পৈতৃক সম্পত্তিতে মুসলিম নারীদের প্রতি বৈষম্যঃ আইন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা

সফি মল্লিক

পৃথিবীতে নথিভুক্ত ব্যক্তিগত জমির ২০% মেয়েদের নামে আছে বলে জাতি সঙ্ঘের একটি সমীক্ষাতে দাবি করা হয়েছিল। অর্থনৈতিক কার্যকলাপে অংশ নেওয়ার সুযোগ বা নিয়ন্ত্রক হওয়া, উচ্চ শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ, স্বাস্থ্য ও গড় আয়ু ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাপ কাঠিতে The World Economic Forum’s Global Gender Gap Report 2018 অনুযায়ী ভারতের অবস্থান ১৪২টি দেশের মধ্যে ১০৮তম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিভাগের আর একটি সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতে ১২.৮% জমি মেয়েদের দখলে আছে। মেয়েদের নামে থাকা আর মেয়েদের নিয়ন্ত্রণে থাকার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ আছে। ভারতে ৮৮% জমির দখল পুরুষের অধিকারে থাকলেও উপরোক্ত জাতিসংঘের রিপোর্ট দেখলেই বোঝা যাবে মানুষের অর্ধেক নারী ও অর্ধেক পুরুষ হিসাবে মূলত বিভক্ত হলেও সম্পত্তির অধিকারে নারীরা এখনও চরম বৈষম্যের শিকার। এই বৈষম্য গোটা পৃথিবী জুড়েই কম বেশি উন্নত, অনুন্নত, উন্নয়নশীল, জাতি, ধর্ম, গোষ্ঠী নির্বিশেষে আছে। মর্গানের তত্ব অনুসারে আদিম সমাজের মাতৃতান্ত্রিক অবস্থা থেকে সম্পদ সঞ্চয় ও উৎপাদনের পরিবর্তনের সাথে সাথে পিতৃতান্ত্রিকতা সমাজে জাঁকিয়ে বসেছে। এঙ্গেলসের মতে এই মাতৃতান্ত্রিকতা থেকে পরিবার, গোষ্ঠী, রাষ্ট্রের বিবর্তনের পর দেখা গেল নারী সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে গেছে।

এই প্রবন্ধে প্রসঙ্গক্রমে বিভিন্ন দেশে কৃষিক্ষেত্রে বা পৈতৃক সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার আলোচনায় আসলেও মূল উদ্দেশ্য থাকবে ভারতে মুসলিম মহিলাদের পৈতৃক সম্পত্তিতে অধিকার নিয়ে। যেহেতু মুসলিম পারিবারিক আইনের কেন্দ্রে ইসলামিক আইডেন্টিটি আছে, তাই মধ্যযুগ থেকে চলে আসা প্রচলিত অন্যায় বা অন্যায্য রীতিকে আধুনিক রাষ্ট্র যেমন এন্ডোর্স করতে পারে না, তেমনি আধুনিক পশ্চিমা দেশের সাম্য বা মানবধিকারের ধারণাকে সরাসরি জোর করে প্রয়োগও করতে পারে না। জোর করে প্রচেষ্টা নিলে সেটা শুধু নৈতিকতারই বিরুদ্ধে যায় না, সেটি আসলে সেইভাবে কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে না। আরোপিত বিদেশি মানদণ্ড সহজে আত্তীকরণ করা যায় না। আরোপিত করার উদ্দেশ্য সৎ হলেও বা স্বল্পকালীন কিছু সাফল্য এলেও, তার ভিত্তি অনেক সময়েই দুর্বল থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মেয়েদের অধিকারের দাবিগুলির প্রতিবন্ধকতাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার শ্রেষ্ঠ পন্থা হিসাবে দেখানো উচিত যে বর্তমানের মুসলিম সমাজের জন্য পুরানো নিয়ম নীতি প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে। যদি কোনও আইন প্রসঙ্গিতা হারায় সেগুলি তুলে দেওয়া দরকার, এই মানসিকতা ও দাবি মুসলিম সমাজের ভিতর থেকেই উঠিয়ে আনা যেতে পারে। যেমন এক পত্নীর উপস্থিতিতে একাধিক বিবাহের ছারপত্র দেওয়ার আর কোনও প্রয়োজন নেই। ইসলাম বহু বিবাহতে উৎসাহ দেয় না বললেই মুসলিমদের দায়িত্ব শেষ হয় না, এখন আইন করেই সেটা নিষিদ্ধ করতে কোনও দ্বিধা থাকার কথা নয়। ইসলামি সমাজের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বৈষম্যমূলক উত্তরাধিকার আইন এবং অনুশীলনগুলি বর্জন করার সম্ভাবনাটি অন্বেষণ সব থেকে বেশি এফেক্টিভ হতে পারে, সেখানে রাষ্ট্র পুরোপুরি সহায়ক হিসাবে ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রতিটি দেশে পৈতৃক সম্পত্তিতে মেয়েদের উত্তরাধিকার প্রশ্নে সমবন্টনের প্রশ্ন উঠলে জাতি ধর্ম ভাষা নির্বিশেষে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ঐতিহ্য, সনাতন মূল্যবোধ, এবং সর্বোপরি ধর্ম। এই প্রতিটি বিষয়কে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে আজকের অর্থনীতি ও রাজনীতি। তাই, সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্ন শুধু ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক নয়, সেটি একটি রাজনৈতিক প্রশ্নও বটে। আধুনিক মানবধিকার, নারী স্বাধীনতা, সাম্য, লিঙ্গ বৈষম্য বিষয়গুলি নিয়ে বিংশ শতাব্দীর রাজনীতি ও নারীবাদ উত্তাল ছিল, তাই পরের দুটি অনুচ্ছেদের প্রথমে বিশ্বজুড়ে রাজনীতির উথাল পাথালের মধ্যে লিঙ্গ সাম্যর বিষয়গুলির পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছিল সেই নিয়ে আলোচনা করবো, তারপর নারীবাদী ধারার ঢেউ নিয়ে আলোচনা করবো। মুসলিম মহিলাদের পৈতৃক সম্পত্তিতে অধিকার নিয়ে আলোচনায় মেয়েদের প্রতি বৈষম্যের কথা তুললেই মৌলবাদী একটি শিবির থেকে প্রথমেই মেয়েদের প্রতি বৈষম্যকে সরাসরি অস্বীকার করা হয়। এই বৈষম্যের অস্তিত্ব অস্বীকার করার প্রবণতাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন না থাকলেও ঐতিহাসিক বাস্তবিকতা হিসাবে ইসলামিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার বণ্টন নিয়ে আলোচনা করবো, তারপর বৈষম্য অস্বীকারের প্রবণতা নিয়ে আলোচনা করে নেব। সব শেষে বৈষম্য দূরীকরণের সম্ভাব্য পদ্ধতি নিয়ে।

সম্পত্তির অধিকার নিয়ে রাজনীতি :

বিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধকে যদি মুক্তির যুগ ধরা হয়, যে সময়ে সোভিয়েত রাশিয়ার জন্ম হয়েছে, তার সাথে পৃথিবীর নানা প্রান্তে উপনিবেশের পতন ও আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে, দ্বিতীয় অর্ধে ফ্যাসিবাদের পতন ও পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্য শুরু করেছে, সবেমাত্র স্বাধীন হওয়া দেশগুলি নতুন আশা ও নিরাশার দোলাচলে এগিয়েছে। আগের অনুচ্ছেদেই উল্লেখ করেছি সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্ন শুধুই ধর্মীয় বা অর্থনৈতিক নয় তা আসলে বিপুল ভাবে রাজনৈতিকও এবং সেই রাজনৈতিক ক্ষমতা হাতে আসার পর আধুনিকতা যদি সমাজে আরোপ করা হয় তার প্রভাব বুঝতে সোভিয়েতের অভিজ্ঞতা অবশ্য পাঠ্য। সোভিয়েতের পতনে এই ধরণের আরোপের কোনও ভূমিকা আছে কিনা সেটা এই প্রবন্ধে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু সোভিয়েতের পত্তন নারী মুক্তির আন্দোলনের ইতিহাসে নব নব দিগন্ত খুলে দেয় এবং নতুন নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়। তাই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কী ধরণের কাজ ও আইডিয়া জনপ্রিয় করার চেষ্টা করা হয়েছিল সেটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রথম অর্ধ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় অর্ধে গিয়ে পুঁজিবাদী দেশগুলিতে ধীরে ধীরে মেয়েদের ভোটাধিকার অর্জিত হয়েছে, সোভিয়েত রাশিয়াতে বিপ্লবের পরেই শুধু ভোটাধিকার নয় অর্জিত হয়েছে গৃহশ্রম থেকে মুক্তির পথ। গৃহশ্রমকে মহান করার যে অপপ্রয়াস আজকাল নজরে আসে, সেই সময় ঠিক তার বিপরীত অবস্থান নিয়ে একঘেয়ে, সৃষ্টিশীলতার লেশমাত্র নেই যে গৃহশ্রম, তাকে সামাজিক শ্রমের অধীনে আনার প্রয়াস শুরু হয়েছে। যৌথ রান্নাঘর, শিশুপালনে রাষ্ট্রের ভূমিকা, মহিলাদের মা সর্বস্ব জীবনের ইতি, কলে-কারখানায় ক্রেশ চালু হল, সন্তানকে অবৈধ হিসেবে গণ্য করা নিষিদ্ধ হল। গর্ভপাত আইনসিদ্ধ হল। অবিবাহিত মা-দের সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্বু বিবাহিত মা-দের মতোই রাষ্ট্রের বলে ঘোষিত হল। ডিভোর্সের জন্য পুরুষের আর মহিলাদের পারস্পরিক সহমতকেই প্রধান বলে গণ্য করা হল। এবং সর্বোপরি বিবাহ পরবর্তী সম্পত্তিকে যৌথ সপত্তি বলে ঘোষণা করা হল। বিপ্লবের পরেই এক মাসের মধ্যেই মেয়েদের মুক্তির জন্য যে সমস্ত আইন প্রণয়ন করা হল বা ডিক্রী জারী করা হল (প্রথমটি ডিসেম্বর ১৯, ১৯১৭), তাতে বলা হল যে এখন থেকে মেয়েরা সামাজিক-আর্থিক-রাজনৈতিকভাবে সমানাধিকার পেলো এবং সেই অনুযায়ী বেশ কয়েকটি মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হল। আর্থিক-রাজনৈতিক দিকগুলি নিয়ে এখানে আলোচনা করছি না। আমার লেখার প্রয়োজনে মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার। আজ ভারতে বা বিশ্বজুড়ে সম্পত্তির অধিকারের জন্য মেয়েদের লড়াইয়ের জন্য প্রাথমিকভাবে জরুরী, মেয়েরা ধর্মের নাগপাশে যেভাবে আবদ্ধ তা থেকে তাদের ছিন্ন করা, সেই কাজটাই করেছিল এই ডিক্রীগুলি। প্রথমেই ধর্মীয় বিবাহকে নিষিদ্ধ করা হল। একমাত্র আইনসিদ্ধ হল রেজিস্ট্রী বিবাহ, বা সিভিল বিবাহ। এর সাথে কেউ যদি ধর্মীয় বিবাহ করতে চায় তা তার ব্যক্তিগত ইচ্ছে অনিচ্ছে হিসেবে বিবেচিত হল। ফলে বিবাহকে স্বর্গের ঠিক করা একটি বিষয় থেকে এক ধাক্কায় মাটিতে নামিয়ে আনা হল। যা আজও আমরা ভাবতে পারি না, আর ১০২ বছর আগে, যে দেশে ধর্ম-গ্রামীণ জনতারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, সত্যিই অভূতপূর্ব। প্রসঙ্গত মনে রাখতে হবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুক্ত ছিল এশিয় মুসলিম অধ্যুষিত বিরাট অঞ্চল। বিবাহ আর পরিবার, এই দুই ভাবনাকে বিচ্ছিন্ন করা হল। বলা হল, বিয়ের সাথে পরিবারের কোনও সম্পর্ক নেই। বিয়ে দুটি ব্যক্তির মধ্যেকার স্বেচ্ছাকৃত যৌন ঐক্য আর পরিবার হল জন্মের সঙ্গে যুক্ত। ফলে অবিবাহিত সন্তানও বৈধ সন্তানই। আর যেহেতু বাবা মায়ের সম্পত্তি সন্তানেরা পাবে না, বা বিপরীতটাও সত্যি, ফলে মেয়েদের বিবাহ সম্পর্কে ধর্মীয় সম্ভ্রম ছিন্ন হল। বিবাহ আর ধর্ম যে মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন হল, অমনি স্বামী-সংসার-সন্তান সম্পর্কে তার ধর্মীয় সম্ভ্রম-ভয় কেটে গেল। এবার মেয়েরা এই তিনটিকেই মানবিক দৃষ্টিতে দেখতে শিখলো। মানুষ মানেই ভুল ভ্রান্তি থাকেই, সোভিয়েতের কোথায় কি ভুল ছিল সেটা যেহেতু আলোচ্য নয় তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে আরোপ করার ফলে কী হয়েছিল তার থেকে কী কী নতুন ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল সেটাই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সোভিয়েত প্রতিষ্ঠার একদম প্রাথমিক কার্যকলাপের কিছু ভুল ভ্রান্তি থেকে শিখে এবং যুদ্ধের বিশেষ পরিস্থিতিতে কিছু পরিবর্তন আনা হল আইনে, কিন্তু মূল বিষয়টা হল ধর্মের সঙ্গে মেয়েদের নাড়ির টান ছিন্ন হল। পরবর্তীতে যে স্বপ্ন দেখেছিল ও যা প্রাপ্তি হয়েছিল তার মধ্যে গ্যাপ ছিল কিনা, ধর্মের সঙ্গে মেয়েদের নাড়ির যে টান বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল সেখানে কোনও শূন্যস্থান তৈরি হয়েছিল কিনা, যদি শূন্যস্থান তৈরি হয়ে থাকে সেখানেও পরবর্তীতে একধরণের পরিচিতি স্বত্বার বিকাশ হয়েছিল সেটি পুরুষ ও মহিলাদের ক্ষেত্রে একই পরিমানে হয়েছিল কিনা তার উত্তর আমাদের হাতে নেই। সেই সব অভিজ্ঞতাগুলি আজকে সম্পত্তির অধিকারের জন্য মুসলিম (অন্য ধর্মের মেয়েদের ক্ষেত্রেও তাই) মেয়েদের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া মেয়েদের বিবাহের বয়স ন্যূনতম ১৮ করা হয়েছিল, যার মধ্য দিয়ে মেয়েটির বিবাহ পরবর্তী জীবনের আগেই একটি দীর্ঘ সময় কাটানোর সুযোগ পেল, এবং তার স্বাদ নিতে পারলো। এই বিবাহ বয়স আইন করে বাড়ানোর সরাসরি প্রভাব মেয়েদের সঙ্গে তার বাবা মায়ের সম্পর্কেও নতুন প্রভাব ফেলতে শুরু করে। বাল্য বিবাহের ফলে মেয়েদের সঙ্গে বাবা মায়ের বন্ধনের গভীরতা হয়তো কম থাকতো। অনেক ছোট বয়সেই বিবাহ করে অন্যের বাড়িতে চলে যাওয়ার ফলে পৈতৃক বাড়িতে “আমার” বলে অধিকারবোধ সেইভাবে জন্ম নেওয়ার সুযোগ কম পেত। মৌলিক অধিকারের ১১ নং ধারা অনুযায়ী মেয়েটি বিবাহের পর পদবী পরিবর্তন করতে আর বাধ্য থাকতো না। একই ধারা অনুযায়ী মেয়েটি বিবাহের পরে স্বামীর সঙ্গে থাকতে বাধ্য নয়, স্বামীর বাড়িতে থাকতেও বাধ্য নয়। ঠিক এই কারণে সমাজতান্ত্রিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হতো যে তাঁরা পরিবারের ধারণার বিরুদ্ধে।

এবার আসা যাক সম্পত্তির অধিকারে। বিবাহের পর স্বামীর যা সম্পত্তি তার যৌথ মালিকানা স্ত্রীরও হয়ে যাওয়ার কথা। এবং যদি ডিভোর্স হয় তবে তার অর্ধেক স্ত্রী পাবে। স্ত্রী এক পয়সা রোজগার না করলেও। যদি এই নিয়ে কোনো মীমাংসার সমস্যা হয় তবে গৃহশ্রমের ঘন্টা দেখে তার পাওয়া মিটিয়ে দেওয়ার বিধি। আবার ডিভোর্স হওয়ার পর পরস্পরের দেখভালের দায়িত্ব বহাল থাকবে, যদি কেউ একজন কাজ না করতে পারে কোনো কারণে তবে অন্য জনকে তাকে দেখতে হবে। যেক্ষেত্রে স্ত্রী চাকরি করছেন অথচ স্বামী করছেন না, সেক্ষেত্রে স্ত্রীকেই স্বামীর দায়িত্ব নিতে হবে। বোঝাই যাচ্ছে বিবাহের অর্থ আর এরকম দাঁড়ালো না যে স্বামী স্ত্রী-এর ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব নিচ্ছেন। এই যে বহন করার ধারণা ধর্মীয় সনাতন জ্ঞানে চলে আসছে, স্ত্রী-র ভাত কাপড় স্বামী যোগাবেন আর তার বদলে স্বামী ও স্বামীর বাবা-মা-আত্মীয়-দের সেবা ও স্বামীর যৌনক্ষিধে (এ ক্ষেত্রে স্বামী যে একগামী হবেন তার কোনো নিশ্চয়তা ধর্ম দেয় না, তাই দেহব্যবসায় ধর্মের বাধা নেই) মেটাবে, আর সন্তান ধারণ করবেন, এই অলিখিত (অলিখিত হওয়ার ফলে, ঐ ভাত কাপড় কীরকম-কতটা যোগানো হবে তা স্থির করবে যে পাচ্ছে সে নয়, যে দিচ্ছে সে) চুক্তিকে ধুলিস্যাত করা হল। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে থাকা মধ্য এশিয়াতে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত ধর্মীয় স্বাধীনতা, এমনকি শরিয়ত পর্যন্ত অনুমোদনযোগ্য ছিল। কিন্তু কম্যুনিস্টদের বা কেন্দ্রীয় সরকারী দলের প্রচার করার সুযোগ, শরিয়তের বিরুদ্ধে, বোরখার বিরুদ্ধে প্রচার করার সুযোগকে যখন আঞ্চলিক অ-সোভিয়েত সরকার নস্যাত করছিল, বিদেশি শক্তিগুলির সাথে মিলে কেন্দ্রীয় সরকারকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা শুরু করলো, তখনই সোভিয়েত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ঝাঁপালো। যদিও তা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত ধর্মাচরণের অধিকার ছিলই । কিন্তু মেয়েদের দ্বিতীয় শ্রেণি নাগরিক করে রাখা নিষিদ্ধ হল। এবং ১৯৩০ সালের মধ্যেই মুসলিম মেয়েরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুরুষের থেকেও এগিয়ে গিয়েছিল। মাথায় রাখতে হবে এই সবের অনেকটাই আরোপিত ছিল। বর্তমান সময়ে আমরা যখন বিষয়গুলি নিয়ে নতুন করে ভাববো তখন অবশ্যই কতটা আরোপ করা যায় আর কতটা অভ্যন্তরীন বিকাশের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেগুলি নিয়ে সোভিয়েতের পরীক্ষাগুলো পথ দেখাতে পারে নতুন পথের নির্মাণ করতে। এই সমস্ত বৈপ্লবিক পদক্ষেপের প্রভাব ছিল বিশ্বজোড়া, এবং সার্বিক লড়াইয়ের কিছু সুফল পরবর্তী অর্ধ শতাব্দীতে এলেও অর্ধেক মানব সভ্যতা নারীর জন্য সেইভাবে কাঙ্খিত ফল আসেনি। আকাঙ্খা ও প্রাপ্তির মধ্যে যে দুরত্ব তৈরি হয়েছিল তাই নিয়ে এই সময়েই সমান্তরালে চলেছে নারীবাদী চিন্তা ও তার ভিন্ন ভিন্ন ঢেউ। এই নারীবাদী ঢেউ এর মৌলিক বিষয়টা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পরের প্রবন্ধে। এই দ্বিতীয় অর্ধেই নারীর অধিকার নিয়ে বিপুল বিতর্কে গোটা পৃথিবী জুড়েই নারীর ক্ষমতায়নের প্রধান অস্ত্র হিসাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সম্পত্তির উপর নারীর অধিকারের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। বিংশ শতাব্দীর শেষ ও একবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই আন্তর্জাতিক আইন ও অধিকার সংস্থাগুলো তাই বৈষম্য মূলক আইনগুলি দূর করে রাষ্ট্রব্যবস্থায় আধুনিকীকরণের সুপারিশ করছে। আধুনিক সভ্যতার মাপকাঠি হিসাবে উপরের লিঙ্গবৈষম্য কোন দেশ কতটা কমিয়ে আনতে পেরেছে সেটি বিচার করা হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে যে বিতর্কগুলি দেশে দেশে হয়েছে সেখানেও অস্থাবর সম্পত্তির বণ্টনের থেকে বিতর্ক প্রধানত জটিল হয়েছে স্থাবর সম্পত্তির বিষয়টি। মুসলিম পরিবারে বোনের ১ ভাগ ও ভাইয়ের ২ ভাগ রীতিতে বোনের কিছুটা অধিকার স্বীকৃত হলেও বিবাহিত বোনেদের মধ্যে ভাইয়ের কাছ থেকে জমির সেই প্রাপ্য ন্যায্য ভাগটি বুঝে নিতে দেখা যায় না যতক্ষণ না জমিটির বিক্রি করা হচ্ছে। বাবার রেখে যাওয়া স্থাবর সম্পত্তি হিসাবে জমি ভাইয়েরা যখন বিক্রি করতে উদ্যত হন, তখন অনেক মেয়েরা নগদ অর্থের ব্যাপারটা কিছুটা বুঝে নিতে আসেন। এই ধরনের পরিস্থিতি সিঙ্গুর আন্দোলনে বেশ কিছু পরিবারের ভাইদের অতি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল। প্রসঙ্গক্রমে ব্যাপারটা এখানে বলে রাখি। এমনও উদাহরণ আছে যে জমি ৩ একর, আর ভাই বোন বিধবা মা মিলে সংখ্যা ১১। ৬ বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, ৪ ভাই আর মা একসঙ্গে থাকেন। বছরে একবার বা দুইবার বোনের কাছে চাল-আলু-ফল যায়। কিন্তু জমির উপর কোনো অধিকার তাঁদের বোনেরা চান না। কিন্তু জমি বিক্রী হলে নগদ টাকা যখন ভাগ হবে তখন বোনেরা তা ছাড়বে না। তাই ভাইরা সেই জমি বিক্রির থেকে ধরে রাখার জন্য আন্দোলনে নামলেন। এটাই স্বাভাবিক, এই ব্যাপারগুলি বোঝেনি তৎকালীন সরকার। এইভাবে সম্পত্তির অধিকারের বিষয়গুলি কতটা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সেগুলি খুব স্পষ্টভাবে দেখতে সাহায্য করে।

লিঙ্গ প্রভেদ নিয়ে নারীবাদী ধারনা ও কিছু মৌলিক ভ্রান্তি :

ফেমিনিজম বা নারীবাদী আন্দোলনের প্রাথমিক দাবিই ছিল রাজনৈতিক–ভোটাধিকারের স্লোগান। মেরি উলস্টোনক্র্যাফটরা সেই ১৭৯২ সালেই বুঝেছিলেন যে ভোটাধিকার ছাড়া অন্যান্য অধিকারগুলি অর্জন করাই অসম্ভব। তিনি বলেছেন, মহিলাদের প্রত্যক্ষভাবে নিজেদের পরিচালনা করতে হবে, সরকারে সরাসরি প্রতিনিধি পাঠিয়ে। আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোটির এটুকু দাবি গ্রহণ করতে সময় লেগেছিল ১৩০ বছর! মহিলাদের ভোটাধিকারের দাবিটিকে উত্থাপিতই হয়েছে মেরি উলস্টোন্‌ক্র্যাফটের ৭৫ বছর পর। জন স্টুয়ার্ট মিল ১৮৬৭ সালে প্রথম এই দাবি তুললেন বৃটিশ সংসদে, ৭৩:১৯৬ ভোটে সেই প্রস্তাব পরাজিত হল। কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিক বলছে, পুরুষ ও নারীর সমানাধিকার আইনের চোখে ও সমাজ জীবনেও– বৈবাহিক জীবনের পারস্পরিক অধিকারে ও পারিবারিক নিয়মশৃংখলায় বৈপ্লবিক রূপান্তর, মাতৃত্ব ও সন্তান প্রতিপালনকে সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে স্বীকার করায়। কমিন্টার্ণ খুবই নির্দিষ্টভাবে ১৯২৪ সালে বলেছে, ‘বিপ্লব অকার্যকারী থাকবে ততক্ষণ যতক্ষণ সমাজে পরিবার ও পরিবার সংক্রান্ত ধ্যাণ ধারণাগুলি টিকে থাকবে।’ কিন্তু ১৯৪৯এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী নারী মুক্তি আন্দোলন পেল সিম্যোন দ্য বোভোয়াকে। এটাই সম্ভবত মহিলা আন্দোলনের বিরাজনীতিকরণের শুরু। অনেক সত্যি কথাই তিনি লিখলেন, সাম্যবাদের গুরুত্বের কথা স্বীকারও করেছেন তবুও কার্যত রাজনীতির প্রসঙ্গটিকে খাটো করে ফেলেছেন। বামপন্থী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত নারী আন্দোলনটি একটি অন্য ধারার স্বাদ পেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, নারীর নির্যাতনে যুদ্ধের ভূমিকা নিয়ে তাঁকে একটি শব্দও খরচ করতে দেখা যায়নি। বরং যুদ্ধে সরকারের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্যই, বা আন্দোলনকে কিছুদিনের জন্য স্তিমিত রাখার জন্যই সরকার আন্দোলনকারীদের ভোটাধিকার দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল, এই মত ব্যক্ত করলেন বোভোয়া। অথচ বাস্তব হল উগ্রজাতীয়তাবাদের এই বিস্তারের ফলেই, আন্তর্জাতিক ভগিনিত্বকে ধ্বংস করে ও নারী আন্দোলনের মেরুদণ্ডকে ভেঙে দেওয়া গিয়েছিল। যে রাশিয়ার প্রায় আড়াই কোটি পুরুষ যার বেশিরভাগই যুবক, যুদ্ধে নিহত হল সেই দেশের মেয়েদের স্বাধীনতা কিভাবে রক্ষিত হবে, সমাজের ভারসাম্য রক্ষা হবে কীভাবে ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক পরিবেশেরই বা কী হবে সে বিষয় তার অনুসন্ধিৎসু মন কোনও প্রশ্ন তোলেনি! যদিও এই দ্বিতীয় যুগ পুঁজিবাদের উচ্ছেদ ও সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ ছাড়া নারী মুক্তি সম্ভব নয়, তা একবাক্যে স্বীকার করেছে কিন্তু তা সত্ত্বেও এই ঘরানার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল অন্য কথাও। এই যুগেরই এক গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী জুলিয়েট মিশেল, প্রথম দফার নারী আন্দোলনের যে দাবী অর্থাৎ ভোটাধিকার, তাকে বিদ্রুপ করলেন। বললেন, ভোটাধিকারপন্থীরা নিজেদের সংকীর্ণ গন্ডী ছেড়ে বেরোতেই পারেননি, ফলে ভোটাধিকার পেয়েও মহিলাদের অবস্থার বিন্দুমাত্র কোনো উন্নতি হয়নি। মেরি উলস্টোন্‌ক্র্যাফদের যা মানাত তা আর বোভোয়া বা মিশেলদের মানায় না। পুঁজিবাদী ঘেরাটোপের মধ্যেই ভোটাধিকার দাবী করেছিলেন তারা। কিন্তু যেদিন তা অর্জিত হল, তখন ভোটাধিকারে আর মুক্তি খুঁজে লাভ ছিল না। তা আঞ্চলিক ক্ষমতাভিত্তিক কাঠামোর দাবি, আমলাতন্ত্র খারিজের দাবিতে পর্যবসিত হয়েছিল। তা সচক্ষে দেখেছেন পরবর্তী নেত্রীরা। তাই ভোটাধিকার পেয়েও মেয়েরা কেন মুক্ত হল না এই বলে আক্ষেপ না করে ভোটাধিকারের আরও বিস্তার, অর্থাৎ পঞ্চায়েতের হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতার দাবিটি কেন তারা তুললেন না? অ্যানি কোয়েট নামক আরেক নেত্রী বললেন, যা ব্যক্তিগত তাই রাজনৈতিক। এই আওয়াজ যে বাস্তবতাকেই স্বীকৃতি দিক না কেন কার্যত মহিলাদের বিশুদ্ধ রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের আওয়াজটিকে লঘু করেছে। যা কিছু ব্যক্তিগত তার মধ্যে পুরুষতন্ত্রের মতাদর্শ খুবই শক্তিশালী নিসন্দেহেই। কিন্তু বলা হল না যে ব্যক্তিগত এই সব মূল্যবোধকে তাড়নোর জন্য চাই মহিলার রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন; রাষ্ট্র ক্ষমতার ভাগীদারী। রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রবক্তাদের ‘সেকেলে’ হিসেবে গণ্য করে, মতাদর্শগত সংগ্রামকে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে বার করে আনা হয়েছে, সেই ১৯৬০-এর দশক থেকেই। যেহেতু নারী আন্দোলন বামপন্থী আন্দোলনের পাশে পাশেই, অনেক ক্ষেত্রে ভিতর থেকেই জন্ম নিয়েছে তাই ভেতরের দুর্বলতাগুলি নারীবাদীদের চোখে পড়েছে জ্বলন্তভাবে এবং বিরক্তির উদ্রেকও ঘটিয়েছে। নেত্রী গ্রীয়ার বললেন, কাজের ক্ষেত্রে যাওয়াটা মহিলাদের ক্ষেত্রে মুক্তি আনে না কারণ সেখানেও পুরুষতন্ত্রের আগ্রাসন থাকে, সেখানেও পুরুষের মর্জি মতো চলতে হয় মেয়েদের। অর্থাৎ ওনার কথা মতো, আগে পুরুষতন্ত্রের মতাদর্শকে ধ্বংস করতে হবে, তার পর আর্থিক, রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য মহিলারা প্রাণপাত করবেন, যা আবার অসম্ভব। আরেক বিখ্যাত নেত্রী বেটি ফ্রিডমান সংসার-সন্তানে মগ্ন অসহায় মহিলাদের কটাক্ষ করে বললেন, যে তারা আরামদায়ক কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পে আছেন। রোকেয়া অবশ্য আগেই বলেছিলেন, মেয়েরা গৃহপালিত জীব হয়ে থাকতেই ভালবাসে। কেট মিলেট যিনি আবার বেটির উপরোক্ত অসহিষ্ণুতার বিরোধী ছিলেন, বললেন, “আর্থ-সামাজিক কাঠামোটির সাথে যুক্ত হলেও লিঙ্গ রাজনীতি প্রাথমিকভাবে একটি মতাদর্শ। পুরুষতন্ত্র নিজেই যেহেতু একটি রাজনৈতিক কাঠামো, বলা ভালো আদিমতম রাজনৈতিক কাঠামো, তাই এর ধ্বংস সাধন ছাড়া অন্যান্য শোষণ, তা আর্থিক, রাজনৈতিক বা জাতিভিত্তিক যাই হোক্‌, ধ্বংস করা অসম্ভব। পুরুষতান্ত্রিক অবদমন মুখ্যত চলে মতাদর্শগতভাবে”। অথচ ভারতের দলিত নেতারা দলিত সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে যে রাজনৈতিকভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে আঘাত করতে না পারলে যে ব্রাহ্মণ্যবাদের মতাদর্শকে বিলুপ্ত করা যাবে না। আর তাই দলিত আন্দোলন অনেকে এগোলেও নারী আন্দোলন আজও পিছিয়ে। দলিত ঘরের মেয়েরা, মুসলিম মেয়েরা, হিন্দু মেয়েরা আন্দোলোনগুলির ফসল ঘরে তুলতে পারলো না। নেত্রী ভার্জনিয়া উলফ্‌ প্রশ্ন তুললেন, যেহেতু নারী ও পুরুষের চাহিদা ভিন্ন তাই আইন প্রণয়ন নাকি সেই ভিন্নতাকে অগ্রাহ্য করে। নারী মুক্তিকামীদের সম্মেলনগুলি সমকাজে সমবেতন, বাচ্চাদের জন্য ক্রেশ এবং গর্ভপাতের অধিকারের আওয়াজ তুলল, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য কোন্‌ দাবি প্রয়োজন সে ব্যাপারে কিছু নির্দিষ্ট করতে পারল না। ৫০-৬০ দশকে যে মার্কিন সরকার ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াতে মহিলাদের ধর্ষণ ও হত্যা করছে, যাদের যুদ্ধনীতি বিশ্বজুড়ে মহিলা নিপীড়নের অন্যতম কারণ হচ্ছে– তার কাছে পোষা বিড়ালের মতো জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়নের জন্য চাপ দিলেন! এভাবেই নারী আন্দোলনে ভোটাধিকারপন্থীদের প্রথম ঢেউ যখন দ্বিতীয় ঢেউ-এর জন্ম দিল তা মহিলাদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রশ্নকে প্রাথমিক গুরুত্ব দিতে অস্বীকার করলেন। দ্বিতীয় যুগের শক্তিশালী প্রতিনিধি জুলিয়েট মিশেল ফ্রয়েডীয় ধারাকে বিরোধিতা করলেও যা বললেন তা হল বহুত্ববাদ। বললেন, চারটি বিষয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক একেক যুগে সেই মতো পুরুষতন্ত্রের হাতিয়ার হয়েছে। সামাজিক উৎপাদন, সন্তান উৎপাদন, যৌনতা ও সন্তান ধারণ, এই চারটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন ছাড়া নারী মুক্তি অসম্ভব। একথা সত্য, কিন্তু উপরুক্ত চারটি বিষয়ের পরিবর্তনের আগে যে রাজনৈতিক পরিবর্তনটি প্রয়োজন তা বলা হল না। যা না ঘটলে সমাজের যে ভিত, সেই অর্থনীতিও বদলায় না, বদলায় না মতাদর্শও। আবার উপরোক্ত চারটির মধ্যে ‘সামাজিক উৎপাদন’ বা অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেও ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। বিপরীতে তিনি বলছেন, উপরোক্ত চারটির মধ্যে সামাজিক উৎপাদনে অংশগ্রহণ, প্রজনন ও সন্তান প্রতিপালনে সামাজিকীকরণ, এই তিনটিই মোটামুটি একটি ধাপে উন্নীত হয়েছে, কিন্তু যৌনতার ক্ষেত্রটি এখনও অধরা, ওটিই পুরুষতন্ত্রের দুর্বলতম গ্রন্থি হয়ে আছে। অতএব ওখানেই কুঠারাঘাত করতে হবে। অথচ ভারতের মত দেশের কথা বাদও যদি দেওয়া হয়, খোদ পশ্চিমী দুনিয়াতেও বাকী তিনটির মোটামুটি সমাধান হয়ে গেছে– অবস্থাটা তাও তো নয়! তাছাড়া দুনিয়ার নিয়মেই এগোতে না পারলে যেটুকু অর্জিত হয়, তাও যে আর থাকে না–এটাও কি তিনি বুঝলেন না? এভাবেই দ্বিতীয় দফার আন্দোলন হয়ে পড়ল এক বহুত্ববাদী ধারা, কোন্‌ কাজকে প্রাধান্য দেওয়া হবে তা নিয়ে বিভ্রান্তি জন্ম নিল। এহেন প্রতিপক্ষকে সামনে পেয়ে পুঁজিবাদের ধারক বাহকরা আহ্লাদিত হলেন নিঃসন্দেহেই। নারী আন্দোলনের মধ্য থেকেই এবার এসেনশিয়ালিস্ট নাম নিয়ে উঠে এল এমন এক মতাদর্শ যা শারীরিক পার্থক্য দেখিয়ে যাবতীয় লিংগ বৈষম্যকে বৈধতা দান করতে চায়। উঠে এল তৃতীয় ঢেউ। বহুত্ববাদের প্রভাবে তৃতীয় ঢেউ আরও প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠা করল। ফলে তৃতীয় ঢেউ অস্বীকার করতে শুরু করল যে পুরুষের অধীনেই মহিলারা এখনও আছে। মহিলাদের ‘সমান্তরাল ও পৃথক অস্তিত্বের’ তত্ত্বকে তারা সামনে নিয়ে এলেন। অর্থাৎ মেয়েরা মেয়েদের মতো আছে, পুরুষ পুরুষের মতো। কেউ এগিয়ে বা পিছিয়ে নেই। এই তত্ত্ব ভারতীয়দের কাছে নতুন নয়। রাজার পোষা পুরোহিতরা এভাবেই গরীব মানুষকে বুঝিয়ে এসেছে, ত্যাগই তাদের ধর্ম, আবার ভোগই ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের ধর্ম। এর মধ্যে কোনও উঁচু বা নীচু নেই, শোষণ বা অত্যাচার নেই। সবই সমান্তরাল! ফ্রয়েডীয় রাস্তায় শুরু হল সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্মভাবে পুরুষতন্ত্রের উৎস খোঁজার প্রক্রিয়া। যৌন প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলিকে নিয়ে যেমন অত্যধিক নাড়াঘাটা শুরু হল তেমনই যা যা সামাজিক হিসেবে স্বীকৃত তার সমস্ত কিছুকেই অযৌক্তিকভাবে বাতিল করা হল। এর নেত্রীরা প্রগতীর বিপরীতে গিয়ে বলতে শুরু করলেন, যে সমানাধিকারের দাবীটিই নাকি পুরুষতান্ত্রিক! পুরুষকে নকল করার প্রচেষ্টাই নাকি পুরুষতান্ত্রিকতার ফল! অথচ যুগে যুগে এগিয়ে থাকা অংশকে নকল করতে চেয়ে, এবং বাধাপ্রাপ্ত হয়েই পিছনের সারিরা এগিয়েছে। যেমন সামন্তপ্রভুদের ও মালিকদের অখণ্ড অবসরকে নকল করতে চেয়ে ৮ ঘন্টা কাজ ও ৮ ঘন্টা অবসরের দাবী; শুধু সম্ভ্রান্ত মানুষই নয় সবার জন্যই ধর্মীয় শিক্ষার চাহিদা; রাজাদের কেনা থিয়েটারে দাঁড়িয়ে রাজাদেরই পছন্দ করা গল্প নিয়ে সর্বসাধারণের জন্য তা পরিবেশন করার জন্য শেক্সপিয়রের চাহিদা; রাশিয়ার অনুকরণে ভারতের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা; রাশিয়ার অনুকরণে পশ্চিমী ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে জনকল্যাণমুলক সরকারের প্রতিষ্ঠা; রাশিয়ার অনুকরণে ১৯২৮ এ এসে ইংল্যন্ডে মহিলাদের ভোটাধিকার প্রদান; সবই নকল করা ছাড়া আর কি? অর্থাৎ গায়ত্রী স্পিভাকরা ভারতবর্ষ ছেড়ে আমেরিকাতে বসবাস করবেন আর প্রাচ্যের মহিলারা যদি মার্কিন মুলুকের সুবিধাটুকু নকল করতে চান তবে নাকি তা হবে অন্যায়! যদিও বাস্তবে সাম্রাজ্যবাদের চাহিদা অনুযায়ী বড়লোকী মতাদর্শের এক সাংঘাতিক নকলনবিশি শুরু হল শিক্ষিত মহিলা মহলে। অনেকটা সেই দলিতদের মতো যারা ভারতের কেন্দ্র সরকারের আধা-পঙ্গু ও সীমিত সংরক্ষণের নীতির সুবিধা নিয়ে অতঃপর ব্রাহ্মণদের মতোই কায়িক শ্রম করতে বিরক্ত হন! একই রকম ভাবে দেখা গেল নারীবাদীরা বলছেন পুরুষরা যদি বহুগামী হতে পারেন তবে নারীরা কেন তা হবে না! এঙ্গেলসও নাকি সেই রকম উপদেশ দিয়েছিলেন মহিলাদের! এভাবে রাজনীতি থেকে ক্রমে সরে এসে নেত্রীরা নিজেরাই আজ স্বীকার করছেন নারী আন্দোলন এক চূড়ান্ত পশ্চাদপসরণের ঢেউয়ে আবদ্ধ হয়েছে। একসময়ের ডাকসাইটে নেত্রী সুশান ফালুডি আজ ‘পশ্চাদপসরণ’ নামক একটি বই লিখে ফেলেছেন। নারীবাদ সত্ত্বেও আজ মহিলারা “আভূষণ, জন্ম নিরোধক বড়ি, কসমেটিক্‌স, কসমেটিক অপারেশন ইত্যাদির যে শিকার হয়ে গেছেন” তা অস্বীকার করতে পারছেন না ফালুডি, গ্রীয়াররা। রাজনৈতিক ক্ষমতার অধীনে অন্যান্য মতাদর্শগত প্রশ্নগুলিকে বিবেচনা না করে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ময়দানকে অন্যদের জন্য ছেড়ে দিয়ে ‘মেয়েছেলেদের স্বভাব’ অনুযায়ী রান্নাঘর, শোওয়ার ঘরে গিয়ে ঢুকল নারী আন্দোলন। স্বাভাবিকভাবেই পুরুষ বিদ্বেষটি একদিকে মাত্রাছাড়া হল, অন্যদিকে দ্বন্দ্বের নিয়মানুযায়ীই পুরুষে আসক্তিও বেড়ে চলল নির্বিচারে। যে ডিক্রীগুলি ১৯১৭ সালেই মানব সভ্যতা জন্ম দিয়েছে তার বাস্তবায়ন আজও অধরা থেকে গেলো। মেয়েরা আজও বিবাহের পর নিজের সমস্ত সংস্কৃতি, জীবন চর্যাকে ভুলে তার ‘আসল’ পরিবারে মিশে যেতে বাধ্য হয়, যে পরিবারে তার জন্য সম্পত্তির ন্যূনতম অধিকারটুকুও নেই, যেটুকু তার পিতৃগৃহে অন্তত ঘোষিতভাবে হলেও আছে। নিজের মা-বাবার দায়িত্ব নেওয়ার পঠন পাঠন সে ছেলেবেলা/মেয়েবেলা থেকেই পায়না, ফলে একধরনের খণ্ডিত খর্বিত মূল্যবোধ নিয়ে সে বড় হয়ে ওঠে, আর কে না জানে এটাই ধর্মীয় শিকড় প্রোথিত হওয়ার উপযুক্ত শর্ত। আমরা আশঙ্কাজনক ভাবে আরও দেখেছি যে গৃহকাজের জন্য বেতনের দাবিটি নারী আন্দোলনের অভ্যন্তর থেকেই উঠে এল। গৃহের মালিকানার দাবির বদলে গৃহের শ্রমজীবী হয়ে থাকতেই পছন্দ করা হল। একই রকম ভাবে আওয়াজ উঠেছে নারীর শরীর একান্ত তারই। কথাটি এই অর্থেই সঠিক যে সন্তান ধারণ করা বা না করার ক্ষেত্রে স্বামীর অনুমতি ছাড়া সে সাবধানতা অবলম্বন করতেই পারে না– এমন মত আদৌ অনুমোদনযোগ্য নয়। কিন্তু শরীর বা জরায়ু তার হওয়া সত্বেও ১৮ বছরের আগেই তাকে মা হওয়ার স্বাধীনতা দেয় না বর্তমান যুগের কোনও সরকারই। অথবা ‘নিজের’ শরীর বেচে পয়সা রোজগার করবে তাও অনুমোদন করে না সভ্য সমাজ। অন্যদিকে সতীদাহকে নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে একটি মতামত ছিল এই যে মেয়েরা যদি স্বেচ্ছায় সহমরণে যেতে চায় তবে আপত্তি নেই। নিজের শরীর, সে যা খুশী করুক! আবার অন্যদিকে সন্তানের দায়িত্ব যখন রাষ্ট্রকে নিতেই হয় তখন শরীরের উপর ১০০% অধিকার তার কার্যত থাকে না। সমাজেরও এব্যাপারে বলার থাকে। এই দ্বন্দ্বিকতাকেও অনুধাবন করতে পারেনি নারীবাদীরা, অতএব ক্রমেই সরকারের কর্তৃত্বের বিরোধী হয়ে বিশ্বায়নের মতাদর্শকে সমর্থন করে বসেছেন। এই হল মোটামুটি পাশ্চাত্যে নারীবাদের উত্থান ও তার পরিণতির বিবরণী। সেখানে নানারকম বিপরীত চিন্তাভাবনা পরিণতির মধ্যে থেকেছে ক্রমাগত দ্বন্দ্ব।     

আধুনিক সমাজ শারীরবৃত্তীয়, জৈবিক বা বাহ্যিক শরীরের পার্থক্যকে সামাজিক বৈষম্যের অজুহাত হিসাবে দেখতে অস্বীকার করে। ধর্মভিত্তিক চিন্তা কখনো ধর্ম গ্রন্থের কথা বলে বা কখনো প্রাচীন লোকাচারের প্রসঙ্গ নিয়ে এসে শারীরবৃত্তীয়, জৈবিক বা বাহ্যিক পার্থক্যকে সামাজিক ক্ষমতায়নের বিপক্ষে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। ইসলামিক উত্তরাধিকার আইন ব্যবস্থার অনুচ্ছেদের প্রথমেই উল্লেখ করেছিলাম, ইসলামি আইন নির্মাণের উদ্যোগে আইনকে বিচারক হিসাবে ব্যক্তি ও স্থান হিসাবে নির্মাণ করার প্রচেষ্টা প্রসংসা জনক হলেও আইনকে সময় নিরপেক্ষ করে তোলার প্রচেষ্টা ততটাই সমস্যাজনক। আইন যে “মানব ও মানবীর” কথা ভেবে প্রণয়ন করা হয়েছিল সেই “মানব ও মানবী” বস্তু হিসাবেই পরিবর্তিত হয়ে গেলে পুরানো বাস্তবতার আইন নতুন বাস্তবতায় প্রয়োগ করলে নানা রকম দ্বন্দ্ব আসবেই, এবং সভ্যতাকে পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। এই প্রবণতা আমরা লক্ষ করেছি ইরানে শাহ ডাইনাস্টির পতন ও খোমেইনির নেতৃত্বে ইরানি ইসলামি রাষ্ট্রের প্রবর্তনের মাধ্যমে। খোমেইনির “লার্জার দ্যান লাইফ” কাল্ট একদিকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে নির্মাণ করা হয়েছিল, ইরানের মানুষ চাঁদের পৃষ্ঠে খোমেইনির মুখ আবিষ্কার করতে থাকেন সেটি অন্য বিষয় হিসাবে বাদ দিলেও সমাজে নারীদের অবস্থান নিয়ে খোমেইনির চিন্তা নিয়ে দুই এক লাইন আলোচনা না করে উপায় নেই। এই মতবাদের ভিত্তিতে আছে নারী একটি আদ্যন্ত গৃহস্থ প্রাণী। বৈবাহিক ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের শারীরিক পার্থক্যের সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে। এখানেও নারী পুরুষের বাহ্যিক পার্থক্য নিয়ে অনেক ভুল ধ্যান ধারণা জনমানসে আছে। নারী পুরুষের জৈবিক পার্থক্যকে অনেক ক্ষেত্রেই সার্বজনীন, অনিবার্য ও কাঙ্খিত ধরে নেওয়া হয় এবং এই জৈবিক পার্থক্যকে সামাজিক অসাম্যর ন্যায্যতা প্রতিপন্ন করা হয়। প্রথমত, এই পার্থক্য সার্বজনীন নয়। মানব প্রজাতির পুরুষ ও মহিলাদের পার্থক্য একটি গড় পার্থক্য, এনাটমি, শারীরবৃত্তীয় রসায়ন, স্বভাবগত ও জীববিজ্ঞানীরা ‘ডাইমরফিজম’ নামক একটি কথা বলেন যা পরিমাণগত বিশাল পার্থক্যের থেকে একধরণের গুণগত পার্থক্যকে নির্দেশিত করে। নারী-পুরুষের বাহ্যিক ও ব্যবহারিক পার্থক্যের ক্ষেত্রে কোনও নির্দিষ্ট পয়েন্টের পরিমাণগত বিচারের ভিত্তিতে বাইমডাল ডিস্ট্রিবিউশনের থেকে দুই লিঙ্গের ওভারল্যাপ দেখা যায়। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে লিঙ্গের পার্থক্যের ক্ষেত্রে জিন ও হরমোনকে নির্ণায়ক বস্তু হিসাবে ধর্তব্যের মধ্যে নেওয়া হয়। জিনকে ধরলে সেক্স ক্রোমোজোম পার্থক্য টোটাল ক্রোমোজোমের তুলনায় ২% পৃথক, বাকি ৪৪ টি ক্রোমোজোম নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যেই থাকে যা নারী বা পুরুষের মধ্যে আলাদাভাবে পার্থক্য নির্ধারণ করে না। বাহ্যিক শারীরিক পার্থক্য মূলত যেটুকু পরিলক্ষিত হয় সেটাও একই জেনেটিক মেটেরিয়ালের দুইরকমের প্রকাশ। স্তন্যপায়ীদের এই পার্থক্য প্রাথমিকভাবে ওয়াই ক্রোমোজোম ও পরবর্তীতে হরমোন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। ভ্রুনাবস্থায় আন্ড্রজেন এর উপস্থিতি যেখানে XY ক্রোমোজোমে পুরুষ স্ট্রাকচার নির্মাণ করে আর নির্দিষ্ট সময়ে এন্ড্রজেনের অনুপস্থিতি XY ক্রোমোজোমে নারীর বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলে, একই ভাবে ভ্রুনাবস্থায় নির্দিষ্ট সময়ে নারীর  XX ক্রোমোজোম কোনভাবে এন্ড্রজেনের সংস্পর্শে এলে পুরুষ বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। এছাড়া পিটুইটারী গ্রন্থী থেকে গোনাডট্রপিক হরমোন ব্যভারিকভাবে নারীসুলভ বা পুরুষ সুলভ আচারন নিয়ন্ত্রণ করে। এইভাবে জেনেটিক্যালি পুরুষের নারীসুলভ আচারন নারীর পুরুষ সুলভ আচারন ব্যাখ্যা করা যায়। এখন এই হরমোন গুলি সবই নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যে সামান্য পরিমাণগত পার্থক্য হিসাবে বর্তমান থাকে যা গুণগত বৈশিষ্ট্য হিসাবে উদ্ভাসিত হয়। জিন ও হরমোনের এই পার্থক্যই মানুষের বাহ্যিক ব্যবহারের একমাত্র নিয়ন্ত্রক ধরে নেওয়া সব থেকে দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি, একে অনেক সময় ‘বায়োলজিক্যাল ডিটারমিনজিম’ বলা হয়ে থাকে। আচার ব্যবহারে জৈবিক পার্থক্যকে অন্তর্নিহিত, অনমনীয় জটিল পূর্বনির্ধারিত কিছুর সাথে সমান করা জৈবিক শব্দটির দুর্ভাগ্যজনক অপব্যবহার। প্রাণীর আচরণ নিজেই একটি জৈবিক প্রক্রিয়া, জীব ও পরিবেশের মিথস্ক্রিয়া। আচরণ ও ব্যবহারে এই ‘পরিবেশের’ ভূমিকা বিপুল। সেখানে নারী বলতে সাধারণভাবে আমরা যা বুঝি সেটির অনেকটাই এই পরিবেশ ও সমাজের নির্মাণ। তবে কতটা সামাজিক নির্মাণ আর কতটা জৈবিক তার পরিমাণমূলক অবস্থান নিয়ে বিতর্ক আছে, আধুনিক চিন্তাভাবনায় ‘পার্থক্য নিয়েও সমান’ নামক একটা দ্বন্দ্বমূলক ব্যবস্থা স্বীকার করে নেওয়া হয়। অধিকার প্রশ্নে শারীরিক পার্থক্যের জন্য দুই রকম নিয়মকে সরাসরি বৈষম্য বলা হয়।

ইসলামিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার ব্যবস্থা :

ইসলামী আইনশাস্ত্রের ধ্রুপদী পদ্ধতিটি আইনের উপর ব্যক্তির হস্তক্ষেপকে সীমাবদ্ধ রাখা। স্থান-কাল নিরপেক্ষভাবে, এমন একটি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি, যা আইনের ব্যাখ্যার নামে ব্যক্তির কারচুপিকে রুখে দিতে পারে। কুরানিক উৎসগুলির বিকৃত করার জন্য কোনও অনৈচ্ছিক প্রবণতাও হ্রাস করতে পারে। আইনকে নৈর্ব্যক্তিক করার প্রচেষ্টা যতটা প্রশংসার, পরবর্তী আলোচনায় দেখানোর চেষ্টা করবো কাল-নিরপেক্ষ করা ততটাই সমস্যাজনক। মুসলিম পার্সোনাল আইনের গাইডিং লাইন শরিয়া আইন, আরও নির্দিষ্টভাবে বললে কোরানের সুরা নিশা। মুসলিম আইনে সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারায় বেশ কিছু সংখ্যার বিশেষ গুরুত্ব আছে, যেমন মোট সম্পদের ১) অর্ধেক (১/২) ২) এক চতুর্থাংশ (১/৪) ৩) এক অষ্টমাংশ (১/৮) ৪) দুই-তৃতীয়াংশ (২/৩) (২) ৫) এক-তৃতীয়াংশ (১/৩) এবং ৬) এক-ষষ্টাংশ (১/৬)। 

কোন মুসলমান মারা গেলে তার সম্পত্তি বণ্টনের আগে কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়। চলুন আগে জেনে নিই কী সেই সব আনুষ্ঠানিকতা।

১. মৃত ব্যক্তির পর্যাপ্ত সম্পত্তি থাকলে সেখান থেকে তার দাফন কাফনের যাবতীয় খরচ মেটাতে হবে।

২. তিনি যদি জীবিত থাকা অবস্থায় কোন ধার-দেনা করে থাকেন তবে তাও রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে পরিশোধ করে দিতে হবে।

৩. তাঁর স্ত্রী বা স্ত্রীদের দেনমোহর পরিশোধিত না হয়ে থাকলে বা আংশিক অপরিশোধিত থাকলে তা পরিশোধ করে দিতে হবে। মোট কথা স্ত্রীর সম্পূর্ণ দেনমোহর স্বামী মৃত অথবা জীবিত যাই থাকুক না কেন তা স্বামীর সম্পত্তি থেকে আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ পরিশোধ করে দিতে হবে।

৪. মৃত ব্যক্তি কোন দান কিংবা উইল করে গেলে তা প্রাপককে দিয়ে দিতে হবে।

উপরের সব কাজ সম্পন্ন করার পরে মৃত ব্যক্তির অবশিষ্ট সম্পত্তি ফারায়েজ আইন অনুযায়ী তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে।

মুসলিম উত্তরাধিকার নির্ণয় করার জন্য উপরে উল্লেখিত প্রথম তিন জনের বণ্টন কাজ সমাধা হলে চতুর্থ পর্যায়ে উত্তরাধিকারীদের অংশ। এই অংশটিকে আবার দুইভাগে ভাগ করা হয়।  এই ৬ টি অংশের অধিকারীদের সংখ্যা ১২ জন, তার মধ্যে চার জন পুরুষ, ১) পিতা ২) পিতামহ, ৩) বিপৈতৃক ভাই এবং ৪) স্বামী । এবার আট জন মহিলা ১) স্ত্রী ২) কন্যা ৩) পুত্রের কন্যা যত নিম্নে হোক না কেন ৪) সহোদরা ভগ্নী ৫) বৈমাত্রেয় ভগ্নী, ৬) ভগ্নী, ৭) মাতা ৮) মাতামহী। এই অধিকারীদের আসহাবুল ফারায়েজ বা যাবিল ফুরূজ হিসাবে ধরা হয়। যাবিল ফুরূজ অংশ বণ্টনের পর বাদবাকি অংশ আসাবাদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। কোন উত্তরাধিকারী থাকলে বা না থাকলে স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রীর বা স্ত্রীর মৃত্যুতে স্বামীর প্রাপ্য, ভাই থাকলে বা না থাকলে বোনের প্রাপ্য এবং এরকম বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ইসলামিক রীতিতে কার কি প্রাপ্য তার বিস্তারিত বর্ণনায় যাওয়ার কোনও প্রয়োজন এই মুহূর্তে অনুভব করছি না। মূল যে বক্তব্য ইসলামিক রীতিতে ও আল কুরআনিক নির্দেশ হিসাবে পাই তাতে বলা যেতে পারে উত্তরাধিকার আইনে পরিবার পরিজনের নিকট বা দূর আত্মীয়ের মধ্যে উত্তরাধিকার সম্পত্তির এক রকম ব্যবস্থা আছে, যেখানে একজন দাস মালিক থেকে মুক্তি প্রাপ্ত দাসের প্রাপ্য বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় ভ্রাতা ও ভগ্নির জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রাপ্যের উল্লেখ আছে। যে রীতি নীতিকে বিচার করলে এক কথায় বলা যায় কুরআনিক এই নির্দেশাবলী আসলে সম্পদের কেন্দ্রীভবনের বিরুদ্ধে এক সদর্থক প্রচেষ্টা। প্রায় ১৫০০ বছর আগে যখন দাস ব্যবস্থা ধীরে ধীরে উঠে যেতে বসেছে তখন সম্পত্তি নিয়েও স্বাধীন নাগরিক ও ক্রীতদাসের অধিকার নিয়ে যেসব বক্তব্য আছে সেসব পাঠ করলে বোঝা যায় সেই সময়ে ক্রীতদাস ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ বা হারাম করে দেওয়ার মত আধুনিকতা অর্জন করা যায়নি কিন্তু ক্রীতদাস ব্যবস্থা যে সাধুবাদ পাওয়ার ব্যবস্থা নয় বরং দাসকে মুক্তি দেওয়ায় উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। হয়তো আরও ৫০০ বছর পর হজরত মোহাম্মদ ধরাধামে অবতীর্ণ হলে ক্রীতদাস ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করা হতো কিনা সেটা বলা মুশকিল। এবার জেনে নিই কি অনুপাতে বা কীভাবে এই সম্পত্তি বণ্টন হবার নিয়ম আছে।

১. স্বামীর অংশ : স্বামী ২ ভাবে মৃত স্ত্রীর সম্পত্তির ভাগ পেয়ে থাকে। স্বামী কখনো তাঁর মৃত স্ত্রীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে না। মৃত স্ত্রীর কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তান থাকলে স্বামী স্ত্রীর সম্পত্তির ১/৪ অংশ পাবে। মৃত স্ত্রীর কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তান কেউই না থাকলে স্বামী স্ত্রীর সম্পত্তির ১/২ অংশ পাবে।

২. স্ত্রীর অংশ : স্ত্রীও ২ ভাবে তাঁর মৃত স্বামীর সম্পত্তি পেয়ে থাকে। বিধবা স্ত্রী কোন ভাবে তাঁর স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে না। মৃত স্বামীর কোন সন্তান বা তাঁদের পুত্রের সন্তান থাকলে স্ত্রী, স্বামীর সম্পত্তির ১/৮ অংশ পাবে। যদি মৃত স্বামীর কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তান কেউই না থাকলে তবে স্ত্রী, স্বামীর সম্পত্তির ১/৪ অংশ পাবে। স্ত্রী একাধিক হলেও সবাই মিলে ১/৪ অংশ সমান ভাগেই পাবে।

৩. বাবার অংশ : বাবা তাঁর মৃত সন্তানের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী ৩ ভাবে হয়ে থাকে। যদি মৃত সন্তানের পুত্র, পুত্রের পুত্র বা পুত্রের পুত্রের পুত্র এভাবে যতই নিচের হোক না কেন যদি থাকে, তবে মৃত সন্তানের পিতা পাবেন সন্তানের সম্পত্তির ১/৬ অংশ।

যদি মৃত সন্তানের শুধু মাত্র কন্যা সন্তান বা তাঁর পুত্রের কন্যা সন্তান থাকলে তবে পিতা সন্তানের সম্পত্তির ১/৬ অংশ পাবেন।

এই ক্ষেত্রে কন্যাদের ও অন্যান্যদের দেয়ার পর অবশিষ্ট যে সম্পত্তি থাকবে তাও পিতা পাবেন। আর যদি মৃত সন্তানের কোন পুত্র-কন্যা বা পুত্রের সন্তান কিছুই না থাকে তাবে বাকী অংশীদারদের তাঁদের অংশ অনুযায়ী দেয়ার পর অবশিষ্ট যা থাকবে তার সবটুকুই বাবা পাবেন।

তবে মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান ও বাবা কেউ না থাকলে তাঁর সম্পত্তি তাঁর জীবিত ভাই বা ভাইরা পাবে। আবার ভাই না থাকলে তাঁর ভাইয়ের সন্তানরা পাবে।

৪. মায়ের অংশ : মা তাঁর মৃত সন্তানের সম্পত্তি পেয়ে ৩ ভাবে পেয়ে থাকে। – মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি যত নিম্নেরই হোক থাকলে অথবা যদি মৃত ব্যক্তির আপন, পূর্ণ বৈমাত্রেয় বা বৈপিত্রেয় ভাইবোন থাকলে তবে মাতা ছয় ভাগের এক ভাগ (১/৬) পাবেন।

মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি যত নিম্নের হোক না থাকলে এবং মৃত ব্যক্তির যদি একজনের বেশি ভাই বা বোন না থাকে তবে মাতা তিন ভাগের এক ভাগ (১/৩) পাবেন। কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি যত নিম্নের হোক না থাকলে অথবা কমপক্ষে দুইজন ভাইবোন না থাকলে এবং যদি মৃত ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রীর অংশ বাদ দেয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকবে, তার তিন ভাগের এক ভাগ (১/৩) মাতা পাবেন। মৃত ব্যক্তির এক ভাই থাকলেও মাতা ১/৩ অংশ পাবেন।

৫. পুত্র সন্তানের অংশ : মৃত ব্যক্তির ছেলে বা ছেলেরা সকল ক্ষেত্রেই সম্পত্তি পায়। যেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ছেলে ও মেয়ে রয়েছে সেই ক্ষেত্রে ছেলে বা ছেলেরা, মেয়ে বা মেয়েদের চেয়ে দ্বিগুন সম্পত্তি পাবে। মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে মাতাপিতা ও স্বামী-স্ত্রী নির্দিষ্ট সম্পত্তি পাওয়ার পর অবশিষ্ট সম্পত্তি ছেলে মেয়ের মধ্যে বন্টন করা হবে। তবে মেয়ে না থাকলে অংশীদারদের অংশ দেয়ার পর অবশিষ্টাংশভোগী হিসেবে বাকী সম্পূর্ণ সম্পত্তি ছেলে বা ছেলেরাই পাবে।

৬. কন্যা সন্তানের অংশ : উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে কন্যারা তিনভাবে মাতাপিতার সম্পত্তি পেতে পারে। একমাত্র কন্যা হলে তিনি রেখে যাওয়া সম্পত্তির দুই ভাগের এক ভাগ বা (১/২) অংশ পাবে। একাধিক মেয়ে হলে সবাই মিলে সমানভাগে তিন ভাগের দুই ভাগ বা (২/৩) অংশ পাবে। যদি পুত্র থাকে তবে পুত্র ও কন্যার সম্পত্তির অনুপাত হবে ২:১ অর্থাৎ এক মেয়ে এক ছেলের অর্ধেক অংশ পাবে। যা হোক কন্যা কখনো মাতাপিতার সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হয় না।

উপরের ভাগ বাঁটোয়ারায় নজর করলে দেখা যাচ্ছে, স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা, ভাই-বোন প্রতি ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির পরিমান ভিন্ন, এবং এই ভিন্নতার মূলে আছে দাবিদার পুরুষ নাকি নারী তার উপর। একদিকে এই ভিন্নতা যেমন দৃষ্টিকটু লাগে অন্যদিকে প্রশংসার বিষয়টি হচ্ছে উপরের সম্পত্তির ভাগবাঁটোয়ারায় সম্পত্তির বিকেন্দ্রীভবন করার প্রচেষ্টা। আজ থেকে ১৫০০ বছর আগে যেভাবে সম্পত্তির ভাগবাঁটোয়ারার ব্যাপারটিকে ধরা হয়েছে তাতে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে একদিকে চমকিত হতে হয়, কারণ সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এই আইনগুলি বেশ কিছু আধুনিক ও যুক্তি বোধের অভিমুখকে নির্দেশ করে। সবার জন্য কিছু না কিছু আছে, কাউকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত করে সম্পত্তির কেন্দ্রীভবন রোধ করার প্রচেষ্টা স্পষ্টভাবেই পরিলক্ষিত হয়। শরিয়তের আইনে বারংবার বৈমাত্রিক বা বৈপিতৃক ভাইবোন, অনাথ বালক বালিকার উল্লেখ স্পষ্টভাবে সেই সময়কার গোষ্ঠী ভিত্তিক লড়াই ও নিরন্তর যুদ্ধ বিধ্বস্ত সমাজকে নির্দেশ করে। যার স্বাভাবিক পরিণতি পুরুষদের বহুবিবাহ ও মহিলাদের সন্তান ধারণ ও পালনই মুখ্য ভুমিকা। আজকের দিনে যখন ছোট পরিবারের ধারণা প্রশ্নাতীতভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে, কেন সম্পত্তি আইনগুলির বদল দরকার সেই প্রশ্নগুলি একবার পর্যালোচনা  করা যাক।

বৈষম্য অস্বীকারের প্রবনতা :

একদিকে হিন্দু সমাজে যেখানে বিবাহিত মেয়েদের পৈতৃক সম্পত্তিতে অধিকার পেতে ২০০৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে, সেখানে মুসলিম সমাজে নারীরা ১৫০০ বছর আগেই সম্পত্তিতে অধিকার পেয়েছে, মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিটি ব্যবস্থা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যথাযথ দাবি করেন রক্ষণশীল মুসলিম চিন্তাবিদ ও স্কলাররা। এই শিবিরের দাবির ভিত্তিতে আছে যে কিছু ক্ষেত্রে ভাই-বোন বা স্বামী মারা গেলে স্ত্রীর প্রাপ্য বা উল্টো ক্ষেত্রে কিছু বৈষম্য থাকলেও অন্য বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে নাকি মেয়েরা একই লেভেলের একজন পুরুষের থেকে বেশি সম্পত্তির ভাগ পায়। তাঁদের দাবি অনুযায়ী নারী বলতে শুধু আপন কন্যা বা আপন বোনকেই বোঝায় না। শরিয়তে এদের ছাড়াও উত্তরাধিকার হিসেবে দূর সম্পর্কের অন্য নারীদেরও অংশীদার করা হয়েছে, সেখানে ক্ষেত্র বিশেষে নারী-পুরুষের পৃথক অংশ রয়েছে। যেমন,

১) ৪ রকম ক্ষেত্রে পুরুষ নারীর দ্বিগুণ অংশ পায়।

২) ১০ রকম ক্ষেত্রে পুরুষ এবং নারী সমান অংশ পায়।

৩)  ১২ রকম বা তারও বেশি ক্ষেত্রে  নারী পুরুষের তুলনায় বেশি অংশ পায়।

৪) ৪ রকম বা তার বেশি ক্ষেত্রে সমমানের নারী উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির অংশ পেলেও পুরুষ কোনো অংশ পায় না।
এই রকম ভেদের মধ্যেই এক রকম চাতুরী লুকিয়ে আছে। এটা সেই শিশু কাহিনি মনে করিয়ে দেয়, যেখানে বোকা ও চালাক ব্যক্তি এক এক বছরে এক একরকম ফসল ফলিয়ে একজন মাটির উপরিভাগটা নেয় আর অন্য জন্য মাটির নীচের অংশটা নেয়, এবং প্রতি ক্ষেত্রে বোকা ব্যক্তিকে ঠকানো হয়। ধানের ক্ষেত্রে মাটির উপরের অংশটা পুরুষকে আর পেঁয়াজের সময় আগের অবস্থান বদলে মাটির নীচের অংশটা পুরুষকে দেওয়ার কথা বলা আর বাবার সম্পত্তিতে ছেলে বেশি পাবে আর মায়ের সম্পত্তিতে মেয়ে বেশি অংশ পাবে বলা একই ব্যাপার। মায়ের সম্পত্তি বা সেরকম দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের থেকে মেয়েদের ভাগে বস্তুত কিছুই জোটে না। সমস্ত সার্ভে রিপোর্ট থেকে সম্পত্তির মালিকানায় পুরুষ ও নারীদের মধ্যে ভয়ঙ্কর বৈষম্য এই রকম ভেদের অসারতা স্পষ্ট করে দেয়। এই নিয়মের পক্ষে আর এক রকম যুক্তি আসে–স্বামীর সম্পূর্ণ সম্পদেই মেয়েদের অধিকার তো থাকেই বা ইসলামিক জীবন বিধানে পরিষ্কার উল্লেখিত যে, একই পরিবারে পারিবারিক খরচখরচা থেকে শুরু করে খোরপোষ সমস্ত দায়দায়িত্ব পুরুষের। নারীর আর্থিক কোনো দায়দায়িত্ব নেই। যেহেতু আর্থিক কোন দায় নেই তাই নারীর আসলে সেইভাবে বেশি সম্পত্তির প্রয়োজন নেই। এই বক্তব্য যিনি বলবেন তাঁকে তাহলে প্রথমে নিশ্চিতভাবে স্বীকার করতে হবে মেয়েরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসাবে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার। পরের পদক্ষেপ হিসাবে লিঙ্গ বৈষম্যের অজুহাত হিসাবে ভাই ও বোনের মধ্যে ভাইয়ের আর্থিক দায়-দায়িত্ব বেশি তাই তাঁকে বেশি দেওয়া সমর্থন করতে হবে। বোনের যেহেতু দায় নেই তাই তাঁর সম্পত্তির দরকার নেই। বোনের বিয়ের খরচ খরচার প্রসঙ্গ তুলে বিভ্রান্ত করারও প্রচেষ্টা অনেকে নিয়ে থাকেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, আজকের দিনের পরিবারে এক ছেলে ও এক মেয়ের সংসারে বৃদ্ধ বাবার মৃত্যুর পর সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সাধারণত সরাসরি ছেলের হাতে চলে যায়। বোনটির যদি বিয়ে হয়ে গিয়ে থাকে সেখানে স্বামীর বাড়ির সম্পত্তিতে নিয়ন্ত্রণের অধিকার সে পায় কি? পায় না। গৃহবধূ হলে তো কথাই নেই, ভাত কাপড়ের চুক্তিতে মেয়ে চলল অন্য বাড়িতে শ্রম দিতে। অর্থাৎ বৈষম্য সর্বত্রই আছে। মজার বিষয় হল অনেক ক্ষেত্রে একই ব্যক্তি কখনো বলেন ইসলামে নারী পুরুষে বৈষম্য করা হয় না, আবার পরের মুহূর্তেই বৈষম্যের অজুহাতটিও দেন। এই সব পুরুষরা বাবা মায়ের দায় নেওয়া বা মৃত বাবার ঋণের দায়ভার নেওয়ার প্রশ্নে উভয় ক্ষেত্রেই মেয়েদের বোতল বন্দী করে দিতে চান। এই প্রসঙ্গে আধুনিক সমাজের বাস্তবিকতার বদল নিয়ে পরের অনুচ্ছেদে আবার আলোচনা করবো। 

সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ও বাস্তবিকতার বদল :

আজকের দিনে বেশিরভাগ বাবা মায়েরা একটি অথবা দুটি সন্তান নেওয়া নিয়ে কোনো রকম দ্বিধা-দ্বন্দে ভোগেন না। সন্তানদের বড় হওয়ার পর তারা যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তখন সেটি আর আগের মত একটি মেয়েকে বিয়ে করে তার পরিবার ও পরিবেশকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করে নতুন একটি পরিবার ও পরিবেশে বন্দী করা বোঝায় না। আজকাল হিন্দু সমাজের মধ্যে কন্যাদান ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মোহোরানা দিয়ে বিয়েকে অপমান সূচক হিসাবে ন্যায্যভাবেই ধরা হচ্ছে। একদিকে যেমন পণ প্রথাকে সমাজের অভিশাপ ধরা হয়, তেমনি মোহোরানা দিয়ে বিয়ে করাকে অর্থ দিয়ে বউ কিনে আনা হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে। এখন বিয়ে মানে এক ব্যক্তি একটি পরিবারের পরিবর্তে দুটি পরিবারের অংশ হয়ে ওঠে। ঘরে বাইরে মেয়েদের সমস্ত ক্ষেত্রে ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সমাজ নির্মাণে এগিয়ে চলেছে। ১১৫ বছর আগে বেগম রোকেয়া “সুলতানা’স ড্রিম” কল্পবিজ্ঞান হিসাবে লিখেছিলেন যেখানে পেশি শক্তির প্রয়োজনকে পিছনে ঠেলে দিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘরের বাইরের ‘সমস্ত’ কাজই মেয়েরা করেন। পুরুষরা পর্দানশিন হয়ে বাচ্চা মানুষ করা থেকে আধুনিক বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে সৌর শক্তির সাহায্যে রান্না থেকে নানারকম অটোমেটিক ব্যবস্থায় ঘরের অভ্যন্তরের কাজের মধ্যে আবদ্ধ থাকেন। বেগম রোকেয়ার এই ছোট উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে প্রথম কল্পবিজ্ঞান হিসাবে সৌর শক্তির ব্যবহারের উল্লেখ কিনা আমার জানা নেই। রোকেয়া পেশি শক্তির প্রয়োজনীয়তা ফুরাতে বিজ্ঞান প্রযুক্তির যে উন্নতির স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটি কতদূর এখনও পর্যন্ত অর্জন হয়েছে সেই আলোচনা না করে নিশ্চিতভাবে বলা যায় সমাজ এগিয়েছে অনেকটাই। মাত্র ৩০০ বছর আগের রাজা বাদশাহদের বা তাঁদের সৈন্য সামন্তদের ব্যবহৃত অস্ত্রে সজ্জিত কোন মিউজিয়ামে একটু ভ্রমণ করলেই বোঝা যায় আজকের সময়ে গড় পুরুষের থেকে মাত্র ৩০০ বছর আগেই গড় মানুষ অনেক বেশি পরিমাণ পেশি শক্তির ব্যবহার করতেন। কয়েক হাজার বা লক্ষ বছর পার করে গুহাযুগের মানুষের সঙ্গে তুলনা করলে কোনো সন্দেহই থাকার কথা নয় যে, পেশি শক্তি ব্যবহারে মানুষের মধ্যে ক্রমাগত বিবর্তন চলছে। এই বিবর্তন শুধু পেশি শক্তিতেই নয়, মানুষের সার্বিক আকার, আকৃতি, আচার ব্যবহার, মানসিকতা সর্বত্রই ঘটছে। এই পরিবর্তন মানুষের যৌনতায় ঘটেছে। আদিম যুগে প্রতিকুল পরিবেশে বংশ রক্ষা করার প্রবৃত্তিতে যে পরিমাণ সন্তান উৎপাদন করতে হত ও সম্পদের কেন্দ্রীভবন নারীকে যেখানে একটি সম্পদ উৎপাদনের যন্ত্রী বানিয়ে দিয়েছিল, সেই অবস্থা এখন বদলে গেছে। এই বদল আসলে পেশী শক্তির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নতুন নতুন ভারসাম্যের দিক উন্মোচন করছে। রক্ষণশীল ইসলাম এই বিবর্তনকে অস্বীকার করতে চায় অথবা বাধা দিতে চায়, উল্টো দিকে নিয়ে যেতে চায়। নারী পুরুষ “Different but equal” অবস্থানের ঠিক উল্টো নারী ও পুরুষের মধ্যে সর্বত্র হায়ারারকি বিদ্যমান, সেখানে নারী ও পুরুষের মধ্যে আধিপত্য ও পরাধীনতার স্পষ্ট সম্পর্ক আছে, সেখানে পুরুষ প্রভু হিসাবে নীতি নির্ধারণ করেন এবং নারী পুরুষের নির্ধারণ করে দেওয়া রীতিনীতি মেনে চলবেন। এই শ্রেণিবিন্যাসে, মহিলাদের দুর্বল লিঙ্গ হিসাবে গণ্য করা হয় এবং আধুনিক সমাজের বিবাহের এথিকস হিসাবে “বিবাহ দুটি মানুষের মধ্যে পার্টনারশিপ ও কোলাবরেশনের একটি সাম্য চুক্তি”কে অস্বীকার করা হয়। নারীকে শালীনতা, পবিত্রতা এবং লজ্জাবতীর প্রতীক হিসাবে নির্মাণ করে তাঁকে সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়। ব্যক্তিকে অতিমানবিক করে তোলার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে ভারতেও অতীতে ফিরে যাওয়ার একটা প্রবণতা বিগত বেশ কয়েক বছরে দেখা যায়। এই ভাবে অতীতের দিকে যাত্রা করার প্রচেষ্টা স্থান ও কালের ভেদে কোথাও কোথাও স্বল্পকালীন সময়ের জন্য কিছুটা সাফল্য পেলেও দীর্ঘমেয়াদী ইতিহাসের দিকে নজর দিলে বোঝা যায় সেই প্রচেষ্টা অদূরেই মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। সময়ের গতির অভিমুখ পাঠ করলে বোঝা যায় ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে সামাজিক ক্ষমতায়নের প্রশ্নে জেন্ডার গ্যাপ কমতে বাধ্য। কোথাও সেটা ৫ বছর লাগতে পারে অন্য কোথাও ৫০ বা ১০০ বছর লাগতে পারে। সম্পত্তির প্রশ্নে, সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থার প্রশ্নে, ঘরের বাইরের কাজে মেয়েদের উপস্থিতির প্রশ্নে সবরকম সার্ভের ফলাফল মেয়েদের উপস্থিতি ভয়ঙ্করভাবে কম আছে সেটি প্রতিষ্ঠিত। ইসলাম বা অন্য কোন ধর্মীয় কালচারে সম্পত্তির প্রশ্নে বৈষম্য অস্বীকার করে সামাজিক সংস্কারকে প্রতিহত করার চেষ্টা হোক বা শারীরবৃত্তীয় ও জৈবিক পার্থক্যকে ভিত্তিভূমি ধরে সামাজিক বৈষম্যকে প্রকৃতির নিয়ম বলে প্রতিহত করার চেষ্টা করা হোক, দুটোই শেষ বিচারে পরাস্ত হবেই। এই মুহূর্তে তাই জেন্ডার গ্যাপ কমাতে ও পৈতৃক সম্পত্তিতে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সম্ভাব্য পথ গুলি নিয়ে কিছুটা আলোচনা করবো। এই আলোচনা দুইভাবে হতে পারে, ইসলামিক স্ক্রিপচারের মধ্যে থেকে বা তাঁর আশপাশ থেকেই আইনের সংস্কার অথবা ধর্ম ও ধর্মীয় স্ক্রিপচারকে আধ্মাত্মিক বিষয়ে সীমাবদ্ধ করে সামাজিক নিয়মের জন্য ধর্মীয় রীতি রেওয়াজকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আধুনিকতার মাপ কাঠিতে নতুন নিয়মের প্রবর্তন। 
সর্বোপরি শারীরিক শক্তির পার্থক্য ২০২০ সালে আর সামাজিক অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে না। প্রযুক্তির বিকাশ, চেয়ার টেনে বসে কাজ, সুইচ টিপে কাজ, এখন যন্ত্রের সাহায্যে অতি বড় দুর্বল মানুষকে দিয়েও হাতির সমান কাজ নিমেষেই করিয়ে নিতে পারা যায়। তাই যখন দাস ছাড়া সভ্যতার বিকাশ সম্ভব ছিল না তখন এক রকম আইন ছিল, দাসদের জন্য অধিকার দিলে সভ্যতার বিকাশ আটকে যেতো। আবার আরব দুনিয়ার অগ্রগতির কালে যে নিয়ম বলবৎ ছিল তা আজ আবার প্রযোজ্য নয়। সমাজে এই পরিবর্তনগুলি নিরন্তর দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। সেই দ্বন্দ্বের প্রভাব একই বিষয়ে অনেক পরস্পর বিরোধী ভুমিকার মধ্যে দেখা যায়। এক্ষেত্রে কবি নজরুলকে সাবাসি জানাতেই হয়। একদিকে তিনি খিলাফত আন্দোলনের সক্রিয় অংশীদার ছিলেন আবার তিনিই ‘কামাল তুনে কামাল কিয়া ভাই’, লিখে কামাল আতাতুর্ক এর বৈপ্লবিক কর্মকে প্রশংসা করে গেছেন নিঃসকোচে। যে কামাল শরিয়তকে দেশের আইনের মেরুদন্ড হিসেবে দেখতে অস্বীকার করেছিলেন।  

ইসলামিক আইনের অভ্যন্তর থেকে সম্পত্তি আইনের আধুনিকীকরণ:

যেহেতু হজরত মহম্মদের মৃত্যুর সাথে সাথে মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে বিধিবদ্ধ নিয়মাবলী সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে ওহী হিসাবে আসা বন্ধ হয়ে যায়, প্রথম দিকের মুসলিম আলেমরা ইসলামী আইনের উৎস (ফিকহ) এবং এর কৌশলগুলির যথাযথ বিকাশ, গ্রহণ ও বর্জনের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন। এর ফলে ইসলামিক সাম্রাজ্যে বিষয়গত ও আঞ্চলিক ভেদে পৃথক পৃথক মতামতের জন্ম দেয় যা ইসলামি আইনশাস্ত্রের ভিন্ন ভিন্ন ধারার জন্ম দেয়। সময়ের সাথে এই বিভিন্ন ধারাগুলো কমবেশি একত্রিত হয়ে সুন্নি সমাজের চারটি মুখ্য প্রতিষ্ঠানে এসে ঠেকে। এগুলি হল হানাফি, মালিকি, শাফিহই এবং হানবালি। 
এই সুন্নী প্রতিষ্ঠানগুলি সর্বসম্মতিক্রমে ফিকহের চারটি সূত্র গ্রহণ করে: কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা (সর্বসম্মতি) এবং কিয়াস (সাদৃশ্য)। ইসলামিক চিন্তাধারা অনুযায়ী উত্তরাধিকার আইনসহ কিছু আইন কোরানে সেট করা আছে তবুও কুরআন কেবল একটি আইনী পাঠ্য নয় বরং সমস্ত সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিচারের বিশ্বস্তভাবে জীবনধারণের মূলনীতিগুলি নির্ধারণ করে। কুরআনের আইনী বিষয়গুলির কোথাও ফাঁক থাকলে হাদিসে বর্ণীত সুন্নাহ দ্বারা পরিপূর্ণ করা হয়–কখনও আইনের শাসনে ইসলামী ফকীহগণের মধ্যে ইজমা ও কিয়াস ব্যবহার করে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা দেখা যায়। শরিয়ত নির্ধারিত হয়ে ইসলামিক আইনকানুনকে ব্যক্তি মানুষের ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত পক্ষপাত প্রতিরোধ করতে কঠোর প্রচেষ্টা নিলেও আইনের ব্যাপারস্যাপারগুলির যথাযথ প্রয়োগের জন্য বিচারক বা ইসলামি আইনবিদদের কিছুটা যুক্তি ও চিন্তা ভাবনা প্রয়োগ করার প্রয়োজন হয়, যা ইজতিহাদ নামে পরিচিত। মালিকি ঘরানায় একজন ব্যক্তি (বিচারক) যে ব্যবস্থার সাহায্যে যুক্তি ও বিবেচনা প্রয়োগ করার সুযোগ পান তাকে বলে ‘উরফ’ এবং ‘ইস্তিসিলাহ’। ‘উরফ’, প্রচলিত রীতিকে সম্মান করার ব্যবস্থা। প্রচলিত রীতিনীতি একটি বাধ্যতামূলক রীতিনীতি হিসাবে স্বীকৃতি পাবে যদি সেই প্রথাগত অনুশীলন ইসলামী নীতিগুলি লঙ্ঘন না করে এবং নির্দিষ্ট অঞ্চলে প্রচলিত হওয়া উচিত যার জন্য এটি বিবেচনা করা হচ্ছে। ‘ইস্তিসিলাহ’ হ'ল যে ব্যবস্থার সাহায্যে একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে দুটি বিকল্পের মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়া হয়। এই বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট পরিস্থিতির জন্য আরও উপযুক্ত হিসাবে একটি বিকল্প বেশি গ্রহণযোগ্য এবং নির্বাচিত সমাধানটি প্রত্যাখ্যাত সমাধানের চেয়ে গভীরে বিশ্লেষণ করলে তুলনায় দুর্বল হলেও গৃহীত সিদ্ধান্ত নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে বেশি গুরুত্ব পায়। মালিকি ঘরানার বিচার প্রক্রিয়ায় যে নীতিটি মানা হয় সেটি হল, যেহেতু আল্লাহর আইন মানব কল্যানের জন্যই নাজিল হয়েছিল, তাই সার্বিক মানব কল্যানের প্রয়োজনটাই একাধিক বিকল্পের মধ্যে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়াকে গাইড করতে পারে। সুতরাং ইস্তিসিলাহ আলেম বর্গদের মাধ্যমে মানব কল্যাণের (মাস্লাহা) নির্দিষ্ট পথ তুলে ধরার নির্দেশ করে। দশম শতক পর্যন্ত এই ব্যবস্থার মাধ্যমে আইনকানুনের চর্চা হলেও তারপর এই ব্যবস্থার প্রচলন ধীরে ধীরে কমতে থাকে, পরিবর্তে ‘তাক্লিদ’ এর ব্যবহার শুরু হয়। এই ব্যবস্থায় সেই ঘরানায় একই রকম অবস্থায় পূর্ববর্তী কোনো বিচারের উদাহরণকে অনুসরণ করার রীতি শুরু হয় এবং বলা যায় ইসলামে ইজতিহাদের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।  
         ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন ভৌগলিক ক্ষেত্রে যেভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে সেই অনুযায়ী মুসলিম বিশ্ব এক একটি শরিয়তি ধারা গ্রহণ করেছে। শরিয়তি আইনের ঘেরাটোপে থেকেও মুসলিম বিশ্বে এখনও পর্যন্ত নাইজেরিয়া একমাত্র দেশ জাতিসংঘের সুপারিশ গ্রহণ করে তাঁদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উত্তরাধিকার আইন সংস্কার করে নারী পুরুষের জন্য সমান অধিকারের অন্তত আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে। আমরা তাই নাইজেরিয়ার অবস্থা আরও একটু গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করবো। পশ্চিম আফ্রিকার অন্যান্য দেশের মতই নাইজেরিয়াতে ইসলামের মালিকি ঘরানার প্রভাব বেশি। এই ঘরানায় উৎস হিসাবে ইমাম মালিক ইবনে আনাস কে ধরা হয়, ইনি অষ্টম শতকে মদিনায় দেহ ত্যাগ করেন এবং উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকায় ইমাম মালিক এর প্রভাব সৃষ্টি হয়। মালিকি ঘরানায় মুসলিম জগতে সর্বত্র ঐতিহাসিক ভাবে স্থানীয় জনজাতির সার্বিক কল্যাণ (মাস্লাহা) এবং স্থানীয় রীতিনীতিকে প্রভূত গুরুত্ব দিয়েছে যতক্ষণ পর্যন্ত তা ইসলামের মৌলিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে না গেছে। ইসলামি আইনের বিশেষ কিছু উৎসে গুরুত্ব দেওয়ার কারণে মালিকি ঘরানা ইসলামের অন্য তিনটি অর্থোডক্স সুন্নি ঘরানার থেকে বস্তু ও চরিত্রগত ভাবে ভিন্ন এবং সেখানে উত্তরাধিকার নিয়ে আইনও তারই অন্তর্গত। উত্তরাধিকার নিয়ে ইসলামিক আইনের বেশীরভাগের উৎস কোরআন। কুরআন নাজিল হওয়ার আগে সম্পত্তির উত্তরাধিকার আরবের বেশিরভাগ জনজাতির মধ্যে পুরুষের হাত ধরে হত, সেখানে নারীর কোন স্থান ছিল না, মেয়ে ও মাতৃরক্ত সম্পর্কিত উত্তরাধিকারের কোনও ব্যবস্থা তো ছিলই না, বরং কিছু ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারী পুরুষের হাতে সম্পত্তির সাথে কিছু নারীও সম্পত্তি হিসাবে হস্তান্তরিত হত, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে বাবাকে অতিক্রম করে তাঁর সন্তানের কাছে চলে যাওয়ার অবকাশ ছিল। হজরত মুহাম্মদ অহি নাজিলের মাধ্যমে এই সব দীর্ঘদিন চলে আসা আইনের যুগান্তকারী পরিবর্তন করে দেন। সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে সুন্নি ঘরানার আইনগুলি আগেই উল্লেখ করেছি। মালিকি ঘরানা সেই আইনের থেকে স্পষ্টভাবে যেখানে আলাদা সেটি হল দূরবর্তী আত্মীয়রা কোনও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন না যা অন্য ঘরানার নিকট বা দূর সকলের জন্য কিছু না কিছু থাকার থেকে আলাদা। মেয়ের ছেলে, ভাইয়ের মেয়ে, বোনের ছেলে, চাচা বা মামার মেয়ে, চাচা, ফুফু, মামা, খালা এই দূরবর্তী আত্মীয়র পর্যায়ে অন্তরভুক্ত। মালিকি ঘরানা বাদ দিয়ে অন্য ঘরানায় এদের সবাই কিছু না কিছু উত্তরাধিকার হিসাবে পাওয়াকে কিয়াসের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেয়। মালিকি ঘরানায় ‘উরফ’ ব্যবস্থার প্রয়োগ করে যে অঞ্চলের মানুষ ইসলামে কনভার্টেড হয়েছেন সেখানে দূরবর্তী আত্মীয়দের প্রাপ্য সম্পত্তির ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মালিকি ঘরানায় তাই উত্তর নাইজেরিয়ার হাসুয়া উপজাতির মধ্যে সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইনকেই দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্ব দেওয়া হত। সেই আইনে কৃষিজমি, কৃষি খামার, বিল্ডিং কম্পাউন্ড এর মত মুল্যবান সম্পদ উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে মহিলাদের অধিকার উপেক্ষা করে, পরিবর্তে কৃষিজমির ফসল, ফল, নগদ টাকা, গবাদি পশু উত্তরাধিকার হিসাবে পেত। অর্থনৈতিক গাছের ক্ষেত্রে ফলের একমাত্র অধিকারী মেয়েরা হলেও সেই গাছ মেয়েরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেতে পারে না। নারী ও পুরুষ দুজনেই এইসব পদার্থের ভাগ নেয় এবং একে অপরের অধিকার স্বীকার করে নেয়। নাইজেরিয়ার এই ব্যবস্থা কোরআনের আইন ও আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের সমান অধিকারের সুপারিশ দুটিই ভঙ্গ করে কিন্তু প্রচলিত রীতি হিসাবে মালিকি ঘরানা স্বীকৃতি দেয়। সুতরাং বর্তমানে একদিকে মালিকি ঘরানার উত্তরাধিকার আইন, হাসুয়া উপজাতির প্রচলিত আইন এবং আন্তর্জাতিক অধিকার সংগঠন গুলোর রীতি নীতির পরস্পর বিরোধী অবস্থানে আছে। আধুনিক মুসলিম স্কলারদের একটি অংশ ইসলামি আইনের বজ্র কঠিন আইনের মুষ্টি আলগা করার উদ্দেশ্যে ইসলামি আইনের একটি গতিশীল ধারাকে ধরতে চাইছেন। এই ধারায় ধরে নেওয়া হয় ইসলামের ইতিহাসে অতীতের সকল স্বনামধন্য আলেমরা ইসলামিক আইনের একটি গতিশীল ধারাকে ছুঁয়ে থেকে বিচার দিয়েছেন। উনবিংশ শতকের ইজিপ্টের স্কলার মহাম্মদ আব্দুহর মতে, ইস্তিস্লাহ ও কল্যাণকামী হিসাবে মাস্লাহা কে উর্ধে তুলে ধরার প্রচেষ্টা গতিশীল ইসলামি আইনের অন্যতম একটি হাতিয়ার। ধ্রুপদী ইসলামিক আইনের ধারায় ইস্তিস্লাহ এর প্রয়োগের ক্ষেত্র খুবই সীমিত ইসলামি আইন বিশারদরা মূলত কোরআনে নাজিল হওয়া সূত্র মেনে চলেন। ক্লাসিক্যাল তত্ত্ব অনুসারে ব্যক্তি মানুষের ভূমিকাকে ন্যূনতম রাখার প্রচেষ্টার অঙ্গ হিসাবে মাস্লাহার ভূমিকা গৌণ ধরা হয়। কিছু কিছু স্কলারের মতানুসারে আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে একজন বিচারক এমন কোনও আইন যদি খুঁজে পান যা আইনের ‘পাঁচটি সূত্রে’র কোনও একটিকেও সার্বজনীন নিশ্চিতভাবে ক্ষতি করবে বলে মনে হলে তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। নাজিল হওয়া কুরআনের মধ্যে সুরক্ষার এই পাঁচটি সূত্র হল, ১) জীবনের সুরক্ষা ২) বংশ ৩) সম্পত্তি ৪) ধর্ম ও ৫) যৌক্তিকতা। এমনকি কোরআনের কোনও নির্দিষ্ট আইনকেও দূরে সরিয়ে রাখা যেতে পারে যদি কোনও নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কোনও আইন অপ্রতিরোধ্য ও সার্বজনীনভাবে পাঁচটি সূত্রের কোনও একটারও ক্ষতি করে। সাদৃশ্য থেকে প্রাপ্ত আইনের যথাযথতা পরীক্ষা করা উচিত। সাদৃশ্য থেকে প্রাপ্ত আইন যথাযথ নয় যদি সেই নতুন আইনটি সুনির্দিষ্ট যে আইন থেকে নেওয়া হয়েছে সেটার মতই সামাজিক ভালত্ব দিতে না পারে অথবা আইনটি সরাসরি পাঁচটি নীতির কোনও একটির জন্যও ক্ষতিকর হলে। সাদৃশ্য (analogy) থেকে প্রাপ্ত আইনের ক্ষেত্রে সাদৃশ্যটি খুব ভালো হলেও আইনটি প্রয়োগযোগ্য না হলে দূরে রাখতে হবে। এই গবেষক ও তাঁর উত্তরসুরীরা মাস্লাহার ধ্রুপদী নীতিকে বিস্তারিত করেন। সংস্কারবাদী পদ্ধতি হিসাবে মাস্লাহা কে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা হয় যাতে বিচারকরা মৌলিক গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত সূত্র ও মানবিক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দুটিকেই বিচার্য হিসাবে নেওয়া যায়। ঐশ্বরিক কিতাব ও নবীজীর ঐতিহ্য থেকে মুসলিম আইনকানুন নির্ধারিত হলেও আইনের উৎস সম্পর্কে মানবিক ব্যাখ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ইসলামিক আইনে ইসলামিক আইন বিশারদ হিসাবে ফকিহদের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রকৃতপক্ষে, ইসলামী আইন মূলত ফকীহদের আইন, যেটি সুদূর সময়কালে মুসলিম ফকীহগণের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। সেই কারণেই আধুনিক সংস্কারবাদী মুসলিমরা মনে করেন মৌলিক টেক্সট ও হাদিসগুলির ব্যাখ্যায় মুসলিম ফকিহদের সব সময় জড়িত থাকা দরকার। তাঁরা মনে করেন ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করা উচিত হয়নি। ইশ্বরের ইচ্ছানুসারে মানুষ কীভাবে আচরণ করতে চায় তা নির্ধারণ করার পদ্ধতি হিসাবে তারা ‘তাকলিদ’ এর বৈধতাকে প্রশ্ন তোলেন। এই বিশেষ সংস্কারবাদী ধর্মতত্ত্বকে সঠিকভাবে নিও-ইজতিহাদ বলা যেতে পারে। সংস্কারবাদী পদ্ধতি হিসাবে নিও-ইজতিহাদ ১৯৭০ সালের পর উত্তর নাইজেরিয়াতে ব্যাপক জনপ্রিয় হয় এবং ইসলামিক আইন নিয়ে স্থানীয় মানুষের ধারণার বিপুল পরিবর্তন হয়। এই মতের উপর ভিত্তি করে ধর্মীয়-রাজনৈতিক সংগঠন ইজালা মৌলবাদী ঝোঁকের বিরুদ্ধে নাইজেরিয়ান মানুষদের চিন্তা ভাবনা প্রকাশ করার সুযোগ দেয়। ইজালা মেয়েদের অগ্রগতির সপক্ষে প্রচার করে যা আধুনিকতার পরিচায়ক ও আন্তর্জাতিক মানবধিকার সংগঠনের ভাবনার সাথে সাযুজ্য রাখে। এইভাবেই মুসলিম আইনকে আধুনিক মানবধিকার রীতিনীতির সাথে মিলিয়ে দিয়ে অনুশীলনের সুযোগ করে দেয়। এইভাবে আইনের সংস্কার করা সম্ভব হলেও প্রয়োগের উপর ব্যক্তি ও পরিবারের হাতে সম্পূর্ণ ছেড়ে দিলে মুসলিম সমাজ তাঁদের অভ্যাসের পরিবর্তন বাস্তবিক ক্ষেত্রে কতটা করবে সেটা দেখার জন্য রাষ্ট্রের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। রাষ্ট্র মানেই যেহেতু চাপিয়ে দেওয়া একটি যন্ত্র, ফলে আইন মাত্রেই তাই। হিন্দু সমাজের সংস্কারের জন্য যে সমস্ত আইন আনা হয়েছে, তা যারা এনেছিলেন তারা সবাই দেশের ও দশের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে এনেছিলেন তা নয়। যেমন লর্ড বেন্টিক্ট বা লর্ড ডালহৌসি বা রানী ভিক্টোরিয়া। কিন্তু সেই সব আইন যখন আর্থিক-রাজনৈতিক সার্বিক বিকাশের সাথে তাল মিলিয়ে আসে তখন তার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। রাষ্ট্রের ভূমিকা জবরদস্তি মূলক না হয়ে সহযোগিতা মূলক হওয়াটা কাম্য। তবে কিছু ক্ষেত্রে কিছুটা চাপিয়ে দিয়ে, কিছুটা সমাজের ভিতর থেকে চাহিদা হিসাবে তুলে নিয়ে আসার দরকার হয়। চাকরি-শিক্ষা-স্বাস্থ্য নিয়ে মানুষের অভাব অভিযোগ যত কমে ততোই সেই সব চাপিয়ে দেওয়া আইনকে মেনে নিতে মানুষের অসুবিধা কম হয়। সংস্কারের প্রকৃত সুফল পেতে আইনের পরিবর্তনকে ভিতর থেকেই ন্যায্যতা দিয়ে আনতে হয়। এই পদ্ধতিতেই মুসলিম সমাজের ভিতর থেকে সংস্কার কার্যকরী করিয়ে আনার প্রচেষ্টা চলছে। নারী-পুরুষের বিতর্ক ছাড়াও ডক্ট্রিনেটের ব্যবস্থার মধ্যেও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনেকে অনুভব করছেন। ডক্ট্রিনেটের সংস্কারের প্রয়োজনকে কেউ অসিওতনামা করে বা আত্মীয় স্বজনদের ভালো ভাবমূর্তির উপর ভরসা করতে বলে বিরোধিতা করলেও, আইনের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। সংস্কারের এই প্রচেষ্টা যে শুধু সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা নিয়েই হচ্ছে তাই নয়। প্রার্থনার রীতি নীতি নিয়েও সংস্কারের প্রচেষ্টা চলছে। ইসলামে নারী ও পুরুষের প্রার্থনার রীতির মধ্যে লিঙ্গ বৈষম্য আছে। মসজিদে নামাজ পড়তে নারীদের নিষেধ না থাকলেও পৃথিবীর সব দেশেই মূলত পুরুষরাই মসজিদে জামাতে নামাজ পড়েন। যেখানে মসজিদে মহিলাদের নামাজে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, সেখানেও নারী পুরুষের এক সাথে জামাত হলে নারীকে নামাজ নেতৃত্ব দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয় না। জামাতের সারি হিসাবে সকল পুরুষদের পরের সারিতে মেয়েদের দাঁড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়। নামাজের লাইনের বিভিন্ন অবস্থানের আলাদা আলাদা মর্যাদা আছে। পুরুষদের ক্ষেত্রে ইমামের ঠিক পরের লাইনের মর্যাদা বেশি পিছনের সারির তুলনায়। মেয়েদের ক্ষেত্রে সব শেষ সারির মর্যাদা পুরুষদের ঠিক পরের লাইনের থেকে বেশি। ইসলামের ইতিহাসে ২০০৫ সালের ১৮ই মার্চ এক ঐতিহাসিক দিন। এইদিন ইসলামের ইতিহাসে প্রথম বারের জন্য নিউইয়র্কে একটি নারী পুরুষের যৌথ জুম্মার নামাজে নেতৃত্ব দেন আমিনা ওদুদ নামে এক মহিলা। এই ঘটনা একদিকে যেমন ঐতিহাসিক অন্যদিকে বিতর্কিতও। এই ঘটনার প্রভাব সুদূর ইন্দোনেশিয়াতেও গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে সংস্কারবাদী মুসলিম স্কলাররা কিছু হাদিসের উদাহরণ টেনে মেয়েদের প্রার্থনায় নেতৃত্ব দেওয়ার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তোলেন। এই দাবিতে সবথেকে বেশি সোচ্চার হন একজন পুরুষ ইসলামিক স্কলার। এমনিতে ইন্দনেশিয়ায় বহু মহিলা মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করেন। এই বিতর্ক যখন তীব্র আকার নেয় তখন ইন্দনেশিয়ার সর্বোচ্চ শরিয়ত সংস্থা ফতোয়া দিয়ে মেয়েদের জামাতে নেতৃত্ব দেওয়ার অধিকারকে অস্বীকার করা হয়। নামাজ প্রার্থনায় নেতৃত্ব দেওয়াকে একটি পারফর্মিং এক্ট ধরলে বাইরের জগতে পারফর্মিং এক্টে মেয়েদের উপর ইসলাম নিষেধাজ্ঞা দিতে চায়। ভারতের মত দেশেও সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রশ্নে ইসলামিক রীতিনীতির প্রতি যারা দায়বদ্ধ থাকতে চান তাঁদের দায়িত্ব আধুনিক আন্তর্জাতিক মানবধিকার রীতিনীতির সঙ্গে সাযুজ্য রাখা আইনের পথ ইসলামি ব্যবস্থার মধ্য থেকে খুঁজে বার করে নিয়ে আসা। পরকাল নিয়ে চর্চা করার ব্যাপক তাগিদ থেকে গত শতক থেকে তবলীগই জামাত ইসলামিক রীতির পিউরিটান সংস্কার করার কাজে নিয়োজিত আছে। আসলে ইসলাম বর্তমানে যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় ইসলাম খুবই ভালনারেবল হয়ে আছে। তাই ইসলাম ধর্মের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা এরকম নানা দেশ ও সমাজ থেকেই উঠে আসছে। ভারতে তবলীগই জামাত তারই এক ধারার প্রকাশ। মানবধিকার প্রশ্নে বা লিঙ্গ বৈষম্য কমিয়ে আধুনিকতার সঙ্গে তাল ন্যূনতম রীতিনীতি পরিবর্তন বা সংস্কার করার এজেন্ডা তাঁদের এখনও নিতে দেখা যায়নি। সংস্কার করে অতীতের ইসলামিক অবস্থায় কতটা পৌঁছানো সম্ভব সেই নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ করা যেতেই পারে। তাই সংস্কারের অভিমুখ অতীতের দিকে হবে নাকি ভবিষ্যতের দিকে হবে সেটা ইসলামিক ধর্মতত্ত্ববিদদের ঠিক করতে হবে। সম্পত্তির লিঙ্গ নিরপেক্ষ সমবন্টনের আইনি স্বীকৃতির জন্য অন্য কোনও সংগঠন তৈরি হয়ে এই দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে যাবেন কিনা আমি জানি না, তবে হয় মুসলিম সমাজের অভ্যন্তর থেকে অথবা ধর্মীয় রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে অন্য কোনও ক্ষেত্র থেকে লিঙ্গ সাম্যের আইন প্রতিষ্ঠিত যে হবেই সে নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। 
ধর্মীয় সংগঠনের বাইরে থেকে সংস্কারের সম্ভাবনা:
ধর্মীয় রীতিনীতির বাইরে থেকে নারী পুরুষের সমানাধিকারের প্রশ্ন বিপুল সংখ্যক আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নারী ও পুরুষ সচেতন প্রচেষ্টার মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাছ থেকে অধিকার হিসাবে ছিনিয়ে নিতে পারে। ইসলামিক জগতের বাইরে গত শতাব্দীর শেষ দশকে হংকং এ নারী আন্দোলনের মাধ্যমে সম্পত্তিতে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়াটি আলোচনা করা যেতে পারে উদাহরণ হিসাবে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে সম্পত্তিতে মেয়েদের উত্তরাধিকারে সমানাধিকার নিয়ে তীব্র চর্চা শুরু হয়। সেই সময় হংকং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা থেকে রূপান্তরিত হচ্ছিল। হংকং এর আশেপাশে চীন, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম এরকম অনেক দেশেই পৈতৃক সম্পত্তিতে মেয়েদের সমানাধিকার স্বীকৃত হলেও হংকং এর নিউ টেরিটোরি অঞ্চলে পৈতৃক সম্পত্তিতে মেয়েদের কোনও অধিকার ছিল না। হংকং এর সেই অঞ্চলের মাত্র একজনের একটি ঘটনা থেকে কীভাবে নারী আন্দোলনের এক সুনামির সৃষ্টি হয় এবং শেষ পরিণতি হিসাবে সম্পত্তির উত্তরাধিকারে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, সামাজিক প্রক্রিয়া ও গতিশীলতা নিয়ে উৎসুক যে কোনও মানুষের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে। ১৯৯৪ সালে আইন পরিবর্তন করার দাবিতে একদল গ্রামীণ আদিবাসী মহিলা হংকংয়ের মহিলাদের দলগুলির সাথে যোগ দিয়েছিলেন। এই আন্দোলন একটি অধিকার আন্দোলন নিয়ে বিশ্বব্যাপী মতাদর্শ কীভাবে দুনিয়াজোড়া দাবি-দাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে এক ধরণের সংহতি নির্মাণ করছে তার এক আদর্শ পাঠ্যবিষয়। আন্তর্জাতিকভাবে নারীর উত্তরাধিকারের আন্দোলনগুলি অনেক স্বতন্ত্র স্তরের জোট হিসাবে দেখা হয়। 
একটি ধারণা প্রচলিত যে বিশ্বব্যাপী ধারণার প্রচলন সাংস্কৃতিক একজাতীয়তা বৃদ্ধি করছে। হংকং মহিলা আন্দোলনের অনুঘটক ছিলেন লাই-শেইংচেং নামে এক আদিবাসী মহিলা। কোনো উইল ছাড়া (আমাদের দেশেও উইল না করার সংখ্যাটাই বেশি) চেং এর বাবা মারা যান তখন স্বাভাবিকভাবে তাঁর দুই ভাই বাড়ির দখল পান। ১৯৯১ সালের মে মাসে তাঁর দুই ভাই বাড়িটি এক প্রোমোটারকে বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সম্পত্তির মালিকানার অধিকার না পেলেও সেখানের কাস্টমারি আইন অনুযায়ী অবিবাহিত মেয়ে তাঁর পৈতৃক বাড়িতে আজীবন বসবাস করার অধিকারী। চেং দাবি করেন সম্পত্তি বিক্রির একটি অংশ তিনি না পেলেন বাড়িটির দুইতলায় যে ঘরে তিনি থাকতেন সেটি তিনি ছাড়বেন না। দেশে দেশে দুর্জন প্রমোটারের মতই সেই প্রোমোটার মিস চেং কে বহিষ্কার করতে উৎপাত শুরু করেন। মাঝে মাঝেই তাঁর বাড়িতে প্রোমোটারের লোক ঘরে ঢুকে ইঁদুর ছেড়ে দিয়ে আসতো বা দরজায় জানালায় পেচ্ছাব করে দিয়ে চলে আসতো। ব্যাপারটা একজন বাউন্ডুলে দুর্বৃত্তের আর একজন মহিলার উপর তাণ্ডব ছিল। এই তান্ডব ও উৎপাত এতটাই মাত্রা ছাড়ায় যে মহিলাকে প্রতি রাত্রেই পুলিশে খবর দিতে হত। তারপর একদিন তিতিবিরক্ত হয়ে হংকং এর গভর্নরকে চিঠি লেখেন কোনও সাড়া না পেয়ে সমস্ত কিছুর বর্ণনা করে একটি চায়না পত্রিকায় চিঠি লেখেন। পত্রিকা চিঠিটি প্রকাশ না করে হংকঙের একটি মহিলা সংগঠনের নেত্রী লিন্ডা ওয়ং এর সঙ্গে মিস চেং এর যোগাযোগ করিয়ে দেন। মহিলা সংগঠনের সেই নেত্রীরা তখন মহিলাদের দাবি দাওয়া নিয়ে একটি কমিশন প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছিলেন। চেং মহিলা সংগঠনের নেত্রী লিন্ডার সঙ্গে দেখা করে তাঁদের আদিবাসী সমাজের আরও বেশ কয়েকজন একই রকম পরিস্থিতিতে আছেন সেটি জানান। ১৯৯৩ সালের শেষ দিকে সেইসব আদিবাসী মহিলাদের একত্রিত একটি মিটিং হয় এবং ইস্যুটি শক্তপোক্ত ভাবে ফ্রেমিং করা শুরু হয়। একদিকে গ্রামীন আদিবাসী মহিলাদের রুটি রুজি ও প্রাণের ইস্যু, পিছনে হংকং এর আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত গ্লোবাল মহিলাদের সাপোর্ট। আদিবাসি মহিলারা যে পরিমাণ নিজেদের মধ্যে সংগঠিত হচ্ছিল তার সাথে বিষয়টি রাজনৈতিক চর্চার কেন্দ্রের দিকে আসতে শুরু করে। প্রায় এক দশক থেকে ঐ অঞ্চলের মহিলাদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে বৈষম্যের শহুরে চর্চা ছিলই, সেই সময় তা নতুন গতি পেয়ে যায়। ১৯৯১ সালের  হংকংয়ের মহিলা পরিষদের জেনেভায় মানবধিকার কমিটির কাছে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিআর) সঙ্গে সাযুজ্য রেখে একটি প্রতিবেদনের পরে নারীর উত্তরাধিকারের বিষয়টির চর্চা আরও বেড়ে যায়। এই প্রতিবেদনটির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পৈতৃক সম্পত্তিতে নারীর অধিকারের বিষয়টিকে মানবধিকারের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া। প্রতিবেদনের চার জন লেখিকার প্রত্যেকের পশ্চিমি আধুনিক শিক্ষার একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল। তাঁদের মূল বক্তব্য ছিল পুরুষ কেন্দ্রিক উত্তরাধিকার জাতিসংঘের বৈষম্য মূলক নীতির বিরুদ্ধে যায়। হংকং এর আইনসভায় এই একাডেমিক ব্যক্তিরা ফরমালি অভিযোগ জানান। একদিকে আইনসভায় তর্ক বিতর্ক, সংবাদ পত্রে প্রবন্ধ রচনা চলে, অন্যদিকে মানুষের মধ্যে মহিলা আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে The Anti-Discrimination Female Indigenous Residents Committee নামে একটি কমিটি তৈরি হয়। প্রথম দিকে এই সংগঠনে যে সব আদিবাসি মহিলারা চেং এর মত দুরবস্থায় ছিলেন সেটিকে একান্ত ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের পৈতৃক বা বৈবাহিক আত্মীয়-স্বজনদের করা ব্যক্তিগত অবিচার বলে ধরে নিতেন। আইনসভার বাইরে মহিলা সংগঠনের নেত্রী ওয়ংরা এইসব মহিলাদের নিয়ে প্রথম যে জনসভাটি করেন তার আগে পর্যন্ত এই মহিলারা আইন পরিবর্তন করে নিজেদের দুর্দশার কথা ভাবেননি, তখনো পর্যন্ত তাঁরা আত্মীয়-স্বজন কর্তৃক অন্যায় ও অবিচারের থেকে একটু ন্যায় চাইতেন। আত্মীয় স্বজনদের কাছে রক্তের সম্পর্ক থেকে ন্যায় পাওয়া তাঁরা দয়া বা করুণা হিসাবেই দেখছিলেন, সমানাধিকারের ভিত্তিতে নয়। মহিলা সংগঠনের নেতৃত্বে এই আদিবাসী মহিলারা তাদের আত্মীয়তার অভিযোগগুলি অধিকার এবং সাম্যের ভাষায় অনুবাদ করতে শিখলেন। এই শিক্ষাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন ছিল, নিরন্তর রাজনৈতিক প্ররোচনার মাধ্যমে সাফল্য ছুঁতে হলে মহিলাদের প্রয়োজনটা যারা শুনছেন তাঁদের কাছে ঠিক ভাষায় পৌঁছানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইনসভা বা মিডিয়া পারিবারিক কোলাহল বা কাদা ছোড়াছুঁড়ি শুনতে পছন্দ করবে না বরং ব্যাপক অর্থে লিঙ্গ সাম্য, মানবধিকার নামক শব্দগুলি শুনতে অনেক স্বচ্ছন্দ হবে। মহিলাদের ব্যক্তিগত অভিযোগ ও আবেগ অতিক্রম করে তথাকথিত “অভিজাত” ভঙ্গিতে নিজেদের উপস্থাপন করতে “elitist and rational pose” দিতে “শিখতে হয়েছিল”। যদিও মহিলা সংগঠনের নেত্রীরা দাবি করেছিলেন আদিবাসী মহিলারা নিজেরাই সব কিছু শিখে নিয়েছিলেন, শহরের মহিলা সংগঠন শুধু কিছু রিসোর্সের জোগান দিয়েছিল, তবু ব্যাপারটা অবশ্যই অনেক জটিল। আদিবাসী মহিলাদের দুঃখের গল্পগুলিকে ঠিক ঠাক ফ্রেমিং করতে রাজনৈতিক ভাষায় বহিরাগতরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন গল্পগুলিকে সাধারণীকরণ এর মাধ্যমে অধিকারের ভাষায় ট্রান্সলেট করতে। এই মহিলা নেতৃবৃন্দরা আদিবাসী মহিলাদের পাবলিকলি কথা বলার সময় স্ল্যাং না ব্যবহার করাও শিখিয়েছিলেন। তাঁদের সমস্যা নিয়ে মধ্যস্থতাকারী বা একটু আধটু সুবিধা পাওয়ার পরিবর্তে অন্যায্য আইনের ব্যাপক পরিবর্তনের পক্ষে সওয়াল করতে শেখেন। অনেক অনুষ্ঠানেই গ্রুপের বহিরাগত মহিলারা আদিবাসী মহিলাদের কীভাবে মিডিয়া সামলাতে হবে, বিশেষ করে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দিতে হবে ধরে ধরে শিখিয়ে ছিলেন। তাঁরা চেয়ে ছিলেন যে মহিলারা তাদের ব্যক্তিগত গল্প বলার চেয়ে  স্ট্যান্ডার্ড দাবির পুনরাবৃত্তি করুক যাতে আন্দোলনটি কেবল ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার অনুপ্রেরণার দিকটি সবার আগে উপস্থিত না হয়। বিশেষ করে তাঁদের অনেককে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় যে, ‘আপনার মত মহিলার পৈতৃক সম্পত্তির কোনও দরকার হওয়ার কথা নয়, তবু আপনি এই আন্দোলনের সমর্থনে দাঁড়াচ্ছেন কেন’, ‘আপনার নিজের জীবনে এমন কী অভিজ্ঞতা হয়েছে যে বাপের সম্পত্তির জন্য এরকম উঠেপড়ে আপনাকে নামতে হয়েছে?’ এক অধিবেশনে, সমাজকর্মীরা  এই প্রশ্নটি করার  সময় সাংবাদিকদের সুর অনুকরণ করেছিলেন এবং একজন মহিলার দেওয়া প্রতিক্রিয়াটি রেকর্ড করে ছিলেন। তারপরে তিনি সেই রেকর্ডটি অন্য মহিলাদের মাঝে শুনিয়ে ব্যাখ্যা করতে থাকেন একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত কাহিনীকে বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে তুলে ধরার কী রকম অসীম প্রভাব হতে পারে। এইভাবে মানবধিকার ও সাম্যের প্রশ্নে উদবুদ্ধ করার ফলে সেই গ্রুপের একজন মহিলা পালিত কন্যা হয়েও তাঁর পালিত পিতার ঔরস জাত সন্তানের কাছ থেকে পৈতৃক সম্পত্তির দাবি রাখেন। এছাড়া মহিলা সংগঠন তাঁদের দাবি দাওয়া নিয়ে শিল্প, সাহিত্য, পপুলার ডিমনেস্ট্রেশন এ ভূমিকা তো রেখেই ছিলেন। ঐতিহ্যের ধ্বজা ধরে, প্রাচীন সংস্কৃতির নাম করে, আইন সংস্কারের বিরুদ্ধে যা কিছু বিরোধী মতামত ছিল সব পরাস্ত হয়। টিভি প্রোগ্রাম, গল্প, নাটক সব কিছুতেই একমাত্র পুরুষ এর মারফত বংশ পরম্পরায় উত্তরাধিকারের রীতিকে ব্যাকডেটেড, ফেউডাল ব্যবস্থা হিসাবে চিহ্নিত হতে থাকে, অন্যদিকে মহিলাদের দাবিদাওয়া গুলি আধুনিকতা ও প্রগতি হিসাবে চিহ্নিত হয়, আদিবাসীদের পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার না থাকাকে “ট্র্যাডিশন” ও “পুরুষতান্ত্রিকতার” শিকার হিসাবে ধরা হতে থাকে। আইন সংস্কারের বিপক্ষে যারা ছিলেন তাঁরা প্রথম থেকে দেখাতে চাইছিলেন, যে পরিবারে শুধু মহিলা সন্তান আছে এবং ঐ বিশেষ কিছু আদিবাসীদের সমস্যা, কয়েকজনের সমস্যা। এগুলির সমাধান কেস বাই কেস ধরেই করে দেওয়া যায়। মেয়েরা বিয়ের পর যেহেতু অন্য সংসারে চলে যায় তাই সার্বজনীন ভাবে মেয়েদের জন্য সমানাধিকারের দরকার নেই। মহিলা সংগঠনের প্রতিষ্ঠিত একডেমিসিয়ানদের নিরন্তর পরিশ্রমের ফলে ততদিনে আদিবাসী মহিলারা নিজেদের কথাকে সাধারণীকরণ করে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে নিজেদের ভাষায় বলতে শিখে গিয়েছিলেন। আইনসভার বেশ কয়েকজন এই সময় এই সময় আদিবাসীদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে চকিত হয়ে গিয়েছিলেন। বহিরাগত মহিলাদের প্রভাবে আইন পরিবর্তনের এই আন্দোলনকে অনেকেই আদিবাসী মহিলাদের রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার হিসাবে অভিযোগ খুব সহজেই করতেই পারেন, কিন্তু সেই অভিযোগ ধোপে টেকে না কারণ সময়ের সাথে আদিবাসী মহিলারা নিজেরাই স্ট্রাটেজি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে থাকেন। যেমন আন্দোলন নিয়ে গান রচনার চিন্তা আদিবাসী মহিলারা নিজেরাই করেন। আদিবাসী মহিলাদের বানানো ট্র্যাডিশনাল গান এই আন্দোলনে আইকনিক মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছিল। এই মহিলারা যখন তাঁদের সমস্যাগুলি জ্ঞাতিবর্গ মানুষদের বঞ্চনার কাহিনী থেকে মৌলিক অধিকার প্রশ্নে বৈষম্য ও লিঙ্গ অসাম্যের ধ্যানধারণাকেও অঙ্গীভূত করে নেন তখন সেটি চেতনার নতুন স্তরে পৌঁছে যায়। চেতনার নতুন স্তরে পৌঁছেও এই মহিলারা কিন্তু তাঁদের পুরুষ আত্মীয়দের করা অবিচারের কথা কোনও সময়ের জন্য বিস্মৃত হননি। যেহেতু চেতনা একটি অস্পষ্ট শব্দ যাকে পরিমাপ করা যায় না, তাই ঠিক কীভাবে লিঙ্গ-সাম্যের ধারণায় এই মহিলারা নিজেদের মিশিয়েছিলেন সেটা বলা খুব কঠিন। এই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আগে অনেক মহিলাই ছিলেন যারা “gender discrimination”, “injustice” শব্দগুলি কখনো শোনেন নি। কিছু আদিবাসী মহিলাদের সমস্যা যেভাবে উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তনের দাবিতে উন্নীত হয়েছিল, সেই গল্পটি দেখায় যে স্থানীয় অভিযোগগুলির মোকাবেলায় কীভাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের প্রশ্নকে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এই যাত্রা শুধুই কিছু শহুরে বহিরাগত এলিট মহিলার অধিকার আন্দোলনের বাচনকে ইম্পোজ করার মত সরলও ছিল না। আসলে অধিকার আন্দোলনের ভাষার বহু গ্রহণ, বর্জন, উপেক্ষা, পরিবর্তনের মাধ্যমে আত্মিকরণ হয়েছিল। যারা একাডেমিক্যালি চর্চা করেন তাঁরা এই আন্দোলনটিকে তিনটি লেয়ারের গুরুত্বপূর্ণ সম্মিলনের ফল হিসাবে দেখেন-- 
১) প্রবাসী মানুষরা বিষয়টিকে চর্চার মূল কেন্দ্রে নিয়ে আসতে ভূমিকা নিয়েছিলেন, এঁরা মূলত একডেমিক ও আইনজীবী ছিলেন যারা আদিবাসী অনেক মহিলাদের আইনি সহায়তা দিতেন। 
২) আইনসভা, বিষয়টি যখন আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যায় তখন আইনসভার সদস্যরা আইন পরিবর্তনকে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার প্রশ্নের মধ্যে নিয়ে চলে আসেন, যা আইন পরিবর্তনের পক্ষকে শক্তিশালী করে। 
৩) মহিলা সংগঠন গুলি, যারা আইনসভা, আদিবাসী মহিলা এবং আন্দোলনের মধ্যে যোগসূত্র নির্মাণ করেন। আর, সবার উপরে ছিল--
৪) আদিবাসী মহিলারা যারা এই আন্দোলনের সব থেকে নীচের শ্রেণি।
হংকং এর এই আন্দোলনকে খুঁটিয়ে পাঠ করার পরে আমরা আবার আমাদের দেশের আলোচনায় ফিরে আসলে, চেং এর মত একজন ব্যক্তি বা তাঁর সঙ্গে আরও বেশ কিছু মানুষ যেভাবে আত্মীয় পরিজনদের অন্যায়ের স্বীকার হয়েছিলেন সেরকমই ঘটনা কি আমরা দেখতে পাই না? যেভাবে তিনতালাক নিয়ে কিছু মানুষের সমস্যা কয়েক বছর ধরে ভারতে চর্চিত ছিল, সেটিকে মূলধারার ইসলামিক সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গেরা বলতে থাকেন ‘কয়েক জন মানুষের করা অপরাধ, বা ইসলামি আইনও অমান্য করা কিছু ব্যক্তির অপরাধ যা মুসলিম সমাজের বাইরেও অনেকে করে থাকেন ও পার পেয়ে যান’। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে ইসলামি আইন মানা কোনও সংগঠনকে অধিকার আন্দোলনের প্রশ্নে সেই দুর্ভাগা মহিলাদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। এমনকি অন্যায়ভাবে তিন তালাকের শিকার মহিলাদের ইস্যুটি তথাকথিত প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক শিবির যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে নিতে না পারলেও বিজেপি নিয়েছিল এবং ভিক্টিমরা মিডিয়ার সামনে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে অনেক জড়তার সম্মুখীন হতেন, এই বুঝি তাঁদের কোনও কথা বিজেপি এনক্যাশ না করে নেয়। হংকং এর উদাহরণে আইন পরিবর্তন না করে বিচার ব্যবস্থার মধ্যে থেকে কেস বাই কেস বিচারের ব্যবস্থা একদম ছিল না তা নয়, তবু তাঁরা সেই সমস্যাটা কেস বাই কেস সুবিচারের পথে না গিয়ে তাঁরা সার্বিক আইন পরিবর্তনের পন্থাটি গ্রহণ করেন। ইসলামি আইন সম না সুষম সেই বিতর্কে না গিয়ে ইসলামের ভিতর থেকে সম্পত্তির প্রশ্নে লিঙ্গ সাম্যের প্রশ্নটি ধর্মীয় আইনের নতুন ব্যাখ্যার মাধ্যমে উত্থাপিত না হলে সেটি ইসলামের বাইরে কোন পথে হবে আমি জানি না। এটা ঠিক, বঞ্চনা যদি একিউট না হয় তাহলে মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্খার আগুন সহজে জ্বলে ওঠে না। যেসব সমাজে শুধুই পুরুষ লাইন ধরে বংশ পরম্পরায় সম্পত্তির উত্তরাধিকার ট্র্যাডিশনের নামে দীর্ঘদিন চলে এসেছে সেখানে আইন পরিবর্তন করে সমান অধিকারের প্রশ্নটি অনেক সহজে রাখা গেছে ও আইন পরিবর্তন সহজ হয়েছে। ভারতের মত সুজলাং শস্য শ্যামলাং দেশে বেঁচে থাকা অনেক দেশের তুলনায় সহজ হওয়ায় সামজিক উথাল পাথাল হওয়ার সম্ভাবনা সব সময় একটু কম থাকে। মুসলিম সমাজে মেয়েরা কয়েক শতাব্দী আগেই কিছুটা হলেও পৈতৃক সম্পদের অধিকার পেয়েছেন তাই সেটিকে সমানাধিকারে প্রশ্নে নিয়ে যেতে যে পরিশ্রম ও উদ্যোগ থাকা দরকার সেটি এখনও সম্মিলিতভাবে হয়ে উঠছে না।  মুসলিম সমাজ থেকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এলিট মুসলিমরা আইন পরিবর্তনের পক্ষে জনমত তৈরি করবেন নাকি বিজেপির মত কোনও রাজনৈতিক দল তিন তালাকের মত তাঁদের হয়ে আইন নিয়ে আসবে সেই অপেক্ষায় থাকবে, সেটা অনাগত ভবিষ্যৎ বলবে। 
আইন পরিবর্তন ও তারপর: 

আমার নিজস্ব ধারণায় আইন আজ না হয় কাল পরিবর্তন হবেই, কিন্তু মূল প্রশ্ন তখন ফিরে আসে যে বাস্তবিকতার বদল কীভাবে হবে? যে বাস্তবিকতার বদল না হলে ২০০৫ সালে হিন্দু আইনের সংস্কার করে সমানাধিকার স্বীকৃত হয়েছে তারপরেও প্রকৃত পক্ষে মেয়েদের হাতে পৈতৃক সম্পত্তি, বিশেষ করে কৃষি জমি আসেনি। এর কারণ ট্রাডিশনালি দুই ভাই হলে পৈতৃক সম্পত্তিকে দুইভাগ করার মধ্যে কোনও ভাই লজ্জা পায় না, কিন্তু এক ভাই ও এক বোন হলে এবং বোন ভাইয়ের কাছ থেকে অর্ধেক সম্পত্তির দাবি করলে সেটি সমাজের চোখে ঘৃণিত হয়। বোনকে লোভী, স্বার্থপর হিসাবে চিত্রিত হতে হয়। তাই, আইন হলেও যতক্ষণ সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইনকে অধিকার প্রশ্নে দেখা না হচ্ছে, আইন থাকলেও বোনেদের ন্যায্য সম্পদে সেইভাবে দাবি জানাতে দেখা যাবে না। পরিবারের সংজ্ঞা বদলে গিয়ে বা সংক্ষিপ্ত হয়ে গিয়ে যখন সন্তান সংখ্যা এক বা দুইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় তখন পৈতৃক সম্পত্তির ইস্যুটি শুধু মেয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, সেটি বৃদ্ধ বাবা মায়ের জন্যও ইস্যু হয়ে যায়। ভবিষ্যতে কখনো যদি জমি জায়গার প্রশ্নে ব্যক্তিগত সম্পদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় তখনকার ব্যবস্থা যেমনই হোক, যতদিন ব্যক্তিগত সম্পদের ব্যবস্থা থাকবে ততদিন সম্পদ মানুষ সঞ্চয় করে অনাগত ভবিষ্যতের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে। বংশ পরম্পরায় পরের প্রজন্ম বৃদ্ধ অবস্থায় তাঁদের দেখবেন এই আশাতে আগের প্রজন্ম সম্পদের সঞ্চয় করেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিয়ে মানে শুধুমাত্র ভাই ও বোনের মধ্যে বোনটিকেই অন্য বাড়িতে উঠে যেতে হবে এই ব্যবস্থার বদল হতেই পারে। ভাই ও বোনের মধ্যে কেউ অন্য বাড়িতে উঠে যাবেন, নাকি বোন বিয়ে করে তাঁর স্বামীকে সেই বাড়িতে নিয়ে আসবেন এবং ভাই ও বোন পাশা পাশি পৈতৃক বাড়িতে বসবাস করবেন বা ভাই বিয়ে করে তাঁর বউয়ের বাড়িতে উঠে যাবেন এগুলির একান্তই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হতে পারে। প্রবন্ধের প্রথমেই যেমন উল্লেখ করেছিলাম, বিয়ের পর একজন একটি পরিবারের থেকে দুটি পরিবারের সদস্য হতে পারেন। এখন বহু পরিবারে বৃদ্ধ বাবা মায়ের দেখভাল এর দায়িত্ব উপার্জনশীল কন্যা নিলেও গৃহবধূ কন্যারা ব্যতিক্রমী স্বামী ছাড়া ইতস্তত করেন বা নিতেই পারেন না। অনেক বৃদ্ধ বাবা মাও মনে করেন বিয়ে হয়ে যাওয়া মানে তাঁদের কন্যা অন্য পরিবারের হয়ে গেছে, যেহেতু মেয়ে তাঁর সম্পদ সেইভাবে পায় না, তাই বাবা মা মেয়ের কাছে গিয়ে থাকতে ইতস্তত করেন, এরফলে অনেক ক্ষেত্রে ছেলে দুর্ব্যবহার করলেও সেসব সহ্য করে হলেও ছেলের কাছেই থাকতে বাধ্য হন। তাঁরা মনে করেন যেহেতু তাঁর সম্পদ ছেলেই পাবে তাই অপমানিত হলেও ছেলের কাছে থাকেন। অনেক মেয়ে আজকাল নিজে থেকেই বৃদ্ধ বাবা মায়ের দায়িত্ব নিলেও যতদিন সম্পত্তির অধিকার থেকে মেয়ে বঞ্চিত থাকবে ততদিন মেয়ের কাছে বৃদ্ধ বাবা মায়ের দেখাশোনা ঐচ্ছিক প্রশংসনীয় কাজ হয়ে থাকবে, কর্তব্যের পর্যায়ে পৌঁছাবে না। পৈতৃক সম্পদের সমান উত্তরাধিকার যেমন লিঙ্গ সাম্যের প্রশ্ন, বার্ধক্যে বৃদ্ধ বাবা ও মায়ের দেখাশোনা করা ছেলে ও মেয়ে উভয়ের জন্য অবশ্য কর্তব্য। আর এই সমানাধিকারের প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের দেশে সবার আগে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে প্রতিষ্ঠিত মহিলাদের এগিয়ে আসতে হবে। পৈতৃক সম্পত্তির প্রয়োজন থাক বা না থাক, সেই অধিকার উপভোগ করে সামাজিক ট্যাবুকে দূর করার দায়িত্ব নিতে হবে। ভাইয়ের কাছ থেকে সম্পত্তি বুঝে নেওয়া যাতে ঘৃণ্য বা লজ্জাজনক না হয়। এইভাবে বিয়ের পর এক পরিবার থেকে দুই পরিবারের সদস্য হয়ে নারী ও পুরুষ উভয়ের দুই বাড়িতেই একটি করে একদম নিজস্য ঘর বুঝে নিতে হবে। সম্পদের এই অধিকার মেয়েরা বুঝে নিতে পারলে ওয়ার্কিং মহিলা বা গৃহবধূ যাই হন, একজন মহিলার তার নিজের যে কোন একটি ঘরে যাওয়ার জন্য শ্বশুর বাড়ির লোকেদের অনুমতি নেওয়ার প্রচলিত রীতিকে মুছে ফেলা সম্ভব হবে। আর মেয়েদের বাবা মা-দের ভূমিকা এক্ষেত্রে ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ। বাবা মায়েরা ছেলেদেরকে যেভাবে মানুষ করেন তার মধ্যেও বদল আনার দরকার। রোজগার, সম্পত্তি নিয়ে ভাবনা ছেলেদের মাথায় যতটা ঢোকানো হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদের মাথায় সেটা ঢোকানো হয় না। বিয়ের আগে মেয়ের প্রয়োজন বাবা মেটাবে আর বিয়ের পর স্বামী, এই ভাবনা যাতে কোনভাবে মেয়েদের মাথায় না ঢোকে সে বিষয়ে সচেতন থাকা দরকার। দেশে যতদিন ব্যক্তিগত সম্পদ সৃষ্টি বেআইনি নয় মেয়েরা সম্পদ সৃষ্টি, সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়াকে যেন নিচু চোখে না দেখে। এখনো মেয়েরা শ্বশুরের সম্পত্তিরও অধিকারী নয়। তাই স্বামীর সাথে সংসার করতে গিয়ে অত্যাচারিত হলে, সে যাতে নিশ্চিন্তে মা বাবার কাছে ফিরে আসতে পারে সেই ব্যাপারে তাদের অত্যন্ত যত্নশীল হতে হবে। যদিও এখন ভারতে ডিভোর্সের মামলা মেয়েটি শ্বশুড়বাড়িতে থেকেই চালাতে পারে, কিন্তু মেয়ের বাবা মা-র দায়িত্ব অনেক। মুসলিম ও হিন্দু মেয়েরা একইসাথে সম্পত্তির অধিকার নিয়ে আলোচনা শুরু করুক। আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিক, হংকং এর  আন্দোলনের আলোচনায় যা লিখেছিলাম, এই লড়াই শুধু আদালত বা শুধু ভুক্তভোগীর ব্যাপার নয়। সমাজের প্রতিটা স্তরের ভূমিকা আছে। সমাধান ধর্মীয় সংস্কারের মধ্যে হবে নাকি নারীবাদী আন্দোলনের সাফল্যের উপর চেপে হবে সেটা বোঝা না গেলেও একটা স্পষ্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের দায়িত্ব যে নিতেই হবে সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ক্ষমতার রাজনীতি ও সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার আন্দোলনের রাজনীতি বিচ্ছিন্ন নয়। নারীবাদী আন্দোলনের তৃতীয় ঢেউ নারী পুরুষের মধ্যে একটা বিভাজন সৃষ্টি করলেও দ্বন্দ্বমূলক ঐক্যের নিরিখে নারী ও পুরুষকে পাশাপাশি আসতে হবে। যে সব মুসলিম পুরুষরা ভারতের রাজনীতিতে মুসলিমরা প্রান্তিক হয়ে যাচ্ছেন বলে চিন্তিত হবেন রাজনৈতিক অভিমুখ বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখবেন তাঁদের সমাজে মেয়েদের প্রান্তিক হয়ে যাওয়া নিয়েও ভাবতে হবে। ভাইদের স্বামীদের অনেক বেশি সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। কয়েক হাজার বছরের পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি এক প্রজন্মের শিক্ষা ও চেতনা দিয়ে ব্যক্তি মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সেখানে রাজনৈতিক সংগ্রামে যুক্ত প্রতিটি পুরুষকে নারীবাদের মৌলিক প্রশ্নগুলিকে নিয়ে এগিয়ে চলতে হবে। নিরন্তর পুরুষের নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই গুরুত্বপূর্ণ, আধুনিক স্ত্রী যেমন নিজের সম্পত্তির বিষয়ে সচেতন থাকবে স্বামীকেও সচেতনভাবে স্ত্রীর সম্পদের প্রশ্নগুলি নিয়ে চর্চা করতে হবে। নারীবাদ যে শিক্ষা দিতে চেয়েছিল, গৃহকাজে পুরুষ ও মহিলাদের সমান তালে হাত লাগানো শিখতে হবে। রাজনৈতিক কর্মী ভাইদের সচেতন ভাবেই বোনেদের সম্পত্তির অংশ বুঝিয়ে দিতে হবে। বোনেরা যাতে ভাইয়ের কাছে সম্পত্তির ভাগ নিতে কুণ্ঠিত না হয় তাঁর জন্য হাজারে হাজারে উদাহরণ সমাজ জুড়ে তৈরি করতে হবে। উচ্চ শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত নারী পুরুষ, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোনদের মধ্যে আপাতভাবে কোন একজনের পৈতৃক সম্পত্তির প্রয়োজন না থাকলেও সামাজিক দৃষ্টান্ত তৈরি করতে এর অনুশীলনগুলি দরকার। তবেই আইন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরেও বাস্তবে মেয়েদের অধিকার সুনিশ্চিত করা সম্ভব হবে এবং তথাকথিত শিক্ষিত ও আধুনিক মহিলাদের দৃষ্টান্ত প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র ও অল্পশিক্ষিত মহিলাদের স্বপ্ন দেখতে শেখাবে। এই ভাবেই নিরন্তর আমরা লিঙ্গ বৈষম্যের মান ক্রমাগত কমানোর লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারবো।

———-

তথ্যসুত্রঃ

Addo, Fenaba R., and Daniel T. Lichter. 2013. “Marriage, Marital History, and Black – White Wealth Differentials among Older Women.” Journal of Marriage and Family 75 (2): 342–362. doi:10.1111/jomf.12007.

Afshar, Haleh. 1982. “Sage Publications, Ltd.” Feminist Review 12 (12): 59–72. https://www.jstor.org/stable/1394882.

Arnez, Monika. 2018. “EMPOWERING WOMEN THROUGH ISLAM : FATAYAT NU BETWEEN TRADITION AND CHANGE Author ( s ): MONIKA ARNEZ Source : Journal of Islamic Studies , Vol . 21 , No . 1 ( January 2010 ), Pp . 59-88 Published by : Oxford University Press Stable URL : Https://Www.Jstor.” 21 (1): 59–88. doi:10.1093/iis/etp025.

“At the Intersection of Scripture and Law : Qur ’ an 4 : 34 and Violence against Women Author ( s ): Shannon Dunn and Rosemary B . Kellison Source : Journal of Feminist Studies in Religion , Vol . 26 , No . 2 ( Fall 2010 ), Pp . 11-36 Published by : Indian.” 2018 26 (2): 11–36.

Bishin, Benjamin G, and Feryal M Cherif. 2020. “Women , Property Rights , and Islam Author ( s ): Benjamin G . Bishin and Feryal M . Cherif Source : Comparative Politics , Vol . 49 , No . 4 ( July 2017 ), Pp . 501-519 Published by : Comparative Politics , Ph . D . Programs in Political Science , City U” 49 (4): 501–519.

Deininger, Klaus, Aparajita Goyal, Hari Nagarajan, and Klaus Deininger. 2019. “Women ’ s Inheritance Rights and Intergenerational Transmission of Resources in India Stable URL : Https://Www.Jstor.Org/Stable/23799109 Women ’ s Inheritance Rights and Intergenerational Transmission of Resources in India” 48 (1): 114–141.

Doumato, Eleanor Abdella. 2016. “Women and Work in Saudi Arabia : How Flexible Are Islamic Margins ? Author ( s ): Eleanor Abdella Doumato Published by : Middle East Institute Stable URL : Http://Www.Jstor.Org/Stable/4329391 Accessed : 12-06-2016 14 : 43 UTC Your Use of the JSTOR Archive” 53 (4): 568–583.

Hager, Anselm, and Hanno Hilbig. 2019. “Do Inheritance Customs Affect Political and Social Inequality?” American Journal of Political Science 63 (4): 758–773. doi:10.1111/ajps.12460.

Hansen, M. N. 2014. “Self-Made Wealth or Family Wealth? Changes in Intergenerational Wealth Mobility.” Social Forces 93 (2): 457–481. doi:10.1093/sf/sou078.

Hartung, John, Andrew E. Abelson, Amitabha Basu, Mahadeb Prasad Basu, Kenneth L. Beals, B. Chiarelli, Cyril C. Curtain, et al. 1976. “On Natural Selection and the Inheritance of Wealth [and Comments and Reply].” Current Anthropology 17 (4): 607–622. doi:10.1086/201799.

Journals, Pluto, and Studies Quarterly. 2018. “The Changing Status of Islamic Women in the Arab World Author ( s ): Debbie J . Gerner-Adams Source : Arab Studies Quarterly , Vol . 1 , No . 4 ( Fall 1979 ), Pp . 324-353 Published by : Pluto Journals Stable URL : Http://Www.Jstor.Org/Stable/41857519” 1 (4): 324–353.

Keister, Lisa A, and Stephanie Moller. 2017. “Wealth Inequality in the United States Author ( s ): Lisa A . Keister and Stephanie Moller Published by : Annual Reviews Stable URL : Http://Www.Jstor.Org/Stable/223437 WEALTH INEQUALITY IN THE UNITED STATES” 26 (2000): 63–81.

Kimber, Richard. 2008. “The Qurʾanic Law of Inheritance Author ( s ): Richard Kimber Source : Islamic Law and Society , Vol . 5 , No . 3 , The Islamic Inheritance System , ( 1998 ), Pp . 291- Published by : BRILL Stable URL : Http://Www.Jstor.Org/Stable/3399262 These Qur ’ Anic ” 5 (3): 291–325.

Kirchengast, Sylvia. 2014. “Human Sexual Dimorphism – A Sex and Gender Perspective.” Anthropologischer Anzeiger 71 (1–2): 123–133. doi:10.1127/0003-5548/2014/0376.

Lambert, Helen H. 1978. “Biology and Equality : A Perspective on Sex Differences.” Journal of Women in Culture and Society 4 (1): 97–117. https://www.jstor.org/stable/3173327.

Law, Source, Social Inquiry, and No Winter. 2020. “American Bar Foundation Secularism in the Indian Context Author ( s ): Deepa Das Acevedo Published by : Wiley on Behalf of the American Bar Foundation Secularism in the Indian Context” 38 (1): 138–167.

Merry, Sally Engle, and Rachel E. Stern. 2005. “The Female Inheritance Movement in Hong Kong: Theorizing the Local/Global Interface.” Current Anthropology 46 (3): 387–409. doi:10.1086/428800.

Moghadam, Valentine. 2016. “Women , Work , and Ideology in the Islamic Republic Author ( s ): Val Moghadam Source : International Journal of Middle East Studies , Vol . 20 , No . 2 ( May , 1988 ), Pp . 221- Published by : Cambridge University Press Stable URL : Http://Www.Jstor.Org/” 20 (2): 221–243.

Ortiz-Ospina, Esteban, and Max Roser. 2018. “Economic Inequality by Gender – Our World in Data.” OurWorldInData.Org, no. March: 1–38. https://ourworldindata.org/economic-inequality-by-gender.

Parashar, Archana. 2008. “Gender Inequality and Religious Personal Laws in India.” The Brown Journal of World Affairs 14 (2): 103–112.

Powers, David S. 2010. “On Judicial Review in Islamic Law Published by : Blackwell Publishing on Behalf of the Law and Society Association Stable URL : Http://Www.Jstor.Org/Stable/3053900 On Judicial Review in Islamic Law Hierarchical Judicial Structure in Which Higher Courts Re” 26 (2): 315–341.

Press, California. 2020. “Engels on the Subjugation of Women : Some Cross-Cultural Tests Author ( s ): Michael P . Carroll Source : The Pacific Sociological Review , Vol . 18 , No . 2 ( Apr ., 1975 ), Pp . 223-241 Published by : University of California Press Stable URL : Https://” 18 (2): 223–241.

Report, United Nations. 2015. “Distribution of Agricultural Holders by Sex (Females).” http://www.fao.org/gender-landrights-database/data-map/statistics/en/?sta_id=982.

Ruel, Erin, and Robert M. Hauser. 2013. “Explaining the Gender Wealth Gap.” Demography 50 (4): 1155–1176. doi:10.1007/s13524-012-0182-0.

SEESEMANN, Rudiger. 2005. “Islamism and the Paradox of Secularization : The Case of Islamist Ideas on Women in the Sudan.” Sociologus 55 (1): 89–118.

Shennan, Stephen. 2011. “Property and Wealth Inequality as Cultural Niche Construction.” Philosophical Transactions of the Royal Society B: Biological Sciences 366 (1566): 918–926. doi:10.1098/rstb.2010.0309.

Strauss, David A. 1992. “Biology, Difference, and Gender Discrimination” 1007.

Swaminathan, Hema, Rahul Lahoti, and J. Y. Suchitra. 2012. “Gender Asset and Wealth Gaps: Evidence from Karnataka.” Economic and Political Weekly 47 (35): 59–67.

Szydlik, Marc. 2004. “Inheritance and Inequality: Theoretical Reasoning and Empirical Evidence.” European Sociological Review 20 (1): 31–45. doi:10.1093/esr/20.1.31.

“TOWARD A THEORY OF ARAB-MUSLIM WOMEN AS ACTIVISTS IN SECULAR AND RELIGIOUS MOVEMENTS Author ( s ): Carolyn Fluehr-Lobban Source : Arab Studies Quarterly , Vol . 15 , No . 2 ( Spring 1993 ), Pp . 87-106 Published by : Pluto Journals Stable URL : Http://Www.” 2018 15 (2): 87–106. Vespa, Jonathan, and Matthew A. Painter. 2011. “Cohabitation History, Marriage, and Wealth Accumulation.” Demography 48 (3): 983–1004. doi:10.1007/s13524-011-0043-2.

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *