শবনমের গল্প

সাবিয়া খাতুন

উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে আজ। শবনমের দাদা পাশের গ্রামের সাইবার ক্যাফেতে গেছে শবনমের ফলাফল জানতে। ছ’টি বিষয়েই আশি শতাংশের উপর নাম্বার পেয়েছে জেনে শবনমের দাদা আরিফ খুব খুশি হয়। আরিফ নিজে দিনমজুরের কাজ করে কিন্তু বোনের পড়াশোনায় আগ্রহ ও মেধা দেখে আরিফ দুবছর আগেই ঠিক করে নেয়, যেমন করে হোক বোনকে সে পড়াবে। 

আরিফ নিজেও ভালো ছাত্র ছিল স্কুল জীবনে। কিন্তু তাদের এত বড় সংসার রাজমিস্ত্রী বাবার একার পক্ষে  আর টানা সম্ভব ছিল না। আরিফের এখনো মনে পড়ে, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে সে কলেজে ভর্তি হয়েছিল, প্রথমবর্ষটা কিছুদিন ক্লাস করেছিল। সেই সময়েই একদিন সকালবেলা কলেজের জন্য তৈরী হচ্ছিল সে, মা-কে বলল ‘মা ভাত দাও’; মা তাকে পান্তাভাত আর কাঁচালঙ্কা এগিয়ে দেয়। তার বাবার এক সপ্তাহ থেকে কাজ নেই, এই মফস্বল এলাকায় রোজ কাজ পাওয়াও মুশকিল তাছাড়া, তাঁর বয়স হয়েছে, কমবয়সী মিস্ত্রিরা কাজ পায় আগে। বাড়িতে চাল ডাল কিছুই নেই প্রায়, আরিফ সেদিন কলেজে গেল না খেয়েই। কলেজ ক্যাম্পাসে একটা বাঁধানো বটগাছের বেদীতে বসে অনেক ভাবনা চিন্তা করার পর তার ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি ঠিক করল। সে জানত এই মন্দার বাজারে চাকরি পাওয়া যাবে না।  তাছাড়া চাকরির জন্য পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গেলে কোচিং করতে হবে, নিদেনপক্ষে যদি প্রাইমারিতেও বসে তবুও ডি.এল.এড করতে হবে। আর হাইস্কুলের পরীক্ষার জন্যও তো বি.এড অত্যাবশ্যক। এত টাকার যোগান তাঁর বাবা দিতে পারবেন না। সেই থেকে আরিফ কখনো দিনমজুরের কাজ করে,কখনো অন্যজেলায় কুয়ো-খনন করার কাজে যায় সঙ্গীদের সাথে। কখনো মুরাডির অবৈধ কয়লা খনিতে কাজ করে। এই তো কিছুদিন আগে বোলপুরে এক অফিসারের সবজি ক্ষেতে তিনটে কুয়ো-খুঁড়ে এল তারা। নিজে বেশি পড়াশোনা করতে পারেনি বলে আরিফ তার বোনকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখত,বোনের পড়াশোনায় যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখত,তার পড়াশোনার সমস্ত খরচ চালাত আরিফ। মাধ্যমিকে পঁচাশি শতাংশের বেশী নাম্বার পেয়েছে শবনম। তবুও আরিফ ভয় পেত এই ভেবে যে মাধ্যমিকের পর বহু ভালো ছাত্র উচ্চমাধ্যমিকে তলিয়ে যায়। তাই শবনাম দ্বাদশ শ্রেণিতে ওঠার পর থেকেই প্রতিদিন কাজ থেকে ফিরে শবনমের পড়াশোনার খোঁজ নিত,ও রাত্রে যতক্ষণ পড়ত,আরিফ পাশে বসে থাকত। জুম্মার দিনে সে কাজে যায় না, সারাদিন শবনমের পড়ার দেখ-ভাল করে,পাড়ার ছেলেদের সাথে আড্ডা পর্যন্ত দেয় না। আরিফের সেই পরিশ্রম আর সহযোগিতা বিফলে যায়নি, শবনম ওদের স্কুলে প্রথম হয়েছে। বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে এল আরিফ সেদিন, শবনমকে ডেকে বলল,”তোর বন্ধুরা কোন কোন কলেজের ফর্ম তুলছে খোঁজ রাখবি, তুই তো নামী কলেজগুলোতে চান্স পেয়ে যাবি, তবুও রিস্ক নিয়ে লাভ নেই, তিন চার জায়গায় অ্যাপ্লাই করে রাখবি”।  শবনম বন্ধুদের সাথে গিয়ে এপ্লিকেশন ফর্ম জমা করে এল। যথা সময়ে লিস্ট বেরোলো কলেজগুলোতে, জেলা শহরের নিস্তারিনী উইমেনস কলেজ ও জে.কে কলেজে আর্টস গ্রুপে প্রথম দশের মধ্যে নাম এসেছে শবনমের। বাড়ি থেকে সবচেয়ে কাছের কলেজ পনেরো কিলোমিটার দূরের মহকুমা শহরে, রঘুনাথপুর কলেজ। ওখানে চার নম্বরে শমনমের  নাম থাকায় আরিফ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, সদর-শহরে পড়ানো খরচসাপেক্ষ, তাছাড়া মেয়েমানুষ অতদূরে পড়তে যাবে, মেসে থাকবে এসবে বাড়ির লোকেও আপত্তি করবে। রঘুনাথপুরে হলে প্রতিদিন বাড়ি থেকে যাওয়া করে পড়াশোনা করতে পারবে। তাছাড়া রঘুনাথপুর কলেজের ইংরেজি বিভাগের নাম আছে, আকাশ গায়েন স্যার ভীষণ ভালো পড়ান। শবনমও দাদার সিদ্ধান্তে দ্বিরুক্তি করল না।

ইংরেজি বিভাগে চারজন স্যার,সবাই খুব যত্ন-সহকারে পড়ান। শবনম এমনিতেই মেধাবী ছাত্রী, আবার একদিনও ক্লাস মিস্ করে না। ক্লাসে ছেলেমেয়ে মিলিয়ে চল্লিশজন, সবদিন সবাই আসে না। দুমাস ক্লাস হয়ে গেল,একদিন আই.বি. ম্যাম ক্লাসে ঢুকেই বললেন,”আজ তোমাদের ক্লাস টেস্ট নেবো,দেখি কে কেমন পড়াশোনা করছো!”

ম্যাডাম ব্ল্যাকবোর্ডে খসখস করে ছ’খানা প্রশ্ন লিখে দিলেন, ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস থেকে, সবগুলোই অ্যাংলো স্যাক্সন পিরিয়ডের উপর। প্রশ্নগুলো শবনমের জানা, সে একমনে উত্তর লিখছে। সামনের সীটে বসা একজন ছেলে পিছন ফিরে তার লেখা কপি করার চেষ্টা করছে,শবনম তার খাতাটা আরেকটু এগিয়ে দেয়,যাতে ওই ছেলে আরেকটু ভালো করে দেখতে পায় লেখাগুলো। পরীক্ষা শেষে ম্যাম বেরিয়ে গেলে ছেলেটা শবনমের দিকে ঘুরে বলল, “আজ আপনি না থাকলে আমি সাদা খাতা জমা দিতাম,অনেক ধন্যবাদ”

“একই ক্লাসে পড়ছি, আমরা সবাই সবার বন্ধু আর বন্ধু হয়ে বন্ধুকে সাহায্য করেছি, এতে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই, বাই দ্য ওয়ে আমরা ক্লাসমেট তাই তুমি কিংবা তুই সম্বোধন করলেই চলবে,” শবনম উত্তর দেয়।

“আসলে ম্যাম হঠাৎ পরীক্ষা নেবেন বুঝতে পারিনি।”

শবনম বলল, “আচ্ছা”।

কথায় কথায় দুজনের আলাপ পরিচয় হয়ে গেল।

ছেলেটি হল অরিত্র, রঘুনাথপুর থেকে আট কিলোমিটার  দূরে আনাড়ার রেল-কলোনিতে থাকে, তার বাবা রেলে চাকরি করেন। তাঁদের পৈতৃক-বাড়ি বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে।

কলেজের আরও কটা মাস কেটে গেল, এখন ক্লাসসুদ্ধ সবাই শবনমের বন্ধু। অন্য ডিপার্টমেন্টেও তার বন্ধুত্ব হয়েছে কয়েকজনের সাথে। সাম্যব্রতী, শ্রুতিকণা, অর্পণ এদের সাথে শবনম ও অরিত্রের একটু বেশী ভাব। শবনম গুণী মেয়ে, পড়াশোনার পাশাপাশি আবৃত্তি, ডিবেট কম্পিটিশন সবেতেই তার অসাধারণ দখল। তাঁর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয় ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাই। অরিত্র আর শবনমের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে দিন দিন। অরিত্র নিজেও পড়াশোনায় ভালো কিন্তু শবনমের ক্ষুরধার মেধার কাছে সে ম্লান। এই কদিন থেকে অরিত্রের হয়েছে কী সবসময় শবনমের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে, ক্লাসে ওর পাশেই বসে কিন্তু ক্লাসের বাইরেও শবনমের পায়ে পায়ে ঘোরে সে। বাড়ি ফেরার পথে বাসে শবনমের মুখটা বারবার মনে পড়ে, বাড়িতে এসে বিছানায় শুয়ে সারাদিনের ঘটনা জাবর কাটতে থাকে, সেখানে বেশীরভাগটা জুড়ে শবনম থাকে, ও কোথায় বসেছিল, কী কথা বলেছে তাকে, কী রং এর সালোয়ার-কামিজ পরেছিল —এসব ভাবতে ভাবতে সময় কেটে যায়। ‘সাম্যর সাথে কথা বলতে হবে এ ব্যাপারে,’ অরিত্র মনে মনে ঠিক করে। পরদিন কলেজে সাম্যকে একা পেয়ে আমতা আমতা করে কথাটা বলেই ফেলে। সাম্য তো চিন্তায় পড়ে গেল অরিত্রের মনের খবর পেয়ে, কারণ শবনম মুসলিম পরিবারের মেয়ে, ভবিষ্যতে ব্যাপারটা নিয়ে ঝামেলা হতে পারে। তবুও সে শবনমের সাথে কথা বলে দেখবে বলে অরিত্রকে আশ্বাস দেয়। শবনম সবকিছুতেই সাবলীল। সবার সাথে হেসে কথা বলে। সাম্যব্রতী ক্লাসের পিছন বেঞ্চে শবনমকে টেনে নিয়ে গিয়ে চুপিচপি বলল, তোর সাথে একটা জরুরী কথা আছে, বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়াবি বাড়ি ফেরার সময়। ছুটির পর শবনম বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিল সাম্যর জন্য। ওকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখে উপহাস করে বলল, “কী রে এত জরুরী তলব কিসের!”

“চল্, চায়ের দোকানে বসে সব বলছি।”

দুটো চায়ের অর্ডার দিয়ে সাম্য বলতে শুরু করে, “অরিত্রের অবস্থা শোচনীয় বুঝলি, তোর প্রেমে পড়েছে এবং সেটা যথেষ্ট সিরিয়াস, তোর এখন এ ব্যাপারে কি অভিমত জানা। হ্যাঁ কিংবা না যাই হোক না কেন স্পষ্ট জানাবি কারণ মাঝে ঝুলে থাকলে ব্যাপারটা মারাত্মক আকার ধারণ করবে!”

শবনম চা খেতে খেতে নরম গলায় বলল, “আচ্ছা আমি ভেবে দেখি দুটো দিন।”

বাসের জন্য এগিয়ে দিতে দিতে শবনমকে বলে সাম্য, “আচ্ছা সময় নে, তারপর জানা।”

বাসের সীটে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শবনম ভাবতে থাকে অরিত্রর কথা, প্রথম থেকেই অরিত্রকে তার ভালো লাগে। ও কতবার নোটস দিয়ে, রেফারেন্স বই দিয়ে ওকে সাহায্য করেছে। সব বন্ধুর প্রতিই ও খুব হেল্পফুল। কিন্তু অরিত্র হিন্দুবাড়ির ছেলে। স্থায়ী সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে নানান সমস্যা দেখা দেবে,বাড়ির লোক মানবেও না। তাছাড়া এখন সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়, মা-বাবা-দাদাকে সাহায্য করতে চায় চাকরি করে। এখন এসব ভাবার সময় নয় তার। পড়াশোনাটা তার প্রধান লক্ষ্য।

কিছুদিন পরে ক্লাসে গল্প করতে লাগল অনেকে।

“জানিস্ শবনম আর অরিত্র এখন প্রেম করছে বেশ, দুজন পঞ্চকোট জলাধার গেছিল কদিন আগে বেড়াতে”

“হ্যাঁ আমিও দেখলাম সেদিন ছুটির পর ক্যাম্পাসের পিছনে কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে দুজনে হাত ধরাধরি করে গল্প করছিল,” একজন ফুট কাটল।

“দেখিস্ না, ক্যান্টিনে অরিত্র ছাড়া শবনম কিছু খেতে চায় না,” অন্যজন মন্তব্য করে।

প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ হল, দ্বিতীয় বর্ষে অ্যাডমিশনও হয়ে গেল সবার। রেজাল্ট বেরোবে কয়েকমাস পর। অরিত্র, শবনম দুজনেরই আঠারো পেরিয়ে গেছে বয়স, তাই ওরা এবার চাকরির পরীক্ষায় বসতে পারে।  দুজনেই কাছারিতে সমীরকাকুর পেপার দোকানে গিয়ে চাকরির কোনো ভ্যাকেন্সি বেরিয়েছে কি না খোঁজ নেয়। সাপ্তাহিক কর্মসংস্থানের গ্রাহক হয়। ওখানে একদিন একটা বিজ্ঞাপণ চোখে পড়ে তাদের। এক-হাজার জন তরুণী নেওয়া হবে জি.এন.এম নার্সিং ট্রেনিং-এ। অরিত্র শবনমকে বলে, “এটাতে পাওয়া সহজ তোর পক্ষে, উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টের ভিত্তিতে নেবে, এখন চাকরির যা বাজার, তাতে মেয়েরা নার্সিং ট্রেনিং এ চান্স পাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে।”

অরিত্রর কথামতো ফর্মটা ফিল-আপ করে দুজনে রঘুনাথপুর পোস্ট অফিস থেকে স্পীড পোস্ট করে দিল, পুরুলিয়া জি.এন.এম নার্সিং স্কুলের ঠিকানায়। কিছুদিন পর প্রথম বর্ষের রেজাল্ট বেরোলো, শবনম ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে, অরিত্রও ভালো রেজাল্ট করেছে।  কিন্তু শবনম খুব মন মরা হয়ে আছে, ঠিক ভাবে কারো সাথে কথা বলছে না। বাড়িতে নার্সিং স্কুল থেকে চিঠি এসেছে, ও চান্স পেয়েছে,  কাউন্সেলিং অ্যাটেন্ড করতে হবে সামনের মাসের সাত তারিখে। তার দাদা আরিফ, বাবা-মা সবাই সম্মত হয়েছে তার ট্রেনিং এ যাওয়া নিয়ে। প্রথম প্রথম ভালো লেগেছিল তারও, কিন্তু এখন যত দিন যাচ্ছে তত মন খারাপ হচ্ছে, অরিত্রকে আর সব বন্ধুদের ছেড়ে যেতে হবে এটা তার মনে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে।

নার্সিং এর কাউন্সেলিংয়ের দিন আরিফ গেল শবনমের সাথে। ওখানে প্রিন্সিপাল ম্যাম বুঝিয়ে দিলেন কী কী আনতে হবে বাড়ি থেকে, এখানে কীভাবে থাকতে হবে, হোস্টেলের নিয়ম কানুন সব বলে দিলেন।  একটা জয়েনিং লেটার তাতে ওনারই সাইন করা ধরিয়ে দিয়ে প্রিন্সিপাল ম্যাম বললেন, “যা যা বললাম সব নিয়ে পরের রবিবার চলে এসো হোস্টেলে, সোমবার থেকে ক্লাস শুরু।”

পরের রবিবার আরিফ শবনমকে সঙ্গে করে হোস্টেলে রেখে এল, আসার সময় ওকে একটা কি-প্যাড ফোন দিয়ে এল। শবনম আসার সময় একটা ছোটো নোটবুকে সব বন্ধুর নাম্বার লিখে এনেছিল। অরিত্রর নাম্বার ডায়াল করল সে, ফোনে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করল অরিত্রর কাছে। অরি ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “আমাদের তো ফোনে কথা হবে, তুই সময় পেলে, সুযোগ পেলেই আমাকে ফোন করবি।”

হোস্টেলে ফোন রাখা বারণ, শবনম সাইলেন্ট করে রাখে ফোনটা সবসময়, রুমমেট সুপ্রীতি, চয়নিকা সবকিছুই জানে শবনমের ব্যাপারে।

একদিন শবনম নিজের বেডের উপর খুব চিন্তিতমুখে বসে আছে। সুপ্রীতি রুমে ঢুকে বলল, “কী রে, কী হল তোর? অরিত্রবাবুর সাথে ঝগড়া করলি নাকি?” 

” না রে আজ দুদিন থেকে ওর ফোন লাগছে না”

“তো অন্য কাউকে করে দ্যাখ, পাশাপাশি কেউ নেই যে অরিত্রর খবর দিতে পারবে?”

“না রে ওর সাথে আমার যোগাযোগ আছে,কাউকে জানতে দিইনি সেটা, এখানে আসার সময় দাদা বারবার বলে দিয়েছে , কোনো ছেলেবন্ধুর সাথে যেন বেশী কথা না বলি।”

শবনমের কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না যে অরির সাথে সে ঝগড়া করেনি, তবুও কেন সে একবারও ফোন করছে না। কোনো বিপদ হল না তো তার।

ছ’দিন উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটল। সাত দিনের দিন সকালবেলা ক্লাসে যাবার আগে ফোনটা চেক করে দেখছে অরির দুটো মিসড-কল। শবনম রিং ব্যাক করে,ওপার থেকে ভেসে আসে যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর,”হ্যালো!”

“অরি কী হয়েছে? তোর গলার আওয়াজ এরকম কেন? কীসের কষ্ট তোর বল্ আমায়?

“আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে শবনম, আমার বাবা আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন, তিনি মারা গেছেন।”

“কিন্তু হঠাৎ কীভাবে?”

“রঘুনাথপুর যাচ্ছিলেন বাইকে, পিছন দিক থেকে একটা ট্রাক এসে ধাক্কা দেয়, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু বাবাকে বাঁচানো যায়নি।”

“তুই এখন কোথায়?”

“মা আর বোনকে নিয়ে এখন বাঁকুড়াতেই আছি।”

শবনম সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পায় না। কী বলবে কিছুই বুঝতে পারে না।

অরিত্রর বাবা মারা যাওয়ার পর আরও দুবছর কেটে গেছে। শবনমের এটা থার্ড ইয়ার, তাই খুব চাপ, প্রতিদিন হাসপাতালে ডিউটি করতে হচ্ছে। এদিকে অরিত্রও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নেতামন্ত্রীর কাছে তদবির করে কমপেনসেশন গ্রাউন্ডে তার বাবার চাকরিটা পেয়েছে। কিন্তু তাকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে সুদূর উত্তরবঙ্গে। ফোনে কথা হয় দুজনের সময় পেলেই। এরকমই একদিন গল্প করছে তারা। কথায় কথায় অরিত্র বলল, “মা আমার জন্য পাত্রীর সন্ধান করছেন বুঝলি!”

শবনমের তো মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ল। সে বলল “তুই কী করবি তাহলে এবার?”

অরিত্র বলল, “দেখা যাক্, কী করতে পারি, আসলে কী জানিস মা মনে হয় আমাদের সম্পর্কের কথা টের পেয়েছে, তাই এত তাড়াহুড়ো করছে”

“কী করে বুঝলি?” শবনম জানতে চায়।

“আরে সেদিন বলছিল, আমি নাকি এত দূরে গিয়ে কোনো মেয়ের প্রেমে পড়ে যেতে পারি, তারপর তাকে বিয়ে করে নিতে পারি, তাই মা আগের থেকেই সবকিছু ঠিক করে দিতে চান,অন্তত বাগদান পর্বটা চলতি বছরেই সেরে রাখতে চান।”

অরিত্র কথার রেশ ধরে একটানা বলে যায়, “জানিস বোনকে মা বলেছে যে অন্য ধর্মে বিয়ে করলে মা সেটা কোনোমতেই মেনে নেবেন না, সেটা বোন করুক কিংবা আমি করি, তাতে নাকি মাকে কথা শুনতে হবে আত্মীয়দের কাছে, সবাই বলবে ছেলেমেয়েকে ঠিক মতো বাগে রাখতে পারছেন না তিনি।”

আরও ছ’মাস কেটে গেল, শবনমের ইন্টার্নশিপটাও শেষ হয়ে গেল ইতিমধ্যে। জয়েনিং লেটারে ইন্টার্নশিপের কথা অবশ্য লেখাই ছিল, তিনবছর ট্রেনিংয়ের পর ছ’মাস সরকারি হাসপাতালে বেগার খাটতে হবে। তবেই সার্টিফিকেট মিলবে। সরকারি চাকরি পেতে দেরি হবে তাই শবনমের ইচ্ছে কোনো বেসরকারি নার্সিং হোমে জয়েন করবে আপাতত। অরিত্রর কাছে পরামর্শ চায় এই  বিষয়ে। অরিত্র বলে, “আমি তো গতবার বাড়ি গেছিলাম তখনই তোর জন্য একটা ভালো নার্সিং হোম দেখে এসেছি,বাঁকুড়া সদর শহরে”

অরিত্রের কথায় শবনমের আবেগে চোখে জল এসে গেল,অরি তার জন্য এত ভাবে!

বাড়িতে মা, বাবা, দাদা সবাই খুব খুশি, যাক্, এতদিন পরে তাদের সংসারটা একটু সুখের মুখ দেখতে পাবে। পরের সপ্তাহে শবনম বাঁকুড়ার ‘সঞ্জীবনী’ নার্সিংহোমে জয়েন করল। ওখানে স্টাফদের থাকার ব্যবস্থা আছে। বাঁকুড়ায় থাকলে অরিত্রর সাথে মাঝে মাঝে দেখা হবে, ও যখন ছুটিতে বাড়ি আসবে তখন, এটা ভেবে শবনম খুব আনন্দ পেল। চাকরিতে কেটে গেল কয়েকটা মাস। একদিন সকালবেলা অরিত্র ফোন করে বলল, “আমি নার্সিং হোমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, তুই এখুনি আয়।”

অরিত্র বাড়ি এসেছে এটা শবনম জানত না, মুখোমুখি দেখা হতেই অরিত্রর থমথমে মুখ দেখে শবনম ঘাবড়ে গেল।

“শবনম তোকে আজ আমার কথা শুনতেই হবে, এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”

“বল্, কী কথা।”

“কাল সকালে আমরা পুরুলিয়া যাব, ওখানে ঘাঘরবুড়ি মন্দিরে বিয়ে করব, তুই একবার বাড়ি যাবি, তোর সব জিনিসপত্র নিয়ে আসবি।”

“কিন্তু এত তাড়াহুড়ো করছিস্ কেন? আমরা তো রেজিস্ট্রি করেও বিয়ে করতে পারি?”

“না, স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিয়ে করতে সময় লাগবে, তাই এখন মন্দিরে গিয়ে করি, পরে রেজিস্ট্রি করব” অরিত্র বলে।

শবনম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “কিন্তু কী এমন হল যে এরকম হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে হবে?”

“মা আমার এনগেজমেন্টের ডেট ঠিক করে দিয়েছে, গত পরশু, তার আগেই বিয়ে করতে হবে আমায়, নইলে তোর আর আমার সম্পর্ক এখানেই শেষ করতে হবে,” অরিত্র জানায়।

পরদিন অরিত্র-শবনম পুরুলিয়ার বাসে উঠল সকাল সকাল, বাড়িতে এসে শবনম তার জিনিসপত্র, অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশনের কাগজ, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড সব গুছিয়ে নিয়ে বেরোতে যাবে এমন সময় মা দেখতে পেয়ে বলছেন, “হ্যাঁ রে শবু এখনি আলি, আর এখনি চল্যে যাবি?কাল যাবিস নাহইল্যে..”

“না মা আমাকে যাত্যে হবেকেই, অফিসের কটা কাজ আছে পুরুল্যায়।”

সেদিন বিকেলে মা ,দাদা, বোন শবনমকে ফোনে ধরার চেষ্টা করল, তার ফোন সুইচ অফ। তার পরদিনও ফোন খোলেনি। দুদিন কোনো খবর না পেয়ে বাড়ির লোক সবাই ভয় পেয়ে গেল, কী হল মেয়েটার সবাই চিন্তা করতে লাগল। আরিফকে তার বাবা বাঁকুড়া গিয়ে শবনমের কী হয়েছে খোঁজ নিয়ে আসতে বলল। নার্সিংহোমে শবনমের কলিগদের কাছে আরিফ জানতে পারল যে শবনম অরিত্রকে বিয়ে করেছে, এই বাঁকুড়া শহরেই তারা ভাড়াবাড়িতে আছে,ঠিকানাও দিলেন তাঁরা। বাড়ি এসে আরিফ সব জানাতেই পুরো বাড়ি শোকের সাগরে ভেসে যেতে লাগল। গ্রামাঞ্চলে কোনো কথাই বেশিক্ষণ চাপা থাকে না। খবরটা ইতিমধ্যে রাষ্ট্র হয়ে গেল। মসজিদ কমিটির সভাপতি আরিফের বাবা মোজাম্মেল হক ও আরিফকে ডেকে বললেন, “কাল আমরা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে যাব, তোমরা দুজনও আমাদের সাথে যাবে, এরকম ঘটনা মুসলমান ধর্মের অপমান, জাতের মুখে চুন কালি পড়ে গেল, এর একটা হেস্তনেস্ত না করলে বাঁধন ঢিলে হয়ে যাবে,  সব মেয়েগুলো বিধর্মীদের সাথে পালাবে!”

পরদিন সকালে একটা টাটা-সুমোতে করে গ্রামের সভাপতিসহ আরও দুজন নও-জোয়ান, দুজন পুলিশ আর আরিফ ও তার বাবা বাঁকুড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। শবনমের ভাড়াবাড়িতে পৌঁছে সবাই আরিফকে নির্দেশ দিল শবনমকে ডাকার জন্য, শবনম বুঝতে পারেনি ওর দাদা এসেছে। ও বাইরে বেরিয়ে এল, পরনে শাঁখা, সিঁদুর আর লালরং এর একখানা শাড়ি। আরিফ বলল, “চল্,বাড়ি চল্”।

শবনমের পিছন পিছন অরিত্রও বেরিয়ে এসেছিল। ও জোরে জোরে বলতে লাগল, “না শবনম যাবে না, ও এখন আমার স্ত্রী”। গ্রামের ছেলে দুটি অরিত্রের গালে চড় মারল। ওকে শাসিয়ে বলল, “বেশী বাড়াবাড়ি করতে এলে জানে মেরে দেবো শালা, শুয়োরের বাচ্চা, তোর এত সাহস হয় কী করে মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করার”!

এতজনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা অরিত্রর পক্ষে সম্ভব নয়, সে নিশ্চল পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

শবনমকে ওরা একপ্রকার জোর করেই গাড়িতে তুলেছিল সেদিন। মসজিদ কমিটির সভাপতি দাড়িওয়ালা লোকটাকে সে আগে দেখেছে গ্রামে, নামটা মনে নেই, তিনি শবনমকে বেশ ভদ্রভাবেই বললেন, “কেন রে বিয়ে করার জন্য আর ছেলে পেলি না, আমাদের সমাজে কী ছেলের অভাব?”

শবনম তীরবিদ্ধ হরিণীর মতো তেজ দেখিয়ে বলেছিল, “আমি বিয়ে করেছি, সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, আপনাদের তাতে কী?”

পাশে বসা ষণ্ডা মতো দুজন যুবকই ওর চুলের মুঠি ধরে মারতে মারতে বলল, “রেন্ডি,আ-কাটাদের সাথে শুত্যে দমে মজা তর, চল্, গাঁয়ে তখে দেখছি, গাঁয়ের বাইরে পা দিলে তর ঠ্যাং কাইট্যে দিব মাগী”।

শবনম এবার ভয় পেল ওদের এরকম অশ্লীল ভাষা আর জন্তুর মতো আচরণে। আরিফ, মোজাম্মেল হক একদম চুপ। মেয়ে, বোনের উপর এরকম অত্যাচারেও তাঁরা কিছু বলতে পারছেন না। তাঁরা মেনেই নিয়েছেন যে এটা তাঁদের মেয়ের অন্যায়, তাই গ্রামের লোক যা শাস্তি দেবে তারা মাথা পেতে নেবে। তবুও শবনম মিনমিনে গলায় শেষবারের মতো বলতে চেষ্টা করল, “আমি কাকে বিয়ে করব সেটা সমাজ ঠিক করে দেবার কে?আমার নিজের পছন্দ অপছন্দের দাম নেই?”

একজন যুবক চিৎকার করে উঠল, “চুপ খানকি মাগী, একদম একটা কথা বইলবি নাই, জাত্যের মুহে চুনকালি মাঁখায় আরহ ভাষণ মাইরছিস? তুই খুব শিক্ষিত হঁয়েছিস, তর শিক্ষা তর পঁদে গুঁইজ্যে দিব ,চল্, গাঁয়ে চল্”।

আজ আবার সালিশি সভা বসেছে গ্রামে। শবনম বাড়িতে আছে,মা-বোন উঠতে বসতে তাকে অপমানজনক কথা বলছেন। মা তো বলেই ফেললেন ছোটো মেয়েটাকে নাকি আর কেউ বিয়ে করবে না, দিদির এই কলঙ্কের কথা শুনে। বোনও তাকে স্বার্থপর বলেছে কাল রাতে। বাবা আর দাদাকে ওরা কী বলছে কে জানে। সে শুয়ে শুয়ে এসব কথা ভাবতে থাকে।

মিটিংএ সবাই আলোচনা করে ঠিক করেন যে আরিফ আর মোজাম্মেল হক দেড় লাখ টাকা জরিমানা-বাবদ জমা করবেন মসজিদ কমিটিতে, এটাই শমনমের কৃতকর্মের জন্য তাঁদের শাস্তি। আর শবনমকে তাড়াতাড়ি কোনো মুসলিম ছেলের সাথে বিয়ে দিতে হবে, বিয়ের আগে শবনম যেন বাড়ির বাইরে কোথাও না যায়। এরকম কঠিন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে নাকি অন্যরাও এ কাজ করে বসবে,কেউ আর ভয় পাবে না। তাদের এতদিনকার ব্যবস্থা সব ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। আরিফ কিংবা তার বাবা যদি এর অন্যথা করে তাহলে এ গাঁ থেকে তাদের সপরিবারে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। পুলিশে অভিযোগ জানিয়ে কিছু হবে না কারণ পুলিশকে আগেই ঘটনাটা জানিয়ে টাকা খাইয়ে দিয়েছে, এরকম সেন্সিটিভ কেসে তারাও নাক গলাতে চাইবে না, কারণ এর আগেও এই গ্রামের মুসলমানরা থানা ঘেরাও করে পুলিশ পিটিয়েছে। তাছাড়া এই গাঁ ছেড়ে চলে গেলেও তারা কেউ পার পাবে না। ওই হিন্দু ছেলেটা আর শবনম বেশী বাড়াবাড়ি করলে দুজনকেই শায়েস্তা করবে তারা। আরিফ ইঙ্গিতটা ঠিক বুঝতে পারে। এদের কথা না শুনলে তার বোনকে যে এরা বাঁচতে দেবে না এটা ভালোমতোই অনুভব করে সে। আলোচনা সভাতেই কমিটির একজন মেম্বার, পরনে পাঞ্জাবি,লুঙ্গি,মাথায় ফেজ টুপি বলে উঠল, “বিটিছেল্যার রোজগার খাবার জন্যে নাং কইরত্যে পাঠাই দিয়েঁছিস, শরম নাই তদের, একবারেই সোনাগাছিতে দিয়েঁ আইসত্যে পারতিস্”।

লজ্জায়, ক্রোধে, অপমানে আরিফ দ্রুতবেগে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়, তার বাবাও পিছন পিছন আসতে লাগলেন।

উঠোন থেকেই চিৎকার করে আরিফ,

“শবনম”

“শবনম”

শবনম কাছে আসতেই তার চুলের মুঠি ধরে  বেধড়ক মারতে মারতে বলল,  “এজন্য এত কষ্ট কইর‍্যে পড়ালেখা শিখাইছিলি তখে? ওইজন্যে বলে বিটিছেল্যাখে চার দেওয়ালের মধ্যে রাখাটাই ঠিক, বাহিরের আলো দেইখ্ত্যে দিয়া উচিত লয়।”

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *