ভূপেন কেবিন

প্রিয়াঙ্কা পোদ্দার

ভূপেন কেবিনে মাংসের দর আজও কিভাবে যেন একই আছে। ট্যালট্যালে নুন হলুদ তেলের ঠিকঠিক পারমুটেশন কম্বিনেশনে ঝোল বানানোটা আদ্যন্ত একটা মেধা। একটা নিস্পৃহ ট্যালেন্ট ছাড়া বছরের পর বছর ধরে পোড় খাওয়া হাত ঠিক একই অনুপাতে এভাবে ম্যাজিক করে যেতে পারে না নয়তো,তাও আবার একটা নিতান্ত সস্তার হাততালিও অসহ্য যার কাছে। বাসফেরতা আমআদমির পকেটের খুচরো দিয়ে সুড়ুৎ করে চুমুক দেওয়ার সুখ কেনা যায়, বদলে নিদেনপক্ষে একটা তারিফ তো গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিৎ ছিল সুখের কারিগরের কাছে। লোকটা জীবনেও তেলঝোল মাখা কালো কড়াইয়ের মোহ থেকে মুখ তুলতে পারেনি নির্ঘাত, নয়তো এমন ঔদাসীন্য তো আর পথেঘাটে পড়ে থাকা অনাথ আধুলি নয়, যে সহজেই পকেটস্থ করা যাবে। এক একটা মানুষের এমন নির্লিপ্ত ঔদ্ধত্য, সত্যিই বারবার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে যায় টুকরো হওয়া মানুষকে।

রোজ দিন স্টেশনের হল্লার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকার পর মানুষ কর গুনতে ভুলে যায়,সময় গিলে নেয় তাদের একটু একটু করে প্রতিটাদিন, হয়তো সেই সময় চুরি হয়ে যাওয়া লোকটাও ঘড়ির কাঁটার সব হিসেবটিসেব ভুলে পৌঁছে যায় এই কেবিনের সবচেয়ে কোণার টেবিলটায়,তারপর এবড়োখেবড়ো দেওয়ালে হলদে কালোয় লেখা মেনু পড়ে পাক্কা তিন মিনিট ধরে, শেষ অবধি সব ছেড়ে ঐ পাতলা ট্যালট্যালে সুখাদ্য অর্ডার করে চুপ করে বসে ভাবতে থাকে, পরের ট্রেনের টিকিট কাটতে কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে আবার, আবার কত সময় চুরি যাবে ব্যস্ততম জীবনের পাতা থেকে। কিন্তু পোড় খাওয়া হাতওয়ালা লোকটা মাংসের চর্বি গলতে দেখে দেখে রোজ, ঠিক জেনে ফেলেছে পাকস্থলী বেয়ে খিদে চাগাড় দিলে মানুষও ঠিক এমনভাবেই গলতে শুরু করে। সব কাঠিন্য, বাস্তবতা, গূঢ় হিসেবনিকেশ, নিষ্ঠুরতা, রাগ, অভিযোগ, অভিমান সবটুকুই বোধহয় গলে মিশে যায় ঐ ঝোলের বাটির সুবাসে। অদ্ভুতভাবে তাই ই হয়, একটু আগেও বেজায় হুটোপাটি করা লোকটা কেমন পাতের দু’গাল ভাত মুখে দিতে দিতেই মিইয়ে যায় স্মৃতিতে, বোধহয় ছেলেবেলার মায়ের কোলে বসে মুখে তোলা গ্রাসের কথা মনে পড়ে যায়, ঘোড় দৌড়ের জীবনের সমস্ত তাড়াহুড়ো নিভে গিয়ে একটা নিপাট অনন্ত সময় হাতে থাকা মানুষ পড়ে থাকে টেবিলে চেয়ারে মাখামাখি করে।

লোকটা নিজের রান্নার প্রশংসা শুনতে পারে না মোটে, আহ্লাদে আমোদে কেউ কিছু দু চারটে মিঠে কথা যদি বা ন মাসে ছ মাসে বলতে আসে তো সে এমন রে রে করে ওঠে, কিংবা তার বাংলার পাঁচের মতো মুখ দেখে কেউ আর হয়তো সাহসই করে না ঘাঁটাতে। এ কেবিনের মালিক সে, তাকে তো অমন গলে যাওয়া মানায়ও না কিনা। তাই হয়তো অমন কঠিন মুখ করে কাজ করে চলে নিজের মনে। মালিক হলেও রাঁধার শখ কিছু কম নয় তার, বিশেষত ভূপেন কেবিন খ্যাত ঐ ট্যালট্যালে মাংসের ঝোলের ব্যাপারে তো খুবই শৌখিন, ঐ পদটি তো মোটেই কারোর হাতে তিনি একদিনের জন্যও ছাড়েননি। সহকারী ছেলেপিলে সবাই তার চেয়ে বয়সে ছোটো, নেপোকাকা বলেই ডাক খোঁজ করে তারা, উঁকিঝুঁকি মারে কাকার রেসিপির খোঁজে, কিন্তু ধমকে চমকে তিনি একসা করেন তার রান্নার সময় হেঁসেলের ধারেকাছে কেউ ঘেঁষলে পর্যন্ত। কেউ ভুলেও তখন ওপথ মাড়ায় না তাই।

তাদের নেপোকাকা বাকী সময়টা ক্যাশবাক্সে বসে হিসেব কষে আর মানুষ পড়ে। আর কিভাবে যেন প্রতিবারই ঠিক ঠিক মানুষ পড়ে ফেলে লোকটা, কিংবা কোনোবার হবেও বা ভুল, তাতে কি। সেসব জল্পনা কল্পনা তো তার একান্তই নিজস্ব,তাতে তো ভুলঠিকের বেড়াজাল নেই কোনো। কোনো টেবিলে এক প্লেট মাংসের ঝোল অর্ডার হলেই নেপোকাকার চোখ চিকচিক করে ওঠে, যদিও কেউ জানতে পারে না। অর্ডারকারীকে দেখে নেপোকাকা কতবার মনে মনে হিসেব কষেছে, সে হিসেব মিলে যেতেও দেখেছে কখনো কখনো চোখের সামনে। হয়তো একটা ট্যাক্সি ড্রাইভার সারাদিনের ক্লান্তিতে নিঃশেষ হয়ে এসে হাজির কেবিনে, একপেট খিদে নিয়ে মাথায় তখন তার গনগনে আঁচ। হাতে ধরা তার সাথে বেমানান একটা দামী কালো ব্রিফকেস, বোধহয় ট্যাক্সিতে কোনো প্যাসেঞ্জার ফেলে গেছে হবে। নিঃসন্দেহে দরকারী জিনিস, টাকাপয়সা থাকবে, হয়তো মালিক অবধি পৌঁছোনোর হদিশও তাতেই মিলবে। অর্ডার আসতে আসতে কাকা পড়ে ফেলে তার মুখ, সে মুখে অজস্র রাগ, খিদে, জ্বালা, হিংস্রতা খেলা করে বেড়াচ্ছে, নাহ এ লোক ফেরবার চেষ্টা করবে না মোটে ঐ ব্রিফকেস খানা, কষে জাপটে ওটাকে কেমন হিংসুটের মতো আগলে রেখেছে, মনে মনে মুচকি হেসে নিলো নেপোকাকা, কারণ পরেরটুকু তার জানা, সবটাই হয়তো বদলে যাবে একদম ভোল পাল্টে। কিন্তু ঠিক এ লোকটাই ঠিক ১৭ মিনিটের মাথায় ঝোলভাতের শেষ গ্রাসটুকু চেটেপুটে খাবার পর অন্য মানুষ, মুখের হিংস্র রেখাগুলো কেমন মিলিয়ে গিয়ে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি, মন বদলেছে নিশ্চিত, ভরপেট লোকটাকে অভাব আর কাবু করতে পারবে না নিশ্চিত। টাকা মেটাতে এসে সেই লোকটাই তো কেমন দিব্য ব্রিফকেস খুলে মালিকের কার্ড বের করে জিজ্ঞেস করে ফেলল ঠিকানাটা কোনদিকে হবে।

এমনও হয়তো কতদিন হয়েছে বাড়ি থেকে রাগ ঝাল করে ঝগড়া অশান্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে সব দায় দায়িত্ব ছেড়ে পালিয়ে আসা লোকও এ ঝোল চেটেপুটে খেয়ে শান্ত মাথায় ফের বাড়ির পথটাই ধরেছে। কিংবা দীর্ঘদিন মান অভিমান করে থাকা বাপ মেয়েতে একসাথে কব্জি অবধি গড়িয়ে পড়া ঝোল চেটে হেসে কুটোপাটি হয়েছে। বাড়িতে আঁশের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলা দজ্জাল শাশুড়িকে ভয় করে নতুন বউটা হয়তো মাংস না খেতে পেরে বহুদিন আকুলি বিকুলি করেছে ভেতর ভেতর, হয়তো তার বরটা তাকে ঠিক সবার অলক্ষ্যে ফাঁকতালে লুকিয়ে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে এই কেবিনের টেবিল পর্যন্ত। এসব গল্প মাংসের প্লেট সামনে পাওয়া নতুন বউয়ের চোখ দেখলেই দিব্যি বলে দেওয়া যায়। আবার হয়তো অসম্ভব হতাশায় আক্রান্ত একটা আপাদমস্তক নিঃস্ব, মরবে বলে নিরুদ্দেশে বেরোনো মানুষ, তার শেষ সম্বল ঐ ৫০টা টাকা দিয়ে ঝোলভাতের স্বাদ নিয়ে শেষবারের মতো কেঁদে ফের রুখে দাঁড়িয়েছে জীবন যুদ্ধের প্রতিকূলতার সামনে ঢাল হয়ে, সমস্ত লড়াই হয়তো এ স্বাদের কাছে তার তুচ্ছ মনে হয়েছে।

ছেলেপিলেরা বুঝবে কি প্রশংসার দু চারটে আপাত মনোহর বাক্যে ভেজার থেকে অনেক অনেক অনেক বেশী উর্ধ্বে এই স্বাদ। জীবনীশক্তি ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা আছে এর, এ স্বাদের দাম তাই কক্ষনো লাভক্ষতির হিসেব করে রাখেননি নৃপেণ বাবু। আসলে মাঝরাতে যখন ঘুম ভেঙ্গে যায়, রোজ রান্নার শুরুতে আলাদা করে তুলে সরিয়ে রাখা একটা থালায় একমুঠো সাদা ভাত আর এক বাটি ধোঁয়া ওঠা ঝোল উঁকি মেরে দেখতে যান, তখন ভেতরসুদ্ধ একটা তীব্র হাহাকার আজও ছুটে বেড়ায়।

ভূপেন কেবিনের নাম নৃপেণ বাবুর বাবার নামে। লোকটা তেলে ঝোলে খেতে বড় ভালোবাসতো, মাংস ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। গরীব ঘরে কদিনই বা জুটত সেসব। মা মারা যাবার পর থেকে বাপই ছেলেকে রেঁধে খাইয়েছে। শেষটায় রোগের কথা অবিকল চেপে গেছিল লোকটা, পাছে গুচ্চের টাকা খরচ হয়, ছেলের জন্য সামান্য যেটুকু জমাপুঁজি রোগের রক্তচক্ষু শুষে নেয়, কাউকে টের পেতে দেননি, গ্যাসট্রিক আলসারে পেট পচে গেছিল পুরো। তবু রসিয়ে কষিয়ে রান্না ছাড়া রোচেনি মুখে। শেষ কটাদিনে ছেলে যখন জানতে পারে তখন অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। শেষবারের মতো মাংসের ঝোল খেতে চেয়েছিল লোকটা। সব বারণ ছিল মশলাপাতি, অথচ বিস্বাদ খাবার তার মুখে রোচেৎনা মোটে। ছেলে অনেক কসরত করে যত্ন করে ভেবেচিন্তে হাল্কা করে একটা মাংসের ঝোল রাঁধে বড় আশা করে। নাহ বুড়োর বড্ড তাড়া ছিল,সে ঝোল চাখা হয়নি তাঁর আর কোনোদিন।

সেই তো সেই থেকেই রোজ রাতে সেই ঝোলখানা রেঁধে রেখে দেয় বাপের জন্য ছেলে,আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বিড়বিড় করে বলে, “তোমার রেখে যাওয়া টাকায় হোটেল হলো,আজ তোমার খেতে চাওয়া আমার হাতের সেই রান্না এতো লোক খাচ্ছে বাবা, এতো সুখ্যাতি তার, এতো মহিমা তার, শুধু তুমি খেতে পেলে না বাবা, শুধু তুমি খেতে পেলে না, কি অপরাগ সন্তান আমি! “

আসলেই জীবন কি অদ্ভুত তাই না, এক একটা মানুষের নির্লিপ্ততা, ঔদাসীন্য, কিংবা ঔদ্ধত্যের নেপথ্যে হয়তো এমনই কত গল্প থেকে যায়, এমনই কত অসহায়ত্ব, এমনই কত যন্ত্রণা ঠিকরে বেরোয়, যা সাদা চোখে ধরা পড়ে না। আসলেই তো তাই না, সবটাই কি আর সাদাকালোর পোচে দাগিয়ে দেওয়া যায়, আমরা প্রত্যেকেই তো আসলে এক একটা এমন টুকরো টুকরো ভূপেন কেবিনের নিত্যদিনের অংশ।

জীবন ইকুয়ালটু এমনই একটা ভূপেন কেবিন কিংবা ভূপেন কেবিন ইকুয়ালটু হয়তো একটা আস্ত জীবন বললে কি খুব ভুল বলা হবে? খুব অত্যুক্তি হবে? (সব চরিত্র কাল্পনিক)

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *