এই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক শাহযাদ ফিরদাউসের সাক্ষাৎকার নিলেন বর্তমান সময়ের অন্যতম প্রতিভাবান গল্পকার নাফিস আনোয়ার

শাহযাদ ফিরদাউস

[ভিন্নধারার ঔপন্যাসিক এই আপাত ক্লিশে কথাটি ব্যবহার করেও বোধহয় শাহযাদ ফিরদাউসকে ঠিকঠাক বর্ণনা করা সম্ভব নয়। বরং বাংলা সাহিত্যে অন্য এক ধারার জন্মদাতা হিসেবে তাঁকে ব্যাখ্যা করাটা যুক্তিযুক্ত হতে পারে। সেই ধারার সাথে প্রবলভাবে জড়িয়ে আছে দার্শনিক চিন্তার গভীরতা, বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব এবং সর্বোপরি মানুষের প্রতি ভালোবাসা। ৪২ বছর বয়সে লেখা ব্যাস উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি পাঠক মহলে সমাদৃত হন। তারপর একে একে লিখেছেন কুড়িটি উপন্যাস। অঙ্গুলিমাল, লামেদ-ওয়াফ, শাইলকের বাণিজ্য বিস্তার, পালট মুদ্রা, মহাভার, প্লেগ, কানানগণ প্রভৃতি উপন্যাসগুলির প্রত্যেকটি মননশীল পাঠকের কাছে সাড়া ফেলেছে। গৌতম ঘোষের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র মনের মানুষের স্ক্রিপ্ট ও গান লেখার কাজেও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। বেশি না, শুধুমাত্র তাঁর উপন্যাসগুলির উৎসর্গ অংশটি দেখুন আপনি বুঝে যাবেন কেন তিনি অনন্য। তাঁর সাম্প্রতিকতম উপন্যাস ইহদেহ ঠিক একইভাবে উৎসর্গ করেছেন–’ভয়ঙ্কর ভাঙনের মুখেও যারা পৃথিবীকে সুন্দর করে সাজাতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে।’ এই সুন্দর পৃথিবী, শান্তির পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে কলকাতা শহরের প্রাণকেন্দ্রে বসেও নিভৃতে এই সত্তর বছর বয়সেও তাঁর জীবন দর্শনের প্রতিটি কণা উজাড় করে নিরলস সাধনা করে চলেছেন, লিখে চলেছেন। এই মুহূর্তের বাংলা সাহিত্যে তিনি একজন প্রকৃতই আন্তর্জাতিক মানের, আন্তর্জাতিক ভাবনার ঔপন্যাসিক। ফোনে কথোপকথনের মাধ্যমে নেওয়া সাক্ষাৎকারটি তাঁর অনুমতিক্রমে খানিকটা নিজের মত করে সাজিয়ে লেখা হল]

কেমন আছেন?

ভালো আছি।

লিখছেন?

হ্যাঁ লিখছি তো।

এখন কী লিখছেন?

এই তো বিপদে ফেললে(হাসি)। চারপাশের এই ভয়াবহ অবস্থা তো আমাদের সকলকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষেই আমরা এখন নাড়া খাওয়া মানুষ। এই করোনা রোগ! কে বাঁচবে কে মরবে কেউ জানে না। এই নিয়েই লিখছি। যদিও রোগের কথাটি সরাসরি আমার এই লেখায় খুবই কম আছে। এক কথায় বলতে হলে– এই গভীরতম সংকটকালে মানুষের উত্তরণের আকাঙ্খা, একে কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা–এটাই আমার লেখার বিষয়।

বর্তমান সময় নিয়ে আপনার ভাবনাটি যদি বলেন?

দেখো আমার যেটা মনে হয়, পৃথিবী এখন একটা অদ্ভুত যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এই সন্ধিক্ষণের দু’রকম ফলাফল হতে পারে। এক, যারা এই পৃথিবীটাকে এতদিন দখল করে রেখেছে, সেই ক্ষমতাবান, অর্থবান কিছু মানুষ, মানবজাতির অত্যন্ত নিকৃষ্ট পর্যায়ের এই মানুষগুলো, পুরোপুরি এই বিশ্বটাকে দখল করে নেবে। ফলে আজকে যেভাবে শ্রমিকদের দুর্দশা হচ্ছে, নিম্নবিত্ত মানুষদের দুর্দশা হচ্ছে সেভাবেই এমনিতে কোণঠাসা সমস্ত সেন্সিবল মানুষ শেষ হয়ে যাবে। অথবা দুই, এই প্রকৃত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, দলিত, শ্রমিকসহ সমাজের সবচেয়ে দুর্ভাগা যারা তারা এককাট্টা হবে আর নতুন সভ্যতা রচনা করবে।

এই দ্বিতীয়টা হওয়ার ব্যাপারে আপনি কি আশাবাদী?

আমি বরাবর আশাবাদী মানুষ। নৈরাশ্যবাদ জীবনের ধর্ম নয়। হ্যাঁ যখন কেউ পাশে থাকে না, জীবনের কোন সময়ে যখন তুমি অপমানিত হও তখন নিশ্চয় ভালো লাগে না কিন্তু সেটা যে কাটিয়ে উঠতে পারে সেই তো খাড়া থাকে।

দেখো একটা কথা বলি, এই যে ‘শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ’ কথাটা সবাই ব্যবহার করে, এই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষগুলোই আসলে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নয়। ফলে এরা কোনদিন একত্র হতে পারবে না। তাহলে কি হতাশ হয়ে চুপচাপ বসে থাকবে সবাই! না, থাকা উচিত নয়। যদি দুটো মানুষও তোমার পাশে থাকে তাদের সংগঠিত করাটাই তোমার কাজ। যদি কেউ না থাকে তাহলেও নিজের কাজটা করে যেতে হবে। এটাই আমার জীবনের শিক্ষা।

এ নিয়ে যদি আর একটু বলেন?

আমার জীবনের কথাটাই বলি। আমার প্রথম উপন্যাস ব্যাস। আমাকে কেউ কিন্তু তখন অ্যাসাইনমেন্ট দেয়নি হিন্দু মাইথলজি, হিন্দু সংস্কৃতি, হিন্দু সভ্যতা, তার দর্শন নিয়ে কাজ করার। একইভাবে খ্রিস্টান ধর্ম, ইহুদি ধর্ম নিয়ে কাজ করেছি। বৌদ্ধধর্ম নিয়ে তো একাধিক কাজ করেছি। আর ইসলাম তো জন্মগতভাবেই কিছুটা পেয়েছি। আর আমার লেখা যাঁরা পড়েন তাঁরা জানেন কোনোটাতেই এতটুকু ফাঁকিবাজি করিনি। কাজগুলি করার পরেও কেউ ফিরে তাকায়নি, ভাবেইনি যে এই একটা লোক সারাজীবন ধরে ভয়ঙ্কর পরিশ্রম করে এই কাজগুলো কেন করে গেল! আমি আমার তাগিদ থেকেই করে গেছি। সংক্ষেপে বললে আমি আমার জীবনটা বরবাদ করে দিয়েছি বিশ্ব শান্তি বলো, মানুষের শান্তি বলো বা শান্তিপূর্ণ পৃথিবীর নির্মাণ যাই বলো, তার জন্য।

এ নিয়ে কোন আক্ষেপ নেই তো আপনার?

আক্ষেপের ব্যাপার নয়। ব্যাপারটা তোমায় বুঝতে হবে। এতগুলো উপন্যাস লেখা ছাড়াও আমি নানারকমের সংগঠন করার চেষ্টা করেছি। কলকাতা পিস মুভমেন্ট করার চেষ্টা করেছি, গোর্কিসদনে লিটেরারি ক্লাব করেছি কিন্তু এসব কাজে মানুষ পাওয়া যায়‌ না। একটা বাচ্চাদের স্কুল চালাই তাতে প্রথমে অনেকে এল। এই করবে ওই করবে… তারপর যখন দেখল পাওয়ার কিছু নেই সবাই সরে গেল। আমি তো পাওয়ার জন্য কিছু করিনি। মৃত্যুর পর কিছু পাব সেটাও বিশ্বাস করি না। আমি আমার কাজের মাধ্যমে এভাবেই আমার জীবনটাকে জাস্টিফাই করে গেলাম।

আপনার জীবনের সম্বন্ধে কিছু জানতে চাই?

বলো।

ব্যাস তো আপনি লিখলেন যখন মোটামুটি আপনার বিয়াল্লিশ বছর বয়স। এর আগে কখনো উপন্যাস লেখার কথা ভাবেননি?

না ভাবিনি। ছোটবেলায় আমি কবিতা লিখতাম। আমার যখন সতেরো আঠারো বছর বয়স তখনই নামীদামি পত্রিকায় আমার লেখা বেরিয়েছে, দেশ পত্রিকায় বেরিয়েছে। কিন্তু এরপর কবিতা লেখা ছেড়ে দিলাম।

কেন?

সেইসময় প্লেটো অ্যারিস্টটলের কিছু বই পড়তে শুরু করি, যা সেইসময় হাতের কাছে পাওয়া যেত আর কী। প্লেটোর সিম্পোসিয়াম, সক্রেটিসের বিচার এইসব। সেসব পড়ার পর আমার নিজের কবিতা এবং চারপাশে যে কবিতা লেখা হচ্ছে, সবকিছুকে ভীষণ অগভীর শ্যালো মনে হতে লাগল। তখন আর কবিতা লিখতে পারছিলাম না।

তারপর?

তারপর সিনেমার দিকে আগ্রহ তৈরি হল। এদিকে তখন লেফ্ট ওরিয়েন্টেশন তৈরি হচ্ছে। মানুষের জন্য কাজ করব, মানুষের কথা বলব, মানুষের কাছে যাব এইসব ভাবনা আর কি! কিন্তু সিনেমা এমন একটা মাধ্যম যার জন্য একদিকে দরকার পড়ে প্রচুর পরিমাণ টাকা অন্যদিকে টিকে থাকার জন্য দরকার ভয়ানক চাতুর্যেরও। সেটা আমার দ্বারা রপ্ত করা সম্ভব ছিল না। ফলে ছবির জগতে আমি কিছুই করতে পারিনি।

ব্যাসও তো চিত্রনাট্য ছিল প্রথমে। তাই নিয়ে দিলীপ কুমারের সিনেমা করার কথা ছিল। আপনি তাঁর বাড়িতে ছিলেনও!

আমি সিনেমা করেছি। দু ঘন্টা ষোল মিনিটের ‘তথাগত’ বানিয়েছিলাম হিন্দিতে। টেলিকাস্ট হয়েছিল। নন্দনে দেখানোও হয়েছিল। বুদ্ধ সংসার ত্যাগ করেছিলেন ২৯ বছর বয়সে আর সিদ্ধিলাভ করলেন ৩৫ বছর বয়সে। বুদ্ধের তারপরের জীবন সম্বন্ধে কমবেশি আমরা জানি। কিন্তু তাঁর জীবনের ওই মাঝের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সময়টা নিয়ে কেউ কিছু বলে না। আমি সেটাকেই ধরার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু এইসব ছবি তো জনপ্রিয় হবার কথা নয়। হয়নি‌।

এখানে একটি প্রশ্ন করতে চাই। আপনার সম্বন্ধে বলা হয়–আপনি সিরিয়াস লেখক। এটাও বলা হয়–আপনার পাঠক অল্প, তারা সিরিয়াস পাঠক। একটি অনুষ্ঠানে একজনকে বলতে শুনেছি–আপনার লেখা সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে গেলে বিপদের সম্ভাবনা আছে। এই সিরিয়াস শব্দটা আপনি কেমন ভাবে নেন?

(হাসি) বিপদের কথা কেউ কেন বলেছেন আমি জানি না। কিন্তু এটা ঠিক সিরিয়াস বলে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। আবার এটাও ঠিক যে চারপাশে সবাই সমান বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হয় না। সবার মেধা, সারমর্ম অনুধাবন করার ক্ষমতাও এক নয়। সিরিয়াসনেস একটা ক্যারেক্টার। সিরিয়াসলি জীবনচর্চা করতে হবে, জীবনকে বুঝতে হবে, দেখতে হবে; অন্তত বোঝার চেষ্টা করতে হবে। যে সিরিয়াস জিনিসকে বুঝতে পারে না, উপলব্ধি করতে পারে না তার পক্ষে সিরিয়াস রিডার হওয়া সম্ভব নয়।‌ সিরিয়াস লেখক, সিরিয়াস পাঠক হওয়া সারা জীবনের সাধনা‌।

আপনিও কী এই একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক সিরিয়াস মননশীল পাঠকই চান?

আমি আমার কথা বলতে চাই, বলে যেতে চাই। আর যখনই তুমি তোমার কথা বলবে, তোমার ভাবনার কথা বলবে, তোমার জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলবে, দেখবে লোক কম। শোনার লোক কম, বোঝার লোক আরো কম।

ইহদেহ আমি এমনি লিখিনি ভাইটি (হাসি)! আমার আরেকটি উপন্যাস আছে ‘সময়সীমা দশ সেকেন্ড’। সেটা আরো মারাত্মক। একটাই ক্যারেক্টার সেখানে–আমি। এই দুটো বইতে আমার কথা আছে। অবশ্য প্রত্যেকটি উপন্যাসেই আমার কথা আছে। যেমন একদম সম্প্রতি যেটা লিখেছি।

সেটা শেষ হয়েছে?

হ্যাঁ শেষ হয়েছে। প্রায় ছয় সাত বছর লিখিনি। তারপর যখন লিখতে শুরু করলাম পরপর লিখে ফেললাম। প্রথমে ইহদেহ, পরে এটি। এখানে এক কবির কাহিনী। মানে একটা উড়নচণ্ডী চরিত্র। কবি বলতে ছোটবেলায় যে ধারণা আসত আমাদের, সেরকম কবি, আজকের এই ধান্দাবাজ কবি, ঘুষখোর কবি, টাউট কবি, বদ কবি… এরকম নয়।(হাসি)

এসব লিখব?

হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি সোজাসুজি বলি। এরা আরেকটু ওপরে উঠতে, একটু বড় হতে সব পারে–মানুষ খুন করতেও পারে। যা বলছিলাম, কবি ফারাকদিল, আমার পরের উপন্যাস। একটু বেখেয়াল চরিত্র, অবশ্য বেখেয়াল না হলে কবি কি করে হয় বলো তো! তার জীবন সার্থক নয়। এখানেও সেই আমার প্রথম জীবনের কবি সত্তাও আছে।

আর ইহদেহতেও তাই। তুমি যদি এ পৃথিবীতে ছোট্ট একটা ফুলের বাগান করতে চাও লোকে পাগল বলবে। আরো বড় বাগান করে তোমার এলাকাকে ফুলে সাজিয়ে দিতে চাও তাহলে লোকে উন্মাদ বলে উত্যক্ত করবে আর যদি তুমি এই পুরো জেলা, রাজ্য কিংবা দেশটাকেই ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিতে চাও তো লোকে তোমাকে জেলা ছাড়া, দেশছাড়া করে ছাড়বে।

আপনি কি আপনার লেখায় বস্তুবাদ ও ধর্মীয় দর্শনের মিলমিশের চেষ্টা করেছেন?

না না না। বস্তুবাদ বস্তুবাদের যায়গায় ধর্মীয় দর্শন ধর্মীয় দর্শনের যায়গায়। আমি কোথাও কোনটাকে মেলাতে চেষ্টা করিনি।‌ এটা তো ঠিক প্রতিটি ধর্মের মধ্যেই প্রথমদিকে পজিটিভ কিছু যায়গা ছিল। পরে তা যখন আচারসর্বস্ব হয়ে রিজিড হয়ে গেল তখন তার সংস্কারমূলক ভূমিকা আর রইল না। সে ব্যাকডেটেড হতে লাগল। বর্তমানে চারপাশটা দেখো, তুমি মুক্তমনা হও, নাস্তিক হও কিন্তু নিজের নামটা আড়াল করবে কী করে! ফলে, ধর্ম মানি না কথাটা বলা সহজ কিন্তু করা ততটা সহজ নয়। তুমি সমাজ নিরপেক্ষ হতে পারবে? পারবে না। সিস্টেমটাই এভাবে তৈরি। আর এই সিস্টেম যতদিন থাকবে ততদিন এই অসভ্যতা গুলোও চলবে। প্রকৃত মুক্তমনা সমাজ এখনো বহু সময়ের অপেক্ষা। ধর্ম মানো, না মানো, ধর্মকে অস্বীকার করতে পারবে না। এজন্যই ব্যাস লিখলাম।

ব্যাসে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আমায় ধর্মবিশ্বাসী বলে মনে হয়, আবার এমন কোন জায়গাও নেই যেখানে আমায় অবিশ্বাসী মনে হয়। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস অবিশ্বাস যাই থাক, লেখায় আমি দুটো ভিন্নমতকেই প্রাধান্য দিয়েছি–আস্তিক এবং নাস্তিক। তাই চার্বাক এবং ব্যাস দুজনকেই আমি সমান গুরুত্ব দিয়েছি।‌ এই জায়গাটা সাহিত্যের বিচারে খুব জরুরি।

আচ্ছা আপনি একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন– আমি একই ভুল বারবার করতে ভালোবাসি, একই বিশ্বাসঘাতকের কাছে বারবার যেতে পছন্দ করি, বারবার ঠকতে ভালোবাসি! এর মানে কী?

(জোরে হেসে উঠলেন) হ্যাঁ এটার মানে করা একটু শক্ত। ব্যাপারটা হল, এমন কেউ যে আমার সাংঘাতিক ক্ষতি করেছে তারপর একদিন হেঁহেঁ করে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। এর পিছনে কারণ যেটা বুঝেছি সেটা হল আমি মানুষ ভালোবাসি।‌ এই বয়সে এসে এটাই আমার উপলব্ধি। আর মানুষ ভালোবাসার অর্থ শুধু ভালো মানুষকে ভালোবাসা নয়। যে পাপিষ্ঠ, নিকৃষ্ট‌ মানুষকে ভালোবাসে, যে নিজের ক্ষতি করা মানুষটাকেও ভালোবাসে, সেই প্রকৃত মানুষকে ভালোবাসে। এটা বোঝানো কঠিন, উপলব্ধি করতে হয়।

আপনার প্রিয় লেখক কে? একবার এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন কাফকা দস্তোয়ভস্কির কাছে কিছুই না!

(হাসি) কাফকা কিছু না এটা বলা অবশ্যই উচিত না। আমি যেটা বলতে চেয়েছি আধুনিক উপন্যাসের জগতে দস্তোয়ভস্কি আর তলস্তয় নিঃসন্দেহে সর্ববৃহৎ, সর্বমহৎ। কিন্তু ধরো বিশ্বসাহিত্যে এঁরা দুজন নেই তখন কাফকা কাম্যু অবশ্যই খুব বড়।

আর কাদের লেখা ভালো লাগে বললে বলব যেকোন মহৎ সাহিত্যই আমার প্রিয়। তলস্তয় দস্তয়ভস্কির নাম বললাম কারণ তাঁরা শিখর। রুশ গদ্য এমনিতেই আমার খুব প্রিয়। যেকোনো দেশের মহৎ সাহিত্য যা টিকে আছে অবশ্যই তার মধ্যে গ্রেটনেস আছে। যেমন সের্ভান্তেসের দন কিহোতের মধ্যে অবশ্যই গ্রেটনেস আছে। আমি মহাকাব্যগুলো খুব গভীর ভাবে পড়ার চেষ্টা করেছি। রামায়ণ মহাভারত। যদিও মহাভারত মহাকাব্য হিসাবে অনেক বেশি মহান। ফিরদৌসির শাহনামা, ইরানিয়ান এপিক, এখনো সারা পৃথিবীর কাহিনীতে শাহনামার অনেক কিছু আলোচিত হয়। রুস্তম সোহরাবের কাহিনী যেমন। কলকাতায় এখনো বড় মস্তানকে রুস্তম বলা হয়। এটাই সাহিত্যের শক্তি। কোথায় ইরান কোথায় ভারত অথচ রুস্তম শব্দটা এখানে প্রবাদে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই শক্তিটাকেই একজন লেখক মানবকল্যাণে ব্যবহার করতে পারেন, মানুষের মুক্তির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু তা হচ্ছে না।

কেন হচ্ছে না?

কারণ সাহিত্য শুধু অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাহিত্য শুধু ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাহিত্য করে বাড়ি গাড়ি টাকা করব এটাই সবার লক্ষ্য।

বর্তমান বাংলা সাহিত্য নিয়ে আপনার কী মত?

আমার মত হল বাংলা সাহিত্যের যাঁরা লেখক তাঁরা ভালো পাঠক নন। তাঁরা অনেকে দস্তয়ভস্কি তলস্তয় পড়েননি। পড়লেও সিলেবাসে যতটুকু আছে ততটুকু পড়েছেন অথবা এইটা না পড়লে জাত যাবে মনে করে পড়েছেন। আমার পরিচিত একজন একবার তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস সম্বন্ধে বলেছিলেন যে এই বইটার এক তৃতীয়াংশ অংশ ছিঁড়ে ফেলা উচিত। কেন! না অনেক বেশি লেখা হয়ে গেছে! এই তো পাঠক! এঁদের হাতে আবার বাংলা সাহিত্যের ভার এবং ভবিষ্যত। এটাই বর্তমান বাংলা সাহিত্যের ট্র্যাজেডি। আমি এটাই বলব– এখন বাংলা সাহিত্য খুব দুর্বল মেধাহীন লোকেদের দ্বারা চালিত।

এইসময় সাহিত্যিকদের কী করা উচিত বলে মনে হয়?

সাহিত্যিকরা কী করবেন জানি না কিন্তু আমি যেটা মনে করি এই গভীরতম সংকটকালে প্রতিটি প্রকৃত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে কাছে আসতে হবে, পরস্পরের হাত ধরতে হবে। পড়শি যদি তার পড়শিকে দেখে তাহলেই সবাইকে সবার দেখা হয়ে যায়।

দেখো তুমি আমি যে ভবিষ্যত নিয়ে আশঙ্কা করছি সেটা তো একেবারে হাওয়ায় নয়। দক্ষিণপন্থী সরকার বিশেষত এইরকম সরকার ক্ষমতায় এলে এটা হবেই। সুহার্তো ইন্দোনেশিয়ায় তিরিশ লক্ষ মানুষকে শেষ করে দিয়েছিল। কীভাবে? সিআইএ-র পদ্ধতি, তাদের আইডিয়া, তাদের লিস্ট দেখে দেখে। হিটলার একই কাজ করেছিল আরো বড় আকারে! এরা যদি মনে করে জনসংখ্যার বিশ তিরিশ শতাংশ উদ্বৃত এদের কাছে, সমাধান একটাই– মেরে দাও। শ্রমিকরা বাড়ি ফিরছে। দিনেরবেলা লু বইছে। হাঁটতে পারছে না। অথচ রাতে কার্ফু জারি করে দেওয়া হল! মানেটা কী! মানে হল– মরে যাক এরা! এটাই চাইছে।

তাহলে?

আমি বিশ্বাস করি এভাবে চলতে পারে না। সাহিত্য যেমন অসৎ দুর্বল মেধার লোকেদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে এই পৃথিবীটাও অসৎ অত্যন্ত নিকৃষ্টধরণের লোকদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।

এর থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য বিরাট পাণ্ডিত্যের দরকার নেই, বিরাট বিজ্ঞানের আবিষ্কারের দরকার। হৃদয়ের দরকার, সহানুভূতির দরকার, সহশীলতার দরকার। সাহিত্যিকের দায়বদ্ধতা এখানেই।

এই যে গ্লোবাল ওয়ার্মিং। এটা কি বড় বড় নেতারা, পণ্ডিত, বিজ্ঞানীরা বোঝেন না। মানুষকে তারা সহজ সরল ভাষায় এর বিপদ সম্বন্ধে বোঝাতে পারেন তো। কিন্তু তারা বোঝাবেন না। আর মানুষও লেগে রয়েছে ইঁদুর দৌড়ে। বোঝার ধৈর্য্য, স্থৈর্য, মানসিকতা নেই। টাকা টাকা টাকার পিছনে ছুটছে। সেদিন একটি আর্টিকেল পড়ছিলাম সেখানে বলছে– আমরা যত জিনিস ব্যবহার করি তার বেশিরভাগই ব্যবহার ছাড়াও আমাদের চলে যায়। আগে সেভাবেই চলত। অনেক কমেই মানুষের চলে যায়। কিন্তু যান্ত্রিক সভ্যতার তা হতে দেবে না।

আপনার এক বন্ধু আপনার লেখা সম্বন্ধে একবার বলেছিলেন আপনার লেখায় শুধু সমস্যা থাকে না তা থেকে উত্তরণের পথও থাকে, তাই এত ভালো লাগে!

না ঠিক এমনটাই বলেননি। সে বলেছিল আমার লেখায় আমি মানুষের সামনে অনেক প্রশ্ন তুলে ধরি আবার তার জবাব দেওয়ারও চেষ্টা করি। সে সেটা প্রশংসা করে বলে থাকবে হয়ত।

আমার মতে আমার যা লেখার ধরন তাতে আমি সংকটটাকে তুলে ধরতে পারি। আর পৃথিবীর গভীরতম সংকটের সমাধান আমি কি করে জানবো! সেটা সম্ভব নয়। আর সমাধান যেটাকে বলছ–মানুষের হাত ধরা, ভালোবাসা, সহনশীলতার কথা এসব তো আমার আবিষ্কার নয়। মানুষের সভ্যতা তৈরি হওয়ার পিছনে এগুলিই ছিল প্রধান চালিকাশক্তি। পরস্পরের হাত না ধরলে মানুষ কবেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। বন্য পশুর হাত থেকে বাঁচতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচতে তারা একসাথে পালাতো না হলে একসাথে রুখে দাঁড়াতো। তারপর চাষাবাদ শুরু হল। চাষবাসও একা করা যায় না। অর্থাৎ মানুষের সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে একত্রে থাকার, একত্রে বাঁচার অভ্যেসটা করতে হবে।

আর এর থেকেই আরেকটি গভীর বিষয় বর্তমানে আমার মনে হচ্ছে সেটা বলেই আজকে শেষ করব।

সেটা কী?

কনসেপ্ট অফ কানট্রি–এটাকে উড়িয়ে দিতে হবে। কনসেপ্ট অফ ফ্যামিলিকে রিসাফল করতে হবে। জাতীয়বাদের ধারণাটাই বদলে দিতে হবে।

কিন্তু এখন সেই উগ্র জাতীয়তাবাদকেই হাতিয়ার করা হচ্ছে।

দুবারের নোবেলজয়ী লিনাস পাউলিং একবার বলেছিলেন– ন্যাশেনালিজমের কনসেপ্টটা শুধু ব্যাকডেটেড নয় ফসিল।‌ এরা ইচ্ছাকৃতভাবে জাতীয়তাবাদকে বাড়িয়ে তুলছে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। দেখো আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে যখন পরিবারের ভাবনা এল তখন থেকেই মানুষ স্বার্থপর হতে শুরু করল। সেখান থেকে দেশের কনসেপ্ট এল, তখন স্বার্থের সংঘাত আরো একধাপ বাড়ল।‌ তুমি বলবে তাহলে কি আদিম যুগে ফিরে যেতে হবে! সেটা হলে তো ভালোই হয়। সেভাবেই যদি সে যুগে সভ্যতা এগিয়ে থাকতে পারে তাহলে এখন তাতে ক্ষতি কী! এবার কী হয়, কোন জিনিসের একদম একইরকম ভাবে তো পুনরাবৃত্তি হয়‌ না। আমি যেটা বলছি এই যে বর্ডার সিস্টেম, ফ্যামিলি একটা বর্ডার, দেশ আরেকটা বর্ডার, এরকম আরো আছে, এ দুটো বোঝা সহজ বলে বলছি, এটাকে রিসাফল করতে হবে। ভেঙে দিতে পারলে আরো ভালো। কে কি মনে করল আমার তাতে যায় আসে না। তুমি এটা লিখতেই পারো। আমি এটাই চাই। সমস্ত রকমের বিভাজন মুছে গিয়ে এক পৃথিবী, এক মানুষ, এক জাতি– এইভাবে যদি ভাবা যায় তাহলে মানুষের মধ্যে মুক্তির সম্ভাবনা আছে। না হলে এই মারামারি, কাটাকাটি চলতেই থাকবে। আমি সারাজীবন সাহিত্যে যা করেছি, যেখানে যা বক্তব্য রেখেছি তার মূল মেসেজ হল এইটুকুই।

অনেক অনেক ধন্যবাদ।

ধন্যবাদ। ভালো থেকো।

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *