নাসরিন
১
তাড়াতাড়ি ফোনের ভাইব্রেশনটা বন্ধ করে শোয়েব। বাঁচা গেল। ইরা গভীর ঘুমে ডুবে আছে। এমনিতে ও সকাল সকাল উঠতে পারে না। তার উপর কাল দুপুর রাত অবধি মায়ের সাথে রান্নাঘরে কাজ করেছে। সব ঠিকঠাক থাকলে ন’টার আগে ওঠার কথা নয়। তার মধ্যেই তাহলে কাজ গুছিয়ে ফেলতে হবে। শোয়েব উঠে পড়ল। মুখ হাত ধুয়ে যখন সে ঘর থেকে বেরোলো তখন ছ’টা বেজে আরো মিনিট কুড়ি কেটে গেছে। মাকে দেখতে পেল না। রান্নাঘরে তো নেই। মা কি তাহলে ওঠেনি এখনো? কেলো করেছে। মায়ের ঘরের দরজা খুলে দেখল মা নেই। তাহলে নির্ঘাত বইয়ের ঘরে। তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে অবাক হয়ে থ মেরে গেল। রুকাইয়া আলপনা দিচ্ছেন। দরজা খোলার শব্দে রুকাইয়া চমকে তাকালেন, একটু লজ্জাও পেলেন।
“কিরে এত তাড়াতাড়ি উঠলি কেন? ইরা ওঠেনি তো?”
“না ওঠেনি”
শোয়েব মায়ের পাশটায় সাবধানে বসল, কি সুন্দর আলপনা দিচ্ছে মা।
“মা, এত ভালো আলপনা দেওয়া কোথায় শিখলে?”
রুকাইয়া তার হাতের কাজ থেকে চোখ না সরিয়েই বললেন, “আমাদের স্কুলে সরস্বতী পূজায় প্রতিবছর আলপনা দিতাম। জানিস… বাজার করা, প্রতিমা আনা, ফল কাটা, চিড়ে মাখা সব করতাম আমরা। জীবনের জ্ঞান কিছুই যায় না ফেলা, দেখ কেমন কাজে লেগে গেল”।
শোয়েব একটু পিছিয়ে গিয়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আনমনে ভাবতে লাগল। যেদিন প্রথম ইরাকে নিয়ে এলো, মা নিজের এই বইঘরটাতেই ইরাকে বসিয়েছিল। মায়ের তো ইরাবতীকে পছন্দ হবে জানা কথা। শোয়েব নিজের ভালোলাগা-মন্দলাগায় মায়ের আদলই বেশি করে খুঁজে পায়। একমাস আগে যখন ইরা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েই এলো, শুধু একটা ফোন করেছিল শোয়েব মাকে। রুকাইয়া শুধু বলেছিলেন “নিয়ে চলে আয়।” শোয়েব মনে মনে হাসে। বিগত এক মাস শোয়েব আর ইরাবতী লিভ ইন করছে। ইরা মজা করে বলে দুজনের না, এটা তিনজনের লিভ ইন, রুকাইয়া, শোয়েব আর ইরাবতী।
“কি রে পা ছড়িয়ে বসে রইলি কেন? গোসল করে নে। আটটায় জামাত রেখেছে তো। ” রুকাইয়া বললেন এবার।
“চা খেয়েছো মা?”
“খেয়েছি। তোদেরটা টি পটে ঢালা আছে।”
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে শোয়েব ,উঠতে ইচ্ছে করছে না।
“আচ্ছা মা নামাজটা ঘরে পড়ে নিই? ইচ্ছে করছে না মসজিদে যেতে।”
“যা তোমার ইচ্ছে! তাহলে এখনি গা ধুয়ে নামাজ পড়েনে। তারপর ফল গুলো কেটে ফেল। আমি আলপনাটা সেরে নিয়ে নাড়ু বানাবো”
“কেন? কাল কী করলে তাহলে অত রাত অব্দি দুজনে মিলে?”
“আরে রান্নাবান্না তো অনেকটা এগিয়ে রাখলাম! কিন্তু ইরার সামনে নাড়ুটা আর করিনি। সারপ্রাইজটা নষ্ট হতো।”
২
আলপনাটা শেষ করে রুকাইয়া উঠে পড়েন। কুলসুমকে ফোনটা করে নিতে হবে। কুলসুম তার চাকরি জীবনের প্রথম দিককার রুমমেট। অনাথা অবিবাহিতা গর্ভবতী রুকাইয়া তখন চোরাবালিতে ডুবছেন। যার ঔরসে শোয়েব তার কোলে এসেছিল সেও তখন অজানা-অচেনার ভিড়ে মিশে গেছে। সেসময় কুলসুম আর তার স্বামী আজহার তাদের সদ্য পাতা সংসারে তাকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। শোয়েবকেও দত্তক নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শত কৃতজ্ঞতা সত্বেও রুকাইয়া তার জিয়ন কাঠিটিকে ত্যাগ করতে পারেননি। নম্বরটা ডায়াল করলেন।
“হ্যালো সুমি?”
“ঈদ মোবারক আপু! “
“তোকেও ঈদ মোবারক! আল্লাহ তোদের সুখ-শান্তি বরকতে ভরিয়ে রাখুক।”
এ কথা সেকথার পর কুলসুম বললেন “আপু ঈদের পর ইরাবতী আর শোয়েবের রেজিস্ট্রিটা করিয়ে দাও।”
“সে ওরা যা ভালো বুঝবে করবে”
“তাও আপু, মা হিসেবে শোয়েবের বিয়ে দেওয়াটা তোমার স্বপ্ন আর দায়িত্বও তো বটে!”
রুকাইয়া আলতো হাসেন। তার জন্য তার এই বোনটির আকুলতা দেখে খুশি হন। একটু থেমে থেকে বলেন “সুমি, শোয়েব মানুষের মত মানুষ হয়েছে এতেই আমি খুশি! আর বিয়ের কথা কি বলি বলতো? আমি কারো স্ত্রী হইনি বলে শোয়েবের জন্ম হওয়া বা মানুষ হওয়া কোনটাই কি আটকেছে?”
কুলসুম এই অকাট্য যুক্তির কি উত্তর দেবেন ভেবে পান না। শুধু জিজ্ঞেস করেন “তুমি খুশি তো আপু?”
“খুব খুশি সুমি, এবার শাশুড়িগিরি করে দুই বোনে মিলে ইরাকে জব্দ করবো আমরা।”
রুকাইয়ার ঠাট্টায় দুজনেই হেসে ওঠেন। আরো দু চার কথা বলে ফোনালাপ শেষ হয়।
রুকাইয়া রান্নাঘরে গিয়ে দেখেন ছেলে ফল কাটছে।
মাকে দেখে শোয়েব হাসলো, বলল, “মা দেখো, মনে হচ্ছে ইফতারির ফল কাটছি” রুকাইয়া হেসে বলেন, “ফল তো ফলই বাবা। কেউ বলে ইফতারি, কেউ বলে প্রসাদ, কেউ বলে ফ্রুট স্যালাড।”
রুকাইয়া এবার চান করতে যাবেন, ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। ছেলে এই সময় এক কাণ্ড করলো, মাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খেলো।
“কিরে হঠাৎ এত আদর কেন মাকে?” রুকাইয়া আহ্লাদিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন।
“থ্যাংক ইউ মা! থ্যাংক ইউ সো মাচ!”
রুকাইয়া ছেলের মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে চলে যান। অনেক কাজ বাকি।
শোয়েব বই ঘরে গিয়ে ফলের থালা শিমুইয়ের বাটি, পায়েসের বাটি, নাড়ুর থালা, ফুলের সাজি, ঘণ্টা সব পাশাপাশি সাজিয়ে রাখে। এই বইঘরটা মা ও ছেলের পরমপ্রিয়। এখন এটা ইরাবতীর আঁকার ঘরও বটে। মতিঝিলের এক কামরার ভাড়া বাড়ি থেকে উঠে যখন মা ছেলে কসবার এই হাজার স্কোয়ার ফুট ফ্ল্যাটে এসে স্থায়ী হলো, তখনই শোয়েব তিনটি ঘরের একটিতে লাইব্রেরি গড়ে তুলল। মা ছেলে দুজনেরই বই পড়ার নেশা। টিসিএসে চাকরি পাওয়ার দু’বছর পরেই এখানে চলে আসা, তার পরেই মায়ের নার্সিংয়ের চাকরি থেকে অবসর নেওয়া। ছেলেকে কীভাবে তিল তিল করে মানুষ করেছেন রুকাইয়া, সেটা শোয়েব এর থেকে বেশি কে জানে?
৩
ইরাবতীর ঘুম ভেঙেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল সে। নটা বেজে গেছে? আম্মা একাই সব করে ফেলল নাকি? তাড়াতাড়ি উঠে বাইরে যাবে, তার আগে শোয়েব ঘরে ঢুকলো।
“কী রে তুই? এত দেরি হয়ে গেছে, তুলিসনি কেন?”
“মাদার ইন্ডিয়া বারণ করেছে ম্যাডাম!”
“আম্মা কি করছে? দূর, ভাল্লাগে না, কোথায় ভাবলাম সেমুই রান্না করবো আম্মার সাথে, ঘুমিয়েই কেটে গেল!”
দরজায় টোকা দিয়ে রুকাইয়া ঘরে ঢুকলেন।
“এই যে মেয়ে, একেবারে চান করে রেডি হয়ে এসো।”
“আম্মা, এটা কি ঠিক হলো? তুমি একা সব করলে কেন?”
“সারাটা জীবন পড়ে আছে তোর এসব করার জন্য! তুই চান করে আয় দেখি।”
ইরাবতী একটা হালকা গোলাপি লখনৌ চিকনের শাড়ি পরেছে, শাশুড়ির দেওয়া। কানে গোলাপি মুক্তোর দুল। শোয়েব কানের তলায় চুমু খেলো।
“এলিগেন্ট লাগছে”
“ঈদ মোবারক শোয়েব”
“তোকেও ঈদ মোবারক। আচ্ছা শোন একটা সারপ্রাইজ আছে তোর জন্য ।”
“কি রে?”
“চোখ বন্ধ কর, খুলবি না , চিটিং করবি না!”
চোখ বন্ধ অবস্থায় ইরাবতীকে শোয়েব বইঘরে নিয়ে এলো। “এবার চোখ খোল”। শোয়েব বললো।
চোখ খুলে ইরাবতী যা দেখল তাতে মুখে আর কিছু বলতে পারলো না। কিন্তু চোখ জলে ভরে গেছে। ঘরে সুন্দর আলপনা। সারা ঘর ধূপকাঠির চন্দন গন্ধে ম-ম করছে। রুকাইয়া বসে আছেন এক পাশে। মিটিমিটি হাসছেন।
“কিরে সব ঠিকঠাক হয়েছে? একবার ভাবলাম, গুগল করে দেখে নিই হাউ টু ডু কৃষ্ণ পূজা। তারপর ভাবলাম ওসব তুই বুঝে নিবি, আমরা শুরুটা তো করি”
এরপর তিনজনে মিলে বসলেন, ইরাবতীর নিজের হাতে আঁকা কৃষ্ণের একটা ছবির সামনে। ইরাবতী ধর্মের ধার ধারে না। কিন্তু তার একটা গভীর কৃষ্ণ প্রেম আছে। তার আঁকার সবচেয়ে প্রিয় বিষয়ও রাধা কৃষ্ণের প্রেম। সেটাই রুকাইয়ার কাছে একদিন গল্প করেছিল।
রুকাইয়া বলেছিলেন “তাহলে পুজো কর না, ভালো তো।” “করব আম্মা? তোমার খারাপ লাগবে না তো?”
“কেন খারাপ লাগবে রে মেয়ে? এই বুঝলি তোর আম্মাকে?”
“ঠিক আছে আম্মা তোমার রোজাটা হয়ে যাক! তারপর একটা ভালো দিন দেখে ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করবো!”
ইরাবতীকে আর দিন দেখতে হয়নি।
রুকাইয়া আর শোয়েবই দিন স্থির করলেন। বাজার থেকে পূজার তৈজসপত্র কেনা হলো। একটা বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠা হবে। হাতের কাছে ঈদ আছে, এর চেয়ে ভালো দিন আর কি হতে পারে!