ইসলামে ‘পরধর্মবিদ্বেষ’-এর অভিযোগ: সত্যাসত্য নির্ণয়

রাজকুমার চক্রবর্তী

ইসলাম সম্পর্কে একটি ‘লোকপ্রচল’ ধারণা হল—ইসলাম চূড়ান্তভাবে পরধর্মবিদ্বেষী ও সহিংস ধর্ম। ‘এক হাতে কোরান, অন্য হাতে তরোয়াল’ নিয়ে এই ধর্মের সম্প্রসারণ ঘটেছে—এমন একটি ধারণা এডওয়ার্ড গিবনের ডেক্লাইন অ্যান্ড ফল অফ রোমান এম্পায়ার-এর প্রকাশকাল থেকে সেই যে চালু হয়েছিল, আজও তার ‘বাজার পড়েনি’। ২০০৬ সালে প্রকাশিত একটি গ্রন্থের শিরোনাম: দি ট্রুথ এবাউট মুহাম্মাদ: ফাউন্ডার অফ দি ওয়ার্ল্ড’স মোস্ট ইনটলারেন্ট রিলিজিয়ন (লেখক রবার্ট স্পেনসার)। এই ব্যাখ্যা অনুসারে, ইসলাম অন্য ধর্মাবলম্বীদের সমানাধিকারে তো বিশ্বাসী নয়ই, সহাবস্থানও সহ্য করে না। ধারণাটি হিন্দুত্ববাদী মহলেও জনপ্রিয়। হিন্দুত্ববাদী শিবিরে নাম-লেখানো এক ভারতীয় ঐতিহাসিক (কে এস লাল) ১৯৯৯-এ প্রকাশিত একটি পুস্তকে লিখছেন: ‘কোরান মানবজাতির ভ্রাতৃত্বের দলিল নয়, তা যুদ্ধের নির্দেশিকা। অন্যধর্মের মানুষের জন্য জিহাদ বা চিরস্থায়ী যুদ্ধের ডাক দিয়েছে কোরান। তাদের ‘আটক করার, বেঁধে ফেলার, মুন্ডু কাটার ও আগুনে নিক্ষেপ’-এর বিধান সেখানে লিপিবদ্ধ। ফলস্বরূপ ইসলাম রূপান্তরিত হয়েছে ‘একটি সর্বগ্রাসী ও সন্ত্রাসমূলক মতবাদে’। ইসলামের ইতিহাসে ‘বিধর্মী’-দের জিজিয়া কর দেবার বিধানটিকেও অধ্যাপক লাল পাঠ করেছেন এই অনুষঙ্গে। তাঁর ভাষায়, ‘জিজিয়া কোনও আর্থিক বন্দোবস্ত নয়, এটি মূলত একটি জিহাদি ব্যবস্থা’, কাফেরদের জন্য ‘শাস্তিমূলক জরিমানা’, অমুসলমানদের ‘বঞ্চনা ও অপমানের প্রতীক’। এর বিকল্প ছিল মৃত্যু, সম্পদের লুন্ঠন, দাসত্ব, মুক্তিপণ ও বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ (দি থিওরি অ্যান্ড প্র্যাকটিস অফ নুসলিম স্টেট ইন ইন্ডিয়া)। বর্তমান প্রবন্ধে আমি উপরিউক্ত ধারণার যাথার্থ্য ও প্রামাণিকতা যাচাই করব ইসলামের আদিপর্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করে। ‘আদিপর্ব’ বলতে বোঝাতে চাইছি হজরত মুহম্মদের সময়কাল থেকে ইসলামের ইতিহাসের প্রথম কয়েকশো বছর, যখন মিশর সহ মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তীর্ণ অংশে ইসলামি রাজনৈতিক শক্তির সম্প্রসারণ ঘটেছিল।

সকলেরই জানা, ইসলামের উত্থান সপ্তম শতকে, আরবের হিজাজ অঞ্চলের অন্তর্গত মক্কা ও মদিনা থেকে। তৎকালীন আরবের সবচেয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠী কোরাইশদের বসবাস ছিল মক্কায়। কোরাইশ গোষ্ঠীরই মানুষ ছিলেন হজরত মুহম্মদ। কোরাইশরা ছিল বহুদেববাদী পেগান। ৬১০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আল্লাহ-র প্রথম প্রত্যাদেশ পেয়ে নবি মুহম্মদ সেই ধর্মবিশ্বাসের বিরোধিতায় নামেন। কোরাইশরা মুহম্মদকে রসুল বা নবি হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে। মুহম্মদের সংখ্যাল্প অনুগামীদের বিরুদ্ধে নামিয়ে আনে নিপীড়ন। প্রাণনাশের চেষ্টা হয় মুহম্মদের। কিন্তু তীব্র বিরোধিতার মুখেও মুহম্মদ ছিলেন নিজের বিশ্বাসে প্রত্যয়ী। ‘অবিশ্বাসী’-দের উদ্দেশে উচ্চারণ করেন ‘সতর্কবাণী’: জগতের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ-র প্রত্যাদেশ যারা অবমাননা করবে ‘শেষ বিচারের দিন’ তারা পাবে অনিবার্য শাস্তি—দোজখের অনন্ত যন্ত্রণা। সংখ্যালঘু অনুগামীদের মনে করিয়ে দেন ধৈর্য ও বিশ্বাসে অটল থাকা ও আল্লাহ-নির্দেশিত নীতিনিষ্ঠ জীবনের গুরুত্ব—বেহেস্তের অনন্ত সুখ-উপভোগের নিশ্চয়তা। এই পর্বের হজরত মুহম্মদ তাঁর একেশ্বরবাদ প্রচারে বিন্দুমাত্র বলপ্রয়োগে বিশ্বাসী নন।

মদিনাপর্বে (৬২২-৬৩২), যখন মুহম্মদ কেবল একজন নবি নন, ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা’-র অধিকারী ‘প্রশাসক’-ও বটেন, তখন পেগান ‘অবিশ্বাসী’ ও মুহম্মদ-অনুগামীদের ক্ষমতা-সম্পর্কটি বদলে গিয়েছিল। এই পর্বের মুহম্মদ নিজের সম্প্রদায় বা উম্মাহ-র সুরক্ষায় ও ‘রাজনৈতিক’ প্রভাববিস্তারে প্রয়োজনে ‘শক্তি’-র ব্যবহারে কুন্ঠিত নন। মদিনাতে মুহম্মদের ‘রাজনৈতিক’ কার্যক্রমের তিনটি অভিমুখ: মদিনার সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব—সেখানে বসবাসকারী ইহুদি গোত্রগুলির সঙ্গে বিরোধ; মক্কার কোরাইশদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সংঘর্ষ; এবং আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর উপর (যাদের কেউ পেগান, কেউ খ্রিস্টান, কেউ ইহুদি) আধিপত্য স্থাপন।

মদিনায় ‘হিজরত’-এর অব্যহিত পরে সেখানকার বিভিন্ন গোত্রকে নিয়ে (যাদের মধ্যে আরব ও ইহুদি উভয় গোত্রই ছিল) উম্মাহ গঠন করেছিলেন মুহম্মদ। ‘উম্মাহ সনদ’ বা ‘মদিনা সনদ’ নামক দলিলে এ-সংক্রান্ত চুক্তিটি সংরক্ষিত আছে। সনদটিতে দেখা যায়, উম্মাহ-র অভ্যন্তরে ধর্মাচরণের স্বাধীনতা নিয়ে মুহম্মদের অনুগামীরা ছাড়াও বিভিন্ন ইহুদি গোত্র স্থান পেয়েছে। মুহম্মদ ও মুহম্মদের অনুগামীদের তখন প্রধান প্রতিপক্ষ মক্কার শক্তিশালী কোরাইশরা। স্বভাবতই আত্মরক্ষার জন্যে মদিনার জনসমাজের নিবিড় ঐক্যের প্রয়োজন ছিল। মদিনা সনদের মধ্যে এই আকাঙ্ক্ষাই প্রতিফলিত। ‘সম্মতিভিত্তিক শাসনের আদর্শ, ধর্মীয় সমতা ও বহুত্ববাদ’-এর উপস্থিতিও সেখানে লক্ষণীয়। কিন্তু চুক্তিটি স্থায়ী হয়নি। ইহুদি গোত্রগুলির সঙ্গে অনতিবিলম্বেই মুহম্মদের অনুগামীদের সংঘাত বাধে। সংঘাতের সূত্রে নাজির ও কায়নুকা নামক গোত্রদুটি মদিনা থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিল। ইহুদি কোরায়যা গোত্রের সমস্ত পুরুষকে প্রাণদন্ড দেওয়া হয়, শিশু ও নারীরা রূপান্তরিত হয় দাসে। আজকের দৃষ্টিতে এই ভয়ানক শাস্তি খুবই বিসদৃশ লাগে। কিন্তু স্মরণে রাখা দরকার, কোরায়যা গোত্রের ভাগ্যের মীমাংসাটি হয়েছিল ‘ইহুদি বিধান’ মেনে। বিচারের রায় যিনি দিয়েছিলেন তিনি ছিলেন ইহুদি আউস গোত্রের মানুষ। হজরত মুহম্মদ সেই রায়ের বিরুদ্ধতা করেননি।  

মদিনার ইহুদিগোত্রগুলির সঙ্গে সংঘাতের প্রেক্ষাপটে ইহুদি-বিরোধী কয়েকটি ‘আয়াত’ অবতীর্ণ হয়। মুহম্মদ ‘কিবলা’-র দিক্‌পরিবর্তনও করেন এই সময় থেকে। এতদিন পর্যন্ত ইহুদি ও ইসলামবিশ্বাসী নির্বিশেষে সমস্ত একেশ্বরবাদী জেরুসালেমের দিকে মুখ করে নামাজ পড়ত। অতঃপর মুহম্মদ তাঁর অনুগামীদের পবিত্র কাবা-র দিকে মুখ করে নামাজ পড়ার নির্দেশ দেন।

প্রশ্ন ওঠে—মুহম্মদের অনুগামী বনাম ইহুদিদের সংঘাতকে আমরা কীভাবে বিচার করব? এটা কি আদি-ইসলামের ধর্মীয় হিংসার অকাট্য প্রমাণ নয়? এ-কালের কোনো কোনো গবেষক ঘটনাধারাকে সে-ভাবেই পাঠ করেছেন। কিন্তু ভেবে দেখলে দেখা যাবে যে এই দ্বন্দ্বের চরিত্র মূলত রাজনৈতিক, হয়তো অর্থনৈতিকও। ইহুদি নাজির ও কুরায়যা গোত্র ছিল মদিনার সমৃদ্ধতম জমিগুলির মালিক, আর কায়নুকা গোষ্ঠী ছিল স্বর্ণকার ও ব্যবসায়ী—মদিনার বাজারের নিয়ন্ত্রক। ‘মুহাজিরুন’ অর্থাৎ মক্কা থেকে আগত মুহম্মদের অনুগামীদের সঙ্গে বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাদের দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল। সবচেয়ে বড়ো কথা, মুহম্মদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি এদের আস্থা ছিল সন্দেহজনক—মক্কার বিরুদ্ধে অস্তিত্বরক্ষার যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ উঠেছিল ইহুদি গোত্রগুলির বিরুদ্ধে। এক গবেষক (Anver M. Emon) তাই মদিনার ইহুদিদের সঙ্গে সংঘাত এবং যে-পন্থায় তার নিষ্পত্তি করা হয়েছে (আধুনিক পরিভাষা ব্যবহার করে যাকে কেউ কেউ ‘cleansing model’ নামে অভিহিত করেছেন) তার মধ্যে ‘সদ্যগঠিত মদিনার রাজনৈতিক সমাজের বিপন্নতার প্রতিক্রিয়া’ খুঁজে পেয়েছেন—“these three incidents offered the necessary conditions for Muhammad to bolster his authority and to ensure the sheer existence of a nascent Medinan polity whose future was at best uncertain and plagued by insecurity”. (p. 54)।

তখনও পর্যন্ত মুহম্মদের নীতি যে সার্বিকভাবে ইহুদি-বিদ্বেষে রূপান্তরিত হয়নি, তার প্রমাণস্বরূপ বলা যায়, ইহুদি শহর খায়বারের (মদিনার দেড়শো কিলোমটার উত্তরে অবস্থিত) বিরুদ্ধে মুহম্মদ যখন সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন (৬২৮ খিস্টাব্দ) তখন দশজন ইহুদি পরামর্শদাতা সেই অভিযানের সঙ্গী হয়েছিলেন। ইহুদি একেশ্বরবাদীদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, অন্ততপক্ষে ব্যাপকভাবে—এমন কোনো তথ্যও পাওয়া যায় না। অতএব বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, তাদের কাছ থেকে চাওয়া হয়েছিল বশ্যতা ও রাজনৈতিক আনুগত্য, ইসলামে ধর্মান্তর নয়।

ইহুদি বা খ্রিস্টানরা নয়, হজরত মুহম্মদের প্রধানতম প্রতিপক্ষ ছিল মক্কা। ৬৩০-এর সূচনায় মক্কা বিজয় মদিনাকে আরবের সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষমতাকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। এর পরে মুহম্মদের নেতৃত্বাধীন মদিনার বশ্যতা ও আনুগত্য স্বীকারের জন্যে আরবের আরবের দূর-দূরান্তর থেকে বিভিন্ন গোত্র দূত প্রেরণ করে ও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ মুহম্মদের প্রচারিত একেশ্বরবাদে দীক্ষা নিয়েছিল, কেউ-বা স্বীকার করেছিলে কেবল রাজনৈতিক আনুগত্য।

সিরিয়ার সীমান্তে অবস্থিত খ্রিস্টান বসতি তাবুক-এ মদিনার কর্তৃত্ব-বিস্তারের সংগ্রামের সময় জিজিয়া সংক্রান্ত কোরানের আয়াতটি (৯: ২৯) অবতীর্ণ হয়েছিল বলে মনে করা হয়। আয়াতটি ছিল এমন: ‘তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো, যারা পূর্বে ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ লাভ করেছে অথচ ঈশ্বরে অথবা শেষ বিচারের দিনে বিশ্বাস করে না, ঈশ্বর ও তাঁর নবি যে-সত্য ধর্ম অনুশীলনের কথা বলেছেন ও যেগুলি নিষিদ্ধ করেছেন, যারা সেগুলি শোনে না কিংবা পালন করে না—যতক্ষণ না তারা জিজিয়া কর নিজে হাতে প্রদান করছে ও নত হচ্ছে, ততক্ষণ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো’ (প্রবন্ধকারের অনুবাদ)। ‘নিজের হাতে জিজিয়া প্রদান’ এবং ‘নত’ হওয়ার বিধানটিকে পরবর্তীকালের উলেমা অর্থাৎ শরিয়ত-বিশেষজ্ঞরা ‘জিম্মি’ (অন্যধর্মের প্রজা)-দের অধীনতা ও হীন সামাজিক অবস্থানের নির্দেশক হিসেবে বুঝেছিলেন। কিন্তু হজরত মুহম্মদের সময় সম্ভবত তা ছিল কেবলমাত্র রাজনৈতিক বশ্যতাস্বীকার ও নজরানা প্রদানের বন্দোবস্ত।   

 তাবুকের খ্রিস্টান জনগণ মুহম্মদের সঙ্গে চুক্তিতে জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা এবং নিজেদের ধর্মাচরণের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন। একইভাবে আরবের অন্য গোত্র ও বসতিগুলি (যাদের মধ্যে কিছু ছিল পেগান, কিছু খ্রিস্টান এবং কিছু ইহুদি) হজরত মুহম্মদের আনুগত্য স্বীকার করে জিজিয়া প্রদানে সম্মত হয়। কিছু পেগান গোষ্ঠীর উপর ‘জিজিয়া’ জারির বিষয়টি এ-কালের পাঠকের কাছে অস্বাভাবিক লাগতে পারে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, মুহম্মদের সময়কালে জিজিয়ার অর্থ ছিল আনুগত্যসূচক ‘নজরানা’, (যা অর্থে অথবা দ্রব্যের মাধ্যমে, এককালীন ভাবে বা ধাপে ধাপে প্রদান করা যেত)। খরাজ অর্থাৎ ভূমিরাজস্ব এবং জিজিয়া বা মাথাপিছু ধর্মীয় কর—এই রকম স্বতন্ত্র দুটি করের অস্তিত্ব মুহম্মদের সময়কালে ছিল না। ইসলামের আদিপর্বের ইতিহাসের বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, “মুহম্মদের সঙ্গে এই সব আরব জনগোষ্ঠীগুলির স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্রগুলি পড়লে লক্ষ করা যায় সেগুলিতে মুসলমান ও অমুসলমান গোষ্ঠীগুলির মধ্যে তফাত করা হয়নি। পার্থক্য ছিল একমাত্র যে মুসলমানরা ইসলামের বিধিগুলি (জাকাত প্রদানসহ) বিশ্বস্তভাবে পালন করবে, এবং অমুসলমানরা জিজিয়া প্রদান করবে” (জিয়াউদ্দিন আহমেদ)। আসলে, আরবজোড়া বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও বসতির সঙ্গে চুক্তি করার সময় গোষ্ঠীগুলির ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে প্রধান বিবেচ্য হয়েছিল মদিনার সম্প্রসারিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্নটি। এই রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্যে মদিনার তরফ থেকে যেমন কর বা নজরানার প্রয়োজন ছিল, তেমনই পরাজিত গোষ্ঠীগুলির প্রয়োজন ছিল মদিনার সামরিক আক্রমণ থেকে নিরাপত্তা। চুক্তিগুলির শর্তাবলির মধ্যে দু’পক্ষের এই চাহিদাই মূর্ত হয়েছিল।

‘জিজিয়া’-র প্রসঙ্গে আরও যে-তথ্যটি স্মরণে রাখা কর্তব্য তা হল—এই কর আদৌ ইসলামের আবিষ্কার নয়। ৫০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়কালেও এশিয়া মাইনরের সমুদ্রসংলগ্ন অঞ্চলের মানুষের উপর এই রকম করের নিদর্শন পাওয়া গেছে। রোমান শাসকেরা তাদের ভিন্নধর্মের প্রজাদের উপর এই ধরনের কর আরোপ করতেন। পারসিক শাসকেরা কিজওয়াত নামে করারোপ করেছিলেন এবং ‘জিজিয়া’ শব্দের উৎপত্তি সম্ভবত সেই ফারসি শব্দ থেকেই। সাসানিদ শাসক নওশেরওয়ান জিজিয়া কর থেকে অভিজাত ও সেনাধ্যক্ষদের অব্যাহতি দিয়েছিলেন বলে আরব লেখকেরা লিখে গেছেন। জিজিয়া নামক কর আরোপের এই পূর্বদৃষ্টান্তই মুহম্মদ ও তাঁর উত্তরসূরীরা বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে সেই সঙ্গে, জিম্মি বা ‘আশ্রিত প্রজা’-র ধারণাটি যোগ করে তাতে নতুন মাত্রাও যোগ করেছিলেন।

পেগান ও একেশ্বরবাদী (খ্রিস্টান, ইহুদি) দু’ধরনের মানুষই ছিলেন আরবে এবং  কোরানের প্রত্যাদেশ উভয় ধরনের মানুষের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন রকম। ৯: ৫ নং আয়াত বলছে, ‘পবিত্র মাসগুলি আতিবাহিত হলে ‘অবিশ্বাসী’ (মুশরিক)-দের সামনে পেলে তাদের হত্যা করতে, অবরুদ্ধ করতে, চোখে ধাঁধা দিয়ে ঘিরে ফেলতে পারো। কিন্তু তারা যদি অনুশোচনা করে, নামাজ পড়ে, দরিদ্রকে জাকাত দেয়, তাহলে তাদের নিজের পথে ছেড়ে দাও…’। আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছিল মুহম্মদের মদিনাপর্বের শেষের দিকে। ইসলামের ‘অসহিষ্ণু ধর্মদ্বেষী’ রূপটির প্রমাণ হিসেবে প্রায়শই এই আয়াতটি উল্লেখ করা হয়। এখনকার ইসলাম-গবেষকেরা বলে থাকেন, এখানে ‘অবিশ্বাসী’ বা ‘মুশরিক’ বলতে পেগান আরবদের কথা বলা হয়েছে, যাদের সামনে এই সময় ‘হয় ইসলাম, নয় তো মৃত্যু অথবা দাসত্ব’ ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু আহল-ই-কিতাব বা ঐশ্বরিক ধর্মগ্রন্থের অধিকারী একেশ্বরবাদী সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গে এ-কথা বলা যায় না। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস পালনে কোরানে বাধানিষেধ আরোপিত হয়নি। প্রসঙ্গত ২: ৬২ এবং ৫: ৬৯ আয়াতদুটি স্মর্তব্য। সেখানে উচ্চারিত হয়েছে, ‘বিশ্বাসী’ অর্থাৎ ‘ইহুদি, খ্রিস্টান, এবং সাবিয়ানদের’ ‘শেষ বিচারের দিনে’ শোকার্ত বা ভয় পাবার কারণ নেই’। ‘সাবিয়ান’ বলতে ঠিক কাদের বোঝানো হয়েছে স্পষ্ট নয়। তবে তাদের ‘ধর্মগ্রন্থের অধিকারী কোনও সম্প্রদায়’ ধরে নিয়ে পরবর্তীকালের শরিয়ত বিশেষজ্ঞদের একাংশ খ্রিস্টান ও ইহুদিদের পাশাপাশি ‘ধর্মগ্রন্থের অধিকারী’ অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়কেও জিম্মি বা আশ্রিত প্রজার গোত্রভুক্ত করেছে। এই বিবেচনায় জরথুস্ট্রবাদী, বৌদ্ধ ও হিন্দুরাও পেয়েছে ‘জিম্মি’-র আসন। কোরানের আরও কিছু আয়াত এই ব্যাখ্যার সহায়ক হয়েছে। যেমন, ৩৫: ২৪ নং আয়াত, যেখানে বলা হয়েছে, আল্লাহ সমস্ত জাতির উদ্দেশেই পূর্বে রসুল (messenger/ আল্লাহ-র বার্তাবহ) পাঠিয়েছেন। ইবনে সা’দ লিখেছিলেন, মুহম্মদকে নিয়ে মোট রসুলের সংখ্যা ৩১৫; আর নবির সংখ্যা ১০০০।   

শরিয়ত বা ইসলামি আইনে ‘জিম্মি’-দের জীবন, সম্পত্তি ও ধর্মপালনের অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হলেও ইসলাম-ধর্মাবলম্বীদের সমান মর্যাদা দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় খলিফা উমর (৬৩৪-৬৪৪)-এর কার্যকালে দু’একটি আরব গোষ্ঠীর জিজিয়া করারোপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের উদাহরণ ইসলামি ঐতিহ্যে লিপিবদ্ধ আছে। যেমন বানু তঘলিব গোষ্ঠী জিজিয়া জারিতে অপমানিত হয়ে বিকল্প হিসেবে দ্বিগুণ হারে ‘সাদাকা’ (আয়ের একটি অংশের ‘দান’, যা সাধারণভাবে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রদেয়) দেবার আর্জি জানিয়েছিল। উমর তাতে অসম্মত হলে বানু তঘলিবদের অনেক সদস্য রোমান সেনাবাহিনীতে নাম লেখানো শুরু করেছিল। তখন উমর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে ‘সাদাকা’ প্রদানের আর্জিটি স্বীকার করে নেন। তানুক ও বুহরা নামে আরও দুই খ্রিস্টান আরবগোষ্ঠী জিজিয়া দিতে অসম্মত হয়ে দ্বিগুণ হারে ‘সাদাকা’ দিতে সম্মত হয়। এই সব ঘটনা থেকে মনে হয় যে, জিজিয়া করকে কিছু আরব গোষ্ঠী অন্তত আত্মমর্যাদার পরিপন্থী হিসেবে ভেবেছিল।

পরবর্তীকালে (নবম শতক থেকে) যখন শরিয়ত (আল্লার ঐশ্বরিক বিধান) ও ইসলামি আইনশাস্ত্র (ফিকহ) লিখিত রূপ পাচ্ছিল তখন সেখানে ‘জিম্মি নীতি’ অর্থাৎ মুসলমান শাসনাধীন রাষ্ট্রে অমুসলমান প্রজার অধিকারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নেয়। এ-ক্ষেত্রে ইসলামীয় আইনশাস্ত্রবিদ ও আলেমরা সবাই যদিও এক সুরে কথা বলেননি, তবুও মধ্যযুগের মুখ্য সুরটি জিম্মিদের সামাজিক মর্যাদার পক্ষে ‘অসম্মানসূচক’ (অন্তত আধুনিক মানদন্ডে)। অন্যভাবে বললে, জিম্মিদের ধর্মাচরণের অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হলেও তাদের ধর্মপালন ও সামাজিক জীবনযাপনে নানা বাধানিষেধ ও শর্তাবলী প্রস্তাব করা হয়। এই সব শর্তকে ‘প্রামাণ্য’ করে দেখানোর জন্য উল্লেখ করা হয় দ্বিতীয় খলিফা উমরের সঙ্গে সিরিয়ার খ্রিস্টানদের স্বাক্ষরিত একটি ‘চুক্তিপত্র’ (Pact of Umar)। চুক্তিপত্রে দেখা যায়, নিরাপদে বসবাসের বিনিময়ে সিরিয়ার খ্রিস্টানদের উপর ইসলামি রাষ্ট্র বৈষম্যমূলক নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। যেমন, মুসলমানদের চেয়ে স্বতন্ত্র ধরনের পোশাক পরা (যাতে তাদের আলাদা ‘পরিচয়’ সহজেই চিহ্নিত করা যায়), নতুন ধর্মস্থানের নির্মাণ থেকে বিরত থাকা, ঘোড়ায় না চড়া, অস্ত্র না রাখা, মুসলমান নারীদের বিবাহ না করা ইত্যাদি।

এ-কালের ইসলাম গবেষকদের (লক্ষণীয়, ‘ইসলামি গবেষক’ বলা হচ্ছে না) একটি বড়ো অংশ ‘দলিল’-টির সত্যতা নিয়ে সন্দিহান। প্রথমত, নবম শতকের আগে কোনো তথ্য বা সাক্ষ্যপ্রমাণে এই চুক্তিপত্রটির উল্লেখ নেই। দ্বিতীয়ত, উমরের সময়কাল সম্পর্কে অন্য সূত্র থেকে যে ছবি ফুটে ওঠে, তার সঙ্গে চুক্তিপত্রটি খাপ খায় না। যেমন আল তাবারি-র লেখা থেকে জানা যায় (নবম শতকের লেখক), জেরুসালেমের সঙ্গে চুক্তি (৬৩৮)-তে ‘অসুস্থ ও সবল নির্বিশেষে তাদের জীবন, সম্পত্তি, ধর্মস্থান ইত্যাদি ধর্মবিশ্বাসের যাবতীয় সব কিছু’-র নিরাপত্তা উমর সুনিশ্চিত করেছিলেন। চুক্তিটিতে এও বলা হয়েছিল, ‘তাদের ধর্মস্থান ধ্বংস করা বা তাকে বাসস্থানে পরিণত করা যাবে না, তাদের বিশ্বাস পালনে কোনো বাধানিষেধ চাপানো বা তাদের কোনো ক্ষতি করা’ হবে না। প্যালেস্তাইনের লুড শহরের অধিবাসীদের সঙ্গেও অনুরূপ চুক্তি সাধিত হয়েছিল।

বস্তুত, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ইসলামি রাষ্ট্রের সৈন্যবাহিনীতে যোগদান থেকে অব্যাহতির বিনিময়ে জিজিয়া প্রদানের বিধি উমরের সময়কালে চালু হয়েছিল। জিম্মি শ্রেণিভুক্ত সম্প্রদায়ের শিশু, নারী, বৃদ্ধ, দরিদ্র এবং ধর্মীয় পূজারিদেরও জিজিয়ার আওতা থেকে বাদ দেওয়াও হয়। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যে যারা অতি-দরিদ্র, রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে তাদের আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করেন উমর। এই সব কারণে অনেক গবেষক মনে করছেন যে, আব্বাসিদ আমলে (নবম-দশম শতকে) অমুসলমান প্রজাদের উপর নানা রকম বৈষম্যমূলক বিধিনিষেধকে গ্রহণযোগ্য করে দেখানোর জন্যেই এমন একটি ‘চুক্তিপত্র’ উদ্ভাবন করে অতীত-ইতিহাসে আরোপ করা হয়েছিল।  

এর মানে, আগেই বলেছি, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে জিম্মিদের অধিকারের পূর্ণ সমতা ছিল, তা নয়। যাঁরা আদি-ইসলামকে ‘ধর্মীয় সমতা ও বহুত্ববাদের নিখুঁত দৃষ্টান্ত’ হিসেবে দেখাতে চান এবং যাঁরা তার বিপরীতে তা-কে চূড়ান্ত পরধর্মদ্বেষী একটি ধর্মমত হিসেবে তুলে ধরেন—দু’পক্ষের মতামতকেই ‘অতিকথা’ বলে চিহ্নিত করেছেন সাম্প্রতিক অনেক গবেষক। ইসলাম ও মধ্যপ্রাচ্য-বিশেষজ্ঞ বার্নার্ড লুইস মনে করিয়ে দিয়েছেন, ধর্মসম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মানুষ রাষ্ট্রের কাছ থেকে সমান অধিকার দাবি করে এবং সব ধর্মই সমভাবে সত্য—দুটি দাবিই মূলত আধুনিক কালের দাবি। অতীত-ইতিহাসে এই ধারণার প্রয়োগ কালানৌচিত্যদোষ (anachronism)। ইসলামি রাজনৈতিক শাসনে ইসলাম-ধর্মাবলম্বীরা নিঃসন্দেহে ছিল সুবিধাভোগী উচ্চতর গোষ্ঠী। তবে এ-ক্ষেত্রে যা মনে রাখার—সুবিধাভোগী গোষ্ঠী হলেও ভিন্নধর্মের প্রজাদের ইসলামি রাষ্ট্র উৎখাত করতে সচেষ্ট হয়নি, যেমন বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের খ্রিস্টান শাসকদের নীতিতে লক্ষ করা গিয়েছিল। ইসলামি রাষ্ট্রের অধীনে তারা পেয়েছিল সম্পত্তির সুরক্ষা ও ধর্মাচরণের অধিকার।

মধ্যপ্রাচ্যের খ্রিস্টান জনসমাজ তখন নানা গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। বাইজান্টাইন শাসকেরা ছিলেন ‘চ্যালসেডোনিয়ান’ (আজকের পরিভাষায় গ্রিক অর্থোডক্স)। মনোফাইসাইট ও নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টানদের তারা ‘ধর্মদ্রোহী’ মনে করত। রাষ্ট্রের অত্যাচার নেস্টোরিয়ানদের প্রতি এতই তীব্র হয়েছিল যে তাদের পালিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল সাসানিয়ান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে। ৪৫১ খ্রিস্টাব্দের চ্যালসেডোনিয়ান কাউন্সিল মনোফাইসাইটদের ‘ধর্মদ্রোহী’ ঘোষণা করেছিল। তাদের বিরুদ্ধেও নেমে এসেছিল ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন। এই ‘বিরুদ্ধ’ খ্রিস্টান গোষ্ঠীগুলি স্বাগত জানিয়েছিল ইসলামি আরব শক্তিকে। ইসলামি শক্তির অধীনে এরা পেয়েছিল সম্পত্তির সুরক্ষা ও ধর্মপালনের অধিকার। জন পেনকায় নামক জনৈক খ্রিস্টান পুথিকার ইসলামি শাসনের এই ধর্মসহিষ্ণু চরিত্র উল্লেখ করে ৬৬৭-৬৬৮ নাগাদ লিখে গিয়েছেন, ‘আরব যাযাবর জনগোষ্ঠী নজরানা দাবি করেছে, কিন্তু মানুষকে তার ইচ্ছামতো ধর্মপালনের অধিকারও দিয়েছে।‘

‘এক হাতে কোরান, অন্য হাতে তরোয়াল’ নিয়ে ইসলামের রাজনৈতিক সম্প্রসারণের তত্ত্ব অতএব ভুলে-ভরা। ইতিহাসবিদ হিউ কেনেডি আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন এই বলে যে, ইসলামি রাজনৈতিক শক্তির সামরিক সম্প্রসারণকে চিরাচরিত ব্যাখ্যায় ‘ইসলামের বিজয়’ বলে চিহ্নিত করা হয়। সেখান থেকেই ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি। এই সম্প্রসারণ একটি রাজনৈতিক ঘটনা, যার ফলে অমুসলমানদের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাজনৈতিক সম্প্রসারণের প্রক্রিয়াটি ছিল দ্রুত, কিন্তু ধর্মান্তরকরণের প্রক্রিয়াটি ছিল ধীর। রাজনৈতিক সম্প্রসারণের এই প্রাথমিক পর্বে ইসলামি শাসকেরা ধর্মান্তরকরণকে আবশ্যিক মনে করেননি। মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তীর্ণ অংশে বেশ কিছুকাল (দু-তিনশো বছর) ইসলাম সংখ্যালঘু এলিট মানুষের ধর্ম হিসেবেই বিরাজ করেছিল।

আরও ‘অবাক করা’ তথ্য হল—প্রথম যুগের খ্রিস্টান সূত্রসমূহে মুহম্মদ বা ইসলামি-আরব আক্রমণকারীদের স্বতন্ত্র ধর্মীয় সত্তা উল্লিখিতই হয়নি (আগ্রহীরা অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অফ ইসলাম-এর সপ্তম অধ্যায়টি পড়তে পারেন)। মনোফাইসাইট আরমেনিয়ান বিশপ শেবো-র চোখে আরব-মুসলিমরা ছিলেন আব্রাহামের মিশরীয় উপপত্নী হ্যাগার (বা, হাজারে) ও তার পুত্র ইসমাইলের বংশধর, যাদের সর্বশক্তিমান ঈশ্বর মহান জাতিতে পরিণত হবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন (জেনেসিস ২১: ১২-১৩)। মধ্যপ্রাচ্যের বুকে মুহম্মদ-অনুগামীদের পদার্পণের ঘটনাকে মনোফাইসাইট খ্রিস্টানরা ৪৫১ খ্রিস্টাব্দের চ্যালসেডোনিয়ান কাউন্সিলের খ্রিস্টধর্মসংক্রান্ত ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে ‘ঈশ্বর-প্রেরিত শাস্তি’ হিসেবেই বিবেচনা করেছিল।

এই ধরনের চিত্রায়ণ অর্থাৎ ইসলামকে বাইবেলীয় ঐতিহ্যের অন্তর্গত একটি শাখা হিসেবে দেখার মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই। হজরত মুহম্মদ নিজেও সম্ভবত তাঁর একেশ্বরবাদী আন্দোলনকে কোনো স্বতন্ত্র ধর্মমত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হিসেবে ভাবেননি। খ্রিস্টান ট্রিনিটির ধারণা বা যিশুকে ঈশ্বরপুত্র রূপে দেখা কোরানে মান্যতা পায়নি ঠিক কথা, কিন্তু যিশুকে নিয়ে এই বিতর্ক বাইবেলীয় ঐতিহ্যের মধ্যেই চলমান ছিল। ইহুদি ও খ্রিস্টীয় শাস্ত্রবিদদের মধ্যে ধর্ম ও একেশ্বরবাদ নিয়ে কয়েকশো বছর ধরে বিতর্ক অব্যাহত ছিল, এবং সেই বিতর্ক লিখিত ঐতিহ্যের পাশাপাশি মৌখিক ঐতিহ্যেও বাহিত হচ্ছিল। ইহুদি রাব্বি, খ্রিস্টান যাজকদের পাশাপাশি মুহম্মদও ছিলেন এই বিতর্কের একটি ‘পক্ষ’ বা সক্রিয় অংশীদার। প্রসঙ্গত কোরানের ৪২: ১৩ আয়াতটি স্মরণীয়: ‘ধর্ম (দীনের) ক্ষেত্রে ঈশ্বর তোমাদের সেই নির্দেশই দিয়েছেন যা তিনি একদা দিয়েছিলেন নোরাকে। সেই নির্দেশই তোমার (মুহম্মদ) কাছে প্রত্যাদিষ্ট হয়েছে, যা আব্রাহাম, মোজেস ও যিশুর কাছেও প্রস্তাব করা হয়েছে: আল দীন-এ সমুন্নত রাখো, এর মধ্যে বিভাজন করো না।‘

ইহুদি ধর্মের আদিপুরুষ আব্রাহাম (ইব্রাহিম)-এর মিশরীয় উপপত্নী হ্যাগার (বা হাজারে)-এর পুত্র ইসলাইলের বংশধর হিসেবে নিজেকে দাবি করেছিলেন মুহম্মদ। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সঙ্গে একত্রে আহার বা তাদের নারীদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কও কোরানে স্বীকৃত (৫: ৫)। এই সব নানা তথ্য থেকে বোঝা যায়—ফ্রেড ডোনার যেমন বলছেন—  মুহম্মদের অনুগামীরা নিজেদের ‘a community of Believers’ বা ‘বিশ্বাসীদের সম্প্রদায়’ বলেই মনে করতেন, যাদের মধ্যে ইহুদি ও খ্রিস্টান একেশ্বরবাদীদেরও (যারা তাদের মধ্যে একেশ্বরবাদে তন্নিষ্ঠ) স্থান ছিল। অর্থাৎ পেগান ধর্মবিশ্বাসীরাই ছিল মুহম্মদের ধর্মান্দোলনের প্রধান প্রতিপক্ষ, একেশ্বরবাদী সম্প্রদায়গুলি নয়।

এই মতের বিরুদ্ধে অবশ্য পালটা যুক্তি দেওয়া যায়। কোরানের একাধিক আয়াতে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত আক্রমণাত্মক কথা উচ্চারিত হয়েছে। খ্রিস্টান ও ইহুদিদের সঙ্গে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বন্ধুত্ব বা মিত্রতা (আউলিয়া) না-করার নির্দেশ পাওয়া যাবে ৫: ৫১ আয়াতে। ৩: ১৯ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ঈশ্বরের চোখে সত্য ধর্ম (আল-দীন) হল ইসলাম। ৩: ৮৫ আয়াতে উচ্চারিত হয়েছে—কেউ যদি ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম (দীন) সন্ধান করে, তা গ্রহণ করা হবে না। এই সব উচ্চারণের তাহলে ব্যাখ্যা কী? ডোনারের প্রতিপাদ্য মেনে একটি ব্যাখ্যা এমন হতে পারে: ইহুদি ও খ্রিস্টান কেউই আরব ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে অখন্ড সম্প্রদায় ছিল না। এদের মধ্যে গোষ্ঠীভেদে (আনুগত্য ও বিরোধিতার বিবেচনায়) মুহম্মদের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন হয়েছিল। কোরানের আয়াতগুলিতেও সেই প্রতিফলন পড়েছে। ৩: ১৯ এবং ৩: ৮৫ আয়াতদুটি প্রসঙ্গে ইসলাম-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মাদ হাসান খালিল লিখেছেন, কোরানের ‘দীন’-এর ধারণা পরবর্তীকালের মতো সংকীর্ণ ছিল না। আল-ইসলাম শব্দটি দিয়ে তখন বোঝাত ‘আল্লার কাছে আত্মসমর্পণ’ (যা একেশ্বরবাদী যে-কোনো মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য)। খালিলের ভাষায়, ‘মুহম্মদের অনুগামী বোঝাতে ‘ইসলাম’ শব্দের প্রয়োগ নিশ্চিতভাবেই কোরান-পরবর্তী কালের ঘটনা’।

ইসলাম ধর্মের এই রূপান্তর (ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের চেয়ে ‘শ্রেষ্ঠ’ ও ‘স্বতন্ত্র’ ধর্মমত দাবি করে ইসলামের উত্থান), ফ্রেড ডোনারের মতে, অষ্টম শতকের সূচনা থেকে লক্ষ করা যায়। আব্বাসিদ আমলে ইসলামি লিখিত ঐতিহ্য ও ইসলামি ধর্মশাস্ত্রের নির্মাণের মাধ্যমে তা আরও সংগঠিত হয়। লক্ষণীয়, আব্বাসিদ আমলেই ইসলামি আইনশাস্ত্রবিদদের হাতে দার-উল-ইসলাম (ইসলামি রাজ্য) এবং দার-উল-হারব (বিধর্মী রাজ্য)-এর মধ্যে চিরন্তন জিহাদ বা আক্রমণাত্বক যুদ্ধের তত্ত্বটি নির্মিত হয়েছিল। অথচ, জিহাদের এমনতরো ব্যাখ্যা কোরানে আদৌ স্পষ্ট নয়। ‘জিহাদ’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ ‘সচেষ্ট হওয়া’ বা মহৎ লক্ষ্যে ‘অন্তরের সচেষ্টতা’। কোরানে, বিশেষ করে মক্কা পর্বে, জিহাদের এই অর্থই প্রাধান্য পেয়েছে, যখন ‘জিহাদ’ ছিল পেগান ধর্মবিশ্বাসীদের প্রচার ও হয়রানির বিরুদ্ধে ‘অন্তরের অহিংস প্রতিরোধ’। পরবর্তী কালে, আমাদের আলোচনায় দেখেছি, রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মদিনার উত্থানের পরে, বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পেগান ‘অবিশ্বাসী’দের ধর্মান্তরকরণ মান্যতা পায় (উক্ত ৯: ৫ আয়াতটি)। তবে এও লক্ষণীয়, এই ‘আগ্রাসী কার্যক্রম’ জিহাদ হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। কোরানে যুদ্ধের প্রতিশব্দ ‘কিতল’ এবং প্রাক-উমাইয়া যুগে সামরিক সম্প্রসারণ বোঝাতে ‘ফুতুহ’ শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। মোদ্দা কথা, নবম শতকের আগে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্বক যুদ্ধ হিসেবে ‘জিহাদ’কে চিহ্নিত করার উদাহরণ নেই। পাশ্চাত্যের গবেষকেরা ইসলামের চূড়ান্ত অসহিষ্ণুতার প্রমাণ হিসেবে ‘জিহাদ’-এর নবম শতক-পরবর্তী উক্ত ধারণাটিকেই ব্যবহার করেন এবং সেটিকে ইসলামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য করে দেখান। অথচ সপ্তম শতকে, কেবলমাত্র খারিজি গোষ্ঠী ছাড়া, কেউ-ই ইসলামি বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে ‘জিহাদ’-কে চিহ্নিত করেননি। হানাফি মতে, শুধুমাত্র আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ বৈধ।

ইসলামি রাষ্ট্রে জিম্মিদের নানা ‘অপমানজনক’ শর্তে বসবাসের বিধানও সম্ভবত এই যুগেরই নির্মাণ। আগেই বলা হয়েছে, ‘অপমানজনক শর্তগুলি’-কে বৈধতা দেওয়া উদ্দেশ্যে ‘উমর চুক্তিপত্র’ নামক দলিলটিকে ‘উদ্ভাবন’ করা হয়। কোরানের কয়েকটি আয়াত, কিছু কিছু হাদিস এবং মদিনার ইহুদিদের সঙ্গে মুহম্মদের সংঘাতকেও ‘জিম্মি নীতি’-র অসহিষ্ণু ব্যাখ্যার সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে দাখিল করা হয়। দীর্ঘ সময় ধরে (৬১০-৬৩২) বিবিধ ঐতিহাসিক পরিস্থিতি ও প্রেক্ষিতে বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন সূক্তের মাধ্যমে কোরানের আয়াতগুলি ‘অবতীর্ণ’ হয়েছিল। বহু আয়াতের সুনির্দিষ্ট অর্থগত ব্যঞ্জনাও স্পষ্ট নয়—কোরান বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সেগুলির ব্যাখ্যা নিয়ে আছে বিস্তর মতভেদ। মোদ্দা কথা, কোরানের কিছু আয়াত বেছে নিয়ে খন্ডিত ব্যাখ্যার সাহায্যে ইসলামকে ‘অসহিষ্ণু ও হিংসাত্মক মতবাদ’ হিসেবে প্রতিপন্ন করা অসম্ভব নয়। আবার ভিন্নরকম আয়াতের সাহায্যে (২: ৬২, ২: ২৫৬, ৫: ৬৯, ৩৫: ২৪, ৪৯: ১৩) ‘উদার ও সহিষ্ণু ধর্মমত’ হিসেবে ইসলামকে ব্যাখ্যা করা খুবই সম্ভব। ইসলামি ঐতিহ্যে ইসলামি চিন্তক ও ধর্মতাত্ত্বিকদের মধ্যে এই উভয় ধরনের মানুষই (অসহিষ্ণু ও বহুত্ববাদী) দেখতে পাওয়া যাবে। যেমন, প্রখ্যাত তফসির-লেখক মাহমুদ ইবনে উমর জামাকশারি (১০৭৫-১১৪৪)-র ‘বিধান’ ছিল—জিম্মিদের কাছে থেকে এমনভাবে জিজিয়া আদায় করতে হবে যাতে তাদের প্রতি ‘অবজ্ঞা ও অপমান’ ফুটে ওঠে। জিম্মিকে জিজিয়া দিতে আসতে হবে পায়ে হেঁটে, টাকা দেবার সময় সে দাঁড়িয়ে থাকবে আর করসংগ্রহকারী থাকবেন বসে। জিম্মির ঘাড় ঝাঁকিয়ে করসংগ্রাহক ‘জিজিয়া দাও’ উচ্চারণ করবেন। জিম্মিদের প্রতি এমন নিদান মধ্যযুগের বহু উলেমা ও ধর্মতাত্ত্বিকের কন্ঠেই উচ্চারিত হয়েছে। এ-কালের ইসলাম-গবেষক ও রাজনৈতিক প্রচারকদের একাংশ এদের বিধান ও নির্দেশাবলি উল্লেখ করেই সহিংস ও পরধর্ম-বিদ্বেষী ধর্মমত হিসেবে ইসলামের চিত্রায়ণকে ‘প্রামাণিক’ করেন। কে এস লালও করেছেন।  

একইভাবে, ইসলামের ইতিহাসের মধ্যে এমন ধর্মতাত্ত্বিক ও আইনবিদের দেখা মেলে যাঁরা ছিলেন জিম্মিদের প্রতি অপেক্ষাকৃত সহিষ্ণু নীতির প্রবক্তা। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় ইসলামের ইতিহাসের আদি-আইনজ্ঞ ও করসংক্রান্ত গ্রন্থের লেখক আবু উবাইদ (৭৭০-৮৩৮)-এর কথা। তিনি জিম্মিদের উপর অতিরিক্ত ও অসহনীয় কর আরোপ করতে নিষেধ করেছিলেন। খলিফা হারুন-আল-রশিদের প্রধান কাজি ও প্রখ্যাত আইনজ্ঞ আবু ইউসুফ (মৃত্যু ৮০৮) বিধান দেন যে, জিজিয়া প্রদানের সময় জিম্মিদের ‘উত্তপ্ত সূর্যের নিচে দাঁড়ানো বা প্রহার করা কাম্য নয়’, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারই বাঞ্ছনীয়। মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ বার্নার্ড লুইস মনে করিয়ে দিয়েছেন, আইনজ্ঞদের ‘বাস্তববাদী পরামর্শ’ মেনেই ইসলামি রাষ্ট্রের কর্ণধার ও প্রশাসকেরা সাধারণভাবে চলতেন (কিছু ‘ব্যতিক্রমী’ পরধর্মদ্বেষী শাসক নিশ্চয় ছিলেন), উলেমা বা ধর্মতাত্ত্বিকদের বাড়াবাড়ি শিরোধার্য করে নয়। তাঁর ভাষায়, জিজিয়া সংগ্রহের ক্ষেত্রে কট্টরপন্থী উলেমার নির্দেশাবলি ইসলামি-মানসের (একটি অংশের) ইতিহাসের জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ, রাষ্ট্র বা প্রশাসনের ইতিহাসের ক্ষেত্রে ততটা নয়। জিম্মিদের একাংশ শুধু সম্পত্তির নিরাপত্তাই পাননি, রাষ্ট্রের উচ্চপদাধিকারী হয়ে শাসকশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, এমন দৃষ্টান্তও ভুরিভুরি।

………………………

রচনাসূত্র:

Anver M Emon. Religious Pluralism and Islamic Law Dhimmis and Others in the Empire of Law. Oxford University Press: 2012

Asma Afsaruddin. The First Muslims History and Memory, One World Oxford: 2007

Bernard Lewis. The Jews of Islam, Princeton University Press: 1984

Fred M. Donner. Muhammad and the Believers At the Origins of Islam. Harvard University Press: 2010

Hugh Kennedy. The Prophet and the Age of the Caliphate—the Islami New East From Sixth to the Eleventh Century. Longman: 2014

John L. Esposito. The Oxford History of Islam, Oxford University Press: 1999

K S Lal. The Theory and Practice of Muslim State in India. Aditya Prakashan: 1999

Mohammad Hasan Khalil. Islam and the Fate of Others Salvation Question. Oxford University Press: 2012

Ziauddin Ahmed. ‘The Concept of Jijya In Early Islam’, in Islamic Studies, Vol. 14, No. 4 (Winter 1975), pp. 293-305 Published by: Islamic Research Institute, International Islamic University, Islamabad.

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *