আমাদের ঈশ্বর অক্ষয়—দ্বিশতবার্ষিক স্মরণালেখ্য


অশোক মুখোপাধ্যায়:


আজও কান পেতে রই

আসুন, সেই দুজন মানুষের কথা বলি, যাঁরা কম বেশি সমচিন্তার ভিত্তিতে উনিশ শতকের প্রায় পুরো দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে বাঙালির মনন জগতের যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক ইমারতটি গড়ে তুলেছেন এবং বাংলাদেশের সাস্কৃতিক চলনে এক অপ্রতিরোধ্য গতিবেগ সঞ্চার করেছেন। আমাদের ভাষায়, গদ্যে, ছন্দে, অলঙ্কারে, সমাসে, অনুপ্রাসে তাঁরা উপস্থিত। আমাদের চিন্তার বুননে, মননের বয়ানে, যুক্তির উচ্চারণে, সংস্কার বিতাড়নে, তাঁরা ক্রিয়াশীল। আমাদের আবেগ, মর্যাদাবোধ, চরিত্র, মেরুদণ্ড, দৃঢ়তা, নৈতিকতা, সংকল্প—যতটুকু গড়ে উঠেছে এবং আমরা ধারণ করতে পেরেছি, সেখানেও এই দুই রথীর অবদান। তাঁদের জন্মদ্বিশতবার্ষিকী তাই এমন এক উপলক্ষ যেখানে আমরা তাঁদের গুণাবলি আরও বেশি করে আত্মস্থ করার জন্য এক সংগঠিত সামূহিক অনুশীলনে যুক্ত হতে পারি। এই স্মরণ প্রবন্ধ তারই বিনীত নিবেদন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১) এবং অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-৮৬) একই কালে একই জীবনদর্শন ধারণ করেছেন এবং সমাজের দুই ক্ষেত্রে তাকে বাস্তবায়িত করে তুলেছেন। ইউরোপীয় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রাক্কালে রেনেশাঁস আন্দোলনের তিনশ বছরের ইতিহাস থেকে দুজনেই তার রণ-শাঁসটুকু আত্মসাৎ করেছেন এবং সমকালে বাংলায় তাকে প্রয়োগ করতে উদ্যোগী হয়েছেন। মানবতাবাদ, যুক্তিবাদিতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক মনোবৃত্তি, শ্রমের মর্যাদাবোধ, আধুনিক শিক্ষা, ইত্যাদির প্রতি তাঁদের ছিল এক দুর্নিবার দায়বদ্ধতা। পক্ষান্তরে, ঐতিহ্য বর্জন, পরজীবিত্বে ঘৃণা, জমিদারিত্বে বিকর্ষণ, শ্বেতপ্রভুভক্তিতে অপারগতা, ধর্ম কুসংস্কার জাতপাত লোকাচারে বীতস্পৃহা—এই সব ছিল দুজনেরই চরিত্র নির্ণায়ক উপাদান। যুক্তি বুদ্ধি জ্ঞান হাতিয়ার করে বিদ্যাসাগর কাজ করেছেন শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কর্মকাণ্ডে, আর সেই সমাজ মানসেরই উন্নতি বিধানে অক্ষয়কুমার দত্ত জীবন পাত করেছেন জ্ঞান সংগ্রহ ও বিতরণ কাণ্ডে। দুজনের সেই কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড থেকে শিক্ষা নেবার অফুরন্ত অবকাশ রয়ে গেছে।

কেননা, সময়ের অঙ্কে আমরা বিদ্যাসাগর এবং দত্তর যুগ থেকে শতাধিক বছর পেরিয়ে এলেও, এবং দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রগুলিতে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন হয়ে গেলেও, তাঁদের আরদ্ধ কাজগুলো আজও পূরিত হয়নি। সেই সব অ্যাজেন্ডা যা নিয়ে তাঁরা কাজ শুরু করেছিলেন, অনেক দূর অবধি এগিয়েওছিলেন, আজও আমাদের সমাজের বুকে অসমাপ্ত রয়ে গেছে। মানবাধিকার বিকশিত হওয়া তো দূর, যেটুকু নবজাগরণ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাও আজ ক্রমাগত অপহৃত হয়ে চলেছে। কবি শিল্পী বিজ্ঞানী অধ্যাপক শুধু মাত্র রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন বলে, পথে নেমেছেন বলে, বিনা বিচারে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হচ্ছেন। সাধারণ প্রতিবাদী মানুষের কথা তো দূরের কথা। ধর্ম জাতপাত কুসংস্কারকে কেন্দ্র করে উন্মাদনা, সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। সারা দেশ জুড়ে আসিফা আর প্রিয়াঙ্কাদের মতো একের পর এক বীভৎস নারী নির্যাতনের ঘটনা বিদ্যাসাগরের স্বপ্ন, অক্ষয় দত্তের যুক্তিকে আজ ধূলায় লুটিয়ে দিয়েছে।

যে সামাজিক সমস্যাগুলি নিয়ে বিদ্যাসাগর লড়াই শুরু করেছিলেন, বাল্যবিবাহ রোধ, বহুবিবাহ নিবারণ, বিধবাবিবাহ প্রবর্তন—তার সবই প্রায় আজকের সমাজে আরও বৃহত্তর ও জ্বলন্ত অভিপাদ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। বিধবা বিবাহের মুদ্দাটিকে বাদ দিলে বাকি দুটো সমস্যা শুধু হিন্দু সমাজ নয়, আজ মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেও ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের দাবি নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। সাধারণ ভাবে বলা যায়, সামন্ততান্ত্রিক সমাজের পুরুষতান্ত্রিক বিধিনিষেধের কঠোর নিগড় থেকে নারীমুক্তি এবং নারী পুরুষের সমানধিকার ও সম মর্যাদার যে দাবিকে উনিশ শতকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয়কুমার দত্ত নানা ভাবে নানা মাত্রায় উত্থাপন ও প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন আজ তার যৌক্তিকতা আরও বেশি করে সমাজ মননে ধাক্কা দিচ্ছে। সেই অর্থে বিদ্যাসাগরের আন্দোলন এবং অক্ষয় দত্তের বৌদ্ধিক আবেদনের যুক্তিগ্রাহ্যতা ও ন্যায্যতার ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারিত হয়েছে বলা যায়।

যে বিজ্ঞান শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির বিকাশের জন্য অক্ষয়কুমার দত্ত এক নিত্য সঙ্গী শিরঃপীড়াকে শিরোধার্য করে এত যুক্তি তর্ক তথ্য দিয়ে লিখলেন, সেদিনের তুলনায় আমাদের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষার যতই পাইকারি ও খুচরো কারবার বেড়ে গিয়ে থাকুক না কেন, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রশ্নে আমরা খুব দ্রুত নিজেদের খ্রিস্টপূর্ব অবস্থানে নিয়ে যেতে ব্যগ্র হয়ে পড়েছি। এক গরুর মলমূত্রই এখন সারা ভারতবর্ষের এক বিরাট অংশের মানুষের ধ্যান জ্ঞান হয়ে বসে আছে। বিজ্ঞানের বই বা পত্রিকায় নয়, শিক্ষিত এমনকি একদল বিজ্ঞানীও আজকাল আধুনিক বিজ্ঞানের খবর খুঁজে বেড়াচ্ছেন রামায়ণ মহাভারতে, ঋগবেদে, ভাগবত পুরাণে। জ্যোতিষার্ণবদের ঘোষিত যে গ্রহনক্ষত্রের দ্বারা মানব জন্ম মৃত্যু বিপদাপদ নিয়ন্ত্রণের কথা শুনে অক্ষয় দত্ত এক কালে প্রাণ খুলে হেসেছিলেন এবং অন্যদের হাস্যাস্পদ হওয়া থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন, আজ কেন্দ্রীয় সরকার ইউজিসি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিজ্ঞান সংস্থা সেই হাসির খোরাককে সারা বিশ্বে সম্প্রসারিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। যে শাস্ত্র আজ অবধি সূর্য এবং চাঁদের পরিচয় ঠিক ভাবে জানতে পারেনি, পৃথিবী সম্পর্কে কিছুই বলতে পারেনি, সেই আবার আমাদের জীবনের ভবিষ্যত নাকি বাতলে দেবে বলে দুবেলা ডজন ডজন এসএমএস পাঠাচ্ছে আমাদের মোবাইলে। অক্ষয় দত্তের যুগ থেকে আমরা শুধু সাধু ভাষার বদলে কথ্য ভাষায় লেখাপড়াকে স্থানান্তরিত করতে পেরেছি, মগজ কোষে জ্ঞান বা বোধের প্রশ্নে এক দানাও কি এগোতে পারলাম?

মূর্তি-ভাবমূর্তি ভাঙার গল্প

পঞ্চাশ বছর আগে (১৯৭০) বিদ্যাসাগরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীতে এক স্মারক সঙ্কলনের ভূমিকায় সম্পাদক গোলাম মুরশিদ লিখেছিলেন: “বিদ্যাসাগরের সার্ধ-শততম জন্মবার্ষিকী এবার বাঙালীরা দুভাবে উদযাপন করলো। এক দল বিদ্যাসাগরের প্রস্তর মূর্তি বিচূর্ণ করে; অন্য দল আরো নির্দয়ভাবে—পরিপূর্ণ ঔদাসীন্য প্রদর্শন করে।” [গোলাম মুরশিদ (সং ১৯৭০), “ভূমিকা”, বিদ্যাসাগর; বিদ্যোদয় লাইব্রেরী, কলকাতা।] তাঁর সেই কথাটাকে আজ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্তকে মিলিয়ে একটু অন্য রকম আঙ্গিকে সমার্থক ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। পশ্চিম বাংলার মাটিতে বাংলার এই দুই বিরল মাপের প্রতিভাবান সন্তানকে তাঁদের জন্মদ্বিশতবর্ষে আমরা শ্রদ্ধা জানাচ্ছি দুই ভাবে: বিদ্যাসাগরের চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের খুঁত বের করে করে; আর অক্ষয়কুমার দত্তকে নিঃশব্দ উপেক্ষায়!

কোনো মানুষই নিখুঁত নন, বিদ্যাসাগর বা অক্ষয়কুমার দত্তও নন! তাই এই দুই চরিত্রে ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা খুঁজে পেলে এবং মননশীল চর্চায় তা উল্লেখ করলে আমাদের মতো যুক্তিবাদী ও সামাজিক ঐতিহাসিক চেতনার বাহকদের তরফে আপত্তির কোনো প্রশ্ন ওঠে না। বরং সেই আলোচনায় আমাদের উৎসাহ থাকাই স্বাভাবিক, কেননা, আমাদের তাতে ঋদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা ও সুযোগ থেকে।

কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের উত্তরে সমালোচিত আসামী আত্মপক্ষে কিছু বলতে আসতে পারছেন না। ফলে আমাদের এখানে দায়িত্ব অনেক। সমালোচককেই সমালোচিতের সম্ভাব্য আত্মপক্ষ বয়ান তৈরি করে নিতে হবে। সেই বয়ান সাপেক্ষেই সমালোচনাকে দাঁড় করাতে হবে। তাছাড়া, ত্রুটি সন্ধানের ক্ষেত্রে আরও দুটি কথা মনে রাখা উচিত: এক, সেই ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা সমকালে আলোচিত ব্যক্তির ঘোষিত বক্তব্য ও কৃত কর্মকাণ্ডের বিরোধী ছিল কিনা এবং কতটা। দুই, তৎকালিক সমাজের অগ্রগতির ক্ষেত্রে তা কতটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল। আমাদের ভাবনাচিন্তার বর্তমান পর্যায়টা আমরা দেড় শতক আগেকার মানুষদের কাছে প্রত্যাশা করতে পারি না।

এর বাইরে থেকে ত্রুটি ধরার যে কোনও প্রবণতার একটা খারাপ দিক আছে। আমার রাজনৈতিক সামাজিক ধ্যান ধারণার সঙ্গে মিলছে না, অতএব বিদ্যাসাগরকে নামিয়ে দিতে হবে—এরকম মনোভাব। বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে এই মনোভাবের পরিচয় আমরা একাধিক সমালোচনায় পেয়েছি। উনিশশ’ সত্তরের দশক থেকে শুরু করে আজ অবধি লাইন দিয়ে এই বিশ্লেষকদের হাতে উপস্থাপিত তথ্য একের পর এক বিকৃত হয়ে যাচ্ছে, সাল তারিখের পর্যন্ত গরমিল ঘটে যাচ্ছে। মধ্যপ্রদেশ বা রাজস্থানের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে যে মুক্তচিন্তার খানিকটা হলেও এখনও একটা পরিসর আছে, তার পেছনে এই দুই দ্বিশতবর্ষ অতিক্রান্ত মনীষীর যে ভূমিকা রয়েছে তা বুঝতে হলে আমাদের একটু তথাকথিত গোবলয়ে ঘুরে আসতে হবে। দুজনে মিলে সেদিন তাঁরা ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রীয় ভাববাদী অচলায়তনে যে বেশ কয়েকটি ধাক্কা দিয়েছিলেন, তার ফলেই বৈদিক পৌরাণিক শাস্ত্রীয় অজ্ঞতা অন্ধতার দেওয়ালগুলো নানা জায়গায় খসে পড়েছিল। নতুন চেতনা, যুক্তিবাদ মাথা তুলেছিল।

এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যাচ্ছে, উনিশ শতকের প্রগতির আন্দোলনের মূল স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে সেকালে বঙ্কিমচন্দ্রকেও বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে নিন্দা সমালোচনার অনুচিত ও অশোভন কাঁচা রাস্তায় নামতে হয়েছিল। বেশির ভাগ বাঙালি লেখক ও পাঠক বিদ্যাসাগর নিন্দায় বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ উপন্যাসের একটি সংলাপই জানেন এবং ব্যবহার করে থাকেন। তাঁরা অনেকে জানেনই না, বঙ্কিমচন্দ্র আরও বড় আক্রমণ নামিয়েছিলেন তাঁর স্বল্প পরিচিত একটি গুরুভার ইংরেজি রচনায়। বিদ্যাসাগরের মনন ঐশ্বর্যকেই ধূলায় নামিয়ে দেবার আয়োজন করে তিনি বলেছিলেন:

“If successful translations from other languages constitute any claim to a high place as an author, we admit them in Vidyasagar’s case; and if the compilation of very good primers for infants can in any way strengthen his claim, his claim is strong. But we deny that either translating or primer-making evinces a high order of a genius; and beyond translating and primer-making Vidyasagar has done nothing. His brief discourse on Sanskrit literature deserves, and his widow marriage pamphlets claim, no notice here.” [বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৬০), “বেঙ্গলি লিটারেচার”, বঙ্কিম রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড, যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত; সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, পৃষ্ঠা ১০৮-১০৯।]

অর্থাৎ, বিদ্যাসাগরের বুদ্ধি সম্পদ মানে হচ্ছে অনুবাদ, শিশুপাঠ্য আর প্রচার পুস্তিকা। সে আর এমন কী! আবার, অনুবাদকর্মে কিছু গুণ দেখেও তার গুরুত্ব নাকচ করে দেন তিনি: “The scenes are well chosen, and the expulsion of the supernatural element gives them a more realistic tone, but Vidyasagar is not free from the tautology and bombast which always disfigure the writers of the school to which he belongs.” [ঐ]

সেদিনের প্রগতি প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্বে যখন রক্ষণশীলতার এক প্রধান মুখ বিদ্যাসাগরকে এতটা নিন্দা করতে এবং নামিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তখন আমরা যাঁরা আজকের দিনের প্রগতির পতাকা হাতে তুলে নিয়েছি, তাদের এই বিরোধিতার স্বরূপ বুঝে নিতে হবে। ভাবতে হবে, বিদ্যাসাগরের সমালোচনায় মুখর হতে গিয়ে আমরা সেই অনুদার শাস্ত্রপন্থী বঙ্কিমি ভাষ্যকেই গ্রাহ্য করে ফেলছি না তো!

উনিশশ’ সত্তর পর্বের বাংলায় সুতীব্র বিদ্যাসাগর বিরোধিতার মধ্যে ছিল এক বিশেষ রাজনৈতিক সুর। ইউরোপীয় রেনেশাঁসের “মডেল”-এ এই দেশেও কৃষক বিদ্রোহ আর শিল্প বিপ্লব খোঁজার আকুলতা ও তার অপ্রাপ্তির হতাশা থেকে যার জন্ম! তার তীব্রতা অনতিবিলম্বে মিলিয়ে গেলেও প্রতিধ্বনি থেকেই গেছে এবং একজনের পর অন্য জনে মুদ্দান্তরে সমালোচনার রথ টেনে টেনে নিয়ে গেছেন। এদিকে একুশের শতকে এসেছে আর এক ধরনের সমালোচনা, যে ধারা এক উত্তর-আধুনিক উত্তর-ঔপনিবেশিক নির্দেশতন্ত্র থেকে রেনেশাঁস নামক পরিঘটনাকে শুধু বাংলা নয়, সারা পৃথিবীর মানচিত্র থেকেই মুছে দিয়েছে; সেই চিন্তাপথিকরা বিদ্যাসাগর বঙ্কিমচন্দ্র অক্ষয় দত্ত নরেন দত্ত—প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার সকলকেই এক বন্ধনীতে রেখে আধুনিকতা ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনার উন্মেষের চিত্রটিকে এক অদ্ভুত যুক্তিশৈলীতে ব্রিটিশের স্বার্থরক্ষী ও সহায়ক শক্তি হিসাবে চিহ্নিত করে ফেলতে সক্ষম হন। তাঁদের কড়া ইউরোপ বিরোধী চোখে প্রাচীন ও মধ্য যুগের সামন্তী জাতপাত দীর্ণ ভয়ঙ্কর অমানবিক ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতবর্ষ দেশজ শিক্ষা দীক্ষা ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি চর্চার এক বিশাল নালন্দাক্ষেত্র হয়ে প্রতিভাত হতে থাকে। বিদ্যাসাগর অক্ষয় দত্ত প্রমুখ যার নির্দয় সমূল হত্যাকারী! উপনিবেশ আর মেকলের যান্ত্রিক বিরোধিতা করতে গিয়ে নিজেদের অজান্তেই ভারতের সামন্ত অচলায়তনের কোলে আশ্রয় নেবার এক চিত্তাকর্ষক উদাহরণ হয়ে ওঠেন তাঁরা।

দু-চার জন ইংরেজ অফিসারের রিপোর্টের ভিত্তিতে হয়ে ভাবতে পেরেছেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের আগে নাকি ভারতে লক্ষ লক্ষ স্কুল ছিল, স্কুলহীন গ্রাম নাকি ছিলই না, সেখানে নাকি জাতি ধর্ম লিঙ্গ নির্বিশেষে ছাত্ররা পড়তে আসত। রিপোর্টগুলি পড়লেই বোঝা যায়, সেগুলো কোনো উপযুক্ত তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি মেনে তৈরি হয়নি। যে দেশে এমনতর স্কুল-ভাসি সংস্কৃতির অস্তিত্ব সত্যিই থাকবে, জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির অবারিত বিকাশ হয়ে থাকবে, সেই দেশে দলিত শিক্ষয়ত্রী সাবিত্রীবাই ফুলে ইস্কুলে যাওয়ার সময় রাস্তায় “উচ্চ”-বর্ণের লোকেরা তাঁকে লক্ষ্য করে নোংরা কাদাই বা নিক্ষিপ্ত করত কেন, তাঁকে ব্যাগে করে অতিরিক্ত শাড়ি নিয়ে যেতে হত কেন—সেই সরল প্রশ্নটুকুও তাঁরা আর নিজেদেরকে করেন না। সেই লক্ষ লক্ষ পাঠশালায় তাহলে কারা, কাদের, কী, শেখাত? সত্যিই অমন লক্ষ লক্ষ শিক্ষালয় থাকলে এমনটা হতে পারত কি? এরকম প্রশ্নপ্রবণ হতে হলেও বিদ্যাসাগর অক্ষয় দত্তের জীবন কর্ম ও রচনার চর্চা করা দরকার।

যে দেশে আট দশ বছর বয়সের মধ্যেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হত, সতীপ্রথার নামে যে দেশে উচ্চ বর্ণের মধ্যে নির্বিচারে বিধবা নারীহত্যা জায়েজ ছিল, বহুবিবাহের ক্ষেত্রে যে দেশে কোনো সংখ্যাসীমার অস্তিত্ব ছিল না, সেরকম একটি দেশে ছোট ছোট মেয়েরা পাঠশালায় যেত এবং ছেলেদের পাশে বসে এক সঙ্গে লেখাপড়া করত—এটা যাঁরা অ্যাডাম রিপোর্ট পড়ে বিশ্বাস করতে পেরেছেন, তাঁদের পক্ষে বোধ হয় অধুনাতন সঙ্ঘজাত হিন্দু মৌলবাদীদের কোনো প্রচারেই আস্থা রাখতে অসুবিধা হবে না। রামমোহন বিদ্যাসাগর বা অক্ষয় দত্তকে নামানোর জন্য তাঁরা যে কোনো দেশজ গল্পজ “তথ্য” মেনে নিতে পারেন। অক্ষয় দত্তর রচনা সম্পদ এই আধুনিক অন্ধতাকে চ্যালেঞ্জ করতে শেখায়। চেতনার এই অন্ধকার এবং চিন্তার এই বন্ধ্যাত্বকে বিদ্যাসাগরের শিক্ষাপ্রণালীর বেলচা দিয়েই উন্মূলন করা সম্ভব। তাই যাঁরা উনিশ শতকের সত্য মিথ্যা রেনেশাঁস বিশ্লেষণে যাবেন, তাঁরা আগে বিদ্যাসাগর অক্ষয় দত্তের কাছে কিছু প্রাথমিক পাঠ নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তির সাবালকত্ব অর্জন করুন।

অভিযোগ উঠেছে, বিদ্যাসাগর (এবং অবশ্যই অক্ষয় দত্তও) নাকি সাধু বাংলা ভাষায় শিক্ষা ও পঠন চালু করতে গিয়ে আম জনতার স্বাভাবিক কথ্য বাংলাকে নির্বাসিত করেছেন এবং বাংলা ভাষার মধ্যে অ-তৎসম শব্দের প্রবেশাধিকার রুদ্ধ করে দিয়ে গেছেন। তাঁরা এসব সমালোচনা তোলার সময় ভুলে যান, বিদ্যাসাগর থেকে মধুসূদন, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র হয়ে মোহিতলাল মজুমদার সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বা কাজী নজরুল ইসলামের কথ্য-বাকের কলম হাতে তুলে নেবার কালিক পার্থক্য কত দিনের। আর বিদ্যাসাগরী সুসংস্কৃত ভাষা ব্যবহারের সড়কপথ বেয়ে তাঁদের হাত দিয়ে কীভাবে আরবি ফারসি তুর্কি শব্দ অক্লেশে ঢুকে গেল বাংলা কাব্য সাহিত্যের অলিতে গলিতে! তাছাড়া, বিদ্যাসাগরের নিজেরও বেনামে লেখা শ্লেষাত্মক রচনাগুলিতে তো সেকালে প্রচলিত বিপুল সংখ্যক আরবি ফারসি তুর্কি শব্দ সাধু গদ্যের মধ্যেই দিব্যি জায়গা করে নিয়েছে! ফলে যে দরজা তাঁরা দেখছেন বিদ্যাসাগর বন্ধ করে দিয়েছেন, আসলে সেই দরজা তিনিই অন্য পথে হাট করে খুলে দিয়ে গেছেন। শুধু দেখার যন্ত্রপাতিতে রাজনীতিজাত বৈকল্যের কারণে সম্ভবত তাঁরা আর তা দেখে উঠতে পারেননি।

যাঁরা বাংলার রামমোহন-ডিরোজিও-বিদ্যাসাগর-অক্ষয় দত্ত নির্মিত নবজাগরণকে কলকাতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উপজাত ধনসমৃদ্ধ মধ্যবিত্ত পায়রা-বাবুদের বাইরে যেতে দেখেননি, তাঁরা আশ্চর্যজনকভাবে ভুলে যেতে পেরেছেন ঈশ্বরচন্দ্র ও অক্ষয় দত্তের জন্মস্থান। জগদীশ্চন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহার মতো বিজ্ঞানের কৃতি ছাত্র, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নজরুল ইসলাম, রোকেয়া সাখাওয়াতের মতো লেখকরাও দূর মফঃস্বল বা গ্রামাঞ্চল থেকে উঠে এসেছিলেন। কিংবা, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কোনো লেখককে হয়ত তাঁরা নবজাগৃতির ফসল হিসাবে খুঁজে পাননি। তাঁরা চব্বিশ পরগণা, হুগলী, বর্ধমান, মুরশিদাবাদ, মানভুম, মেদিনীপুর, কুচবিহার, যশোর, ঢাকা, ময়মনসিং, চট্টগ্রামের মতো সুদূর প্রান্ত এলাকায় নতুন স্কুল কলেজ স্থাপন, গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা, নাটকের দল গড়ে ওঠা, পত্রপত্রিকা চালু হওয়া, নতুন সংস্কৃতির বিকাশের ঘটনাগুলিকে দেখতেই পান না। মেকলের দেশি-সাহেব বানানোর শিক্ষানীতি চালু হওয়ার তিরিশ বছরের মধ্যেই যে ইংরেজ শাসককে ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট কিংবা ইলবার্ট বিল ইত্যাদি আনতে হয়েছিল, সেই মেকলে-নীতি-উৎপাদিত মানব সম্পদের সৃষ্ট আপদকেই রুখবার জন্য—এও উত্তর-ঔপনিবেশিক বুদ্ধিজীবীদের প্রায় সকলেরই হ্রস্ব-দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। আসলে মেকলেকে সর্বশক্তিমান বানাতে চেয়ে তাঁদের দেশের ইতিহাসকেও ভুলে থাকতে হয়, কিংবা হয়তো চোখ বুজে থাকা শ্রেয় বলে মনে হয়।

আমরা অবাক হয়ে দেখেছি, ইদানীং কালে বিদ্যাসাগরের লেখা ও ছাপানো বইপত্রের দাম নিয়ে একদল অদ্ভুত অদ্ভুত বক্তব্য রাখছেন। সেই সব বইপত্রের দাম নাকি খুব বেশি ছিল, বিদ্যাসাগর নাকি সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ব্যবহার করে জবরদস্তি সেই সব বই গ্রামেগঞ্জের স্কুলে চালু করে নিজের ব্যবসা বাড়াতেন, স্কুল বুক সোসাইটিতে থাকার সুযোগ নিয়ে নিজের বই চালু করে দিতেন আর অন্যদের বই আটকে দিতেন, ইত্যাদি। এই সব নিয়েও আজকাল ভয়ানক রকমের সোৎসাহ গবেষণা হচ্ছে, বাজারি পত্রিকায় মাঝে মধ্যে গুরু গুরু লেখা বেরচ্ছে। অথচ, ১৮৭৫ সালে স্কুল বুক সোসাইটির এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলায় প্রকাশিত মোট পাঠ্য বইয়ের সংখ্যা যেখানে ১৫৪৪, তার মধ্যে বিদ্যাসাগরের বই ক’টা? খুব বেশি হলে উনিশ বা কুড়িটা। তাহলে কাদের এবং ক’খানা বই তিনি আটকে দিলেন? যাঁরা এসব বলছেন, তাঁরা কি বোঝেন, কী প্রসঙ্গে কী বলছেন? তাঁরা বোধ হয় জানেনই না, এরকম অভিযোগ তোলার আগে কী কী তথ্য জেনে নিতে হয়। তবু তাঁরা বলেন, অভিযোগ উত্থাপন করেন। ছাপার অক্ষরে সেগুলি বেরয়। কেননা, আসলে কিছু না জেনেই তাঁরা কে কী বলবেন ঠিক করে ফেলেছেন।

আর বইয়ের দাম সম্পর্কে বলতে চাই, যে সমস্ত বইতে এই বইয়ের দাম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তাদেরও কোনো কোনোটার দাম আজকের বাজার মূল্যের অর্থেও যে যথেষ্ট বেশি, এই সব লেখকরা তা আর মনে রাখতে পারেন না। বই ছাপিয়ে বিনা পয়সায় বা নাম মাত্র মূল্যে বাজারে বিতরণ করতে পারে খ্রিস্টান সংগঠন বা অন্যান্য ধর্মীয় প্রচার সমিতিগুলি। যাদের নানা সূত্রে পয়সার অফুরন্ত অলকনন্দা প্রবহমান! আমরাও আমাদের মুদ্রিত বই বা পত্রিকার দাম খুব একটা যে কম রাখতে পারি না, তার কারণ যাঁরা জানেন এবং বোঝেন, তাঁদের মনে বিদ্যাসাগরের বইয়ের দাম নিয়ে কোনো প্রশ্নই জাগবে বলে আমাদের বিশ্বাস হয় না। সেই সঙ্গে যদি মনে রাখা যায়, ১৮৫৫ সালে প্রথম প্রকাশিত বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের ১৮৯০ সালের মধ্যে ১৫২টি সংস্করণ ছাপা হয়েছিল, এবং দ্বিতীয় ভাগের ১৪০টি, তখন এই সব আজগুবি অভিযোগের একটাই মানে দাঁড়ায়। লেখক হিসাবে আমাদের পাঠক স্বল্পতার জন্য আমরা বিদ্যাসাগরের উপর মিথ্যা দোষারোপ দিয়ে প্রতিশোধ তুলি। আর সান্ত্বনা খুঁজি।

তা না হলে, উপরের বিভিন্ন তথ্য থেকে এটা সহজেই বোঝা যেত, নিজে বই লিখে এবং নিজের ও বন্ধুদের বই ছাপিয়ে তিনি সেকালের একজন একচেটিয়া পুস্তক ব্যবসায়ী হতে পারতেন, যার বিরাট ও ক্রমবর্ধমান সম্পদের মালিকানা তাঁর পুত্রকন্যাদের হাতে বর্তাত। কিন্তু হায়! আজ বিদ্যাসাগরের মেয়ের দৌহিত্রী বাজারি পত্রিকায় অভিযোগ করছেন, তাঁর এই খ্যাতনামা পূর্বপুরুষ তাঁদের জন্য টাকাপয়সা সম্পত্তি কিছুই প্রায় রেখে যাননি! অভিযোগকারীদের তথ্যভাণ্ডারের দৌড় এ থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।  

ইতিহাসের ফসল থেকে স্রষ্টা

আসলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয়কুমার দত্ত ঊনবিংশ শতাব্দের নিছক দুজন ব্যক্তি নন, বিচ্ছিন্ন দুটি চরিত্র নন; তাঁদের নিজ নিজ কর্ম ও বিচরণ ক্ষেত্রে তাঁরা উভয়েই তৎকালীন বাংলার অন্তত পঞ্চাশ বছর ধরে চলা শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন এবং প্রগতিশীল বৈজ্ঞানিক চিন্তার অনুশীলনের দুই সুসমৃদ্ধ পরিণতি। যে ভারতবর্ষ কম পক্ষে দুহাজার বছর ধরে কাদামাটির রাস্তায় চলা গরুর গাড়ির চাকার নকশায় কোনো পথ-বান্ধব পরিবর্তন আনতে পারেনি, সেই দেশেই বিদ্যাসাগর অক্ষয় দত্তের আন্দোলনের বিশ-তিরিশ বছরের মাথায় তাঁদের সাগ্রহ অংশ গ্রহণের মাধ্যমে ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের উদ্যোগে এমন একটা দেশজ সম্পদ ও মেধা নির্ভর জাতীয় বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র গড়ে ওঠে, যেখান থেকে পাঁচ দশকের মধ্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মতো গবেষণা সম্ভব হয়।

অবশ্য কঠোর উপনিবেশ বিরোধীরা বলে থাকেন, নোবেল পুরস্কারও আসলে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের দেশজ প্রকৃত বিজ্ঞানের মর্যাদা লুণ্ঠনের একটা নজর ঝলসানো আপাত নিরীহ পন্থা! আসুন, আমরা বরং “দেশের কুকুর ধরি, বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া”! আমাদের সৌভাগ্য যে বিদ্যাসাগর অক্ষয়কুমার এরকম ভাবেননি।

রাজা রামমোহন রায়ের সময় থেকে প্রাচীন পন্থী টোল মাদ্রাসা শিক্ষার বদলে আধুনিক শিক্ষা এবং বিজ্ঞান শিক্ষা প্রবর্তনের সপক্ষে যে জনমত গড়ে উঠতে থাকে, ডিরোজিও মুক্তমন শিক্ষণ পদ্ধতির যে পরীক্ষা ও প্রয়োগ হিন্দু কলেজের ছাত্রদের নিয়ে শুরু করেছিলেন, প্রায় তিন দশকের সেই অভিঘাতেই বিদ্যাসাগর আরও দু পা এগিয়ে তাঁর শিক্ষা সংস্কারের কর্মসূচি রচনা করে ফেলেন। অক্ষয়কুমার দত্তও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার পাতায় পাতায় সেই শিক্ষা সংস্কারের সপক্ষে আরও নানা দিক থেকে যুক্তিতর্ক চালাতে থাকেন।

আর, বিদ্যাসাগরের অন্তত তিরিশ বছর আগে থেকে, রামমোহন ও ডিরোজিওর প্রচার আন্দোলন থেকেই বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহ দূর করার পাশাপাশি হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহের ধর্মীয়, সামাজিক ও আইনি সমস্যা নিয়ে চিন্তার এক আলোড়ন উঠেছিল। তরুণ ডিরোজিও তাঁর “Fakir of Janghira” গাথাকাব্যে কাঁচা হাতে সতীদাহ রোধ এবং বিধবার পুনর্বিবাহ ও সংসার পাতার অপরিণত কিন্তু প্রতিশ্রুতিমান এক গল্প শুনিয়েছিলেন। এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি অধিকাংশ সংশ্লিষ্ট গবেষকদের দৃষ্টির বাইরে থেকে গেছে। তাঁর শিষ্যরা যেভাবে পত্রপত্রিকায় এই সমস্যা নিয়ে, এমনকি পরাশর সংহিতার সেই বিখ্যাত শ্লোক উদ্ধার করে এর শাস্ত্রানুমোদন নিয়ে লেখালেখি করেছিলেন, ঢাকা নবদ্বীপ কলকাতায় প্রায় একশ বছর ধরে জমিদার, পণ্ডিত সমাজ থেকে শুরু করে নব্য যুবকদের তরফে বিধবাদের পুনর্বিবাহের সুযোগ সৃষ্টির দাবিতে যে ঘরোয়া ও প্রকাশ্য সভাসমিতি হচ্ছিল, ঈশ্বরচন্দ্রের বিধবাবিবাহ আইন প্রবর্তন আন্দোলন তারই যুক্তিসম্মত ঐতিহাসিক পরিণাম।

আবার সেই রামমোহনের সমকাল থেকেই আধুনিক গণতান্ত্রিক মানবতাবাদী চিন্তা, নতুন নীতিবোধ, যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতায় সম্পৃক্ত ও সমৃদ্ধ ভাবগম্ভীর মনন যেভাবে ধাপে ধাপে নানা দেশীয় সংবাদপত্রের মাধ্যমে একটু একটু করে বাংলার বোধি সমাজে ক্ষীণকণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল, মাঝখানে বিদ্যাসাগরও (সমকালীন) আধুনিক বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার প্রতি আকর্ষণ তৈরির জন্য সামান্য হলেও অসামান্য কিছু উদ্যোগ নেন, গ্রাম থেকে অক্ষয়কুমার দত্তের কলকাতায় পদার্পণ, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক পদে যোগদান ও ইংরেজি বইপত্র থেকে বিদ্যা আহরণ করে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও দর্শন বিষয়ক বৈচিত্র্যপূর্ণ রচনাপুঞ্জ সৃষ্টির চার দশক ব্যাপী (১৮৪১-৮৩) নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রম ছিল সেই সব খণ্ড খণ্ড প্রয়াসেরই সার্থক সমুন্নত সম্মিলনী। 

তাঁদের সেই কার্যক্রমের ধারায় কাজের প্রয়োজনীয়তা ও অবকাশ বাংলা তথা ভারতের সমাজে আজও পুরোপুরি নিঃশেষিত হয়নি। বিশেষ করে, আজকে যখন ধর্ম জাতপাতের নামে ব্রাহ্মণ্যবাদের সংকীর্ণতা ও হিংস্রতা এক দুর্বৃত্ত-স্বরূপ  রাজনৈতিক শক্তির হাতিয়ার হয়ে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের মুখোশহীন মদতে ভারতবর্ষের মানুষ ও মানসকে আচ্ছন্ন করতে চলেছে, এই পূর্ণগ্রাস বুদ্ধিগ্রহণের কালে আমাদের আবার জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে রাখার জন্য চাই এই দুই ঋজু চরিত্র—ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয়কুমার দত্তকে। তাই এই দুই পরিণত ভাবমূর্তিকে আরও বহু দিন বাঁচিয়ে রাখতে হবে, আমাদের সামনে এঁরা আরও অনেক দিন পথপ্রদর্শক হিসাবে থেকে যাবেন! ভাবে কাজে ও চরিত্রে।§

[বিদ্যাসাগরের ছবি উইকিপেডিয়া থেকে নেওয়া, অক্ষয় কুমার দত্তের ছবিটি এঁকেছেন আলপ্তগীন তুষার]

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *