প্রাচীন ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানের “আবিষ্কার”: গেরুয়া প্রচারের নতুন মুখ 

অশোক মুখোপাধ্যায়

[১] আবার “সবই ব্যাদে আছে”!

ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ISRO)-এর বর্তমান চেয়ারম্যান শ্রীধর সোমনাথ গত ২৫ মে ২০২৩ গিয়েছিলেন মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীতে মহাঋষি পাণিনি সংস্কৃত ও বৈদিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাৎসরিক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে। সেখানে তিনি স্বভাবতই বিজেপি-র পরিচালনাধীন বর্তমান কেন্দ্রীয় ও মধ্য প্রদেশ রাজ্য সরকারের মৌলবাদী গেরুয়া মনোভাবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান চর্চা সম্পর্কে বেশ কিছু কথা বলে ফেলেন। সংবাদ মাধ্যমে তাঁর সেই বক্তব্য সংক্ষেপ করে বেরয় এই ভাবে: ভারতের বেদেই আধুনিক বিজ্ঞানের সব কিছু ছিল। তখন প্রয়োজনীয় বর্ণমালার অভাবে সংস্কৃত ভাষায় লেখা যেত না বলে সেই জ্ঞান মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। পশ্চিমা পণ্ডিতরা সেগুলোই এখান থেকে আরবদের মাধ্যমে তুলে নিয়ে গিয়ে আধুনিক বিজ্ঞান বানিয়েছে এবং নিজেদের নামে চালিয়ে দিয়েছে।

স্বভাবতই, প্রত্যাশা মতো বিভিন্ন বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংগঠনগুলো এর বিরুদ্ধে নানা কথা তুলেছে। এই যেমন ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির একজন অন্যতম কর্মকর্তা দেবকুমার হালদার খবরের কাগজে এক পত্রে লিখেছেন: “সম্প্রতি ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো)-র প্রধান এস সোমনাথ “আধুনিক বিজ্ঞানের সব মূল সূত্র বেদে নিহিত” বা “বেদ থেকেই আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে” বলে যে সব আলটপকা মন্তব্য করেছেন, তা তাঁর পদমর্যাদার পক্ষে যতই বেমানান ও দেশের ভাবমূর্তির পক্ষে যতই কলঙ্কজনক হোক, এমনতর মন্তব্য করতে তিনি বস্তুত বাধ্য। এমন মন্তব্য যাতে তাঁর মুখ দিয়ে বলিয়ে নেওয়া যায় সেজন্যই তাঁকে ওই পদটি “উপহার” দেওয়া হয়েছে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী কেন্দ্রের তখতে বসার পর থেকে বিজ্ঞান শিক্ষার সারস্বত প্রতিষ্ঠান ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলি কব্জা করে সেখানে সঙ্ঘ-অনুগামী (রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ) লোকজন বসিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়, যাতে সঙ্ঘের উগ্র হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডার রূপায়ণ সহজতর হয়। এরই অঙ্গ হিসেবে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টরিক্যাল রিসার্চ কর্তৃক প্রকাশিত “টুওয়ার্ডস ফ্রিডম” সংকলনের সম্পাদক পদ থেকে কে এন পানিক্কর ও সুমিত সরকারের মতো প্রথিতযশা ইতিহাসবিদদের ছেঁটে ফেলা হয়। তিলক-কাটা, ভূত-খেদানো লক্ষ্মীধর বেহেরা-কে নিযুক্ত করা হয় আইআইটি (মান্ডি)-র মতো প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তার পদে। রোবোটিক্স ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বিশেষজ্ঞ, আইআইটি কানপুরের প্রাক্তন অধিকর্তা, তিলকশোভিত এই গোঁসাইঠাকুর দাবি করেন—তিনি নাকি ভূত দেখেছেন, এবং গীতার শ্লোক ও ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ আউড়ে সে ভূত তাড়িয়েওছেন। মনোজ সোনিকে বসানো হয়েছে ইউপিএসসি-র চেয়ারম্যান পদে। স্বামীনারায়ণ সম্প্রদায়ের অনুপম মিশনের দীক্ষিত এই ব্যক্তির কট্টর হিন্দুত্ববাদী বলে বিশেষ সুনাম আছে। আশঙ্কা অসঙ্গত নয় যে, এর ফলে দেশের আমলাকুলের নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি সঙ্ঘের হাতে চলে যাবে। “সঙ্ঘের ঘরের মেয়ে” বলে পরিচিত শান্তিশ্রী ধুলিপুড়ি পণ্ডিতকে বসানো হয়েছে জেএনইউ-এর উপাচার্য পদে। যিনি মনে করেন, দিল্লিতে আন্দোলন করা কৃষকরা “পরজীবী দালাল”। শাহিনবাগের সিএএ-বিরোধীরা সব “জেহাদী”। ইউজিসি-তে পাঠানো হয়েছে গেরুয়া-অনুগামী জগদীশ কুমারকে। ফিলম্ অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া-র প্রধান করা হয়েছে গজেন্দ্র চৌহান ও অনুপম খের-এর মতো বিজেপি-অনুগত লোককে।” [এই সময়, ১ জুন ২০২৩]

এই পত্রে যে সমস্ত অভিযোগ উত্থাপন এবং আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে, তা সর্বাংশেই যথাযথ। অনুগতদের উচ্চতর পদে বসানো হচ্ছে এই ভরসাতে যে তাঁরা গেরুয়া গল্পগুলির গায়ে তাঁদের পদমর্যাদা যুক্ত করে ওজন বাড়িতে দেবেন।

এই সমালোচনার সঙ্গে নেট বাজারে ঘুরছে মেঘনাদ সাহার একটি বিখ্যাত উক্তি: “বলা বাহুল্য যে, বিগত কুড়ি বৎসরে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দুশাস্ত্র গ্রন্থ এবং হিন্দু জ্যোতিষ ও অপরাপর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রাচীন গ্রন্থাদি তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া আমি কোথাও আবিষ্কার করিতে সক্ষম হই নাই যে, এই সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থে বর্তমান বিজ্ঞানের মূলতত্ত্ব নিহিত আছে। সকল প্রাচীন সভ্যদেশের পণ্ডিতগণই বিশ্বজগতে পৃথিবীর স্থান, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহাদির গতি, রসায়ন বিদ্যা, প্রাণী বিদ্যা ইত্যাদি সম্বন্ধে নানারূপ কথা বলিয়া গিয়াছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাস্তবিক পক্ষে বর্তমান বিজ্ঞান গত তিনশত বৎসরের মধ্যে ইউরোপীয় পণ্ডিতগণের সমবেত গবেষণা, বিচারশক্তি ও অধ্যবসায় প্রসূত।

একটা দৃষ্টান্ত দিতেছি, এদেশে অনেকে মনে করেন, ভাস্করাচার্য একাদশ শতাব্দীতে অতি অস্পষ্টভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন, সুতরাং তিনি নিউটনের সমতুল্য। অর্থাৎ, নিউটন আর নূতন কি করিয়াছে? কিন্তু এই সমস্ত “অল্পবিদ্যা-ভয়ঙ্করী” শ্রেণীর তার্কিকগণ ভুলিয়া যান যে, ভাস্করাচার্য কোথাও পৃথিবী ও অপরাপর গ্রহ সূর্যের চতুর্দিকে বৃত্তাভাস (elliptical) পথে ভ্রমণ করিতেছে একথা বলেন নাই। তিনি কোথায়ও প্রমাণ করেন নাই যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও গতিবিদ্যার নিয়ম প্রয়োগ করিলে পৃথিবীর ও অপরাপর গ্রহের ভ্রমণ কক্ষ নিরূপণ করা যায়। সুতরাং ভাস্করাচার্য বা কোন হিন্দু, গ্রীক বা আরবী পণ্ডিত কেপলার-গ্যালিলিও বা নিউটনের বহুপূর্বেই মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন, এরূপ উক্তি করা পাগলের প্রলাপ বই কিছুই নয়। দুঃখের বিষয়, দেশে এইরূপ অপবিজ্ঞান প্রচারকের অভাব নাই, তাহারা সত্যের নামে নির্জলা মিথ্যার প্রচার করিতেছেন মাত্র।” [মেঘনাদ সাহা — সবই ব্যাদে আছে; পত্রিকার বর্তমান সংখ্যায় দ্রষ্টব্য]

[২] সবই কি ব্যাদে আছে?

চার দিকের এত সমালোচনামূলক মন্তব্যের তুফানে, বিশেষ করে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী সাহার মেঘনাদে বিব্রত হয়ে স্বভাবতই কিছু চাপা স্বভাবের গেরুয়াপন্থীর আঁতে ঘা লেগেছে। সোমনাথ আসলে কী বলেছিলেন না জেনেই সকলে বিরূপ মন্তব্য করছেন—এই কথা বলে তাঁরা সক্ষোভ আবার ফেসবুকে পোস্ট করে অনেক রকম লিঙ্কফিঙ্ক দিয়ে শুধু মাত্র বেদ নয়, প্রাচীন ভারতের সমগ্র সময় জুড়ে বিজ্ঞানের কত বিকাশ হয়েছিল বোঝানোর গুরুদায়িত্ব বহন করেছেন। তাতে তাঁদের দাবি অনুযায়ী সোমনাথ নাকি তাঁর ভাষণে জ্যোতিষ বিষয়ক গ্রন্থ সূর্য-সিদ্ধান্তের এমন সব আবিষ্কারের কথা জানান, যা পশ্চিমারা অনেক পরে জানতে পেরেছে, কিন্তু নিজেদের নামে চালিয়ে দেয়। তার মধ্যে অন্যতম একটা সিদ্ধান্ত হচ্ছে, মহাকর্ষ আবিষ্কার, যা নাকি নিউটনের বারোশ বছর আগেই ভাস্করাচার্য সেরে ফেলেছিলেন।

ওঁদের এই প্রচেষ্টাটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। বিজ্ঞানের আলোচনায় বা বিতর্কে গ্রন্থসূত্র সহ দাবি পেশ করলে জানতে বুঝতে তর্ক করতে সুবিধা হয়। শুধু যদি ওনারা সামাজিক মাধ্যমে যে সমস্ত লিঙ্ক দিয়ে থাকেন সেগুলো দেওয়ালে টাঙানোর আগে নিজেরা একটু খুলে পড়ে নিতেন, তাহলে যে কত উপকার হত বলার নয়। তাঁরা সূর্য-সিদ্ধান্তে আছে বলে যে লিঙ্ক দিচ্ছেন, তাতে ক্লিক করলে আপনি সূর্য-সিদ্ধান্তের কোনো পাঠে নয়, অন্য লেখকের অন্য কোনো গ্রন্থে গিয়ে পৌঁছবেন। তিনি আবার আর একজন একই রকম দাবিদার। দাবির লিঙ্ক থেকে আপনি দাবিতেই পৌঁছবেন। আদি সূত্রে কিছুতেই যেতে পারবেন না।

তথাপি অনেক কষ্ট করে আমি ওঁদের দেওয়া একটা লিঙ্ক থেকে সূর্য-সিদ্ধান্তেই পৌঁছতে পারলাম। কিন্তু ও মা, সেখানে ঢুকে দেখি, যা যা সোমনাথ মহোদয় এবং এই সব লিঙ্কদাতারা সূর্য-সিদ্ধান্তে আছে বলে জানিয়েছিলেন, তার একটা তথ্যেরও সেখানে কোনো অস্তিত্বই নেই। এই যেমন বুধের ব্যাস, পৃথিবী থেকে মঙ্গলের দূরত্ব, ইত্যাদি। থাকবে বলে আমি অবশ্য আশা করিনি। সেই যুগে বসে সেকালের জ্যোতির্বিদগণ এত সব জটিল বা সূক্ষ্ম হিসাব নিয়ে মাথা ঘামাবেনই বা কেন, আর হিসাব পাবেনই বা কী করে?

সে না থাকুক। আমাদের মতো শিক্ষায় এবং বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়া দেশে সোমনাথরা তবুও আছেন এবং তাঁরা দাবি করেই যাবেন। বিশেষ করে যে সময়ে এই রকম দাবিদাররাই ধর্ম এবং ঐতিহ্যের নামে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ভোট কুড়নোর এবং শাসন দণ্ড চালনার কুকর্মে ব্রতী। তাঁদের একটাই ভরসা, কে আর মূল বইটই মিলিয়ে এত সব বানানো গালগল্পের সত্যমিথ্যা যাচাই করতে যাবে।

মেঘনাদ সাহাও অনেকটা এই কথাই বলতে চেয়েছিলেন। তিনি বহুকাল ধরে প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রপুঞ্জ পড়ে পড়ে হদ্দ হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের ব-এরও সন্ধান কোথাও পাননি। পাওয়ার কথা নয় বলেই পাননি। শুধু ভারত কেন, প্রাচীন গ্রিক মিশরীয় বা চিনা সভ্যতায়ও সেই সব আধুনিক জিনিস পাওয়ার কথা ছিল না। তাই বলে সোমনাথ জাতীয় লোকেরা পুরনো সেই দিনের কথা কিছুতেই ভুলতে পারেনও না, কাউকে ভুলতে দিতেও চান না। উচ্চতর পদপ্রাপ্তির বিনিময়ে কিছু প্রতিদান দেবার দায়িত্বের কথা তো আছেই।

আমি অবশ্য এঁদের সুবাদে খোঁজাখুঁজি করতে করতে ১৮৬০ সালে প্রকাশিত সূর্য-সিদ্ধান্তের একটা ইংরেজি অনুবাদ পেয়েছি। নামিয়ে নিয়েছি। এটা একটা মস্ত লাভ। তার ভিত্তিতে দু-একটা দাবি একটু পরীক্ষা করে দেখা যাক। 

গেরুয়া ভক্তদের তরফে দাবি করা হয়েছে, সূর্য-সিদ্ধান্ত মতে পৃথিবীর ব্যাস নাকি প্রায় আধুনিক মাপজোকের কাছাকাছি। সত্যিই কি তাই?

সূর্য-সিদ্ধান্তের মতে পৃথিবীর ব্যাস = ১৬০০ যোজন [Surya Siddhanta, 1/59; translated by Bapu Dev Sastri; Baptist Mission Press, 1861];

এদিকে, ১ যোজন = ১২.৩ কিলোমিটার;

অতএব, সেই অনুযায়ী পৃথিবীর ব্যাস =  ১৯৬৮০ কিমি;

কিন্তু, এখন আমরা জানি, পৃথিবীর প্রকৃত (নিরক্ষীয়) ব্যাস = (আনুঃ) ১২৭৫৬ কিমি। মেরু বরাবর ব্যাস আরও কম; ১২৭১৪ কিমি। সেটা ধরলে ভুলের পরিমাণ কিঞ্চিৎ বেড়ে যাবে।

অর্থাৎ, সূর্য-সিদ্ধান্ত সেকালে অন্তত দেড় গুণ বেশি বলেছিল। সুতরাং মেঘনাদ সাহা ভুল কিছু বলেননি।

পশ্চিমা গণিত শাস্ত্রে যাকে পাই (π) বলা হয়, অর্থাৎ কোনো বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত, সূর্য-সিদ্ধান্ত তার মান বলেছিল দশ-এর বর্গমূল, অর্থাৎ, ৩.১৬২২৭৭ [Ibid]; এটাও আমাদের জানা হিসাবের চাইতে খানিকটা বেশি (এখন π = ৩.১৪১৫৯২…….)। তবে সময়ের সাপেক্ষে সেকালে বৃত্তের পরিধি:ব্যাস অনুপাতকে দশের বর্গমূল হিসাবে ভাবতে পারাটাও খুব খারাপ হিসাব নয়। যদি না আমরা সেকালেই একালের বিজ্ঞানটা পেতে চাই।  

এই সব তথ্য দেখার পরে সোমনাথবাবুরা এবং তাঁদের গেরুয়া ভক্তরা দাবিগুচ্ছ পাল্টাবেন?

মনে হয়, না।

তাঁরা হয়ত বলবেন, তখন পৃথিবী অনেক বড় ছিল। ফলে ব্যাসও এখনকার চাইতে দেড় গুণ বড় ছিল। সেই কারণেই π-এর মান তখন একটু বড় আকার নিয়ে ছিল (অনুপাতের ধ্রুবকত্বের কথা তুলে তাঁদের আর লজ্জা দিচ্ছি না)।

এই প্রক্রিয়ায় তথাকথিত ভারতীয় জ্ঞানতন্ত্রকে আপনি কিছুতেই ভুল প্রমাণ করতে পারবেন না! মেঘনাদ সাহা প্রমুখ বিজ্ঞানীরাই বরং ঘাবড়ে যাবেন।

তাঁরা তখন স্কুল জীবনে পড়া অষ্টাদশ শতাব্দের আইরিশ কবি অলিভার গোল্ডস্মিথ-এর লেখা এক ইংরেজি কবিতায় জনৈক গ্রামের পাদ্রি-কাম-স্কুল শিক্ষকের সম্পর্কে পঠিত বিখ্যাত বাণীটি স্মরণ করবেন:

“In arguing too, the parson own’d his skill,

For e’en though vanquish’d he could argue still;”

ইসরোর খ্যাতিমান চেয়ারম্যান এবং তাঁর ভক্তবৃন্দও তদনুরূপ অনন্ত তর্ক চালাতে পারেন।  

[৩] জানতে জানা

যাঁরা বেদ পুরাণ বা অন্যান্য প্রাচীন শাস্ত্রে আধুনিক বিজ্ঞানের সমস্ত আবিষ্কার হয়ে গিয়েছিল বলে দাবি করেন, তাঁরা তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুঝতে অপারগ বলে শিক্ষিতদের কাছে কিঞ্চিত হাসির খোরাকি যোগান। যথা:

১) আধুনিক বিজ্ঞানের জগতে যে সমস্ত যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়ে গেছে বলে জানা আছে, তাঁরা কেবল মাত্র সেই সব কাহিনিই প্রাচীন শাস্ত্রে খুঁজে বেড়ান। অর্থাৎ, বিশ্ববাসী জানলেই তবে তাঁরা জানতে পারেন যে ওগুলো ভারতেও আগেই জানা ছিল।  যেমন, ১৯৩০-এর দশকে যখন অরবিন্দ-শিষ্য অনিল বরন রায় ভারতবর্ষ পত্রিকায় মেঘনাদ সাহার সঙ্গে বিতর্কে নেমে প্রাচীন ভারতে আবিষ্কার তালিকা পেড়েছিলেন, সেখানে প্লাস্টিক সার্জারি বা রাইনোপ্লাস্টির দাবি ছিল না। কেন না, তখনও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে এগুলো আসেনি। মহাভারতে তখনও কিন্তু গণেশের হস্তীমুণ্ডই ছিল বলে লেখা ছিল। কিন্তু তাকে কী বলে মহিমান্বিত করা হবে সেরকম পরিভাষা হাতে আসেনি। সেই জন্য দেখবেন, সাহাকেও এর উত্তর দিতে হয়নি। ১৯৫০ পরবর্তীকালে যখন থেকে এই সব নতুন চিকিৎসা কৌশল পাশ্চাত্যে উদ্ভাবন হল, অমনি আমাদের নতুন অনিলগণ প্রাচীন ভারতে প্লাস্টিক সার্জারি, রাইনোপ্লাস্টি ইত্যাদি ছিল বলে জেনে গেলেন! জানার কী সুন্দর পদ্ধতি ভেবে দেখুন! স্টেম সেল, জিন প্রযুক্তি, নলজাতক, ইত্যাদিও আপনি ১৯৭০ পূর্ববর্তী কোনো প্রাচীন ভারতের দাবি তালিকায় দেখতে বা দেখাতে পারবেন না। সে পুরাণে কর্ণ, গান্ধারীর শতপুত্র, ইত্যাকার যাবতীয় তথ্য থাকলেও। মেঘনাদ সাহাকে এই সব উদ্ভট দাবি নিয়েও শব্দ খরচ করতে হয়নি। এই সব প্রাচীন “আবিষ্কার”-গুলি আবিষ্কৃত হয়েছে অধুনা পশ্চিমা বিজ্ঞানে জিনতত্ত্ব, অণুজীববিদ্যা ইত্যাদির বিকাশের পর। এখানেই দাবিগুলির অসারতা ধরে পড়ে যায়।

২) প্রাচীন “আবিষ্কার”-এর আবিষ্কারকগণ আর একটা গোল পাকান এই প্রতিটি আবিষ্কারের নামের বিজ্ঞাপনে। ধরুন, প্রাচীন ভারতের জ্ঞানী বৈদ্যরা প্লাস্টিক সার্জারি জানতেন। অন্য বিজ্ঞানীরা কেউ জানতেন স্টেমসেল কীর্তি, কেউ পারঙ্গম ছিলেন জিন প্রযুক্তিতে। তা, তাঁরা এই সব বিদ্যার নামকরণ কীভাবে করতেন? তাঁরাও প্লাস্টিক সার্জারিই বলতেন? রাইনোপ্লাস্টি? স্টেমসেল? জিনতত্ত্ব? আধুনিক যত সব ম্লেচ্ছ নাম? তাঁদের সেই সব “নিজস্ব” জ্ঞানের কোনো নিজস্ব সংস্কৃত শিরোনাম ছিল না? নাকি, যাঁরা প্লাস্টিক সার্জারি জানতেন, তাঁরা ইংরেজি কিংবা গ্রিক লাতিন জানলেও সংস্কৃত ভাষাটা তখন জানতেন না? এমনকি, এই ব্যাপারটা যে খুবই বিসদৃশ, তাও তাঁদের ধরিয়ে না দিলে তাঁরা এখনও নিজে থেকে ধরতে পারেন না। তাঁরা অনায়াসে ঋগবেদে “পিথাগোরাসের উপপাদ্য” খুঁজে পান। কোথায় কীভাবে পান পরে বলছি। কিন্তু যদি ধরেও নিই, পেয়েছেন, সেটার অস্তিত্ব পিথাগোরাসের নামে হবে কেন? সত্য হলে তাঁদের তো বলার কথা, এই দেখ, বেদে (বা অন্যত্র) বৌধায়নের বা নচিকেতার ক্ষেত্র সম্বন্ধীয় যে শ্লোকটি রয়েছে, সেটা পিথাগোরাসের উপপাদ্যেরই অনুরূপ। এটা বললে তার একটা কার্যকর মানে দাঁড়ায়। এরকম তাঁরা বলতে পারেন না কেন?

৩) তাছাড়া, যে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি জানেন, অঙ্কের কথা থাকে অঙ্ক বইতে; জ্যামিতির কথা লেখা থাকে জ্যামিতির পাঠে; আকাশ সংক্রান্ত বিদ্যার খবর থাকে জ্যোতির্বিদ্যার বইপত্রে; উদ্ভিদ ও প্রাণী সম্পর্কে নানা রকম জরুরি তথ্য পাওয়া যায় জীববিদ্যার পুঁথিতে; চিকিৎসা সংক্রান্ত জ্ঞান থাকার কথা চিকিৎসা শাস্ত্রের বইতে; ইত্যাদি। কিন্তু প্রাচীন কালের জ্ঞান বিজ্ঞানের খবর এরকম কক্ষবদ্ধ নয়। আপনি যে কোনো বিষয়ের “তথ্য” অন্য যে কোনো প্রকারের গ্রন্থে পেতে পারেন, শুধু সেই প্রকারের গ্রন্থ ছাড়া। আপনি চিকিৎসা বিষয়ক নানা তথ্য, যেগুলি আধুনিক পশ্চিমা বিজ্ঞানের সঙ্গে তুলনা করে দাবি করা হচ্ছে, চরক সংহিতা বা শুশ্রুত সংহিতাতে পাবেন না। কোথায় পাবেন? মহাভারতে। “পিথাগোরাসের উপপাদ্য” কেউ কোনো প্রাচীন গণিতের পুস্তকে দেখতে পাবেন না, পাবেন ঋগবেদে। উদ্ভিদ সম্পর্কে কোনো তথ্যই আপনি বিজ্ঞানের কোনো শাস্ত্রে খুঁজে পাবেন না। আপনাকে হয়ত বলা হবে, এর জন্য মহানির্বাণতন্ত্র খুলে দেখুন। জীব বিবর্তনের বিষয়ে জানতে চান? দুটি গ্রন্থের নাম বলতে পারি। স্বামী বিবেকানন্দের সুপারিশ অনুযায়ী পাতঞ্জল মহাভাষ্য এবং অনিল বরন রায়ের প্রস্তাবনা অনুসারে বিষ্ণু পুরাণ। খবরদার কোনো বিজ্ঞানের বইতে হাত লাগাবেন না।  

সত্যিই এ এক অদ্ভুত জ্ঞান চর্চা। সামান্য মনোযোগ দিলেই এই সব ঘটনার মধ্যে গোলমালটা কোথায় ধরা পড়ে যাবে। আরও কিছু কথা পরে বলছি।

হ্যাঁ, তার আগে এরকম একটা প্রশ্ন উঠতেও পারে, সেই সুদূর প্রাচীন কালে কি অত বিষয় (discipline) ধরে ধরে আলাদা আলাদা গ্রন্থ ছিল? বা থাকা সম্ভব ছিল কি? জ্ঞানের এতটা বিশেষায়ন হয়েছিল কি? নাকি, এক একটা গ্রন্থেই নানা বিষয়ে অনেক রকম আলোচনা থাকত?

Exactly! এটাই পঞ্চাশ লক্ষ বার রামায়ণ মহাভারত বিষ্ণুপুরাণ মহাঅর্ণব তন্ত্র করে করে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই এত বার প্রাচীন ভারত উচ্চারণ করেও দেশের বেশির ভাগ লোকেরই মনে নেই বা জানা নেই যে এক দিকে ঋগবেদ ছিল প্রাচীন কাব্যগ্রন্থ, উপনিষদগুলি ছিল গদ্যাকারে তত্ত্ব আলোচনা, রামায়ণ মহাভারত ছিল পুরাণ সাহিত্য, ষড় দর্শনের পাঠ ছিল বিভিন্ন দার্শনিক গ্রন্থে, আর অন্য দিকে ছিল পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী (ভাষাতত্ত্ব ও ব্যাকরণ), পতঞ্জলীর রচিত তারই টীকা মহাভাষ্য, ষড় বেদাঙ্গ (কল্প = পূজাপাঠ, ছন্দ = কাব্যরীতি, নিরুক্ত = শব্দতত্ত্ব, শিক্ষা = ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ = ভাষা প্রকরণ ও জ্যোতিষ = আকাশ বিদ্যা), চরক সংহিতা (ভেষজ বিদ্যা), শুশ্রুত সংহিতা (শল্যবিদ্যা),  ইত্যাদি। তাহলে এতগুলো বিষয় ভিত্তিক গ্রন্থ যখন ছিল, তখন জ্যামিতি বা বস্তুর গতি সংক্রান্ত বিদ্যা বিকশিত হলে তারও বিশেষীকৃত পাঠ থাকারই কথা। সেরকম পাঠ না থাকলে বুঝতে হবে, বিষয়টা সেভাবে বিকশিতই হয়নি। হয়নি বলেই জ্যামিতি খুঁজতে হচ্ছে রামায়ণে, স্টেম সেল মহাভারতে, ইত্যাদি।    

এবার অন্য কয়েকটা বিষয়ের দিকে তাকানো যাক।

ধরা যাক, ঋগবেদে না হলেও অন্যত্র কোথাও (যেমন, শূল্বসূত্রে, যেখানে কিছু কিছু জ্যামিতিক আকার প্রকার নিয়ে দুচারটে শ্লোক পেতে পারেন) পিথাগোরাসের উপপাদ্যের মতো কিছু একটা পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হল। এবং হয়ত আমাদের সমালোচনা শুনেটুনে আর পিথাগোরাসের নাম না করে, মনে করুন, বৌধায়ন বা কাত্যায়নের উপপাদ্য বলেই তাকে ঘোষণা করা হল। তাতেই কি দাবিওয়ালাদের সমস্যার সমাধান হয়ে যাচ্ছে?

না। একেবারেই না। আরও কটা জিনিস আমরা দেখতে চাইব।

প্রথমত, কোথাও আপনি শুনেছেন, জ্যামিতি করতে বসে হঠাৎ একটা মাত্র (পিথাগোরাসের) উপপাদ্য উত্থাপন করে সেই জ্যামিতিওয়ালা চলে গেল? তার আগেও কিছু নেই, পরেও কিছু নেই? জ্যামিতি মানে কি শুধু পিথাগোরাস? শুধু একটা উপপাদ্য? আর কিছু তাতে থাকে না? সেগুলো দাবিওয়ালাদের দাবিপত্রে কই? বিন্দু কাকে বলে, রেখা কাকে বলে, সরল ও বক্র রেখার সংজ্ঞা কী; ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বহুভুজ, আয়তক্ষেত্র, বর্গক্ষেত্র, বৃত্ত ইত্যাদি কী প্রকারের বস্তু—এই সব প্রসঙ্গ দিয়ে জ্যামিতির আলোচনা শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু সোমনাথবাবুদের বা অন্যদের বৈদিক ও পৌরাণিক দাবিসনদে সেসবের সন্ধান আপনি কখনই পাবেন না। যে কোনো ত্রিভুজের দুইটি বাহুর দৈর্ঘ্যের যোগফল তৃতীয় বাহু অপেক্ষা বৃহত্তর—এই উপপাদ্যের প্রাচীন ভারতে জন্মের কথা কাউকে দাবি করতে দেখবেন না। কিংবা ধরুন, অ্যাপোলোনিয়াসের উপপাদ্যের কথা ভারতেই প্রথম জন্মেছিল বলে কেউ দাবি করছে, এমনটাও শোনা যায় না।

এর কারণ কী?

এর মানে হল, এই দাবিওয়ালারা—আজ নয়, অনেক কাল আগে থেকেই—কখনও কোনো সূত্রে হয়ত জ্যামিতিতে পিথাগোরাস এবং তার নামে প্রচলিত এক উপপাদ্যের কথা শুনে ফেলেছিলেন। তাদের ধারণা হয়েছিল, এ এক সাংঘাতিক কঠিন কিছু এবং জ্যামিতিশাস্ত্রের এক দারুণ ব্যাপার। অমনি তাঁদের মনে হয়েছে, এটাকে “ভারতীয় জ্ঞানতন্ত্র”-এর থলেতে পুরে নিতে হবে। তার আগেকার জ্যামিতিক ব্যাপারগুলো হয় তাদের মনে তেমন রেখাপাত করেনি, অথবা তারা জীবনে সেসবের নামই শোনেনি। আর পরের উপপাদ্যগুলোকে দেখেছে বেশ কঠিন কঠিন। তখন থেকে তারা এই উপপাদ্যকে বেছে নিয়েছে প্রাচীন ভারতের এক নিজস্ব উৎপাদন হিসাবে। এ হল এক নম্বর রহস্য।

দ্বিতীয়ত, তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকলে তার প্রয়োগও থাকবে। তার নিজের এলাকায়ও থাকবে, জ্ঞানের অন্য নানা ক্ষেত্রেও থাকবে। কিন্তু প্রয়োগ আছে দেখেই আপনি ধরে নিতে পারেন না, তার পেছনের তাত্ত্বিক জ্ঞানও সেই প্রয়োগকারীর আয়ত্তে এসে গেছে। যেমন, মানুষ আগুনে পুড়িয়ে ঝলসিয়ে সেদ্ধ করে রান্না করছে বহু লক্ষ বছর ধরে। কিন্তু তার পেছনকার ভৌতরাসায়নিক তত্ত্ব জ্ঞান আয়ত্ত করেছে মাত্র কয়েকশ বছর আগে।

সুতরাং বৈদিক যুগের লোকেরা যজ্ঞ করার জন্য নানা আকারের বেদী নির্মাণ করতেন, এর থেকেই আপনি ধরে নিতে পারেন না, তাঁরা সেই নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জ্যামিতিক জ্ঞানেরও অধিকারী ছিলেন। যদি বলতে চান যে তারা তখনই জ্যামিতি সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিলেন, তাহলে তার আলাদা করে প্রমাণ দিতে হবে। জ্যামিতিক জ্ঞানের রচনা খুঁজে বের করতে এবং দেখাতে হবে। হঠাৎ করে কেবল মাত্র একটা উপপাদ্যের কোথাও উল্লেখ দেখিয়ে বলা যাবে না, এরকম জ্যামিতিক জ্ঞান প্রাচীন ভারতে ছিল। এই বোধগুলো জ্ঞান শাস্ত্রের একেবারে প্রাথমিক কথা।

এরকম জ্যামিতিক পাঠযুক্ত কোনো পাণ্ডুলিপি যে প্রাচীন ভারতে পাওয়া যায়নি তা সকলেই জানেন এবং বেদ-কৈবল্যবাদীরাও এখন অবধি সেরকম কোনো দাবি উত্থাপন করেননি বা করতে পারেননি। কিংবা, যেখানে নানা রকম জ্ঞান বিজ্ঞানের খবর এনারা খুঁজে পান, যেমন রামায়ণ মহাভারতে, বিষ্ণুপুরাণ শিবপুরাণ বা চণ্ডীস্তোত্রে, সেখানেও যে সেরকম বাণী নেই তা তাঁদের দাবিতালিকাতেই মালুম। অর্থাৎ অন্যত্রও “পিথাগোরাসের উপপাদ্য” প্রয়োগের কোনো উদাহরণ কুত্রাপি পাওয়া যাচ্ছে না।

এই সমস্ত দাবিদাওয়ার তাই কোনো বাস্তব তথ্যগত ভিত্তি নেই। 

[৪] ভাস্করাচার্য বনাম নিউটন

অন্য একটি দাবি প্রসঙ্গে বিষয়টাকে আরও পরিস্ফূটনের স্বার্থে মেঘনাদ সাহার উপরে প্রদত্ত উদ্ধৃতির একটা অংশকে নিয়ে এবার একটু সবিস্তার চর্চা করতে চাই।

যাঁরা মনে করেন, ভাস্করাচার্য অস্পষ্টভাবে মাধ্যাকর্ষণ বলের উল্লেখ করে গেছেন, তাঁদের উদ্দেশে সাহার বক্তব্য, “ভাস্করাচার্য কোথাও পৃথিবী ও অপরাপর গ্রহ সূর্যের চতুর্দিকে বৃত্তাভাস (elliptical) পথে ভ্রমণ করিতেছে একথা বলেন নাই। তিনি কোথাও প্রমাণ করেন নাই যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও গতিবিদ্যার নিয়ম প্রয়োগ করিলে পৃথিবীর ও অপরাপর গ্রহের ভ্রমণ কক্ষ নিরূপণ করা যায়।”

দ্বাদশ শতাব্দে মধ্যযুগের ভারতের বিশিষ্ট গণিতবিদ ভাস্করাচার্য (যিনি ভাস্কর-২ নামেও পরিচিত, সপ্তম শতকের প্রথম ভাস্কর থেকে স্বতন্ত্র) গণিত শাস্ত্রে নানা কাজ করে গেছেন। তাঁর রচিত লীলাবতী (পাটিগণিত) ও বীজগণিত বহু দিন পর্যন্ত ভারতে ছাত্রদের গণিত শিক্ষার পাঠ্যপুস্তক হিসাবে খ্যাত ছিল। কালের সাপেক্ষে এটা তাঁর সে যুগের একটা মস্ত অবদান। এই কালের সাপেক্ষে কথাটা খুব জরুরি একটা বিষয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫২ সালে কলকাতার সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে এসে এই বইদুটি বাতিল করে দেন এবং গণিত শিক্ষার জন্য ইংরেজিতে লেখা তখনকার প্রচলিত পাঠ্যবই চালু করেন। কেন না, তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, সংস্কৃত শ্লোকের মাধ্যমে ছাত্ররা এই বইদুটি থেকে যতটা অঙ্ক শেখে, (সেকালের) আধুনিক গণিতের পুস্তক থেকে তার চাইতে অনেক বেশি করে শিখতে পারবে। অর্থাৎ, মধ্য যুগে যতই গুরুত্ব থাক, বিদ্যাসাগরের কালে গণিত শিক্ষার ক্ষেত্রে ভাস্করাচার্যের সেই বইদুখানার কোনো প্রাসঙ্গিকতাই আর ছিল না। আর সেই সময় বিদ্যাসাগরকে কোনো দেশি পুঁথি-বীর বলেননি, “আহা হা, করেন কী পণ্ডিতজি? এতে যে স্বয়ং নিউটন ভর করে আছেন!” থাকলে কি আর তাঁরা (অন্তত রাধাকান্ত দেবের দলবল) ছেড়ে কথা বলতেন? অর্থাৎ, মেঘনাদ সাহার প্রায় সাত দশক আগেই আসলে বিদ্যাসাগর ভাস্করাচার্যের নিউটন-দাবি সমূলে খারিজ করে রেখে গেছেন! না জেনেই অবশ্য!  

ভাস্করাচার্য কেবল মধ্য যুগের গণিতবেত্তা? আমাদের গেরুয়া দাবিদারগণ এত অল্পে সন্তুষ্ট হতে পারেন না। তাঁদের দাবি হল, আইজ্যাক নিউটনের বহু বছর আগেই ভারতবর্ষে ভাস্কর মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। সুতরাং আমরা এই দাবিটিকে আরও বিভিন্ন দিক থেকে বাজিয়ে দেখব।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, মেঘনাদ সাহা উপরের বয়ানে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কারের কৃতিত্ব ভাস্করাচার্যের উপরে আরোপনের বিরুদ্ধে তিনটি আপত্তি উত্থাপন করেছেন।

[১] ভাস্কর (বা সম কালে অন্য কেউ) সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ আবর্তন করছে—একথা কোথাও বলেননি;

[২] সেই আবর্তন পথ যে উপবৃত্তাকার তাও কেউ বলতে পারেননি;

[৩] উলটো দিক থেকে, তথাকথিত মহাকর্ষ সূত্র থেকে তিনি গ্রহগতির কোনো সূত্র নিষ্কাশন করে দেখাননি।

প্রথম দুটো নিছক শুষ্ক তথ্য। হয় তা মেনে নিতে হবে, নতুবা, ভিন্ন তথ্য সামনে এনে দেখাতে হবে যে সাহা ভুল বলেছেন। নান্য মধ্যম্‌পন্থাঃ।

দ্বিতীয় আপত্তির মধ্যে অবশ্য তথ্য সহ আবার একটা মস্ত যুক্তির কথাও আছে। গ্রহগুলির আবর্তন পথ উপবৃত্তাকার, বৃত্তাকার নয়। এটা ভালো করে বুঝতে হলে খানিকটা পদার্থবিজ্ঞান জানা এবং গণিতে সামান্য পারদর্শিতা থাকা দরকার। সরলরেখায় গতিজাড্য এবং সূর্যের আকর্ষণ বলজনিত পতন—গ্রহগুলির কক্ষপথ বরাবর এই দুই প্রকারের গতির বিভিন্ন বিন্দুতে লব্ধির সমাকলন করলে পাওয়া যাবে উপবৃত্তাকার আবর্তন (নীচের ছবি দ্রষ্টব্য)। খুব দূরবর্তী ধূমকেতুর ক্ষেত্রে কখনও কখনও এই লব্ধির সমাকলন অধিবৃত্তাকার (parabola)-ও হয়ে যেতে পারে। সেগুলো একবার সূর্যের কাছ দিয়ে ঘুরে যাওয়ার পর আর কখনও ফিরে আসে না। পৃথিবী থেকে মানুষও তাকে সেই একবারই হয়ত দেখার সুযোগ পেতে পারে। এতগুলো জিনিস যদি ভাস্করাচার্য না বলে থাকেন সেটা তাঁর কোনো গুণাভাব নয়। সেকালে এত সব জিনিস বলার বা জানার কথাই ছিল না। নিউটনের পঞ্চাশ বা একশ বছর আগে ইউরোপেই কেউ এসব কথা বলতে পারেননি।

আপনি একটা বল উপরে ছুঁড়ে আবার লুফে নিতে পারেন—শুধু মাত্র এর থেকে আপনার মাথায় মহাকর্ষের ধারণা কোনো মতেই আসবে না। কিংবা এও আপনি বুঝতে পারবেন না, যে নিয়মে বলটা উপর থেকে আপনার হাতে নেমে আসছে, সেই একই নিয়মে পৃথিবী বা বৃহস্পতি সূর্যের চারদিকে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে। যদি এরকম ভাবে এত সহজে এটা বোঝা সম্ভব হত, তাহলে আরিস্ততল কিংবা কপিলই হয়ত মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার করে ফেলতেন। নিউটন তো দূরের কথা, ভাস্করাচার্যকেও লাগত না।

চিত্র পরিচিতি: একটি গ্রহের বিভিন্ন অবস্থানে (P, P’, . . . ) লব্ধিগুলির সমাকলন করলে নিউটনীয় তত্ত্বকাঠামোয়

এরকম একটি উপবৃত্তাকার পথ বেরিয়ে আসে (ভেকটর রাশিগুলির অঙ্কন স্কেল অনুযায়ী নয়)।

এবার আসা যাক তিন নং আপত্তির কথায়।

এই আপত্তির মধ্যে বৈজ্ঞানিক চিন্তাপদ্ধতির একটা অত্যন্ত জরুরি মূল নীতির কথা বলা আছে। সাহা জানতেন, গ্যালিলেওর অবাধ পতনের সূত্র, কেপলারের গ্রহগতি সূত্র এবং নিউটনের পার্থিব গতিসূত্র—এই তিন প্রকার নিয়মের সংশ্লেষণ করেই নিউটন তাঁর বিখ্যাত মহাকর্ষের সূত্রে পৌঁছেছিলেন। এটুকু বিজ্ঞানের ছাত্ররা আজকাল কম বেশি অনেকেই জানে। কিন্তু সাহা এবার এও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এই মহাকর্ষসূত্রটি নিউটনের গতিসূত্রগুলির সঙ্গে মিলিয়ে আবার বিপরীত দিকে প্রয়োগ করলে গ্রহগুলির উপবৃত্তাকার পরিভ্রমণের কক্ষপথ নির্ণয় করা যায়। তবে বিজ্ঞানের কাজটা সম্পূর্ণ হয়।

বিজ্ঞানে এরকম একটি পূর্ণাঙ্গ গাণিতিক নিয়ম প্রতিপালনকে বলা হয় আবশ্যক ও পর্যাপ্ত শর্ত (necessary and sufficient condition) নির্মাণ। এই শর্তকে সিদ্ধ না করলে আধুনিক বিজ্ঞানের কোনো গাণিতিক নিয়মই সম্পূর্ণ সত্য রূপে গ্রাহ্য হয় না। ভাস্করাচার্যের নামে প্রচলিত কোনো সূত্র এই শর্তকে পরিপূরণ করে না (করার কথাও নয়)। তিনি বস্তুর গতি সংক্রান্ত অন্য কোনো সূত্রই আবিষ্কার না করে বা না জেনে ঝপ করে মহাকর্ষ সূত্রে ঝাঁপ দিলেন, এটা বিজ্ঞানের জগতে সম্ভব নয়। বিজ্ঞান আর ভোজবাজি এক জিনিস নয়।

অতএব তাঁর নামে প্রচলিত এই দাবিটিও আর একটি বৃহদায়তন মিথ্যাচার।

[৫] বায়ুতাড়িত মহাকর্ষ?

এই সব দাবি সংক্রান্ত মিথ্যাচার সাহা-উত্তর কালে কীভাবে ভাব সম্প্রসারণ করে চলেছে, সে সম্পর্কে আরও কিছু কথা এবার বলতে চাই।

আমরা অনেকেই আজকাল গ্রন্থাগারের কাজ আন্তর্জালের পরাবাস্তব জগতে গিয়ে সেরে নিই। আমিও যাই। অনেক সুবিধা হয়। ওতে যত বইপত্তর নাড়াচাড়া করতে পারি, সেই পরিমাণ খোঁজাখুঁজির জন্য লাইব্রেরিতে যেতে হলে যা বাস বা অটোভাড়া দিতে হত, তার তুলনায় অনেক কম পয়সা নেটে ভরলেই কাজ হয়। কিন্তু এই ব্যাপারে এখন একটা বিরাট সমস্যা এসে দাঁড়িয়েছে, আপনি কী খুঁজতে গিয়ে কী খুঁজে পাবেন। যা পাবেন তা সত্য বা সঠিক কিনা। সন্দেহ হলে ভুল ঠিক যাচাই করবেনই বা কীভাবে। ভালো দলিল আর নকলের মধ্যে ফারাক করবেন কিসের ভিত্তিতে? বিভিন্ন দাবির ফয়সালাই বা হবে কীভাবে?

প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান সম্পর্কে আলোচনা করতে বসে হঠাৎ করে এসব কথা কেন বলছি?

বলছি ধাক্কা খেয়ে।

প্রথম পর্বের আলোচনায় বলেছি, এক গেরুয়া কলমচির “ব্যাদেই-সব” দাবির সমর্থনে প্রদত্ত একাধিক লিঙ্ক থেকে “সূর্য-সিদ্ধান্ত” নামক গ্রন্থে যাচ্ছি ভেবে রওনা হয়ে পৌঁছেছি অন্য এক দাবিদারের রচনায়। তার পর অনেক খোঁজাখুঁজি করে যখন সূর্য-সিদ্ধান্তের ১৮৬১ সালের একটি ইংরেজি অনুবাদ নামাতে সক্ষম হলাম এবং তার পরে (মেঘনাদ সাহা কথিত) ১৯৩৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ১৮৬০ সালের আর একটা সটীক সংস্করণ পেলাম প্রবোধচন্দ্র সেনগুপ্তের লেখা একটি চমৎকার ভূমিকা সহ, বইটা পড়ে ভয়ঙ্কর অবাক হলাম।

সূর্য-সিদ্ধান্ত পরিষ্কার সূর্যকে ঘোরাচ্ছে পৃথিবীর চারদিকে, আর দাবিপত্রের লেখকরা বলছেন, সেখানে নাকি আধুনিক বিজ্ঞানের কথা, অর্থাৎ, সূর্যকেন্দ্রিক মডেল দেখানো হয়েছে। বইটিতে লেখা আছে: “Now the planets (such as the Sun) being on their orbits, go very rapidly and continually with the stars towards the west and hang down (from their places towards east) at an equal distance, . . .” [Ibid, 1/25]

ভাস্করাচার্য নাকি এই বইতে মহাকর্ষের কথা বলেছেন। এই সম্পর্কে দুচারটে প্রাসঙ্গিক শব্দ লিখে নেট হাতড়ালেই যে কেউ এরকম একটা বয়ান উদ্ধৃতিচিহ্নের ভেতরে পাবেন: “Objects fall on the earth due to a force of attraction by the earth. Therefore, the earth, planets, constellations, moon and sun are held in orbit due to this attraction.” বাপ রে বাপ! সত্যি হলে তো নিউটনের চৌদ্দ পুরুষ আগের ব্যাপার! দাবিকারকদের লেখায় সূর্য-সিদ্ধান্তের নাম দেওয়া আছে, কিন্তু সঠিক সূত্রনির্দেশ নেই। অর্থাৎ, কোন অধ্যায়ের কত নম্বর শ্লোকে আছে বলা নেই। আমি দুটো পিডিএফ (১৮৬১ এবং ১৯৩৫ সালের) প্রচুর ছানবিন করেও এরকম কোনো বাক্য বা মহাকর্ষের দেখা পেলাম না। এই জন্যই উপরে বলেছিলাম, এই সব বিষয় নিয়ে সোমনাথবাবু এবং তাঁর মতো এক দল গেরুয়া ভক্তবৃন্দ বাজারে নানা মিথ্যার মহাকারবার চালিয়ে যাচ্ছেন!

ভাস্করাচার্যের একটা ছবি নেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাতে লক্ষ করলে দেখবেন, ক্যালকুলাস উদ্ভাবনের কৃতিত্ব নিউটন ও লাইবনিৎস–দের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবার একটা আয়োজনও ইদানীং প্রস্তুতির মুখে। মহাকর্ষ-দাবিটা ভারতের বাজারে চারিয়ে দিতে পারলে কিছুদিনের মধ্যেই ক্যালকুলাস-গুল্পটাও ছড়াতে শুরু করবেন এনারা। বা হয়ত মিথ্যা ছড়িয়েই “ব্যাদেই-সব” দাবিওয়ালারা ভাবছেন তাঁদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়ে যাবে। জায়গা মতো দুচারটে প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থের নাম দিয়ে রাখলে কজন আর খেটেখুটে এতগুলো মিথ্যা ভেদ করতে সক্ষম হবে!

কিংবা এও হতে পারে, আমাদের মতো নাস্তিক অবিশ্বাসী পশ্চিমা বিজ্ঞান পন্থীদের চোখে সূর্য-সিদ্ধান্তে এসব বাক্যবন্ধ থাকলেও ধরা দেয় না। তাই পাঠকদের কাছে অনুরোধ করব, আপনারা কেউ উক্ত গ্রন্থে অনুরূপ বাক্য খুঁজে পেলে আমাকে সঠিক সূত্রটা দিন। ঋদ্ধ হই।

আচ্ছা, এবার অন্য একটা প্রশ্ন করা যাক: সূর্য-সিদ্ধান্ত কার রচনা? কবে রচিত?

এরকম প্রশ্ন করলে আপনি কিন্তু অন্য এক ঝামেলার দিকে পা বাড়িয়ে দেবেন।

উপরে প্রদত্ত মহাকর্ষ উদ্ধৃতির লেখক বলেছেন এটা ভাস্করাচার্যের রচনা এবং ৪০০-৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো সময় লেখা। এদিকে আপনি যদি আন্তর্জালে ভাস্করাচার্যের সম্পর্কে খোঁজ লাগান, দেখবেন, তিনি ১১১৪ – ৮৫ সময়কালের, মানে, দ্বাদশ শতাব্দের মানুষ।

তাহলে দুটো জিনিস নিশ্চয়ই এক সঙ্গে হতে পারে না। দ্বাদশ শতকের একজন বিজ্ঞানী পঞ্চম শতকে বসে একটা বই লিখতে পারেন না। হয় বইটা ভাস্করাচার্যের রচিত নয়, অন্যথায় বইটি পঞ্চম শতকে লেখা হয়নি। “ব্যাদেই-সব” দাবিওয়ালারা অবশ্য এই জাতীয় স্ববিরোধ নিয়ে মাথা ঘামান না। কেন না, এতে মাথা দিলে তাঁদের ৯৬.৫৭ শতাংশ দাবিই ছেড়ে দিতে হবে।

খানিক ভড়কে গেলেও আপনি হয়ত কাশ্যপ সদৃশ ধৈর্য নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে চান।

তখন আপনি একাধিক গ্রন্থকারের নাম এবং রচনার সময়কাল পাবেন আন্তর্জালিকার সূত্রালয়ে। সেই তালিকায় আছেন একেবারে প্রথমে আর্যভাট এবং তাঁর এক শিষ্য লাটদেব (৫ম শতাব্দ), তার পরে বরাহমিহির (৬ষ্ঠ শতাব্দ), ব্রহ্মগুপ্ত (৭ম শতাব্দ) এবং অবশেষে ভাস্করাচার্য (দ্বাদশ শতক), এবম্বিধ।

প্রবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত দেখিয়েছেন, সূর্য-সিদ্ধান্তের প্রদত্ত যুগের হিসাব ধরলে এর রচনার বয়স হওয়া উচিত খ্রিঃ পূঃ ২১৬৩১০২ সাল। [Prabodh Chandra Sengupta, “Introduction”; Sûrya-Siddhânta; Calcutta University Press, Calcutta; 1935, pp. viii-ix.] যস্যার্থ, আজ থেকে অন্তত একুশ লক্ষ পয়ষট্টি হাজার বছর আগে। বিজ্ঞানের মতে ধরলে পৃথিবীর বুকে মানুষ (হোমো স্যাপিয়েন্স) উদ্ভবেরও প্রায় উনিশ লক্ষ বছর আগে। স্বভাবতই একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক হিসাবে সেনগুপ্ত এটা গ্রহণ করতে রাজি হননি। “ব্যাদেই-সব” দাবিওয়ালারাও বোধ হয় আজকাল আর এই হিসাব দাখিলে রাজি হবেন না। তবে তাঁরা প্রবোধবাবুর মতো কি স্বীকার করবেন যে এরকম অনেক আজগুবি জিনিস প্রাচীন শাস্ত্রগুলিতে আছে—যেখানে ওনারা নিউটন আইনস্টাইনের কাজগুলিকে বসাতে চান? মনে হয় না।

বাস্তব সম্ভাবনা হচ্ছে, সূর্য-সিদ্ধান্ত পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতকের কোনো সময় প্রথম লিখিত হয় আর্যভাট এবং/অথবা বরাহমিহিরের হাত ধরে। আল-বেরুনির মত অনুযায়ী, লাটদেবেরও তাতে ভূমিকা থাকতে পারে। তারপর এটা জ্যোতিষ গ্রন্থ হিসাবে অনেকের হাতেই সম্প্রসারিত হয়েছে। ৯৬৬ সালে ভট্টোৎপলের রচনায় এই বিষয়ে উল্লেখ পাওয়া যায়। বার্গেসের মতে এটা ৪৯০ থেকে ১০৯১ সাল পর্যন্ত নানা হাতে সম্প্রসারিত হয়ে এসেছে। সেনগুপ্ত মনে করেন, ১৬০৩ সালে রচিত রঙ্গনাথের টীকা গ্রন্থের পরে এর আর কোনো সম্পাদনা বা বৃদ্ধি ঘটেনি। [Ibid, p. ix] 

মেনে নেওয়া ভালো যে সূর্য-সিদ্ধান্তের যে প্রতিলিপি আমাদের হাতে এসেছে, তাতে পৃথিবীর আকর্ষণের কথা না থাকলেও সূর্য এবং চন্দ্র এই দুই “গ্রহ”-এর আকর্ষণের কথা আছে। যদিও তাতে কোনো বলের কথা নেই। সেটাই আপাতত খানিক উদ্ধার করা যাক। আমি অবশ্য এই সমস্ত উদ্ধৃতির সময় বার্গেসের বদলে বাপুদেব শাস্ত্রীর অনুবাদই এখানে তুলে আনব, যাতে পাঠকদের কারও মনে না হয়, বা গেরুয়া ভক্তরা বলতে না পারেন, যে বিদেশি বলে বুঝতে না পেরে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে সংস্কৃত মূল পাঠ অনুবাদে বিকৃত করা হয়েছে। মজার কথা হল, সেখানে প্রথমে বলা আছে, গ্রহগুলি যে ঘুরে বেড়ায় তার কারণ হচ্ছে হাওয়ার প্রবাহ এবং তার টান। [Surya Siddhanta, 2/1-4; translated by Sastri] তার পর সূর্য-সিদ্ধান্তের গ্রন্থকার জানিয়েছেন, “The attraction of the Sun (by its apogee) is very small by reason of the bulkiness of its body, but that of the Moon is greater than that of the Sun, on account of the smallness of the Moon’s body.” [Ibid, 2/9] স্বাভাবিক। হাওয়ার পক্ষে ভারি জিনিসকে টেনে চলা তো সত্যিই কঠিন। সূর্যসিদ্ধান্ত ভুল কিছু বলেনি। যদি অবশ্য গ্রহগতির পেছনে বায়ুপ্রবাহের কোনো সদর্থক ভূমিকা থেকে থাকে। চাঁদ বা সূর্যকে, মঙ্গল বা শনিকে পৃথিবীর বায়ু প্রবাহ ঠেলে নিয়ে ঘোরাচ্ছে—এমনটা যদি বাস্তব হয়। 

এই সত্য বিবরণের মধ্যে নিউটন পাচ্ছেন নাকি কেউ?

নিউটনের মহাকর্ষের ফরমুলাটা এমন যে সেখানে আকর্ষণ বল ভরের সমানুপাতিক। বস্তু বড় আর ভারি হলে আকর্ষণ বল বেশি হবে, ছোট আর হালকা হলে কম হবে। আর পবন দেবের সেখানে কোনো দায়দায়িত্ব নেই। যদি ধরে নিই, সূর্য- সিদ্ধান্তই ঠিক বলেছে, তাহলে নিউটনের তত্ত্বটাকে ভুলই বলতে হবে। কিন্তু সূর্য-সিদ্ধান্ত যা বলেছে, নিউটন সেটাই পরে টুকে নিয়ে বলেছেন—এরকম দাবি করা মানে হল সূর্য-সিদ্ধান্তের গ্রন্থকারকে(দের) অসম্মান করা। 

তথাপি বলি, সূর্য-সিদ্ধান্তের সিদ্ধান্ত সকল আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে না মিললেও এই যে একটা লম্বা সময় বরাবর আর্যভাট থেকে শুরু করে ভাস্করাচার্য পর্যন্ত অনেকে মিলে গ্রহ নক্ষত্রকে বোঝার চেষ্টা করেছেন, এটাই একটা বড় ঘটনা। ১৮৬0 সালে যিনি প্রথম সূর্য-সিদ্ধান্ত ইংরেজিতে সটীক অনুবাদ করেন, রেভারেন্ড ই বার্গেস, এবং American Oriental Society-র পত্রিকায় প্রকাশ করেন, তিনি কী বিপুল পরিশ্রম করেছিলেন, বইটির পাতায় পাতায় তার সাক্ষ্য বিধৃত আছে। এই সব না দেখে না জেনেই এক দল চরম অকৃতজ্ঞতা বশত বলতে থাকেন, বিদেশিরা নাকি আমাদের দেশের দেশজ বিদ্যাবুদ্ধিকে পাত্তা দেননি। সেই অনুবাদই পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৫ সালে পুস্তকাকারে বের করেছিল।

বার্গেস তুলনা করে দেখিয়েছেন, চাঁদ পৃথিবী এবং সূর্যের আনুপাতিক ব্যাস মাপনে তলেমির হিসাবের সঙ্গে সূর্যসিদ্ধান্তের হিসাবে পার্থক্য খুব বেশি নয়। চাঁদ এবং পৃথিবী ধরলে আধুনিক মাপনের সঙ্গেও তফাত সামান্য।

কিন্তু, সূর্যের ব্যাস ধরলে আধুনিক মাপনের সঙ্গে তলেমি এবং সূর্যসিদ্ধান্তের হিসাব পুরোদস্তুর ওলটপালট হয়ে যাবে। নীচের ছবিতে একটা তুলনামূলক হিসাব দেখানো হল। [Surya-Siddhanta 1935, (Note by Burgess) 145]

তবে মনে রাখতে হবে, বার্গেস সূর্যের ব্যাসের আনুপাতিক যে সমকালীন হিসাব দিয়েছিলেন, সেটা এখনকার মতে সামান্য বেশি। সূর্যের ব্যাস আধুনিক হিসাবে পৃথিবীর ব্যাসের তুলনায় প্রায় ১০৯ গুণ, আর বার্গেসের হিসাবে ছিল ১১২ গুণের চাইতে একটু বেশি। এইটকু ভুল দেখে ভয় পাওয়ার বা চমকে ওঠার কিছু নেই। বিজ্ঞানের এটাই দস্তুর। ভুল হবে আর তাকে শুধরে নেওয়া হবে। সব কিছুই সবাই আগেভাগেই একেবারে সঠিক বলে যাবেন—এটা বিজ্ঞানে কখনই মনে করা হয় না। অনেক কঠিন মূল্য দিয়ে পশ্চিমের জ্ঞানীরা লোকেরা এটা শিখেছেন। আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া দেশের লোকের পক্ষে এই শিক্ষা লাভে বোধ হয় আরও সময় লাগবে।

 [৫]

পরিশেষে অনেক দিনের বহুব্যাপ্ত একটি অজ্ঞতার নিরসন করতে চাই। আমাদের দেশে অনেকেই মনে করেন, ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিবর্গ, যুক্তিবাদী শিবির, বামপন্থী দল বা মার্ক্সবাদী মহল জ্ঞান বিজ্ঞানের জগতে প্রাচীন ভারতের কী কী অবদান ছিল, তার কোনো খোঁজখবর রাখেন না। রাখতে চানও না। বরং একটু তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। ফলত, যুক্তিমনস্করা “ব্যাদেই-সব” জাতীয় আলোচনার প্রসঙ্গ তুললেই এই জাতীয় লোকেরা “প্রাচীন শাস্ত্রগুলিতে কী ছিল জানা দরকার” গোছের যুক্তি মন্তব্য বা টিপ্পনী করে থাকেন। তাঁদের কথা শুনলে মনে হবে যেন, এপর্যন্ত কেউ সেই সব প্রাচীন শাস্ত্র উল্টেপাল্টেও দেখেননি, কোথায় মূল্যবান জ্ঞানের হিরেমাণিক কী আছে; এই প্রথম বাজপেয়ী-মোদীদের রাজত্বেই এগুলো নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। বাস্তব ঘটনা ঠিক উলটো। তাঁরা অনেকেই বরং ভুলে থাকেন, প্রথমত ভারতে ব্রাহ্মণ্য শাসন বজায় থাকলে আম জনতার কাছে এই সব জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার খবর কোনো দিনই পৌঁছত না। মুষ্টিমেয়র মধ্যে কুক্ষিগত হয়ে থাকত। ইংরেজ আমলে ব্রাহ্মণ্য দাপট খানিক দুর্বল হওয়ার ফলে এবং হাতে লেখা পুঁথির বদলে পুস্তক মুদ্রণ চালু হওয়ার কারণে ধীরে ধীরে অনেক তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। গেরুয়াপন্থীরাও যে এখন বেদ উপনিষদ শূল্বসূত্র সূর্য-সিদ্ধান্ত চরক শুশ্রুত সম্পর্কে দুচার কথা (মিথ্যা হলেও) বলতে পারেন, সে এই যুক্তিবাদী উদারমনস্ক বিদ্বানদেরই সুদীর্ঘ প্রয়াসের ফলে। [এই প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য: অশোক মুখোপাধ্যায়, “প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: তথ্যভিত্তিক পর্যালোচনা”; অনীক, বইমেলা সংখ্যা, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, ২০১৮] সেই উনিশ শতক থেকে শুরু করে দীর্ঘদন ধরে বিজ্ঞানমনস্ক দেশি বিদেশি এক দল জ্ঞানতাপসই প্রাচীন ভারতের জ্ঞান সম্পদ উদ্ধার করে চলেছেন। বিজ্ঞানের গবেষণার ধরনটাই এই যে কোনো বিষয়ে কোথায় কত দূর অবধি কাজ হয়েছে আগে দেখে নেওয়া। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে হাতে লেখা পুঁথি উদ্ধার, আসল নকল যাচাই, সম্পাদনা, প্রয়োজনীয় টীকা সংযোজন, মুদ্রণ ও নবতর সংস্করণ—ইত্যাদি কাজ তাঁরাই অত্যন্ত ধৈর্য ও শ্রদ্ধার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন। মোদী কোম্পানির লোকেরা একটাই কাজ করে চলেছেন—কোনো পরিশ্রম বা পড়াশুনা না করে শুধু মাত্র শিরোনামগুলি ব্যবহার করে যত্রতত্র এই সব বইপত্র থেকে আজগুবি অতিকথনের আকারে নানা রকম দাবি পেশ করতে থাকা।

নীচে আমি এরকম সামান্য কিছু বইপত্রের উল্লেখ করছি, যাতে বোঝা যায়, এই কাজ কত কাল আগে থেকে কীভাবে ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে:   

1. Ebenezer Burgess (1860), Sûrya-Siddhânta; American Oriental Society, 1860. Reprinted, Calcutta University Press, Calcutta; 1935, pp. viii-ix.

2. Surya Siddhanta and Siddhanta Siromani (1861), translated respectively by Bapu Dev Sastri and Lancelot Wilkinson; Baptist Mission Press.

3. G. Thibaut (1875), “On the Sulvasutras”, Journal of Asiatic Society of Bengal, Vol. 44.  

4. W. Brennard (1896), Hindu Astronomy; Straker & Sons, London.

5. V. A. Smith (1897), “The Iron Pillar of Delhi”, Journal of Royal Asiatic Society, London.

6. P. C. Ray (1902-09), History of Hindu Chemistry, Vols. I-II; Calcutta.

7. A. R. Rudolf Hoernle (1907), Studies in the Medicine of Ancient India, Parts I-II; Oxford University Press.

8. D. E. Smith and L. C. Karpinsky (1911), The Hindu Arabic Numerals; Boston and London.

9. Girindra Nath Mukhopadhyay (1913), History of Indian Medicine, Vols. I-III; Calcutta.

10.   Girindra Nath Mukhopadhyay (1913), The Surgical Instruments of the Hindus, Vols. I-III; Calcutta University.

11.   G. R. Kaye (1915), Indian Mathematics; Calcutta and Simla.

12.   Brajendra Nath Seal (1915), The Positive Sciences of the Ancient Hindus; Longman, Green and Co., London.

13.   Panchanan Neogi (1918), Copper in Ancient India; Indian Association for the Cultivation of Science, Calcutta.

14.   Benoy Kumar Sarkar (1918), Hindu Achievements in Exact Sciences; London.

15.   A. B. Keith (1921), Indian Logic and Atomism—an Exposition of the Nyaya Vaiceshika Systems; Oxford.

16.   E. R. Bevan (1922), “India in Early Greek and Latin Literature”, The Cambridge History of India, Vol. I.

17.   W. E. Clark (1930), The Arbhatiya of Aryabhata; Chicago.

18.   B. Datta (1932), The Science of Sulba—a Study in Early Hindu Mathematics; Calcutta University.

19.   Ekendra Nath Ghosh (1932), “Studies in Rig-Vedic Deities—Astronomical and Meteorological”, Journal of the Asiatic Society of Bengal.

20.   A. S. Altekar (1934), Education in Ancient India; Benaras.

21.   G. R. Hunter (1934), The Script of Harappa and Mohenjodaro and its connection with other scripts; London.

22.   P. K. Acharya (1935), “University Life in Ancient India”, Science and Culture, December 1935.

23.   B. Datta & A. N. Singha (1935), History of Hindu Mathematics, Vols. I-II; Lahore.

24.   W. E. Clark (1937), “Science”; in G. T. Garrat (ed. 1937), The Legacy of India; Oxford University Press, London.

25.   M. S. Randhawa (1946), “Role of Domesticated Animals in Indian History”, Science and Culture, Vol. 12 No. 1.

26.   H. R. Zimmer (1948), Hindu Medicine; Baltimore.

27.   Stuart Piggot (1950), Prehistoric India; Penguin.

28.   R. C. Majumdar (1950), “Scientific Achievements of Ancient Hindus: Chronological and sociological background”, Paper Read at Symposium on History of Science in South Asia, New Delhi.

29.   K. S. Shukla (1950), “Chronology of Hindu Achievements in Astronomy”, Paper Read at Symposium on History of Science in South Asia, New Delhi.

30.   Radha Kumud Mookerji (1951), Ancient Indian Education; MacMillan. 

31.   M. S. Krishnan (1955), Iron ores of India; Indian Association for the Cultivation of Science, Calcutta.

32.   Daniel Uranovic (n. d.), “Indian Prelude to European Mathematics”, Osiris, Vol. I.   

আশা করা যাক, এই সব তথ্য জানার পর আমাদের ভাবনাচিন্তায় সামান্য হলেও পরিবর্তন আসবে। প্রাচীন কালের অর্জিত জ্ঞানকে আমরা আধুনিক কালের অধীত জ্ঞানের সমতুল্য বলেও যেমন মনে করব না, কোনো অতিকথন তার উপরে চাপিয়ে দেব না, জ্ঞানের জগতে অগ্রগতিকে আমরা স্বীকার করে নেব, পাশাপাশি, অতীতেও যে আমাদের দেশে বহু মানুষ বহু বিষয়ে জানার চেষ্টা করে গেছেন, সেই প্রয়াসকেও সম্মান জানাব। আবার আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতি যে পথ ধরে সম্ভব হয়েছে, তাকেও সঠিক ভাবে বুঝে নেবার চেষ্টায় ব্রতী হব। ☼π☼

Ashoke Mukhopadhyay
+ posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *