দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া, হঠাৎ শুনি রাতের কড়া নাড়া…

বর্ণালী মুখার্জী:

মুসলমানদের নামে চারটে গালাগাল না দিয়ে যে আরএসএস-এর নেতারা এক ঢোঁক জল খায় না, সেই তারাই আজ তালিবানদের নিয়ে, একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি। চীনের ভয়ে? স্বাভাবিক। দালালি তাদের রক্তে। একটু চোখ রাঙালেই তাদের আস্ফালন শেষ। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের দালালি করে তাদের দল বড় হয়েছে। আর আজ চীনের ভয়ে নীরব! যদিও তারা এই আশাতেও আছেন যে তালিবানী অভ্যুত্থান তাদের এদেশের ক্ষমতা আরও ৩০ বছর পাকা করবে। যদিও কানাভুষোয় তাদের হয়ে নানা অবান্তর অজুহাত দিচ্ছেন তাদের পেটোয়া বুদ্ধিজীবীরা। সরকার নাকি আফগানিস্তানের মাটিতে বিনিয়োগ করা ৩০০ কোটি ডলারের মায়া কাটাতে পারছে না। তারা নাকি চীনকে আফগান খনিজ সম্পদ ছেড়ে দিতে রাজী নয়! তাই নাকি আফগান মাটি আঁকরে পড়ে থাকার ইছে মোদী সরকারের!! মোদী সরকার নিশ্চয়ই এতটাই বেওকুফ নয় যে তারা আগুন নিয়ে খেলতে চাইবে। একবার যুদ্ধ বেঁধে গেলে সরকারের ৩০০ কোটি ডলারের বদলে ৩০০০ কোটি খরচ হয়ে যাবে, সেটুকু বোঝার ক্ষমতা নিশ্চয়ই রাজনীতিবিদদের আছে। বুদ্ধিজীবীদের তা না থাকতে পারে। বুদ্ধিজীবীরা উইকিপিডিয়া ঘেঁটে চারটে নতুন তথ্য পেলেই খুশী! যদিও সরকারের কোষাগার শূন্য হলে কিই বা যায় আসে ফ্যাসিস্ট বিজেপির! উপমহাদেশে যুদ্ধ হবে, অস্ত্রের কেনা বেচা হবে, দূরে দাঁড়িয়ে আমেরিকা-ইজরায়েল মজা লুটবে, যদি অস্ত্র কেনা বেচার কমিশন নাগপুর পায় তবে ক্ষতি কী! আরএসএস-এর মনের কথা এমন হলে তা বোঝা যায়। কিন্তু ভারতের প্রগতিশীলদের কি হল? প্রগতিশীলদের শিবির থেকেই শোনা যাচ্ছে তালিবান ক্ষমতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নিয়ে তারা বিজেপির হয়ে সাফাই গাইছেন। বিজেপি নাকি নিরুপায়, কে বলছেন? প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা! তাদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হয়, তাহলে আপনারা ১৯৯১ সালে নয়া অর্থনীতির বিরোধিতা কেন করেছিলেন? যেদিন ভারত সরকারের কোষাগারে ছিল মাত্র ১৩ দিন খরচ চালানোর টাকা! নিরুপায় হয়েই কি মনমোহন সিং বিশ্বায়ন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেননি? যাই হোক, রাতের এই কড়া নাড়া দেখেও তারা দুয়ার দিয়েছেন। আসুন উত্তর খুঁজি। বর্তমান, ইতিহাসে। প্রশ্ন করি, ‘লিবারাল’রা বাড়ি আছো?

নাস্তিকদের মৃত্যুদন্ড দেওয়ার আইন আছে ৭টি দেশে—পাকিস্তান, সৌদি আরব, ইরান, আফগানিস্তান, সুদান, পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মরিশানিয়া, মালদ্বীপ ইত্যাদি। আবার অত্যন্ত দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির ব্যবস্থা আছে আরও ৫/৬ টি দেশে, যেমন মিশর, ইন্দোনেশিয়ার মত দেশে। ইরানে শেষ মৃত্যুদন্ড হয়েছিল ২০১৪ সালে। পাকিস্তানে আজও হয়নি। আজও ইরান বা সৌদিতে মেয়েদের ভোটে সমানাধিকার নেই। ইরানের মত এমন একটা প্রতিভা সম্পন্ন দেশ, যেখানে দুরন্ত সব বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পী তৈরী হয়েছে মেয়েদের মধ্যে, তারা যদি সমানাধিকার পেতো কোথায় পৌঁছে যেত তা ভাবাই যায় না। গত দশ বছর ধরে সেখানে পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলা মহিলাদের চাবুক মারা হচ্ছে, ৩০-৫০ বছরের জন্য জেল বন্দী করার হচ্ছে। পাকিস্তানে বা ইন্দোনেশিয়াতে এখনো পরিস্থিতি অত খারাপ হয়নি।

তালিবানদের এই উত্থানের পরেই উইলিয়াম ডারিয়েম্পলের বই নিয়ে খুব চর্চা শুরু হয়েছে। যেখানে এই ইংরেজ ইতিহাসবিদ আফগানদের দুরন্ত ক্ষমতার ইতিহাস লিখেছেন, রোমান্টিসাইজ করেছেন তাদের। তাঁর দেখাদেখি আফগানিস্তানের ইতিহাস চর্চা করে প্রগতিশীলরা তালিবানদের বিপদকে লঘু করার চেষ্টা করছে। প্রথম প্রথম ১৯৭৬ থেকে শুরু হয়েছিল সেই ইতিহাস চর্চা, আজ বিভিন্ন লেখা থেকে ১৮৩০ থেকেই আফগানিস্তানের ইতিহাস জানা যাচ্ছে। কিন্তু এত ইতিহাস চর্চা সত্ত্বেও নাসিরুদ্দিন শাহ থেকে জাভেদ আখতারদের দুশ্চিন্তা ঘোঁচানো যাচ্ছে না। এমন নয় যে নাসিরুদ্দিন শাহ জানেন না যে আমেরিকার শাসকরা যুদ্ধ করে, আমেরিকা বোমা বর্ষণ করে মানুষ হত্যা করে। কিন্তু তাও তিনি তালিবানদের নিয়ে ভীত। কারণ নাসিরুদ্ধিন শাহ হিন্দু বিয়ে করেছেন। কারণ নাসিরুদ্দিন শাহ শরিয়াকে ঘৃণা করেন, কারণ তিনি ধর্মাচরণ করেন কিনা তা আমরা কেউ জানি না। জানার চেষ্টাও করি না আমরা কেউ। এদেশের এটাই রীতি। এদেশে সরকারে আছে ঘরওয়াপসির হুমকি দিয়ে রাখা ফ্যাসিস্ট আরএসএস, আবার এদেশেই আছে নাসিরজীর পক্ষে থাকা রাহুল গান্ধী-ইয়েচুরি-মমতা ব্যানার্জী। তাহলে নাসিরুদ্দিন শাহ কেন তালিবানদের নিয়ে এত দুশ্চিন্তায় করছেন? কালবুর্গি বা পানসারেদের ভবিষ্যত জেনেও যখন তিনি ভয় পাননি, আজ তালিবানদের উত্থানে তিনি ভয় পেলেন কেন? কারণ তালিবানদের ছোঁওয়া এদেশে লেগে গেছে, তা তিনি আঁচ করছেন। ভারতে পানসারেকে হত্যা করা হয় আইন ভেঙে, সরকার বাধ্য হয় কাউকে না কাউকে গ্রেপ্তার করতে। দাভোলকারের পক্ষে মিছিলে-শোক সভায় দেশ ভরে যায়, তাঁর নামে রেল স্টেশন করার দাবি ওঠে। আর তাই একজন গৌরি লংকেশ মারা গেলেও অনেক লংকেশ এখনো বেঁচে থাকেন। বেঁচে থাকেন আমাদের সকলের প্রিয় নাসিরুদ্দিন শাহ। বাংলাদেশে ব্লগার হত্যা হয় গোপনে, তাই এখনো আরও কিছু ব্লগার বেঁচে থাকেন। কিন্তু তালিবানদের অভিধানে গোপনীয়তা, আইন ইত্যাদি কোনো শব্দই নেই। তারা মানুষ হত্যা করে বুক বাজিয়ে, মশা মাছি মারার মত করেই। তালিবানদের একমাত্র ভাষা, বন্দুকের ভাষা। এর বাইরে আর কোনো ভাষা তাদের জানা নেই। আইনের প্রক্রিয়ায় চলার ধৈর্য তাদের নেই। বাদী-বিবাদী পক্ষের মধ্যে তর্ক বিতর্কের মধ্য দিয়ে সত্য উদ্‌ঘাটনের কোনো প্রয়োজন তাদের নেই। কোনো একজন খোমেইনি ফতোয়া দেবেন, আর তারা দ্রুত হাত পা কেটে নেবেন। পাথর ছুঁড়বেন, চাবুক মারবেন বা শিরচ্ছেদ করে দেবেন। নাসিরুদ্দিন শাহ খুব ভাল করেই বোঝেন যে আরএসএস প্রথমে কোনো মুসলিম মারেনি। তাদের প্রথম টার্গেট ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, ‘রাম’ নামকে ভারতে রাজনীতিতে এনেছিলেন যিনি। পানসারে-কালবুর্গি-গৌরি লংকেশ-দাভোলকার, এরা সকলেই ছিলেন হিন্দু। আর তালিবানদের প্রথম টার্গেট মুসলিম কাফের। তারা নিজেরা ছাড়া, তাদের বাহবা দেন সোচ্চারে এমন মুসলমান ছাড়া, সকলেই তালিবানদের চোখে কাফের। এবং কাফেরদের হত্যা করলেই তাদের বেহেস্ত বাস পাকা। যেখানে অফুরান ফল আর মিষ্টি জল, যেখানে অফুরন্ত ভোগ বিলাস। মরুভূমিতে বসবাস করা একজনের কাছে অফুরান জলের লোভ সাংঘাতিক। তাদের চোখে নাসিরুদি শাহ তো কাফের বটেই। আর শাবানা আজমির তো কথাই নেই। তিনি একাধারে অধার্মিক, অন্যদিকে মহিলা।  

নাসিরজী, শাবানাজী খুব ভাল টের পাচ্ছেন, পাশের দেশের কু-বাতাস এদেশে পৌঁছে গেছে ঝড়ের গতিতে। সংখ্যালঘু মৌলবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে ভীষণ রকম। শুধু কাশ্মীরেই নয়। সেখানে নিপীড়িত জনগণের মধ্যে উল্লাস টের পাচ্ছে ফারুক আব্দুল্লাহ-মেহবুবা মুফতি। ফারুক আব্দুল্লাহ এখন স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন যে শরিয়া আইন মেনে সরকার তৈরী হলে শান্তি প্রতিষ্ঠা পাবে, ‘আচ্ছে দিন’ আসবে। যদিও মেহবুবা মুফতি এখনো সমর্থন জানাননি। ৩৭০ ধারা বাতিল করে, শুধু জনগণই নয়, সমস্ত দলগুলির নেতাদের গৃহবন্দি করে সেখানকার জনগণের মধ্যে তালিবান প্রেম বাড়িয়েছে দেশদ্রোহী মোদী। কিন্তু শুধু কাশ্মীর নয়, হিন্দু রাষ্ট্রের ভয়ে ভীত, নাগরিকত্ব আইনের আতঙ্কে থাকা ভারতের অন্যান্য শহরে গ্রামে থাকা মুসলিম জনগণের একাংশের মধ্যে উল্লাস স্পষ্ট। ‘এবার মোদী টের পাবে’— ভাবখানা যেন এমনই। এতদিন ধরে যে অসহায়তা তাদের কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল তার সমুচিত জবাব দিতেই যেন বা ত্রাণ কর্তা হিসেবে উঠে আসছে তালিবানরা, এমনটাই কি মনে হচ্ছে তাদের? আর সেটাই ভয় নাসিরুদ্দিন শাহ-দের। কারণ তিনি ভালই বুঝছেন তালিবান সরকারকে মোদীরা স্বীকৃতি দিয়েই দেবে অনায়াসে। দেশের মুসলিমদের তাড়াতে তারা উদগ্রীব হলেও বর্বর তালিবানদের দূতাবাস, শহরে শহরে কন্সোলেট নির্মাণ শুধু সময়ের অপেক্ষা। যে তালিবান দূতাবাসগুলি হয়ে উঠবে সন্ত্রাসবাদী ও ধর্মান্ধ তৈরী স্তম্ভ। ধর্মান্ধদের আশ্রয়স্থল। টাকা-অস্ত্রের লেনদেনের কেন্দ্রস্থল। জনগণের মুক্তিদূত সেজে যদি একবার এই ধর্মান্ধ বর্বররা প্রবেশ করতে পারে এদেশে, তবে নাসিরজীদের বেঁচে থাকাই দুরূহ হয়ে উঠবে। একদিকে তারা নিজ সমাজে একঘরে হবেন, মৃত্যুর হুমকিতে ছেয়ে যাবে তাঁর বাকি জীবন। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ নিশ্চিন্তে সাভারকারের ভাষায় কথা  বলবেন— ‘আর কতদিন আমরা হিন্দুরা এমন মিইয়ে থাকবো। আমাদের ধর্মের শত্রুরা আমাদের উদারতার প্রশংসা করে, আমাদের ভীতু করে রেখেছে। জাগো হিন্দু জাগো’। সত্যিই তো, নাসিরজী-শাবানাজী কোথায় যাবেন? তাঁরাও কি বাধ্য হবেন মাথায় ফেজ টুপি পড়তে, মাথায় হিজাব দিতে? অথবা লেসার ইভিল হিসেবে মোদীদের ভোট দিতে? দেখাও গেল ভারতের সর্বদলীয় বৈঠকে প্রতিটা বিরোধী দল সরকারের সুরে সুর মেলাল। মোদীরা নিশ্চিন্তে হিন্দু তালিবানে পরিণত হবেন। এদেশেও নাস্তিকতা নিষিদ্ধ হবে। আমি, বর্ণালী মুখার্জীই বা কোথায় যাব?

এতদিন এই বিপদ ছিল ঘর থেকে অনেক দূরে। খবরের কাগজে মধ্য প্রাচ্যের অন্তহীন যুদ্ধ ও লাশের পাহাড় দেখে শিউড়ে উঠতাম আমরা। শিয়া সুন্নী হত্যাকান্ড। কুর্দ বনাম আইসিস হত্যাকান্ড। আবার আমেরিকার বোমা বর্ষণ। সাদ্দামের ফাঁসির দিন শোক করেছি আমরা। লিবিয়ার রাস্তায় পড়ে থাকা গদ্দাফির মৃতদেহ দেখে চোখের জলও ফেলেছি। ইরানে প্রতিবাদী মেয়েদের চাবুক মারা দেখেছি, ফাঁসি হতেও দেখেছি আরবে। কিন্তু কখনো কল্পনাও করিনি আমাদের উপমহাদেশ শেষে যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিণত হবে। মোদীদের উত্থানের পর থেকেই সেই ভয় যে আমরা পাচ্ছিলাম না তা নয়। যুদ্ধ অর্থনীতির দিকেই মোদীরা এগোচ্ছে, পুঁজিবাদের সামনে এখন যুদ্ধ অর্থনীতি ছাড়া পথ নেই, একথাই বলছিলাম আমরা। কিন্তু বলা আর টের পাওয়া, জানা আর বোঝার অধ্যে যে আকাশ পাতাল তফাত। বিশেষত আমাদের মতো ভারতীয়দের কাছে, বা উপমহাদেশের মানুষদের কাছে। আমাদের কাছে যুদ্ধ একটি অনাস্বাদিত অভিজ্ঞতা। আমরা মন্বন্তর দেখেছি, খরা দেখেছি, দারিদ্রে মৃত্যু দেখেছি, কিন্তু যুদ্ধের বিভীষিকা আমরা প্রায় দেখিনি বললেই চলে। কিন্তু এখন এক্কেবারে দরজায় করাঘাত করছে যুদ্ধ!! বিশ্ব পুঁজিবাদ আবার যুদ্ধবাজ লবিতে বিভক্ত হচ্ছে। একদিকে তুরস্ক-পাকিস্তান-আফগানিস্তান-ইরান-চীন, রাশিয়া এই লবিতে পা বাড়িয়ে রেখেছে। সত্যি এত সুন্দর এক সাজানো মঞ্চ পুঁজিবাদ পাবেই বা কোথায়? একদিকে হিন্দু প্রধান দেশ, যেখানে আবার আরএসএস ক্ষমতায়। পাশে বৌদ্ধ প্রধান দেশ যেখানে আবার কিছুদিন ধরেই রোহিঙ্গা তাড়ানো চলছে। নীচে শ্রীলঙ্কা খ্রীস্ট প্রধান ও বৌদ্ধ দেশ। আর আছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান। সোনায় সোহাগা। শিয়া-সুন্নী মারামারির থেকে কম লোভনীয় নয় এই অঞ্চল অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছে।

কিন্তু দরজায় এসে দাঁড়ানো এই বিভীষিকা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় নেই প্রগতিশীল-উদার ভারতীয়রা। বরং বাস্তব হল এই প্যান ইসলামিক বর্বরদের দিকে সহানুভূতির চোখে তাকাচ্ছেন তাঁরা। ভারতে ফ্যাসিস্ট বিরোধী শিবিরের মধ্যে আছে ভোট ব্যবস্থায় বিশ্বাস না করা একাংশ। এনারা সাধারণভাবে লিবারাল। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা অন্ধ তালিবান ভক্ত। ভোট বিরোধী এই লিবারালরা সন্ত্রাসবাদী দেখলেই কেমন যেন মুগ্ধতার শিকার হয়ে যান। হয়তো আন্তর্জাতিক প্যান ইসলামী লবির থেকেই তাদেরও অস্ত্র যোগাড় করতে হয়। এদের বাধ্যবাধকতা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু ভোটে-আইনে-উদারপন্থায় বিশ্বাসীদের এমন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা কেন?

গত বছর ১৬ই অক্টোবরে ফ্রান্সের স্কুল মাস্টার স্যামুয়েল প্যাটীকে শিরোচ্ছেদ করে এক চেচেন যুবক, যার কাছে ইসলামের শান্তির কথা আকর্ষণীয় ছিল না। ভারতে যেমন নাথুরাম গডসের রামের প্রেমিক রূপটা ভাল লাগেনি। অভিযোগ হল প্যাটি নাকি ক্লাসে বাক-স্বাধীনতার মানে বোঝাতে গিয়ে হজরত মহম্মদের কার্টুন দেখান। যদিও পরে ক্লাসের এক ছাত্রী স্বীকার করেছে যে আসলে তিনি কার্টুন দেখাননি। দেখালে কি হতে পারে তা বলছিলেন!! যাই হোক সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল, সেই ঘটনার নিন্দা করতে দেখা যায়নি ফ্রান্সের, ইউরোপের বা ভারতের উদারপন্থীদের। কেন? ভারতের লিবারালদের বক্তব্য নিশ্চয়ই এমন যে এদেশে আরএসএস আছে, প্যাটি হত্যার নিন্দা করলে মোদীর লাভ হবে। আমেরিকা ও ইউরোপের প্রগতিশীলরাও হয়তো বলবেন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে দুনিয়া জুড়ে সাম্রাজ্যবাদি শক্তি সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে মুসলিম সমাজের উপর অত্যাচার নামাচ্ছে, ফলে ঘটনার নিন্দা করলে সেই সাম্রাজ্যবাদেরই লাভ। আর ইরান বা মধ্য প্রাচ্যের প্রগতিশীলদের সেই ক্ষমতাই নেই। তাদের নিজেদেরই প্রাণে বেঁচে থাকা দুঃসাধ্য। পাকিস্তান আর বাংলাদেশের প্রগতিশীলরাও নীরব ছিলেন। অথচ বাংলাদেশের হাজার হাজার মুসলিম মানুষের জমায়েত হয়েছিল, ফরাসী সরকারের গ্রেপ্তারির বিরুদ্ধে, ইমরান খান বিবৃতি দিলেন ম্যাক্রঁ-র বিরুদ্ধে।   

কিন্তু কেন? ভারতের প্রগতিশীলদের মধ্যে রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস আছে, বামপন্থীরা আছেন। তারা যদি ভেবে থাকেন, এভাবে তারা মুসলিম জনগণের সমর্থন পাবেন, ভোট পাবেন তবে মূর্খের স্বর্গে তারা বসবাস করছেন। বর্বরতাকে নিন্দা না করলে বিভ্রান্ত জনগণের সমর্থন পাবে ধর্মীয় দলগুলি। ধর্মের ভিত্তিতে ভোটের মেরুকরণ হবে। নরেন্দ্র মোদীরা ২০২৪ সালে ভোটে হারতে চলেছে, তালিবানদের উত্থানের আগে একথা যতটা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছিল, এখন আর তা যাচ্ছে না। যেমন ঐ হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে ইসলামের সংস্কার দাবি করা ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ-র জনপ্রিয়তা বেড়েছে, বৈ কমেনি। মার্কিন টুইন টাওয়ারের সুইসাইড আক্রমণ, যা আমেরিকার ৩০০০ নাগরিককে হত্যা করেছিল, তার ফলে বিশ্বের ২০ হাজার মানুষকে হত্যা করতে যুদ্ধবাজ বুশদের সুবিধা হয়েছিল। সুযোগ পেয়ে ইরাক-লিবিয়া-আফগানিস্তানকে তারা দুরমুশ করলো, সম্পদ দখল করলো। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম কৃষক বিদ্রোহ, মোপলাহ বিদ্রোহকে সাম্প্রদায়িক চেহারা যদি মুসলিম সাম্প্রদায়িক নেতারা দেওয়ার চেষ্টা না করতেন, তবে আর-এস-এস-এর জন্ম নাও হতে পারতো। গোধরার ঘটনা বিজেপি নিজেই ঘটিয়েছিল বলেই সন্দেহ করা হয়, কিন্তু সেই ধরনের ঘটনা দেখিয়েই তারা গুজরাটে নারকীয় হত্যাকান্ড চালিয়েছিল। ফলে এই ধরনের সন্ত্রাসী আক্রমণ সাম্রাজ্যবাদকেই গণহত্যা চালানোর লাইসেন্স প্রদান করে। লিবারালরা কি ভুলে গেছেন এই সব অ আ ক খ?

সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি প্রগতিশীলদের এক সহজাত সহানুভূতি আছে। থাকারই কথা। জনগণের মধ্যেই আছে আত্মত্যাগী চরমপন্থীদের প্রতি সমর্থন। চলচ্চিত্রে, সাহিত্যে যার বহিঃপ্রকাশ হরদম আমরা দেখি। ক্ষুদিরামের প্রতি সহানুভূতি থাকারই কথা। লেনিনের দাদার প্রতি সহানুভূতি থাকারই কথা। কিন্তু বামপন্থীরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে অনুশীলন সমিতি আর আরএসএস এক নয়। সাভারকার দুই দলে থাকলেও এক নয়। তিলক আর মুনজে এক নন। মদনমোহন মালব্যের কংগ্রেস অধিবেশনের বক্তব্য আর হিন্দু মহাসভার মঞ্চে ভাষণ এক নয়। উদারপন্থীরা এটাও স্বীকার করবেন যে লেনিনের দাদা রাজাদের মারতেন। সেদিনের ট্রাম্প, মোদীদের মারতেন। ক্ষুদিরাম ভুল করে একজন সাধারণ ইংরেজ রমনীকে মেরেছিল। সামুয়েল প্যাটিকে যাদের উস্কানিতে হত্যা করলো এক তরুণ, তাদের কাছে শ্রেণী বিভাজন বলে কিছুই হয় না। তারা গরীব অসহায় কাফেরকে হত্যা করতে এক লহমাও ভাবে না। শিশুদেরকেও না। ফলে এলটিটিই-র সুইসাইড স্কোয়াডের এক মেয়ের সাহসের সাথে এই বর্বর তালিবানী ধর্মান্ধদের ভীরুতার কোনো তুলনা চলে না। যাদের আত্মত্যাগের প্রাকশর্ত হল স্বর্গবাসের নিশ্চয়তা প্রদান, তাদের আর যাই থাকুক সাহস নেই। এমনকি গডসের কাছেও স্বর্গলাভের তেমন কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল বলে জানা নেই। ভগৎ সিং, যিনি নাস্তিক, ফাঁসির পর আর তার জন্য কোনো দ্বিতীয় জন্ম অপেক্ষা করে নেই যিনি জানতেন, তার সাথে এই বর্বরদের তুলনা না করাই শ্রেয়। উইলিয়াম ডারিয়েম্পল, এক সাক্ষাৎকারে শেষমেশ বললেন যে আফগান যুদ্ধে না গিয়ে ইংরেজদের উচিত ছিল মুঘলদের মত এই আদিম যাযাবরদের পয়সা দিয়ে কিনে রাখা!

কিন্তু সন্ত্রাসবাদের প্রতি উদারবাদীদের সহানুভূতির আর একটি কারণ লক্ষ করা যায়। তারা অনেকেই ভাবেন যে সন্ত্রাসপন্থা ভাল। তারা নিজেরা যেটা করতে পারছেন না সেটা সন্ত্রাসবাদীরা করলে তারা খুশি হন। মনে করেন অর্দ্ধেক কাজ এগিয়েই গেল বোধহয়।  

কিন্তু বিষয়টা স্রেফ এটুকুই নয়। প্রগতিশীলদের বিভ্রান্তির শিকড় আরও গভীরে রয়েছে।

বামপন্থীরা মনে করেন সাম্রাজ্যবাদ বনাম জনগণের দ্বন্দ্বই এই মুহূর্তে প্রধান দ্বন্দ্ব। সেই জনগণের প্রতিনিধিদের মধ্যে থাকবে ধর্মান্ধ তালিবানরাও। তাই উপনিবেশ মুক্ত করার সংগ্রামে তারাও এক অর্থে স্বাধীনতা সংগ্রামী, বলতে চান কম্যুনিস্টরা। ফলে তালিবানদের উত্থানের মধ্য দিয়ে যত না ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে বেশী লাভ হয়েছে আমেরিকাকে তাড়িয়ে, এমনটাই বক্তব্য বামপন্থী প্রগতিশীলদেরও।

প্রগতিশীলরা আজ এক চরম দৈন্যের শিকার হয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদ কেন বর্বরদের জন্ম দিল, সেই প্রশ্ন না তুলে তারাই আজ বর্বরদের সমর্থন করছেন। অজুহাত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা!! তারা ভুলে যাচ্ছেন, সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়। যে পুঁজিবাদ বিজ্ঞানের আর গণতন্ত্রের আধুনিকতম স্লোগান তুলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিল। যে পুঁজি এই সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসে ধর্ম-কুসংস্কারের সাথে আপোষ করে বলেই কম্যুনিস্টদের প্রয়োজন হয়। কামাল পাশাকে প্রশ্রয় না দিয়ে, আফগান প্রতিবাদী মহিলা কুবরা খাদেমিকে প্রশ্রয় না দিয়ে সেই পুঁজিবাদের ধারক বাহক আমেরিকা আজ সৌদি আরবকে বা মায়ানমারের সরকার বা মোদী সরকারকে প্রশ্রয় দেয়, এই কারণেই মার্কিন নাগরিকদের কাছে সমাজতন্ত্রের, উদারপন্থার, বামপন্থার, প্রগতিশীলতার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ওয়্যাফত্‌দের সংস্কারকে সাহায্য না করে মুসলিম ব্রাদারহুডদের জন্ম দেয়, প্রশ্ন তা নিয়ে। ওবামা বা বুশ, সংস্কারপন্থীদের সাহায্য না করে ওয়াহাবি ও সালাফিদের সাহায্য করেন, প্রশ্ন তা নিয়ে। এক কথায় বললে পুঁজিবাদ নিজেরা যে স্লোগান তুলেছিল, তা নিজেরাই কার্যকর করে না, বা বিপরীত অবস্থান রাখে বলেই সমাজতন্ত্রের গুরুত্ব পৃথিবীতে টিকে আছে। তার বদলে সাম্রাজ্যবাদ নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বে যে বর্বর শক্তিদের কাজে লাগায়, আইসিস বা আল কায়দা বা তালিবান, যারা একচেটিয়া পুঁজির এজেন্ট, সেই বর্বরদের তাঁবেদারি করলে প্রগতিশীলদের, বামপন্থীদের, সমাজতন্ত্রের কোনো গুরুত্বই আর থাকে না। বর্বরতার বিরুদ্ধে লড়াই করে যে পুঁজিবাদের জন্ম, সেই বর্বরতাকে আঁকড়ে ধরে আছে বলেই এই ব্যবস্থা থাকবে না। তার বদলে আজ প্রগতিশীলরাই সেই আদিমতাকে আলিঙ্গন করছেন! সাম্যবাদীরা নিজেদের আগে যদি আদিম বিশেষণ যুক্ত করে আনন্দ পান তাতে বিশ্বসংসারের কিছুই এসে যায় না। কিন্তু বিশ্বসংসার জানে যে আদিম সাম্যবাদ দিয়ে এক বিন্দুও উন্নতি সম্ভব ছিল না বলেই শ্রেণী বিভক্ত সমাজের জন্ম হয়েছিল। এখন একচেটিয়া পুঁজিই যখন সেই আদিমতা ফিরিয়ে আনতে চাইছে, তখন পুঁজিবাদের তুলে ধরার স্লোগানগুলোকে রক্ষা করার দায়িত্ব একমাত্র বামপন্থীদেরই। আমেরিকা যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়ে আফগানিস্তান দখল করেছিল সেগুলো তারা পালন করেছিল কী? দেশ জুড়ে মেয়েদের শিক্ষা, চাকরির ব্যবস্থা হয়েছিল কী? কেন কুবরা খাদেমিকে প্যারিসে গিয়ে থাকতে হল মার্কিন মিলিটারির শাসনের সময়ে? ইংরেজরা ভারত দখল করার সময় যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার কতটা তারা পালন করেছিল? বামপন্থীদের পূর্বসূরী রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত, ডিরোজিও বা এমনকি রবীন্দ্রনাথ এই প্রশ্নগুলিই তুলেছিলেন। প্রগতিশীলরা একদিকে ভীমা কোরেগাঁও যুদ্ধের বর্ষপুর্তি পালন করেন, অথচ আমেরিকা বিরোধিতার নামে তালিবানদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন করেন! এ এক বিড়ম্বনা! সকলেই জানেন যে এই যুদ্ধ আসলে ভারতীয় পেশোয়াদের পরাজয়ের আর ইংরেজদের জয়ের দিন। সাম্রাজ্যবাদের প্রতিষ্ঠার দিন। পেশোয়া স্বদেশী রাজারা এতটাই নিষ্ঠুর ছিল যে তাদের বিরুদ্ধ্বে মাহার জাতির প্রজারা ইংরেজ সৈন্যে নাম লিখিয়েছিলেন। প্রথম সিপাহী বিদ্রোহের ঠিক এক বছর আগে খ্রীস্টান বিরোধী, ইংরেজ বিরোধী হিন্দু ধর্মের প্রতিক্রিয়াশীল পান্ডাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিদ্যাসাগর ইংরেজদের সাহায্যে বিধবা বিবাহ আইন চালু করেন। আবার পরের ইতিহাসও তাই। আম্বেদকার ইংরেজ দালালির অভিযোগ নিয়েই প্রতিনিধি দল নিয়ে নিজেদের দাবি সনদ পেশ করে আসেন সাইমন কমিশনের কাছে। মুসলিম লীগও শেষ দিন পর্যন্ত চেয়েছিল ইংরেজরা থাকা অবস্থাতেই ভবিষ্যত সংবিধান, রাজ্যগুলির গ্রুপিং, স্বশাসনের ফর্মুলা পাকা করতে। তার জন্য যদি আরও কয়েক বছর ইংরেজদের থাকতে হয় তবে তাই ভাল। আম্বেদকারেরও শেষ দিন পর্যন্ত একই অবস্থান ছিল। আম্বেদকার বা মুসলিম লীগ, কারুরই বিকল্প ছিল না। আজকে ভারতের প্রগতিশীলরা, যারা ‘জয় ভীম’ আর ‘ইংকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান একই সাথে তোলেন, তাদের মুখে তালিবান সমর্থন শোভা পায় না।  একই অভিযোগ উঠেছিল লেনিনেরও বিরুদ্ধে। তাকে বলা হয় জার্মানির দালাল, কারণ তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিজের দেশের সরকারের পতন চেয়েছিলেন, যে সরকার তখন জার্মানির বিরুদ্ধে লড়ছে, এবং বিপ্লবের পরে ব্রেস্ট লিভস্ক চুক্তি করে সেই জার্মানির হাতেই পোল্যান্ড ছেড়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের নিখিলেশ, বা এক অর্থে রবীন্দ্রনাথ নিজেও ছিলেন ‘ইংরেজ ভক্ত’। বিদ্যাসাগর, রামমোহন সকলেই তাই। অর্থাৎ প্রগতিশীলতাকে কোনো বিদেশি শক্তির অজুহাতেই দমিয়ে রাখা যাবে না। তাই মার্ক্স ভারতের দমবন্ধ পরিবেশ ভাঙতে ইংরেজ শক্তির অবদান স্বীকার করেছেন, সিপাহী বিদ্রোহের মাত্র ৪ বছর আগে। তার মানে এমন নয় যে মার্ক্স ইংরেজদের প্রশংসা করেছিলেন। স্পষ্টই বলেছেন যে ইংরেজরা ভারতের রাজাদের পররাষ্ট্র লুট বা যুদ্ধ আর প্রজাদের লুট বা অর্থদপ্তর দখল করলো ঠিকই কিন্তু তিন নম্বর যে দপ্তর আর্থাৎ দেশের প্রজার উপকারের জন্য সেচ, জল ইত্যাদির ব্যবস্থা করার দপ্তর, তা গ্রহণ করলো না। এই কথা বলে তিনি ইংরেজদের লুটের উদ্দেশ্যকে ঘোষণা করছেন ঠিকই, কিন্তু এই বিদেশী শক্তিই যে পানা পুকুরের মধ্যে আবদ্ধ, যুগের পর যুগ ধরে টিকে থাকা, গ্রামের সীমানা লংঘন না করা ভারতীয় জীবনকে তছনছ করেছিল, সেই আনন্দ তিনি চেপে রাখেননি। যদিও বিকল্প গড়ে ওঠেনি, কিন্তু সেই আবদ্ধ জীবনকে ভেঙ্গে দিয়েছিল ইংরেজ লুন্ঠন, ইংরেজ নিষ্ঠুরতা, আর ইংরেজ ম্যাঞ্চেস্টার, অস্বীকার করেননি মার্ক্স। সিপাহী বিদ্রোহ সম্পর্কে মার্ক্সের লেখায় যেমন ইংরেজদের সম্পর্কে অনেক প্রশংসা নেই, তেমনই নেই সিপাহীদের সম্পর্কেও বাড়তি প্রশংসা। আগ্রা, কানপুরে পেশোয়া রাজশক্তির প্রতিনিধি নানা সাহেব ও তাঁতিয়া টোপে ইংরেজ মহিলা ও শিশুদের হত্যা করেছিল তার কিছুটা বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। ১৮৫৩ সালে যে বর্বরতা ক্ষমাহীন ছিল, তা আজ ২০২১ সাল পরে কেমন করে সমর্থন যোগ্য হবে? আজ কাবুলের রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই আদিম দস্যুরা শপাং শপাং করে মেয়েদের চাবুক মারছে, তা দেখে অন্ধ হয়ে বসে থাকবে কোন নারীবাদী? পুরুষতন্ত্রের পাঁকে পচে যাওয়া, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার অজুহাতে নিজেদের আত্মসম্মান, গণতন্ত্র বিসর্জন দেওয়ার মত মেরুদন্ডহীন কিছু মেয়ে ছাড়া? যে সতীদাহ প্রথা ক্ষমাহীন ছিল, তা সরাতে ইংরেজদের ‘দালালি’ করা শ্রেয় ছিল। নিষ্ঠুর নানা সাহেব সেইদিন নিজেদের রাজত্ব ফিরে পেতে গরীব সিপাহীদের ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু তাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম কয়েক বছর পর থেকেই ইংরেজদের খাস চাকরে পরিণত হয়েছিল। সেদিনের পরিস্থিতিও ছিল অনেকটা আজকের মতোই। সেদিন সাধারণ সিপাহীরা ২০০ জন মহিলা শিশুকে হত্যা করতে অস্বীকার করেছিল। তাঁতিয়া টোপে তাদের মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও তারা বন্দুক ফেলে দেন। বিবিঘরের মেয়েরাও অনশন শুরু করেছিল। কিন্তু তাদের প্রতিবাদে কর্ণপাত করেনি পেশোয়া রাজ শক্তি। কসাইকে দিয়ে ছুড়ি দিয়ে খুন করা হয় শিশুদের। অথবা জ্যান্ত কুঁয়োতে ফেলে দেওয়া হয়। যার ফল ভুগতে হয়েছিল গ্রামবাসীকে, ইংরেজদের গুলিতে প্রাণ দিয়ে। যদিও নানা সাহিব নিজে পালিয়ে চলে যান আজকের আফগান প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আসরাফ গনির মতোই। সাভারকার যেভাবে সিপাহী বিদ্রোহকে দেখেছিলেন সেইভাবে মার্ক্সের পক্ষে দেখা সম্ভব ছিল না। যদিও আজকাল অনেকেই বহু চেষ্টা করেন প্রমাণ করতে যে মার্ক্স নাকি সাভারকারের মত করেই ১৮৫৭ সালের ভারত দর্শন করেছিলেন।

কেউ কেউ বলবেন কার্ল মার্ক্স, বিদ্যাসগরেদের যুগ আর আজকের যুগ এক নয়। কার্ল মার্ক্সের জীবনকালে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম ছিল না। ফলে জনগণ বনাম সাম্রাজ্যবাদ, এই দ্বন্দ্বটির গুরুত্বই ছিল না, প্রধান দ্বন্দ্ব হয় ওঠার প্রশ্ন তো ছিলই না। তাই মার্ক্সের খুব খোলাখুলি ক্রিমিয়ার যুদ্ধে বর্বর রুশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ইংরেজ-অটোমান-ফরাসী সাম্রাজ্যকে প্রগতিশীল বলতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু লেনিন-মাওসেতুং-দের যুগে এসে অমন দিলখোলা হওয়ার সুযোগ নেই।   

সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিটি সংগ্রামকে পাশে নিতে লেনিন ব্যগ্র ছিলেন। সেই সংগ্রাম যাদের নেতৃত্বেই হোক না কেন। ১৯০৫ সালে রুশ সাম্রাজ্যের দুর্বল হওয়ার সুযোগ নিয়ে মধ্য প্রাচ্য, মধ্য এশিয়া জুড়ে জন্ম নিয়েছিল রুশ সাম্রাজ্য বিরোধী মুসলিম জনগণের বিদ্রোহ। এমনকি অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেও বালকান জনগণের বিদ্রোহ। প্রজারা বেশীরভাগই মুসলিম। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন ধর্মীয় পরিচিতি সত্ত্বা নিয়ে থাকা মুসলিম নেতারা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, তুরস্কে ও ইরানে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের জন্ম হচ্ছিল উত্তর আফ্রিকা সহ অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত দেশে, অঞ্চলে। রুশ কম্যুনিস্টরা সেই সমস্ত লড়াইকে মুসলিমদের সাম্রাজ্যবাদ লড়াই হিসেবেই ঘোষণা করেছিল। যদিও শ্রেণী বিশ্লেষণ করে সেগুলিকে জাতীয় বুর্জোয়াদের লড়াই হিসেবেই তাঁরা ব্যাখ্যা করেন। রুশ বিপ্লবের পরেই তারা ঘোষণা করেন যে মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করা হবে না। ব্যক্তিগত স্তরে শরিয়া পালনে বাধাদান করা হবে না। সদিচ্ছা বোঝাতে মুসলিম প্রতিনিধিকে পার্টি থেকে কোরান উপহার দেওয়ার ঘটনার উল্লেখ করেছে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ই এইচ কার। ঘোষণাটি শুরু হয় এভাবে, “হে মুসলিম জনগণ,…To all the Muslim workers of Russia and the East’, issued by the fledgling Soviet government on 24 November 1917, stated: Muslims of Russia…all you whose mosques and prayer houses have been destroyed, whose beliefs and customs have been trampled upon by the tsars and oppressors of Russia: your beliefs and practices, your national and cultural institutions are forever free and inviolate. Know that your rights, like those of all the peoples of Russia, are under the mighty protection of the revolution…আবার ১৯২০ সালের সম্মেলনে, তাদের বলা হল যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামই তাদের ধর্মযুদ্ধ, জেহাদ। জাপানের মৌলবী বরকতুল্লাহ, মধ্য এশিয়ার সুলতান গ্যালিয়েভ ‘ইসলামীয় সমাজতন্ত্রের’ আদর্শ বহন করতে শুরু করেন। আফগানিস্তানের আমানুল্লাহও তাই। যাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে বন্ধু হিসেবেই স্বীকার করেছেন লেনিনরা। ভারতের কম্যুনিস্ট আন্দোলনের প্রেক্ষিতেও তাসখন্দে জন্ম নেওয়া ভারতীয় পার্টির অনেকেই আগে ছিলেন মুহাজিরদের অংশ, খলিফার পতনের পর, যারা আর খলিফার পতনের জন্য যারা দায়ী সেই ইংরেজ শাসনে থাকতে রাজী ছিলেন না। যে তরুনের দল আফগানিস্তানে থাকবেন বলে পাড়ি দিয়েছিলেন, তাদেরই একাংশ কম্যুনিস্ট হয়ে গেছিলেন। লেনিন যখন ১৯২০ সালে এদেশের কম্যুনিস্টদের অভিনন্দন জানালেন, তখন শ্রমিক-কৃষক যেমন বলেছিলেন, তেমনই ব্যবহার করেছিলেন এই শব্দবন্ধনী ‘মুসলিম ও অমুসলিম জনগণের ঐক্য’। অর্থাৎ এই পরিচিতিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বুখারিন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে হিন্দুদের আন্দোলন বলে অভিহিত করেছিলেন। জিনোভিয়েভ বা রাদেকের বক্তৃতাগুলিও একই মর্মবস্তুর ছিল। সব থেকে বড় কথা ব্রেস্ট লিতভস্ক চুক্তির মধ্য দিয়ে মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলিকে অটোমান সাম্রাজ্যের কাছে অর্পন করা হয়। তাদের মধ্যে সংস্কারের যে চাহিদাগুলি ছিল তাকে অগ্রাহ্য করতে বাধ্য হয় রুশ পার্টি। ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির দলিলেও স্পষ্ট করেই বলা হয় আল্লাহের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন যারা, যে শিখ মানুষরা স্লোগান দিচ্ছেন যে তাদের ধর্মই সর্বোৎকৃষ্ট , যে হিন্দুরা ধর্মের কথা বলছেন তারা সকলেই বন্ধু। আবার মাও -সেতুঙ-ও বললেন যে চীনের যুদ্ধবাজ জমিদারদের মত বর্বর শক্তিদেরকেও প্রয়োজনে জাপ বিরোধী যুদ্ধে বন্ধু হিসেবে নেওয়া যায়। তার অন্তত ১৫ বছর পরে, তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তানের জোট যেহেতু একটা বড় সময় ধরে মার্কিন দিকে ছিল, এবং সেই পর্যায়ে রুশ পার্টির সাথে চীনা পার্টির চরম শত্রুতা চলছে, তাই একটি সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে চীনের পার্টির সাথে। আবার ভারতেও চিত্রটি ছিল একই। খলিফাকে রক্ষা করার যে প্রতিক্রিয়াশীল প্যান ইসলামীয় দাবি, যাকে জিন্নাহ যদিও সমর্থন করতে চাননি, কিন্তু গান্ধীজী নিজেই সেই দাবীকে গ্রহণ করে খিলাফত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ইংরেজ বিরোধী হিন্দু মুসলিম ঐক্য গড়ে তুললেন।

উপরোক্ত উদাহরণগুলো দেখিয়ে আজ প্রগতিশীলরা তালিবানদের স্বাধীনতা সংগ্রামী বলার চেষ্টা করছেন। এবার আসুন বাস্তবটা দেখি।

ঠিক যে মাসে লেনিন হে মুসলিম জনগণ বলে অভিহিত করছে মধ্য এশিয়ার প্রতিনিধিদের, তার একমাসের মধ্যেই, ১৯২০ সালেই, কমিন্টার্নের দ্বিতীয় কংগ্রেসে স্পষ্টই বলছেন যে মেহনতী মানুষকে যাতে ক্ষমতার ভাগ দিতে না হয় তাই প্যান ইসলামিক আন্দোলনের জন্ম। কমিন্টার্নের থিসিসে তিনি লিখলেন প্যান ইসলামিকমিজিমের বিরুদ্ধ্বে জরুরী সংগ্রামের কথা। “in which feudal or patriarchal relations predominate.”….“It is particularly important to bear in mind: The need for a struggle against the clergy and other influential reactionary and medieval elements in backward countries; … the need to combat Pan-Islamism and similar trends, which strive to combine the liberation movement against European and American imperialism with an attempt to strengthen the positions of the khans, landowners, mullahs, etc.” কারণ ততদিনে আর্মেনিয়া থেকে শুরু করে তুরস্ক, সর্বত্র জাতীয় বুর্জোয়াদের স্বাধীন চরিত্রের ফাঁকা বুলি স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। ইরানের জাতীয় বুর্জোয়ার সাথে তুরস্কের জাতীয় বুর্জোয়ারা শত্রুতা করছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের সাহায্য চাইছে তারা। এই সব দ্বন্দ্ব যেমন মুসলিম জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাচ্ছে, তেমনই মধ্য এশীয় প্যান ইসলামিম্পন্থীরা চুক্তি ভঙ্গ করছে। তারা চক্রান্ত করা শুরু করে দিয়েছে। যে মুহূর্তে ব্রেস্ট লিতভস্ক চুক্তি ভেঙে দিল অটোমান সাম্রাজ্য, যে মুহূর্তে মধ্য এশিয়ার কিছু অঞ্চল নিজেদের বিদেশী শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিল, ১৯২৪ সালের মধ্যেই সোভিয়েত সরকার কিন্তু দ্রুত নিজেদের পুরোনো অবস্থা থেকে সরে এসে সেই সব অঞ্চলের মেহনতী মানুষদের স্বার্থ রক্ষা করাই প্রথম কর্তব্য হিসেবে গণ্য করলেন। ভুললে চলবে না যে সোভিয়েত বিপ্লবের আগুন সেঁকে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনগুলির নেতা হিসেবে যে ধর্মগুরুরাই থাকুন তারা যখন রুশ সরকারের সাহায্য নেবেন বলে স্থির করলেন তখন তারা এটাও বুঝে নিলেন যে তাদের দেশের ভেতরে নাস্তিকতার প্রচার হবে, তাদের দেশের ভেতরে কম্যুনিস্ট পার্টির জন্ম হবে। যদিও মস্কোর পার্টি এশীয় কম্যুনিস্ট উপর করা নির্দেশ দিয়েছিলেন মুসলিম সংস্কৃতি ও ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত না করতে। কিন্তু মেয়েদের স্বাধীনতার কথা প্রচার করতে বাঁধা দেওয়া হয়নি। কলোনতাইরা সেই কাজ মন দিয়ে করতে শুরু করেন। শুধু তাই নয়, মুসলিমদের ব্যক্তিগত ধর্মাচরণের অধিকার বহাল রাখলেও পর্দাকে বাধ্যতামুলক করা নিষিদ্ধ হল। আবার যে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে হে মুসলিম জনগণ বলে অভিহিত করা হয়েছিল, সেখানেই উপস্থিত থেকেছেন কামাল পাশা। তুরস্কের সমাজ বিপ্লবের কাণ্ডারি। আজ ম্যাক্রঁ যেটা বলেছেন সেইদিন কামাল পাশা তা করে দেখিয়ে দিয়েছেন। নজরুল যাঁকে শাবাশ জানিয়েছেন। সেই বৈঠকেই কামালের জাত শত্রু, কট্টরপন্থী এনভারকে উপস্থিত হতে দেওয়া হয়নি, বরং তার ভাষণ জিনোভিয়েভ পড়ে শুনিয়েছেন। মোদ্দা কথা প্যান ইসলামপন্থীরা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে লেনিন স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, কিন্তু তাদের হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা ছেড়ে দেননি। জোট করতে বাধ্য ছিলেন তারা। সুতরাং গণতন্ত্রের প্রাথমিক পাঠে অভ্যস্ত হতে হয়েছিল প্যান ইসলামীয়দের। নাস্তিকদের সহ্য করেই তাদের ধর্ম প্রচার করতে হবে। আজ চীনের সাথে তালিবানদের চুক্তি যদিও তা নয়। প্যান ইসলামিজমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট আন্দোলন সঙ্ঘত হতে শুরু করেছিল। আবার আলবানিয়াতে হোক্সার সাথে মাও-দের সুসম্পর্কের কথা আমরা সবাই জানি, যে আলবানিয়াতে কামাল পাশাদের তুরস্কের মতোই, হুসেনের ইরানের মতোই, নাসেরের মিশরের মতোই দোদুল্যমানতা নিয়ে হলেও সংস্কার হয়েছে। ভারতেও বাস্তবতা ঠিক তাই। মুসলিম লীগকে জোট মানতে হয়েছে। খলিফা না হেরে গেলে পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াতো তা অবশ্য কেউ জানে না। খলিফার পতন ও তার বদলে কামাল আতাতুর্কের উত্থান, এক বিরাট বিপ্লব বয়ে এনেছিল। ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি শেষ বেলায় দাঙ্গা না করে মুসলিমদের স্বাধিকারে মত দিয়েছিলেন। ঠিক যে সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারদের বিরুদ্ধে থাকা সব শক্তির সাথেই কম্যুনিস্টরা সুসম্পর্ক রাখছিল। ইংরেজদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলা মুসলিম নেতাদের পক্ষ নিয়েছিলেন তারা। আবার ভারতে ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর লীগ-কংগ্রেস-পেরিয়ার-আম্বেদকার-কম্যুনিস্টদের জোট সরকার হয়নি, তা দুর্ভাগ্যজনক। বিহারে মিমের সাথে জোট করে বিজেপি-নীতিশদের সরকারে আসীন হওয়া রোখা যায়নি তা দুর্ভাগ্যজনক। শুধু তাই নয়, নাসেরের মিশর-হুসেনের ও শাহ রেজাদের ইরান-গদ্দাফির লিবিয়া-কামালের তুরস্ক বা এমনকি আসাদের সিরিয়া বা প্রথম দিকের সাদ্দামের ইরাক যে গতিতে সংস্কার করেছে তা অতুলনীয়। ৫০-র দশকের শেষ থেকেই শরিয়ার ক্ষমতা কমতে থাকে জনগণের জীবনে। ৮০-র দশক থেকেই সর্বত্র পশ্চাদপসরণ শুরু হয়, এগোনো পিছোনো চলতে থাকে। আজও ইরাকে মার্কিন মিলিটারির উপস্থিতি রয়েছে, শক্তিশালী মেয়েদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ আছে। পর্দা প্রথা চালু করতে পারছে না শিয়া-সুন্নী মৌলবীরা। ইরানে সংঘাত জারী আছে, তবে অবস্থা খুবই করুণ।

প্রগতিশীলরা এটাও ভুলে যাচ্ছেন, যে বর্বররা বিরোধী অবস্থানে থাকা যা, ক্ষমতায় যাওয়ায় এক নয়। তালিবানরা যখন পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে কোনো না কোন সাম্রাজ্যবাদী লবির সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছে তখন তাদের চরিত্র ভিজে বেড়াল। আবার ক্ষমতায় এসেই তারা বাঘ। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তাদের নিজেদের মেরুদন্ডের উপর ভরসা নেই, নিজেদের ধর্মের উপরও নেই। তাদের কোনো না কোনো প্রভু দরকার। হয় আমেরিকা, নতুবা পাকিস্তান, হয় ইরান নতুবা চীন। আর ক্ষমতায় গেলেই তারা নির্মম। ২০২০ সালে পাকিস্তান এক বিলিয়ন ডলার টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয় সৌদি আরবকে। ইরান-পাকিস্তান-চীন জোটের আভাস সেদিনই ছিল। ফলে এই নতুন লবি পাহাড়ের গুহা থেকে কাগুজে আদিম পশু তালিবানদের হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে গর্জন করতে সাহায্য করেছে।

প্রগতিশীলরা এটাও ভুলে যাচ্ছেন যে প্যান ইসলামিজম আসলে একটি মিথ্যাচার, একটি ভাঁওতা। আজ প্যান ইসলামপন্থীরা স্লোগান তুলেছেন ইরাক-সিরিয়া-কাশ্মীর-মিশর সব তাদের চাই। তালিবানরা প্রথম দিন বললেন যে কাশ্মীর নিয়ে তারা মাথা ঘামাবেন না, দ্বিতীয় দিনই কথা ঘোরাতে শুরু করে দিলেন। আজ তারা তাজিকিস্তান নিয়ে কিছু বলছেন না, কিন্তু পুতিন কি ভরসা রাখতে পারছেন? মনে হচ্ছে না। চীনের মুসলিম বিদ্রোহীদের সাথে তালিবানরা কিভাবে সুসম্পর্ক গড়ে তুলবে তা ভবিষ্যতই বলবে। এই প্যান ইসলামিজিম একটা ভাঁওতা। কোথাও মুসলিম-মুসলিম ভাতৃত্ব হয়নি। হওয়া সম্ভবই না। কারণ মুসলিম হোন বা হিন্দু, ভাতৃত্ব হওয়া সম্ভব নয় ধনী-গরীবে। ধনীরা বড়জোর গরীবদের বিভ্রান্ত করতে পারেন। আবার শিয়া ধনীর সাথে সুন্নী ধনীরও মিল হতে পারে না। মুসলিম ব্রাদারহুড ও আইসিস-দের মধ্যে হতে পারে না। কুর্দ আর আইসিস-দের মধ্যে হতে পারে না। আল কায়দা আর তালিবানদের মধ্য হতে পারে না। হলেও তা অতি সাময়িক। আর বর্বরদের মধ্যে বিরোধের সমাধান কখনো আলোচনার টেবিলে হতে পারে না, যুদ্ধ-হত্যাই তাদের কাছে বিবাদ মেটানোর একমাত্র পথ।

ভুলে গেলে চলবে না সাত ভগিনির opec-কে একসময় জাতীয় বুর্জোয়াদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অস্ত্র হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল, আজ যা সরাসরি সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার।

মুসলিম ব্রাদারহুড ভাল হয়ে গেছে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এমন আওয়াজ তুলেছিল, একবিংশ শতকের প্রথম দশকে। এমনকি নারীবাদীরাও ঐতিহ্যে ফেরার আওয়াজ তুললেন!! আজ আফগানিস্তানে মেয়েরা কি করবে? কবে দেশের ভেতরে বিপ্লব জিতবে তার জন্য অপেক্ষা করবে? যদি বিদেশী শক্তি তাদের মুক্ত করতে না আসে তবে অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই। কিন্তু যদি বিদেশী শক্তি আসে বাঁচাতে, তবে তাকেই স্বাগত জানানো ছাড়া পথ নেই। গুজরাটে যখন গণহত্যা চালাচ্ছিল মোদীরা তখন যে কোনো বিদেশী শক্তি যদি এসে মোদী-অমিত শাহ-কে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে পারতো, আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টে বিচার করার জন্য, বিদেশি শক্তির ওই হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে বেঁচে যেতেন গুজরাটের মুসলিম জনগণ। যেমন হিটলারদের হত্যাকান্ড থেকে বেঁচে গেছিলেন সেইদিন পূর্ব ইউরোপের বাসিন্দারা, সোভিয়েত হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে।

ভারতে তালিবান দূতাবাস, তালিবান সরকার মানেই এদেশে মোদীদের শক্ত ভিত তৈরী হওয়া। উত্তর প্রদেশ ভোটে যার বহিঃপ্রকাশ ঘটার সম্ভাবনা তৈরী হচ্ছে। আর তার পরেই ২০২৪ সালের আগে কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশন বা দিল্লির ধারাভি বস্তিতে যদি দুই একটা বোমা বিস্ফোরণ হয়, তবে তো আর কথাই নেই।

কালরাত্রে প্রবেশ করলাম আমরা। এতদিন ভয় ছিল এই উপমহাদেশকে যুদ্ধাঞ্চলে পরিণত করবে সাম্রাজ্যবাদ। আজ ভয় শুধু সেটুকুতেই সীমিত থাকছে না। আজ মানব সভ্যতার অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন চিহ্ন চলে এসেছে। ইরানের হাতে নাকি আনবিক বোমা আছে। ইজরায়েলের হাতেও আছে। কিন্তু এই ধর্মোন্মাদ তালিবানদের হাতে যদি তা আসে, তবে বেহেস্তের আশায়, কাফেরদের হত্যা করার আশায় উন্মাদরা সেই বোমার ব্যবহার করতে দুবারও ভাববে না।

…… হঠাৎ শুনি রাতের কড়া নাড়া, গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী, লেনিন বাড়ি আছো?

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *