মনিরুজ্জামান
ছোটবেলা থেকে আমরা সবাই পড়ে এসেছি স্বাস্থ্যই সম্পদ। অথচ ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার পথে এই কথাটা আমরা কেমন যেন ভুলেই যাই। স্বাস্থ্য সত্যি সত্যিই সব অর্থেই সম্পদ। এখন ঘরে ঘরে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি অসুখ। আমার স্বশুর শাশুড়ির শুধু ওষুধ বাবদই মাসে পনেরো হাজার টাকা খরচ হয়। এই খরচ কিন্তু অনেকাংশেই বাঁচানো সম্ভব আমরা যদি আমাদের দৈনন্দিন জীবনচর্চায় সামান্য কিছু পরিবর্তন আনি।
আমাদের বেশিরভাগের অধিকাংশ শারীরিক সমস্যার মূলে আছে আমাদের কায়িক পরিশ্রম বিহীন জীবন এবং খারাপ খাদ্যাভ্যাস।
খাদ্যাভ্যাস: অনেক আগে যখন কৃষি আবিষ্কৃত হয়নি তখন মানুষের খাবার ছিল মূলত ফলমূল এবং মাছ, মাংস। ভেবে দেখুন এগুলো খুব সহজে গাদা গাদা খাওয়া যায় না। তখনকার দিনে চাষ করা নরম নরম মাংস ছিল না। বন্য পশুর পেশীবহুল মাংস বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে হত। ফলমূলও তাই। আপনি চাইলেও গুচ্ছের গুচ্ছ খেতে পারবেন না।
কিন্তু এখন দেখুন, আমাদের সব খাবারই খুব নরম নরম। খেতে বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। অল্প চিবিয়ে বা প্রায় না চিবিয়েই বেশিরভাগ খাবার খেয়ে ফেলা যায়। এতে হয় কি আমাদের ব্রেইন ঠিক বুঝতে পারে না ঠিক কতটা খাবার খেলে যথেষ্ট খাওয়া হয়েছে। ফলস্বরুপ আমরা খাই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি।
কী খাচ্ছি তাতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। আগে লিকুইড ক্যালরি যেমন কোল্ড ড্রিংক ইত্যাদির কোনও ধারণা ছিল না। গুচ্ছের ফাস্ট ফুড ছিল না। এমনকি আগে চাল, আটা, ডাল ইত্যাদিও ছিল আলাদা। এখনকার সব পালিশ করা চাল, আটায় স্রেফ সরল শর্করা পড়ে থাকে, পালিশ করার সময় ওপরের স্তর যেহেতু ছেঁটে ফেলা হয়। তাই আমরা যে পরিমান ভাত রুটি খাই তা থেকে বেশি ক্যালরি কিন্তু কম পুষ্টিগুণ পাই। এগুলো ছাড়া, বাইরের প্যাকেটজাত বিস্কুট, কেক, বিভিন্ন কুকিজ, চকলেট, কোল্ড ড্রিঙ্ক, রেস্তরাঁর খাবার, পিতজা, বার্গার এসবের কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল।
ভাল খাদ্যাভ্যাসের কিছু বাস্তবসম্মত টিপ্সঃ
১। খাবার খান ভাল করে চিবিয়ে চিবিয়ে। খাবার সময় খাওয়ায় মন দিন। টিভি ইত্যাদি দেখবেন না। খাবার যখন মুখের মধ্যে থাকবে তখন অনুভব করুন খাবারের স্বাদ, ওটা কীভাবে আপনার মুখের মধ্যে পিষে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। অনুভব করুন চিবানোর বিভিন্ন পর্যায়ে কিভাবে খাদ্যর স্বাদ পালটে যাচ্ছে। আপনি যত ধীরে ধীরে চিবিয়ে চিবিয়ে মাইন্ডফুলি খাবেন তত আপনার শরীর শুধুমাত্র যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু খেতে শিখবে।
২। ভাত/রুটি খাওয়া কমান। ভাত/রুটি খাওয়া যতটা কম করলেন সেটাকে রিপ্লেস করুন সমপরিমান সবজি দিয়ে। প্রতিবার খাবারের সময় একটা কোনও ফল খাওয়ার চেষ্টা করুন।
৩। লিকুইড ক্যালরি খাওয়া বন্ধ করুন। চা, কফি খাওয়ার অভ্যেস থাকলে সুগারফ্রি কিছু ব্যবহার করুন। চিনির বদলে স্টেভিয়া খুবই নিরাপদভাবে ব্যবহার করা যায়। কোল্ড ড্রিঙ্ক খাওয়ার অভ্যাস থাকলে লো ক্যালরি ডায়েট কোল্ড ড্রিঙ্ক খান। স্বাদ একই কিন্তু তাতে একগাদা চিনি থাকবে না। ফলের রস খাবেন না। ফল খান।
৪। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন মাছ, মাংস, ডিম, ছোলা , বিভিন্ন বাদাম, ডাল, সয়াবিন ইত্যাদি বেশী খাওয়ার চেষ্টা করুন। সাধারণভাবে আমাদের বেশিরভাগের ডায়েটে দরকারের থেকে কম প্রোটিন থাকে।
৫। বাড়ির বাইরে খেতে হলে আগে থেকে প্ল্যান করে রাখুন। সঙ্গে খাবার ক্যারি করুন। ভুলভাল খাওয়া বেশিরভাগ আমাদের তখন হয় যখন আমাদের কোন প্ল্যান থাকে না যে কি খাব। সাধারণত বিকেলে লোকে চপ, শিঙাড়া ইত্যাদি নানান ভুলভাল খাবার খায়।
৬। প্যাকেটজাত দ্রব্যের লেবেল পড়তে শিখুন। বিস্কুট, কেক, ইত্যাদি সমস্ত প্যাকেটজাত খাবারে লেখা থাকে সেটা কী কী দিয়ে তৈরি। কোনোকিছু কেনার আগে দেখুন তাতে Added Sugar কত আছে। যেগুলোতে এডেড সুগার একশ গ্রামে দশ গ্রামের থেকে বেশি সেগুলো এভয়েড করুন। ময়দা দিয়ে তৈরি জিনিস এভয়েড করুন।
কায়িক পরিশ্রম: খাদ্যাভ্যাস সুস্বাস্থ্যের একটা অংশ, আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হল কায়িক পরিশ্রম। আমাদের বেশিরভাগেরই এখন প্রায় কোনরকম কায়িক পরিশ্রম করতে হয় না। প্রায় সমস্ত কাজ এখন একটা সুইচ টিপে দিয়ে হয়ে যায়। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করা খুবই দরকার।
কী ধরণের ব্যায়াম করছেন তার ওপর নির্ভর করে প্রতিদিন আধঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা ব্যায়াম করা দরকার। কী ব্যায়াম করবেন? যা আপনার ইচ্ছে। যা আপনার করতে ভাল লাগে। সাঁতার কাটুন, জিমে যান, কোনও কিছু খেলুন, যোগা করুন, ঘরে ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করুন ইত্যাদি। কী ধরণের ব্যায়াম করছেন সেটার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ব্যায়াম করা। আর যদি কিছুই না ভাল লাগে তাহলে হাঁটুন। স্রেফ হেঁটেই অনেক অনেক সাস্থ্যগুণ পাওয়া যায়।
ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন দিনে ন্যূনতম আটহাজার পা হাঁটতে বলে। আমার মতে সেটা বেশ কম। আপনি যদি দিনে বারো থেকে পনেরোহাজার পা হাঁটেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই অনেক রোগ ব্যাধির প্রকোপ থেকে মুক্তি পাবেন।
ফিটনেস ব্যান্ড পাওয়া যায় যেগুলো দিয়ে আপনি হাঁটা ট্র্যাক করতে পারেন। এমনি স্মার্টফোনেও হাজারো অ্যাপ আছে যেগুলো আপনার হাঁটা ট্র্যাক করতে পারে। আপনাকে যে একবারেই এত হেঁটে ফেলতে হবে তা নয়। এক্টিভ থাকুন সারাদিন। টেকনোলজির সাহায্য নিন। কুড়ি মিনিটের টাইমার লাগিয়ে রাখুন। টাইমার বেজে উঠলেই, চেয়ার, সোফা, বিছানা যেখানে বসে ছিলেন সেখান থেকে উঠে পড়ুন। দুই মিনিট হাঁটুন। এরকম করলে প্রতি ঘণ্টায় ছয় মিনিট হাঁটা হবে। আট ঘন্টা যদি অফিসে থাকেন তাহলে সেখানেই পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটা হয়ে যাবে।
যখনই কাউকে ফোন করতে হবে, বসে বসে বা শুয়ে শুয়ে কথা বলবেন না। ফোনে কথা বলতে বলতে হাঁটুন। স্টেপ সেট গো নামে একটা অ্যাপ আছে। সেটা ডাউনলোড করে নিন। ওই অ্যাপে হাঁটলে কয়েন পাবেন। সেই কয়েন দিয়ে নানান ফ্রি জিনিস পাওয়া যায়। দারুণ কুল ব্যাপার। আমার এক বন্ধু একটা অয়ারলেস হেডফোন পেয়েছে স্রেফ হেঁটে হেঁটে।
স্বাস্থ্যই সম্পদ, সবরকম অর্থে। সকলে সুস্থ থাকুন, অর্থবান থাকুন।