ফ্যাসিবাদের চরিত্রলক্ষণ

বিষাণ বসু

ফ্যাসিবাদ জিনিসটা কী, তা খায় না মাথায় মাখে, এসব নিয়ে আমার স্পষ্ট কোনও ধারণা নেই। তার মানে অবশ্যই এমন নয়, ব্যাপারটা যে খারাপ এবং বিপজ্জনক, সে নিয়ে আমার মনে বিশেষ সংশয় আছে। ফ্যাসিবাদ যে খারাপ, যে কোনও মূল্যে ফ্যাসিবাদের লক্ষণযুক্ত নেতাকে/নেতাদের বা দলকে/দলদের প্রতিহত করা উচিত, সে বিষয়ে আমি রীতিমতো নিঃসংশয়। আশেপাশের লোকজনের কথাবার্তা শুনে যদ্দূর বুঝি, আরও অনেকেরই অবস্থা আমার মতো। কিন্তু ফ্যাসিবাদের লক্ষণগুলো যে ঠিক কী, সেটুকু না জানলে তো মুশকিল। নাহলে যে কেউ যে কোনও পরিস্থিতিকে ফ্যাসিবাদ বা ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি বলে দাগিয়ে দিতে পারে, আবার বিপরীতে কেউ কেউ ফ্যাসিবাদের আদ্যলক্ষণকেও অগ্রাহ্য করে তাকে হাল্কাভাবে নেওয়ার ভুল করে বসতে পারে। বলা বাহুল্য, দুটিই বিপজ্জনক। তেমন তেমন পরিস্থিতিতে রজ্জুতে সর্পভ্রম অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলতে পারলেও সর্পে রজ্জুভ্রম কিন্তু প্রাণসংশয় ঘটাতে সক্ষম। একেবারে গ্যাসচেম্বার-কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প অব্দি না গেলে, বা যাওয়ার প্রকাশ্য প্রয়াস না দেখা গেলে ফ্যাসিবাদ বলা যাবে না, এমন একটা কথা মাঝেমধ্যে ভেসে বেড়ায় বটে। কিন্তু সীমিত জ্ঞানেও বুঝি, কথাটা মুখের ঘা গাল ফুঁড়ে বাইরে দগদগে হওয়া অব্দি ক্যানসার বলা যাবে না-র মতোই ভুল। অসুখের মতোই ফ্যাসিবাদেরও আদ্যলক্ষণ থাকে। আর কাণ্ডজ্ঞান বলে, এ ব্যাপারে যত আগে সচেতন হওয়া যায়, রোগমুক্তির সম্ভাবনা ততো বেশি। 

সাতপাঁচ ভেবেটেবে মনে হয়, এসব বিষয়ে যাঁদের পড়াশোনা আছে – ইতিহাসবিদ, সমাজবিজ্ঞানী প্রমুখ – তাঁরা যদি আমজনতার উপযোগী করে ফ্যাসিবাদের সাধারণ লক্ষণগুলি সকলকে জানাতেন, তাহলে সকলেরই সুবিধে হতে পারত। কিন্তু সে গুড়ে বালি। ফ্যাসিবাদের বিপদ নিয়ে এত কথা শুনি, যত্রতত্র অমুক দলের দাপট ফ্যাসিবাদ না হলেও তমুক দলের ক্রিয়াকলাপে ফ্যাসিবাদ প্রকট এমনটাও শুনি – কিন্তু ঠিক কী দেখে ফ্যাসিবাদ চিনব, সেই সাধারণ লক্ষণগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা নিতান্তই কম। সাধারণ লক্ষণগুলির কথা বলছি, কেননা সব দেশে সব কালে ফ্যাসিবাদ একই রূপে হাজির হয়নি, হবেও না। সাধারণ লক্ষণগুলো জানা থাকলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রূপে বদল ঘটিতে হাজির হলেও বিপদকে চিনতে সুবিধে। তা নাহলে, যা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই, তাকে বিপদ হিসেবে চিনে সেই বিপদকে প্রতিহত করতে পারার কাজটা তো সহজ নয়। চিনতে পারলে, তবেই সম্ভব।

এই লক্ষণগুলো চটজলদি বলে দেওয়াটা অবশ্য সহজ কম্মো নয়। নামকরা ঐতিহাসিক ইয়ান কের্শ ফ্যাসিবাদকে সংজ্ঞায়িত করা এবং একদলা জেলি পেরেক দিয়ে দেয়ালে আটকে রাখা, দুটিকেই একইরকমের দুঃসাধ্য কাজ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তাছাড়া, ফ্যাসিজম ব্যাপারটা যাঁদের হাত ধরে মাথা তুলেছিল, তাঁরা তো শব্দটিকে সেভাবে খারাপ হিসেবে ভাবেননি। তাঁদের চোখে ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা এবং পরবর্তীতে যাঁরা শব্দটিকে পরিত্যাজ্য হিসেবে দেখেন, তাঁদের চোখে ফ্যাসিবাদ, প্রত্যাশিতভাবেই এক নয়। সুতরাং…

এমন গোলমেলে গুলিয়ে-যাওয়া পরিস্থিতিতে উমবার্তো একো-র Ur-Fascism নিবন্ধটি পড়ে দেখা যেতে পারে। নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ। স্বাদু গদ্য। তরতর করে পড়ে ফেলা যায়। যেখানে উনি মুসোলিনির ইতালিতে নিজের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি, যুদ্ধ শেষে একনায়কতন্ত্র থেকে মুক্তি ইত্যাদি প্রসঙ্গ ধরে এগোতে এগোতে ফ্যাসিবাদের সাধারণ লক্ষণগুলিতে পৌঁছাতে চেয়েছেন। পড়তে পড়তেই মনে হলো, আমরা যারা ইতিহাস সেভাবে পড়িনি, কিন্তু ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাবলীর উল্লেখ করে বসি প্রায় আলটপকা প্রসঙ্গ-অপ্রসঙ্গে – তাদের সব্বার অন্তত একো-র এই লেখাটুকু পড়ে দেখা উচিত।

এ লেখায় ফ্যাসিবাদের সাধারণ চরিত্রলক্ষণ নির্দিষ্ট করতে উমবার্তো একো মোট চোদ্দটি পয়েন্টের উল্লেখ করেছেন। সাধারণ চরিত্রলক্ষণ। এর প্রতিটিই শাসকের চরিত্রে উপস্থিত থাকতেই হবে, এমন নয়। অনেকসময় একটিমাত্র লক্ষণের জাঁকিয়ে উপস্থিতিই যথেষ্ট হতে পারে। কিন্তু এই সাধারণ লক্ষণগুলো মনে রাখতে পারলে ফ্যাসিবাদের উপস্থিতি অনুভব করতে অসুবিধে হবে না।

এক্ষেত্রে একো ভারি চমৎকার একটি উদাহরণ দিয়েছেন। উদাহরণ, যা সংশয় বা বিভ্রান্তির চেহারাটা স্পষ্ট করতে পারে। ধরুন, প্রথম শাসক যার মধ্যে ফ্যাসিবাদের তিনটি চরিত্র a, b এবং c রয়েছে। একেবারে আগমার্কা ফ্যাসিস্ট। দ্বিতীয়র মধ্যে রয়েছে b, c ও d এবং তৃতীয়ের মধ্যে রয়েছে c, d ও e। প্রথম ও দ্বিতীয়ের মধ্যে খুবই মিল (b ও c), প্রথম ও তৃতীয়ের মধ্যে মিল বলতে শুধুই c। কিন্তু ধরুন, চতুর্থ এক শাসক, যার চরিত্রলক্ষণ d, e আর f। এর সঙ্গে প্রথম শাসকের কোনও মিলই নেই। তাহলে কি একে ফ্যাসিস্ট বলা যাবে না? অথচ চারজনই তো একটি অবিচ্ছিন্ন কন্টিনিউয়ামের অংশ। তাহলে?

এইসব ধন্দটন্দ মাথায় রেখেই আমাদের এগোতে হবে ফ্যাসিবাদের সাধারণ চরিত্রলক্ষণ নির্ধারণের কাজে। প্রাথমিকভাবেই একো মনে করিয়ে দিয়েছেন, ফ্যাসিবাদ বলতে গেলে, মুসোলিনির ফ্যাসিবাদকে দিয়ে ফ্যাসিবাদের চরিত্র চিনলে ভালো হয়। যা হিটলারের নাৎসিবাদ থেকে অনেকখানি ভিন্ন। নাৎসিবাদ সংশয়াতীতভাবে টোটালিটেরিয়ান, যাবতীয় ব্যক্তিগত বা ক্ষুদ্র-সমষ্টিগত মতকেও নাৎসি আদর্শ তথা রাষ্ট্রীয় আদর্শের কাছে নত হয়ে থাকতে হয়। মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ অবশ্যই একনায়কতন্ত্র, কিন্তু কেন্দ্রীয় বা রাষ্ট্রীয় আদর্শের জায়গাটা অনেকখানিই ঘোলাটে। কাজেই, বিভিন্ন মতকে দাবিয়ে রাখার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় একনায়কতন্ত্রের মডেলের মধ্যে বিভিন্ন এমনকি পরস্পরবিরোধী মতকেও নিজের মতো করে আত্মসাৎ করতে পারা সেখানে সম্ভবপর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হিটলারের জার্মানিতে রাষ্ট্রীয় আদর্শানুসারী শিল্প বাদ দিয়ে অন্য ধরনের শিল্পচর্চা সম্ভব ছিল না, কিন্তু মুসোলিনির ইতালিতে সবরকম শিল্পচর্চা সম্ভব হতো। এমনকি প্রথাভাঙা বা আভাঁ গার্দ শিল্প, যাকে নাৎসি জার্মানি বিকৃতি হিসেবে দেখতে চাইত – তাও দিব্যি চালু ছিল মুসোলিনির ইতালিতে। এর অর্থ এমন নয় যে মুসোলিনির ইতালি ছিল মুক্তমনা গণতন্ত্র – বিপরীতটাই সত্য – কিন্তু ফ্যাসিবাদের চরিত্রলক্ষণ নিয়ে আলোচনা করার শুরুতে, এক একনায়কতন্ত্রী শাসনকাঠামোর মধ্যে বিভিন্ন মতের আত্তীকরণ ঘটিয়ে আজব জগাখিচুড়ি রান্না করতে পারার ব্যাপারে ফ্যাসিবাদের দক্ষতার কথাটা মাথায় রাখা জরুরি। এই কথাটা মাথায় না থাকলে রাত্তিরের অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে ঝটিকা-বাহিনীর মিছিল, পার্লামেন্টে অগ্নিকাণ্ড কিংবা কনসেনট্রেশান ক্যাম্প না দেখতে পেলেই ‘ধুস্, এ ফ্যাসিবাদ নয়’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা। 

আবারও বলি, উমবার্তো একো-র প্রবন্ধটি নাতিদীর্ঘ ও সুখপাঠ্য। সরাসরি পড়ে নেওয়াই ভালো। আমি সম্পূর্ণ নিবন্ধ নিয়ে আলোচনায় ঢুকতে চাইছি না। ফ্যাসিবাদের চোদ্দটি লক্ষণ নিয়ে বিশদ আলোচনা, তা-ও বর্তমান প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। আমি মূল নিবন্ধটি থেকে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পড়ে দেখতে চাইব। নিজে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পড়াটা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেব। পারিপার্শ্বিক ও বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে ভাবার দায়িত্ব আপনারই।

ফ্যাসিবাদের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে একো চিহ্নিত করেছেন, কাল্ট অফ ট্র‍্যাডিশন। জাতিগত আত্মানুসন্ধান ও ঐতিহ্যের উৎসমুখ সন্ধানের নামে এক বিকৃত ইতিহাস-চর্চাকে সমাজচিন্তার মূলস্রোত করে ফেলা। ফ্যাসিস্ট শাসনে অতীত-গৌরবের নামে যে ঐতিহ্যের ধুয়ো তোলা হয়, তা সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী কিছু ঐতিহাসিক/আধা-ঐতিহাসিক সত্যের সমন্বয়ে নির্মিত – প্রায়শই কল্পনাশ্রয়ী, এবং সত্য হলে অনিবার্যভাবে প্রেক্ষিত হতে উৎপাটিত ও বিচ্ছিন্ন। 

আবার, অতীত উৎকর্ষই যেহেতু শ্রেষ্ঠ – সুতরাং অনতিক্রম্য – নতুন করে শেখা-জানার কিছু আর বাকি থাকে না। ফ্যাসিস্ট আমলে আধুনিক সময়ের উপযুক্ত জ্ঞানান্বেষণ বা গবেষণা বলতে, অতীত শ্রেষ্ঠত্বকেই সঠিকভাবে জানা, অতীত গ্রন্থরাজি হতে আলটপকা উদ্ধৃতি তুলে আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে তাকে সমকালীন জ্ঞানের পূর্বাভাস হিসেবে দেখার ও দেখানোর চেষ্টা করা। এমতাবস্থায়, সাধারণত, অতীত জ্ঞান বলতে যে কথাগুলো উদ্ধৃতি হিসেবে উঠে আসতে থাকে, সেগুলো ততখানি সুস্পষ্ট নয়। আর, প্রায় বাধ্যতাবশত, এই অস্পষ্টতাকে উচ্চতর জ্ঞান ও মেধার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সঙ্কেতবার্তা হিসেবে পেশ করা হয় এবং সেই সঙ্কেতের সমকালীন পাঠোদ্ধারকেই বর্তমান চর্চা ও গবেষণার মূল অভিমুখ হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়।

অতীতই যেহেতু শ্রেষ্ঠ এবং ঐতিহ্যের চর্চাই যেহেতু মুখ্য অভীষ্ট, আধুনিক সভ্যতা যথা যন্ত্রসভ্যতা প্রযুক্তি ইত্যাদি ফ্যাসিবাদের আদর্শে, মূলগতভাবে ও আদর্শগতভাবে, পরিত্যাজ্য। আধুনিকতার অপরিহার্য অঙ্গ যেহেতু, সমকালীন বিজ্ঞানও তা-ই। যদিও ফ্যাসিস্ট শাসনকালে, অনেক দেশেই, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সম্ভব হয়েছে, তবুও সেই বিজ্ঞানের উৎকর্ষকে মেনে নিতে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের একরকম অস্বস্তি থেকেছে। বরং সুদূর অতীত থেকে খুঁড়ে এনে সঙ্কেতের উদ্ধারই ফ্যাসিবাদের মুখ্য বিজ্ঞানচর্চা। যার মধ্যে যুক্তির অভাব বা অযৌক্তিকতার বাড়াবাড়ি অনিবার্য। 

অযৌক্তিকতার আরেক প্রকাশ, যেকোনো ভাবে কর্মকেই অগ্রগণ্য ধরে নেওয়া। একো-র ভাষায়, অ্যাকশন ফর অ্যাকশনস সেক। কর্মের জন্যই কর্ম। কর্ম-ই শ্রেষ্ঠ, অতএব যেকোনও মূল্যে ভাবনাচিন্তা ছাড়াই কিছু একটা করে ফেলাটাকেই শ্রেষ্ঠ হিসেবে দেখতে চাওয়া। সুতরাং, বিদ্যাচর্চা বা সংস্কৃতিচর্চা – যেখানে গভীর ভাবনা বিবেচনা বা ক্রিটিকালি চিন্তাভাবনা করাটা প্রয়োজন – তাকে আলস্য ও নিম্নগামী বলে ধরা হয়, কেননা তা, ফ্যাসিবাদের চোখে, সময়ের অপচয় মাত্র। অতএব, বুদ্ধিজীবী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, সকলেই একলপ্তে বিভিন্ন শ্লেষোক্তি তাচ্ছিল্য এমনকি নির্যাতনের শিকার হতে থাকেন। রাষ্ট্রের তরফে। বৃহত্তর সমাজের তরফেও।

বিভিন্ন মতামত – তার অনেকগুলো আবার পরস্পরবিরোধী – তাদের জগাখিচুড়িতে নির্মিত ফ্যাসিবাদের রাষ্ট্রীয় আদর্শ। কোন্ কোন্ মত বা ভাবনা মিলে এই জগাখিচুড়ি রাঁধা হবে, তা সংশ্লিষ্ট দেশ ও কালের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। কিন্তু একবার এই অপরূপ জগাখিচুড়ি রান্না হয়ে গেলে সেখানে বিপরীত মতপ্রকাশের তিলমাত্র অবকাশ বা পরিসর থাকে না। আধুনিক জ্ঞানচর্চা কিংবা বিজ্ঞান, মুখ্যত, অগ্রসর হয় বিপরীত মতকে গুরুত্ব দিয়ে – বিপরীত মতের প্রেক্ষিতে নিজ মতকে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ফ্যাসিবাদে বিপরীত মত মাত্রেই রাষ্ট্রদ্রোহিতা, বিশ্বাসঘাতকতা। 

আসলে ভিন্ন মত সামাজিক বৈচিত্র্য তথা সামাজিক বিভিন্নতার প্রতিফলন। অথচ ফ্যাসিবাদের প্রসার ঘটে ‘অপর’-এর প্রতি অবিশ্বাস ও ঘৃণার উপর ভিত্তি করে। মানবসভ্যতার সুদূর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, অপরিচিতের প্রতি অবিশ্বাস মানবপ্রজাতির মজ্জাগত। ফ্যাসিবাদের শুরুটা হয়, ‘অপর’ বা ‘বহিরাগত’ হিসেবে কোনও এক বিশেষ জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে। সেই চিহ্নিতকরণ দ্বারা মানুষের ভেতরকার এই অপরিচিতের প্রতি অবিশ্বাস ও সমাজের মধ্যেকার বিদ্বেষকে চাগিয়ে তোলার মাধ্যমে। 

ফ্যাসিবাদের উদ্ভবের পেছনে সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে উমবার্তো একো যে কথাটা বলেছেন, তা সবসময় মনে রাখা জরুরি। বিশেষত এই সময়ে দাঁড়িয়ে৷ তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদের শুরু হয় হতাশার অনুভূতি থেকে। ব্যক্তিগত হতাশা। সামাজিক হতাশা। ইতিহাস সাক্ষী, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানসিক হতাশা থেকেই বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদের শাসন শুরু হয়েছিল। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কিংবা রাজনৈতিক টানাপোড়েন, হতাশার কারণ বিভিন্ন। নিম্নতর শ্রেণী থেকে অনেক মানুষ মধ্যবিত্ত স্তরে উঠে আসার সম্ভাবনা তৈরি হলে মধ্যবিত্তের অনিশ্চয়তা বাড়ে, একইভাবে আর্থসামাজিকভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বড় অংশের নিম্নবিত্ত শ্রেণীতে নেমে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলেও এমন হতাশা খুবই সম্ভব। 

সমাজের একেবারে নিচুতলায় যাঁরা আছেন, তাঁদের আত্মপরিচিতির খুব একটা সুযোগ থাকে না। সেই সুযোগের অভাব এক নতুন সুযোগ তৈরি করে – এক মহান দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচিতি তৈরি করে ফেলার সুযোগ। ফ্যাসিবাদী জাতীয়তাবাদের উদ্ভব এই পথেই। সবরকম সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত ও নিপীড়িত এই নিচুতলায় পড়ে থাকা মানুষগুলোকে দেশগৌরব অনুভব করানোর সহজতম উপায়, এক শত্রুর প্রেক্ষিতে দেশের ধারণার নির্মাণ। অতএব, নিজের সোনার দেশটি বিভিন্ন চক্রান্তের শিকার হচ্ছে, এমন ধারণা চারিয়ে দেওয়া। শত্রু দেশের বাইরে যতখানি, দেশের ভিতরেও তেমনই। অতএব, অবিশ্বাস সন্দেহ জাতিবিদ্বেষ – জেনোফোবিয়া। এই শত্রু খুব প্রবল না হলে তার বিপরীতে আবেগটা জোরদার হয় না, আরেকদিকে শত্রুকে খুব শক্তিশালী হিসেবে প্রতিপন্ন করলে মানসিকভাবে আগেই হেরে যাওয়া বা হতাশার সম্ভাবনা – অতএব, নির্মিত হয় এক আশ্চর্য শত্রু, যে কিনা একাধারে প্রবল পরাক্রমশালী ও নিতান্ত ঠুনকো।

এমন শত্রুর বিরুদ্ধে যাঁরা সরব ও সক্রিয় নন, তাঁরা অবশ্যই দেশের শত্রু। কেননা, ফ্যাসিবাদ সবসময়ই বিশ্বাস করে, হয় তুমি আমার পক্ষে নাহলে শত্রুপক্ষের। সেক্ষেত্রে সব সঙ্ঘর্ষবিরোধী যুদ্ধবিরোধী শান্তিকামী মানুষকেই দেশের শত্রু হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া যায়। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র মানে নিরন্তর যুদ্ধের প্রতিশ্রুতি, যুদ্ধের প্রস্তুতি। যুদ্ধও। অথচ যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন ফ্যাসিস্ট শাসক দেখাতে চায়, সে প্রায় স্বর্গরাজ্য, সেখানে সঙ্ঘর্ষের প্রশ্ন নেই। এই স্ববিরোধ ফ্যাসিবাদে অনিবার্য।

আরেক স্ববিরোধ এলিটিজম ও আমজনতাকে মেলানোর চেষ্টায়। জাতিগত শ্রেষ্ঠতার তত্ত্ব, যে মোড়কেই পেশ হোক না কেন, সংশ্লিষ্ট জাতির প্রতিটি মানুষকেই শ্রেষ্ঠ হিসেবে মান্যতা দেয়। দলের প্রতিটি মানুষই উচ্চ-গোত্রের, এবং যেহেতু দেশের প্রতিটি মানুষই (শত্রু হিসেবে চিহ্নিত গোত্রভুক্ত মানুষেরা বাদে) দলে যোগ দিতে পারেন – অতএব প্রত্যেকেই উচ্চগোত্র পদবাচ্য হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেন। এদিকে নেতা জানেন, তিনি এই মানুষদের শাসক। শুধু শীর্ষনেতা নন, প্রায় সামরিক হায়ারার্কি মেনে দলীয় কাঠামোয় প্রতি নেতা তাঁর নিচের ধাপের নেতাদের অধস্তন ও নিম্নগোত্রীয় হিসেবে দেখেন। এবং এভাবেই, এমনকি স্থানীয় স্তরের নেতা, যাঁর নিচে কয়েকজন হলেও কর্মী আছেন, তিনি নিজেকে এলিট হিসেবে ভাবার সুযোগ পান। এই ধাঁচটিকে একো ‘মাস এলিট’ নামে চিহ্নিত করেছেন।

গণতন্ত্রে জনগণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। সংখ্যার হিসেবেই তাঁদের জোর বেশি। সংখ্যাধিক্যের জোরেই তাঁরা সরকারি সিদ্ধান্তকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। অন্তত পারাটা সম্ভব। ফ্যাসিবাদে ফ্যাসিস্ট নেতা তথা সরকার নিজস্ব এজেন্ডা তৈরি করেন। সেটিকেই দেশের ও সামগ্রিক নাগরিকসমাজের এজেন্ডা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। জনগণের দায়িত্ব নিজেদের উপযুক্ত ‘জনগণ’-এ পরিণত করা। অর্থাৎ শাসক-নির্দিষ্ট ‘দেশের ও দশের চাহিদা’-ই যে সঠিক দিশা, জনগণের যে ইচ্ছের অছি ফ্যাসিস্ট শাসক – জনগণের একমাত্র কর্তব্য এমন মহান ভাবনার উপযুক্ত ‘জনগণ’ হয়ে ওঠা।

আরও আছে। কিন্তু শুরুতেই বলেছি, উমবার্তো একো-র Ur-Fascism নিবন্ধের সমগ্র ভাষান্তর বা সারমর্ম পেশ বর্তমান লেখকের উদ্দেশ্য নয়। নাতিদীর্ঘ ও সুখপাঠ্য প্রবন্ধ। ইন্টারনেটে সহজেই মেলে। চাইলেই পড়ে নিতে পারেন। আমি শুধু সেই প্রবন্ধ থেকে কিছু কথা নিজের মতো করে পড়ে দেখলাম। পড়তে পড়তেই আপনাদেরও পড়ালাম। আবারও মনে করাই, রাজ্যের বা দেশের সাম্প্রতিক প্রেক্ষিতের সঙ্গে মিলিয়ে ভাবার দায়িত্ব আপনার।

এই অতিমারী পার করে আমাদের দেশটি খুব সুখকর অবস্থানে রয়েছে, এমন তো নয়। আমাদের রাজ্যটিও তেমনই। অতিমারীর পূর্বেও দুর্দান্ত ভালো ছিলাম, এমন বলতে পারি না – বরং উল্টোটাই। তবে পরিস্থিতি যে আরও অনেক খারাপ হয়েছে, এটুকু নিশ্চিত। আর্থিক অসাম্য বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক তীব্র – সামনে উচ্চবিত্ত পদভুক্ত হয়ে ওঠার স্বপ্ন, আরেকদিকে নিম্নবিত্ত শ্রেণীতে পিছলে নেমে যাওয়ার ঘোরতর বাস্তব সম্ভাবনা। অপরদিকে, নিম্নবিত্ত শ্রেণী প্রায় অস্তিত্বের সঙ্কটে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার মুখে। ইশকুল, হাসপাতাল, দোকানবাজার – মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত জীবনের যে কমন ইন্টার-অ্যাকশন পয়েন্টগুলো, প্রাইভেট স্কুল বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও অনলাইন শপিং-এর ঠেলায় সে পরিচিতির সুযোগ হাপিশ। অপরিচিতি ও বিচ্ছিন্নভাবে বেঁচে থাকার দুনিয়ায় অবিশ্বাস মাথাচাড়া দেয় বড় সহজে। ইতিহাস সাক্ষী, এমন সামাজিক-আর্থসামাজিক অনিশ্চয়তা ও বিচ্ছিন্নতা গোলমেলে রাজনৈতিক মতাদর্শের পক্ষে উর্বর জমি। ফ্যাসিবাদ তার একটি প্রকার হতেই পারে।

এদেশে ফ্যাসিবাদের বিপদ নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন। অতিমারীর আগে থেকেই। অতিমারীর মাঝে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। অতিমারী চলাকালীন রাষ্ট্রীয় বিবিধ পদক্ষেপের সুবিধে-অসুবিধের ইস্যুকে ছাপিয়ে এই ফ্যাসিবাদের বিপদই মূল এজেন্ডা হিসেবে উঠে এলো। কাজেই, ফ্যাসিবাদ যে বিপজ্জনক, সে নিয়ে প্রায় কারোরই সেভাবে সংশয় নেই। কিন্তু সেই বিপদের চিহ্নগুলি যে ঠিক কী, তা নিয়ে ধারণা না থাকলে? ঘোলাজলে মাছ ধরার লোকের তো অভাব নেই আশেপাশে! ক-কে ছেড়ে খ-কে, বা খ-এর জায়গায় গ-কে আপনি বাছতেই পারেন – স্থানীয় দাদাগিরিতে বিরক্ত হয়েই হোক, বা ‘ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’ শুনে৷ সে আপনার অধিকার। কিন্তু স্থানীয় দাদাগিরির চেহারা আপনার কাছে যতখানি স্পষ্ট, ফ্যাসিবাদের চিহ্ন হয়ত ততখানি নয়। আবার দাদাগিরির মধ্যে দিয়েও তো ফ্যাসিবাদের চিহ্ন প্রতিফলিত হতে পারে। অথবা রাজনীতি বা সমাজের প্রতিটি পরিসর বিরোধীশূন্য করার প্রয়াসের মধ্যে দিয়েও। ছোট ছোট পদক্ষেপ দিয়েই তো বড় অবনতির সূচনা হয়। ক, খ, বা গ – কাকে বাছবেন, কেন বাছবেন, কখন কী প্রেক্ষিতে বাছবেন, সে নিয়ে আমার বক্তব্য বিশেষ নেই। কিন্তু ফ্যাসিবাদের প্রাথমিক চিহ্নগুলো মাথায় গেঁথে নেওয়া জরুরি। সেটুকু স্পষ্ট করতে চেয়েই এত কথার অবতারণা। 

একো-র প্রবন্ধের একটা ছোট ঘটনা দিয়ে এই লেখা শেষ করব।

১৯৪৫ সাল। এপ্রিল মাস। মুসোলিনি-রাজের পতন ঘটছে। একের পর এক শহরের দখল নিচ্ছেন প্রতিরোধ আন্দোলনের শক্তি। উমবার্তো একো-র ছোট শহরটিতেও তেমনই ঘটল। সেই শহরে প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতা ছিলেন যিনি – তেমন বিখ্যাত কেউ নন – তাঁর নাম ছিল মিমো। লড়াইয়ের শুরুতেই একখানা পা হারিয়েছিলেন তিনি। আন্দোলনের সাফল্যের শেষে তাঁকে ঘিরে অনেক হইচই। শহরের টাউন হল-এ প্রচুর লোক জমা হয়েছেন। মিমো-র জন্য প্রতীক্ষা। তাঁকে নিয়ে প্রবল জনোচ্ছ্বাস। টাউন হলের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন মিমো। ক্লান্ত মুখে হাত তুলে জনগণকে শান্ত হতে অনুরোধ করলেন। কিশোর একো প্রতীক্ষায়, মিমো-র ভাষণ শুরু হবে এইবার। প্রতীক্ষা, কেননা একো-র কৈশোর কেটেছে মুসোলিনির মস্ত সব লম্বাচওড়া ভাষণ শুনে। শুধু শোনা তো নয়, সেসব ভাষণ স্কুলেও পাঠ্য ছিল।

মিমো ব্যালকনিতে দাঁড়ালেন। প্রায় শোনা যায় না, এমন গলায় বললেন…

নাগরিক বন্ধুরা, অবশেষে আজ আমরা এখানে পৌঁছাতে পেরেছি। কত রক্ত, কত আত্মত্যাগ… স্বাধীনতার জন্য যাঁরা প্রাণ দিলেন, তাঁদের সম্মান জানাই…

ব্যাস, এটুকুই। করতালি জয়ধ্বনি উচ্ছ্বাসে ভেসে গেল চারপাশ। 

আর কিশোর একো শিখলেন, স্বাধীনতা বাকস্বাধীনতা মানে নেতাদের লম্বাচওড়া বাকতাল্লা শুনতে হওয়ার থেকেও মুক্তি। ফ্রিডম অফ স্পিচ মিনস ফ্রিডম ফ্রম রেটরিক। 

[প্রথম মুদ্রণঃ সহজিয়া ২০২২ মে মাসে ঈদ সংখ্যায় ]

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *