সব কিছু মনে রাখা হবে…

সুমন সেনগুপ্ত

সারা বিশ্ব করোনার বিরুদ্ধে লড়ছে আর আমাদের দেশ তাঁর নাগরিকদের বিরুদ্ধে লড়ছে। কোন নাগরিকদের বিরুদ্ধে? যে নাগরিকেরা তাঁদের ঘাম, রক্ত, পরিশ্রম দিয়ে তিল তিল করে এই শহর, বন্দর, রাস্তাগুলো বানিয়েছেন। যে নাগরিকদের হাতে তৈরি এই ঝাঁ চকচকে শপিং মল, সিনেমা হল যেখানে শহুরে মধ্যবিত্ত তাঁদের অবসর কাটাতে যান, সেই নাগরিকরাই আজ পথ হাঁটছেন, মাইলের পর মাইল, কিলোমিটারের পর কিলোমিটার, দিনের পর দিন… রাতের পর রাত। কখনও তাঁরা পরিশ্রান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন, কখনও শুকনো রুটি আচার দিয়ে খাচ্ছেন। সেই খাবারের ছবি যদিও তাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় দিতে পারছেন না, তবুও সেইটুকুই তো তাঁদের আছে, তাঁরা সেই টুকুই তৃপ্তি করে হয়তো ভাগ করে খাচ্ছেন। যারা সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে খাবারের ছবি দিচ্ছেন, তাঁদের নিউজ ফিডে হয়তো এই খাবারের ছবি আসছে না, তাঁদের নিউজ ফিডে হয়তো এই মানুষদের ছবি মাঝে মধ্যে আসছে কিন্তু এই মানুষদের কষ্টের এতোটুকুও কি ছুঁতে পারছে এই ঘরে বসে লকডাউন পালন করা মানুষদের ?

এই হেঁটে চলা মানুষদের একজন ছিলেন জামলো মাকদম, ছিলেন না বলে ছিল বললেই ভালো। একটি ১২ বছরের মেয়ে সেও হাঁটছিল তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে। তেলেঙ্গানার লঙ্কা কারখানায় কাজ করতো সে, তাঁর বাবার সঙ্গে। সেও ফিরছিল তাঁর বাড়িতে ছত্তিসগড়ে। ফিরতে পারেনি সে, শেষ পর্যন্ত রাস্তাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। শুধু জামলো নয়, এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যাবে যারা এই করোনার কারণে লকডাউনের মধ্যেই বাড়ি ফেরার পথে মারা গেছেন। এখনো অবধি যা হিসেব পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে ২৯ জন মানুষ মারা গেছেন ক্লান্তিতে, ৮৩ জন মারা গেছেন রাস্তায় দুর্ঘটনাতে। কিছুদিন আগেই ঔরঙ্গাবাদে মালবাহী গাড়ির তলায় চাপা পড়ে মারা গেলেন একসঙ্গে ১৬ জন মানুষ, যারা ট্রেন লাইনে রাতের বেলা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সেই ঘটনার রেশ মিটতে না মিটতে আবার উত্তরপ্রদেশে দুটো মুখোমুখি ট্রাক সংঘর্ষে ২৪ জনের মৃত্যু। এরকম ছবি সামনে এসেছে যা হয়তো তাৎক্ষণিক ভাবে রিলিজিয়াসলি লকডাউন পালন করা মানুষকে একটু হলেও নাড়া দিয়েছে, কিন্তু তাতেও কি সরকার নড়েচড়ে বসেছে?

বসেনি, তার জন্যে দায়ী কারা? যে মানুষেরা নির্বাচনের দিন আঙুলে কালি লাগিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে ছবি দিয়েছেন, তাঁরা যদি তার বদলে সেই আঙুলটিকে ওই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দিকে তুলতে পারতেন তাহলে আজকে হয়তো এই দৃশ্যটা এড়ানো যেত। আসলে আমরা যারা শহুরে,  তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত বিত্তশালী মধ্যবিত্ত তাঁরা আজ পরাজিত। আমরা যৌথ ভাবে পরাজিত। আমরা যারা এই নতুন অর্থনীতির সুফল ভোগ করে থাকি, তাঁরা মিলিত ভাবে হেরে গেছি। আমরা শপিং মলে যাই, আমরা আইনক্সে পপকর্ণ নিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলে সিনেমা দেখে থাকি, তাঁরা সবাই আজ বিজিত। আমরা এই মানুষদের কাছে হেরে গেছি, যারা এই জায়গাগুলো তিলতিল করে নিজেদের শ্রম দিয়ে গড়ে তুলেছেন তাঁদের কাছে পরাজিত। আমরা কোনোদিন তাঁদের খোঁজার চেষ্টা করিনি। ভাবিনি যে এই যে ৬ লেনের জাতীয় সড়ক বানানো হয়েছে, তার পিছনে তাঁদের কি পরিশ্রম আছে, কতটা ঘাম, রক্ত আছে? আজকে যখন তাঁরা সেই ৬ লেনের রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, তখন তাঁদের চোখে যে বেদনা, যে ক্লান্তি, যে ক্ষোভ তা কি আমাদের ছুঁতে পারছে? রাজনৈতিক দলেরা বা নাগরিকেরা যতই করুক না কেন আপনাদের জন্য, তা কি যথেষ্ট? যত খাবারের প্যাকেট বা যত টাকাই তাঁদের কাছে আমরা পৌঁছনোর চেষ্টা করি না কেন, তা কি তাঁদের প্রাপ্য যে সম্মান তা ফিরিয়ে দিতে পারে? একজন কর্মক্ষম মানুষ যখন খাবারের জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়াচ্ছে তাতে কি তাঁর সম্মান বাড়ছে, না আমরা যারা এই খাবার তাঁদের কাছে দিচ্ছি তাঁর সম্মান বাড়ছে?

যে উঁচু উঁচু অট্টালিকায় আমরা থাকি, সেখান থেকে নেমে এসে কি তাঁদের সম্পর্কে কোনোদিন আমরা খোঁজ নিয়েছি, যে তাঁদের কোনও একটা ছোট ঘরও আছে কিনা? তাঁদের স্নানের জায়গাটা কতটা স্বাস্থ্যসম্মত, কতজন মিলে একটি স্নানাগার তাঁরা ব্যবহার করেন? আমাদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া  সামাজিক দূরত্বের নিদান বা শারীরিক দূরত্বের নিদান আদৌ কি তাঁরা পালন করতে সক্ষম? আমরা যারা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কখনও আলো নিভিয়ে বা থালা বাজিয়ে করোনার চিকিৎসায় যুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের উৎসাহ দিয়েছি, তাঁদের কতজন এই পায়েল, জামলো বা ট্রেনের তলায় চাপা পড়া মানুষদের কথা ভেবেছেন? কতজন রাতে ঘুমাতে পারেননি, ওই ট্রেনলাইনে পড়ে থাকা রক্ত লাগা রুটির ছবি দেখে?  বারবার নিজেদেরকে হয়তো আমরা প্রবোধ দিয়েছি যে এতো বিপুল জনসংখ্যা সরকার কিই বা করতে পারত? কিন্তু সত্যিই কি তাই? সরকার কি সত্যিই অপারগ নাকি তার সদ্দিচ্ছার অভাব? সরকার চাইলে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের কি তাঁদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পারত না? চাইলে কি সরকার এই মানুষদের জন্য প্রাপ্য খাবার এবং টাকার সংস্থান করতে পারত না? এই যে এতো বড় কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষিত হল, তা কি এই মানুষদের জন্য, নাকি অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে, সেই প্রশ্ন করার কি সময় হয়নি এখনও? আসলে আমরা যাঁদের নির্বাচিত করে সরকারে বসিয়েছি তাঁরা বুঝে গেছি, যে এই সরকারের অভিধানে সহানুভুতি শব্দটা নেই, কিন্তু একটা কথা আমরা ভুলে গেছি, আজকে যারা ওই পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কোনও সহানুভূতি দেখাচ্ছে না, কাল আমাদের জন্যেও তার কোনও ভাবনা থাকবে না।

অনেকেই ভেবেছেন যে স্বচ্ছ ভারত অভিযানের সাফল্যে হয়তো বা গরীব মানুষ উপকৃত হয়েছেন, কিংবা হয়তো ভেবেছেন গরিবি হটাও অভিযানে সত্যিকারের গরিব মানুষ উপকৃত হবেন, কিন্তু আসলে তার পিছনে গরিব মানুষদেরই হটানোর প্রক্রিয়া ছিল সেটা মানুষ বুঝতে পারেনি। বিশ্বাস করেছেন এই রাজনীতিকদের। আজ তার এই পরিণতি দেখতে হচ্ছে। যে মানুষেরা প্রধানমন্ত্রীর কথায় থালা, বাটি, ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন, যারা প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন ভেবেছিলেন যে এই ভাবে করোনা তাড়াবেন বা দেশের স্বাস্থ্যপরিসেবার সঙ্গে যুক্ত থাকা মানুষদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছিলেন তাঁরা কি মনে করেন না যে এই গরীব খেটে খাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদেরও একটা প্রাপ্য সম্মান আছে, যা থেকে তাঁরা রোজ বঞ্চিত হচ্ছেন?

এর সঙ্গে আমাদের দেশে যুক্ত হয়েছে করোনাকে ঘিরে তৈরি হওয়া সাম্প্রদায়িকতা। দিল্লির নিজামুদ্দিন মার্কাজে তবলিগ জামাতের সম্মেলনকে ঘিরে তৈরি হওয়া ঘৃণা ও বিদ্বেষের যে রাজনীতি সেটাও একইসঙ্গে কাজ করছে। খোঁজা হচ্ছে কোথায় কোথায় মুসলমান আছে, তাঁরা কীভাবে এই করোনা সংক্রমণের জন্য দায়ী সেটা চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। যার ফলশ্রুতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হাওড়া এবং হুগলীর তেলেনিপাড়ার দাঙ্গা। সর্বভারতীয় দুটি নিউজ চ্যানেলের রিপোর্টে যা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে কীভাবে মুসলমানদের লক্ষ্য করে টিটকিরি কেটে দাঙ্গা সংগঠিত করা হয়েছে। কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে সেগুলো ছড়ানো হয়েছে, উসকানি দেওয়া হয়েছে, যাতে দীর্ঘদিন ধরে পাশাপাশি বাস করা প্রতিবেশীরাও একে অন্যের শত্রু হয়ে উঠেছেন। তারপরের ঘটনা ইতিমধ্যে হয়তো অনেকেই জেনে গেছেন। আসলে যারা কেন্দ্রে ক্ষমতায় আছে, সেই বিজেপির মূল লক্ষ্য নির্বাচনে জয়, তার জন্য তারা যে কোনও মাত্রায় যেতে পারে। তেলেনিপাড়ার ঘটনা দেখে বোঝা যায়  বেশির ভাগ ক্ষয়ক্ষতি ভাঙচুর হয়েছে মুসলিম এলাকায়। এটাও দেখা গেছে  যে রাজা বাজার সংলগ্ন এলাকায় কিছু হিন্দুদের বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মোটের ওপর এটুকু বোঝা গেছে যে এই আক্রমণ রীতিমত প্ল্যান করে একতরফা ভাবে ঘটানো হয়েছিল। একাধিক প্রমাণ পাওয়া গেছে যে আলাদা করে মুসলিমদের বাড়ি দোকান চিহ্নিত করা হয়েছিল আর আক্রমণ করা হয়েছিল একের পর এক। স্থানীয় বাসিন্দাদের সকলেই জানিয়েছেন যারা এসেছিল, তারা মূলত বাইরের লোক, তাদের রাস্তা দেখিয়ে এনেছিল এই এলাকারই কিছু লোক, যারা এই অঞ্চলের সমস্ত গলিঘুঁজি পরিষ্কারভাবে চেনে।

কিন্তু এখানেই তো সবটা শেষ হয়ে যায় না, এরপরেও কিছু থাকে। দুজন  শ্রমিক বন্ধুর গল্প। তার মধ্যে একজন মুসলমান, অন্যজন ধর্মীয় ভাবে হিন্দু। দুজনের আরও একটি পরিচয় আছে দুজনেই গুজরাটে কাজ করতে গিয়েছিলেন পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে। যেদিন প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করলেন সেদিন থেকে অন্য অনেকের মতো তাঁরাও আটকে গিয়েছিলেন। কোনও ট্রেন, বাস কোনও কিছুর ব্যবস্থা না করতে পেরে এই দুই বন্ধু ‘এই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাবো’ এই কথাগুলো বলে রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন। একজন মহম্মদ ইয়াকুব অন্যজন অমৃত কুমার। পথ চলতে চলতে ক্লান্ত, অসুস্থ অমৃত কুমার ইয়াকুব মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। হাইওয়েতে চলতে থাকা মানুষদের কাছে বারবার কাঁদতে কাঁদতে অনুরোধ করেন ইয়াকুব। কিন্তু কেউ শোনেনি, কারণ সবাই তখন ব্যস্ত নিজেরা বাড়ি ফিরবেন।

সুরাটের কাপড়ের কারখানা যা থেকে হয়তো আমাদের মতো মানুষদের জন্য জিনস, টি শার্ট বা কুর্তি, লেগিংস এসব তৈরি করতেন এই দুই বন্ধু। সেখানে এই লকডাউনের ফলে কাজ হারিয়েছিলেন দু’জনেই। সেখান থেকে ফিরতে ইন্দোরগামী ট্রাকে উঠেছিলেন দু’জনে। কিন্তু ট্রাক কিছুটা যাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন অমৃত। কিন্তু ইয়াকুব বন্ধুকে ছেড়ে যাননি, নেমে পড়েন তিনি, চেষ্টা করেন বন্ধুকে বাঁচানোর, স্থানীয়দের সাহায্যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু বাঁচাতে পারেননি। যে সময়ে তেলেনিপাড়ার মতো ঘটনা ঘটছে, সেই সময়ে এই ধরনের কিছু ছবি, কিছু ঘটনা মনে থেকে যাবে। পরবর্তী প্রজন্ম যখন করোনার ডায়েরি লিখবে …তখন নিশ্চিত ইয়াকুব এবং অমৃতের বন্ধুত্বের গল্পটা লিখবে। নিশ্চিত লিখবে আমি আশাবাদী। এটাই তো আসল ভারতের ছবি।

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *