতো শহর আর হোস্টেলটা। এখন চারদিকে শুধু আতঙ্ক। অনেক ছাত্রই বাড়ি পালিয়েছে। গোটা হস্টেলে পড়ে আছি আমরা জনা বারো ছাত্র। আমি আর আমার রুমমেট স্যাম আমাদের দুজনেরই যাওয়া অসম্ভব ছিলো। এমনিতেও আমরা ক্রাইম পার্টনার। তাই হোস্টেলের ঘরটাই হয়ে উঠলো আমাদের পৃথিবী।

চারদিকে লকডাউন, বেরোতে পারছি না। তাস খেলে, নেশা করে , গল্প করে আর সময় কাটে না।

◆◆◆◆◆◆◆

সেদিন মার্চের ষোল তারিখ। ইউটিউবে একটা ব্ল্যাক ম্যাজিকের ভিডিও দেখছিলাম আমরা।

আমার এক সময় খুব শখ ছিল। অনেকটা শিখেছিলাম।

স্যামের কথায় চমকে উঠলাম আমি।

কি? ব্ল্যাক ম্যাজিক?

হ্যাঁ। এখন অবশ্য অনেকদিন চর্চা নেই। তবে চেষ্টা করলে আবার হবে বোধ হয়।

প্রয়োজন আছে কি?

ধুর, সময় কাটে না। এটাই করি।

স্যাম, আমার এসব ব্যাপারে ভয় আছে তুই জানিস।

ধুর। কিছু হবে না। ভীতু কোথাকার।

তখনকার মত কথাগুলো থেমে গেলেও স্যামের মাথায় যে তা ঘুরছিলো সেটা আমি বুঝিনি।

রাত তখন দুটো

ঘুমোলি?

হুম, কেন?

ঘুম জড়ানো গলায় উত্তর দিলাম।

আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে।

কি প্ল্যান?

আমার ব্ল্যাক ম্যাজিকের কিছু পদ্ধতি জানা আছে। চারজন লাগবে। তুই সার্জিও আর দিয়েগোকে রাজী করা। আমি বললে শুনবে না। তুই বললে শুনবে।

ঘুমো তো। আমাকেও ঘুমোতে দে।

তখনকার মত চুপ করলেও পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে আবার শুরু করলো স্যাম। অনেক বুঝিয়েও যখন আমি রাজী হলাম না তখন স্যাম শেষ চালটা দিলো–

ভারতীয়রা এত ভীতু হয় জানতাম না।

কথাটা বুকে জ্বালার মত লাগল। রাজী হয়ে গেলাম। যদি জানতাম কি অভিশাপ আসতে চলেছে আমাদের জীবনে তাহলে কখনোই রাজী হতাম না।

দিয়েগো আর সার্জিও ছিলো এক নম্বরের নেশাখোর। ওদের রাজি করাতে বিশেষ বেগ পেতে হলো না। সময় ঠিক হলো তিনদিন পরে শুক্রবার রাত বারোটা।

স্যামের মধ্যে একটা অদ্ভুত চাঞ্চল্য আর অস্থিরতা লক্ষ্য করলাম। সারাদিন কিছু হিসেব করছে। নিজের আলমারির ভিতর থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস বের করছে। একদিন তো মেডিক্যাল এমার্জেন্সি দেখিয়ে পাস জোগাড় করে বেরিয়েও গেলো।  ঘন্টা দুয়েক পরে ফিরলো ঝোলা ভর্তি কীসব নিয়ে।

শুক্রবার সকাল থেকেই চাপা টেনশন সবার মধ্যে। স্যাম, সার্জিও আর দিয়েগো আজ একটু বেশিই নেশা করছে। আমাকেও স্যাম বারবার জোর করছে কিন্তু আমি নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করছি।

রাতের খাবার হয়ে যাওয়ার পর চারজন আমাদের ঘরে একত্রিত হলাম। সিঙ্গল খাট দুটোকে দেওয়ালের দুপ্রান্তে সরিয়ে মাঝখানে বসা হয়েছে। স্যাম বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে একটা গোলের মধ্যে তারার মত একটা কিছু আঁকছে। আঁকা শেষ হওয়ার পর দেখলাম সেটা দেখতে খানিকটা ঔজা বোর্ডের মত আর তার ঠিক মাঝখানে একটা ভয়ানক চোখ।

স্যাম আমাদের বোঝাতে লাগলো–

অনেক ধরণের ব্ল্যাক ম্যাজিক হয় কিন্তু যদি ঠিক করে করতে হয় তাহলে শুরুতে শয়তানের উপাসনা করতে হয়। সেই উপাসনা দিয়ে আমরা শুরু করবো। ব্ল্যাক ম্যাজিকের মাধ্যমে আমরা একটি অতৃপ্ত আত্মার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবো। আমাদের মধ্যে একজন হবে মিডিয়াম। তোরা যেহেতু সব পদ্ধতি জানিস না তাই আমিই হবো মিডিয়াম। আমার মাধ্যমে সে আসবে আর এই ব্ল্যাক ম্যাজিক কাজে লাগিয়ে সেই আত্মাকে আমি বশ করবো। তারপর তাকে ব্যবহার করবো নিজের ইচ্ছেমত। একটা কথা মনে রাখবি, যা খুশি হোক আমি যতক্ষণ না বলবো কেউ নিজের জায়গা ছেড়ে উঠবি না। তাহলে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাবে।

স্যামের চোখে এক নৃশংস ক্রুরতা। আমার রীতিমত ভয় করছিল। বাকি দুজনকে দেখে ভয় পেয়েছে বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু ওরা অনেকটাই নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করছে। আমিও মনে সাহস সঞ্চয় করে বসলাম। স্যাম একটা প্যাঁচার কঙ্কাল আর শকুনের মাথার খুলি রাখলো ওই ভয়ানক চোখটার সামনে। চোখটার দুদিকে জ্বালানো হলো দুটো মোটা মোম।

ঠিক রাত বারোটার সময় লাইট নিভিয়ে দেওয়া হলো। মোমদুটোর আলোটা যেন চারপাশের অন্ধকারকে আরো ঘন করছে। স্যাম চোখ বুজে শয়তানের উপাসনা মন্ত্র পাঠ করছে। দিয়েগো আর সার্জিও একটা ঘোরের মধ্যে মোমের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাকিয়ে আছি স্যামের দিকে। স্যামের মুখটা মোমের আলোয় কেমন অপার্থিব দেখতে লাগছে। আস্তে আস্তে ঘরের ভেতরটা কেমন গুমোট হতে লাগলো। একটা চাপা চাপা ভাব। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। একটা ভ্যাপসা গন্ধ ভরে যাচ্ছে ঘরে।

সে এসে গেছে।

ফিসফিস করে বললো স্যাম।

কিন্তু স্যামই তো মিডিয়াম। তাহলে সে কোথায়? আরো অপেক্ষা, দীর্ঘ অপেক্ষা। পচা গন্ধটা বাড়ছে, আরো বাড়ছে। দমবন্ধ হয়ে আসছে। অন্ধকারটা যেন আরো চেপে বসেছে। মোমদুটো ছোট হয়ে যাওয়ায় দেওয়ালে আমাদের ছায়া গুলো অনেক বড়ো লাগছে, ঠিক যেন প্রেতাত্মা। হঠাৎ আমার শরীরটা হালকা হতে লাগলো। যেন শূন্যে উড়ছি। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।

যখন জ্ঞান ফিরলো তখন জানলা দিয়ে বেশ ভালো রোদ ঢুকছে। ওরা তিনজন চিন্তিত মুখে আমার চারদিকে বসে আছে। ওদের মুখে যা শুনলাম সেটা হলো আমি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাই এবং বিচিত্র ভাষায় কিছু বলতে থাকি। তারপর একসময় চুপ করে যাই। যেন ঘুমোচ্ছি। সেই ঘুম ভেঙেছে আজ রবিবার দুপুরে মানে প্রায় ছত্রিশ ঘন্টা পরে। ডাক্তার ডাকবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত ওরা নিয়ে উঠতে পারেনি। আর স্যামের অবস্থা ছিলো সবচেয়ে খারাপ। মুখ চুন করে বসেছিলো। আমি চোখ খোলাতে কিছুটা যেন শান্তি পেলো।

সারাদিন ভালোই কাটলো। কিন্তু স্যামকে যেন কিছু একটা চিন্তা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।

কি হয়েছে রে?

কিছু না তো। কেন?

কিছু তো হয়েছে। দুপুর থেকেই দেখছি তুই কিছু একটা ভাবছিস।

সেরকম কিছু না। আমি মিডিয়াম ছিলাম। আমার মধ্যে কিছু এলো না। কিন্তু আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম। সে এসেছে। তারপর শুধু তুই অজ্ঞান হয়ে গেলি আর তার কোনো পাত্তা পেলাম না। তুই অজ্ঞান হলি কেন বলতো?

আমি আমার সমস্ত অনুভুতিটা খুলে বললাম। স্যাম বললো ওদেরও তাই মনে হয়েছে। কিন্তু ওই হালকা হয়ে যাওয়াটা ওদের কারো হয়নি।

আমায় এটা নিয়ে জানতে হবে। এলো তো গেলো কোথায়। এরকম তো হওয়ার কথা নয়।

পরদিন সকালে সার্জিওর দুমড়ানো মোচড়ানো লাশটা পাওয়া গেলো ওদের ঘরের দরজার বাইরে। পুরো শরীরটাকে যেন জামাকাপড় নেংড়ানোর মত করে মোচড় দেওয়া হয়েছে। শরীরে একফোঁটা রক্ত নেই। চোখ দুটোতে অসম্ভব যন্ত্রণা আর ভয়। ওর ওই অবস্থা দেখে গা গুলিয়ে গেলো।

স্বাভাবিক ভাবেই পুলিশ এলো। দিয়েগোর কথা মত ও কিছুই জানে না। ও নাকি অঘোরে ঘুমাচ্ছিলো। পুলিশ আমাদের সবাইকে হোস্টেল না ছাড়ার অর্ডার দিয়ে সার্জিওর দেহটা নিয়ে চলে গেলো। সাথে জেরা করার জন্য নিয়ে গেলো দিয়েগোকে। একটা চাপা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো হোস্টেল জুড়ে। পুলিশ যাই বলুক ওরকম ভাবে দেহকে মুচড়ে দেওয়া কোনো মানুষের কাজ নয়।

ঘরে ফিরে স্যাম আর আমি মুখোমুখি–

আমি নিশ্চিত এই ঘটনার সাথে আমাদের সেইদিনের কাজের কিছু যোগাযোগ আছে।

আমার খুব ভয় করছে স্যাম। সত্যি।

সত্যি কথা বলতে এখন আমারও ভয় করছে। সেদিন কিছু একটা ভুল হয়েছে। আমাকেই এটা ঠিক করতে হবে।

স্যাম ফোনটা নিয়ে হোষ্টেলের ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে কারো সাথে চাপা গলায় কথা বলছে। সার্জিওর দেহটার কথা মনে পড়ায় আমি বাথরুমে ছুটলাম। বেশ খানিকটা বমি করলাম। ঘাড়ে মাথায় জল দিয়ে আমায় ঘরে  এনে শুইয়ে দিলো স্যাম।

হস্টেলে আজকেও ঠিক করে খেতে পারেনি। সারা হস্টেল যেন এক মৃত্যুপুরী। কারো মুখে কথা নেই। সন্ধ্যের পরে সবাই ঘরে। কোনো আওয়াজ নেই। ইন্টারনেট ঘেঁটে আর নিজের ব্ল্যাক ম্যাজিকের গুরুর সাথে কথা বলে স্যাম নিশ্চিত যে সেদিন কোনো ভয়ঙ্কর শক্তিশালী অতৃপ্ত আত্মার প্রবেশ ঘটেছে এই হোস্টেলে। একে আটকানোর ক্ষমতা স্যামের নেই। আর উনি এই লকডাউনের মধ্যে আসতেও পারবেন না। উনি স্যামকে কিছু জিনিস বলে দিয়েছেন। সেই পদ্ধতির ফলাফল ওনাকে জানাতে বলেছেন। অনেক চাপাচাপিতেও স্যাম কিছুতেই আর একটাও কথা বললো না।

রাত দুটো, হোস্টেলের নিচের তলায় লবি দিয়ে হেঁটে চলেছে একটা মানুষ। লাইট গুলো নিজে থেকেই এক এক করে নিভে যাচ্ছে।

পরদিন সকালে নিচের তলার দশ নম্বর ঘরের ভিতরে পাওয়া গেলো ওই ঘরের দুজন ছেলের মৃতদেহ। ঠিক সার্জিওর মতোই মৃত্যু, কিন্তু তার চেয়েও ভয়ঙ্কর। দুজনের দেহ দিয়ে যেন গিঁট পাকিয়ে দেওয়া হয়েছে একে অপরের সাথে। দিয়েগো পুলিশ হেফাজতে। পুলিশ কিছু বুঝতেই পারছে না। সবাইকে নিজের ঘর ছেড়ে নিচের তলার চারটে পাশাপাশি রুমে থাকতে বললো পুলিশ। চারজন গার্ড নিয়োগ করা হলো হস্টেলে। স্যামের মুখ কালো। আমরা বাকি সাতজন যারা থেকে গেছি হোস্টেলে ,পালাতে পারলে বাঁচি। কিন্তু একে লক ডাউন তার উপর পুলিশের অর্ডার। পুরো হোস্টেলে মাত্র আটজন, চারটে ঘরে আর চারজন গার্ড। পুরো বিল্ডিংটা যেন খেতে আসছে। সারাদিন শ্মশানের নিস্তব্ধতা বিল্ডিংয়ে৷

◆◆◆◆◆◆◆

 তারপর দুদিন কিছু হয়নি। দিয়েগো ফিরে এসেছে। আমাদের ঘরেই ওর জায়গা হয়েছে।

ধীরে ধীরে আবার সব স্বাভাবিক হয়ে আসছিলো। সপ্তাহখানেক কোনো ঘটনা নেই। পুলিশের পাহারা রয়েছে৷ তদন্তের জন্য পুলিশের আনাগোনাও রয়েছে কিন্তু কিছুই অগ্রগতি নেই।

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ। এই সপ্তাহে রান্নার দায়িত্ব আমার আর স্যামের। দিয়েগোও হাত লাগিয়েছে।  সন্ধ্যের মধ্যে সব রান্না সেরে ফেলা হয়েছে। এখন সবাই ঘরেই তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয়। অনেকদিন মন খারাপের পর আজ আবার নেশার আসর বসিয়েছে স্যাম আর দিয়েগো। আমিও টুকটাক সঙ্গ দিচ্ছি। সেই প্রয়োজনেই রান্নাঘরে যেতে হলো আবার। নিজেদের স্টকের কাজুটা রোস্ট করে নিয়ে আর সামান্য একটু ফ্রুট স্যালাড বানানোটা প্রায় শেষের মুখে, হঠাৎ কারেন্ট চলে গেলো। কারেন্ট যাওয়ার সাথে সাথেই একটা আতঙ্ক চেপে বসলো আমার মাথায়। ফোনটাও নিয়ে আসিনি। মোমটা জ্বালিয়ে আস্তে আস্তে এগোতে থাকলাম ঘরের দিকে।

হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় মোমটা নিভে গেলো। আর একটা বরফ ঠান্ডা হাওয়া আমার শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিলো। একটা ভয়ের শীতল স্রোত আমার শিরদাঁড়া দিয়ে নামছে। চোখের সামনে এটা ছায়ামূর্তি।

যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমায় সবাই ঘিরে রেখেছে। উঠে যা শুনলাম তাতে মাথা ঘুরে গেলো আমার।

অনেক্ষন আমায় ফিরতে না দেখে ওরা এমার্জেন্সি লাইট নিয়ে এসে দেখে আমি রান্নাঘরের বাইরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছি। ডাকাডাকিতে অন্য সবাই এসে আমায় উদ্ধার করে নিয়ে যায়। কিন্তু পুলিশদের খুঁজে পাওয়া যায় না। পুলিশ স্টেশনে পুলিশদের অন্তর্ধানের ব্যাপারটা জানতেই তারা এসে পৌঁছায়। এসে অনেক খুঁজে দোতলার একটা ঘরে ওই চারজন পুলিশের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। প্রবল আক্রোশে তাদের মাথাগুলো পিছনদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। চোখে অপার বিস্ময়। পুলিশদের ওই অবস্থা দেখে হোস্টেলের সমস্ত ছেলে আর বাকি পুলিশেরা শিউরে উঠেছে। এরকম নৃশংস ভাবে কেউ মারতে পারে?

◆◆◆◆◆◆◆

তারপর পাঁচ দিনে আরো চার জন। প্রতিটা মৃত্যু খুব বীভৎস। যেন প্রবল আক্রোশে কেউ প্রতিশোধ নিয়ে বেড়াচ্ছে। পুলিশ কোনো কিনারা করতে পারছে না। আমরা সবাই এই অভিশপ্ত হোস্টেল ছেড়ে পালাতে চাইছি কিন্তু লকডাউন থাকায় পুলিশ বেরোতে দিচ্ছে না। আমরা বুঝতে পারছি এ কোনো মানুষের কাজ নয়। কিন্তু পুলিশ মানতে নারাজ। পুরো হোস্টেল বাইরে থেকে পুলিশ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। আমরা পাঁচজন রয়েছি দুটো ঘরে।

আজ সকালে স্যামের ফোনে ফোন এসেছিলো। ওর ব্ল্যাক ম্যাজিকের গুরু বলেছেন ওই ঘরেই আবার একটা ব্ল্যাক ম্যাজিক করতে হবে। অবর্থ্য উপায় জানিয়েছেন। রাতে এগারোটার সময় আমি আর স্যাম চুপি চুপি চলে গেলাম দোতলায়। দিয়েগোকে কিছু জানাইনি। ও নেশা করে ঘুমোচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় প্রতি মুহূর্তে এক অজানা আতঙ্কে বুক কেঁপে উঠছে। হঠাৎ গায়ে একটা টিকটিকি পড়ায় স্যাম প্রায় চিৎকার করে উঠেছিল। অন্ধকারে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছি। আমার মন বলছে আজই আমার শেষ দিন। গলা শুকিয়ে কাঠ। ওইটুকু পথ পেরোতে যেন একবছর লাগছে। কোনোমতে পৌঁছলাম আমাদের পুরোনো ঘরে। লাইট জ্বালানো যাবে না। বাইরে থেকে পুলিশ আলো দেখলেই চলে আসবে। একটা ছোট মোমবাতি  জ্বালিয়ে একটা ছোট আঁকিবুঁকি কেটে নিলো স্যাম। শুরু হলো মন্ত্রপাঠ। ঘরের অন্ধকারে নিজেকেই প্রেত মনে হচ্ছে আর স্যামকে প্রেত সাধক। হঠাৎ আমি দাঁড়িয়ে স্যামের পা ধরে দিলাম টান।

কি করছিস তুই?

কি ভেবেছিলি? এতদিন পর আমায় জাগিয়ে তুলে শান্তি পাবি? আমি এই হোস্টেলেরই ছাত্র ছিলাম। সিনিয়রদের অত্যাচারে আমি অসুস্থ হয়ে পুলিশে খবর দেবো ভেবেছিলাম। ওরা জানতে পেরে আমায় গলা টিপে মেরে ফেলে। লাশটা পুঁতে দেয় পিছনের বাগানে। এতদিন আমি আটকে ছিলাম আর প্রতিশোধে জ্বলছিলাম। তুই জাগিয়েছিস আমায়। সবাইকে শেষ করে দেবো।

স্যাম কোনোমতে আমার হাত ছড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করছে। আমি নিজেকে নিজে চিনতে পারছি না। শরীরটা আমার কন্ট্রোলে নেই। আমি চিৎকার করতে চাইছি, পালাতে চাইছি কিন্তু এক অদৃশ্য শক্তি আমায় চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রায় উড়ে গিয়ে স্যামকে ধরে ছুঁড়ে ফেললাম দেওয়ালে। গলাটা দুহাত দিয়ে চেপে ধরে আস্তে আস্তে ওকে উপরের দিকে তুলছি। গরম নিশ্বাস পড়ছে। হঠাৎ মাথায় ভারী কিছুর আঘাত। পড়ে গেলাম। মাথা থেকে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। দিয়েগো। ও কখন উঠে এসেছে জানিই না। ওর হাতে একটা বেসবল ব্যাট। স্যাম সেই সুযোগে পালানোর চেষ্টা করছে। দিয়েগো আবার ব্যাটটা চালালো আমার মাথা লক্ষ্য করে। আমার গায়ে তখন অসুরের শক্তি।  দুহাতে ধরে ফেললাম ব্যাটটাকে। তারপর ছিনিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। স্যাম ঘরের এক কোণে সিঁটিয়ে আছে। আমি দিয়েগোর দিকে এগোচ্ছি। ও দিশেহারা। পালাতে উদ্যত হতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে ধরে ফেললাম। নিখুঁত হাতের মোচড়ে মাথাটা ঘুরিয়ে দিলাম পিঠের দিকে। ওর আতঙ্কিত চোখদুটো পিছনদিকে তাকিয়ে আমায় দেখছে। তাকিয়ে দেখি স্যাম নেই। ওইতো বাথরুমের দিকে যাচ্ছে। ওর পিছন পিছন বাথরুমে ঢুকে দুটো পা ধরে চিড়ে দিলাম। স্যামের চিৎকারে খানখান হয়ে গেলো রাতের নীরবতা। লুটিয়ে পড়লাম আমি মাটিতে। আমায় নিয়ে আর মাত্র তিনজন বাকি…

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *