পরিযায়ীদাস্তান

ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

[শেষমেশ ধর্ম না, থেকে যায় বন্ধুত্বই, মোহাম্মদের কোলে মাথা রাখা রামের মতোই]

অমৃত রামচরণ গুজরাটের সুরাত অঞ্চলে বস্ত্র কারখানায় কাজ করতো৷ বাড়ি উত্তরপ্রদেশে। ৪০০ টাকা দিনে উপার্জন ছিল। লকডাউনে যথারীতি কাজ ছিল না, টাকা ও ফুরিয়ে আসছিল৷ সে ও তার বন্ধু ঠিক করে বাড়ি ফিরে যাবে। ওদের দুজনেরই বাড়ি বস্তি জেলায়। হেঁটে ফেরার পরিকল্পনা করছিল কিন্তু হঠাৎ একটা লরির খোঁজ পায়। জনপ্রতি চার হাজার টাকা নেবে গুজরাট থেকে উত্তরপ্রদেশে নিয়ে যেতে। যা সঞ্চয় ছিল তা দিয়ে ওরা দুজনের আট হাজার টাকা দিয়ে দেয়। ঘরে পৌঁছে দিক!

ও বলা হয়নি। কাজের সূত্রেই অমৃত রামচরণ বন্ধুত্ব পাতায় ইয়াকুব মোহাম্মদের সাথে। দুজনেই এক জেলার মানুষ, এক ভাষা, একই ঘামের গন্ধ, একই মনখারাপ বাড়ির থেকে দূরে থাকায়। রাম আর ইয়াকুব লরিতে উঠে পড়ে। কিন্তু ৪০ ডিগ্রির এই তাপমাত্রায় টানা ১৪৫০ কিলোমিটার চালাতেও ২৬ ঘন্টা লেগে যায়। জল নেই, খাবার সামান্য, গাদাগাদি করে ভেড়ার পালের মতো লরিতে চলা। চাঁদিফাটা রোদ মাথায় নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে অমৃত রামচরণ। ১০৫ জ্বর, টানা বমি, মাথা ব্যাথা।

ওই ২০ ফুট বাই ২০ ফুট লরিতে প্রায় ৫০জন মানুষ জল দিয়ে, ফল দিয়ে চেষ্টা করে ওকে সুস্থ করতে। কিন্তু লাভ হচ্ছে না। ডাক্তারই বা কই আশেপাশে। এদিকে যাত্রীরা ভয় পেতে শুরু করে, কোরোনা হয়েছে ভেবে! ওরা লরিটাকে ঘুরিয়ে কোন হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারতো কিন্তু একজনের জন্য কি এতোজনের বাড়ি ফেরা থমকে যেতে পারে? ওরা ঠিক করলো রামচরণকে লরি থেকে নামিয়ে দেওয়ার। নিশ্চয়ই পুলিশ দেখতে পাবে ওকে, ওরাই নিয়ে যাবে।

১০৫ জ্বর, আধা বেহুশ এক মানুষকে একা ফেলে চলে যাওয়া যায়? এতে ঘরে ফেরার আনন্দ ফিকে হয়ে যাবে না? ইয়াকুব মোহাম্মদ ঠিক করে সেও নেমে যাবে। বন্ধুর সাথেই থাকবে। পরে না হয় দেখা যাবে কী করে বাড়ি ফেরা যায়। মধ্যপ্রদেশের হাইওয়েতে ওদের নামিয়ে দেওয়া হয়। ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, দুপুর রোদে রাস্তার ধারে ইয়াকুব মোহাম্মদের কোলে মাথা রেখে রাম। ইয়াকুব যাকে পারছে আকুতি করছে, “এ ভাইয়া, ইসকো হাসপাতাল লে চালো না”। জলপট্টি দিচ্ছে নিজের রুমাল ভিজিয়ে, হাওয়া করছে। রাম অস্ফুটে ইয়াকুবকে কিছু বলে চলেছে, ইয়াকুব খুব মনোযোগ দিয়ে সে সব শুনে উত্তর দিয়ে চলেছে। দুই বন্ধুর কথোপকথন। ইতিমধ্যে অন্যান্য লোকের থেকে খোঁজ পেয়ে পুলিশ আসে। রামকে জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তখনো রাম মোহাম্মদের কোলে শুয়ে। ইয়াকুব আশ্বাস দিচ্ছে “সব ঠিক হো জায়েগা মেরে ভাই”।

এরপর সূর্য ঢোবার আগেই রাম চলে গেল। এ দেশের এক পরিযায়ী শ্রমিক অমৃত রামচরণ। ইয়াকুব মোহাম্মদ যার এতোক্ষণে বাড়ির কাছে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল তার সবরকম চেষ্টা ব্যার্থ করে ওর বন্ধু চলে গেল। রামের মৃতদেহের কিছু দূরে দাঁড়িয়ে অঝোর কাঁদছে এদেশের রাম। আসলে এক বন্ধু আরেক বন্ধুর বিয়োগে কাঁদছে। জায়গাটির নাম শিবপুরি।

বহু দূরে কিছু মানুষ তখনো হয়তো জিহাদ, মন্দিরে মাংস ছুঁড়ে দেওয়া, মসজিদ গুড়িয়ে দেওয়া, একে পাকিস্তানে পাঠানো, ওকে হিন্দু হৃদয়সম্রাট বানানোর খেলায় মেতে আছে। দু তরফই এক্কাট্টা হতে বলছে দুই সম্প্রদায়ের মানুষকে। সামান্য যেটুকু আলো তাতে বেঁচে ইয়াকুব মোহাম্মদ আর অমৃত রামচরণ। এক বন্ধুর কোলে মাথা রেখে আরেক বন্ধু শুয়ে। বন্ধুত্বের আবার ধর্ম হয় নাকি?

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *