জিন্নাহ, বাল্মীকি থেকে রত্নাকর বানানো হল

বর্ণালী মুখার্জি:

নেহরুর বদলে জিন্নাহ যদি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হতেন তবে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। জমিদারদের গায়ে বা মিল মালিকদের গায়ে আঁচ আনা যাবে না, এই ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান তিনি প্রত্যাহার করবেন সেই শর্তে অবশ্যই। জওহরলাল নেহরুর মতো পণ্ডিত মানুষ এদেশে বিরল ছিল। উনি যদি নিজের বিশ্বাসের প্রতি সুবিচার করে ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা হতেন তবে এই প্রস্তাব তিনি নিজেই দিতেন, আমি নিশ্চিত। যাই হোক দিবাস্বপ্ন দেখে লাভ নেই! আজ আলোচনা মহম্মদ আলি জিন্নাহকে নিয়ে। জিন্নাহ যদি খুবই মৌলবাদী টাইপের হতেন তবে নিশ্চয়ই সরোজিনি নাইডু ওনার প্রেমে হাবুডুবু খেতেন না। কেউ কেউ আপত্তি তুলে বলবেন যে নেহাত মুসলিম বলেই তাঁকে এই পদ দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত? মুসলিম মৌলবাদের অপর পিঠই হল হিন্দু মৌলবাদ। সুতরাং এই প্রস্তাব অনৈতিক, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মিশিয়ে ফেলারই নামান্তর।

উত্তর দেবেন ১৯১৯ সালের মহাত্মা গান্ধী। খিলাফত আন্দোলনে যোগদান করার সময় হিন্দু মহাসভার নেতাদের (যাদের অনেকেই কংগ্রেসেরও সদস্য ও নেতা ছিলেন) তীব্র বিরোধিতার উত্তর তিনি যেভাবে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে হিন্দু ভারতীয়দের যদি সত্যিই মুসলিম ভারতীয়দের সাথে আঁটোসাঁটো বন্ধুত্ব করতে হয় তবে নিঃশর্ত ভাবেই হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। আজ যখন পিছন ফিরে দেখি ভাবতে অবাক লাগে যে ১৯১৯ সালের গান্ধী আর ১৯২৭ সালের মহাত্মা কি একই মানুষ? আবার একই প্রশ্ন করি জিন্নাহকে নিয়েও। ১৯১৯ সালের তিনি আর ১৯৪৬ সালে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেওয়া জিন্নাহ কী একই ব্যক্তি! ফিরে যাই মুসলিম লীগ আর কংগ্রেসের জোটের সেই চার বছরে। একদিকে যখন হিন্দু মহাসভা খিলাফত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে লীগ কংগ্রেস জোটের আপ্রাণ বিরোধিতা করে যাচ্ছে, তখনই কংগ্রেস সদস্য ও দলের আগামী নেতৃত্বের অন্যতম দাবিদার জিন্নাহও খিলাফত আন্দোলনে কংগ্রেসের যোগদান করা নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মেশাতে বারণ করেছিলেন তিনি। তুরস্কের রাজতন্ত্রকে বা খলিফাকে টিকিয়ে রাখার দাবিকে প্রশ্রয় দিতে বারণ করেছিলেন। স্বজাতির মৌলবাদের বিরুদ্ধে বলার এই সাহস জিন্নাহর মধ্যে আমরা দেখেছি। সেইদিন গান্ধী খলিফাকে টিকিয়ে রাখার দাবিকে সমর্থন করে মুসলিম মনকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নিয়ে আসার মধ্যে অন্যায় দেখেননি। তবে জিন্নাহকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাবতে পারলেন না কেন? তিনি নিজেও জানতেন, আজ না হোক কাল ইংরেজরা যাবেই। তা যে আশু, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সুতরাং তাদের আসল লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল হিন্দু-মুসলিম ঐক্য বজায় রাখা। যেন আয়ারল্যান্ডের পুনরাবৃত্তি না হয়। কিন্তু তা হল না। তবে কি হিন্দু মহাসভা ও আরএসএস ক্রমেই দলে ও বাইরে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল?

এমন নয় যে জিন্নাহ কংগ্রেস দল ছাড়ার পর আর তাকে প্রধানমন্ত্রী করার কথা ভাবা যেত না। ১৯১২ সালে তিনি লীগের সদস্য হলেন আর ১৯২০ সালে কংগ্রেস দল ছাড়লেন। কংগ্রেস দল ছাড়ার ৫ বছর পরেও একজন সাংসদ (আজকের অর্থে নয়, বোঝার সুবিধার জন্য এই শব্দ ব্যবহৃত হল) হিসেবে জোর দিয়ে বললেন যে তিনি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একজন জাতীয়তাবাদী। একদিকে যখন হিন্দুমহাসভার নেতারা বলছেন যে হিন্দুরা আগে হিন্দু পরে ভারতীয়, লীগের মৌলবাদী পাঞ্জাব অংশের নেতারা বলছেন যে তারা আগে মুসলিম পরে ভারতীয়, তখনও জিন্নাহ এই কথা বলে যাচ্ছেন। তাহলে প্রশ্ন হল তিনি কংগ্রেস দল ছাড়লেন কেন? যে হিন্দুত্ববাদী তিলককে উকিল জিন্নাহ ফাঁসি থেকে বাঁচালেন, সেই তিনিই কেন দল ছাড়লেন? কারণ হিসেবে অনেকেই বলেন যে গান্ধীর সঙ্গে দলের নেতা হওয়ার প্রতিযোগিতায় তিনি আর পেরে উঠছিলেন না। খিলাফত আন্দোলনকে কংগ্রেসের আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করে গান্ধী মুসলমান মনকে জয় করে নিয়েছিলেন। আর অন্যদিকে জিন্নাহ ছিলেন মুসলিমদের মধ্যেই একঘরে। হতে পারে। কিন্তু যথার্থ রাজনৈতিক নেতাদের কর্তব্য হল এই অভিমানী হৃদয়কে জয় করে নেওয়া। গান্ধী এত মুসলমানকে জয় করলেন অথচ জিন্নাহকে পারলেন না! সি আর দাস বা মোতিলাল নেহরুকে কিন্তু ফিরিয়েছিলেন।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কংগ্রেস নেতৃত্ব, অর্থাৎ হিন্দু ও পারসী সমাজের সম্ভ্রান্ত ও ধনীরা, মুসলিম সমাজের সম্ভ্রান্তদের সাথে বোঝাপড়া না করেই সমাধানের চেষ্টা করলেন। ১৮৬১ সাল থেকে ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশের যে সুযোগ তৈরি করেছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ, যে সুযোগ নিতে চেয়েছিল ভারতের সকল ধনীরাই, সেই প্রতিযোগিতায় মুসলিম সম্ভ্রান্তরা পিছিয়ে পড়ছিল। তারাই বা সুযোগ ছাড়বে কেন? হিন্দু বা মুসলিম মেহনতী মানুষ, তখনও পর্যন্ত স্বাধীন আওয়াজ তোলার অবস্থানে ছিলেন না। ফলে তাদের সামনে দুটো পথ খোলা ছিল। স্বজাতির সম্ভ্রান্তদের পিছু পিছু হাঁটা অথবা সম্ভ্রান্তদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ইংরেজ শাসনকেই আঁকড়ে ধরা। এই দুই পথই জনতা অবলম্বন করেছিল। মুসলিম সম্ভ্রান্তরা একতরফা সিদ্ধান্তে বিচলিত হল, হিন্দু ধনীদের সাথে হাড্ডাহাড্ডী প্রতিযোগিতায় নামতে মুসলিম লীগ তৈরি করা হল। যেমন ১৮৮৫ সালে তৈরি হয়েছিল কংগ্রেস, ইংরেজদের ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশের সুযোগকে সদ্ব্যবহার করতে। নির্বাচন ও সংসদে (সেদিনের অর্থে) প্রতিনিধিত্বের সুযোগ না এলে হয়তো ধর্মের ভিত্তিতে এই দলবাজি দরকার হত না। দেখাও গেল ১৮৮৫ থেকে ১৮৯৩ পর্যন্ত বহু দাঙ্গা হচ্ছে, ক্ষমতার অলিন্দে যাওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল যে মুহূর্তে একটি দল তৈরি হয়ে গেল ১৮৮৫ সালে। আবার যখন মর্লেমিন্টো সংস্কারের জন্য আলোচনা শুরু হল, ১৯০৭ থেকে ১৯১৪, অন্য দলটিও তৈরি হয়ে গেছে ও ভাগিদারির জন্য লড়া শুরু করেছে, বহু দাঙ্গা হল। এই প্রেক্ষাপটেই যখন স্বাধীনতা সংগ্রামের যাত্রা শুরু হল, তখন কোন পথে হিন্দু মুসলিম ঐক্য গড়ে তোলা যায়, ও দেশভাগ রোখা যায় তা ভাবতে হত নেতাদেরই। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে সংখ্যাগুরু ধর্মের ধর্মনিরপেক্ষ নেতাদের। নেহরু-গান্ধীর কাছে এটুকু চাওয়া কি অন্যায়?

কিছুদিন ভালোই চলছিল। লীগের প্রস্তাব মেনে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ মর্লে মিন্টো সংস্কার করল, যা মুসলিমদের পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী প্রদান করল। মুসলিম ধনীদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী স্থিরিকৃত হল। নাইরোজি-গোখেল-জিন্নাহ-দের কংগ্রেস তা মেনে নিল, অন্যদিকে বাংলা-পাঞ্জাবের হিন্দু কট্টরপন্থীরা, বলা ভালো মুসলিম বিদ্বেষীরা বেঁকে বসলেন। তৈরি হল হিন্দু মহাসভা। মনে রাখবেন, মুসলিম লীগ তৈরী হওয়া মাত্র এই দল গঠিত হয়নি। ফলে লিগ গঠনের প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু মহাসভা তৈরি হয়েছে যারা বলছেন তারা সত্য বিকৃত করছেন। আসলে তা তৈরি হয়েছে সংখ্যালঘুদের জন্য রাজনৈতিক সংরক্ষণের সংস্কার আসার পর। নীতিগতভাবে স্বাধীন ভারতের সংবিধান আজও সংখ্যালঘুদের বিশেষ অধিকার দিয়েছে। সেটাই প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা। হিন্দু মহাসভাদের একটাই স্লোগান, হিন্দু আর মুসলিম এক সাথে বসবাস করতে পারে না, যদি করে তবে মুসলিমদের অধিকার দেওয়া যাবে না। এক কথায় দ্বিজাতি তত্ত্ব। কিন্তু জিন্নাহ না গেছেন লীগে, না ছেড়েছেন কংগ্রেস। প্রশ্নও ছিল না। কারণ কংগ্রেস এই সংস্কার মেনে নিয়েছিল। জিন্নাহ নিজেকে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের প্রতিনিধি ভাবতেন, গোখেলও নিজের প্রিয় ছাত্র সম্পর্কে একই কথা ভাবতেন। জিন্নাহ কিছুতেই লীগের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। তাঁর একটাই শর্ত ছিল, লীগের সংবিধান বদলাতে হবে, সেখানে লিখতে হবে যে দলের উদ্দেশ্য হল স্বশাসন, যা কংগ্রেসেরও ছিল। অর্থাৎ দেশ আগে, ধর্মীয় পরিচয় পরে। এবং লীগ যখন তা মেনে নিল তখনই তিনি লীগের সদস্য হলেন। যে কারণে তিনি কংগ্রেস ছাড়লেন তা এমন বিরাট অপরাধ ছিল না যার জন্য আর তাকে প্রধানমন্ত্রী ভাবা যাবে না! তিনি খিলাফত আন্দোলনকে জঙ্গি হতে দিতে রাজি ছিলেন না। কারণ আগেই আলোচিত। ফলে মুসলিম সমাজে তিনি কোণঠাসা হলেন। যে মুসলিম কট্টরপন্থীদের সাথে তিনি এতকাল বিতণ্ডা করেছেন কংগ্রেসের পক্ষ নিয়ে, সেই তারাই এখন কংগ্রেসের মঞ্চ কাঁপাচ্ছে, তাকে হল্লা করে মঞ্চ ছাড়তে বাধ্য করছেন, রাগ তো হবেই। কংগ্রেস দলের নেতৃত্বের লাগাম তার হাত থেকে বেরিয়ে গেল। তিনি মুখে যেটা বলেছিলেন তা হল, ধীরে চলো নীতির পক্ষে তিনি। সাংবিধানিক পথেই এগোতে চান তিনি। সেটাও আহামরি অপরাধ নয়। কংগ্রেসের মধ্যে নানা নেতার মধ্যে এই নিয়ে বিরোধ শেষ দিন পর্যন্ত ছিল। জওহরলাল নেহরুর সাথে তার বাবারই বিরোধ ছিল এই নিয়ে। তাছাড়া মাত্র ৫ বছর আগেই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিজয়কে সুনিশ্চিত করতে কংগ্রেস লোক ও অর্থ দিয়ে যুদ্ধে তাদের সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ফলে ধীরে চলো নীতি কংগ্রেসে অতি সাধারণ ব্যাপার ছিল। আর জিন্নাহ যিনি লীগের সংবিধানে স্বশাসন না দেখে সেই দলে যোগই দেননি, তাঁকে ইংরেজদের দালাল ভাবার কোনো কারণ ছিল না।

উপরন্তু মুসলিম হিসেবে জিন্নাহ-র ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি একেবারেই অপরাধ নয়। কারণ ভারতীয় সমাজে সামাজিক ভাবে ও শ্রেণিগত ভাবে অত্যাচারিতরা চেয়েছেন ধীরে চলো নীতি। রাজন্য বর্গের প্রজারা চেয়েছেন ইংরেজরা এসে তাদের মুক্ত করুক, মাহাররা দলে দলে নাম লিখিয়েছেন ইংরেজ-সৈন্যে। মহাত্মা ফুলে চেয়েছেন ইংরেজদের সাহায্যে দলিতদের এবং মেয়েদের শিক্ষাদান করতে। বিদ্যাসাগর ও রামমোহন রায় একই জিনিষ চেয়েছেন। আবার পরে যখন পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী যুগে প্রবেশ করল তখন আম্বেদকার ইংরেজদের সাহায্যে অস্পৃশ্যদের অধিকার আদায় করতে চেয়েছেন। জিন্নাহ যদি ভেবে থাকেন যে বৃটিশরা থাকা অবস্থাতেই বা তাদের মধ্যস্থতাতেই যা আদায় করার তা করে নিতে হবে, তা মোটেই অভিনব নয়। ফুলে থেকে শুরু করে আম্বেদকার বা জিন্নাহ, কেউই মেহনতি মানুষের উপর ভরসা রাখতে শেখেননি। যাই হোক্‌, জিন্না বা মুসলিমদের আশংকা যে অমুলক ছিল না তা যত পরিস্থিতি এগোল ততই স্পষ্ট হল।

১৯১৯ সালে মন্টফোর্ড সংস্কার হল। যা আগের পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর আইনটিকেই আরও মান্যতা দিল, এবং সবচেয়ে বড় কথা স্বাধীন ভারতের শাসন কাঠামো যে যুক্তরাষ্ট্রীয় হবে সেই আভাস দেওয়া হল। এক কথায় বললে কেন্দ্র দুর্বল হবে আর রাজ্যগুলি শক্তিশালী হবে, সেই মান্যতা। কংগ্রেস পৃথক নির্বাচক মণ্ডলী মেনে নিয়েছিল কিন্তু কেন্দ্র সবল হবে না, এটা তাদের কল্পনার অতীত ছিল। কিন্তু তখনও বিষয়টা আভাস মাত্র ছিল। তাছাড়া তখনই ভারত স্বাধীন হবে এই অবস্থার কথাও কেউ ভাবেনি। ফলে কংগ্রেস এই সংস্কারও মেনে নিল, আর হিন্দু মহাসভা সরাসরি খিলাফত আন্দোলনের বিরুদ্ধে নামল। অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারিত হতেই মালাবার অঞ্চলে ভূমিহীন কৃষকদের তীব্র সংগ্রাম শুরু হল, যা ইংরেজ প্রশাসনকে টলিয়ে দিয়েছিল। নাগাড়ে ৩ মাস মালাবার গ্রামাঞ্চল বিদ্রোহিদের দখলে ছিল। এবং শেষ পর্যন্ত শুধু হত্যালীলা চালিয়েই নয়, (শোনা যায় সিপাহী বিদ্রোহ আর সাঁওতাল বিদ্রোহের পর এত বড় হত্যাকাণ্ড আর হয়নি) হিন্দু জমিদার বনাম মুসলিম কৃষক, এই বিরোধ কদর্য দাঙ্গায় পর্যবসিত হল। এদেশে বহু জায়গায় দাঙ্গা হল, এবং সেই দাঙ্গার জন্য কংগ্রেসের অভ্যন্তরে এবং বাইরে থেকে মুসলিম নেতাদের দায়ী করা হল। যার কিছু সত্যতাও ছিল।  হিন্দু মহাসভা সুযোগ নিল। অন্যদিকে জিন্নাহ নিশ্চয়ই লক্ষ্য করলেন যে ১৯২০-র প্রথম নির্বাচনে খিলাফত ও অসহযোগের যৌথ ডাকে নির্বাচন বয়কট করেছিল কংগ্রেস ও লীগ দুই দলই। কিন্তু ১৯২৩-র নির্বাচনে কংগ্রেসের বহু নেতা, অতি দক্ষিণপন্থী ও মুক্তমনা, দুই পক্ষের যৌথতায় তৈরি হল ‘স্বরাজ পার্টি’, এবং সেই দলই নির্বাচন লড়ল এবং বহু আসনে জিতলও। অথচ লীগ তখন ছন্নছাড়া। এটা এক ধরনের কথার খেলাপ তো বটেই। ১৯১৯ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত লীগ কার্যত কংগ্রেস দলে মিশে গেছিল। তাদের কোনো পৃথক দলীয় বৈঠক হয়নি। মুসলিমরা তাদের সংরক্ষিত নির্বাচকমণ্ডলী থেকে গেলেন ক্ষমতার অলিন্দে কিন্তু সবই ব্যক্তি হিসেবে। তাছাড়া তুরস্কে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার ফলে এদেশের খিলাফতপন্থীরা হতাশ এবং বেশ কিছু ক্ষেত্রে দাঙ্গায় ইন্ধনকারীও বটে। এই অবস্থায় যদি গান্ধীজী একদিকে চিত্তরঞ্জন দাস আর অন্যদিকে জিন্নাহকে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের মুখ হিসেবে সামনে আনতে পারতেন, তবে ঐ কট্টর দাঙ্গাবাজ মুসলিম মৌলবাদীরাও জব্দ হত, আরএসএস তৈরি করতেও অসুবিধা হত। জিন্নাহ কংগ্রেস ছেড়ে দিয়েছেন, চিত্তরঞ্জন দাস-মোতিলাল নেহরুও তাই। তাদের দলে ফেরানোর জন্য গান্ধী আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, সফলও হয়েছেন। অথচ লীগের নেতা জিন্নাহর ক্ষেত্রে  তা হল না। ১৯২৪ সালে বহু বছর পরে যখন আবার লীগ বৈঠকে বসল জিন্নাহ তখন দলের বৈঠকেই পূর্ণ স্বরাজের ডাক দিলেন। ফলে দল ছাড়লেও জিন্নাহ তখনও হিন্দু মুসলিম ঐক্যের অন্যতম পোস্টার বয়।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯২৭ সালে আসবে পরবর্তী কমিশন, যা ভবিষ্যত সরকারের নবতম রূপরেখা হাজির করবে। সাইমন কমিশন এল। কিন্তু তা বয়কটও করা হল, কংগ্রেস আর লীগ দুই দলই করল। জিন্নাহ কিছুতেই লীগকে ইংরেজদের ধামাধরা হিসেবে গড়ে তুলতে বা অন্তত চিহ্নিত হতে দিতে চাইছিলেন না। যা চাইছিল লীগের পাঞ্জাবের মৌলবাদী গোষ্ঠী। ইংরেজদের চ্যালেঞ্জ মতো ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধভাবে সাংবিধানিক রূপরেখা হাজির করার কথা। এবার কিন্তু জিন্নাহ বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করলেন। ১৯২৪ সাল থেকেই তিনি অতি সবল কেন্দ্রের বিপক্ষে কথা বলতে শুরু করেছেন। এবার তিনি মুসলিম নেতাদের সাথে সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ২৭ মার্চ ১৯২৭ সালে এক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। ১৪ দফা দাবির মধ্য দিয়ে যে এবার পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি থেকে তারা সরে এলেন। বদলে তারা চাইলেন সিন্ধু প্রদেশকে বম্বের থেকে আলাদা করতে। চাইলেন কেন্দ্রীয় আইনসভায় এক তৃতীয়াংশ মুসলিম সংরক্ষণ। রাজ্যের হাতে স্বশাসন আর বাংলা ও পাঞ্জাবে নির্বাচনে আসন সংরক্ষণ। অর্থাৎ তুলনায় অনেক নমনীয় দাবি। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ঊর্দ্ধে তুলে ধরলেন। এটাই ভারতের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে যুগ সন্ধিক্ষণ হতে পারত, ইতিবাচক ভাবে।  সমস্ত দল ঐক্যবদ্ধভাবে সাম্রাজ্যবাদের মোকাবিলা করতে প্রতিশ্রুতি নেওয়ার সুযোগ তৈরি হল। এবং এই নমনীয়তার কারিগর হিসেবে জিন্নাহকে মুখ করা দরকার ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর এজেন্ডাকে আর ধামাচাপা দেওয়া যাবে না। রাজন্য বর্গ থেকে শুরু করে মুসলিম সকল গোষ্ঠীর ছিল পৃথক পৃথক স্বার্থ, কিন্তু সকলেই কমবেশি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা বলছেন, এ যেন এক বিচিত্র পরিস্থিতি। অনেকটা যেন ‘হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই’ বলার মতো। সবাই বলছে, কিন্তু ভিন্ন অর্থ বহন করছে প্রত্যেকেই। যখন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী বলছেন, তার অর্থ হল, মুসলিমরা সৎ ‘অবৈধ’ ভাই, যাদের অবলীলায় সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায়। অথবা জবরদস্তি পরিবারের মধ্যে রেখে ক্রীতদাসের মত খাটানো যায়। মহাত্মা গান্ধী যখন এই বাক্য বলছেন তার অর্থ, হিন্দু দাদা আর মুসলিমরা হল নাবালক পঙ্গু ভাই, যত্ন করলেও যাদের অভিভাবক দাদা। আর বৃটিশরা যখন ব্যবহার করেছে তার অর্থ হল, বাবা দাদাকে বেশি সম্পত্তি দেবে নাকি সমান ভাবে ভাগ করে দেবে, এই নিয়ে দুই ভাই-র মধ্যে অবিরাম সন্দেহ জিইয়ে রাখা। যাই হোক ফিরে যাই ১৯২৭ সালে। কংগ্রেস রীতিমতো প্যাঁচে পড়ে গেল এবং হিন্দু মহাসভার নেতাদের কোর্টে বল ঠেলে দিল। ভারতের সর্বদলের বৈঠক মুসলিম প্রশ্নে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারল না। এবং সেই বৈঠকে হাজির হিন্দু মহাসভা ও তাদের নেতা জায়াকার এই সিদ্ধান্ত না পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করলেন। মোতিলাল নেহরুকে দিয়ে একটি কমিটি বানিয়ে যে রিপোর্ট তৈরি হল তা মুসলিমদের দাবিকে মানলোই না। তাদের ভোটাভুটি করে হারিয়ে দেওয়া হল। জিন্নাহ যে বৈপ্লবিক ভূমিকা নিয়েছিলেন তা জলে গেল। ইংরেজদের স্পষ্ট জানানো হল যে নেহরু রিপোর্টের ভিত্তিতে যদি সংবিধানের রূপরেখা না হয় তবে কংগ্রেস আন্দোলনে নামবে। কম্যুনিস্টদের যদিও ডাকা হয়নি, হলে কী হত আমরা জানি না। জিন্নাহর ১৪ দফা প্রস্তাবকে সম্পূর্ণ অবহেলা করে ভারতবর্ষ যুগ সন্ধিক্ষণে পৌঁছাল। কিন্তু নেতিবাচকভাবে।

জিন্নাহর রাজনৈতিক জীবনকে চার ভাগে ভাগ করা যায় সহজেই। প্রথমত, গোখেল এবং দাদাভাই নাইরোজির গুণমুগ্ধ কংগ্রেসী উঠতি নেতা, যাকে গোখেলের মৃত্যুর পর  উত্তরাধিকারী হিসেবেই অনেকে ভেবছিলেন। তিনি লীগের সদস্য হলেন কিন্তু কংগ্রেসের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখলেন। মোতিলাল নেহরু রিপোর্টের মধ্য দিয়ে জিন্নাহ তার দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করলেন। হয়ে উঠলেন কংগ্রেস বিরোধী লীগের নেতা। তাঁর এই পর্যায় চললো ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত। তৃতীয় পর্যায় হল ১৯৩৭ থেকে ক্যাবিনেট মিশন পর্যন্ত। যখন তিনি হিন্দু মহাসভার সাথে সরকার গঠন করতেও পিছুপা হলেন না অথচ ক্যাবিনেট প্রস্তাব মেনে নিলেন। আর সবশেষে ক্যাবিনেট মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেওয়া জিন্নাহ।

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ আয়ারল্যান্ডের সম পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সমাধান হাজির করতে বাধ্য হয়েছিল। জিন্নাহ যে ১৪ দফা দাবি পেশ করেছিলেন তা মোটামুটি সেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকেই সামনে আনল। ১৯৩১ সালের গোল টেবিল বৈঠক থেকেই এই কাঠামো নিয়ে বিতণ্ডা শুরু হল। গোল টেবিল বৈঠকে গান্ধীজী বা কংগ্রেস নিজেরা সক্রিয় ভূমিকা না নিয়ে হিন্দু মহাসভাকে আবার ব্যবহার করলেন। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো শব্দটি এখন সকলেই ব্যবহার করতে শুরু করল। মহাসভার জায়াকার সবচেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো আর স্বরাজ। অনেকটা জাতীয়তাবাদ আর সমাজতন্ত্র একসঙ্গে যেমন বলেছিলেন হিটলার। যত তা হল ততই মুসলিম লীগ কোণঠাসা হয়ে পড়ল। স্বরাজ মানেই সেই বার্তা যা মুসলিমদের বা দলিতদের বা মেয়েদের ভীত করে। একবার ইংরেজরা চলে গেলে উচ্চবর্ণের হিন্দু পুরুষরা তাদের আর কোনো অধিকার দেবে না, এই ভয়। অথচ ভারতে আম্বেদকার-জিন্নাহ-কম্যুনিস্ট ও কংগ্রেসের ঐক্যবদ্ধ শক্তি হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছিল, কিন্তু তা হয়নি। ফাঁক গলে সাম্রাজ্যবাদ সকল অংশের মুক্তিদাতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই গোল টেবিল বৈঠকে হেডগেওয়ারের দীক্ষা গুরু মুনজেকে সাংঘাতিক গুরুত্ব দেওয়া হল কংগ্রেসের তরফে। মুনজের উদ্দেশ্যই ছিল লীগের সাথে কংগ্রেসের দূরত্ব আরও বাড়ানো, এবং সময় বের করে লন্ডন থেকে ইতালি গিয়ে মুসোলনির সঙ্গে সাক্ষাৎকার সেরে আসা।

কংগ্রেস বিরোধী হয়ে ওঠার এই দ্বিতীয় পর্যায় থেকেই জিন্নাহ নিজেকে ও লীগকে মুসলিমদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে দেখানো শুরু করেছিলেন। কিন্তু তা বাস্তব ছিল না। বহু মুসলিম দল তখন ছিল, পাঞ্জাবে, বাংলায়, উত্তর পশ্চিম সীমান্তবর্তী রাজ্যে। এবং প্রতিটি দলই যথেষ্ট শক্তিশালী। যার ফলে জিন্নাহর এখনো নমনীয় হওয়ার সুযোগ ছিল। এখনো জিন্নাহকে জয় করে আনার সময় পেরোয়নি। সামনে ১৯৩৭ সালের নির্বাচন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে লীগ ও কংগ্রেস ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে লড়তে পারত। জিন্নাহকে বা লীগের অন্য কোনো মুখকে কয়েকটিই রাজ্যের ‘মুখ্যমন্ত্রী’ পদে বসিয়ে হিন্দু মুসলিম ঐক্যকে জোরদার করা যেত। এবং জিন্নাহও তেমনই আশা করেছিলেন। তাই নেহরু রিপোর্টের ওই অপমান সত্ত্বেও লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো ছিল এমনই যাতে কংগ্রেসের সাথে জোট সরকার গঠন করা যায়। কিন্তু কোনো সুযোগই কাজে লাগানো হল না । বদলে যা হল তার ফলে জিন্নাহ নামক বাল্মীকী রত্নাকরে রূপান্তরিত হলেন। চারটি মুসলিম প্রধান রাজ্যে, উত্তরপশ্চিম সীমান্ত, আসাম, পাঞ্জাব ও বাংলা, এই চারটের মধ্যে আসাম বাদ দিয়ে তিনটেতেই মুসলিম লীগ বা কংগ্রেস কেউই ভালো ফল করেনি ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে। কিন্তু সংযুক্ত প্রদেশে তারা ভালো করল, অর্থাৎ যেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও সম্ভ্রান্ত। কিন্তু কংগ্রেস কোনোভাবেই জোট সরকার করতে রাজি হল না। লীগের বিজয়ী সদস্যদের দল ছেড়ে আসতে বলা হল। এই অপমানে দেশের সমস্ত মুসলিম আতংকিত হল। ইংরেজরা থাকাকালীন যদি এই অবস্থা হয় তবে না জানি স্বাধীন দেশে কী হবে! আতংকের ও মেরুকরণের প্রতিফলন হিসবে সিকন্দর হায়াত খাঁ-র ইউনিয়নিস্ট দল লীগে মিশে গেল, বাংলার মুসলিম নেতেরা, আসামের মুসলিম নেতারাও তাই করলেন। অর্থাৎ সকলেই মুসলিম লীগের ছাতার তলায় আশ্রয় নিল। যা জিন্নাহকে বদলে দিল। ১৯২৮-র পর থেকে জিন্নাহ যে দাবি করে আসছিলেন তা সত্য হল। এবার সত্যিই লীগ সমস্ত মুসলিমদের প্রতিনিধি হল। কংগ্রেস যতই হিন্দু মুসলিম সকলের প্রতিনিধি হিসবে নিজেকে দাবি করুক বাস্তবে দেখা গেল যে কংগ্রেসের ৪৮২ টি প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ৫৮ জন মুসলিম। জিন্নাহ এবার সরাসরি আশ্রয় নিলেন লীগের মৌলবাদী সাফি গোষ্ঠির কোলে। সুযোগ বুঝে লীগ এমনকি হিন্দু মহাসভার সাথেও সরকার গঠন করে ফেলল সিন্ধু প্রদেশে! সাভারকার আর লীগের কথা যেন মিলে মিশে গেল। জিন্নাহ কোনো বিরোধী পক্ষ রাখলেন না। সিকন্দরকে সরানো হল, ফজলুল হক কেও। অন্য মুসলিম দলগুলিকে গুঁড়িয়ে দিলেন জিন্নাহ। ১৯৪৫ সালের সিমলা মিটিঙ-কে জিন্নাহ ভেস্তে দিলেন এই যুক্তিতেই যে প্রতিনিধিদের মধ্যে অর্ধেক হবে মুসলিম। আর সেই মুসলিমদের নাম দেবে লীগ। অন্য কোনো মুসলিম দল বা কংগ্রেস নয়। এই পর্যায়েরই ফলশ্রুতি ১৯৪০ সালের পাকিস্তান প্রস্তাব।

কিন্তু কংগ্রেস যদি নীতিগতভাবে দুর্বল কেন্দ্র ও সবল রাজ্যের ফর্মূলা মেনে নিতে রাজি থাকত তবে লাহোর প্রস্তাবকেও স্বশাসিত রাজ্যের প্রস্তাবে রূপান্তরিত করা যেত। বলছেন ঐতিহাসিক সুমিত সরকার। ‘স্টেটস’ শব্দকে যেহেতু রাজ্য ও রাষ্ট্র, দুই অর্থেই ব্যবহার করা যায়। কিন্তু তাও হল না। অথচ একমাত্র এই ফর্মূলাতেই দেশভাগ রোখা যেত। শুধু তাই নয়। আজ মোদিদের যে হিন্দু রাষ্ট্রের অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটছে তাও অসম্ভব হয়ে যেত। পররাষ্ট্র-প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ ছাড়া আর সব বিষয় রাজ্যের অধীনে থাকলে স্বাধীন ভারতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কোনো দলের পক্ষে সহজে দেশকে হিন্দু রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলা ক্ষীণ ছিল। ১৯৯২ সালের পর থেকে আঞ্চলিক দল ও রাজ্য সভাতে বিভিন্ন দলের অস্তিত্বের ফলেই দেখেছি মোদীরা এখনও অসুবিধাতে রয়েছেন। তাছাড়া এই ফর্মূলা মেনে নিলে রাজ্যে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর পদটাই অনেক বেশি শক্তিশালী হত, জিন্নাহ প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেও অসুবিধা ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে কংগ্রেস ফ্যাসিবাদবিরোধী ফ্রন্টে থাকার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু ১৯৪১ সালে জাপান শক্তিশালী হতেই তারা বৃটিশ ভারত ছাড়ো স্লোগান তুলল। ১৯৪২ সালে ক্রীপস বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে  অতি লোভনীয় প্রস্তাব নিয়ে এলেন, যুদ্ধান্তে স্বাধীন ভারতের প্রস্তাব। যুদ্ধচলাকালীনই প্রশাসন হস্তান্তরের প্রস্তাব।  কিন্তু তাও মানা হল না। ক্রীপস মিশনের প্রস্তাব মেনে নিয়ে কংগ্রেস-বাম-লীগ যদি যৌথভাবে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ত, যেমনটা খিলাফতের যুগে তারা করেছিল, তা হলে আবার এক ঐক্য গড়ে উঠত। কিন্তু এই দিকে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল না কংগ্রেসের। লেনিনের মতো সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে শ্রেণী যুদ্ধে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা ছিল না। এর পরে যখন জাপানকে চীনা জনগণ আর হিটলাকে রুশ জনগণ জব্দ করল, কংগ্রেস নেতৃত্ব জেল থেকে বেরিয়ে আবার ইংরেজদের সাথে বৈঠকে বসলেন, কিন্তু দুর্বল কেন্দ্র আর সবল রাজ্য নিয়ে নীরবই থাকলেন। এদিকে জিন্নাহ সজোরে পাকিস্তান নামক দেশের কথা বলছেন ভাষণে, সর্বত্র। তবে কি আর জিন্নাহকে ফেরানোর সুযোগ ছিল না? আমি বলব, তাও ছিল।

শেষ সুযোগ পাওয়া গেল ১৯৪৬ সালে। খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব নিয়ে এল ক্যাবিনেট মিশন, ক্রীপসেরই নেতৃত্বে। লীগের পাকিস্তান প্রস্তাবকে বাতিল করল মিশন। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর এক নির্দিষ্ট রূপকেও হাজির করা হল। দুর্বল কেন্দ্র আর সবল রাজ্য। পাশাপাশি রাজ্যগুলিকে ধর্মের ভিত্তিতে group করার স্বাধীনতা দেওয়া হল। চলতে চলতে অসুবিধা হলে শেষ পর্যন্ত দেশ থেকে বেরোনোর স্বাধীনতাও থাকল। অর্থাৎ একবার চেষ্টা করে দেখার প্রস্তাব। রাজন্য বর্গের ক্ষেত্রেও তা মানানসই। আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেল পাকিস্তান প্রস্তাব থেকে সরে এসে লীগ এই প্রস্তাব মেনে নিল। হয়তো বেরিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা থাকার ফলেই তারা মেনেছিল। মিশনের শর্ত মেনে স্বাক্ষরও করল তারা। পৃথক দেশ নিয়ে জিন্নাহ যদি এতই কড়া হবেন তাহলে কেন তিনি ক্যাবিনেট মিশনকে মেনে নিলেন? ফলে আমার মতে পৃথক দেশের স্লোগান ছিল কংগ্রেসের উপর প্রেসার ট্যাক্টিক্স। কিন্তু আবার ঐতিহাসিক ভুল হল।  লিখিত ভাবে তা মেনে নিয়েও খুবই লজ্জাজনক ভাবে পিছিয়ে গেল কংগ্রেস দল। যা এমনকি কংগ্রেস সভাপতি আজাদও মানতে পারেননি।

সুতরাং প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দিয়ে জিন্নাহ পরিণত হলেন সেই মৌলবাদী নেতাতে যা তিনি এককালে ঘৃণা করতেন। দাঙ্গার ফলে মৃত্যুমুখ থেকে বাঁচতে হিন্দু জনগণ হিন্দু অঞ্চলে পালাবেন আর মুসলিমরা মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে, দাঙ্গার মধ্য দিয়ে দেশভাগের আগের ড্রেস রিহার্সাল হল। পাশাপাশি প্রতিটা পাড়ায়, গ্রামে বসবাস করা দুই ধর্মের মানুষদের না হলে কীভাবে ভৌগোলিকভাবে ভাগ করা যেত!

শেষ কথা

এক কথায় বললে, গান্ধীজীর কাছে নেহরু ছিলেন চোখের মণি। ভবিষ্যত স্বাধীন ভারতের একমাত্র যোগ্য প্রধানমন্ত্রী। কারণটাও আশা করি এই আলোচনা থেকেই স্পষ্ট করতে পেরেছি। কংগ্রেসের কাছে একমাত্র চ্যালেঞ্জ ছিল দেশের মুসলিমদের নেতা হয়ে ওঠা। যেটা তারা বার বার বলে এসেছেন, যে তারাই সমগ্র দেশবাসীর প্রতিনিধি। এক্ষেত্রে নেহরুর কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি আদ্যপান্ত ধর্মনিরপেক্ষ। তিনি নাস্তিক। ফলে তিনি নিজেকে হিন্দু ভাবেন না। ১৯১৬ থেকেই হয়তো তা সত্য ছিল। আর শেষের দিকে যখন দেশভাগ অপরিহার্য হয়ে দেখা দিল, তখন ভারতে যাতে বেশ বড় সংখ্যক মুসলিম থেকে যায় (যা আর এস এস-সাভারকার-গডসেদের কাছে অনভিপ্রেত ছিল) তার জন্য নেহরুও অপরিহার্য হয়ে গেলেন। মৌলানা আজাদ যিনি কংগ্রেসের সবচেয়ে দুঃসময় দলের সভাপতি থাকলেন, তাঁকে ঠিক স্বাধীনতার এক বছর আগে সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। আজাদের ভরসায় মুসলিমদের এই দেশে রাখার প্রশ্ন ওঠে না, কারণ সেক্ষেত্রে হিন্দুদের কাছে আর এস এস-র আবেদন বেড়ে যাবে, অমন মেরুকরণের পরিস্থিতিতে। ফলে নেহরু আর গান্ধীজীর ভরসায় মুসলিমরা এদেশে থেকে গেলেন। কিন্তু আমরা জানি ব্যক্তির উপর নির্ভর করে নীতি ঠিক করা কোনো বিজ্ঞান নয়। এমন ফর্মূলা দরকার ছিল যা এদেশের মুসলিমদের সুরক্ষা দেবে, এমনকি দেশভাগকেও রুখে দেবে, স্বাধীন ভারত যাতে কোনোদিন হিন্দু রাষ্ট্র না হয় তার নিশ্চয়তা দেবে, সাভারকার প্রধানমন্ত্রী হলেও যাতে না হয়। সেই ফর্মূলা ছিল দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। বা দুর্বল কেন্দ্র ও সবল রাজ্য, যা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি কংগ্রেস।  সবচেয়ে বড় কথা সমাজের প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ অংশ এই ফর্মূলাকে ঊর্দ্ধে তুলে ধরবে তাও হয়নি। তারা বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। হরিপুরা কংগ্রেসে যে বিভ্রান্তি আরও স্পষ্ট হয়েছিল। শ্রেণি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি কেন্দ্রীভূত শাসন, এমনই আদর্শ ভেবেছিলেন প্রগতিশীল মহল, নেহরু নিজেও। প্রগতিশীল আন্দোলন শ্রেণি সংগ্রাম ও পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতির মধ্যে সম্পর্ক খেয়াল রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ বিষয়গুলি একেবারেই জলজ্যান্ত হয়ে হাজির ছিল। ১৯২০-র দশকে একই সাথে জন্ম কম্যুনিস্ট পার্টি এবং আরএসএস-র। ১৯৩০-র দশকে হল শোলাপুর কম্যুন আর তার কয়েক মাসের মধ্যেই কানপুরের বিভৎস দাঙ্গা। নৌবিদ্রোহের অভূতপূর্ব ঐক্যের ছয় মাসের মধ্যেই হল বাংলার কদর্য দাঙ্গা। ফলে পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতি এভাবেই শ্রেণি সংগ্রামকে ধ্বংস করেছে। এটা মাথায় না রেখে জমিদারী প্রথা বিলোপ যারা চেয়েছেন বা সামন্ততন্ত্রের অবসান চেয়েছেন তারা কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। রাজন্য বর্গের ক্ষমতা হ্রাসের কথা ভেবেছিলেন প্রগতিশীলরা। তাদের মনে হয়েছিল যে সবল রাজ্য হলে রাজন্য বর্গের সুবিধা হবে। ফলে প্রগতিশীলদের বিভ্রান্তির আড়ালে নিজেদের কার্য সিদ্ধি করেছে কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থার পক্ষে থাকা প্রতিক্রিয়াশীলরা। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম যদি নিরঙ্কুশভাবে ১৯২৭ সাল থেকেই সজোরে দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে স্বীকার করত তবে ইতিহাস অন্য খাতে বইত। জিন্নাহকে প্রধানমন্ত্রী ভাবা যেত নিশ্চিন্তে। দেশভাগ বা দাঙ্গার অভাবে সাভারকার-মুসলিম মৌলবাদীরা শুকিয়ে মরত। উত্তাল চল্লিশ ভগত সিং-দের স্বপ্নের ইনকিলাবী ভারতের জন্ম দিতে পারত। ♣️

তথ্যসূত্র :

গুগল করেই প্রত্যেকটি ঘটনা সম্পর্কে সবিস্তারে পাঠ করা যাবে, মৌলিক দলিলের রেফারেন্স আর সাইটেশন দেওয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করিনি। যে বইগুলির সাহায্য নিয়েছি—

Coupland, R., The Constitutional Problem in India

Penderel Moon, Divide and Quit 

Jinnah Correspondences

India wins freedom, Maulana Abul Kalam Azad

Jaswat Singh, Jinnah: India-Partition-Independence

এছাড়া

Stanley Wolpert-র কয়েকটি বই ব্যবহার করেছি, সবগুলো বই আমার এখনও পড়া হয়নি। উৎসাহী, অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিদেরকে এই লেখকের ভারত বিষয়ক সবকটা বই পড়তে অনুরোধ করব।

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *