অভিজ্ঞানপত্র

দেবতোষ দাশ

‘বড়পিসির নাম নেই?’

‘না।’

‘ওরা তো ওখানকার পুরোনো বাসিন্দা, ওদের নাম উঠল না কেন?’

‘বাকি সকলের নাম আছে।’

‘মানে?’

‘কেবল দিদিরই নাই।’

‘পিসি কী বলছে?’

‘কী আর বলবে, হাসছে।’

বড়পিসি নিজেকে তালিকাহীন ভাবতেই পারছে না সম্ভবত। তাই হাসছে। অবিশ্বাসের হাসি। চুপ করে গেল অম্লানজ্যোতি। সুনীলও। অম্লানের মনে হল ছোট্ট একটা টেনশন চারিয়ে গেছে বাবার মাথায়। বড়পিসির ফোন ধরেছিলেন টিভি মিউট করে। হাতে রিমোট কন্ট্রোলারটা নিয়ে বসে রইলেন, আওয়াজ ফেরালেন না টিভির। কেবলই দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে টিভিতে, বিনা শব্দে।

সুনীল তাকিয়ে আছেন পর্দার দিকে। কিন্তু দেখছেন না। আরও কিছু হয়ত বলবেন। কোনও প্রশ্ন না-করে, নীরবতা প্রশ্রয় দিয়ে অম্লানও বসে রইল বিছানায়। একেবারে শব্দহীন তো বলা যাবে না। রান্নার বৌয়ের খুন্তি নাড়ার আওয়াজ আর ছ্যাঁকছোঁক শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মণিমালার গলা। অম্লানের মা। কী বলছে বোঝা না-গেলেও কন্ঠস্বর ভেসে আসছে। 

‘এটাতো ড্রাফট। ফাইনাল লিস্টে ঠিক উঠে যাবে।’

সুনীল প্রত্যুত্তর দিলেন না ছেলের কথায়। অম্লানজ্যোতির অস্বস্তি প্রশমিত করতেই যেন মণিমালা ঘরে ঢুকলেন।

‘আমায় ফোনটা দিলে না যে! দিদির শরীর ভালো? পুটু ওরা আছে কেমন?’

মণিমালার কথার জবাব না-দিয়ে অম্লানের দিকে ফিরলেন সুনীল।

‘আমাদের এখানেও এই লিস্ট তৈয়ার হতে পারে কখনও?’

‘না, না, এখানে কেন হবে! আসাম আর ওয়েস্ট বেঙ্গল এক নাকি! আর হলেই বা কী! আমাদের তো সব আছে। দলিল আছে। পরচা আছে। রেশন কার্ড। ভোটার কার্ড। আধার। স-ব!’

‘দিদিরও তো সব আছে!’

‘ওটা মিসটেক বোঝাই যাচ্ছে!’ 

সুনীলের চোখ আবার শব্দহীন দৃশ্যময় টিভির দিকে। কিন্তু কথা বলে চলেছেন। নিজের সঙ্গেই কথোপকথন। বাবার বিড়বিড়ানিতে কান পাতে অম্লানজ্যোতি।

‘এখন না-হয় গৌহাটি থাকে, আদতে তো ওরা বকসা জেলার শালবাড়ির লোক। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে। এর আগে যখন এনআরসি হয়েছিল একান্ন সনে, সেখানে ওর শ্বশুরের নাম ছিল। ছেষট্টি সনের ভোটার তালিকায় জামাইবাবুর নাম ছিল। দিদিরও ছিল। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে জমির খাজনা দেয় ওরা, তার রসিদ আছে। হতে পারে দিদি ওই বাড়ির বউ, কিন্তু বহু পুরানো বাসিন্দা। নাম উঠবে না কেন?’

‘আরে ভুল হয়েছে বলছি না, এই নিয়ে টেনশন করার কিছু নেই!’

কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলে অম্লান।

সুনীল সটান তাকান পুত্রের চোখের দিকে।

‘এটা অপমান! কলমের এক খোঁচায় আমাকে নো ম্যানস ল্যাণ্ডে ফেলে দেওয়া একটা অপমান! ক্ল্যারিকাল মিসটেক বলে একে লঘু করিও না!’

একটা ধাক্কা বুকে এসে লাগে অম্লানের। নিশ্চুপ বসে থাকে। মণিমালা একবার ছেলে আর আর একবার স্বামীর দিকে তাকিয়ে রান্নাঘরে ফেরত যান।

‘দীর্ঘ নাগরিকত্বের সকল প্রমাণ আছে আমার কাছে। এতদসত্ত্বেও তুমি আমার নাম বাদ দিলে! কেন?’

চুপ থাকতে পারেন না সুনীল। খসড়া তালিকায় আইনী নাগরিক হিসেবে দিদির নাম না-থাকাটা তাঁকে পীড়া দেয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে এপারে আসার পর, নাগরিকত্ব নিয়ে আর ভাবনার অবকাশ ছিল না। দেশত্যাগ করেছেন স্বেচ্ছায়। ঢাকার অফিস থেকে মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট নিয়ে আইনী পদ্ধতিতেই হিন্দুস্তানে এসেছিলেন তিনি। সে তো আজকের কথা নয়, সেই ১৯৫৫ সালের জুলাইয়ের কথা। শেষ-আষাঢ়। আজ এত দিন পর, এ কী আপদ এল দুশ্চিন্তা হয়ে।

মণিমালা রান্নার বৌকে বিদেয় দিয়ে আবার ঘরে ঢোকেন। সুনীলের দিকে তাকান। সামান্য অবাক সে দৃষ্টি। রিমোট কন্ট্রোলারটা তুলে টিভি সরব করে বসে পড়েন মণি। সুনীল টিভির পর্দা জুড়ে দেখতে পান পেট্রোম্যাক্সের আলোয় উজ্জ্বল দিদির কনে-মুখ। লাল বেনারসি, চন্দন-শোভিত সালঙ্কারা দিদির দিকে তাকিয়েই থাকেন সুনীল।

দিদির বিয়ে হল তাঁর চলে আসার আগের বছর। চুয়ান্নয়। বিয়ের পরদিন চলে গেল দিদি। হারিয়ে গেল দিদি। নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া তো একপ্রকার হারিয়েই যাওয়া। মেয়েরা তো হারিয়েই যায়। মেয়েদের কি নিজের কোনও দেশ আছে?

দেশ কি সুনীলেরও আছে? দিদির মতো তিনি-ও তো হারিয়ে গেছেন সে-ই কবেই! নিজের দেশ ছেড়ে, জন্মভিটা ছেড়ে হারিয়ে গেছেন। কোনওদিন কি আর নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন? নিজেই নিজের কাছে ফেরারি।

উঠে পড়েন সুনীল। খাওয়ার টেবিলে রাখা জলের বোতল থেকে জল ঢালেন কাঁচের গ্লাসে। চুমুক দেন। বুক ঠেলে কাশি আসে। দু’বার কেশে আবার চুমুক দেন গ্লাসে।

দিদির বিয়ের দিনই প্রথম সিগারেট খাওয়া। কিংস্টক সিগারেট। প্যাকেটের ওপর বকের ছবি। বরযাত্রীদের জন্য আনা হয়েছিল। সিগারেট দিয়ে তাঁদের আপ্যায়ন করার দায়িত্ব সুনীলের। বরযাত্রীদের বিলিয়েও একটি প্যাকেট উদ্বৃত্ত হয়।

জল খেয়ে হাতের চেটো দিয়ে ঠোঁট মোছেন। কিংস্টকের প্যাকেটের বুকে বকের ছবির উপর হাত বোলান। ভিতর থেকে বার করেন একটা সিগারেট। ম্যাচ বাক্স থেকে মাচিস বার করে ফস করে জ্বালিয়ে ঠোঁটে-চেপে-ধরা সিগারেট ধরান। একটু টেনেই খকখক করে কাশেন, কিন্তু কাশতে কাশতেই আরও দুইবার টানেন।

সিরজু দেখে ফেলেছিল। ভালো নাম ছিল বোধহয় সিরাজ। মনেও পড়ে না। বেদম কাশি দেখে কী হাসি সিরজুর। বাবার প্রজা কাদেরের পোলা। সুনীলের খেলার সঙ্গী।

আশপাশের গ্রাম থেকে মুসলমান প্রজারা এসেছে দল বেঁধে। তাদের জন্য খাওয়ার কোনও ব্যবস্থা নাই। কেবল পান-সুপারি দেওয়া হল তাদের হাতে। কত্তার মেয়ের বিবাহ অনুষ্ঠানে কিছুক্ষণ থেকে তারা আবার চলে যায়। সুনীল চিৎকার করেন, সিগ্রেট খাবি সিরজু?

মুসলমানরা নিমন্ত্রণ পেলেও নমশুদ্ররা তাও পায়নি। গগন চাঁড়াল ও তার দল সকালে পুকুর থেকে মাছ ধরে দিয়ে গেলেও বাবুর বিয়েতে তাদের নিমন্ত্রণ নাই। সুনীল কাশতে কাশতে হাসিমুখ সিরজুর চলে যাওয়া দেখেন। ও কি বর্ডার পেরিয়ে চলে যাচ্ছে কোনও নো ম্যানস ল্যাণ্ডে। আবার চিৎকার করেন সুনীল, একখান টান দি যা সিরজু?

‘বিয়ের পরপরই বড়পিসিরা আসাম চলে গেল?’

পেছনে কখন ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেননি।

‘না, কিছুদিন ফেনীতেই ছিল। জামাইবাবু কুমিল্লা কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে চলে গেল বিলোনিয়া। ত্রিপুরা। আমাদের ফেনীর পাশেই বিলোনিয়া। পরশুরাম হয়ে ট্রেন যেত।’

‘তারপর গৌহাটি?’

‘বিলোনিয়ায় ছিল বোধহয় বছর দুয়েক। তারপর বাড়ি ফিরে যায়।’

‘শালবাড়ি।’

‘জামাইবাবু পেয়ে গেল সরকারি চাকরি। প্রায় সকলেই গৌহাটিতে চলে এসেছে তখন। শালবাড়িতেও যাতায়াত ছিল। দিদিও গেছে বহুবার।’

কথা বলতে বলতেই আবার নিজের ঘরে ঢোকেন সুনীল। টিভির মাথা থেকে চশমাটা নেন। আলমারি খোলেন। লকার থেকে বার করেন পলিথিনের একটা প্যাকেট। বিছানায় রাখেন সেই মোড়ক। ঘরের দ্বিতীয় টিউবটি জ্বালান। তারপর এক এক করে কাগজপত্র বার করে উল্টেপাল্টে দেখতে শুরু করেন।

বাবা-মায়ের ঘরে আর ঢোকে না অম্লানজ্যোতি। খবরের কাগজদুটো হাতে নিয়ে নীচে নামে। মেয়ের টিউটর এসেছেন। সঞ্চারি স্কুলের খাতাপত্র নিয়ে ব্যস্ত। অম্লান বৈঠকখানায় এসে সোফায় বসে। পাতা ওল্টায় খবরের কাগজের। 

দুই

চারের পাতার উত্তর-সম্পাদকীয় রচনার মাঝামাঝি এসেছে, মণিমালা এসে হাজির।

‘কী ব্যাপাররে বাবু, তোর বাবা পাগলের মতো কী খোঁজে? আলমারি তোলপাড়।’

মায়ের দিকে অবাক তাকায় অম্লান।

‘যতই জিগাই, কিছুই কয় না! চোখেমুখে একটা টেনশন!’ মণিমালা বসেন সোফায়। ‘দিদির কাগজ-পত্র এখানে থাকব ক্যামনে? দিদি তো ওয়েস্ট ব্যাঙ্গলে আসেই নাই কখনও।’

কাগজ রেখে ওঠে অম্লান। মণিমালা ছেলেকে নিয়ে স্বামীর কাছে যান।

‘কী খুঁজছো বাবা? কোন কাগজ?’

নিরুত্তর সুনীল খাটের তলা থেকে সুটকেস বার করতে চেষ্টা করেন। বাবাকে সরিয়ে অম্লান সুটকেস বার করে আনে। এইখানেও সুনীল রাখেন প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র। মেঝেতে বসে সুটকেস খোলেন। খাপ থেকে চওড়া কাগজের খামটি বার করলেন। একে একে বার করেন টুকরো টুকরো কাগজ। কিন্তু না, অন্যান্য কাগজের মাঝে ঈপ্সিত নথিটি পেলেন না সুনীল। সুটকেসটি বন্ধ করলেন সশব্দ।

‘কী খুঁজ কইবা ত?’ মণিমালার স্বরে উৎকণ্ঠা।

‘সবথেকে পুরান ডকুমেন্ট।’ অবসন্ন সুনীল মণির দিকে তাকিয়ে বলেন।

‘মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট?’ অম্লানজ্যোতি যেন ধরতে পেরেছে কোন অন্বিষ্ট নথির জন্য বাবার এই চঞ্চলতা।     

‘ওটা আমার কাছে থাকার কথা নয়!’

‘তা’লে?’ মণিমালা অশীতিপর স্বামীর পাশে বসেন।

‘সার্টিফিকেট জমা নিয়েছে বানপুর ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট। জমা নিয়ে একটা টোকেন দিয়েছিল। ওটাই ওয়েস্ট ব্যাঙ্গলে থাকার আসল কাগজ। আমি ত হিন্দুস্তানে বেআইনীভাবে আসি নাই। সরকারি কাগজপত্র লই আইসি!’

‘ঠিক আছে, এখন খেতে চলো। পরে দেখুম আমি। বাবুরে লই খুঁজুম। যাইব কোথায়? চলো, এখন চলো!’

স্বামীকে হাত ধরে মেঝে থেকে তোলেন মণিমালা। ধরে ধরে বাথরুমের কাছে নিয়ে যান। হাতে ধরিয়ে দেন গামছা। ফতুয়া খুলে কেবল লুঙ্গি পরে বাথরুমে ঢোকেন সুনীল।

নাতনির মাস্টার চলে গেছেন। সে-ও এসে বসেছে খাওয়ার টেবিলে। দশটা নাগাদ রাতের খাবার নাতনির সঙ্গে খান সুনীল। সঙ্গে অন্য কেউ থাকতেও পারে, কিন্তু নাতনির থাকা আবশ্যিক। চেয়ারে দাদু এসে বসতেই এগারো ক্লাসে-পড়া নাতনি বলে, হোয়াটস রং উইদ ইউ দাদাই? কী হয়েছে?

‘না, তেমন কিছু না, একটা কাগজ মিসিং।’ নাতনির দিকে তাকিয়ে হাসেন সুনীল।

‘আরে, ইলিশ নাকি! আচ্ছা দাদাই, এখন ট্যাংরা মাছ পাওয়া যায় না?’

অম্লানও এসে খেতে বসে। কাজ সেরে এসে সঞ্চারী খাবার গরম করতে শুরু করেছে। মণিমালা কাঁসার থালায় ভাত বেড়ে দেন সুনীলকে। শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি। বৃষ্টির তেমন দেখাসাক্ষাৎ নেই, বাজারে ইলিশও কম। ফলে বেজায় দাম। ভাত ভেঙে কালো-জিরে-কাঁচালঙ্কার ঝোল ঢালেন।

‘গাঁটি কচুর তরকারিটা খাইব্যা না?’

‘কত করে নিল রে?’ মণিমালার কথার জবাব না-দিয়ে ছেলের দিকে তাকান সুনীল।

‘তুমি খাও। দাম জানি কী কইরব্যা!’ মণিমালা জবাব দেন।

ইলিশের টুকরোটা কিছুটা খুঁটে রেখে, বেশিটা নাতনির পাতে দিলেন সুনীল। ইদানিং রাতে মাছ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন।

‘বড়পিসিঠাম্মাকে তুমি দেখেছ?’ প্রশ্ন নাতনিকে।

‘ওরা গৌহাটি গেল তো একবার, পাঁচ-ছয় বছর আগে! বাবাই তখন ছোট।’ আবার মণিমালা।

‘হ্যাঁ, শিলং গেলাম ওখান থেকে। বড়পিসিঠাম্মার বাড়িতে ছিলাম তো দু’দিন। মনে আছে আমার। টিভিতে ক্রিকেট দেখে আর খুব পান খায়।’

নাতনির কথায় হাসেন মণিমালা। সুনীলও।

‘দিদি খুব ডানপিটে ছিল। আমাদের দেশে বৃষ্টির খুব জোর। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য বৃষ্টি। আর তেমন ঠাডা!’

‘ঠাডা মানে?’ মুখে ভাত নিয়েই নাতনির প্রশ্ন।

‘মেঘগর্জন। বজ্রপাতের প্রচণ্ড শব্দ। থান্ডার। আমি খুব ভয় পেতাম। শ্রাবণ মাসে যখন দিনভ’র বৃষ্টি, হয়তো ইশকুলে যেতে পারিনি, দিদি নেমে যেত পুকুরে!’

‘ওই ঠাডার মধ্যে!’ নাতনি অবাক।

‘পুবদিকের ঢালে কইমাছের ঝাঁক কান বেয়ে উঠত। পুবপাড়ে গিয়ে দিদি কইগুলিরে ধরত আর সাঁইসাঁই করে পাড়ে ছুঁড়ে ফেলত।’

‘আমিও বহুবার শুইন্‌ছি ওই গল্প। দিদির হাত কইয়ের কাঁটায় রক্তারক্তি।’ ইলিশের ঝোল দিয়ে নাতনির ভাত মাখতে মাখতে বলেন মণিমালা।

‘এমা, পিসিঠাম্মার ব্যথা করত না!’

‘কচুপাতার রস লাগিয়ে নিত। পাত্তাই দিত না।’

‘আর তোমার দাদাই তখন ঠাডার ভয়ে চকির তলায়!’

মণিমালা নাতনির দিকে তাকিয়ে চোখ টেপেন। নাতনি হাসে।

‘কাল রমজান আইবনি?’

মণিমালা বোঝেন সুনীলের প্রশ্ন তারই উদ্দেশে।

‘আওনের ত কথা। কেন?’

‘ট্যাংরা কি কাইল আইন্‌বো হেতে?’

‘গত রোববারই তো ট্যাংরা দিয়ে গেল রমজান! খেল তো!’ সঞ্চারী বিরক্তি নিয়ে মেয়ের দিকে তাকায়।

‘বড়পিসিঠাম্মা ট্যাংরা মাছ ধরতে পারত?’

‘দিদি বলে, রেজিস্টারে আমার নাম নাই মানে আমি আর হিন্দুস্তানের না, সুনু চল চলি যাই ফেনী। আমগো ফেনী। মধুপুর! নিব না আমগোরে? নিব না?’   

ভেতরবাড়ি কেঁপে ওঠে অম্লানের। দৃষ্টি যায় বাবার দিকে। নির্বিকার সুনীল খাওয়া প্রায় শেষ করে ফেলেছেন। 

তিন

ঘুম ভেঙে যায় মণিমালার। একি, ঘরের লাইট জ্বলে কেন? সুনীল আবার খুলে বসেছেন পুরনো কাগজের বান্ডিল। একটা-একটা করে দেখছেন আর হতাশায় মাথা নাড়াচ্ছেন।

মশারি সরিয়ে নেমে আসেন মণিমালা।

‘কইলাম না বাবুরে লই খুঁজুম! তোমার তর সয় না!’

‘ওইটাই আসল কাগজ মণি, এখানে তালিকা তৈয়ার হইলে ওই কাগজই আমগো বাঁচাইবো!’

‘আরে যাইব কোথায়? কাগজ তো তোমার কম না! ব্যাকই ঢুকাই রাখো! অহন চলো, কাইল অপ্সরে খুঁজুম!’

ছেলেকে ডাকতে গিয়েও ডাকেন না মণি। সুনীল বাথরুমে ঢোকেন। ঘড়িতে দুটো চল্লিশ।

থম মেরে বিছানায় বসে থাকেন মণিমালা।

চার

‘মালিক যেখানে পাঠাবে সেখানেই চলে যাব মা, সব জাগাই তো মালিকের। নাম কেটে দিলে দেবে!’

‘ভোটের কার্ড, আধার, পরচা, খাজনা দাখিলা সব আছে তোমার?’

‘জ্বী মা।’

কেজি দেড়েকের রুইমাছটা কাটতে কাটতে হাসিমুখে মাথা নাড়ে রমজান।

‘মাথায় মাছ রাখব?’

‘সামান্য।’

‘পেটি করি মা?’

‘কর। তোমার দাদার তো খুব ভয়!’

চুপচাপ বসে মাছ-কাটা দেখেন সুনীল। মণিমালার কথার প্রত্যুত্তর দেয় না রমজান। একমনে ফালি ফালি করে রুই।

‘কাইল কিন্তু ট্যাংরা আনিও রমজান। আমার নাতনি ভালো খায়।’

‘আনব মা।’

মাছভর্তি গামলা সাইকেলের পেছনে বসিয়ে চলে যায় রমজান। মণিমালা রান্নার বৌয়ের সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

‘রমজানের ভয় পাওয়ার কথা, ও ভয় পাচ্ছে না, তুমি পাচ্ছ কেন বাবা? তুমি মুসলমান?’

পুত্রবধু সঞ্চারীর প্রশ্নে সুনীল হাসেন। অস্ফুটে বলেন, ‘আমি রিফিউজি।’

‘পুরো প্রসেসটা এইদেশে মুসলমানকে সেকেণ্ড ক্লাস সিটিজেন বানাবার একটা মাস্টার প্ল্যান! হিন্দুদের ভয় কী?’

‘বৌমা, আমি না-হিন্দু, না-মুসলমান! কোনও এক ধর্মের আশ্রয় লওনের স্বাধীনতাও রিফিউজির নাই! তার একটাই পরিচয়, সে রিফিউজি! চিরজীবন তারে একখান কাগজ পকেটে নিয়ে ঘুরতে হবে। প্রমাণ। না-থাকলে সে অবৈধ। রমজানের ধর্ম আছে। আমার আছে কাগজ। ওইটা মিসিং, তাই ভয়।’

বাঁ পকেটে মানিব্যাগ আর ডানদিকে স্মার্টফোন ঢোকায় অম্লান। সঞ্চারী আর বাবার কথোপকথন কানে আসে। চুমুক দেয় জলের গ্লাসে। দু’ঢোক জল খায়। ভাবে কিছু বলবে, কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না। রুমালে ঠোঁট মুছে আবার পকেটে রাখে। দোতলায় যায়। প্রণাম করে মা-কে। 

ছেলে-বৌ কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পর নাতনির স্কুল যাওয়ার পালা। নাতনি স্কুলের কারপুলে ওঠা না-ইস্তক ফুরসত মেলে না মণিমালার। কিন্তু আজ যেন দ্রুত পৌঁছোতে চান অবসরে। 

খেতে খেতে নাতনি বলে, ‘ঠাম্মা, আমরা কি রিফিউজি?’

মণিমালা মাছের কাঁটা বেছে দিতে দিতে বলেন, ‘কে বলে এইসব কথা?’

‘এই যে বড়পিসিঠাম্মা ক্রিকেট দেখতে ভালোবাসে, বিরাটের ফ্যান, এখন থেকে আর ইণ্ডিয়াকে সাপোর্ট করতে পারবে না?’

‘কেন পারবে না, নিজের দ্যাশরে সাপোর্ট করতে আবার কাগজপত্র লাগে নাকি!’    

‘রিফিউজিদের কোনও দেশ নেই ঠাম্মা।’

অন্নগ্রহণরত নাতনির মুখের দিকে চেয়ে থাকেন মণিমালা।

পাঁচ

ঠাম্মা-দাদুকে টা-টা করে নাতনি বেরিয়ে যেতেই মণিমালা ঈপ্সিত কাগজের খোঁজে স্বামীর সঙ্গে বসেন। সুনীলের উৎকণ্ঠা কিঞ্চিৎ তাঁকেও ঘিরে ফেলেছে। চশমাটা নাকের ডগায় রেখে একটা-একটা কাগজ খুঁটিয়ে দেখেন।  কাগজটির প্রয়োজনীয়তা ছেলের কথাতেও পরিষ্কার। অফিসে বেরোবার আগে সে একান্তে মা-কে বলেছে, ‘বাবার সঙ্গে একটু হাত লাগিও। সন্ধেয় বাড়ি ফিরে আমিও দেখব।’

খুব বেশি খুঁজতে হয় না মণিমালাকে। আলমারির কাগজের বাণ্ডিলের মধ্যে রাম ঠাকুরের একটা চটি জীবনী বই ছিল। তার মধ্যেই মেলে সেই টোকেন, সুনীলের পশ্চিমবঙ্গে থাকার ছাড়পত্র।

‘কইলা যে মাইগ্রেশন লই স্বেচ্ছায় আইস এই দ্যাশে? অহন রিফিউজি কও কা নিজেরে?’

হাসেন সুনীল। মণিমালা খুঁটিয়ে দেখেন সেই কাগজ। কখনও দেখেননি যে কাগজ, সেই কাগজ হঠাৎ এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কী করে! কাগজের লেখা জোরে পড়েন। টোকেন ফর ইমিগ্র্যান্টস। ডিপার্টমেন্ট অফ রিফিউজি রিলিফ অ্যাণ্ড রিহ্যাবিলিটেশন। পূর্ব পাকিস্তানের শেষ ঠিকানাঃ গ্রাম ও পোস্ট মধুপুর। সাবডিভিশন ফেনী। জিলা নোয়াখালি। ইণ্ডিয়ার কোথায় পাকাপাকি বাস করতে চানঃ যাদবপুর কলোনি। নীচে অফিসারের সই। চেকপোস্টের ছাপ। বানপুর পাসপোর্ট চেকিং পোস্ট। নদিয়া।

আবার সব কাগজ গুছিয়ে ফেলেন সুনীল। রামঠাকুরের বইয়ের মধ্যেই ঢুকিয়ে রাখেন টোকেন ফর ইমিগ্র্যান্টস যার মাথায় লেখা, অরিজিনাল।           

‘দর্শনাতে এইটা দেখালেই তুই হিন্দুস্তানের লোক!’ বাবার কথা শুনে বুক কেঁপে উঠে। হিন্দুস্তানের লোক মানে? সে তো কখনও হিন্দুস্তানের লোক হওয়ার কথা ভাবে নাই। দেশভাগ ও স্বাধীনতার পর সে তো পাকিস্তানেরই। পাকিস্তানই তার দেশ।

ঢাকার সেগুনবাগিচায় মাইগ্রেশন অফিস। এত বড় শহর এই প্রথম দেখল সুনীল। কলকাতা কি ঢাকার থেকেও বড়? অত বড় শহরে গিয়ে কী করবে সে? হারিয়ে যাবে না তো? একটা ফর্ম পুরণ করে জমা দিতেই হাতে হাতে পেয়ে যায় মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট।

অফিসার হেসে বাবাকে বলেন, ‘পোলারে আগে পার কইর‍্যা পরে আম্নেরা যাইবেন, তাই তো? কিন্তু ক্যান যাইবেন? ধর্ম ছাড়া ত আর কিছুই মিল নাই!’  

নারায়ণগঞ্জ থেকে লঞ্চে চাঁদপুরে ফেরার পথেও বারবার অফিসারের কথা কানে বাজে সুনীলের।

‘যেদিন আইলাম, কী বৃষ্টি, কী বৃষ্টি! দর্শনা পেরোতেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। কিন্তু, কিছুই তো পরিবর্তন হয় না! সেই একই ধানক্ষেত, মাঠ-ঘাট, তাল গাছের সারি, এমনকি ধোঁয়া ধোঁয়া বৃষ্টি পর্যন্ত এক।’

‘পরিবর্তন আর কী হইব!’ এ টি দেবের ডিক্সনারির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে মণিমালা বলেন।

‘তাইলে এই সীমানা পার হওনের জন্য ব্যাকে এত উতলা ক্যান?’ 

আই-এর পাতায় গিয়ে মণিমালা পেয়ে যান যা খুঁজছিলেন। এ পারসন হু কামস টু লিভ পার্মানেন্টলি ইন এ ফরেন কান্ট্রি। অভিবাসী।

ইমিগ্র্যান্টের এই অর্থই দিয়েছে ডিক্সনারি।

ছয়

খাবার টেবিল গতরাতের মতো থম মেরে নেই, আজ ফুরফুরে। অভিজ্ঞান পত্রটি আবার দৃশ্যমান হতেই ভার নেমে গেছে সকলের। হারানো-নথি হাতে পেয়েই ছেলেকে ফোন করে দিয়েছিলেন মণিমালা। কোথা থেকে কীভাবে অকস্মাৎ বিপর্যয় নেমে আসবে কেউ জানে না। কাগজপত্র সব হাতের কাছে থাকাই মঙ্গল। অফিসে বসেই চাপমুক্ত হয় অম্লানজ্যোতি। স্কুল থেকে সন্ধেয় সঞ্চারী ফিরে খবর পায় শাশুড়ির থেকে। মুচকি হাসে সে।

‘ফেনী থেকে তোমরা চলে এলে কেন দাদু? বিক’জ অব রায়ট?’

‘না, না, রায়টের অনেক পরে আমরা এসেছি!’

‘ওখানে থাকলে কী ভালো হত! আমাদের বিরাট পুকুর থাকত। পিসিঠাম্মার মতো আমি ঠাডার মধ্যে কইমাছ ধরতাম!’

হা-হা করে হেসে ওঠে সকলে।

‘আমাদের এবার বাংলাদেশ ট্যুর প্ল্যান কর তো অম্লান। বাবাকে নিয়ে ফেনী যাই।’ সঞ্চারী বেশ উৎসাহী।

‘পাসপোর্ট লাগবে।’

‘আরে প্ল্যানটা তো কর! পাসপোর্ট করতে এখন বেশি সময় লাগে না!’

অম্লানকে উড়িয়ে দেয় সঞ্চারী। মেয়েও আনন্দে লাফায়। মৃদু হাসেন সুনীল।

‘এই কাগজটা না-পেলে কি আমাদের সিটিজেনশিপ থাকত না, দাদাই?’

‘ধুর, তোর দাদাইয়ের যত ফালতু ভয়!’ হাসতে হাসতে বলে সঞ্চারী।

‘ফালতু ক্যান, যা আরম্ভ হইসে কোথার থিকা কী হইব কেউ জানে!’ মণিমালা দুশ্চিন্তা দূর করতে পারেন না।  

‘আচ্ছা দাদাই, একটা কথা বল, আমি মেসির ফ্যান – সো আর্জেন্টিনার সাপোর্টার – লাস্ট ওয়র্ল্ড কাপে ফ্রান্সের কাছে হারার পর কেঁদেছি – আমি কি আর্জেন্টাইন নই?’

‘আর্জেন্টিনা হাইর্‌লে যারা কাঁদে, তারা অবশ্যই আর্জেন্টাইন!’ সুনীল নাতনির তালে তাল মেলান।

‘ফর্টি সেভেনের পর তুমি পাকিস্তানি ছিলে – ইস্ট পাকিস্তান থেকে ইণ্ডিয়ায় এসেছো – আই ক্যান অলসো ক্লেইম দ্যাট লিনিয়েজ – সো আয়াম আ পাকিস্তানি – আবার ফেনী এখন বাংলাদেশে – সো আয়াম আ বাংলাদেশী অলসো! তাহলে কী দাঁড়াল, আমি ইণ্ডিয়ান, সাইমালটিনিয়াসলি আমি আর্জেন্টাইন, পাকিস্তানি অ্যাণ্ড বাংলাদেশী!’

আবার সকলের হাসি। অম্লান বলে, ‘পাগল একটা!’

সাত

রাতে সুনীল স্বপ্ন দেখেন, বৃষ্টিতে শাদা হয়ে গেছে চরাচর। ঠাডার পর ঠাডায় কেঁপে ওঠে দালান। কইমাছগুলি কান বেয়ে উঠে আসছে পুকুরের পুবপাড়ে।

‘দিদি অরা ক্যান ওইদিকে যায়?’

‘আরে ভোদাই, ওইদিকে খাল না? পার হইলেই যাই পইড়্‌ব গিয়া খালে! পুকুরের মাছ খালের হইব!’

‘দিদি অরা বুঝে ক্যামনে ওইদিকে খাল?’

‘অরা জলের গন্ধ পায়!’ 

চরম ঠাডা আর বৃষ্টির মধ্যেই তার অকুতোভয় দিদি বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। দ্রুত পুবপাড়ে গিয়ে শরীরের ভারসাম্য রেখে ছুঁড়তে থাকে একের পর এক কই। হাত লাল হয়ে যায় দিদির। কইয়ের কাঁটায় তালু রক্তাক্ত। কচুগাছের রস লাগিয়ে দেয় সুনীল দিদির হাতে পরম যত্নে। দিদি হাসে। দিদির মুখটা দিদিভাইয়ের মতো লাগে।

নাতনি বলে, ‘দাদাই আমি কইমাছ ধরতে শিখে গেছি!’ 

রাত কত জানা যায় না। ঘুম ভেঙে মণিমালা দেখেন পাশে সুনীল নেই। ছ্যাঁৎ করে ওঠে বুকটা। মণিমালা ওঠেন। মশারি সরিয়ে খাট থেকে নামেন। এক পা এগিয়েই দেখতে পান স্বামীকে।   

সুনীল কুচি কুচি করে সেই টোকেন ফর ইমিগ্র্যান্টস ছিঁড়ে উড়িয়ে দিচ্ছেন দক্ষিণের জানালা দিয়ে। তীব্র হুইশল কানে আসে তার। পাকিস্তানের দর্শনা আর হিন্দুস্তানের বানপুরের মাঝে দীর্ঘ নো ম্যানস ল্যান্ড অতিক্রম করতে প্রাণপণে গতি বাড়ায় ট্রেন। টুকরো টুকরো অভিজ্ঞান ভেসে যায় হাওয়ায়। ছড়িয়ে পড়ে সেই বেওয়ারিশ ভূমিখণ্ডে।

‘দিদি, তর নাম নাই রেজিস্টারে আর আমিও ছিঁড়ি উড়াই দিসি কাগজ! আমরা আর হিন্দুস্তানের না, দিদি চল চলি যাই ফেনী। আমগো ফেনী। মধুপুর! নিব না আমগোরে? নিব না? নিব না?’

স্বামীর বিড়বিড়ানি শুনে এগিয়ে আসেন মণিমালা। হাত রাখেন পিঠে।

হালকা হয়ে যান সুনীল। মাধ্যাকর্ষণটুকু যেন এখন অগ্রাহ্য করতে পারছেন। সীমানাও তিনি পেরিয়ে যেতে পারছেন সহজেই। 

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *