বিদ্বেষ নয়, সমন্বয় হোক আগামীর ভাবনা

মোঃ আজহারউদ্দীন

আমি বাঙালি। জাতে মুসলমান। থাকি বীরভূমের ছোট্ট এক গ্রামে। আমার গ্রামের শতভাগই মুসলিম। আশেপাশের গ্রাম হিন্দু অধ্যুষিত। অতএব দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মেলামেশা, ওঠাবসা অবাধ। হারু দাদু রাস্তা দিয়ে বুড়ো কাকুকে যেতে দেখলে পাশে দু’দণ্ড বসতে বলেন। বিড়ি ধরান। এবার মাঠে ধান কেমন ফলবে সেই আলোচনা অথবা সংসার টানার লড়াই এর গল্পে মেতে ওঠেন। ধর্মাচরণের পার্থক্য ছাড়া মননের, অনুভূতির, আবেগের পার্থক্য চোখে পড়েনি কখনো দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে। কখনো এই পার্থক্য নিয়ে বাগবিতণ্ডাও দেখিনি।  কিন্তু বড় হতে থাকার সাথে সাথে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে শিখে গেলাম অদ্ভুত ভাবে! অম্ল মধুর নানা রকম অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় হতে থাকলাম রোজ ।

লালুর মা। পাশের গ্রামের। মাথায় মাছের ঝাঁকি নিয়ে ‘মাচ লেবে গো মাচ’ বলতে বলতে ফেরি করে বেড়ান। প্রতিদিন আমাদের গ্রামের ছোট্ট মসজিদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি মাথা থেকে মাছের ঝাঁকি নামিয়ে, ছেঁড়া চটি জোড়া খুলে রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম করতেন ভক্তি ভরে। আলাদা একটা প্রশান্তির অনুভূতি হতো মনে। ঠাকুরের ঠিকানা শুধু মন্দির বা মসজিদেই সীমাবদ্ধ তো নয়, ঠাকুরের বাস মনে, মন্দির মসজিদ ইমারত বই আর কিছু নয়।

ক্লাস সেভেন। ততদিনে মায়ের দৌলতে ছোটদের রামায়ণ ও মহাভারত শেষ করেছি। Additional বিষয় হিসেবে দুটো অপশন ছিল আমাদের হাতে। সংস্কৃত অথবা আরবি। দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম কোন বিষয় নেব? মা সেদিন সব চিন্তার মুক্তি দিয়ে বলেছিলেন– “আরবি তো জানিস! সংস্কৃত নিবি, নূতন একটা ভাষা শিখতে পারবি!” স্কুলে পরের দিন গিয়ে বন্ধুদের আড়ালে আবডালে বলতে শুনেছিলাম– “আরবি মুসলমানের ভাষা! ওসব পড়লে জাত যাবে!” অবাক হয়েছিলাম, ভাষার আবার জাত কী? গোটা ক্লাসে আমি এবং আর একজন, এই দুইজন মুসলিম, যারা সংস্কৃত ভাষা বেছে নিয়েছিলাম। বলে রাখা ভালো সেদিন আমার মা ভাষার জাত বিচার করেননি বলেই আমি সংস্কৃত বিষয়ে প্রতিবার সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েই পাশ করতাম।

পূজোর ছুটি। গল্পর বই, আকাশবাণী কোলকাতার ‘ছুটির ঘণ্টা’ আর আমাদের মুক্ত ডানা! বড় মামা বেড়াতে এসেছেন একবার। পাশের হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে একটাই দুর্গা ঠাকুর। পেল্লাই আকার তার। একদিন বন্ধুরা মিলে সেই ঠাকুর দেখতে গেলাম। মা দুর্গার দশভুজা রূপ, ইয়াব্বড় সিংহ আর অসুরের ভয়ানক রাক্ষুসে রূপ অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম। আমরা কানে কানে একে অপরকে বলতাম ‘হাত জড়ো করে নমস্কার কর, নইলে ঠাকুর গোনাহ দেবে!’ তারপর সবাই হাত জোড় করে দাঁড়াতাম। সর্দারপাড়ার ছেলেরা ঠাকুরদালানে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখতো আমাদের। সেবার বাড়ি এসেই পড়তে হল বড় মামার সামনে! বড় মামা ঠিক খোঁজ পেয়ে গেছেন আমরা ঠাকুর দেখতে গিয়েছিলাম সর্দারপাড়ার মণ্ডপে। চোখ পাকিয়ে ধমক দিলেন– “কোথায় গিয়েছিলি? হেঁদুদের ঠাকুর দেখতে? মাটির পুতুল দেখতে? জাহান্নামে যাবি বাঁদরের দল!” মা, মামার হাত থেকে আমাদের বাঁচিয়ে দিলেন সে যাত্রায়!

একবার তখন ক্লাস সিক্স। ওয়ার্ক এডুকেশনের পরীক্ষায় হাতের কাজে গ্লাস পোট্রেতে রাধা-কৃষ্ণ এঁকে নিয়ে গিয়েছিলাম যত্ন করে। পরীক্ষা শেষে সেই পোট্রে আমার বন্ধু কিরণকে দিয়ে দিয়েছিলাম। আজও কিরণের দিদিমা সেই রাধা-কৃষ্ণের মূর্তিতে ফুল বেলপাতা দিয়ে পূজা সারেন রোজ সকালবেলা!   

একবার কলেজ থেকে ফিরছি বাসে। আমার পাশের সিটে চল্লিশোর্ধ্ব এক ভদ্রলোক। বিস্কুট খাচ্ছেন। শুকনো বিস্কুট। একটু পর আমার কাছে জল চাইলেন– ‘বাবা জলটা দেবে?’ আমি পানির বোতল বাড়িয়ে দিলাম। তিনি বোতল হাতে নিয়ে বললেন– “বাবা তোমার নাম কী?  আমি নাম বললাম– “মোঃ আজহারউদ্দীন।” তিনি পানি না খেয়ে পানির বোতলটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিলেন। লজ্জায় আমার মাথা নীচু হয়েছিল সেদিন।

এই বছর দুয়েক আগের কথা। কোলকাতায় দুর্গাপুজো দেখতে সিদ্ধার্থ মুখার্জিদার বাড়ি গেলাম। তখন আমি প্রাক্টিসিং মুসলিম। দাদা জানেন,আমি নামাজ পড়বো। দাদা এও জানেন ঘরের মধ্যে দেব দেবী ইত্যাদির মূর্তি থাকলে নামাজ হবে না। তিনি তাঁর ঘর থেকে সব মূর্তি, পোট্রে, ছবি অন্য ঘরে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। আলমারি থেকে পরিষ্কার চাদর বের করে দিলেন নামাজ পড়ার জন্য।

এরকম হাজারো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই আমরা প্রায় প্রত্যেকে কোনও না কোনও ভাবে। যত দিন গেছে, বুঝতে শিখেছি এটা ওটা, যখন দেখেছি রাজনীতির চালিকা শক্তি ধর্ম হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে তখন চিরচেনা সম্পর্কগুলো কেমন যেন বদলাতে লাগল রোজ! চারিদিকে, স্বার্থসিদ্ধির প্রচেষ্টায় রত রাজনৈতিক দলের নেতাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে মানুষের মনে বিদ্বেষের বীজ বপন করেছে অন্ধ অনুসারীরা! সেই ১৯৪৭ সালে বিষাক্ত ধর্মীয় রাজনীতির কাছে মাথা নত করতে হয়েছিল হাজার বছর ধরে একসাথে থাকা দুই সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষকে। মাটি ছাড়া হয়েছিল বহু মানুষ। রক্ত ঝরেছিল, বহু মানুষের প্রাণ গেছিল। সেই বিদ্বেষের চাষ এখনো সমানে চলেছে। যার প্রমাণ আমরা অতি সাম্প্রতিক দিল্লি দাঙ্গা থেকে হুগলির তেলিনিপাড়ায় দেখেছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যে খবরের রমরমায় একটা সম্প্রদায়কে দেগে দিতে দেখেছি অবলীলায় রোজ। সেই বিদ্বেষের রাজনীতির প্রভাবে বদলে যেতে দেখেছি একসাথে কলেজের সময় কাটানো বন্ধুকেও, লিখতে দেখেছি–“মোল্লাদের পাকিস্তানে পাঠানো হোক!”

তবে কি এই বিদ্বেষের বিপক্ষে শান্তির ও সাম্যের কোনও চাষ হচ্ছে না?  হচ্ছে। সেই চাষ হচ্ছে বলেই আজ কোন মুসলমান ভাই রোজা ভেঙে রক্তদান করছেন কোন হিন্দু মাকে। রক্ত যোদ্ধা অনুপম ভট্টাচার্য থেকে রাজেশ মল্লিকরা  রক্ত দিয়ে রোজ মিলিয়ে দিচ্ছেন বিভেদের প্রাচীর। লক ডাউনে দূরে আটকে পড়া মুসলমান ভাইয়ের আশ্রয় ও রমজানের সব রকম ব্যবস্থা করছেন কোন মারোয়াড়ি দম্পতি। বাড়ি ফিরতে চাওয়া অমৃতকে মাঝ রাস্তায় ফেলে চলে যাননি বন্ধু ইয়াকুব। এঁরা কেউ-ই সম্প্রীতি রক্ষার তাগিদে বা প্রমাণে এসব করেননি। করেছেন কারণ ধর্মের চেয়ে মানুষ বড় হয়েছে এঁদের প্রত্যেকের কাছে। মানবতার চাষ করেছেন এঁরা ঘৃণার বদলে। মানুষই তাই এদের কাছে সবার আগে জায়গা পেয়েছে, কোন ধর্ম নয়।

এই মানবতার চাষের বড্ড দরকার এবং এর শুরুটা হওয়া উচিৎ বাড়ি থেকে। বাড়ির পরিবেশ ও শিক্ষা শিশুদের মন ও মননে ছাপ ফেলে গভীর ভাবে। পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সহাবস্থান ও ভালোবাসার কথা শুনে শিশুরা বড় হলে কোনও ঘৃণা তার মনকে কব্জা করতে পারবে না। কষ্ট হয় যখন দেখি নার্সারির ছোট ছোট বাচ্চারা বাবরি মসজিদ ভাঙার দৃশ্য মঞ্চস্থ করছে সাথে ঘৃণার স্লোগান! আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মকে কোন মননশীলতার শিক্ষায় শিক্ষিত করছি তার উপর নির্ভর করছে ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতের ভবিষ্যৎ। তাই সর্বাগ্রে বাড়ির পরিবেশ ধর্ম নিরপেক্ষ হওয়া উচিৎ, অন্তত মানবতার খাতিরে। তা না করলে আমার আপনার বাচ্চা উচ্চ শিক্ষিত হলেও, আসল শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে, ভবিষ্যতের ইতিহাসে যার কোন মূল্যই থাকবে না।

দিন দুই-তিন আগের কথা। কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করায় জনৈক দুবাই প্রবাসী বাঙালি খিস্তিখেউড় সহযোগে আমায় মেসেজ দিয়ে বাংলাদেশ পাঠানোর ভয় দেখালেন। আমি রেগে যায়নি। প্রত্যুত্তরে আমি জানতে চেয়েছিলাম–“দাদা,ভালো আছেন?” তিনি প্রত্যুত্তরে উত্তর দিয়েছিলেন। এরপর আমাদের কথা হতে লাগলো নিয়মিত। এখন আমরা বেশ ভালো বন্ধু। প্রতিদিন কথা হয় আমাদের এখন। অর্থাৎ, ভালোবাসায় কাজ হয়। বিদ্বেষ দিয়ে বিদ্বেষ কাটা যায় না, ভালোবাসা দিয়েই কাটতে হবে।

এই যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, এ রক্ষার দায় কিন্তু উভয় পক্ষেরই। সংখ্যাগুরু হওয়ার দায় তবুও কিছুটা বেশিই হয়ে যায় যখন সংখ্যায় কম হবার জন্য প্রতিনিয়ত ‘Discriminate’ হতে হয় টুপি পরা ও দাড়ি রাখা কাদের চাচাকে, দেগে দেওয়া হয় ‘জেহাদী মোল্লা’ বলে! দায় তখন বেশি হয় বই কি যখন দিল্লির জামাত কাণ্ডের দায় বইতে হয় গ্রামের জোয়ান ধার্মিক মুসলমান ভাইকে, চালু হয় ‘করোনা জেহাদ’-এর প্রচার! ক্রিকেট খেলায় ভারত বনাম পাকিস্তানের খেলায় পাকিস্তান কে পর্যুদস্ত করার পরের দিন যখন আমীরকে শুনতে হয় –” কী রে কাল কেমন দিলাম?” তখন দায় একটু বেশি নিতে হয় বই কী! আর এই দায়িত্বটা কিন্তু আর কিছুই না, শুধু বুকে টেনে নেওয়া, একটু আগলে রাখা; সহাবস্থানের এই বার্তা দেওয়া যে আমরা এক!

তাই বলে কি সংখ্যালঘু হবার অছিলায় মুসলমান সমাজ দায় বঞ্চিত?  কখনোই না।  মুসলমান সমাজের যে দীর্ঘকালীন অশিক্ষা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও বৃত্তের বাইরে না বেরোনো কিন্তু মুসলমান সমাজ কে আড়ালে ও চর্চার বাইরে রেখেছে বহুকাল। পারস্পরিক ভাব বিনিময়, সংস্কৃতির আদান প্রদান ও গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে গিয়ে সব কিছুকে গ্রহণ করার মনোভাব তৈরি হলে কিন্তু কাছাকাছি আসা যায়, সম্পর্ক মজবুত হয়।

সুফিবাদের গগনচুম্বী জনপ্রিয়তার পেছনে কিন্তু সুফিভাবের  উদার মনোভাব ও যুগোপযোগী হবার বার্তার অবদান ছিল অসীম। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই সুফি সাধকদের সান্নিধ্যে এসেছিলেন তার একমাত্র কারণ ছিল সকলকে সমান ভাবে গ্রহণ করার ক্ষমতা। বর্তমান মুসলমান সমাজে সেই সুফিবাদের কোন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

অথচ একসময় ভাবের ও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান জন্ম দিয়েছিল  নূতন নূতন সব শিল্পকলা,  সাহিত্য, ভাস্কর্যের। ইন্দো-ইসলামিক শিল্প রীতির সূচনা হয়েছিল। তৈরি হয়েছিল কুতুবমিনার থেকে শুরু করে তাজমহলের মত অসামান্য সব শিল্পকর্ম। জনপ্রিয় হয়েছিল সুফি গান। বাউলেরা একতারার সুরে মাটির গন্ধে বেঁধেছিলেন মোহাম্মদের জীবনকে! ‘মরুতে এলেন মোহাম্মদ’ বা ‘একটু দাঁড়াও মোহাম্মদ’ অথবা ‘ও মোহাম্মদ মোস্তাফা’ বাউল গানগুলিতে মোহাম্মদ বাংলার ঘরের ছেলে হয়ে উঠেছিল কী সাবলীল ভাবে। অথচ ধর্মীয় বাহানায় মুসলিম সমাজে ব্রাত্য রাখা হয়েছে সেই বাউল সাধকদেরও। তাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারিও হয়েছে বহুবার। গ্রহণ করার ক্ষমতা যদি না থাকে তবে গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে কি ভাবে? গ্রহণযোগ্যতা না বাড়লে কাছাকাছি আসা যায় না। কাছাকাছি না এলে সহাবস্থানের কথা বলাটা বড্ড বেমানান, শ্রুতিকটু লাগে।

চর্চা ও চর্চার আদান-প্রদান, সাংস্কৃতিক ভাব বিনিময় অনেকটা নিজের বাড়িতে  কোরমা-পোলাও হলে তা পাশের বাড়িতে দিয়ে আসার মতো, যে দেওয়া নেওয়ায় দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক মজবুত হয়, বিভেদের প্রাচীর ভেঙে যায়। তাই নিজেকে ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না রেখে নিজেকে মেলে ধরতে হবে, গ্রহণ করার ক্ষমতা তৈরি করতে  হবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়– “দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে/এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে!” তবেই কাছাকাছি আসবে দুই সম্প্রদায়। বিভেদের প্রাচীর দূর হবে। ঐক্য ও সম্প্রীতির মিলনে তৈরি হবে এক সুস্থ সমাজ।

তা না হলে আজও আমাদের সম্প্রীতির পোষ্টার হিসেবে তুলে ধরতে হবে দুর্গা পূজোর প্যান্ডেলে টুপি পরিহিত কোন মুসলমানের ছবি অথবা রোজা ভেঙে রক্তদান করার মতো কোন খবর। আর সম্প্রীতির পোষ্টার  হিসেবে এগুলোকেই শুধু তুলে ধরা হাজার বছরের পুরানো সেক্যুলার ভারতের সব থেকে বড় পরাজয়।

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *