মহঃ কাইফ
বসন্তের সতেরো-আঠারো বছরের জীবনে আজ অব্দি বিশাল কিছু ঘটেনি। গ্রামের ছোটখাটো দাঙ্গা আর একটু-আধটু ভূমিকম্প ছাড়া সর্বগ্রাসী বিপর্যয় দেখার দুর্ভাগ্য তার হয়নি। গ্রামে থাকতে মা রাত্রিতে মাঝে মাঝে ১৯৭৬ আর ২০০০-এর ঘটনা বলতো। মা সেবার আকাশে হেলিকপ্টার দেখে ছিল, নৌকা করে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল। মামার বাড়িতে জল ঢোকেনি, তাতে মায়ের কত গর্ব! সে বাড়ির ছাদে কত মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। বাড়ির উঠোনে লাল জল আর মাছ খেলে বেড়াতো। আবার সেখানেই এক প্রতিবেশী মেয়ের বাচ্চাও হয়েছিল। পাশের গ্রামের এক মধ্য বয়স্ক মহিলা আর তার বুকে আর পিঠে বাঁধা দুই বাচ্চার মৃতদেহ ভেসে এসে লেগেছিল এক নিমগাছে। হাজার হাজার মাটির বাড়ি জলে গুলে কাদা হয়ে গিয়েছিল৷
স্কুল-কলেজও মাসের পর মাস বন্ধ ছিল তখন। বসন্ত ভাবতো আর আফসোস করত–ইস! আমাদের যদি এইভাবে স্কুল, পরীক্ষা সব বন্ধ হয়ে যেত, কতই না মজা হতো, সারাটা দিন টিভি দেখতাম শুধু।
বসন্তের কামরাটা বাড়ির দক্ষিণ দিকে, রাস্তার ধারে। কিছু দূরে একটা স্কুল। সাতসকালে এক ভ্যানরিকশাওয়ালা ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে খটখট শব্দ করে রোজ বসন্তের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে চলে যেত। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে তিক্ত স্বরে বসন্ত বলতো, “তাড়াতাড়ি যাও না বাপু, আমাদের বাড়ির সামনে যত জ্বালাতন!” সকালবেলায় রাস্তা পরিষ্কার করার লোকগুলো যখন বসন্তের জানালার পাশে বসে ফসফস করে বিড়ি খেত, বসন্ত রেগে যেত, “আপনারা আর জায়গা পেলেন না? দেখতে পাচ্ছেন না বিড়ির ধোঁয়াগুলো জানলা দিয়ে আমার ঘরে ঢুকেছে! আপনাদের জন্য আমিও মরবো নাকি?”
এভাবেই চলছিল।
তারপর করোনা এলো পৃথিবীতে। সাথে নিয়ে এল নতুন কিছু শব্দ–সোশ্যাল ডিস্টেনসিং, লকডাউন… বন্ধ হলো দোকানপাট, স্কুল কলেজ, রাস্তাঘাট সব কিছু।
সেই রিকশার শব্দ আর আসে না, বিড়িখোর মানুষগুলোরও দেখা নেই। আজকাল সেই বিরক্তিকর দিনগুলোকে ফিরে পেতে ইচ্ছে করে বসন্তের। স্মৃতি সতত সুখের। ঠিক সেরকমই এক সকালে বসন্ত দেখল তার বাড়ির দরজায় তার পরিচিত সেই বয়স্ক দাড়িওয়ালা ভ্যানরিক্সার চালক দাঁড়িয়ে আছেন। তার লম্বা-কালো হয়ে যাওয়া ফতুয়া আর চেক কাটা লুঙ্গি দেখে বসন্ত তাকে চিনতে পারে। কিন্তু যে মুখটা সে চিনত, একমুখ পান খাওয়া লাল দাঁতের হাসি সে মুখটাকে বসন্ত কিছুতেই চিনতে পারল না। দরজা থেকে বেশ অনেকটা তফাতে দাঁড়িয়ে আস্তে করে সেই ভ্যান রিক্সাওয়ালা বললেন, “বাবা কিছু ভিক্ষা দিন”!