মন্থরার রোহিত

বর্ণালী মুখার্জী:

দৃশ্য – ১

(রস্ট্রামে শম্বুক জঙ্গলে তপস্যারত। ব্যাকগ্রাউন্ডে সংস্কৃত শ্লোক বলা হচ্ছে। আলো আঁধারিতে এক রহস্যময় পরিবেশ। রাম প্রবেশ করেন, শম্বুকের দিকে তীরের নিশানা)

রাম:- শম্বুক সাবধান।

শম্বুক:- (চমকে চোখ খুলছে) কে, কে ওখানে?

রাম:- আমি রঘু বংশের রাজা, অযোধ্যার রাজা, শ্রীদাশরথরামচন্দ্র।

শম্বুক:- (বিস্মিত ও মুগ্ধ) শ্রীরামচন্দ্র! আপনি! প্রণাম নেবেন। আসন গ্রহণ করুন। আপনার সাক্ষাত পেয়ে আমি ধন্য। বলুন কেন এসেছেন?

রাম:- তোমার বিচার করতে, তোমাকে দণ্ড নিতে।

শম্বুক:- (বিস্মিত) শাস্তি দিতে! কিন্তু কী আমার অপরাধ?

রাম:- (ক্রুদ্ধ) তুমি ঘোর পাপ করেছ, শূদ্র হয়ে তপস্যা করছ? জানো না, এই কাজ কেবল ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়দের? তোমার ধৃষ্টতা দেখে আমি স্তম্ভিত। অমার্জনীয় অপরাধ করেছ তুমি। সুমহান আর্যাবর্তের নিয়ম অমান্য করেছ।

শম্বুক:- কী সেই নিয়মমহারাজ?

রাম:- বর্ণাশ্রম। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র। ঈশ্বরের মুখ থেকে যার জন্ম তার কাজ একরকম, ঈশ্বরের পা থেকে যাদের জন্ম তাদের কাজ অন্য। তোমার জন্ম সেই পা থেকে। এই অনর্থ আমাদের রাজ্যে ভীষণ বিপদ ডেকে এনেছে। এক ব্রাহ্মণ পুত্রের অকাল মৃত্যু হয়েছে তোমার জন্য।

শম্বুক:- কিন্তু রাজা, আপনিই তো এই কাজে আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন।

রাম:- (গর্জে ওঠে) শম্বুক! এত স্পর্ধা তোমার! আমাকে অপরাধের ভাগী করতে চাও?

শম্বুক:- কিন্তু এ যে সত্য। আপনাকেই দেখেছি শবরী মাতার এঁটো খেতে, মুগ্ধ হয়েছি। আপনাকেই দেখেছি নিষাদ রাজকে দুই হাতে আলিঙ্গন করতে, আবিষ্ট হয়েছি। তাই তো আমিও ঠিক করেছি যা আমার পরমাত্মীয় রোহিত পারেনি, তা আমি করব…

রাম:- (ক্রুদ্ধ) থাম, নরাধম! এই তোমার বুদ্ধি, এই তোমার বিবেচনা! হ্যাঁ এটা ঠিক আমি অস্পৃশ্যতা মানি না, কিন্তু আমি বর্ণাশ্রম মানি। ব্রাহ্মণরা হবেন শাস্ত্রজ্ঞ, পূজা পাঠের একমাত্র অধিকার তাদেরই। রাজা হতে পারি একমাত্র আমরাই। ঈশ্বরের এই ইচ্ছাকে অমান্য করার অধিকার না আছে আমার, না আছে তোমার। (একটু থেমে) আর রোহিত কে?

শম্বুক:- (স্বগতোক্তি, শেষ প্রশ্নটিকে উপেক্ষা করে) অস্পৃশ্যতা খারাপ, বর্ণাশ্রম ভালো! (জোরে দীর্ঘশ্বাস) তবে, কী আমার শাস্তি?

রাম:- মৃত্যুদণ্ড …

(freeze রস্ট্রাম অন্ধকার, এবার মূল মঞ্চে আদিবাসী গ্রামের একটি কুঁড়ে, সামনের দাওয়ায় পরম তৃপ্তিতে রান্না করছেন কুঁজি বুড়ি মন্থরা।)

মন্থরা:- (আপন মনে বিড়বিড়) অবশেষে খবরটা এল। গাঁয়ের সকলেরই আজ অরন্ধন। কিন্তু প্রাসাদের লাল চোখের পরোয়া অন্তত এই বুড়ি আর করে না। আজ আমি পায়েস রাঁধবই। দশদিন আগে আমি প্রাসাদ ছেড়েছি, কিন্তু এই অপেক্ষা যেন অনন্ত। আজ আমার অভিশাপ সত্য হয়েছে। ওরে শত্রুঘ্ন, ওহে রঘুবংশের বংশপ্রদীপরা, তোমরা সকলে শোনো, শূদ্রের অভিশাপও ফলে। আমার অভিশাপেই রাজা দশরথ পুত্র শোকে মারা গেছেন।

(হেসে ওঠে সে। তার পর রান্না সেরে তোরঙ্গ থেকে একটা কাপড় বের করে তাতে হাত বোলায় আর বলে ওঠে)

বিয়ের দিন এটা আমাকে দিয়েছিল খুকু, আমার কৈকেয়ী।

(এবার সে কাপড়টা জড়িয়ে নেয়, আর মাটির বা লোহার বাটিতে পায়েস ভরে নিয়ে চলে গাঁয়ের পথ ধরে। দৃশ্যান্তর হবে না)

মন্থরা:- (দর্শকদের দিকে তাকিয়ে) আজ আমি রোহিতকে আমার গল্প শোনাতে যাচ্ছি। সত্যিকারের রামায়নের গল্প। রোহিত আমার রক্তের সম্পর্কে কেউ নয়, কিন্তু ওই আমার সব। এই গাঁয়ে আমার ধর্ম ভাইয়ের ছেলে। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। রোহিত নামটা আমারই দেওয়া। (সামনের উইংস দিয়ে বেরিয়ে পিছনের উইংস দিয়ে ঢুকবে সে। স্ক্রীনে projection-এ ক্ষেতের ছবি, একটি কুঁড়েও, যার সামনে রস্ট্রামে কৃষিকাজে ব্যস্ত এক যুবক। পাশে তার স্ত্রীও মেহনত করছে, মুখ তুলে দূরে তাকিয়ে দেখে মন্থরা আসছে, স্ত্রী-র দিকে তাকায়, সে দৌড়ে (মূল মঞ্চে) দাওয়ায় পেতে দেয় আসন। (মন্থরা উত্তেজনায় কাঁপছে! আনন্দ চেপে রাখার কোনো চেষ্টাই দেখা যাচ্ছে না।)

রোহিত:- (সন্তর্পণে) খুড়ি!! তুমি আজ রান্না করেছ?জানো না আজ রাজা শ্রীরামচন্দ্রের পাদুকায় শপথ করে ভাই ভরতের হুকুমে গাঁয়ে অরন্ধন, গোটা রাজ্যেই তাই?

মন্থরা:- (হেসে উড়িয়ে দেয়) ধুর! তুই কি জানিস না, গাঁয়ের লোক আমাকে কতটা ভালবাসে! তোর বাপ, এই গাঁয়ের মোড়ল, সক্কলে যাকে ডরায়, আর সে কিনা ডরায় আমাকে! দশদিন আগে তাকেই আমি ভাই পাতিয়েছি। গাঁয়ের লোক জানে আজ মন্থরার আনন্দের দিন, তারা মোটেই বিশ্বাস করে না যে মন্থরার দুস্টু বুদ্ধিতেই শ্রীরামচন্দ্রের বনবাস হয়েছিল। এটা শূদ্র গাঁ। সকলে বোঝে যে এটাই চিরকালের নিয়ম। রাজপরিবারের ভেতরে ষড়যন্ত্র হয়, আর তার সমস্ত দায় চাপিয়ে দেওয়া হয় শূদ্র দাস-দাসীদেরই কাঁধে। আমি দশদিন আগে, প্রাসাদ থেকে মার খেয়ে, বিতাড়িত হয়ে অভুক্ত-অসুস্থ অবস্থায় যখন এই গাঁয়ে আশ্রয় চেয়েছিলাম, কেউই ফিরিয়ে দেয়নি। তবে সতর্ক থাকতে হয়েছিল এই গাঁয়ের সকলকেই। কে জানে রাজপ্রাসাদের কোপদৃষ্টিতে কখন পড়ে যাবে তারা, তবে এখন তাদের দুশ্চিন্তা কেটে গেছে।

(মন্থরা হাসি মুখে দাওয়ায় বসে আর বলে)

বাবা রোহিত, আজ আমি তোমাদের আবদার আর ফেরাব না। গত কয়েকদিন তুমি বার বার আমাকে রামচন্দ্রের, দশরথের প্রাসাদের গল্প শোনাতে বলেছ। কিন্তু আমি বলিনি। আমার ছিল ভীষণ প্রতিজ্ঞা। আমার অভিশাপ যদি সত্যি না হত, কোনোদিনই বলতাম না। জানতেও পারতে না যে কেন আমাকে মেরেছিল শত্রুঘ্ন? অথবা কৈকেয়ী কে হয় আমার। আর কেনই বা তোমার অমন সুন্দর নাম থাকতেও আমি তোমাকে রোহিত বলে ডাকি। আজ আমার বুক থেকে পাথর সরে গেছে। সব, সব বলব তোমাদের আজ।

(মন্থরা ইশারা করে তাদের বসতে বলে। দুজনে তার কোল ঘেঁষে বসে।)

মন্থরা:- তোমার বাপের দেওয়া নাম হল সত্যকাম। শূদ্র ঘরের সব মায়েরই ইচ্ছা হয় যে তার ছেলে হবে সত্যকাম। কিন্তু আমি তোমাকে রোহিত বলে ডাকি। কেন জান?

(রোহিত মাথা নাড়ে, মিউজিক, মন্থরা উঠে দাঁড়ায়, স্পট, বাকি স্টেজ অন্ধকার)

আজ তোমাকে বলতে বাধা নেই, রোহিত আমার ছোট ছেলের নাম ছিল। আজ আর সে বেঁচে নেই, খুন করা হয়েছিল তাকে। আমার ছিল ছয় সন্তান, আর তাদের মধ্যে সব চেয়ে ছোট, রোহিত, আমার রোহিত। ভারী দুস্টু ছিল আমার সোনা.. . (মঞ্চ অন্ধকার, দৃশ্যান্তর)

দৃশ্য ২

(অল্প বয়সী যুবতী মন্থরা, ছেলেকে খুঁজছে, ডাকছে)

রোহিত রোহিত রে! কোথায় গেলি বাছা। (নিজের মনেই) সেই কখন খরগোশ শিকার করতে বন্ধুদের নিয়ে জঙ্গলে গেল, সকলে ফিরে এল, আর আমার বাপধনের পাত্তা নেই। সারাদিন শুধু বনে বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ানো! উফ্ ওর বাপ এবার ছুটিতে ঘরে ফিরুক প্রাসাদ থেকে, আমি বলে কয়ে ওকে প্রাসাদে কাজে ঢুকিয়ে দেব, আমি আর ওকে সামলে রাখতে পারি না, এই (একটি ১৪ বছরের কিশোর দৌড়তে দৌড়তে ঢোকে স্টেজে) এই যে, রাজপুত্তুর এলেন!

(ছেলে মাকে জড়িয়ে ধরে, মা ওর হাত দুটো দেখে জিজ্ঞাসা করে)

ওমা! খরগোশ কোথায়?শিকার করিসনি?আমি তা হলে আজ কী রাঁধব?

রোহিত:- ও মা, শিকার করব কী গো? যেই না শিকার করতে যাচ্ছি, অমনি আমার কানের পাশ দিয়ে একটা প্রজাপতি ফস করে উড়ে গেল, আর আমি ধনুক ছেড়ে প্রজাপতির পিছনে ছুটলাম! (দুস্টুমি ভরা আর আদরের প্রশ্ন মা-কে), কেন বল তো মা?

মা:- (কপট রাগ দেখিয়ে) জানি না, যা। নিশ্চয়ই কিছু একটা অলক্ষুনে কারণ ছিল!

রোহিত:- এটুকুও বলতে পারলে না? আমি নিজের চোখে দেখলাম, একটা শুঁয়োপোকা প্রজাপতি হয়ে গেল। আচ্ছা মা?প্রজাপতি যদি শুঁয়োপোকা থেকে হয়, তাহলে আমরা মানুষ কোথা থেকে হলাম?

মন্থরা:- (ছেলেকে নকল করে) ওমা এটুকুও জানিস না? আমরা শূদ্র, আমরা হয়েছি ঈশ্বরের পা থেকে, আর রাজা দশরথ হয়েছেন ঈশ্বরের বুক থেকে।

রোহিত:- (বিস্মিত) তাহলে আমি তোমার পেট থেকে জন্মাইনি? তুমি আমার মা নও?

মন্থরা:- থাম বাবা থাম! আমি তোর সাথে অত কথা কইতে পারি না। আজ শুধু শাক সেদ্ধ খেয়ে থাকতে হবে।

(দুজনে হাঁটতে শুরু করে, রোহিত বক বক করেই চলেছে হাত পা নাড়িয়ে, যা শোনা যাচ্ছে না। ওরা স্টেজ ছাড়ে, মঞ্চ অন্ধকার হবে। রাত। ঘরের মেঝেতে মা বসে, আর রোহিত মা-র কোলে মাথা রেখে কথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছে, আর মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, এবার ওদের কথা শোনা যাবে)

রোহিত:- আচ্ছা মা, আকাশের ওপরে কী আছে?

মা:- স্বর্গ বাবা।

রোহিত:- দেবতারা স্বর্গে থাকে, না মা?

মা:- হ্যাঁ বাবা, আমরা পাপিষ্ঠ, আমাদের জন্য স্বর্গ নয় বাবা।

রোহিত:- ও আচ্ছা। আচ্ছা মা, একটা কথা বল দিকি, স্বর্গ থেকে আকাশ দেখা যায় না?

মা:- (অবাক কণ্ঠে) স্বর্গ থেকে আকাশ! কী জানি বাবা, সে তো জানি না।

রোহিত:- ও মা! এই তো তুমি বললে আকাশের ওপরে স্বর্গ। তাহলে স্বর্গের ওপরে কি আর আকাশ আছে? নাকি আকাশ শেষ হয়ে যাবে স্বর্গে গিয়ে?

মা:- (হাই ওঠে তার, ঘুম ঘুম স্বর) বাছা, অত ভাবতে পারি নে, আমরা হলাম দাস, তোর বাপ হল রাজা দশরথের প্রাসাদের দাস, আমার বাপও দাস ছিল, অত বিদ্যা কি আমাদের আছে?

রোহিত:- (তড়িৎ গতিতে উঠে বসে) না মা, আমি মুখ্যু হব না। (মা-কে জড়িয়ে ধরে বলে) মা গো, আমি পুঁথি পড়ব। আমাকে জানতেই হবে সব। মা, আমি জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে কী দেখি জানো? দেখি যে গাছেরা আমাদের মতো জল না পেলে শুকিয়ে মরে, তবে কি ওদেরও প্রাণ আছে? মাগো আমার যে জানতে বড় সাধ জাগে।

(মন্থরা চমকে ওঠে, ছেলের মুখ চেপে ধরে)

মা:- আবার সেই কথা! এই সব কথা শুনলেই আমার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যায় বাবা! সোনা আমার, আমাদের ঘরের ছেলেদের পুঁথি পড়তে নেই। এসব কথা মনে আনাও পাপ। ভগবান শাপ দেবে, আর রাজা শাস্তি দেবেন।

রোহিত:- না, মা, আমি শাস্তির ভয় পাই না। আমি পণ্ডিত হবই, আমি পুঁথি পড়বই। তোমার দিকে আঙুল দেখিয়ে মানুষ বলবে, ওই দেখ মন্থরা, রোহিতের মা, পণ্ডিত রোহিতের মা!

(মন্থরা বিহ্বল হয়ে ওঠে, রোহিতের কথায় বিভোর হয়ে যায়)

দৃশ্য ৩

(মন্থরা নদী থেকে স্নান করে ফিরেছে, হাঁফাতে হাঁফাতে মঞ্চে প্রবেশ রোহিতের, মাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে খুশিতে ডগমগ হয়ে বলল)

মা গো, জানো আজ কী হল? আমার সাথে জঙ্গলে মন্ত্রীমশাইয়ের দেখা হল।

মন্থরা:- ওমা! জঙ্গলে উনি কী করছিলেন?

রোহিত:- (হাততালি দিয়ে) সে তো খুউউব মজা। আমি একটা ব্যাঙকে সাপের মুখ থেকে সবে বাঁচিয়েছি, হঠাৎ দেখি কি, একটা শুয়োর খুব জোরে আমার সামনে দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে, প্রাণ ভয়ে, আর ঠিক তার পিছনে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে, ওরেবাবা, প্রথমে পেয়াদারা আর তার পিছনে মন্ত্রীমশাই নিজে। তবে আমাকে ওরা দেখতে পায়নি, আমি তো প্রথমে খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম, তাই গাছের পিছনে লুকিয়ে পড়েছিলাম।

মন্থরা:- (মাটির কলসীটার কাঁখ পরিবর্তন করে হালকা মেজাজে) কিন্তু মন্ত্রীমশাই শিকার করতে এসেছে বলে তোর এত আনন্দের কী হল?

রোহিত:- ধুৎ, শোনোই না। সেই শুয়োরটাকে মেরে পেয়াদারা নিয়ে এল, মন্ত্রীমশাই হুকুম দিলেন ওখানেই ওনারা বিশ্রাম নেবেন, সেই মতো একটা খোলা জায়গা পরিষ্কার হল, গালিচা বিছানো হল, আগুন জ্বালানো হবে, শুয়োরটাকে পোড়ানো হবে। কিন্তু তখনো ভাল কাঠ পাওয়া যায়নি। কাল বৃষ্টি হয়েছে না, পাবে কী করে?

মন্থরা:- (একটু অস্থির হয়ে) আচ্ছা চল্, পরে তোর পুরো গল্পটা শোনা যাবে, এখন ঘরে অত কাজ পড়ে আছে!

রোহিত:- (উত্তেজিত কিন্তু দৃঢ়ভাবে) না মা!! আগে শোনো।

মন্থরা:- (একটা পাথরের উপর বসল সে, কলসীটা মাটিতে সাবধানে রাখল) বেশ, বল দেখি, কী এমন হল যে এক্ষুনি না শুনলেই নয়!

রোহিত:- হ্যাঁ, আমি গাছের পিছন থেকে বেরিয়ে এলাম, ওই একটা পেয়াদার কাছে গিয়ে বললাম যে—

(মঞ্চের অন্য পাশে দেখা যাবে গালিচার উপর মন্ত্রীমশাই আধ শোওয়া, পর্দায় (Projection) একটা শুয়োর বাঁশে বাঁধা, মঞ্চের এক পাশে কয়েকজন পেয়াদা কাজ করছে, রোহিত এই zone থেকে হেঁটে অন্য zone-এ যেতে যেতে সংলাপ বলবে, মন্থরার জোনে আলো কমবে, কিন্তু সম্পূর্ণ অন্ধকার হবে না, ও দেখবে ওপারের ঘটনা)

রোহিত:- (একজন পেয়াদার উদ্দেশে) কাল বৃষ্টি হয়েছিল তো, তাই সব কাঠ ভেজা, আমি জানি কোথায় শুকনো কাঠ পাওয়া যাবে, নিয়ে আসব?

পেয়াদা:- (সন্দেহের চোখে) তুই কী করে জানলি, আমাদের আগুন ভাল জ্বলছে না?

রোহিত:- আমি তো ওই গাছের পিছনে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলাম।

(দ্বিতীয় একজন পেয়াদা এসে দাঁড়ায়, মন্ত্রীমশাই সব খেয়াল করছেন, দ্বিতীয় পেয়াদা প্রথম পেয়াদার উদ্দেশে বলে)

দ্বিতীয় পেয়াদা:- একে তো আমি চিনি, এর বাপ আমাদের সাথেই প্রাসাদে কাজ করে, তা বাছা তুমি ভালো আছো তো? তোমার বাপ খুব তোমার কথা বলে। (স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয় মাথায়)

প্রথম:- আচ্ছা বেশ। তাহলে বরং তুই আমাদের সাথে লেগে পড়। যা, কোথায় শুকনো কাঠ আছে নিয়ে আয় দেখি, এদিকে মন্ত্রীমশাই খুবই অস্থির হচ্ছেন, খিদে তেষ্টায়।

রোহিত:- তেষ্টা? কেন ওই যে ওই গাছে, দেখছ না কত রসালো ফল, পেড়ে আনব? খুব মিষ্টি গো। মন্ত্রীমশাই খুব খুশি হবেন।

(দুই পেয়াদা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, তারপর মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়, রোহিত এক দৌড়ে পর্দার পিছনে যায়, মন্থরাসহ মঞ্চস্থ সকলের শরীরী ভাষায় টের পাওয়া যায় যে রোহিত গাছে উঠছে ও ফল পেড়ে নামছে, আবার রোহিতকে দেখা যায়, কোঁচড়ে অনেক ফল নিয়ে সে সোজা মন্ত্রীর কাছে চলে যায়, পেয়াদারা হাঁ হাঁ করে ওঠে, কিন্তু ততক্ষণে সে মন্ত্রীর মুখোমুখি, হাত বাড়িয়ে ফল দিচ্ছে, মন্ত্রীও পেয়াদাদের ইশারায় চুপ করতে বলেন)

মন্ত্রী:- এটা কী ফল? মিষ্টি?

রোহিত:- হ্যাঁ, মন্ত্রীমশাই, খুউউব মিষ্টি। আপনি খেয়ে দেখুন, আমি তো অনেক দুপুর এই ফল খেয়েই কাটিয়ে দিই।

(মন্ত্রী হেসে উঠে ফল খেতে শুরু করেন এবং তৃপ্ত হয়েছেন বোঝা যায়। হাঁক দিয়ে বলেন)

এই কে আছিস, এই ছোঁড়াকে দুটো চাল দিয়ে দে, ও নিয়ে যাক ঘরে।

রোহিত:- (মিউজিক, খুব ধীরে কয়েক পা মন্ত্রীর দিকে এগিয়ে, একটু ঝুঁকে, মন্ত্রীকে চমকে দিয়ে) আমি পুঁথি পড়ব, আমি পণ্ডিত হব, আমাকে পুঁথি পড়াবেন?

(মিউজিক, এদিকে মন্থরার আর্তচিৎকার, আর ওদিকে ফ্রীজ, আর তারপর কিল চড় লাথি, যে পেয়াদা রোহিতের বাবাকে চেনে সে একটু সামলাচ্ছে, মন্ত্রী উঠে পড়ে চলে যাচ্ছে, রাগ আছে কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রশ্ন চোখে মুখে, রোহিত পড়ে আছে, কাতরাচ্ছে, তারপর আস্তে আস্তে উঠে বসে, মুখে বিজয়ীর হাসি, আর তারপর এক ছুটে মঞ্চের মন্থরার জোনে চলে আসে)

রোহিত:- মা, ও মা, তুমি চিন্তা করো না মা, আমার তেমন লাগেনি, তুমি একটু গাছের শিকড় ডলে দিলেই সব সেরে যাবে।

মন্থরা (ছেলের কোথায় লেগেছে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে সজোরে চড় মারলেন) তোকে জন্মানো মাত্র মুখে নুন দিলাম না কেন রে? তুই এ কী সর্বনাশ করলি! এতক্ষণে নিশ্চয়ই তোর বাপকে কয়েদ করেছে, হয়তো বা, হয়তো বা মেরেও ফেলেছে। (উদ্‌ভ্রান্ত ভাবে) না, কিন্তু আমাদের আর সময় নেই, এক্ষুণি, এক্ষুণি আমাদের পালাতে হবে এই রাজ্য ছেড়ে। ওরা চলে আসার আগেই পালাতে হবে, চল্‌ চল্‌, হ্যাঁ আমরা কাল সূর্য ওঠার আগেই অযোধ্যা ছাড়ব, হ্যাঁ হ্যাঁ দিদির কাছে চলে যাব। অনেক দূর। কিন্তু যেতেই হবে, কালই বেরিয়ে পড়ব। কেকয় রাজ্যে, কেকয় রাজ্যে . . .

(জলের কলসীকে পা দিয়ে ধাক্কা মেরে, বিস্মিত ছেলেকে টানতে টানতে, টলতে টলতে তারা মঞ্চ ছাড়ছে। মঞ্চের আলো ধীরে ধীরে কমে অন্ধকার হয়ে যাবে)

দৃশ্য ৪

সূর্য উঠছে। মন্থরা আর রোহিত নদীর তীরে দাঁড়িয়ে।মঞ্চসজ্জা, বেশভুষা আচরণ আর হাতের দুটো পুটুলি দেখে বোঝা যাচ্ছে যে তারা পালিয়ে দূরে যাচ্ছে, দূর থেকে নৌকা আসতে দেখল তারা, পর্দায় নৌকার ছায়া নদীর ওপরে। আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, খুশীর ভাব, দর্শক বুঝছে যে তারা এই নৌকাতেই উঠবে। কিন্তু নৌকো যত এগোচ্ছে ততই মন্থরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে, মুখে আঁচল চাপা নিয়ে ডুকরে উঠল সে‌ (উইংগসের দিকে তাকিয়ে তাদের শরীরী ভাষায় দর্শককে বোঝাবে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির আগমন। উইংগস থেকে মঞ্চে প্রবেশ এক পেয়াদা আর একজন পুরুষের, মন্থরা রোহিতকে বুকে আঁকড়ে ধরে স্থাণুবৎ)

রোহিত:- বাবা!! (মায়ের হাত ছাড়িয়ে এক দৌড়ে সেই পুরুষের কোমর জড়িয়ে ধরে)

মন্থরা:-(পুরুষের দিকে তাকিয়ে) আপনাকে ওরা কেন পাঠিয়েছে? আমি জানি, সব জানি। আমার রোহিতকে ওরা ধরে নিয়ে যাবে, এই রাক্ষসকে কেন পথ চিনিয়ে নিয়ে এলেন, কেন এলেন! আমার রোহিত ছোট, অবুঝ। ও ভুল করে ফেলেছে। একে তোমরা (বিস্মিত পেয়াদার দিকে তাকিয়ে) ছেড়ে দাও, আমি কথা দিচ্ছি ও আর কোনোদিন পুঁথি পড়তে চাইবে না। (পেয়াদার পা চেপে ধরে কান্না, পেয়াদা বিস্ময়ে ছিটকে সরে যাচ্ছে, বাবা একদৌড়ে মন্থরাকে তুলছে মাটি থেকে)

বাবা:- মন্থরা, ওঠ্ ওঠ্, তুই মিছেই ভয় পাচ্ছিস। রোহিতের ওপর রাজা দশরথ ক্রুদ্ধ হননি। বলছি না ওঠ!

মন্থরা:- (মাটিতেই বসে স্বামীর হাত চেপে ধরে) রাজা রাগ করেননি? সত্যি বলছেন?

বাবা:- হ্যাঁ রে হ্যাঁ, সত্যি না তো কী মিথ্যে? জানিস রাজা দশরথ রোহিতকে ডেকে পাঠিয়েছেন, তাই তো আমি ওকে নিতে এসেছি।

মন্থরা:- নাঃ, না না, ঠিক জানি, আপনি মিছে বলছেন। শূদ্রের ঘরের ছেলে পণ্ডিত হতে চাইছে আর রাজা ক্রুদ্ধ হবেন না, তাও কি সম্ভব! তাই আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আপনি আমার চোখের ধনকে কেড়ে নিতে এসেছেন, ওকে রাজামশাই বন্দি করবেন। না, আমি কিছুতেই যেতে দেবো না ওকে, কিছুতে না।

বাবা:- আরে কী মুশকিল! এই, এই এই দেখ, নতুন ধুতি নতুন চাদর পাঠিয়েছেন রাজা তোর রোহিতের জন্য। (পুটুলি থেকে বের করে কাপড়) তোর ছেলেকে জলপানি দিয়ে প্রাসাদে লেখাপড়া শেখানো হবে।

(রোহিত আনন্দে দিশাহারা। কাঁদছে, লাফাচ্ছে, মাকে জড়িয়ে ধরছে আর বলছে—)

রোহিত:- মা আমি পুঁথি পড়তে পারব, আমি পুঁথি পড়ব, আমি পুঁথি পড়ব। (মায়ের কান্না কিন্তু থামে না।)

বাবা:- মন্থরা শোন্, আমার কিন্তু এক রাতও থাকা হবে না। মন্ত্রীমশাইয়ের নির্দেশ, আজই ছেলেকে নিয়ে এস। তাই তো নৌকা নিয়েই এসেছি। নে তুই ছেলেকে সাজিয়ে দে, দুটো খাইয়েও নিস।

(চারজনে এগোতে থাকে, মন্থরার অবিশ্বাসী চাহনি, ছেলেকে আঁকড়ে হাঁটছে, বাবা বলছে ওদের প্রাসাদে কি হল, কেন দশরথ রোহিতকে ডেকে পাঠালেন)

বাবা:- শোন্ রাজা দশরথের প্রাসাদের এক আশ্চর্য নিয়ম আছে, তা তো তুই জানিস। প্রতি ৫ বছর অন্তর রাজ্যের ৩০ জন ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় ছেলেকে প্রাসাদে রেখে পুঁথি পড়ানো হয়, অস্ত্রবিদ্যা শেখানো হয়। ৫ বছর পর এদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল ৫ জনকে প্রাসাদেরই কর্মচারী পদে বহাল করা হয়। এই বছরেই আবার নতুন ৩০ জনকে নেওয়ার পালা…

(বলতে বলতে তারা মঞ্চ ছাড়ছে, অন্য দিকের উইংগস থেকে মঞ্চে ঢুকছেন দশরথ আর মন্ত্রী। খুবই দুশ্চিন্তায় তারা। মঞ্চের সেদিকের অর্ধ আলোকিত)

রাজা:- এ অসম্ভব মন্ত্রী। আপনি কী পাগল হলেন!

সুমন্ত্র:- রাজা, এ মাথা গরম করার সময় নয়, আমি রাজ্যের, রাজার ভালো চাই বলেই এই পরামর্শ দিচ্ছি, আপনাকে বিবেচনা করতেই হবে এই প্রস্তাব।

দশরথ:- সুমন্ত্র, রাজা থাকলেই বিপদ আসবে, সেই বিপদ কেটেও যাবে। আপনি এর আগেও বহু বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন, সামলেওছেন ঘরের শত্রু, বহির্শত্রু। কিন্তু আজ আপনি এত বিচলিত হচ্ছেন কেন?

মন্ত্রী:- এই বিপদ অভূতপূর্ব। শত্রু কিছু লোক নয়, একটা চিন্তা, একটা আদর্শ যা নাড়া দিচ্ছে সকলকে। একে মোকাবিলা করা ছেলেখেলা নয় রাজা। বেদকে প্রশ্ন করছে, বেদকে অবিশ্বাস করছে মানুষ। (মিউজিক, রাজা অস্থির)

রাজা:- হ্যাঁ, হ্যাঁ শুনেছি শুনেছি। ওরা বলছে যে যজ্ঞ করা নাকি বৃথা, অপচয়।

মন্ত্রী:- বলছে আত্মা বলে নাকি কিছু হয় না।

রাজা:- বলছে পরজন্ম নেই, যা আছে তা শুধু ইহজন্ম।

মন্ত্রী:- আর যদি পরজন্মই না থাকবে তাহলে আর পাপ পুণ্য, পাপের শাস্তি, নরক, স্বর্গই বা থাকবে কেন?

রাজা:- হ্যাঁ, ওরা বলছে, আমরা যা দেখতে পাই না তা নেই, মাটি থেকেই সব কিছুর জন্ম আবার মাটিতেই সব মিশে যাবে।

মন্ত্রী:- ওরা বলছে ঈশ্বর নেই। (মিউজিক শুরু)

রাজা:- আর যদি ঈশ্বরই না থাকবে তবে ব্রাহ্মণও নেই। ঈশ্বরের প্রতিনিধি রাজাও নেই। (মিউজিক লাউড হচ্ছে, দশরথ মাথা চেপে বসে পড়লেন, রস্ট্রামের সামনে বসার জন্য রাখা একটা বেদীতে) কিন্তু কে বলছে এসব কথা? এদের গুরু কে?

মন্ত্রী:- রাজা, এখন অনেকে বলছেন। গুরু বৃহস্পতি এই ধরনের কথা আগেই বলেছিলেন। তা আমি আপনি জন্মানোরও আগে। কিন্তু এখন বৃহস্পতির চ্যালা অনেক। চার্বাক অসুর সব। তবে ওরা সকলে একরকম বলে না, ওদের মধ্যে ভাগাভাগিও আছে।

রাজা:- কী রকম? একটু বুঝিয়ে বল।

মন্ত্রী:- এই যেমন ধরুন, কণাদমুনি, উনি কিন্তু চার্বাকদের মত সব অস্বীকার করেন না, আবার কপিল মুনি, তিনি আবার অবিশ্বাসী। আর আছেন গৌতম বুদ্ধের শিষ্যরা। তারা ঈশ্বরও মানেন, আবার পরকালও মানেন। কিন্তু তিনি বেদের এই যজ্ঞ-উপাসনাতে বিশ্বাস রাখেন না, ব্রাহ্মণদের অপরিসীম ক্ষমতাতে বিশ্বাস রাখেন না। তিনি কর্মতেই মোক্ষলাভের কথা বলেন। সাধাসিধে জীবনের কথা বলেন। আবার বুদ্ধদেব বা মহাবীর কিন্তু চার্বাকদের মোটেই পছন্দ করেন না। তাদের নাস্তিক বলে গালাগালিও করেন বৌদ্ধ এবং জৈন পণ্ডিতরা।

রাজা:- তা ওদের মধ্যে এই হানাহানিকে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না কেন?

মন্ত্রী:- পারলেও লাগাতে চাইছি না। আসলে এখন চার্বাক অসুররা আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ নয়। এখন মূল চিন্তা বৌদ্ধদের নিয়েই। বৌদ্ধ ধর্ম এখন বৈদিক হিন্দু ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে ধ্বংস করতে উদ্যত। দলে দলে সওদাগর আর শূদ্র বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছে। হিন্দু ধর্ম আর হিন্দু রাজারা সওদাগরদের থেকে যথেষ্ট সাহায্য আর পাচ্ছে না। দাস হিসেবে লোক পাওয়াও মুশকিল হচ্ছে। দাসদের মধ্যে বিদ্রোহ হতে পারে। আমাদেরই প্রাসাদে আমার নিজের চোখেই দেখা, এক দাসকে চাবুক মারা হচ্ছে আর সে যন্ত্রণায় বিড়বিড় করছে ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’!!

দশরথ:- হ্যাঁ মন্ত্রী, এ ভারি বিপদ, যেন বা এক যুগ সন্ধিক্ষণে আমরা দাঁড়িয়ে। কিন্তু কেউ কি পারছে না বৌদ্ধদের পরাজিত করতে?

মন্ত্রী:- রাজা, হয়তো বেদের সমালোচনা প্রয়োজন। বাইরে থেকে সমালোচনা হলে হিন্দু ধর্ম সংকটে পড়ছে। ভেতর থেকেই সমালোচনা হয়তো লাগবে। বেদের নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ দরকার। বাড়তি অপচয়, যজ্ঞের ঘনঘটায় রাশ টানা প্রয়োজন। যা বেদকে রক্ষা করবে, রাজাকে রক্ষা করবে।

রাজা:- মানে বেদের শেষে নতুন এক বেদ দরকার? বেদের অন্ত?বেদান্ত?যা বেদ আবার সমালোচনাও। হয়তো হবে খুবই শীঘ্র। সে যাক, কিন্তু এখন আমরা পরিত্রাণ পাব কী করে?আপনার এই পরামর্শ মেনে?

মন্ত্রী:- হ্যাঁ রাজা, আজ আপনিই সেই বেদান্তের সূচনা করুন। (মিউজিক) এইবার ৩০ জন ছাত্রের মধ্যে মাত্র তিনজনকে আপনি ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় ঘর থেকে নেবেন না, দুজন হোক বৈশ্য ঘরের আর একজন হোক শূদ্র। (চড়া মিউজিক) দেখবেন, প্রজাদের মধ্যে বিশেষত সওদাগরদের সমালোচনা বন্ধ হবে, আপনি আবার প্রজাদের রাজা হবেন।

দশরথ:- বেশ মন্ত্রী, তাই হোক। কিন্তু কাল সকালেই আমাদের নাম ঘোষণা করতে হবে, এত দ্রুত আমরা এই তিনজনকে পাই কেমন করে? সওদাগর ঘরের পেতে অসুবিধা হবে না, কিন্তু শূদ্র ঘর থেকে তেমন ছেলে পাওয়া কি সহজ?

মন্ত্রী:- রাজা, আমি তো নিমিত্ত মাত্র। ঈশ্বর আপনার সহায়। সেই রকম একটি ছেলের সন্ধান পেয়েছি। দেখুন ঈশ্বরের কী অপার মহিমা। এই ছেলের পিতা আবার আপনারই দাস। এই প্রাসাদেই থাকে সে। আপনি হুকুম দিলে অবিলম্বে তাকে পাঠাচ্ছি সেই ছেলেকে নিয়ে আসতে।

রাজা:- বেশ, তাহলে। নিয়ে আসুন সেই দাস-পুত্রকে, কি যেন নাম বলেছিলেন?

মন্ত্রী:- আজ্ঞে রোহিত, মহারাজ, রোহিত।

(এই সময় আবার মঞ্চের অন্য অর্ধে আলো জ্বলে উঠবে। বুড়ি মন্থরা আর ভাইপো রোহিত আর তার স্ত্রীর বাড়ির দাওয়া)

মন্থরা:- আমার কিন্তু চোখের জল বাঁধ মানছিল না। রোহিতের চুল আঁচড়ে দিলাম, পড়িয়ে দিলাম একটা নতুন চাদর। আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে, অথচ খোকার যেন একটুও কষ্ট নেই। চোখেমুখে উত্তেজনা। কিন্তু শেষে ঠিক যাওয়ার সময় যখন আমি ওর দুই গালে দুটো চুমা দিলাম, ওর যেন হুঁশ ফিরল। আমাকে জড়িয়ে ধরে শুধু বলল, মা গো রাতে কার কাছে শোব? আর বাপের সঙ্গে যখন রওনা হল, যতক্ষণ আমাকে দেখতে পেল, বার বার শুধু পিছন ফিরে তাকাল। ওরও দু চোখে এই প্রথম জল দেখলাম, আর সেই শেষ। নদীর বাঁকে সেই যে হারিয়ে গেল আমার রোহিত, আমার খোকা, আর কোনোদিন তাকে দেখতে পাইনি। (হু হু করে কেঁদে উঠলেন কুঁজি বুড়ি মন্থরা, ভাইপো রোহিত কোল ঘেঁষে বসে মাথায় হাত রাখলো, কিন্তু দৃঢ়ভাবে বলল)

ভাইপো রোহিত:- কিন্তু কেন তুমি আর তাকে দেখতে পেলে না খুড়ি? সে তো পুঁথি পড়তে গেছিল?কী হয়েছিল তার? আমাকে জানতে হবে। থেমো না খুড়ি, বলে যাও, যতই কষ্ট হোক, তোমাকে বলতেই হবে। (কুঁজি বুড়ি মন্থরা শিরদাঁড়াটা যতটা পারল টানটান করল, আবার শুরু করল সে)

মন্থরা:- আমার আর ঘরে মন টিকল না। আমার অন্য সন্তানেরা তখন যে যার কাজ করে, পাঁচ জনের বিয়েও হয়ে গেছে। রাতে বিছানাটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে। তাই খবর পাঠালাম দিদিকে, সে কেকয়া রাজার প্রাসাদের দাসী। সুখে থাকে, মান্যিগন্যি অতিথিদের মনোরঞ্জন করে সে। দেখতে তাকে মোটেই আমার মতো কুৎসিত নয়… (মঞ্চ অন্ধকার, দৃশ্যান্তর)

দৃশ্য ৫

(কেকয়া রাজপ্রাসাদের অন্দরমহল। এক যুবতী নারী, মন্থরার দিদি, ভুর্জপত্রে লেখা চিঠি পড়ছে জোরে। পাশে আর এক মহিলা, দাসী শ্রেণির দুজনেই।)

দিদি:- অতএব বুঝতেই পারছ দিদি, যে আমি কতটা একা। লক্ষ্মী দিদি, আমায় একটা কাজ দেখে দাও, তোমাদের রাজ্যে। আমি তোমার কাছে গিয়ে থাকি। এখানে একটুও ভাল লাগছে না। (দীর্ঘশ্বাস ফেলে)

দাসী ২:- তোমার বোন আছে তা তো জানতুম না।

দিদি:- আছে তো। আমাদের ভারি ভাব ছিল। কিন্তু দেখতে শুনতে আমরা ছিলাম আলাদা। আমাকে সকলে রূপসী বলতো আর বোনটা জন্ম থেকেই ভারি কুৎসিত, শরীরে যেন একটুও রস নেই। কিন্তু সেই রূপই আমার কাল হল। আমাকে মা-বাপের কাছ থেকে জোর করে নিয়ে যায় গাঁয়ের কয়েকজন ব্রাহ্মণ পুরোহিত, বলে সুন্দরী মেয়ে মন্দিরের দেবদাসী হয়ে থাকুক।

দাসী ২:– হ্যাঁ এই গল্পটা জানি। তারপর তুমি একদিন ঐ মন্দিরের অন্ধকার থেকে পালালে। সওদাগররা যাচ্ছিল বৌদ্ধ মঠে। তুমি সেই যাত্রায় ঢুকে পড়লে, আর তারপর যখন এই কেকয় রাজ্যে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা আস্তানা গাড়ল তুমি এক সওদাগরের সাথে সোজা এই প্রাসাদে। কি, তাই তো?

দিদি:- হ্যাঁ রে, মন্দিরের চেয়ে প্রাসাদের দাসী হওয়া ঢের সুখের রে। রাজারদাসী, আর রাজ কর্মচারীদের বউ হয়ে থাকব, ব্যস এইটুকুই তো।

দাসী২:- বউ? বাব্বা, তুমি পারও বটে! আমরা বউ নই, আমরা দাসী। (দুজনের ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি)

দিদি:- জানিস, আমার মাথায় না একটা জব্বর ফন্দি এসেছে।

দাসী ২:- কী ফন্দি লো?

দিদি:- আমাদের ছোট্ট রাজকুমারীর একজন দাইমা লাগবে। রাণিমাকে রাজামশাই তাড়িয়ে দিয়েছেন। কেন কে জানে, বড় মানুষদের ঘরে এক বউ তো আর থাকে না, থাকে আমার আর তোর মত অনেক দাসী-বাঁদী, কিন্তু তাতেও তাদের মন ভরে না। যাই হোক, কিন্তু রাণি চলে গেলেও রয়ে গেছে তার ফুটফুটে মেয়ে, রাজকুমারী কৈকেয়ী। সে তো রাজার খুব আদরের। ঋষিরা বলেছিলেন যে এই মেয়ে নাকি শুধু রাজরানীই নয়, সরস্বতীর কৃপাদৃষ্টিও পাবে। তার জিভে নাকি দেবী সরস্বতী বাসা বাঁধবে।

দাসী ২:- বাব্বা, তুমি কত কিছুই জানো! (নিজের জিভ বের করে জিভের দিকে তাকিয়ে) কী জানি, জিভে সরস্বতী আবার কেমন করে বাসা বাঁধে! সে সবের মানে আমাদের মতো মুখ্যুসুখ্যু মানুষেরা কী বুঝবে!

দিদি:- কৈকেয়ীর দেখাশোনার জন্য একজন দাইমা দরকার। আমি রাজাকে বলে রাজি করাচ্ছি, আমার বোন মন্থরাই হোক কৈকেয়ীর দাইমা।

(মঞ্চের একপাশে স্পট, মন্থরা আর একটি ৯ বছরের শিশু কন্যা খেলা করছে, এই মেয়েই কৈকেয়ী।কিন্তু হঠাৎ তার পায়ে ব্যথা লাগল আর সে কেঁদে উঠল)

কৈকেয়ী:- আমি মায়ের কাছে যাব, উঁ উঁ মা কোথায়, উঁ উঁ, তোমরা আমার মা-কে নিয়ে এসো, উঁ উঁ।

মন্থরা:- (তাকে ভোলাচ্ছে) হ্যাঁ সোনা, তোমার মাকে খবর নিয়েছি। মা তোমাকে বলে পাঠিয়েছেন যে তাঁর তোমার কথা খুব মনে পড়ে। তুমি লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকলে, মা তাড়াতাড়ি চলে আসবেন।

কৈকেয়ী:- (তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে) আচ্ছা, দাইমা, আমি লক্ষ্মী মেয়ে হয়েই থাকব। চল না, আমি আর তুমি ঐ বাগানে একটু লুকোচুরি খেলি? তুমি চোখ বাঁধো, আমি লুকাই। (মিউজিক, কোনো সংলাপ নেই দেখা যায়, মন্থরা আর কৈকেয়ী লুকোচুরি খেলছে, মন্থরার চোখ বাঁধা, মঞ্চের সাজানো দুই একটি থাম বা গাছের আড়ালে দৌড়ে দৌঁড়ে কৈকেয়ী লুকোচ্ছে। আলো ছায়া দিয়েও এটা করা যেতে পারে)

কৈকেয়ী:- (থামের আড়াল থেকে, ওকে দেখা যাচ্ছে না, শুধু সংলাপ শোনা যাচ্ছে) দাইমা, ও দাইমা, তুমি আর রোহিত এরকম লুকোচুরি খেলতে?

মন্থরা:- (অন্যমনস্ক, কিন্তু ঘুরে ঘুরে খুঁজে চলেছেন কৈকেয়ীকে) রোহিত! হ্যাঁ মা, খেলতাম। খুব খেলতাম। ওরে কোথায় লুকিয়েছিস তুই, কৈকেয়ী? কোথায় তুই, তোকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?কৈকেয়ী, কৈকেয়ী, রোহিত, রো—হিহইত, রোহিইইইইত তুই কোথায়? রোহিত…

(ধীরে ধীরে উইংগসের কাছে থাকা তিন নম্বর থাম বা গাছ বা ছায়া থেকে কৈকেয়ী বেরোয়, বয়স বেড়ে গেছে, এই কৈকেয়ী এখন ১২-১৩ বছরের কিশোরী)

কিশোরী কৈকেয়ী:- (এসে জড়িয়ে ধরে দাইমাকে) মা মা গো! কেঁদো না। দেখো ঠিক তোমার রোহিত তোমার কাছে ফিরে আসবে। আর তখন তো তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, রোহিতের কাছে, তাই না?

মন্থরা:- না রে, তোকেও যে আমি খুব ভালবাসি রে মা।

কৈকেয়ী:- আচ্ছা, দাইমা আমি ভেবে দেখলাম, আমি যদি তোমার রোহিতকে বিয়ে করি, তাহলে আমি তুমি আর রোহিত একসাথে থাকতে পারব। (হাততালি দিয়ে ওঠে সে আনন্দে, মন্থরা হেসে ওঠে)

মন্থরা:- আমার পাগলি মেয়ের কথা শোনো একবার, এমন স্বপ্ন দেখাতে নেই মা, শত্তুরকেও নয়। (দৃশ্যান্তর)

দৃশ্য ৬

(অযোধ্যার প্রাসাদে ৩০ জন ছাত্রের খাওয়ার কক্ষ। রস্ট্রামের উপর ২৯ জন খাচ্ছে, আর মঞ্চের নীচে খাচ্ছে তরুণ রোহিত। ২৯ জন দেখানো হবে না, তিন চারজনকে দেখালেই হবে। বাকিটা শব্দ আর আলোর ব্যবহার হবে। রস্ট্রাম থেকে একজন ছাত্রের কন্ঠস্বর ভেসে এল, বিদ্রূপ করছে সে)

ছাত্র ১:-শোনো রোহিত, মানছি তুমিই আমাদের মধ্যে বিদ্যায় বুদ্ধিতে অস্ত্র চালনায় শ্রেষ্ঠ। কিন্তু শ্রেষ্ঠ হয়ে কী লাভ তোমার? সেই তো তোমাকে নীচে বসেই খেতে হয়।

ছাত্র ২:- আর তোমার ছোঁয়া থেকে বাঁচতে আমাদের মান্যবর ঋষিরা তোমাকে পর্দার আড়ালে রেখে শিক্ষা দেন, আমাদের সাথে তুমি শিক্ষা কক্ষে বসতেও পার না।

ছাত্র ৩:- কী হবে রোহিত? তুমি কি রাজপ্রাসাদের সম্মানিত কর্মচারী হবে ভাবছ নাকি! তোমার পিতা দাস, তোমাকেও দাসই হতে হবে, আমাদের দাস!

(৩জনের থেকে সংখ্যায় অনেক বেশ ছাত্রের অট্টহাস্য, এতক্ষণ রোহিত মাথা নীচু করে খেয়ে যাচ্ছিল, অট্টহাস্যের সময় কান চাপা দিয়ে উঠে পড়ে, থালা সরিয়ে দেয়। আর ঠিক তখনই মঞ্চে প্রবেশ এক ঋষির)

ঋষি:- রোহিত, তুমি যাচ্ছ কোথায়? জান না খাবার পরে আমার সেবা করার তোমার দায়িত্ব। চলে এস, চলে এস।

রোহিত:- ঋষিবর, আজ আমাকে যদি মাফ করেন খুব ভালো হয়, কাল আমাদের পরীক্ষা, একটু পড়তে চাই।

ঋষি:- ওমা! শোনো ছেলের কথা! পড়ে কী হবে, তোমাদের পরীক্ষক তো আমিই। আমাকে খুশি না করলে, ভালো ফল আশা করো না!

(রোহিত খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, ঋষি শুয়ে পড়েন একটি খাটে, আর রোহিত মাটিতে বসে পা টিপতে শুরু করে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই রোহিতের আতঙ্কের কারণ দর্শকরা বোঝে, ঋষি আসলে তার সঙ্গে যৌনাচার করতে উদ্যত হচ্ছে, অশ্লীলভাবে রোহিতের গায়ে হাত বুলাচ্ছে সে, রোহিত পালাতে চায়, কিন্তু পারে না। চারিদিকে আবার অট্টহাস্য, স্পট রোহিতের উপর, তার বেশ আলুথালু, কষ্ট করে উঠে দাঁড়ায় সে, জোরে বলে ওঠে)

বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি! (মিউজিক)

ঋষি:- (চমকে উঠে) কী!! কী বললে তুমি? নাস্তিক। বিধর্মী। তাই তো ভাবি, এবার আসল সত্য ধরা পড়েছে। আমি চললাম এক্ষুনি রাজাকে খবরটা দিচ্ছি। তোকে শূলে না চড়িয়ে আমার শান্তি হবে না।

(২৯ জন ছাত্রের হাস্য, রোহিতের উপর থেকে আলো সরে যায়, রোহিত মঞ্চে পড়ে থাকে, মঞ্চে প্রবেশ করেন, রাজা দশরথ, আর এক রাজা)

দশরথ:- (আমন্ত্রণের ভঙ্গিতে, দুই হাত ছড়িয়ে) আসুন রাজা আসুন, আমার সৌভাগ্য এই রাজ্যে আপনার পদধূলি পড়ল। রাজা পায়াসির নাম এখন সকলের মুখে মুখে (কথার মধ্যে বিদ্রূপের ঝাঁঝ। দশরথের চোখ যাবে উইংসের কাছে দাঁড়ানো এক ঋষির দিকে) রাজা, উনি কে? (সেই দিকে ইশারা করে) আপনার সাথেই এসেছেন?

রাজা পায়াসি:- হ্যাঁ মহারাজ, ইনি আমার সাথেই এসেছেন, ইনি হলেন বিখ্যাত পণ্ডিত (তিনি এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিলেন)

অজিত:- আমি অজিত কেশকম্বলী।

দশরথ:- ও!! তাহলে সাজসজ্জা করেই এসেছেন রাজা পায়াসী!! এ তো শুধুই সৌজন্যের ভ্রমণ নয়, আপনার আপনাদের আগমণের হেতুটা যদি স্পষ্ট করেন।

(দুইজনকে দুটি বসার আসন দেখিয়ে দেন দশরথ তার তিন নম্বর আসনে নিজে বসেন)।

পায়াসী:- মহারাজ, আমি আর ঋষিবর এখানে এসেছি একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে।

দশরথ:- বলুন!

অজিত:- আমরা আপনার রাজপ্রাসাদে পাঠরত দাস পুত্র, শূদ্র পুত্র রোহিতের সাথে সাক্ষাত করতে চাই।

(মিউজিক)

দশরথ:- ও তাহলে এই খবর ছড়িয়ে পড়েছে!

পায়াসী:- হ্যাঁ রাজন, ছড়িয়ে পড়েছে, অন্যরা নিন্দা করলেও, আমি আর ঋবি কেশকম্বলী ভয়ানক আনন্দিত। আপনাকে শতকোটি প্রণাম, এই সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য।

দশরথ:- (আসন ছেড়ে উঠে দৃঢ়ভাবে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে) কিন্তু আমি তো আপনাদের সাথে ওই ছাত্রকে দেখা করতে দিতে পারব না।

অজিত:- পারবেন না!! কিন্তু কেন রাজা? আমরা বহু দুর যাত্রা করে অনেক আশা নিয়ে এসেছি।

দশরথ:- কিন্তু আমি অপারগ। রাজা পায়স, ঋষি কেশকম্বলী। আপনাদের যেটুকু নাম আমি শুনেছি, তা যে প্রশংসার নয়, তা নিশ্চয়ই আপনারা জানেন ।

অজিত (স্মিত হেসে):- হ্যাঁ রাজন, তা আবার আমরা বুঝব না কেন? আপনি যে আমাকে ঋষি বলে সম্বোধন করেছেন, তা আমাকে বিস্মিত করেছে। কারণ বৈদিক ব্রাহ্মণদের মতে আমি, আমরা নেহাতই অসুর!!

দশরথ:- হ্যাঁ, সে তো আমাদের অপরাধ নয়। আপনি বলেন যে মৃত্যুর পর, দেহ ছাই হয়ে যাওয়ার পর আর তা ফিরে আসতে পারে না। মৃত্যুর পর আর কিছু নেই, আত্মা আর দেহকে পৃথক করা যায় না, হোম আহুতি সব মিথ্যা।

অজিত:- হ্যাঁ আমি তা বলি বৈকি! যদি আপনাদের রাজ্যে কোনো বৈদিক ব্রাহ্মণ থাকেন তবে আমার সঙ্গে তর্কে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি তাদের। তবে এও সত্যি যাদের অন্য কিছু করার নেই, বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অন্য কোনো গুণ নেই, পরিশ্রম করার ক্ষমতা নেই, তারাই হন বৈদিক ব্রাহ্মণ।

পায়াসী:- (হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসেন পরিস্থিতি সামলাতে, দশরথ রাগে কাঁপছেন) থাক না ঋষিবর। আমরা এখানে এসেছি একটি নির্দিষ্ট কাজে, এখানে বৈদিক ব্রাহ্মণদের সাথে তর্কে যাওয়ার কোনো অভিপ্রায় আমাদের ছিল না।

দশরথ:- (আত্মসম্বরণ করে ধীরে ধীরে বলেন) না রাজা, রোহিতকে আমরা গতকাল বন্দি করেছি, তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়েছে, ফলে আপনাদের সাথে তার আর দেখা হবে না।

(পায়েস ও অজিত চমকে যান। ধীরে ধীরে বসে পড়েন, ঠিক সেই মুহূর্তে দ্রুত গতিতে মন্ত্রীর প্রবেশ, তিনি দশরথের কাছে চলে যান, স্পট তাদের দুজনের উপর)

মন্ত্রী:- রাজা, এই সুযোগ ছাড়বেন না।

দশরথ:- মন্ত্রী, আপনার কথা শুনে আমি একবার বিপদে পড়েছি, ওই দাস পুত্রকে নিয়ে রাজ্য তোলপাড়, ব্রাহ্মণরা কুপিত। আপনার কোনো পরামর্শ আমি আর মানতে পারবো না।

মন্ত্রী:- দেখুন রাজা, আপনি মিছিমিছি অধৈর্য হচ্ছেন। আমার পরামর্শ মানার ফলেই রাজ্যের কোষাগার পরিপূর্ণ হয়েছে। সওদাগররা খুশী হয়ে রাজস্ব জমা দিয়েছেন, গত ৪ বছর ধরে। আর আজ ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ বলেছে বলে যদি রোহিতকে আপনি মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছেন একথা জানাজানি হয় তবে আবার এরাজ্যের সওদাগররা ক্রুদ্ধ হবেন, আবার তারা আপনাকে রাজস্ব দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন।

দশরথ:- তাহলে আপনি কী পরামর্শ দিচ্ছেন? রোহিতকে মুক্ত করে দেব? যা করলে ব্রাহ্মণরা আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। না, মন্ত্রী, সওদাগরদের তুষ্ট রাখতেগিয়ে আমিতো ব্রাহ্মণদের অবহেলা করতে পারি না।

মন্ত্রী:- না রাজা, আমি বলছি আপনার হাতে সেই সুযোগ এসেছে যার সদ্ব্যবহার করলে আপনি দুই কুলই রক্ষা করতে পারবেন, সওদাগর বা ব্রাহ্মণ, কেউই আপনাকে ছেড়ে যাবে না।

(দশরথের কানে কানে মন্ত্রী কী একটা বলে, আর তারপরেই দুজনে হেসে ওঠে। তবে কাউকেই ভিলেন দেখানো যাবে না। দশরথ খুশি মনে পায়স ও অজিতের কাছে পৌঁছন, ওদিকে আলো জ্বলে ওঠে)।

দশরথ:- রাজা, ঋষিবর। মন্ত্রীর পরামর্শ মেনে আমি রোহিতের সাথে আপনাদের দেখা করার ব্যবস্থা করছি। ওকে আমরা মুক্ত করে দিচ্ছি। আমি পেয়াদা ডাকছি আপনাদের দুজনকে ছাত্রাবাসে নিয়ে যাওয়া হবে।

(পায়াসী যুবই আহ্লাদিত, কিন্তু অজিত কেশকম্বলী যেন কিসের আশংকায় গম্ভীর হয়ে যান। পেয়াদার প্রবেশ, দশরথের ইশারায় পেয়াদা তার কাছে যায়, দশরথ তাকে হাত পা নেড়ে কি যেন বলেন, তার পর পেয়াদা ঘাড় নেড়ে নির্দেশে সায় দিয়ে, তিনজনে উইংগসের দিকে পা বাড়ান, রস্ট্রামে আলো জ্বলে ওঠে, দেখা যায়, রোহিত সেখানে মুষড়ে বসে আছে পা ছড়িয়ে, হাতে একটি পত্র, রস্ট্রামে উপস্থিত হয় পেয়াদা সহ ঋষি ও পায়স)

পেয়াদা:- আপনারা কথা বলুন, আমি রাজার নির্দেশে এই ছাত্রাবাসের অন্য ছাত্রদের ও ঋষিদের এই কক্ষে ডেকে আনতে যাচ্ছি।

পায়স:- অন্যদের?!! কিন্তু কেন? আমরা শুধু রোহিতের সাথেই কথা বলতে এসেছি।

(রোহিত অবাক ও বিহ্বল। ও ওদের কথা শুনছে। কেশকম্বলী হেসে ওঠেন, বলেন)

অজিত:- এটুকুও বুঝতে পারলেন না পায়স!! আসলে রোহিতকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার উপযুক্ত কারণ খুঁজছেন দশরথ।

রোহিত:- আপনারা কে? আমাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে মুক্তি দিয়েছেন রাজা দশরথ। আপনারা এসব কী বলছেন?!!

পায়স:- আমি রাজা পায়স, আর ইনি ঋষিবর চার্বাক অজিত কেশকম্বলী। আমিও এই দেশের একমাত্র চার্বাক রাজা। তা বাছা, তোমাকে রাজা দশরথ মৃত্যুদণ্ড কেন দিয়েছিলেন? কী তোমার অপরাধ?

রোহিত:- পায়স, কেশকম্বলী?!! আপনাদের সাক্ষাৎ পেয়ে আমি ধন্য, কৃতার্থ!

অজিত:- (অধৈর্য হয়ে) কিন্তু তুমি আগে বল, বেশি সময় যে হাতে নেই, কেন তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন রাজা?

রোহিত:- আমি যে বেদ ত্যাগ করতে চেয়েছিলাম, আমি যে বৌদ্ধ হতে চেয়েছিলাম।

(মিউজিক। কেশকম্বলী মাথা নাড়েন, পায়স নাটকীয় ভঙ্গী করেন)

অজিত:- বুঝেছি। বেশ বুঝেছি এবার। বৌদ্ধ হওয়ার অপরাধে হত্যা করলে বৈশ্যরা ক্ষিপ্ত হবেন। আবার রোহিতকে মুক্তি দিলে ব্রাহ্মণরা। এবার আমরা দশরথকে রোহিতকে হত্যা করার সুযোগ করে দিলাম। পেয়াদা সকলকে ডেকে আনবে আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই।

পায়স:- আর সকলের সামনে প্রমাণিত হবে যে রোহিত মোটেই বৌদ্ধ নয়, সে হতে চেয়েছে নাস্তিক, চার্বাক।

রোহিত:- ব্যস, তাহলেই বৌদ্ধ সওদাগররাও আর আমাকে হত্যা করলে অখুশী হবে না, তারাও যে আপনাদের সহ্য করতে পারেন না, কি তাই তো?

অজিত:- হ্যাঁ, বাছা, তোমাকে মরতেই হবে, আমরা খুবই ব্যথিত ও লজ্জিত যে আমাদের জন্য তোমাকে এই যন্ত্রণা পেতে হচ্ছে।

রোহিত:- আপনাদের আর কী দোষ! মরতে আমাকে হতই।

পায়স:- (খুবই উত্তেজিত ভাবে, মিউজিক) তবে বাছা তোমার কাছে আমার একটা আবেদন আছে।

রোহিত:- কী আবেদন রাজা?

পায়স- আমি একটি গবেষণা করছি। উত্তর খুঁজছি, দেখতে চাইছি যে সত্যিই আত্মার অস্তিত্ব আছে কি না। তুমি আমাকে সেই কাজে সাহায্য করবে?

রোহিত:- আমি!! আমি আর মাত্র কিছুক্ষণ বেঁচে আছি, আমি কী উপায়ে আপনাকে সাহায্য করব রাজা?

অজিতঃ- না রোহিত, তোমাকে অবিলম্বে হত্যা করবেন না দশরথ, আগে রাজ্যে তোমার বিরুদ্ধে শোরগোল হবে, সেই অপেক্ষায় তিনি থাকবেন।

রোহিত:- (নাটকীয় ভঙ্গীতে) না ঋষিবর, আমি আর মাত্র কিছুক্ষণই ইহজগতে আছি, ওঃ না ভ্রান্ত কথা। পরলোক বলে তো কিছুই নেই, আত্মাও নেই। হ্যাঁ, আমি আছি আর মাত্র কিছুক্ষণ।

পায়াসী:- (রোহিতের কথাকে অগ্রাহ্য করে দ্রুত বলে চলেন) দেখো রোহিত, তুমিই আমাকে সাহায্য করতে পারবে। যারাই মৃত্যু শয্যায় থাকেন আমি তাদের কাছে নিজে যাই। আবেদন করি। তাঁদের বলি যদি সত্যিই মৃত্যুর পর কিছু থাকে, আত্মার যদি কোনও রকম অস্তিত্ব থাকে, স্বর্গ বা নরকে যাওয়ার আগে তারা যেন একটিবারের জন্য ফিরে আসেন। আমাকে যেন তাঁরা জানিয়ে যান যে সত্যি আত্মা আছে। বহু লোককে বলেছি। এমনকি যারা পাপী, আমার রাজ্যেই যারা মৃত্যুদণ্ডের আসামী ছিলেন, তাদেরকেও লোভ দেখিয়েছি। প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে তাদের যদি বা নরকেই স্থান হয় কিন্তু একবারের জন্য ফিরে এলে আমি তাদের সাথে সুন্দরী স্ত্রী, সুরা, সুস্বাদু ফল, আহার সব পাঠিয়ে দেব। স্বর্গের সমস্ত বিলাস ব্যসনের ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু নাঃ কেউ ফিরে আসেনি।

অজিত:- (তাকে থামাতে যায়)আঃ রাজা, এসব কি বলতে আছে কোনো মৃত্যু পথযাত্রীকে?

(পায়স ভ্রুক্ষেপ করেন না, এক বিজ্ঞানী সুলভ পাগলামি তার চোখে মুখে, রোহিতের আতংক বেড়েই চলেছে)

পায়স:- শোনো রোহিত। তুমি একটিবারের জন্য হলেও ফিরে এস। তাছাড়া, তাছাড়া আমি, হ্যাঁ আমি, রাজা দশরথকে বলব, যেন তোমার মৃত্যুর আগে তোমাকে ওজন করা হয়। আর মৃত্যুর ঠিক পরে আর একবার। আমি দেখতে চাই মৃত্যুতে দেহের ওজন কিছুটা কমে গেল কি না। কমে না গেলে বুঝতে হবে যে তোমার শরীরের মধ্য থেকে কিছু বেরিয়ে যায়নি, কোন আত্মা নির্গত হয়নি।

(আতংকে উন্মাদ রোহিত এক লহমায় তড়াক করে লাফ দিয়ে পায়সের কোমর বন্ধনী থেকে একটি চাকু ছিনিয়ে নেয়, মিউজিক, পায়স ক্ষিপ্র পায়ে এগিয়ে যায়, কিন্তু রোহিত নিজের গলায় চাকু ধরে, আর নিজের হাতে থাকা ভুর্জপত্রটি ওদের দিকে ছুঁড়ে দেয়)

রোহিত:- শুনুন মাননীয়গণ, এই চিঠিটা আমি বন্দি অবস্থাতেই আমার মায়ের জন্য লিখে রেখেছিলাম। একজন পত্র প্রেরক আমার মায়ের কাছে যাবে সেই ব্যবস্থাও পাকা ছিল। কিন্তু রাজা আমাকে মুক্ত করায় আর এই পত্র আমি তাকে দিইনি। নষ্টই হয়তো করে ফেলতাম, কিন্তু আপনারা এসে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন যে বেঁচে থাকার আর কোনো উপায় আমার নেই। কিন্তু না, আমি ওদের হাতে মরব না, আমি নিজের হাতেই মৃত্যু বরণ করলাম . . . !

—— মা, মা গো!! তুমি ঠিকই বলেছিলে মা, আমাদের পুঁথি পড়া সাজে না। চার বছর হয়ে গেল মা, আর মাত্র এক বছর বাকি আছে, কিন্তু আমার কাছে যেন এই অপেক্ষা এক যুগের। মা, আমি এখন পুঁথি পড়তে পারি, সকলের থেকে অনেক ভালো। কিন্তু আমাকে তুমি নিয়ে যাও মা। না হলে আমি যে আর বাঁচব না, আমাকে নিয়ে যাও এই নরক থেকে, মা মা, মা গো!!

(একটি সংস্কৃত শ্লোক সে বলতে থাকে, কিন্তু আবার সেই অট্টহাস্য শোনা যায়, সাথে ভেতর থেকে সংলাপ, কণ্ঠ:-“মিত্রোঁ, অব অওর ইয়ে নেহী চলেগা!! ব্রাহ্মণ ন হোতে হুয়ে ভী ইয়ে লোগ বেদ পঢ় রহে হ্যাঁয়, অওর কিতনে দিন হম সচ্চে হিন্দুলোগ ইন দলিতোঁ কো হমারে সর পর চঢ়নে দেঙ্গে! আইয়ে ভাইয়ো আউর বহনোঁ, ইন নীচলে জাতওয়ালোঁসে সহি তরিকে সে কুছসবকতো শিখাইয়ে।”

রোহিত :-মা হয়তো আর দুই একদিন পরেই এই রাস্তা বেছে নিতাম। কিন্তু আর অপেক্ষা নয়। আসলে আজই দুপুরে আমাদের প্রাসাদের এক কর্মচারী কেকয় প্রাসাদে যাবে। এই চিঠিটা আমি তার হাত দিয়ে তোমার কাছে পাঠাতে চাই। সুতরাং আজকেই আমাকে মরতে হবে মা, (ভেতর থেকে মন্থরার চিৎকার দূর থেকে যেন ভেসে আসবে, রোহিত যাস না, রোহিত না না) না মা, চিৎকার করে উঠো না, কেঁদো না, আমি পারলাম না মা, আমি পারলাম না।

(এই সময় রোহিত ভেমুলার ছবি পিছনে স্ক্রীনে ভেসে উঠবে)

(এক ঝটকায় রোহিত চাকু চালিয়ে দেয় নিজের গলায়, কাঁপতে কাঁপতে ঢলে পড়ে সে, চিঠির ভাষ্য শোনা যায় প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে)

একই কন্ঠ এবার নেপথ্যে:-(স্বরগ্রাম ক্রমশ নিম্নতর হতে থাকবে, ক্রমে বিলম্বিত হবে) মা, আমি হেরে গেলাম। — কতদিন তোমার কাছে শুতে পারিনি।— কেন যে আমি পড়তে গেলাম। বর্ণাশ্রম প্রথা সমূলে সম্পূর্ণ ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত আমাদের ঘরে আর যেন কেউ পুঁথি পড়তে না আসে। — তুমি ঠিকই বলতে মা, আমারই ভুল। — এই ৩০ জনের মধ্যে আমিই সর্বশ্রেষ্ঠ, — আমি প্রমাণ করেছিলাম মা, শূদ্রের জ্ঞান বুদ্ধি ব্রাহ্মণ সন্তানদের চাইতে বেশি হতে পারে —তাই আমাকে বাঁচতে দেবে না ওরা। ওরা আমাকে হত্যা করার আগে তাই আমিই নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। না মা, তোমারসঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। — — তবে তুমিই আমাকে মাথা উঁচু করে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলে। — —- — তার জন্য আমি তোমার কাছে ঋণী রইলাম, মা আমার।

দৃশ্য ৭

(কৈকেয়ী আর মন্থরা, মন্থরার হাতে এক ভূর্জলিপি। সেটি হাত থেকে পড়ে গেল। বোঝা গেল, এইটেই সেই চিঠি, যা রোহিত আত্মহননের আগে মাকে দিয়েছিল, বার্তাবাহক মারফত। সামনে দাঁড়িয়ে বার্তাবাহক)

বার্তাবাহক:- মা, আপনাকে আর একটা খবর দিতে চাই। ছেলের অপরাধের জন্য তার বাপকেও বন্দি করেছিলেন মহারাজ। তবে কয়েদখানার ভেতরেই তিনি পুত্রশোকে প্রাণ ত্যাগ করেছেন। (মন্থরা টলে যায়, কৈকেয়ী তাকে ধরে নেয়)

কৈকেয়ী:- দাইমা, তুমি অমন কোরো না, আজ আমাদের শোকের দিন নয়, শপথ নেওয়ার দিন। তোমার ছেলে আর স্বামীর এই দশা যারা করল তাদের ধ্বংস করতেই হবে। দাইমা রাজা দশরথও যাতে পুত্রশোকে মারা যায়, তার জন্য যা যা করতে হয় আমি আর তুমি মিলে করব, দেখে নিও।

(একটা গ্রুপ নাচ হলে ভালো হয়, নজরুলের “জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা” – প্রথম দুই স্তবক বিলম্বিত লয়ে, পরের দুই স্তবক দ্রুত তালে, নৃত্যগীত করা যেতে পারে।

নাচ ফেড আউট করে শেষে মঞ্চে ফেড ইন অযোধ্যার প্রাসাদের অন্দরমহল, দশরথ ও কৌশল্যা)

দশরথ:-  রাণি, মুনি ঋষিরা আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন আবার বিবাহ করার, তোমার কোলে এখনো কোনো পুত্র এল না।

কৌশল্যা:- মহারাজ, আপনি যদি আর একটু সময় আমাকে দেন, আমি কথা দিচ্ছি আগামী বছরই আপনি পুত্র সন্তানের মুখ দেখবেন।

দশরথ:- না রাণি অবুঝ হয়ো না, শাস্ত্রমতে ব্রাহ্মণ বা রাজার দুই তিন বা চার নয়, অসংখ্য বিবাহ করাই কর্তব্য।অন্যথায় অন্তঃপুরের শোভা বর্ধনের উপায় হয় না।

কৌশল্যা:- (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) আপনি কি পাত্রী মনোনীত করে ফেলেছেন?

দশরথ:- হ্যাঁ, আমার পারিষদেরা পছন্দ করে ফেলেছে। কেকয় রাজ্যের অতি সুন্দরী রাজকন্যা কৈকেয়ী। (আমতা আমতা করে) যদিও একটা শর্ত দিয়েছেন কেকয় রাজা।

কৌশল্যা:- শর্ত দিয়েছে? আপনাকে? কী সেটা?

দশরথ:- এই বিবাহের পর তোমার কোলে যদি পুত্র আসেও, তবুও তার নয়, কৈকেয়ীর পুত্রেরই রাজ্যাভিষেক হবে।

কৌশল্যা:- রাজা!! এ আপনি কী বলছেন? আপনি এই শর্ত স্বীকার করেছেন?

দশরথ:- (মাথা নীচু করে) হ্যাঁ, আমি সম্মতি জানিয়েছি।

[মঞ্চের অন্যধারে স্পট পড়ে, কৈকেয়ী, যুবতীর সাজে সে, আর মন্থরা, দুজনই মনমরা]

কৈকেয়ী:- আমার মা থাকলে এভাবে একটা বুড়ো রাজার হাতে আমাকে গছিয়ে দেওয়া মেনে নিতেন না।

মন্থরা:- সে কী। রাজা আবার বুড়ো হয় নাকি! রাজা রাজাই।

কৈকেয়ী:- কিন্তু এই রাজার তো রাণি আছে।

মন্থরা:- এ আবার কেমন ধারা কথা তোমার বাপু!! সব রাজারই তো অনেক রাণি থাকে। শক্তিমান পুরুষ তেনারা, তাদের কি এক কনেতে মন ভরে? বাইরে তারা নতুন নতুন রাজ্য জয় করে, আর অন্দরমহলে নতুন নতুন কন্যে এনে ঘর সাজায়! এরকমই তো হয়ে আসছে মা!

কৈকেয়ী:- তবু মনে হয়, আমার মা থাকলে আমার এমন রাজার সাথেই বিবাহ হত যার আমিই হতাম প্রথমা স্ত্রী।

মন্থরা:- কিন্তু তোমার বাবা, রাজামশাই তো শুনলুম শর্ত দিয়েছেন, যে তোমার সন্তানই হবে রঘুবংশের রাজা, তাহলে আর তোমার চিন্তা কী?

কৈকেয়ী:- আমি প্রধানা রাণি হতে চাই, সেকি শুধু আমার সন্তান রাজা হবে বলে?? কী জানি!! আমার এই বিবাহেঅন্তরে একটুও সায় নেই। তার চেয়ে আমি তোমার ঘরেই যেতুম, রোহিত নিশ্চয়ই দ্বিতীয়বার বিয়ে করত না,বল? (বলেই সে হুঁশ ফিরে পায়, বোঝে যে তার ভারি অন্যায় হয়ে গেছে)

মন্থরা:- (মাথা নীচু করে) কৈকেয়ী, রঘুবংশের খুব নাম, তুমি সুখী হবে।

কৈকেয়ী:- (ঝাঁঝিয়ে উঠে) কী বলছ দাইমা, ওরা তো খুনী!! তোমার ছেলেকে হত্যা করেছে। তোমার মনে নেই, রোহিতের মৃত্যুর খবর পেয়ে আমরা শপথ নিয়েছিলাম যে দশরথ রাজা যেদিন পুত্রশোকে মারা যাবেন সেদিন রোহিতের আত্মা শান্তি পাবে!!??

মন্থরা:- সে তো পুরনো কথা মা, আমার আর ওসব মনে নেই, ভালোও লাগে না আর।

কৈকেয়ী:- তুমি ভুলে গেলেও আমি ভুলিনি! দাইমা ঈশ্বর আমাদের সুযোগ করে দিয়েছেন, রোহিতের মৃত্যুর বিচার করার।

মন্থরা:- সুযোগ? সে আবার কী কথা মা?

কৈকেয়ী:- হ্যাঁ দাইমা, সুযোগই বটে। যেদিনই আমি শুনেছি, সে বুড়োটা আমাকে বিয়ে করবে বলে পাগল হয়ে গেছে, আমিই পিতাকে বলে সেই শর্ত দেওয়া করিয়েছি। এবার চলো দাইমা, আমরা দুজনেই শত্রুর ঘরে প্রবেশ করে এই যুদ্ধ জিতব। আমি পিতাকে বলব যে তুমিও আমার সঙ্গে শ্বশুর ঘরে যাবে।

(মিউজিক, দৃশ্যান্তর)

দৃশ্য ৮

(আবার বুড়ি মন্থরা আর ভাইপো রোহিত ও তার স্ত্রী)

মন্থরা:- জানিস তো রোহিত, আমার তখন বোধ বুদ্ধি লোপ পেয়েছে, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য অবস্থায় আমি রাজি হলাম।

রোহিত:- তুমি রাজি হলে? রাজাদের পরিবারের এক রাজকুমারীর কথা তুমি বিশ্বাস করলে?

মন্থরা:- হ্যাঁ বাবা, আমি বিশ্বাস করেছিলাম, ভেবেছিলাম কৈকেয়ী বুঝি সত্যিই আমার রোহিতকে ভালবেসেছিল। আসলে দ্বিতীয় রাণি হওয়ার অপমানের প্রতিশোধ নিতে চাইছিল সে।

রোহিতের স্ত্রী:- খুড়ি, তুমি বল, থেমো না। যা হয়ে গেছে তা তো আর ফেরানো যাবে না, তাই . . . — যাই হোক বল।

মন্থরা:- হ্যাঁ হ্যাঁ, বাছা আমাকে একটু জল দে। (রোহিতের স্ত্রী এক মাটির ঘটি ভর্তি জল এনে দিল, মন্থরা খেল) তার পরের কয়েকটা বছর কেমন করে জানি কেটে গেল। এরই মধ্যে রাজা আবার বিবাহ করলেন, আর তিন রাণির কোলেই এল সন্তান, চারটি পুত্র সন্তান। রাম, ভরত, লক্ষ্মণ আর শত্রুঘ্ন।

(আলো ফেড আউট হবে, মন্থরা তার পাকা চুলের কস্টিউম খুলে ফেলে, মঞ্চের অন্য ধারে চলে যাবে। ওপাশে আলো জ্বলবে, চারটি যুবক একসাথে বসে গল্প করছে)।

মন্থরা:- ভরত দাদুভাই, তোমার মা তোমাকে ডাকছেন, তুমি সকাল থেকেই কিছু খাওনি।

ভরত:- না দাইদিদা, দাদাদের সাথেই খাব, এতদিন পরে দাদা আর লক্ষণ তারকা আর মারীচ বধ করে ফিরল, আজ প্রাসাদের আবার প্রাণ ফিরে এল।

(তিন রাণির প্রবেশ, দেখে বোঝা যাচ্ছে যে তিনজনের মধ্যেই গলায় গলায় ভাব। কৈকেয়ী মন্থরাকে বিশেষ পাত্তা দিল না, মন্থরা উইংস দিয়ে ভেতরে যাবে)

কৌশল্যা:- রামকে এবার বিবাহ করতে হবে। রাম, কাল মিথিলাতে যেতে হবে তোমাদের। মিথিলার রাজকন্যা সীতার স্বয়ম্বর সভায়। তৈরি হয়ে নাও।

ভরত:- মা!! বিবাহ করবে দাদা, আমাদের গিয়ে কি হবে? দাদাই যাক।

কৈকেয়ী:- না, তোমরা সকলেই যাবে, পিতার আদেশ।

রাম:- যথা আজ্ঞা। যেতে বলছেন রাজা, তোমরা আপত্তি কোরো না।

শত্রুঘ্ন- দাদা, তুমি হবে অযোধ্যার রাজা। তোমার নির্দেশ শিরোধার্য। (মিউজিক, কৈকেয়ীর মুখে স্পট, দুই রাণি হাসতে হাসতে মঞ্চ ছাড়ছে, কিন্তু কৈকেয়ী দাঁড়িয়ে। কৈকেয়ীর মুখে জিঘাংসা, সে এগিয়ে আসে, আর তার পর ধীরে ধীরে এগোয় মন্থরার নিকে, তারও ওপর স্পট)

কৈকেয়ী:- দাইমা, এবার তৈরি হও, ছেলেরা মিথিলা থেকে ফেরার পরেই আমি রাজা মশাইকে তাঁর প্রতিশ্রুতির কথা মনে করাব, রাম নয় ভরতই রাজা হবে, আর তার সঙ্গে চাইব রামের বারো বছর বনবাস।

(মিউজিক, পর্দায় ছায়ায় তিন মূর্তির বনের দিকে যাত্রা। মঞ্চে দশরথ মাথা নীচু করে বসে, কৌশল্যা, কৈকেয়ী, শত্রুঘ্ন আর ভরত সামনে দাঁড়িয়ে)

ভরত:- মা তুমি এ কী করলে?

কৌশল্যা:- না বাবা, তোমার মা-কে এমন প্রতিশ্রুতি তোমার বাবাই দিয়েছিলেন, বিবাহের সময়।

ভরত:- কিন্তু মা একবারও আমাকে জিজ্ঞেস করলে না? আমি রাজা হতে চাই কি না? বাবা, আমি দাদা রামের আসন ছিনিয়ে নিতে পারব না, এই আসন শুধুমাত্র দাদারই। আপনার অবর্তমানে রাজা হবেন তিনিই।

দশরথ:- মাত্র একদিন হল রাম গেছে প্রাসাদ ছেড়ে আর আমার মনে হচ্ছে বুঝিবা দশ বছর অতিক্রান্ত। মনে হচ্ছে এক লহমায় আমার বয়স বেড়ে গেছে অনেক অনেক বছর। মনে হয় আমি আর বেশিদিন নেই।

কৈকেয়ী:- (ইতস্তত করে) ভরত তুই আমার দিকে ওইভাবে তাকাস না!! এই প্রতিজ্ঞা আজকের নয়, কুমারী অবস্থাতেই আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, রোহিতের হত্যার প্রতিশোধ নেবই।

দশরথ:- কে রোহিত?

ভরত:- আমরা? কে সেই আমরা, মা?

কৈকেয়ী:- রোহিত আমার দাইমা, মন্থরার ছেলে। সে এই প্রাসাদে পুঁথি পড়তে এসে আত্মহনন করেছিল।

শত্রুঘ্ন:- আর তাই ওই দাসী মন্থরা এই চক্রান্ত করেছিল, আপনাকে ব্যবহার করে নিজের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করল ওই দাই!!

ভরত:-  না, না দাইদিদা কিছুতেই এমন কাজ করতে পারে না।

শত্রুঘ্ন:- দাদা, তোমার দাইদিদার উপর এই সহানুভূতি আমরা কেউ ভাল চোখে দেখছি না। তুমি নিজের মা-কে দোষারোপ করছো, অথচ দাইদিদার দোষ মানতে চাইছো না!!!? এই কে আছো, বেঁধে আনো ওই কুচক্রী কুঁজী বুড়ি মন্থরাকে!!

(মন্থরাকে ধরে নিয়ে আসা হল। নাচ। কয়েকটা নেকড়ের মুখোশ পড়া নৃত্যশিল্পী। মন্থরাকে ঘিরে ধরে আঘাতের পর আঘাত করছে শত্রুঘ্ন আর ওই নেকড়েরা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে কৌশল্যা, কৈকেয়ী, ভরত আর দশরথ। কৈকেয়ী হতাশ হয়ে বসে পড়ছে, ভরত নাচের ব্যুহ ভেদ করে ঢোকার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। শেষে সে ঢুকল এবং মৃতুর মুখ থেকে মন্থরাকে বাঁচাল)

ভরত:- (গর্জন করে) থামো তোমরা, সকলে থামো!! এই বুড়িকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দাও তোমরা, কিন্তু মেরে ফেলো না। এরই কোলে পিঠে চড়ে আমি মানুষ।

(কান্নায় ভেঙে পড়ে সে, মন্থরা ধীরে ধীরে ওঠে, ভরতের মাথায় হাত দিতে যায়, ভরত তা ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান করে, মন্থরা এবার কৈকেয়ীর দিকে তাকায়, কৈকেয়ী অস্বস্তিতে চোখ নামিয়ে নেয়, এবার সে আস্তে আস্তে মঞ্চ ছাড়ে, উইংগসে ঢোকার আগে ফিরে তাকিয়ে বলে,)

মন্থরা:- আমি অভিশাপ দিচ্ছি, রাজা দশরথ, আমার স্বামী যেভাবে পুত্রশোকে মারা গেছে, সেই রকম পুত্রশোকই আপনারও মৃত্যুর কারণ হবে।

শত্রুঘ্ন আর ভরত সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে:- দাসীর অভিশাপ!! শূদ্রের অভিশাপ!! তোমাকে প্রাণে মারলেই ভালো হত দেখছি!! ব্রাহ্মণ ছাড়া কারও অভিশাপ লাগে না, বুড়ি।

(মিউজিক, মঞ্চ অন্ধকার, সকলের প্রস্থান। হালকা আলোয় মন্থরাকে নিয়ে সত্যকাম আর তার বউ-এর প্রবেশ, তিনজনের দু চোখে তখন জলের ধারা। বসছে তারা। মন্থরা আস্তে আস্তে পায়েসের বাটি খুলল, দুজনে তৃপ্ত হয়ে সেই পায়েস খেল। দৃশ্যান্তর)

দৃশ্য ৯

(ভাইপো রোহিত বা সত্যকাম আর তার স্ত্রী, কোলে একটি শিশু। কান্নার আওয়াজ শোনা যাবে ভেতর থেকে)

রোহিতের স্ত্রী:- আজ খুড়ির আশীর্বাদ করবে নাতিকে, নাতির মুখ দেখে কি খুশীই না হবে!

ভাইপো:- (উত্তেজিত) শুধু কি তাই, আমাদের খোকার নাম দেবে খুড়ি। না হলে যা রেগে যাবে না!! (হাসি দুজনের)

(মন্থরার কুটিরের একপাশে, মন্থরা কাঠ নিয়ে প্রবেশ করছিল কুটিরে, ওদের দেখে থমকে দাঁড়াল, আহ্লাদে কাঠ মাটিতে ফেলে ছুটে গেল)

মন্থরা:- আমার চাঁদ, আমার সোনার টুকরোকে নিয়ে এসেছিস বাছারা। (শিশুকে কোলে নেয় সে)

রোহিত:- খুড়ি, এর নাম কী হবে? বল, তোমাকেই বলতে হবে।

রোহিতের স্ত্রী:- হ্যাঁ খুড়ি, তোমার আশীর্বাদ পেলে আমাদের খোকার ভালো হবে।

মন্থরা:- (একটু অন্যমনস্ক ও মনমরা) আশীর্বাদ? কিন্তু বাছা, আমার আশীর্বাদ যে অভিসম্পাত হয় যায়, আমার রোহিতকেও যে আমি আশীর্বাদ করেছিলাম। কিন্তু তার তো ভালো হল না!!

(সত্যকামের স্ত্রী চমকে ওঠে, ইতস্তত করতে থাকে, শিশুটিকে নিয়ে নেয় মন্থরার থেকে আচমকা, ভাইপোর চোখ এড়ায় না, সে আবার শিশুকে নিয়ে তুলে দেয় মন্থরার কোলে)

ভাইপো রোহিত:- না খুড়ি, এসব ভয় পেলে আমাদের চলে না, আমাদের জীবনে পদে পদে ঝুঁকি, কিন্তু আমরা বেঁচে থাকি সংগ্রাম করে, আর ভালোবাসায় ভর করে। বলো খুড়ি, এর নাম বল।

মন্থরা:- বেশ, তাহলে এর নাম হোক শম্বুক। হ্যাঁ শম্বুক। ধীর স্থির হবে সে, আমার রোহিতের মতো অস্থির চিত্তের হবে না। আর ওকে রক্ষা করার জন্য অন্য কাউকে লাগবে না, শামুকের মতোই ও নিজেই নিজেকে রক্ষা করবে, কবচ ধারণ করবে ও।

ভাইপোর স্ত্রী:- (খুশি হয়ে শিশুকে নেয় সে) বাঃ, শম্বুক, শামুক, খুব ভালো খুড়ি, আমার শামু।

ভাইপো রোহিত:- (হঠাৎ যেন কী মনে পড়ে যায়) খুড়ি তুমি শুনেছো রামচন্দ্রের খবরটা?

মন্থরা:- (চমকে ওঠে) রামের খবর? কই না তো? রাম খুব দুস্টু ছিল (স্নেহের সাথে), খেলতে খেলতে আমার পায়ে লাঠি দিয়ে এমন আঘাত করেছিল যে এখনো পায়ে মাঝে মধ্যে ব্যথা করে। যা হোক, কী খবর রে?

ভাইপো:- খুড়ি, তোমার রোহিতের মৃত্যু বিফলে যায় নি। রাম বনবাসের পথে যেতে যেতে নিষাদ রাজা, গুহককে আলিঙ্গন করেছেন। আদিবাসী রাজা, শূদ্র রাজা। ক্ষত্রিয় রামের জাত যায়নি তাতে!!

মন্থরা:- সত্যি? সত্যি বলছিস তোরা? ওমা, আজ শম্বুকের মুখ দেখলাম, আবার এই খবরটাও পেলাম, আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম বাপু!!??

ভাইপোর স্ত্রী: (একটু বিরক্ত হয়ে) সে তোমরা মা-বেটাতে যাই বলো বাপু, আমার মন মানে না। আমি ওদের এতটুকুও বিশ্বাস করি নে। এখন রাম রাজপুত্র, রাজা হলে কি আর নিষাদদের জড়িয়ে ধরবে? না, কিছুতেই তা আর তিনি করবেন না। তাছাড়া বনের পথে রাম নিঃসঙ্গ, সীতা আর লক্ষ্মণকে নিয়ে সহায় সম্বলহীন। এখন তাঁর বন্ধু দরকার। তাই সে নিষাদ রাজাকে জড়িয়ে ধরেছে, কিন্তু একবার সিংহাসনে বসলে — উঁহু (মাথা নাড়ে সে)

মন্থরা:- (রাগ করে) ওমা!! তোমার বাছা সন্দেহ বাতিক। রাম আমার ভালো ছেলে। (ভাইপোর দিকে ইশারা করে) এই তোদের সাথে দেখা হলেও জড়িয়ে ধরবে, দেখিস তোরা।

(রোহিতও কটমট করে স্ত্রীর দিকে তাকায়, কিন্তু স্ত্রী ভ্রুক্ষেপ করে না)

ভাইপোর স্ত্রী:- (হেসে ওঠে, ব্যঙ্গের সুরে বলে) আমাদের জড়িয়ে ধরবে!! আমাদের!! না গো না, বড়োজোর আলিঙ্গন করবে শূদ্র নিষাদ রাজাকে, আমাদের মতো নিষাদ — শূদ্র প্রজাকে নয়।

মন্থরা:- আছা, আচ্ছা এখন তোরা যা বাপু, আমার অনেক কাজ। যা, যা।

(কয়েক বছর গড়িয়ে যাওয়ার দৃশ্যপট তৈরি হবে, ওই কুঁড়ে থেকেই আর একটু বয়স্কা মন্থরা বেরিয়ে এল, আর সেই ধারের উইংস থেকেই একটি বালকের প্রবেশ)

বালক শম্বুক:- ও ঠানদি, ঠানদি, ও ঠানদি।

মন্থরা:- এই যে আমার দুস্টু শামুক এসে গেছে। কী রে? আজ কি আবার বাপের কাছে মার খেয়ে এলি নাকি?

শম্বুক:- না না, আমি আজ রাম-সীতার গল্পটা শুনতে এসেছি।

মন্থরা:- ওমা, আর কতবার শুনবি? একই গল্প শুনতে ভালো লাগে তোর?

শম্বুক:- হ্যাঁ লাগেই তো। আচ্ছা সীতা নাকি খুব সুন্দর? গায়ের রঙ নাকি দুধের মত? আচ্ছা এখন যে সীতাকে রাবণ ধরে নিয়ে গেছে, সে কি খুব কাঁদছে?

মন্থরা:- না কাঁদবে কেন? আমার সীতা খুব সাহসী। তাছাড়া রাবণ তাকে আরামেই রেখেছে শুনেছি। রাবণও ধার্মিক, তার উপর জুলুম করবে না।

শম্বুক:- (মন্থরার চারিদিকে ঘুরতে ঘুরতে) আচ্ছা ঠানদি, রোহিত কে? (মিউজিক)

মন্থরা:- কেন? তোর বাপ? (কণ্ঠে ব্যথা আর সন্দেহ)

শম্বুক:- না, এটা অন্য কেউ। কাল মা আর বাবা কথা বলছিল, আমি শুনেছি।

মন্থরা:- (আস্তে আস্তে বসে শম্বুককে ধরে ঝাঁকুনি দেয়) কী বলছিল তোর বাপ-মা?

শম্বুক:- (একটু ভয় পেয়ে যায়) বলছিল, খুড়ির ছেলে রোহিত সব বদলে দিয়েছে। কাল নাকি রাম শূদ্রের এঁটো করা ফল খেয়েছে। (মঞ্চের আলো কমে আসবে, অন্য zone-এ স্পট। শবরী মাটিতে আর রাম একটু উঁচু পাথরের উপর বসা)

বৃদ্ধা শবরী:- আপনি আজ যেভাবে আমাকে সম্মানিত করলেন, তার জন্য আমি আপনার কাছে চিরঋণী।

রাম:- আপনি শূদ্র হলেও জ্ঞানী। বেদ, যজ্ঞ, শাস্ত্র, সবেরই জ্ঞান আপনি আহরণ করেছেন ঋষি মাতঙ্গের কাছ থেকে। তাই আজ আমি অন্য দর্শনাভিলাষীদের কুটিরে যাইনি, আপনার কাছেই এসেছি, আপনার আতিথ্য গ্রহণ করেছি। তবে আমি একটু বিপদে।

শবরী:- কী বিপদ রাম, আমাকে বলুন।

রাম:- আপনার গুরু মাতঙ্গের অভিশাপে সুগ্রীবের খোঁজ পাচ্ছি না। একমাত্র সুগ্রীবই পারবে আমাকে সীতার কাছে পৌঁছে দিতে। আপনি আমাকে বলুন সুগ্রীবকে কোথায় পাওয়া যাবে।

শবরী:- বেশ শ্রীরাম, আপনাকে আমি বলে দিচ্ছি সুগ্রীবের ঠিকানা, আর আপনি আমাকে বলুন আমার মুক্তির উপায়, জ্ঞানের রহস্য।

রাম:- তথাস্তু। (স্পট ফেড করবে, আবার এই জোন আলোকিত।)

মন্থরা:- (উল্লসিত) বাবা শম্বুক, তুই এখন বুঝবি না, কিন্তু শুনে রাখ, আমরা এগোচ্ছি, রোহিত যার সূচনা। নিষাদ রাজ, শবরী। আমরা এগোচ্ছি শম্বুক, আমরা এগোচ্ছি। বল পারবি না, তুই আরও এগোতে? বল?

শম্বুক:- (নিষ্পাপ স্বরে) তুমি যা বলবে আমি তাই শুনব ঠানদি। বল আমাকে কী করতে হবে?

মন্থরা:- (মিউজিক) তোকে পুঁথি পড়তে হবে, তোকে পণ্ডিত হতে হবে, তোকে শাস্ত্র পড়তে হবে, তোকে ঋষি হতে হবে। (দীর্ঘ মিউজিক, দৃশ্যান্তর)

দৃশ্য ১০

(১৪ বছর পর। মন্থরা শয্যাশায়ী। মৃত্যুর অপেক্ষায়। শুয়ে আছে নিঃসঙ্গ কুটিরে, তার ভ্রাতুষ্পুত্র সত্যকাম/রোহিত আর তার যুবক ছেলে শম্বুক এল দৌড়াতে দৌড়াতে, খুড়ির বিছানার পাশে এসে বসে পড়ে বলল)

ভাইপো:- তুমি শুনতে পাচ্ছ? শুনতে পাচ্ছ খুড়ি?

শম্বুক:- ঠানদি। শুনতে পাচ্ছো?

মন্থরা:- (স্নেহের হাসি হেসে মাথা নেড়ে আস্তে আস্তে কথা বলল, বড় ক্ষীণ সেই কণ্ঠস্বর)কেন রে বাছা, আবার কী খবর বয়ে নিয়ে এলি আমার জন্য?

ভাইপো:- (তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল), খুড়ি, গতকাল শ্রীরামচন্দ্র রাবণকে বধ করে বিজয় গৌরবে আযোধ্যা ফিরেছেন।

মন্থরা:- তা বেশ, তা বেশ। বড়ো ভালো ছেলে ওই রাম।

ভাইপো- না না খুড়ি, শোনো পুরোটা।

(মন্থরা ইশারায় বলতে বলে)

ভাইপো- ফিরেই তিনি প্রথমে পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছেন মাতা কৈকেয়ীকে।

মন্থরা:- (স্মিত হেসে) ভালোই তো। বললাম তো, বড়ো ভালো ছেলে আমাদের রাম।

ভাইপো:- (রাগত কন্ঠে) নাঃ, কিছুতেই তুমি শুনছ না। পা ছুঁয়ে কী বলেছেন জানো রামচন্দ্র? (মিউজিক)

মন্থরা:- বল, বাছা আমার, বল। রাগ করিস না, এই বুড়ির ওপর।

ভাইপো:- রামচন্দ্র বললেন।(ফ্রিজ)

(সংলাপ শোনা যাবে, ভেতর থেকে)

মাতা কৈকেয়ী, আমি আপনাকে ক্ষমা করেছি। কারণ আপনি যা বলেছেন তা আপনার কথা নয়, দেবী সরস্বতীই আপনার জিহ্বায় ভর করেছিলেন। আমার বনবাস না হলে রাবণ সীতা হরণও করত না, আর আমিও রাক্ষস রাজা রাবণ বধ করে অধর্মের ওপর ধর্মের বিজয় প্রতিষ্ঠা করতে পারতাম না।

মন্থরার চোখ বিস্ফারিত হয়, সে দুই হাত নাড়াতে চেষ্টা করে কাকে যেন থামাতে চেষ্টা করছে। আস্তে আস্তে উঠে বসার চেষ্টাও করছে সে। ভাইপো তাকে ধরে রাখতে পারছে না। তার পর তার গলা থেকে বেরিয়ে আসে তার শেষ শব্দ, শেষ বাক্য)

মন্থরা:- ওরে, তোরা কেউ রামকে গিয়ে বল, সরস্বতী নয়, কিছুতেই সরস্বতী নয়। আমার ছেলে রোহিত ভর করেছিল কৈকেয়ীর কণ্ঠে, জিভে, মনে। রোহিত সেদিন আত্মহনন না করলে, কৈকেয়ী কোনো অজুহাতেই নিজের ছেলেকে রাজা করার আবদার করতে পারত না। দুষ্ট রাবণকে হত্যা করা সম্ভব হয়েছে আমার রোহিতের জন্য, ধর্মের জয় আর অধর্মের পরাজয় হয়েছে আমার রোহিতের জন্য, কেউ তোরা গিয়ে বল — (দৃশ্যান্তর)

দৃশ্য ১১

(ভাইপো রোহিতের স্ত্রীর প্রবেশ, চুল খোলা ঢিলাঢালা কালো পোশাক, এক শোকস্তব্ধ মূর্তি)

ভাইপোর স্ত্রী:-শম্বুক, শামু, তোকে আমি কিছুতেই তপস্যা করতে দেবো না। শামু শামুরে এ এ…।

(যুবক শাম্বুকের প্রবেশ, উইংসের দিকে ভাইপো রোহিতের স্ত্রী যাচ্ছিল, সেখান থেকেই)

শম্বুক:- মা মা মা গো তুমি ভয় পাচ্ছ মা, আমার কিচ্ছুটি হবে না। আজ আর সেই দিন নেই গো। আজ আর অস্পৃশ্যতা মানেন না রামচন্দ্র।

মা:- ছোঁয়া মানেন না!! তাই বলে কি এই রাজ্যে জাতপাত নেই?ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-শূদ্র সবাই সমান?

শম্বুক:- সে আমি জানি না!! তবে আমি যদি তপস্যা করি রাজা রাগ করবেন না। তিনি প্রজা বৎসল। তিনি প্রজাদের কথাকে মান্যি করে এমনকি সীতাকেও পরিত্যাগ করেছেন। তিনি আমাকে রক্ষা করবেনই।

মা:- ঠিক সেটাই আমার ভয়! রামচন্দ্র যদি ব্রাহ্মণদের কথায় সীতাকে ছেড়ে দিতে পারেন, তবে তিনি ব্রাহ্মণদের কথায় তোকেও শাস্তি দিতে পিছপা হবেন না।

শম্বুক:- (অস্থির হয়ে) যদি তাই হয় তবে হোক। রোহিতের আত্মত্যাগের জন্য আমি হয়েছি, আর আমাকে যদি মরতে হয়, বুঝব আমার জীবন সার্থক, আমার পরে আসবে আরো অনেক শম্বুক, অনেক রোহিত।

মা:- (কেঁদে ওঠে কিন্তু শান্ত গলায়) তুই যখন এত বড় কথা বললি, তখন যা। আমি আর তোকে বাধা দেব না। আমি বীরের মা, এতেই আমার জীবন ধন্য হল। তবে শুধু শোন বাবা, জঙ্গলে গিয়ে সাবধানে থাকিস। জঙ্গলে বন্য পশু আছে, কিন্তু তার চেয়েও হিংস্র হচ্ছে সেই সব ঋষি, যারা তপস্যার নামে শুধু হোম-যজ্ঞ করেন আর পশু হত্যা করেন আর সেই সব মাংস খান। সাবধান বাবা। ঋষিদের থেকে সাবধান, ঋষিদের থেকে সাবধান, —

(প্রথম দৃশ্যের চরিত্ররা, রাম শম্বুক রস্ট্রামে সেইভাবেই দাঁড়িয়ে, রাম শম্বুককে হত্যা করতে উদ্যত, পশ্চাতপর্দায় আবার দেখা যায় রোহিত ভেমুলার ছবি, সামনের পর্দা ধীরে ধীরে পড়বে)

ব্যাকগ্রাউন্ডে অন্ধকার ও ধীর লয়ে সংলাপ:- ওরে — তোরা রামকে গিয়ে বল — সরস্বতী নয় — ধর্ম ধ্বজা উড়েছিল —রোহিতের জন্য।

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *