জলসাঘর

অরিজিত চ্যাটার্জী

বর্তমান ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চে এখন “দেশপ্রেম”-এর বন্যা বয়ে চলেছে। যার আঁচ পড়েছে মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে। সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে “ভারতীয়”-দের খাদ্য, বস্ত্র, সংস্কৃতিকে এবং কোনটা “ভারতীয়” কোনটা নয় তা প্রতিষ্ঠা করতে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্তরা হাতিয়ার করেছে গুন্ডাগিরি, পুলিশ-প্রসাশন এবং কিনে রাখা সংবাদ-মাধ্যমকে। ভারতের বিশাল retail market-দখলের জন্য লালায়িত Facebook, Amazon, Google, Jio এর মতো internet-দানবদের স্নেহধন্য এই ফ্যাসিস্তরা internet-কেও নিজেদের পরাভূত করার স্পর্ধা দেখায়। “ভারতীয় খাদ্যাভ্যাস” ঠিক করে দেওয়ার জন্য “গো-রক্ষক” দের হাতে মুসলিম ও দলিত হত্যা, গো-মাংস নিষিদ্ধ করা নিত্যদিনের সংবাদ। এদের বিরূদ্ধে কথা বলার জন্য সাংবাদিকদের নিগ্রহ ও হত্যাও ঘটছে নিয়মিত। দেশ-বিদেশের বিজ্ঞাপন, সিনেমা ban ও কাটছাঁট করে দেশের সংস্কৃতিকে মজবুত করা হচ্ছে। রাজধানীর বুকে প্রসিদ্ধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শিল্পীকে কাওয়ালি পরিবেশনা করতে বাধা দেওয়া হয়, কারণ তা নাকি ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী। চারিদিকে যারা সংস্কৃতি নিয়ে যখন এত হৈ-হুল্লোড় করছে তারা কিন্তু নিজেদের সংস্কৃতির ইতিহাস মূল্যায়নে কোনোভাবেই আগ্রহী নয়। কারণ সেটা হলে তারা নিজেরাই মুস্কিলে পড়বে। কাজেই এই ইতিহাস-চর্চা আমাদেরই করতে হবে, নইলে সংস্কৃতিবাজেরা ইতিহাসকে নিজেদের মতোই লিখবে।

ভারতীয় উপমহাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির অনেক ধারা রয়েছে, যথা— ভাস্কর্য, সাহিত্য, নৃত্য ও সংগীত, বস্ত্র-শিল্প, নানারকমের কারিগরি, খাওয়াদাওয়া, ধর্মীয় লোকাচার ইত্যাদি। এগুলির মধ্যে কয়েকটি কালপ্রবাহে হারিয়ে গেছে এবং কয়েকটির দশা মৃতপ্রায়। এদের মধ্যে যে ধারাটি সর্বাপেক্ষা প্রাচীনতার সাক্ষবাহী, বৈচিত্রপূর্ণ এবং এখনও কালগর্ভে পুরোপুরি বিলীন হয়নি সেটি হল এখানের নৃত্য ও সংগীত। এখানে যেমন রয়েছে অসংখ্য লোকগীতি ও লোকনৃত্য। তেমনি এটি পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে রয়েছে দুটি পৃথক ধ্রুপদী সঙ্গীত এবং ছয়টি ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পের ধারা। কাজেই এই বিশালায়তন নৃত্য ও সঙ্গীত–এর সবকিছু নিয়ে আলোচনা করার মতো পরিসর এবং লেখকের জ্ঞান দুই সিমীত। আমরা এখানে মূলত ভারতে বীণা তথা যন্ত্র-সঙ্গীতের ইতিহাস নিয়ে আমাদের আলোচনা সীমিত রাখব।

বীণা বলতে প্রথমেই যা আমাদের মনে আসে তা হল দেবী সরস্বতীর মূর্তি। বীণা এবং সরস্বতী উভয়ের উল্লেখ ঋগ্‌বেদে রয়েছে বলে অনেকে বীণা ও ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীত-কে ততোটাই পুরানো বলে উল্লেখ করে থাকেন, যা সঠিক নয়। প্রথমত আমরা সরস্বতীর বীণা-বাদিনী যে মূর্তি বর্তমানে দেখি তার উৎপত্তি খ্রীষ্টীয় দশম শতক নাগাদ। আর ঋগ্‌বেদের সময়কাল থেকে শুরু করে গুপ্তযুগের শেষ অবধি আমরা যে বীণার উল্লেখ পাই তা ছিল Harp । গুপ্তযুগের মুদ্রায় সমুদ্রগুপ্তের যে বীণাবাদনরত চিত্র দেখা যায় সেটি এক রকমের Arched Harp ।[1] ধনুকের তারের কম্পনে যে তীখ্ন মিষ্টি শব্দ উৎপন্ন হয় তা থেকে অনুপ্রানিত হয়েই Harp বাদ্যযন্ত্রটি বানানো হয়। এই যন্ত্রটির আবিস্কার প্রাচীণ মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় (খ্রীঃপূঃ ৩০০০)।[2] সেখানে রাজা ও অভিজাতদের সমাধিস্থলে বাদ্যযন্ত্রটির বহু চিত্র পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে Harp-এর সাথে কাঠের বাক্স যোগ করা হয় যাতে করে বায়ুস্তম্ভের কম্পনে যন্ত্রের শব্দ পরিবর্ধিত হয়। এইধরনের Harp–এর পরিমার্জিত সংস্করণ আমরা Western Classical Music-এ দেখতে পাই। এভাবে কাঠের দণ্ড বা Board–এর ওপর তার বা সুতো বেঁধে এবং তার সাথে Air-chamber যুক্ত করে নানান রকমের String Instrument–এর উদ্ভাবন ঘটে; এদের সামগ্রিক ভাবে Lute বলা যায়। এই Lute -গুলি হল সমস্ত আধুনিক String Instrument-এর পূর্বপুরুষ । প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, মিশর এবং এর অনেক পরে গ্রীসেও বিভিন্ন রকমের Lute জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু তৎকালীন সিন্ধু সভ্যতায় এই বাদ্যযন্ত্র-গুলির প্রচলন ছিল খুব সামান্যই। সেখানে পোড়ামাটির তালবাদ্যের বিশেষ প্রচলন ছিল। সম্ভবত এইগুলি ছিল মৃদঙ্গের prototype ।[3]

এতদূর এসে আমরা এটুকু বুঝতে পারি যে এই প্রাচীণ String Instrument-গুলির আবিস্কার মধ্য-প্রাচ্যে এবং সেখান থেকে পরবর্তীতে বাদ্যযন্ত্রগুলি ইউরোপ ও এশিয়ার নানান প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। যাইহোক, বীণা-র ইতিহাস প্রসঙ্গেই Harp ও Lute নিয়ে আলোচনার অবতারণা। তবে সমসাময়িক ভারত ভূখন্ডের সঙ্গীত সম্পর্কে কথা না বললে আলোচনাটা অসম্পূর্ণ থাকে। তাই ঋগ্‌বেদের সময়ে (খ্রীঃপূঃ ১৫০০) সঙ্গীত নিয়ে প্রথমেই বলা উচিত যে সেইসময় বেদের মন্ত্রপাঠের জন্য ব্যবহার করা হত দুইটি স্বর (সাতটি স্বর সা রে গা মা… –এর মধ্যে)। পরবর্তিতে সামবেদে মন্ত্রপাঠে স্বরের সংখ্যা বেড়ে তিনটি হয় [ড: লালমনি মিশ্র]। কাজেই এই পর্যায়-এর সঙ্গীতকে ধ্রুপদী সঙ্গীত না বলে আদিম লোকসঙ্গীত বলাই শ্রেয়।

এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, বহু সহস্র বছরের মানব সভ্যতার ইতিহাসে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ ও উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে লোকসঙ্গীতের মাধ্যমে। কিন্তু লোকসঙ্গীত আলেয়ার মতো যেমন আকস্মিক জ্বলে ওঠে, তেমনি কালের অন্ধকারে মিলিয়েও যায়। পৃথিবীর কোথাও লোকসঙ্গীতের প্রত্যক্ষ সংরক্ষণ হয়নি। লোকসঙ্গীতের পরোক্ষ সংরক্ষণ হয়েছে বিভিন্ন ধ্রুপদী সঙ্গীতের ধারায়, যা সাধারণ ভাবে বেড়ে ওঠে ধর্ম বা রাজ-অনুগ্রহের ছত্রছায়াতে। যন্ত্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও একইরকম ভাবে দেখা যায়, আদিম Harp, বাঁশি, তালবাদ্য-গুলির পরিমার্জনের ফলে Clarinet, Guitar, Violin, সেতার, সরোদ, এস্রাজ ইত্যাদি যন্ত্রের উৎপত্তি ঘটে এবং সেগুলি ধ্রুপদী ও আধুনিক সঙ্গীতের অন্তর্ভুক্ত হয়। আমরা এখানে ভারতে বীণার উদ্ভব ও বিবর্তন নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব এবং এই বিবর্তনের আলোচনাকে পুরোপুরি ভাবে লোকসঙ্গীত বা ধ্রুপদী-সঙ্গীতের সীমারেখায় বেঁধে রাখা সম্ভব নয়।

যাইহোক, সামবেদ-এর মন্ত্রপাঠ থেকে পূর্ণাঙ্গ সঙ্গীতের জন্ম হয় আরো পরে, যখন থেকে “ভারত নাট্যশাস্ত্র”–এর রচনা শুরু (৫০০ খ্রীঃপূঃ)। কথিত আছে যে ভরত-মুনি এর লেখক। কিন্তু বর্তমানে Scholar-রা মনে করেন যে গ্রন্থটির রচনা একটি বিস্তীর্ণ সময় ধরে হয়েছে কাজেই এর রচয়িতা কেউ একজন নন। এই সময় থেকে সঙ্গীতের ব্যাকরণ নির্মাণ শুরু হয়। স্বর, সপ্তক —এসবের আলোচনা নাট্যশাস্ত্রে পাওয়া যায়।  তৎকালীণ হিন্দু ও বৌদ্ধ রচনাগুলিতেও বীণা ও তালবাদ্য সহযোগে সঙ্গীত পরিবেশনার কথা রয়েছে। যদিও সঙ্গীতের গঠন বা রাগরাগিনী নিয়ে আলোচনা পাওয়া যায় না। আর বীণা (প্রকৃত-অর্থে প্রাচীন Harp) তখনো অবধি মূলত সঙ্গত এর জন্যই ব্যবহার করা হত কারণ এটি গঠনগত ভাবে উন্নত হয় এরও অনেক পরে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার যে ভারতে সঙ্গীত তথা অন্য সমস্ত শিল্পে নথিবদ্ধ-করণ হয়েছে খুব সামান্যই। তাই এখানের সঙ্গীতের বিবর্তন নিয়ে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। তবে Musicologist-রা এই বিষয়ে একমত যে মন্ত্রপাঠকে কেন্দ্র করেই এই সঙ্গীত বিস্তার লাভ করেছে। সেই কারণেই এই সঙ্গীতের  গঠন একদিকে যেমন সরল তেমনভাবেই গাণিতিক ভাবে সংগতি-পূর্ণ। প্রাচীন ধ্রুপদের চলনের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যটি আমরা খুব সহজে বুঝতে পারি। Western Classical-এর Baroque period-এর মধ্যেও এই গাণিতিক সাযুজ্য লক্ষনীয়। Musicologist Dr. V.R. Raghavan-এর মতে ভারতীয় সঙ্গীতের এই আঙ্গিকের সাথে অদ্ভুত রকমের মিল রয়েছে ইহুদীদের প্রাচীন লোকসঙ্গীত ও ধর্মীয় সঙ্গীতের [4]। বৈদিক সংস্কৃতির সাথে মধ্য-প্রাচ্যের যোগাযোগ ইতিহাস-চর্চার বিভিন্ন প্রান্তে বারে বারে ফিরে আসে। যদিও আমাদের দেশের “দেশপ্রেমিকেরা” এটা মোটেই ভালো চোখে দেখেন না। কারণ তাঁদের গর্ব করা “সংস্কৃতি” যদি “বিদেশী” হয়ে যায় তাহলে তাঁরা নিজেরাই অপাংক্তেয় হয়ে পড়বেন।

যাইহোক, বীণার গঠনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন শুরু হয়ে যায় গুপ্তযুগের শেষের দিক থেকে (খ্রীঃ ৫ম শতক)। আগেই আলোচনা হয়েছে যে কীভাবে Harp থেকে বিভিন্ন Lute এর সৃষ্টি হয়েছে। এইরকমের একটি প্রাচীন Lute (যেটিকে বর্তমানে Musicologist-রা Stick-zither বলে থাকেন) থেকেই বীণার উৎপত্তি। Stick-zither-এ একটি ফাঁপা বাঁশের দণ্ডের ওপরে তার বাঁধা থাকে এবং Amplification-এর জন্যে এর একদিকে শুকোনো লাউ বা কুমড়োর ফাঁপা খোল লাগানো থাকে যাকে Resonator বলা হয়। খ্রীঃ ৫ম-৭ম শতকের মধ্যে অজন্তার গুহাচিত্রে যেসব বীণার ছবি পাওয়া যায় সেগুলি মূলত বড় আকারের Stick-zither [5]। সেই অর্থে এগুলিই প্রাচীনতম বীণা। পরবর্তীতে এর সাথে আরো একটি Resonator (অর্থাৎ লাউ/কুমড়োর খোল) লাগানো হয় এবং সম্ভবত মোটা ধাতব তার যোগ করা হয়। এর ফলে শব্দের যেমন Amplification ও  Bass বাড়ানো হয় তেমন Sustain–ও বাড়ে। এভাবেই বীণা একটি সঙ্গতের যন্ত্র থেকে স্বতন্ত্র যন্ত্রে উত্তীর্ণ হয়। এরকম বীণার ছবি ও মূর্তী ইলোরা, মহাবলীপুরম, তাঞ্জোর ও অন্যান্য স্থানে পাওয়া যায় (খ্রীঃ ৭ম-১০ম শতকে)। এর পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ছিল তারের নীচে কাঠের পর্দা (fret)। এটিই হল বীণার সম্পূর্ণ কাঠামো, অর্থাৎ ফাঁপা বাঁশের বা কাঠের দণ্ড দুটি Resonator, তার ও কাঠের পর্দা। এই সম্পূর্ণ বীণার ভাস্কর্য দেখা যায় বেলুড়, হালেবিডু ইত্যাদি স্থানে (খ্রীঃ একাদশ-দ্বাদশ শতকে)। এই মূল কাঠামোর ওপরে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তৈরি হয় নানারকমের বীণা, যথা- রুদ্রবীণা, কছপীবীণা, চিত্রবীণা, কিন্নরীবীণা ইত্যাদি। এই সময়েই রচিত হয় “সঙ্গীত রত্নাকর”, যেখানে রাগ-রাগিনীর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। ধ্রুপদ-এর কোন উল্লেখ এখানে না থাকলেও নিম্বর্ক সম্প্রদায়ের (বৈষ্ণব-দের একটি শাখা) রচনায় কিছু গান পাওয়া যায় যার চলন ধ্রুপদের মতো।

এখানে বলে রাখা দরকার যে আগে উল্লিখিত অধিকাংশ গুহাচিত্র-গুলিতে শিব ও নারদের হাতে বীণা দেখা যায়। এর কারণ, দীর্ঘদিন ধরেই কৃচ্ছসাধনকারী সন্তরাই এই সঙ্গীতের ধারক ও বাহক ছিলেন এবং গুহা, নির্জন আশ্রম ও মন্দিরেই এর চর্চা হত। সর্বশেষ, প্রবাদপ্রতিম মিঞা তানসেনের গুরু ছিলেন সন্ত হরিদাস। আর সরস্বতীর হাতে বীণা থাকলেও বলা বাহুল্য যে, সমস্ত ধর্মের তথাকথিত ভদ্র সমাজে মেয়েদের প্রকাশ্যে নৃত্য-গীত পরিবেশনা নিষিদ্ধ ছিল। তাই প্রাচীন বৌদ্ধ ও হিন্দুশাস্ত্রগুলি থেকে শুরু করে গত শতকের প্রথমার্ধ অবধি আমরা দেখতে পাই নগরবধূ, দেবদাসী ও বাঈজীরাই এই সংস্কৃতি-চর্চার নজির রেখে গেছেন এবং তাঁদের অনেকেই সেই সময়ের স্বনামধন্যা শিল্পী ছিলেন।

এর পরবর্তী সময় থেকে গুহা, জঙ্গল, মন্দির থেকে বেরিয়ে এই সঙ্গীত রাজ-দরবারে পৌঁছতে শুরু করে, যা সম্পূর্ণ হয় মুঘল আমলে। এই সময় থেকে মার্গসঙ্গীত ব্যাপক ভাবে রাজ-অনুগ্রহ পেতে শুরু করে; স্বাভাবিক ভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্গীতচর্চা ও গবেষণার শুরু এই সময় থেকেই। তবে বলে রাখা ভালো সাধারণ মানুষের কাছে সেই সঙ্গীতের দরজা খোলে এর অনেক পরে; কারণ শিল্পীরা সঙ্গীতের জ্ঞান তাঁদের পরিবারের ভেতরেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইতেন যাতে করে উত্তরসূরীদের জীবিকানির্বাহ সুরক্ষিত থাকে। এই ধারা যে এখন একেবারেই নেই তা নয়, তবে বিংশ শতকের প্রথমার্ধ অবধি এটি খুবই প্রকট ছিল। যাইহোক, আমরা চলে আসব মুঘল আমলে। এই সময় থেকে গ্বালিয়র হয়ে ওঠে মার্গ সঙ্গীতের পীঠস্থান এবং পরবর্তী কয়েক শতকেও এখানের উজ্জলতা ম্লান হয়নি।  রাজপুত রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতাই সম্ভবত এর কারণ। বৈজু বাওরা, রামতনু পাণ্ডে (যিনি পরবর্তীকালে তানসেন নামে খ্যাত) প্রমুখরা এখানের রাজসভাকে অলংকৃত করেছেন। পরবর্তীকালে আকবরের আমন্ত্রনে তানসেন ফতেপুর-সিক্রীর রাজদরবারে চলে যান এবং এর পরবর্তী কয়েক শতকের উত্তরভারতীয় রাগ-সঙ্গীতকে তানসেন-যুগ বললে অত্যুক্তি হয় না। কারণ মুঘল পৃষ্ঠপোষকতায় তানসেন ও তাঁর উত্তরসুরীরা এই সঙ্গীতকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যান। এই Hegemony এতটাই প্রকট ছিল যে এর কয়েক শতক পরেও অনেক সঙ্গীত শিল্পী নিজেদেরকে তানসেনের বংশধর বলে জাহির করায় উৎসাহী ছিলেন।

এই প্রসঙ্গে বলা দরকার যে এইসময় ভারতের জনমানসে সুফিবাদের ভাবধারার গভীর প্রভাব ছিল। বিশেষত এখানের শিল্পী ও লেখকদের জীবন ও কাজে সুফিবাদের অনুপ্রেরণা বারে বারে উঠে আসে। তানসেন সুফি সন্ত মুহাম্মাদ ঘাউসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তাঁর উত্তরসূরীরা ধর্মান্তরিত হন। কিন্তু মজার ব্যাপার হল তাঁদের অনেকেই নিজেদের একটি হিন্দু এবং একটি মুসলিম নাম রাখতেন। কাজেই তৎকালীন সমাজে ধর্ম নিয়ে ছুঁতমার্গ-এর পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ ও সহিষ্ণুতার সহাবস্থান লক্ষনীয়।

এতো গেল যন্ত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা। কিন্তু রবাবী ও বীণ্‌কারদের সঙ্গীতের মণিমানিক্য তখনও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে পরিবার-তান্ত্রীকতার বেড়াজালে আবদ্ধ। এই বেড়াজাল কাটল বিংশ শতকের প্রথমার্ধে; আর এই বিপ্লব যিনি সংঘটিত করলেন তিনি একজন বাঙ্গালি। তৎকালীণ বাংলাদেশের ব্রাহ্মন্যবেরিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন উস্তাদ আল্লাউদ্দিন খাঁ [৭]। সঙ্গীত-শিক্ষার জন্য ৯-বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে  কলকাতায় আসেন। এরপর কখনো ফুটপাথে থেকেছেন কখনো বা সঙ্গীত-গুরুর বাড়িতে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ফাই-ফরমায়েশ খেটে সঙ্গীত শিক্ষা করেছেন। ভারতের বভিন্ন প্রান্তে সঙ্গীতের মণিমাণিক্য সংগ্রহ করেছেন। Western Classical-এরও তালিম নিয়েছেন, যার পরিচয় আমরা তাঁর এবং তাঁর শিষ্যদের সৃস্টির মধ্যে পেয়ে থাকি। মধ্যপ্রদেশের মাইহারের রাজার Court Musician হিসেবে তিনি বাকি জীবন কাটান। সেখান থেকে সঙ্গীত শিক্ষা করে তৈরি হয়েছেন উস্তাদ আলি আকবর খাঁ, পণ্ডিত রবিশংকর, শ্রীমতি অন্নপূর্ণা দেবী, পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জী, পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষ প্রমুখ, যাঁরা পৃথিবীর সর্বকালের সেরা সঙ্গীতজ্ঞদের মধ্যে নিজেদের স্থান করে নিয়েছেন। এভাবে তিনি পরিবারতন্ত্র ও সংকীর্ণতার বেড়াজাল থেকে যন্ত্রসঙ্গীতকে যেমন মুক্তি দিলেন তেমন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মণিমানিক্যকে এক সুতোয় বেঁধে উপহার দিলেন মার্গ-সঙ্গীত থেকে বঞ্চিত এখানের সাধারন মানুষকে। এই অর্থে তাঁকে ভারতীয় যন্ত্র–সঙ্গীতের তানসেন বললে অত্যুক্তি হয় না।

আমরা এখানে দক্ষিণ ভারতের মার্গ-সঙ্গীত নিয়ে খুব একটা কিছু বলিনি কারণ সে বিষয়ে লেখকের বিশেষ চর্চা নেই। তবে এই দুই ধারা উৎপত্তিগত ভাবে একই। সেখানের রাগ-রাগিণী ও তালের বহু প্রকরন এবং গাণিতিক সংগতির নিপুণতা বিশ্ব-সংগীতে বিরল। কিন্তু ব্রাহ্মন্যবাদের ভয়াবহতা সেখানে এতটাই প্রকট, যে, বিশিষ্ট কর্ণাটিক সঙ্গীতশিল্পী T.M. Krishna, এই সঙ্গীতকে “For the brahmins by the brahmins” বলে ব্যঙ্গ করেছেন। ব্রাহ্মন্যবাদের চাপে পড়ে কর্ণাটিক সঙ্গীত জড়বৎ একটি সাংস্কৃতিক ধারায় পরিণত হয়েছে এবং উত্তর ভারতের ন্যায় এত বৈচিত্র সেখানে অনুপস্থিত— এই ধারণা পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জী ব্যক্ত করেছেন।

বাদ্যযন্ত্রের বিবর্তন ও বীণার উদ্ভবের আলোচনা প্রসঙ্গে ভারতীয় সঙ্গীতে নারীদের অবগুন্ঠন, পরিবারতান্ত্রিকতা, ব্রাহ্মন্যবাদের প্রকোপ আমরা আলোচনা করেছি। এই প্রসঙ্গে উঠে আসে বাদ্যযন্ত্রের কারিগরদের কথা। আজ থেকে কয়েক শত বছর আগেও যন্ত্রের কারিগর ও যন্ত্রশিল্পীরা ছিলেন অভিন্ন। কিন্ত শ্রমবিভাজনের নিয়মেই বর্তমান আধুনিক সভ্যতায় এই সমস্ত যন্ত্রের কারিগর ও যন্ত্রশিল্পীদের মধ্যে বহু যোজনের অন্তরায়। ভারতীয় উপমহাদেশে এই অন্তরায়ের মধ্যে আবার জাতপাতের ছুঁতমার্গ প্রবল। উদাহরণ স্বরূপ, চামড়ার বাদ্যযন্ত্রের কারিগর-রা মূলত বাদ্যকর সম্প্রদায় এবং কাঠের বাদ্যযন্ত্রের কারিগর-রা সূত্রধর সম্প্রদায়ের মানুষরা ছিলেন সমাজের নিচু জাতের অন্তর্গত এবং অস্পৃশ্যতার শিকার। ধ্রুপদী সঙ্গীত, এমনকি বর্তমান আধুনিক সঙ্গীতেও সমাজের নীচু জাতের মানুষের প্রবেশ অনেকাংশেই কন্টকাকীর্ণ। ঐতিহাসিক ভাবে ভক্তি-আন্দোলন থেকে উঠে আসা সন্ত কবীর, রবিদাস, তুকারাম প্রমুখ-দের সঙ্গীতে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, আজকের বানিজ্যিক ভীম-গীত, দলিত-pop তাকে বহন করে চলেছে।

এবার আলোচনার ইতি ঘটানোর পালা। আমরা ভারতীয় যন্ত্র-সঙ্গীতের ইতিহাস আলোচনা শুরু করেছিলাম সেই ঋগ্‌বেদের সময় থেকে। কালক্রমে দেশ ও বিদেশের নানান প্রান্তের সংস্কৃতির স্রোত এসে মিশেছে এখানে এবং সমৃদ্ধ করেছে আমাদের। কিন্তু এতো ছিল আমাদের অতীত। বর্তমান সময়ে আমাদের সঙ্গীতের কথা না বললে এই আলোচনা পূর্ণতা পাবে না। বর্তমান সময়ের popular music-এর একটি চলতি trend, Hiphop-এর সৃস্টি আমেরিকার কালো চামড়ার মানুষের মাঝে ১৯৭০-এর দশকে। আমেরিকান critic Nelson George বলেছেন, আমেরিকার কালো চামড়ার মানুষের তৈরী করা Jazz, Blues -এর ধ্বংসস্তুপের ওপর তৈরী হয়েছে Hiphop। এর পেছনে রয়েছে সামন্ত-তন্ত্র থেকে পুঁজিবাদী এবং তারপর neoliberal সামাজে এই প্রান্তজনেদের transformation-এর ইতিহাস। শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও একথা সত্যি যে সামন্ততন্ত্রের তুলনায় পুঁজিবাদী সমাজ ও অর্থনীতি, শিল্প-সংস্কৃতিকে করেছে বৈচিত্রহীন ও অনেকাংশে অসাড়। সম্ভবত, প্রকৃতি থেকে দূরে সরে আসা এবং connectivity-এর উন্নতি এই homogenization এবং অসাড়ত্বের কারণ। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য। এখানের বর্তমান pop music দাঁড়িয়ে রয়েছে remake/plagiarism এবং sound track mixing-এর ওপর, যার রমরমা মূলত ১৯৮০-এর দশকের পরবর্তি সময় থেকে। বর্তমান সময়ের এই সাঙ্গীতিক অচলায়তনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমাদের দেশের সঙ্গীত-পিপাষুরা আগামীর তানসেন, Bach, লালন, রবীন্দ্রনাথ-দের অপেক্ষায় চাতকের মতো চেয়ে থাকবে।

References:

1.       Wrazen, Louise (Autumn–Winter 1986). “The Early History of the Vīṇā and Bīn in South and Southeast Asia”. Asian Music. University of Texas Press. 

2.       Galpin, F. W. (1929).“The Sumerian Harp of Ur, c. 3500 B.C.E.” Oxford Journal of Music and Letters.

3.       www.harappa.com, Ahmed Hasan Dani.

4.       www.thehindu.com/features/friday-review/music/the-fount-of-indian-music/article3938725.ece

5.       www.rudravina.com

6.   রাগ-অনুরাগ, পণ্ডিত রবি শংকর

7.   আমার কথা, আচার্য আলাউদ্দিন খাঁ

+ posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *