ইমানুল হক
পুঁজিবাদ পৃথিবীকে ধ্বংস করবে। বলেছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো।
করোনা ভাইরাস ছড়াতে দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র ধ্বংস, প্রবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে অমানবিক ও বৈষম্যমূলক আচরণ হিমশৈলের চূড়ামাত্র।
শুধু গুজরাট নয় খোদ কলকাতায়, মানিকতলাতেও শোনা যাচ্ছে, তোরা জল নিতে আসবি না। তোরা মুসলমানরা করোনা ছড়াচ্ছিস।
করোনা অতিমারি কিনা এখনও যে যাই বলুক তত প্রমাণিত নয়, কিন্তু পুঁজিবাদ বহুমারি।
গণতন্ত্র ব্যক্তিস্বাধীনতা মানবতা ন্যায়পরায়ণতা বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা প্রশাসনের অদলীয় অবস্থান– সব এখন বইয়ের পাতায়।
তাও বেশিদিন থাকবে বলে মনে হয় না। গুজরাটের পাঠ্যপুস্তকে ইতিমধ্যেই হিটলার হিরো।
সিবিএসই পাঠক্রম থেকে গণতন্ত্র ও সংবিধানের মৌলিক অধিকারের অধ্যায় পড়ানো নিষিদ্ধ।
কর্পোরেটরা ছয় লাখ কোটি করছাড় পেয়েছেন।
শুধু লিপসার্ভিস জনগণের জন্য।
১০ লাখের ওপর আয় করলে মধ্যবিত্ত কর্মচারী দেবেন ৩০% কর।
আর বছরে ১০ কোটির থেকে
২২ লাখ কোটি টাকা আয় করা আদানি আম্বানিরা দেবেন ২২% কর।
এই বাবদ ২০১৯-২০ অর্থ বর্ষে ভারত সরকার এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড় দিয়েছে।
রামদেব মেহুল চোকসি নীরব মোদির মতো ৫০ জন ৬৮ হাজার কোটি টাকা মেরে দিলেন।
মোদি সরকারের কথায় তা মকুব করে দিয়েছে ব্যাঙ্ক।
দেবেগৌড়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বলেছিলেন, ব্যাঙ্কগুলি ৬ লাখ কোটি টাকা পায় পুঁজিপতিদের থেকে। এটা বলার ক’দিন পরেই তাঁর সরকারের পতন ঘটে।
পাকিস্তানের পারভেজ মোশাররফ টিভিতে বিজ্ঞাপন দিতেন শিল্পপতি ও ধনীরা কত টাকা ঋণ নিয়ে ফেরৎ দিচ্ছে না। এর কিছুদিন পরেই কার্গিল যুদ্ধের অজুহাতে পি টিভি ভারতে নিষিদ্ধ হল।
দুঃখের বিষয়, ভারতে প্রথম পি টিভি নিষিদ্ধ হয় ১৯৯৯এ বাংলায়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নির্দেশে।
আজ পাকিস্তানে তেলের দাম ৩০-৩৫ টাকা করে কমেছে। ভারতে ১০-১৩ টাকা বেড়েছে। তাই বাসভাড়া ন্যূনতম ২৫ টাকার দাবি উঠেছে।
অথচ বিমানের জ্বালানি তেলের দাম এখন ২৩% কমেছে।
৪৬ টাকা মাত্র। এতে বিপুল ভর্তুকি দিচ্ছে ভারত সরকার।
ইতালি আমেরিকা ইংল্যান্ড থেকে বিনা পয়সায় বিমান ভাড়া করে নিয়ে এল ধনীদের। আর ভারত গড়ার কারিগরদের কাছ থেকে রেল টিকিট পিছু ৭২০ টাকা করে বেশি নেওয়া হচ্ছে। রাজধানী এক্সপ্রেসে তিনবার খাবার ও জল দেওয়া হয়।
অথচ শ্রমিকরা বেশি পয়সা দিয়ে এই ট্রেনে এসেও এক গ্লাস জল পর্যন্ত পাননি।
পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায় সাম্রাজ্যবাদ।
সাম্রাজ্যবাদের কুৎসিত রূপ ফ্যাসিবাদ।
ফ্যাসিবাদ বিদ্বেষ বিভাজন ও অস্ত্র বিপণন বোঝে। বোঝে যুদ্ধ।
তাই করোনা ভাইরাস পরীক্ষায় কোন ভর্তুকি দেওয়া হয় না। উল্টে যে কিটের দাম মাত্র ২৩ থেকে ৭৭ টাকা তার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারগুলোর কাছে ৭৯৫ টাকা করে দাম নেয়।
লুঠমারি করতে দিয়েছে কর্পোরেট হাসপাতালগুলোকে।
এখানে করোনা পরীক্ষার খরচ ৪৫০০ টাকা।
কেন্দ্রীয় সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম।
৫০ টাকা করে করোনা কিট দিতে চেয়েছিল দিল্লি আই আই টি ও সিপলা। তাঁরা অনুমতি পাননি।
অনুমতি দেওয়া হয়েছে এক ভুঁইফোড় দালাল গুজরাটি সংগঠন কসোরাকে।
তাঁদের আমদানি করা করোনা কিট জাল। ভেজাল। তা প্রমাণিত।
কোটি কোটি টাকার কেলেঙ্কারি।
কিন্তু মোদি সরকারের প্রসাদ পুষ্ট মিডিয়া চুপ।
দৃশ্যমাধ্যমে শুধু এনডিটিভি ও পশ্চিমবঙ্গে কলকাতা টিভি লড়ে যাচ্ছে।
করোনা নিয়ে নানা মত।
ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অভিযোগ করেছেন, এটি বিল গেটসের কীর্তি।
বিল গেটস মানুষের ওপর খবরদারি বাড়াতে শরীরে চিপস বসাতে চায়।
এডোয়ার্ড স্নোডেন অভিযোগ করেছেন, করোনা মোকাবিলার নামে রাষ্ট্র আরও বেশি নজরদারি চালাতে চায়।
আরোগ্য সেতু অ্যাপ ভারতে তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
করোনার নামে কেন্দ্রীয় সরকার সাম্প্রদায়িকতা বাড়িয়েছে।
বিদ্বেষ ছড়িয়েছে।
রাজ্য সরকারগুলোকে অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু করে দিয়েছে।
স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম বলে কিছু রাখবে না আর।
কাগজ ছাপাই হচ্ছে না।
বিজ্ঞাপন প্রায় নেই।
সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর বাঁচতে হবে।
অতএব বকলমে সরকারি মুখপাত্র এবং পত্র।
তাই, দেখবেন আমফানে বাংলার চারটি জেলা বিধ্বস্ত। ৭২ জনের বেশি চারঘন্টার ঝড়ে নিহত। লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরহীন। আশ্রয়হীন। বস্ত্রহীন। খাদ্যহীন। এনডিটিভি ছাড়া সমস্ত তথাকথিত জাতীয় সংবাদপত্র নীরব।
কেন্দ্রীয় সরকারের হুঁশ নেই। টুইটমাস্টার প্রায় নীরব।
গত কয়েক বছরে কালান্তক ঘূর্ণিঝড় বেড়েছে। মহাসেন বুলবুল ফণি আমফান– চলছে তো চলছেই।
কেন ঘটছে?
কেউ বলছেন না, মরুভূমিতে খাদ্য সাম্রাজ্যবাদীরা ফসল ফলাচ্ছে। ফলে মৌসুমী বায়ুর পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।
যে আশ্বিনে হতো তা হচ্ছে যে কোন সময়।
ঘূর্ণিঝড় হয়ে যাচ্ছে প্রলয়ঙ্কর।
ইজরায়েল শুধু অস্ত্র বানায় না, তারা মরুভূমিতে চাষের মাস্টার।
পরিকল্পনা করে পৃথিবীর কৃষি ও কৃষকের সর্বনাশ করা হচ্ছে।
জমির চরিত্র পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।
সমুদ্রের জল ঢুকে নোনা হয়ে চাষের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের এই সবের বিরুদ্ধে তাত্ত্বিক ও আদর্শগত লড়াই চালাতে হবে।
করোনা কালে বেশ কিছু সামাজিক সংগঠন ত্রাণের কাজ ভালো ভাবে করছেন।
বামপন্থী কর্মীরা পথে নেমেছেন, তৃণমূল এবং কংগ্রেস। বিজেপি অনুপস্থিত ত্রাণ কাজে। কিন্তু ঘৃণা ছড়ানোর কাজ ভালোভাবে নিষ্ঠার সাথে করে চলেছেন।
প্রান্তজন, নাগরিক উদ্যোগ, গণতদারকি, বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ, ভাষা ও চেতনা সমিতির মতো বহু সংগঠন ত্রাণের কাজ করছেন।
করছেন সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ।
এর মধ্যে দু তিনটি সংগঠন মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ে জন্মানো ছেলেমেয়েরা চালাচ্ছেন।
কিছু ব্যক্তিও আছেন।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই, এই সংগঠনগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই। একটা সংগঠন গড়েই আবার একটা নতুন সংগঠন।
এতে বৈরিতা বাড়ছে। সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক
বৈরিতা ঠেকাতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি বাড়ছে।
আড়ালে আবডালে সমালোচনা হচ্ছে, হাম কিসিসে কম নেহি’ মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অথচ অনেকেই নানা গুণের অধিকারী। কেউ ভালো তথ্যানুসন্ধান করতে পারেন, কেউ লিখতে, কেউ বলতে, কেউ গাইতে, কেউ অর্থ সংগ্রহ করতে, কেউ সংগঠন করতে, কেউ তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ, কেউ জনসংযোগে, কেউ সমাজকর্মে।
এঁদের একজোট হতে হবে।
এর মানে এখনই কোনও একক সংগঠনের কথা বলছি না, কিন্তু যৌথ প্ল্যাটফর্ম দরকার।
মনে রাখবেন, শত্রু ঐক্যবদ্ধ আক্রমণে।
ওরা বাছবিচার করবে না বিনাশে।
আমরা শতধাবিভক্ত।
শতফুল বিকশিত হোক।
শত আগাছা নির্মূল হোক।
ঈর্ষা ও বৈরিতা কমুক। পরস্পরের গুণের প্রশংসা প্রকাশ্যে ও আড়ালে শুরু হোক।
সময় বেশি নেই।
ফ্যাসিবাদ রুখতে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ ও শক্তি একজোট না হলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না।
নিজের জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হবে সবাইকেই।