উইকেটে টিকে থাকতে হবে

বজরা ঘোষ

পোশ্ন হচ্চে কী করে সামলাব? একসাথে এত কী করে ঠেকাই আমরা? করোনায় উজাড় হয়ে যেতে পারি, আরো বেয়াড়া বাতব্যাধি আসতে পারে, খাবার নিয়ে টানাপাড়ি পড়বে, অর্থনীতির তো এমনিই পোঙা মেরে চোদ্দ সিকে করে ছেড়েছেন মোদি ভাই, তার ওপরে এই ঝাপ্টা সামাল দেওয়ার মত অবস্থা আম পাব্লিকের নেই। যাঁরা ঊনসত্তর তলায় বসে ভাবছেন আমি তো ভাল আচি, আজ্ঞে না স্যার, আপনি মোট্টে ভাল নেই। মানুষ কেড়ে খেতে বাধ্য হলে সরকার আপনার পাশে দাঁড়ানোর লোকবল দেবে না। কারণ যাদের ভরসায় বুক বাজাচ্চেন সেই সব রাজনীতির ফেরিওয়ালাদের ঘর থেকে আরক্ষা পোতিরক্ষার লোক আসে না। লুটমার কী জিনিস চোদু মধ্যবিত্তের ধারণার বাইরে।

আমফান এসে সিকি-মরা লোকগুলোকে আধমরা কোরে ছেড়েচে। নিজেদের জন্য ভাবার পাশাপাশি অল্প অল্প করে বাকিদের জন্য ভাবলে কিছুটা সুরাহা তো হয়ই। একে অপরের পাশে দাঁড়াতে পারি, একটুখানি টিকে থাকতে হবে।

বুড়োরা বলেন উইকেটে টিকে থাকলেই রান আসে।

সারাদিন কেচ্ছা আর ধম্মো নিয়ে খেউড় বন্দ হয়নি। হবে কী করে? ওইটিই তো অক্সিজেন। হেঁদুরা মোচুমানকে খেস্তায়, মোচুমান হেঁদুদের। সারাদিন ঘেন্না আর বিষ উগরাচ্চে। শিক্ষিত ডাক্তার, উচ্চ শিক্ষিত কবি, সুপার সাহিত্যিক, বাম্পার বলপ্লেয়ার, সমাজসচেতন সায়িত্যিক, সকলেই থুতু ছিটাচ্চেন, উগরাচ্চেন খোস পাঁচড়ার বীজ। মোল্লা মুমিন পুরোহিতের তবে দোষ কোতায়? তার সাথে ফেক নিউজ, পাল্টা ফেক ছবি, গালমন্দ, হুমকি, কত কী। আহ্লাদী সরকার দশটা করোনা রোগী ধরা পড়লে, দুটো বলে রেকর্ড বানায়। রাজ্যের মুখ এমন উজ্জ্বল হয় যে চোক ঝলসে যায় মাজে মাজে।

গনতন্ত্রের চারটে ল্যাওড়ার একটি বিশেষ ল্যাওড়া হল মিডিয়া। তো তাদের, মানে পেসালি টিভি চ্যানেলের কোনো কাজ নেই। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের নামে ঢ্যামনামি চলচে। মহম্মদ শেলিমের মেসোমসাই আজ খেলেন মোচার ঘন্ট, মিমি চক্কোত্তির মাসিশ্বাশুড়ি রাঁদচেন চালকুমড়োর ছক্কা, দিলিপ ঘোষ আজ পরেচেন দেশওয়ালি ঘাগরা! এই হচ্চে আজকের হিট নিউজ।

টিকে থাকতে আমরা পারব, বা পারব না। চেষ্টা কত্তে দোষ কী!

একটা খেলার বাসি গপ্প বলি–টিকে থাকা কারে কয়।

১৯৮৬-৮৭ সালের ইমরান খানের পাকিস্তান বনাম কপিলের ভারত। চারটে অমীমাংসিত ম্যাচের পর ফিফথ টেস্টের লাস্ট ইনিংসে মাত্তর ২২১ রান তুলতে হবে। অমরনাথ, বেংসরকার, আজহার, শাস্ত্রি, কপিলদেব আচেন। চিন্তা কি? কিন্তু এক এক করে বিদায় নিলেন নক্ষত্রেরা। দিনের শেষে ৮০ রানে চার চারটে উইকেট খুইয়ে ধুঁকচে ভারত। লড়চেন গাওস্কর আর আজাহারুদ্দিন। পরের দিন সকালে দেখা গেল বল মাতলা নদীর মত ঘুরচে। পিচে গর্ত। ব্যাট তোলাই যায় না। বোঝা গেল ক্রিকেটের ভগবান এসেও আজ বাঁচাতে পারবে না ইন্ডিয়াকে। আজাহার, কপিল, শাস্ত্রী তিন মহারথী উল্টে পড়লেন। সাত উইকেটে ১৬১।

এত কান্ডের মধ্যে উল্টোদিকে একটাই লোক টুক টুক করে খেলচেন। ছোট্টখাটো মানুষটা য্যান হিমালয় হয়ে উটচেন আস্তে আস্তে। তার পতন নেই। হারার আগে হার মানবেন না। চক্রব্যুহে অভিমন্যুকে যেভাবে ঘিরেচিল সেভাবেই থাবা পেড়েচে বিপক্ষের ফিল্ডার।

তিনি গাভাস্কর। সাপের ছোবলের মত ডেলিভারিকে নির্বিষ করে ফিরিয়ে দিচ্চেন বাউন্ডারিতে। ভারত ম্যাচ হারল বটে, কিন্তু সাড়ে পাঁচ ঘন্টা একা কুম্ভের মত লড়ে লোকটা ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়ে মাঠ ছাড়ল।

এই হল উইকেটে টিকে থাকা। এই হল চোয়ালচাপা লড়াই।

অভিমন্যু আর রানা কুম্ভ দুজনেই মারা গ্যাচিল, হেরে গ্যাচিল। কিন্তু লড়েচিল, ছাড়েনি ময়দান। বিপক্ষের করোনা, আমফান, পঙ্গপাল, ধর্ম, রাজনীতি, ঘেন্না, বিদ্বেষ, হানাহানিকে সপাটে বাউন্ডারিতে না পাটাবার চেষ্টা কল্লে মুক্তি নেই। তার জন্যে ক্ষতবিক্ষত হতে হবে, কিন্তু আউট হলে চলবে না। ঠান্ডা মাথায় খেলা চাই। ছোট ছোট মানুষের অনেকগুলো ছোট ছোট ভাল কাজ ঠেকিয়ে দিতে পারে অল্প কটা খারাপ লোকের বিরাট অপশক্তি।

কী জানেন যুগ যুগান্ত থেকে আমরা মারি নিয়ে ঘর করি। ব্রয়লার মুরগি যেমন সামান্য রোগে পটকে যায় দেশি মুরগী সহজে মরে না৷ পোকামাকড় কচুঘেঁচু খেয়ে ইমিউনিটি এমন বাড়িয়েচে যে ফুলের ঘায়ে মুচ্চো যায় না।

জেমস লং সায়েব লিকেচিলেন ম্যালেরিয়ার দাপটে দামড়া সায়েবরা পটাপট মরত কিন্তু নেটিভ ভিকিরিদের কিচু হত না। হবে কী করে? কলেরা, বসন্ত, কালাজ্বর, পালাজ্বর প্লেগ, কত্ত কত্ত মহামারিকে টপকে বেঁচে আচে এই বাঙালি। কত দুর্ভিক্ষ বন্যা আশ্বিনের ঝড় খরা মড়ক অজন্মা সামলে উঠে দাঁড়িয়েচি শেষমেশ।

অমন যে আমেরিকা বার বার আর্থিক মন্দায় মুখ থুবড়ে পড়েচে, আমরা পড়িনি। কারণ আমরা চাষার জাত যে। আদ্ধেক পৃথিবীকে খাবার জোগাই। আমাদের কৃষকরা দশ আনা রোজকার করলে জন্ম জন্মান্তর থেকে দু আনা সঞ্চয় করতে ভোলে না। বচরের পর বচর চোট খায়, ফসল মরে, বাজার দর পায় না, সর্বস্বান্ত হয়, আত্মহত্যা করার আগে আবার শেষ চেষ্টা করে ধান গম বুনে দেখায়। এরকম লড়াকু জাতির বংশ আমরা।

শোলে সিনেমায় ঠাকুর তো আমাদেরই বলেছিল ‘চাচা, আমরা যোদ্ধা নই, চাষী। এ দেশ যুগ যুগ থেকে কিষাণের দেশ৷ কিন্তু যতবার হানাদার হামলা করেছে গঙ্গা কসম লাঙলের ফাল গলিয়ে তলোয়ার বানিয়েছি আমরা’।

এবার ভাল কতায় আসি।

চাঁদে টিনটিন পড়েচিলেন? একদম লাস্ট পাতায় চলে যান। ক্যালকুলাস যকন বলল, চাঁদে আমাদের পায়ের ছাপ ককোনোই মুচবে না। আমরা আবার ফিরে যাব.. আমাদের প্রাণের হ্যাডক খুড়ো পেল্লায় ধমক মেরে বলেচিল, শালা, চাঁদ একটা যাওয়ার জায়গা হল? আমাদের পৃথিবীই ভাল।

করোনা থাকবে, আম্ফানও আসবে, মন্দির মসজিদের লাঠালাঠি ভি উধাও হবে না। তাও নীল গ্রহটা সুন্দর। কারণ বন্যা ঝড়ে উজাড় হয়ে যাওয়া পরিবার, দু মুঠো ভাত রাঁধলে আধমুঠো প্রতিবেশীর অভুক্ত বাচ্চাটাকে আজো তুলে দেয়, লকডাউন ঠেলে অচেনা মানুষকে রক্ত দিয়ে আসে আরেকজন অচেনা মানুষ।

এটাই সভ্যতা, আর সেটা টিকিয়ে রাখে তারাই, যারা ম্যান অফ দ্য ম্যাচ। উইকেটে টিকে ছিল। হারা জেতা তো বলবে ভবিষ্যৎ।

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *