মহম্মদ আলী জিন্নাহ
বেশিদিন না, এই নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে। এই এত্তটুকুন ছিলাম তখন। তবুও হাত খরচ তো লাগেই। বাড়ি থেকে চাইতে গেলেই আব্বার চোখ রাঙানো আর মায়ের বকা। অতএব নিজের রাস্তা নিজেই তৈরি করতে হবে। ছোট হলে কী হবে খরচ তো আছেই নাকি?
এই যেমন আইসক্রীম, ক্রিকেট বল, চকোলেট, বাদাম-কটকটি, আচার এগুলো তো আর আকাশ থেকে পড়ে না। তার উপর পৌষ মেলার, মহরমের মেলার খরচ তো আছেই। এত সব আসবে কোত্থেকে শুনি?
তাই আমাদের ছোটদের সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল যা সারা বছর পাওয়া যায় সেরকম কিছুর সন্ধান করা। আর সেই কাজে প্রথম পছন্দ ছিল হাঁসের পালক। তাও সব পালক না, শুধু ধবধবে সাদা পালক। জানি না কী কাজে ব্যবহৃত হত, তবে আমাদের কাজ হয়ে যেত (পরে শুনেছিলাম ওগুলো নাকি ব্যাডমিন্টনের শাটল কর্ক তৈরিতে কাজে লাগে)। আর এই কাজের সুবিধা হল কেউ কিছু বলতে পারবে না। কারুর থেকে তো আর নিচ্ছি না। রীতিমত নিজে উপার্জন করছি।
তো এই পালক আমরা কোথায় পেতাম…?
কেন পুকুর পাড়, নিজেদের দরমা, আর মাঠে ঘাটে। চোখ খোলা রাখলেই হল।
এখানেও কম্পিটিশন কম ছিল না। শুধু আমারই একার খরচা ছিল এমন তো নয়। তবে অনেকেরই যেতে আপত্তি ছিল। কে যাবে বাঁশ বনে, পুকুর পারে ঘুরতে! কোথায় সাপ খোপ থাকবে বলা যায় না। আমার অবশ্য এতে কিছু যায় আসত না। বরং সাপ তো ভালোই লাগত।
দিন গেলে দু চারটে পালক তো পেতামই। কিছু নির্দিষ্ট জায়গা ছিল যেখানে প্রতিদিন হাঁসগুলো পুকুর থেকে উঠে বসে থাকত। সেখানে সকাল বিকাল একবার করে ঘুরে এলেই হত।
তবে সমস্যার কথা সাদা হাঁসের সংখ্যা খুবই কম ছিল। সে সময় খাকি ক্যাম্পবেল হাঁসের খুব দৌরাত্ম ছিল। ওগুলো ছিল খয়েরি রঙের। আমাদের কোনো কাজের ছিল না। তাই মাঝে মাঝে সাদা হাঁস আছে এমন দলগুলোকে তাড়া দিতেই হত। যখন তাড়া খেয়ে উড়তে যেত কপাল ভালো হলে দু-একটা সাদা পালক খসে পড়ত।
আবার কখনো কখনো সাদা বকের পালকও তুলে নিতাম। যদি গোলেমালে চালাতে পারি। কিন্তু না, ব্যাটা দেখেই বুঝে নিত। রঙ ওয়ালা পালক, ডাঁটা খাওয়া পালক, বা খুব বেশি ব্যাঁকা বা ছোটো পালক বাদ পড়ে যেত। সাদা মুরগির পালক ও ভেঙে সোজা করে পালকের গতের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতাম, যদি চালানো যায়। কিন্তু না… কখনোও ভুল করে একটা গেছে কিনা মনে পড়ে না…
কে নিত এই সব পালক…?
কেন ওই যে সুর করে গ্রামে গ্রামে সাইকেল চেপে ঘুরে বেড়ায় দেখেননি, তারাই ছিল আমাদের পালকের খরিদ্দার। যার মধ্যে আমার দু জনের নাম মনে আছে। বাকের আর বাদল। দুই ভাই ছিল। আর এক জন ছিল এক্কেবারে কালো কুচকুচে। নাম ভুলে গেছি।
টিন ভাঙা, লোহা ভাঙা, কাঁচা ভাঙা, প্লাস্টিকের জুতো ছেঁড়া, দড়ি ছেঁড়া, পলিথিন ছেঁড়া আছে গোওওওওও…. আহা, কত সুর করেই না বলত…
যখন শুরু করি তখন পঁচিশটা পালকে এক টাকা ছিল। পরে বাড়তে বাড়তে একটা পালকে পঁচিশ পয়সা অব্দি এসেছিল। তার পর ধাঁই করে বড় হয়ে গেলাম সাথে সাথে পালক কুড়োতে লজ্জা লাগতে লাগল। ব্যাস সব বন্ধ হয়ে গেল… তবে ওই পালক কুড়িয়ে বেচাতেই আমাদের ‘সোর্স অফ ইনকাম’ সীমাবদ্ধ ছিল না।
এর ঠিক পরেই ছিল প্লাস্টিকের প্যাকেটের স্থান। তবে ওটা সাধারনত বাড়িতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই যেমন আব্বা বাজার থেকে কিছু আনলেন। ব্যস, মা প্যাকেট খালি করতে না করতেই ওই প্যাকেট আমার হস্তগত। জমানোর জন্য জায়গাও নির্দিষ্ট ছিল। বাড়ির বারান্দার একদম দক্ষিণে রান্নার চালার পাশেই খুঁটিটাতে বড় দেখে প্লাস্টিক ব্যাগ বেঁধে রেখেছিলাম। এতে সুবিধাও ছিল। মা বা ফুফুও আমার অনুপস্থিতিতে প্লাস্টিকের ব্যাগগুলো ওখানেই জমা করে দিতেন। ব্যাস এক কিলো হলেই তিন টাকা। তবে এক কিলো হতে প্রায় মাস তিনেক লেগে যেত। সমস্যা কি..! ‘পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা’ই বা কম কোথায়…?
তবে সব প্লাস্টিকের ব্যাগই বিক্রিযোগ্য ছিল না। যে গুলো মোলায়েম শুধু সেগুলোই নিত। যে গুলো নাড়াচাড়া করলে আওয়াজ হত ওগুলো বাদ পড়ত। কে নিত সেটা আর নাই বা বললাম…
তবে আমাদের সবচেয়ে বেশি ইনকাম ছিল ধান ওঠার মরশুমে। বছরে দুই বার আমাদের যাকে বলে রাজার হাল।
ধান কেটে জমি থেকে খামারে তোলার সময় ঝরে পড়া ধানের শীষ কুড়াতাম বিকাল বেলায়। সকালে ধান কেটে সাধারণত দুপুরের পর বাঁধা হত। ওই সময় ধানের আঁটি থেকে ঝরে পড়া ধানের শীষগুলোই আমরা কুড়াতাম। আর যদি কখনোও কোনো মাঠে ধানের ভারি গাড়ি বোঝাই করা হতো তবে তো তা আমাদের জন্য জ্যাকপট ছিল। এক জায়গাতেই এক গত হয়ে যেত। আর কী চাই!
তবে এখানে কম্পিটিশন শুধু মানুষই ছিল না। ছাগল গরুও আমাদের সাথে পাল্লা দিয়ে ধান খেতে থাকত।
তবে সব জমিতে যাওয়ার অধিকার ছিল না। কেউ কেউ তাদের জমিতে ঢুকতে দিত না। তাদের নিজেদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা কুড়িয়ে নিত।
তবে এখানেও দুই নাম্বারি করতাম। ওই ধান জমির আলে চলতে চলতে অসামান্য দক্ষতার সাথে দুই ধারের জমি থেকে ‘ধান টুঙা’ চলত। ধান টুঙা হল যাকে বলা যায় চুরি করা। তর্জনি আর বুড়ো আঙুলের এক মোচড়েই এক একটা শীষ হাতে চলে আসত। ধান গাছও টের পেত না তার থেকে শীষ টুঙা হয়ে গেছে। এখানেও এমন ভাবে কাজ সারতে হবে যাতে কেউ টের না পায়। চলতে চলতে দাঁড়ানো যাবে না, ধান নাড়ানো যাবে না। না হলেই জমিতে কাজ করা মানুষজন দেখলেই বকা খেতে হবে। কপাল ভালো হলে আব্বার বা মায়ের হাতের মারও…
এই ধানের শীষ কুড়িয়ে উঠোনের এক কোনায় জমা করতাম। রবিবার হলেই শুরু হত মাড়াই করা। বাঁশের মুগুর নিয়ে ধুমধাম পিটিয়ে কুলোতে পাছুরে (যে প্রক্রিয়ায় কুলোতে কাজ করা হয়) পরিষ্কার করতাম। এক টিন (পনের কিলো) হলেই কেল্লা ফতে। তবে এই ধান বাইরে কমই বিক্রি করতাম। আব্বাকে দিয়ে দিতাম। বিনিময়ে টিন প্রতি পনের টাকা। আহা!
দু-তিন টিন তো হয়েই যেত প্রতি মরশুমে…