মোমিন কনফারেন্স — নাম তো নেহি শুনা হোগা?

সরফরাজ মল্লিক

বিভাগপূর্ব ভারতবর্ষে যে সমস্ত মুসলমান সংগঠন মুসলিম লীগ ও দ্বিজাতি তত্ত্বের কঠোর সমালোচক ও প্রবল বিরোধী ছিল ‘মোমেন কনফারেন্স’ তাদের অন্যতম। ত্রিশের দশকে তথাকথিত ‘ছোট’ জাতের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। হিন্দু সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির আদলে মুসলমান সমাজেও একটি রাজনৈতিক আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। মুসলমান সমাজের তাঁতিরা ( যাদেরকে ‘জোলা’ বলা হয়) রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে শুরু করে। সামাজিকভাবে পশ্চাত্পদ কারিগর শ্রেণি, বিশেষ করে তন্তুবায় শ্রেণির কণ্ঠস্বর হিসেবে জন্ম হয় ‘জামিয়াতুল মোমিন’ বা ‘মোমিন কনফারেন্সে’র।

মোমিন কনফারেন্সের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মৌলানা আলি হোসেন আজিম বিহারী। তিনি ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই এপ্রিল বিহারের নালন্দা জেলার খাসগঞ্জে এক গরিব তাঁতি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালেই জীবিকার তাগিদে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। কাজ গ্রহণ করেন ঊষা কম্পানিতে, সঙ্গে চলতে থাকে পড়াশোনা। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ার কারণে কোম্পানি থেকে নিষেধ আসলে তিনি কাজ ছেড়ে দেন এবং বিড়ি বাঁধাইয়ের কাজ নেন। সেই সময় বিড়ি শ্রমিকদের দাবি-দাওবা নিয়েও তিনি আন্দোলন করেছিলেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আন্দোলন করার কারণে লালা লাজপত রাই, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দকে ইংরেজ সরকার গ্রেফতার করলে মৌলানা আলি হোসেন আজিম বিহারীর উদ্যোগে ‘পত্র প্রতিবাদ’ শুরু হয়। সারা দেশ থেকে প্রায় দেড় লক্ষ প্রতিবাদপত্র সে সময় রানী ভিক্টোরিয়াকে পাঠানো হয়। ইংরেজ সরকার শেষে এই নেতৃবৃন্দদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার তাঁতবাগে কারিগর শ্রেণির মুসলমান সমাজের আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে তিনি জামিয়াতুল মোমিন দল গঠন করেন। মোমিন কনফারেন্সের প্রথম সর্বভারতীয় সভাও অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায়, ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে।

মোমিন কনফারেন্স ছিল বৃহত্তর মুসলমান সম্প্রদায়ের নির্যাতিত ও পশ্চাৎপদ মুসলমান শ্রেণির কণ্ঠস্বর। আদর্শগতভাবে ইসলামে আশরফ-আতরফ বা জাতিভেদের কোনো অবকাশ না থাকলেও ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় মুসলমানদের মধ্যেও জাতিভেদ প্রথা বিরলদৃষ্ট নয়। জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানদের মধ্যেকার বর্ণভেদ প্রথা বিলোপের দাবিতে এরা সোচ্চার ছিল।  রাঈঁ (সব্জি চাষী), মুনসুরি (তুলা শ্রমিক), ইদ্রিশি (দর্জি), কুরাইশি (মাংস বিক্রেতা) -দের মত তথাকথিত ‘নিচু’ জাতের মুসলমান শ্রমজীবী মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল মোমিন কনফারেন্স। রিষড়ার ক্ষেত্র সাহার বাজারে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে হাওড়ার মোইউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে মোমিন কনফারেন্সের এক প্রাদেশিক সভার আয়োজন করা হয়। উক্ত সভায় মৌলানা আলি হোসেন আজিম বিহারী বলেন,– ‘জোলা বা তাঁতিরা উচ্চবর্ণের মুসলমানদের দ্বারা অবহেলিত। ইসলাম এমন জাতিভেদের শিক্ষা দেয় না। তাঁতিদের অবস্থা অনেকটা তফশিলি হিন্দুদের মতো। তিনি আরো বলেন যে যখন উচ্চবর্ণের মুসলমানেরা তাদের অবহেলা করছে তখন মোমিনদের আত্মপ্রতিষ্ঠিত হতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন আধুনিক শিক্ষার।’

মুসলিম লীগের স্বাতন্ত্র্যবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে ছিল এদের অবস্থান। সমন্বয়পন্থী ভাবধারা প্রচারে এদের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন যুক্তপ্রদেশের গোরক্ষপুরে জাহিরউদ্দিনের সভাপতিত্বে মোমিন কনফারেন্সের এক ঐতিহাসিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ইকবাল ও চৌধুরী রহমত আলির দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রচারের বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদানের উদ্দেশ্যে পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করার। এই অধিবেশন থেকে ঘোষণা করা হয়– ‘এ সত্য অনস্বীকার্য যে মোমিন কনফারেন্স পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। এই অধিবেশন যেমন স্বাধীনতা চায়, তেমনি হিন্দু ও মুসলমানের রাজনৈতিক ঐক্য ও যৌথ কর্মপদ্ধতিকে সমর্থন করে। যারা অন্য কোনও অছিলায় এই ঐক্যের বিরোধিতা করে, তাদের অবশ্যই নিন্দা করা উচিত।’

১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশন আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান প্রস্তাব পাস হয়। পরের মাসেই (এপ্রিল,১৯৪০) মোমিন কনফারেন্সের যুব শাখা মোমিন নওজোয়ান কনফারেন্স তাদের পাটনা অধিবেশনে বিস্তারিত কারণ ও যুক্তিসহ দ্বিজাতি তত্ত্বের তীব্র বিরোধিতা করে। এই এপ্রিলেই আব্দুল কায়ুম আনসারির সভাপতিত্বে বিহারের প্রাদেশিক মোমিন কনফারেন্সের অধিবেশনে দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়। সভাপতি আনসারি তাঁর বক্তব্যে বলেন– ‘দেশভাগের পুরো পরিকল্পনাটাই উদ্ভট, অবাস্তব ও ইসলামের প্রকৃত ভাবনা বিরোধী। তিনি বলেন দেশকে যারা টুকরো করে কেটে ফেলতে চায়, তারা বিশ্বাসঘাতক।… তিনি প্রশ্ন করেন আরব বা তুরস্কের মুসলমানদের সঙ্গে ভারতীয় মুসলমানদের সংস্কৃতিগত মিল কোথায়? একই বাঙালি মুসলমানদের সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কোন সংস্কৃতিগত মিল দেখা যায় না। উল্টোদিকে হিন্দু বাঙালির সাথে তাদের সাধারণ সংস্কৃতিগত মিল আছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন জাতি গোষ্ঠীর (Race) বিচারে তারা অনেকটা এক। তারা একই ভাষায় কথা বলে, একই পোশাক ব্যবহার করে, একই ভাবে জীবনযাপন করে ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একই খাদ্য গ্রহণ করে।’ এই সভা থেকে আরও বলা হয়– ‘এটা (পাকিস্তান) এমন সব পুঁজিবাদী মুসলমানদের স্বার্থ সিদ্ধি করবে, যারা মুসলিম জনগণের উপর আধিপত্য করতে চায় এবং যাদের বৃদ্ধি একমাত্র হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষের উপর ভর করে আছে এবং তারা সাম্প্রদায়িকতাবাদের জন্মদাতা।’

মোমিন কনফারেন্সের পরবর্তী অধিবেশনগুলিতে দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধীতা আরও প্রবলতর হয়। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে মোমিন কনফারেন্সের ঐতিহাসিক অধিবেশন হয়। ২০০০ ডেলিগেট মিলিয়ে মোট উপস্থিতির সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫০০০ এর বেশি। সভার সভাপতি জাহিরউদ্দিন ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে মুসলিম লীগের দাবি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি মন্তব্য করেন, মুসলিম লীগ ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে শুধুমাত্র বর্ণবাদী ও সামন্তশ্রেণির মানুষদেরই প্রতিনিধিত্ব করে। ঐতিহাসিক এই সভার ভাষণে পাকিস্তান প্রসঙ্গে তিনি বলেন– ‘আমরা পাকিস্তান প্রকল্পের বিরুদ্ধে। … পাকিস্তানের পরিকল্পনা একটি মরীচিকা, যা আমাদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে। এটা আমাদের মৃত্যু, গণহত্যা ও লুঠপাটের দিকে নিয়ে যাবে। আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে পাঞ্জাবে একজন মুসলমান কৃষকের সাথে হিন্দু কৃষকের মিল একজন বহিরাগতর থেকে বেশি … পাকিস্তানের দাবি তুলে মুসলিম লীগ বাকি ভারতের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে স্থায়ী সম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্বের প্রতি ভীষণভাবে অনিষ্ট সৃষ্টি করেছে।’ এই সভা থেকে তাঁতিদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়েও আওয়াজ তোলা হয়। বস্ত্রবয়ন শিল্পের পুঁজিপতিদের কড়া সমালোচনা করা হয়।

জাহিরুদ্দিন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও প্রকাশ্যে আনেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে যখন শওকতুল্লাহ আনসারির বাড়িতে আজাদ মুসলিম বোর্ডের (আরেকটি জাতীয়তাবাদী মুসলমান সংগঠন। যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আল্লা বক্স সুমরো) সভা বসেছিল,– ‘মি. রাজাগোপালাচারী সেখানে আসেন এবং বোর্ড সদস্যদের মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবিটি মেনে নিতে বলেন। কিন্তু বোর্ড সদস্যগণ তার এই প্রস্তাব মানতে অস্বীকার করেন। তারা ঠিক করেন যে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে যদি কোনো আপোষ মীমাংসা হয়, তবে সেটা তারা সাদরে মেনে নিতে রাজি আছেন, কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে কোনো সমঝোতা তারা মানবেন না। সে ক্ষেত্রে কোটি কোটি মুসলমান যারা মুসলিম লীগকে মানেন না, তাদের প্রতি অন্যায় করা হবে।’

মোমিন কনফারেন্স ছিল বিভাজন-পূর্ব উত্তর ও পূর্ব ভারতের সর্বাপেক্ষা প্রতিনিধিমূলক গণসংগঠনের একটি। কলকাতা, কানপুর, লাহোর, দিল্লি, আম্বালা, গোরক্ষপুর, গয়ার মতো স্থানে অনুষ্ঠিত তাদের সফল বাৎসরিক সভার অধিবেশন থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। বহুকাল যাবত বাংলা ছিল তাঁত-বস্ত্র শিল্পের অন্যতম প্রধান ঘাঁটি। অন্যদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইংল্যান্ডের উৎপন্ন সামগ্রী বিক্রি করে ভারতের বস্ত্র শিল্পকে ধ্বংস করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। তাই বাংলায় মোমিন কনফারেন্স সহজেই প্রসার লাভ করে। অবিভক্ত বাংলায় মোমিনদের তিনটি সংগঠন গড়ে ওঠে– জামাত-উল-মোমিন, জামাত-উল-আনসারি-হিন্দ ও জামাত-উল-আনসার। এই তৃতীয় সংগঠনটি বামপন্থীদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। কাঁকিনাড়া, জগদ্দল, মেটিয়াবুরুজ প্রভৃতি শিল্পাঞ্চলে এই সংগঠনটি বেশ সক্রিয় ছিল। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে মুসলমান শ্রমিকদের সংগঠিত করতে এদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৩৮ সালে এদের সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ১৮০০। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল মুর্শিদাবাদে মোমিনরা বিলেতি বস্ত্র বয়কটের ডাক দিলে ক্রমে এই আন্দোলন মুর্শিদাবাদ, হুগলি, হাওড়া, ২৪ পরগনা ও পাবনার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

যদিও পরবর্তীতে জটিল রাজনৈতিক আবর্তে দেশভাগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। মোমিন কনফারেন্স দেশভাগের সম্মতি দানের জন্য কংগ্রেসের তীব্র নিন্দা করে। দেশভাগের স্বপক্ষে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে পেশ করা প্রস্তাবটিকে মোমিন কনফারেন্স সাম্প্রদায়িক, দেশবিরোধী ও ভারতের পক্ষে ধ্বংসাত্মক বলে বর্ণনা করে।

পরিশেষে বলার কথা একটাই, অন্য সমস্ত সম্প্রদায়ের মতো মুসলমানরাও বহুধা বিভক্ত। মুসলমান মাত্রই স্বাতন্ত্র্যবাদী এই ধারণা মিথ্যা এবং এক রৈখিক। আপনার কাছে তথ্যের অভাব থাকলে তা দুঃখজনক। কিন্তু জানার চেষ্টা না করা আরও বেশি দুঃখজনক। আর, জানার পরেও পুরনো ভাবনাকে আঁকড়ে ধরে রাখা শুধু দুঃখজনক নয়, বিদ্বেষপুষ্টও। আরেকটি প্রশ্নও থেকে যায়, স্বাধীনতার এত বছর পরেও জিন্নার মতো স্বাতন্ত্র্যবাদীরা প্রাসঙ্গিক থাকে অথচ মৌলানা আলি হোসেন আজিম বিহারীর মতো জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের আলোচনায় ঠাঁই হয় না। এও কি তবে শ্রেণিচেতনারই অঙ্গ?

—————

#সহায়ক গ্রন্থ

১) Muslim against partition of India- Shamsul Islam.

২) ভারতের মুক্তি সংগ্রাম ও বাংলার মুসলমান- সৌম্য বসু। ৩) উপমহাদেশের মুসলমান- এম. মনিরুজ্জামান।

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *