ডুব

শুভায়ুর রহমান

কাশফুল শুকিয়ে ন্যাতার মতো জড়িয়ে আছে৷ বিস্তৃত পাড় যেন অনাথ হয়েছে। এখন জলটা একটু কম। মাঝ ভাগীরথীতে ভেসে চলে যায় ছেলেপুলেরা। ফেরিঘাটের পাশে উঁচু পাড়ে ঢাল বরাবর জল ঢেলে নদীর তীর পর্যন্ত কাদা করেছে ছেলেরা। মাখনের মতো মোলায়েম পিচ্ছিল ঢাল দিয়ে নীচে নেমে আসছে তারা। কখনও বা একে অপরের গায়ে পড়লে হো হো করে হাসি মজায় মেতে উঠছে। পাড়ের উপর উঠে সামনের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ল কামু। পিঠে অভ্রকে বসিয়ে দিব্যি কাদা মাখতে মাখতে ভাগীরথীর জলে গড়িয়ে পড়ল সে। ঘাটে ভুটভুটিতে সাইকেল বাইক সহ চেপেছে জনা তিরিশ নারী পুরুষ। ভেজা গায়ে ভুটভুটির সিঁথিতে দাঁড়িয়ে মানুষগুলোর দিকে চেয়ে রয়েছে অভ্র ও কামু। জেনারেটরে মাঝি স্টার্ট দিতেই চার পাঁচজন মানুষ কিছু একটা ছুড়ে দিল জলে। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে পড়ল অভ্র ও কামু। ডুবের পর ডুব দিয়ে ঘাটে এসে, বসে কামু হাফপ্যান্টের পকেট থেকে একটা পাঁচ টাকার কয়েন বের করল। ডাঙায় রাখা গামছার খুঁটে বেঁধে আবার জলের তলায় চলে গেল। অভ্র জল থেকে উঠেই একবার শ্বাস নিয়ে আবার জলের তলায়। ফের একবার শ্বাস নিতে উপরে উঠল। হাত পায়ের কায়দায় কিছুটা ভাসতে ভাসতেই বলল, ‘কামু কটা পেলি?’

   -‘তুই কটা পেলি রে?’

   -‘আমি তিনটে। চ, স্কুল যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ফিরে চ।’ এবার জানায় অভ্র।

   হাঁপাতে হাঁপাতে অভ্র গুনে দেখল দুটো দু’টাকার কয়েন, একটা পাঁচ টাকার কয়েন। মোট ন’টাকা। কামুর পাঁচ টাকা ও এক টাকার কয়েন নিয়ে মোট ছ’টাকা। পকেটে রেখে গামছায় গা মুছতে মুছতে কামু বলল, ‘ধ্যাৎ, আজ হলই না। এক সপ্তাহের পয়সা গুছিয়ে মা মাংস কিনি দেবে বলিচে।’ অভ্র তার কয়েনগুলো কামুকে দিলে কামু বলে, ‘আচ্ছা অভ্র, তুই আমার জন্যি পয়সা খুঁজিস, তোর বাড়িতে জানলি বকবি না? তুই আর দিস না।’

   -‘নাহ, বকবি কেন? আমাদের তো পয়সা আচে৷ আর বাড়িতে জানবিই না।’

(২)

   পাকুড় গাছটা পেরিয়ে গলির ভিতরে দুটো বাড়ির পরেই কামুদের বাড়িটা। তাদের বাড়ির সামনে ইঁটের গাঁথনি দেওয়া রিজাবুল চাচার ঘর। টালির ছাউনি। দেওয়ালের এক অংশে শ্যাওলা জমেছে। গজিয়েছে ফার্ন গাছ। টালির চালে উঠেছে মা, গলি থেকেই দেখতে পায় কামু। স্কুল ছুটিতে শেষবার যখন মামার বাড়ি গিয়েছিল, তখন কদুর বীজ এনে উঠোনে পুঁতেছিল কামু। দেওয়াল বেয়ে চালে উঠেছে সেই গাছটা। হাঁক পাড়ল কামু, ‘ধুর্, তুমার উঠার দরকার কী ছ্যালো? আমাকে বললে না ক্যানে?’ টালি থেকেই কামুর মা বলল, ‘তুই কী একুনকার কতা গিয়েচিস! একুন ফিরার সময় হলু! তুর নানা এয়িচে।’ মায়ের মুখ থেকে নানা আসার খবরটা শুনে আনন্দে গদগদ হয়ে এক দৌড়ে ‘নানা… নানা…’ বলতে বলতে বাড়ির ভিতর ঢুকল সে। সাদা পাঞ্জাবিটা খুলে, খালি গায়ে সাদা লুঙ্গি পরে শুয়ে আছে নানা। হাতপাখাটা একটু একটু করে নাড়াচ্ছে। উঠোনে দাঁড়িয়ে ‘নানা’ ডাক দিতেই উত্তর দিল, ‘তুই কখন গিয়িচিস? চোখ লাল হয়িচে। ভাগরথীর পানি আমাদের ভালো করে না।’ সেই একই কথা তিন বছর বয়েস থেকে শুনে আসছে কামু। শুনলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। ‘ভালো করে না’ কথাটি শুনে কামুর হাসি মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়। ঘরে গিয়ে প্যান্ট ছাড়ল। ভেজা প্যান্টটা পিঁড়ি থেকেই পায়ের পাঁচ আঙুলের ডগায় নিয়ে, উঠোনে এক টান দিল। পিঁড়ির দুই খুঁটিতে টাঙানো দড়িতে, ঝোলানো কাপড় থেকে খুঁজে, গেঞ্জিটা গায়ে পরে নানার পাশে বসল কামু। নানা, নানি বা মামা কেউ আসলেই কামুর খুব মজা, সেদিন স্কুলে যাওয়ার জন্য কামুর মা রাশেদা জোরাজোরি করে না।

   ঢং ঢং করে বেজে উঠল স্কুলের ঘন্টা। ছেলেরা যে যার মতো করে প্রার্থনা সংগীতের লাইনে দাঁড়াল। এদিক ওদিক উঁকি দিচ্ছে অভ্র। এখনও কেন এল না কামু! কিছুই বুঝতে পারে না অভ্র। এমন তো হওয়ার নয়। একটু আগেই তো এক সঙ্গে ছিল ওরা৷ মাষ্টার ক্লাসে ঢুকে টেবিলে চক ডাস্টার রেখে হাজিরা খাতা খুলে নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। জানলার পাশের বেঞ্চে বসেছে অভ্র। জানলায় চোখ রেখে ভাবছে, এই বুঝি কামু এল। রাস্তা দিয়ে ক্রিং বাজাতে বাজাতে সাইকেল যাচ্ছে। বাইক ছুটছে। রাস্তার ওপারে অনাবাদি জমির বুকে মুখ লাগিয়ে চরছে গরু। ডুমুর গাছে টিকটিক করতে করতে টুনটুনি লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। উলুখড়ে বাতাস এসে আদর করছে। পাশেরজন অভ্রকে কনুই দিয়ে গুঁতো দিল। ‘উপস্থিত স্যার। উপস্থিত স্যার’ বলে উঠে দাঁড়ল অভ্র। স্যার রেগে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী করছিলে এতক্ষণ? কী নাম?’ বেচারা মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল, ‘স্যার, অভ্রজ্যোতি সরকার।’

   একটা ক্লাস, দুটো ক্লাস এমনভাবে সব ক্লাস শেষ। বেলা তিনটে নাগাদ স্কুল ছুটি হল। সেলাই মেসিনে পা রেখে ফ্রক সেলাই করছে রাশেদা। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছে কামুর নানা শরিয়তুল্লা। ‘দেখতে দেখতে ন’টা বছর কেটি গেল। এভাবেই কেটি যাবে মা। আল্লাহতালা তুমার যে মানিককে দিয়েছে, সে বেঁচে থাকুক। বড় হয়ি সেই তুমার হিল্লা হবে।’ মেয়েকে বুঝ দিয়ে চলে শরিয়তুল্লা। সেলাই মেশিন থামিয়ে মাথা নাড়ে রাশেদা৷ 

   -‘ওকে নদীতে যেতে দিও না,’ মেয়েকে সতর্ক করল শরিয়তুল্লা। 

   এমন সময় ‘কামু আচিস? কামু…। আন্টি… ও আন্টি কামু নাই?’ বলে ডাক দিল কেউ। রাশেদা দেখল অভ্র। 

   -‘মদু  আসো, সে তো নাই। একটু আগে তুমার কাচে যাবে বলিই তো বেরিয়েচে।’ উত্তর দিল রাশেদা। 

   -‘আচ্ছা, আমি দেকচি,’ বলে চলে গেল অভ্র।

(৩)

   বেলা গড়িয়ে গিয়েছে। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। মেঘমুক্ত নীল আকাশ, ওই দূরে নদীর জলে যেন স্নানে নেমেছে। নৌকো ভেসে বেড়াচ্ছে কাছে, দূরে অনেক ছোটো ছোটো নৌকো। সইযুক্ত নৌকোগুলো জাল ফেলছে। গাঁ ভুঁইয়ের দিকে ওপার থেকে সব মানুষ ফিরে আসছে। এক দিন, দু’দিন কত দিন গেল। বাবার মুখ মনে পড়ে না কামুর। 

   -‘অচেনা কুনো লোক নৌকোয় ভেসে এসি ঘাটে লাগিয়ে, যদি কামু… কামু বলি ডাক দিতু। যদি আদর করে বলতু, বাপ আমি এয়েচি। মাচ ধরতি এতটা সময় কেটে গেল৷ বিদেশ গিয়িলাম মাচ ধরতি।’ মনে মনে ভাবে কামু। পিছন থেকে ‘কামু’… ডাকেই কল্পনা ভাঙল। শ্মশানঘাটের কিছুটা আগেই নদীর পাড়ে বাবলা গাছের তলায় বসেছিল কামু। উঠে সেও জানাল, ‘অভ্র এদিক দিয়ি আই। ওদিকে কাঁটা আচে।’

   – ‘অনেকক্ষণ থেকে খুঁজচি রে ছোঁড়া, তুই এখানে বসি আচিস, স্কুল যাসনি কেন?’ 

   -‘নানা এয়িচে তাই যাইনি।’

   -‘অ, বুজিচি।’

   -‘জানিস তো নানা বলচিল, এবার ওদের বাড়ি রোজা, ঈদ করবু।’ কথাটা শুনে অভ্র কেমন যেন চুপ করে গেল।

   -‘কী হল!  কী রে? চুপ করি গেলি?’

   -‘কামু তাহলি আমার সিমাই খাওয়া হবে না এবার?’

   -‘ধুর, মা যাবে না বলিচে। মায়ের হাতে অনেক অর্ডার আচে। এটাই তো সিজিন। আর মা না গেলি তো আমিও যাবু না। তুর জন্যি বাটি ভর্তি সিমাই দবুরে।’

   কামুর মুখ থেকে কথাটা শুনে কিছুটা হেসে অভ্র বলে, ‘সে ঠিক আচে। কিন্তু কবে রোজা শুরু তোদের?’

   -‘আজ নাকি চাঁদের চব্বিশ দিন। এই চাঁদে গেলি, সামনে যে চাঁদ উঠবি সেই চাঁদে। তার মানে আর এক সপ্তা।’

   -‘শোন দিদি বলিচে এবার আমার সঙ্গে তোকেও ভাইফোঁটা দেবে৷’ জানায় অভ্র।

   – ‘সত্যি! অনু দিদি বলিচে?’

   – ‘হ্যাঁ রে।’

   দুই বন্ধুর কথাবার্তা চলতে চলতে সময় গড়িয়ে গিয়েছে। সন্ধে নামে। আলো ঘোমটা নামিয়ে দিয়েছে। ওপারের পাকা বাড়ির জানলা দিয়ে আলো জ্বলে উঠেছে। আলোর জ্যোতি যেন  ভাগীরথীতে পড়েছে। ভুটভুটি ঘাটে লাগছে। বাতাস সোঁ সোঁ করে বইতে শুরু করছে। শেয়াল হুক্কা হুয়া ডাক দিচ্ছে। ঝিঁঝিরা নদীর পাড়ের দখল নিয়েছে এখন।

   পরের দিন স্কুলে যুক্তি হল, স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে মানিকডিহি গ্রামে বৈশাখ সংক্রান্তির মেলায় যাবে দু’জনে। সেই মতো দ্রুত বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়ল অভ্র, কামুকে সঙ্গে নিয়ে নৌকোয় চেপে বসল। নৌকোর মাঝি হাবিল চাচা জিজ্ঞাসা করল, ‘কই যাবি?’ ‘মানিকডিহির মেলায়।’ উত্তর দিল অভ্র। আনন্দে মেতেছে মানিকডিহি সহ আশপাশ এলাকার মানুষ। গ্রামে পৌঁছানোর এক কিলোমিটার আগে নো এন্ট্রি ঘোষণা দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। টোটো থেকে নেমে হাঁটা শুরু করল ওরা। গ্রামের মূল রাস্তার পাশে বিরাট ফুটবল মাঠ জুড়ে মেলা বসেছে, তাতে স্টেশনারি দোকান, নাগরদোলা, পুতুল-নাচ, মিষ্টি, তেলেভাজার দোকান, সব আছে।

(৪)

   হাজারে হাজারে মানুষ। প্রচণ্ড ভিড়। দমবন্ধ অবস্থা। অভ্রর হাত চ্যাপ্টে ধরে আছে কামু। মেলার শেষ মাথায় বটগাছের তলায় দেবীর মন্দির। চলছে পুজো। মণ্ডপের ভিতরে যাওয়ার প্রবেশ পথে স্বেচ্ছাসেবকদের ভিড়। অভ্র বলে, ‘ঠাকুরকে প্রণাম করে আসি। তুই কোথাও যাসনে। মণ্ডপের বাইরে দাঁড়া।’ ভিতরে গিয়ে ঠাকুরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে প্রণাম করল সে। প্রণাম সেরে বেরোনোর মুখে অভ্রর হাতে পুজোর প্রসাদ দিল একজন স্বেচ্ছাসেবক। দু’হাত দিয়ে প্রসাদ গ্রহণ করে মণ্ডপের বাইরে এসে এদিক ওদিক তাকাল অভ্র। দেখে কামু নেই। ভয় পেয়ে গেল অভ্র। ভিড়ে মিশে গেলে আর কামুকে খুঁজে পাবে! কী করবে বুঝতে পারছে না অভ্র। মিনিট দুই তিন পরে হাসতে হাসতে মণ্ডপের সামনে এল কামু। প্যান্টের বাম পকেটে হাত ঢুকিয়ে রেখেছে। অভ্র জানতে চাইল, ‘না বলে কেন অন্যদিকে গিয়েছিলি। আর পকেট মোটা লাগচি কেন? কী কিনেচিস?’

   -‘কিচু না,’ বলে মাথা নাড়িয়ে কামু জানায়, ‘হারানোর জন্যি তুর হাত ধরিচি নাকি।’

   -‘প্রসাদ নে,’ বলে এবার অভ্র হাতটা বাড়িয়ে দিল কামুর দিকে৷ সন্ধে নেমে এসেছে। চরম বৃষ্টিপাত শুরু হল। যে যার মতো আশ্রয় নিচ্ছে। স্টেশনারি দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছে দুজনে। কাপড়ের ছাউনি ভিজে বৃষ্টির ফোঁটা চুঁইয়ে অভ্র ও কামুকে ভিজিয়ে দিল।

   অভ্র ও কামুর বাড়িতে শুরু হয়েছে টেনশন। সন্ধ্যা সাতটা বাজে, মুষলধারে বজ্র-বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি হচ্ছে। অভ্রর দিদি অনুসূয়া বলল, ‘বাবা একবার কামুদের বাড়ি খোঁজ নিলে হত।’ বিদ্যুৎ নেই। রাস্তা ঘুটঘুটে অন্ধকার। অভ্রর বাড়ি থেকে কামুর বাড়ি মেরে কেটে হাফ কিলোমিটার, এপাড়া ওপাড়া। বৃষ্টি কমে এসেছে। বড়ো পুকুরে ব্যাঙ ডাকছে। তাদের জলে ঝুপ করে নেমে পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। মুসলিম পাড়ায় পৌঁছে গেছে ওরা। অনুসূয়া আগে যাচ্ছে, পিছনে কাকা শুভ্রজ্যোতি। পাকুড় গাছ পেরিয়ে গলির ভিতরে কামুদের বাড়িতে ঢোকে ওরা। কামুদের বাড়িতে অভ্র নেই। আবার রাশেদা জানতে পারল অভ্রর বাড়িতেও কামু যায়নি। কান্নাকাটি শুরু করল সে। অভ্রর কাকা, শুভ্রজ্যোতি জানাল, ‘নদী ঘাটেই তো বেশিরভাগ সময় থাকে। ঘাটের ওয়াটিংরুমে আছে কিনা, দেখা যেতে পারে। হয়তো বৃষ্টিতে আটকে পড়েছে। কামুর মা জানাল, ‘তুমাদের সঙ্গে আমিও যাবু। চলো…

   ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁইছুঁই। টোটো ধরে ওপারের ঘাটে পৌঁছেছে অভ্র আর কামু। নৌকো যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে। ঘাটের ইজারাদারের কাছে জানতে পারল, হাবিল চাচাও বাড়ি চলে গেছে। ঘাট দেখাশোনার যে ছেলেটি আছে, তাকে অনুনয় বিনয় করল বল্লভপুর ঘাটে পৌঁছে দিতে। না হলে হয়তো আজ রাতে এখানেই কাটাতে হবে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল দুজনে। তাছাড়া ভিজে জুবুথুবু। ঘাট দেখাশোনা করা যুবক অপেক্ষা করতে বলে জানাল, ‘একদল কাপড় ব্যবসায়ী ম্যাটাডোরে চেপে শহরে ব্যবসা করতে যায়। আমি বাড়ি গিয়েছিলাম ঘন্টাখানেকের জন্য, এরই ফাঁকে তারা যদি চলে গিয়ে না থাকেন তবে রক্ষে৷ ওদের পার হওয়ার জন্য লঞ্চ ছাড়বে।’ কিছুটা আশা দেখল দুই বন্ধু। মিটমিট করে লাইট জ্বালাতে জ্বালাতে কারা যেন ঘাটের দিকে এগিয়ে আসছে। অভ্র ভাবল বাড়ির লোক হতে পারে। খুঁজতে বেরোবেই। তাতে আরও বেশি ভয় পেয়ে গেল সে, বাড়িতে যদি মারধর করে। কিছু পরেই ব্যবসায়ীদের ম্যাটাডোর এসে পৌঁছাল। এবার বড়ো লঞ্চ ছাড়ল। 

   অনুসূয়া, শুভ্রজ্যোতি এবং রাশেদা নাম ধরে হাঁক দিতে শুরু করেছে, কিন্তু সে ডাক শূন্যে মিলিয়ে গেল। দুই বন্ধুর কেউ শুনতে পেল না লঞ্চের শব্দে৷ রাশেদা মনে মনে বলল, বছর নয় আগে এক বিকেলে এই ভাগীরথীতে নৌকো নিয়ে মাছ ধরতে বের হয় বাড়ির মানুষটা। এমনই ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছিল সেদিনও। তারপর আজও সে ফেরেনি। অপেক্ষায় থাকে, স্বামী ফিরবে। পীর, দৈবুক কার না কাছে গিয়েছে মনের খেদে। তাঁরা বলেছেন স্বামী ফিরে আসবে একদিন। কেউ কেউ আবার বলেছেন, নৌকো সহ ডুবে মরেছে। ভাবতে থাকে রাশেদা। ‘ছিঃ তোবা তোবা, বালাই-শাট! কী ভাবছি! আল্লাহ মালিক খারাপ কিচু যেন না হয়।’ লঞ্চ ভিড়ল ঘাটে। লঞ্চের আলোয় অভ্র দেখতে পেল দিদি কাকা ও কামুর মা দাঁড়িয়ে রয়েছে। কামু চেঁচিয়ে উঠল, ‘মা এই তো।’

(৫)

   যে ভয়টা করছিল অভ্র, সেটাই হল। মারধর না করলেও প্রচণ্ড বকাঝকা শুরু হল। সুপ্রকাশবাবু ছেলেকে শাসানি দিলেন— আর যেন না জানিয়ে এমনভাবে হুটহাট করে কোথাও না যায় সে। পাশাপাশি নদীতে ডুব দিয়ে পয়সা খোঁজার কথা কানে আসায় আরও বেশি উত্তেজিত হলেন তিনি। কেউ একজন নাকি অভ্রর বাড়িতে বলে দিয়েছে। পয়সার সমস্যা নেই, তবুও কেন সে নদীতে পয়সা খোঁজে! অভ্র কিছু জবাব দিল না, মনে মনে বিড়বিড় করল, ‘আমাদের না হয় পয়সা আচে কিন্তু সবার তো আর পয়সা নেই। তারা কী করবে? তারা তো পয়সার জন্যই ভাগীরথীর বুকে ডুব দেয়। খিদে তো বড়ো রোগ মানুষের।’ 

   প্রচণ্ড ভিজে এমনিতেই কাঁপছিল সে। বাড়িতে গিয়ে পোষাক ছাড়লেও কাঁপুনি থামেনি। রাতে ধুম জ্বর এর গায়ে। সারারাত মা সুমিতা দেবী কপালে জলপট্টি দিয়েছে। জ্বর কমেনি। সকালে ছেলেকে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেলেন সুপ্রকাশ বাবু। রবিবার স্কুলে ছুটি। খেলার জন্য অভ্রকে ডাকতে গেল কামু। কিন্তু অভ্রর বাড়ির লোক যদি বকে,  তাই ডাকতে সাহস হল না। কীভাবে অভ্রকে ডাক দেবে সে? ভাবতে থাকল। বাড়ির পিছনে বন। কচু আর শ্যাওড়া গাছে ভর্তি। তা মাড়িয়ে পিছনে জানলার শিক ধরে ঘরে টুকি দেওয়ার চেষ্টা করে কামু। অমনি বাড়ির সিলিং থেকে ঝোলানো ঝুড়িগুলি থেকে এক দল পায়রা উড়ে গেল। একসঙ্গে এত পায়রার ডানার শব্দ শুনে অনুসূয়া জানলা দিয়ে তাকায়। মাথাটা নিচু করে নিল কামু। 

   ‘কে? কে?’ ধরা পড়ে গেছে ভেবে মাথাটা তুলে কামু আস্তে আস্তে জানাল, ‘দিদি আমি কামু।’

   -‘এই তুই ওখানে কেন?’ বলে হেসে উঠল অনুসূয়া। সেই হাসিতে কামুর ভয় ভাঙল।

   -‘দিদি এটা নাও’, বলে সাদা কাগজে মোড়ানো কিছু একটা দিল।

   -‘এটা কী?’ বলে অনুসূয়া নিজেই খুলে দেখল কাগজটা। অনুসূয়া হাসি মুখে কিছু বলার আগে কামু বলল, ‘দিদি কাল মানিকডিহির মেলা থেকি তুমার জন্যি লাল ফিতেটা কিনিচি। অভ্র বলচিল তুমি আমাকে ভাইফোঁটা দিবা, তাই আগেই উপহার।’

   কামুর কথায় অনুসূয়ার বুকটা আনন্দে ভরে গেল। জানলার শিকের ফাঁক গলে অনুসূয়া হাতটা বাড়িয়ে কামুর গালটা টিপে দিয়ে বলল, ‘আমার ভাই।’ অনুসূয়ার কথায় কামুও খুশি হল। কিন্তু অভ্রর খুব জ্বর। বাবা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছে শুনে কামুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে জানলার শিক ছেড়ে এক দৌড় দিল। মসজিদের গেটে গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে কামু। জোহরের নামাজ পাঠের পর পরপর মুসুল্লিরা বেরিয়ে এল। রিজাবুল চাচা কামুকে দেখে বলল, ‘কামালউদ্দিন কি করছিস এখানে?

   ‘কিছু না’, বলল কামু। মসজিদের ইমামকে বাইরে বের হতে দেখে, কামু সালাম জানিয়ে, গ্লাসটা ইমামের হাতে দিয়ে, চোখ বুঁজে কিছু একটা বলতে থাকল।

   অভ্রর বাড়ির জানলার ধারে আবার গেল কামু। জানলা দিয়ে দেখল, অনুদি ড্রেসিং আয়নার সামনে চুল আঁচড়াচ্ছে।

   -‘দিদি,’ আস্তে করে ডাকে কামু।

   -‘কী হল? আবার?’ পিছনে তাকিয়ে অনুসূয়া জিজ্ঞেস করল।

   -‘দিদি জলপড়াটা নাও। অভ্রর চোখে মুখে ছড়িয়ি দিবা।’

   অনুসূয়া জল পড়াটা নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা ভাই দেব। অভ্র ফিরে এসেছে। ডাক্তার বলেছেন বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এসেছে। ওষুধ দিয়েছেন, সেরে যাবে। তুই গেট দিয়ে এসে দেখে যা।’ মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলে চলে গেল কামু৷

   রাতে পাড়ার মোড়ে ফাঁকা স্থানে ত্রিপল পেতে বল্লভপুরের মুসলিম পাড়ার মানুষেরা বসেছে একসাথে। আলোচনা হল কাগজপত্তর সকলকে ঠিক রাখতে হবে। জমি জায়গা নেই। স্বামী সুরাত আলির মাছ ধরেই চলত সংসার। যাদের পুরনো দলিল নেই, সমস্যায় পড়তে পারে, শুনল সে। চিন্তায় পড়ল রাশেদা। ফজরের নামাজ পড়ে আর ঘুম এল না তার। আলো আঁধারি ঘোর কাটার পর রিজাবুল ভাইয়ের উদ্দেশ্যে, বাড়ি থেকে জিজ্ঞাসা করল। ‘কী হবে গো ভাই আমাদের? কিচ্ছু হবে না বলে আশ্বস্ত করে রিজাবুল জানায়, ‘যা হবে সবার একই হবে। আন্দোলন হবে। এ দেশ আমাদের বাপ দাদোর আমলের দেশ। এদেশে সবার সমান অধিকার।’ এই কদিনে সবার মুখে শুনে কামুর বুঝতে দেরি হল না। কামুকেও তাড়া করছে সেই একই ভয়! এ দেশ থেকে যদি তাড়িয়ে দেয়! আর সেই ফাঁকে যদি আব্বু ফিরে আসে। অভ্রর জ্বর ছেড়ে গেছে। মন ছটফট করছে কামুর সঙ্গে দেখা করার জন্য। বাড়ি থেকে অভ্র বেরিয়ে গেল। অভ্র দেখল ঘাটের বিশ্রাম ঘরের ছাদে একাই বসে কামু। সিঁড়ি ধরে ছাদে উঠে গেল অভ্র। তাকে পেয়ে আনন্দে মেতে ওঠার পরিবর্তে ভারী মুখে বসে থাকল কামু। কোনও উল্লাস দেখা গেল না।

   -‘চুপ কেন?’ প্রশ্ন করল অভ্র।

   -‘অভ্র আমাদের আর থাকতি দেবে না বলচি। তাড়িয়ি দেবে নাকি! সরকার বলচি দলিল লাগবি ভুঁইয়ের। আমাদের তো ভুঁই নাই। কুতাই যাবু? না হলি ভাগীরথীর জলেই হারিয়ি যাবু আব্বুর মতো’, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একনাগাড়ে কথাগুলি জানায় কামু।

   -‘তাড়াবে না। আর তাড়ানোর আগে আমিও তোর সঙ্গে ডুব দবো ভাগীরথীতে। ধরতিই পারবি না সরকার!’

   অভ্রর মুখে কথা শুনে ছাদের ধারে গিয়ে অনেক দূরে তাকাল কামু। মনে হচ্ছে দ্রুত বেগে নৌকো নিয়ে কেউ যেন এগিয়ে আসছে। বিকেলের মৃদু রোদকে মুছে দিয়েছে ঘন মেঘ। প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ফুলে উঠছে ভাগীরথী। নৌকোয় চেপে যেন আব্বু ডাক দিচ্ছে। ‘কামু আমি এসেচি। দেশ ছাড়তি হবে না। ডুব দিয়ি আমার কাচে আই।’ আব্বুর মুখে কথা শুনে কামুও ডুব দিতে দিতে মাঝ ভাগীরথীর অথই জলে ভেসে যাচ্ছে।

+ posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *