খুশির ঈদে এ কোন আগন্তুক!

মিরাজুল হক

বাহিরে মহামারী। সংক্রমণের আতঙ্ক, মৃত্যুর পরিসংখ্যান বাড়ছে। লকডাউনের দমবন্ধ করা আতঙ্ক আর দুশ্চিন্তার মাঝে আসছে রমজানের রোজার পরে খুশির ঈদ। ‘ঈদ’ আরবি শব্দ। যার অর্থ আনন্দ বা উৎসবে ফিরে আসা;  যে দিনে মানুষ একত্র হয় ও দিনটি ফিরে আসে। মোবারক শব্দের অর্থ কল্যাণময়। ঈদ মোবারক অর্থাৎ এই দিনে ঈদ বা আনন্দ উদযাপন কল্যাণময় হোক। এভাবেই পরম করুণাময়  নিয়ামত ও অনুগ্রহ দ্বারা বারবার ধন্য করেন এবং আমরা ‘সুকরিয়া’ (কৃতজ্ঞতা) জানিয়ে থাকি।

ইসলামে ঈদের প্রচলন,  ঈদে করনীয় দায়িত্ব, চাঁদ দেখার আনন্দ,  ঈদের নামাজ পড়া বা আদায় করার গুরুত্ব, পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া, ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়, নতুন পোশাক পরিধান করা, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার বিশেষ সুযোগ, প্রতিবেশীদের খোঁজ খবর নেওয়া – এই সব মিলিয়ে একটা আবেগঘন খুশির পরিমণ্ডলে সমগ্র মুসলিম সমাজ, পাড়া থেকে গ্রাম বস্তি, শহরতলির অর্ধ শিক্ষিত অশিক্ষিত গরীব গুর্বো দিনমজুর রাজমিস্ত্রি থেকে রঙমিস্ত্রি, ফলওয়ালা, মুটেমজুর, মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত অল্প সংখ্যক শিক্ষিত চাকুরীজীবী, কম পুঁজির দর্জি ব্যবসায়ী, জামা কাপড়ের বড়  ওস্তাগার  সকলেই   আনন্দে মেতে ওঠে।

এই আনন্দের দিনে ফিরোজা বেগমের সুমধুর কাঁপানো কণ্ঠস্বরে কাজী নজরুল ইসলামের গানের লাইনগুলো বারবার মনে পড়ে, “ও মন  রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে / শোন আসমানী তাগিদ।”

এই আনন্দের ছোঁয়া অনেকটাই অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষজনের মধ্যেও একটা ভালো লাগার পরিবেশ সৃষ্টি করে। ‘ঈদ মুবারকের’ শুভেচ্ছা জানানোর একটা দায়িত্ব যেন ছড়িয়ে পড়ে এখনকার ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’তেও। কেননা ঈদ আমাদের জীবনে প্রতিবার প্রেম প্রীতি ও কল্যাণের বার্তা নিয়ে হাজির হয়।

 মূলত মানুষে মানুষে ভেদাভেদহীনতা ভুলে সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ব, মমত্ব, ভালোবাসা জাগ্রত করাই ঈদ উৎসবের মূল লক্ষ্য। কবি সুফিয়া কামালের ঈদ বিষয়ক গানেও আমরা সাম্যের বর্ণনা পাই – “কাল ঈদগায়ে ধনী-দরিদ্র মিলিবে যে বুকে বুকে।”

 বাহিরে মহামারী। দেশে সতেরো-আঠারো কোটি মুসলমানের মধ্যে এক কি দুই শতাংশ বিত্তশালী মুসলমান  বাদ দিয়ে,  বাকি কোটি কোটি হাজারে হাজারে নিরন্ন আব্দুল চাচা, রহিম, আকলিমা, বিলকিস বেগমদের কাৎরানি, না খেতে পাওয়া চুপসে যাওয়া পেট, অপুষ্টিতে গহ্বরে ঢুকে যাওয়া মৃত্যুভয়বিহ্বল চোখ– তারা আমাদেরই প্রতিবেশী; দেশবাসী। এই বিশাল সংখ্যক মুসলিম জনমানসের মধ্যে এবার কি ঈদের আনন্দ খুঁজে পাওয়া যাবে? বড়ো  দুঃখ, বড়োই দরিদ্র, কষ্টের সংসার। সংসারে টানাটানি।

রাষ্ট্রীয় কর্তব্যের প্রসঙ্গ তোলার কোন সার্থকতা নেই। সরকার সংবেদনশীল হলে, এই অবস্থার কিছুটা হলেও দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করা যেত। দুই বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও রঘুরাম রাজন রেড্ডি বারবার বলেছেন গরীব মানুষজনের হাতে নগদ টাকা দেওয়ার জন্য, সরকারী খাদ্য ভাণ্ডার থেকে চাল গম ডাল শর্তহীন ভাবে  বিতরণ করার জন্য। এই ভাবে কিছুটা হলেও গরিব মুসলমানদের ঈদের উৎসবে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য পালন করা যেত।

 কিন্তু দেশের শাসনকর্তাদের অনুভূতি সহানুভূতি কম, নেই কোনও সংবেদনশীলতা। সরকার তার শ্রেণি-চরিত্রে অবিচল। ভোটের অঙ্কে মালিক মহাজনদের প্রাচুর্যের উদার ব্যবস্থা করে দেওয়া আর তাতে যদি গরিব মুসলমানরা মারা পড়ে তো কী করা যায়? অর্থনীতির নিয়ম-রীতি বড় অকরুণ। মুসলমানদের বড় উৎসব, খুশির ঈদ – এ সব নিয়ে  ভাবনার অবকাশ নেই। আর সর্বোপরি আছে  RSS এর রিমোট কন্ট্রোল । এমন কী বামপন্থী আন্দোলনেও এই বিষয়টা নেই! বিষয়টা কি তবে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ হয়ে যাবে ?

 সমাজবিজ্ঞানীদের মতে যে কোনো বড় ঘটনা মানব সভ্যতার আর্থসামাজিক প্রেক্ষিতে আমূল পরিবর্তন ঘটায়। সারা দুনিয়া জুড়ে ফরাসি বিপ্লবের পর সাম্য ও সার্বভৌম ধারণা আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর  স্বাধীনতার প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারা ইউরোপ জুড়ে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটেছিল; উদার গণতান্ত্রিক ধারণা, ফ্যাসিবাদ বিরোধী সামজতান্ত্রিক ধারনার প্রভাব বেড়েছিল। তেমনি এই মহামারীর প্রেক্ষাপটে মানবিক মূল্যবোধ, সহমর্মিতা,  নাগরিক সচেতনতার একটা আমূল পরিবর্তন ঘটবে আশা করা গিয়েছিল।

 কিন্তু  কোথায়? কেউ তো দৃষ্টান্তমূলক ভাবে কিছু করছে না। না কী এটাও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ রাজনীতির উদাহারণ হয়ে যাবার আশঙ্কাতে, দ্বিধা-সংকোচের কারণে  আর্থিক সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে বিরাট সংখ্যার মুসলমান জনগোষ্ঠী। অথচ তিরিশ দিনের রমজানের রোজার পর খুশির ঈদ। 

তাই এই খুশির উৎসবে মহামারীর সংকটে “অতিথি  বা আগন্তুক” স্বরূপ যে অসহায়তা কর্মহীনতা বেকারত্বের ভয়াবহতা আসামের করিমগঞ্জ থেকে নলবাড়ি, মুর্শিদাবাদের রাজমিস্ত্রি অউরঙ্গবাদের বিড়ি-শ্রমিক থেকে হাওড়ার পাঁচলার ধুলোগড়ের জরিশিল্প, মেটিয়াব্রুজের ছোট বড় ওস্তাগার থেকে গাজিয়াবাদের কল কারখানার দিনমজুর, কেরলের  মুন্নারের কৃষি কাজের মজদুর পর্যন্ত– সর্বত্র একটা দুঃখ যন্ত্রণা বেদনার ঘটমান  চালচিত্র। এটাকে লুকিয়ে রেখে কি করে এই ঈদে খুশির অভিনয় করা যায়?

ধনী মুসলমানদের জন্য, ইসলামে রমজান মাসে জমানো ধনসম্পত্তির নিরিখে ‘যাকাত’ দেওয়ার নিয়ম আছে। এবং ঈদের দিনে ‘ফিতরা’ ও অভাবগ্রস্তদের খাবার প্রদানের বিধান আছে। ধনী মুসলমানদের টাকাতে সক্রিয় ওয়াকফ বোর্ডেরও একটা বড় ভুমিকা আছে। 

এত কোটি গরিবগুর্বো মুসলমানদের কাছে, এই সবকিছু আশা প্রত্যাশার সঠিক ভরসাস্থল নয়, পদ্ধতিগত পরিকাঠামোর অভাবের কারণে নির্ভরযোগ্য প্রত্যয়ও নয়;  বিশ্বাস করা কঠিন। নাকি সবই আশার ছলনা মাত্র?

বছর শতাব্দী ধরে যে অভাব বঞ্চনার প্রেক্ষাপটে, ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের এই দারিদ্র ও গ্লানি মোচন করার উপায় থাকে না বলে ‘বেহস্থের’ প্রলোভন দেখিয়ে বোঝানো হয় এবং নিজেরাও বুঝে যায় যে, ইহজীবনে যা কিছু ঘটে তা সহ্য করে যাও। ওপরওয়ালার বিধান যা, তা অনিবার্য।

বাহিরে মহামারী। সংসারে টানাটানি। তাই অপছন্দের হলেও এই আগন্তুক-অতিথিকে নিয়ে সরকারী নিয়ম মেনে, নিজেদেরকে বুঝিয়ে অনুপ্রাণিত করে, ঈদ উৎসব উদযাপন করতে হবে।

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *