কী গান শোনাব আজি, ওগো

অশোক মুখোপাধ্যায়:

<এক> গান গাইবার বিপদ!

দ্রোহের কবিয়াল কাজী নজরুল ইসলাম এক দিকে গেয়েছেন “কারার ঐ লৌহকপাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট”, “শিকল পরা ছল রে মোদের”, “চল চল চল”, “তোরা সব জয়ধ্বনি কর”, “জাগো অনশন বন্দি ওঠ রে যত”, “আজি রক্তনিশি ভোরে, একি এ শুনি ওরে”, ইত্যাদি সংগ্রামী চেতনায় ঋদ্ধ দেশাত্মবোধক সঙ্গীত। সেই তিনিই আবার অন্য দিকে রচনা করেছেন, “আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন”, “বল রে জবা বল”, “গোঠের রাখাল বলে দে রে কোথায় বৃন্দাবন”, “ব্রজগোপী খেলে হোরি”, “খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে”, ইত্যাদি নানা রকম হিন্দু ধর্মীয় আধ্যাত্মিক অনুষঙ্গের গান। এবং বেশ কিছু ইসলামি ভক্তিগীতি।

আমরা যারা গানের ভক্তজন, তাদের সামনে অনেক সময় এরকম একটা সমস্যা এসে হাজির হয়: আমি একজন বিজ্ঞানমনস্ক, ভাববাদ বিরোধী, বস্তুবাদী, যুক্তিবাদী এবং মার্ক্সবাদী, সমাজ বদলের ঘোষিত সৈনিক—এই দুইয়ের মধ্যে কী ধরনের গান পছন্দ করব? কোন কোন গানটা শুনব? কোন গানে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাব? প্রথম ধরনের গানের মতো আরও অনেক গান আছে। অন্যদের লেখা সুর দেওয়া এবং গাওয়া। সেইগুলি পছন্দ করব এবং শুনব? সবাইকে শুনতে বলব? নাকি, দ্বিতীয় সারিটার মতো অন্য কবি ও গায়কদের আরও যে সব ভক্তিমূলক গান আছে সেগুলিও পছন্দ করব, শুনব এবং সমমনস্ক অন্যদেরও শুনতে বলব?

সাড়ে তিন দশক আগেকার একটা ব্যক্তিগত স্মৃতি জরিত ঘটনার কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। আমার অতি ঘনিষ্ঠ দুচার জন জানেন, খুব বেশি লোক এটার ব্যাপারে কিছু জানেন না। সেই গল্পটা এখানে সংক্ষেপে বলে নিলে উপরের তর্কটায় ধুনো দিতে সুবিধা হবে।

১৯৮৭ সাল। আমি তখন সক্রিয় ভাবে এসইউসিআই দলের হয়ে রাজনীতি করি। প্রচলিত পরিভাষায় সার্বক্ষণিক কর্মী। ঝাড়খণ্ডের ঘাটশীলা উপশহরে সেই দলের একটা সুবিশাল প্রতিষ্ঠান আছে মার্ক্সবাদ অধ্যয়ন কেন্দ্র হিসাবে। খড়্গপুর থেকে ঘাটশীলা যাওয়ার পথে স্টেশনে ঢোকার মুখে মোটামুটি এক কিলোমিটার আগে ট্রেন থেকে ডান (পুব) দিকে তাকালে দেখা যায়। সেখানে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজ্য এবং জেলার এবং বিভিন্ন গণ সংগঠনের আড়াইশ থেকে তিনশ মতো কর্মীকে বেছে নিয়ে এক একবারে পাঁচ ছ দিন ধরে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা সহ রাজনৈতিক শিক্ষার আয়োজন করা হয়। সব কিছু ভেতরেই এক ছাদের তলায় সম্পন্ন করা যায়।

সেবার সেরকমই একটা বহু-রাজ্য ভিত্তিক ক্লাশের শেষ দিন। মধ্যাহ্ন ভোজনের আগে মূল ক্লাশক্রম শেষ হয়ে গেছে। পরের দিন সকাল থেকেই যে যার কর্মস্থল ও গৃহ অভিমুখে চলে যাবে। খাবার ঘরে ভিন্‌ রাজ্যবাসী কমরেডদের কেউ কেউ আমাকে প্রস্তাব দিলেন, অশোকজি, কুছ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কে আয়োজন কিয়া যায় ক্যায়া? আপ কে পহল সে হো সকতা হ্যায়। সকলেই জানেন, ক্লাশ-টাস লেখাপড়ার ব্যাপারে আমার যত আগ্রহ, তার চাইতে গান বাজনার কথায় আগ্রহ অনেক গুণ বেশি। বিশেষ করে নিজেরও গান গাওয়ার সুযোগ এসে যাবে বলে। তো নিলাম উদ্যোগ।

প্রথমে বাংলার বাইরের রাজ্য থেকে আসা বেশ কিছু কমরেডের নাম তালিকায় ঢোকালাম—দিল্লির রমেশ শর্মা আর প্রতাপ সামল, কর্ণাটকের মঞ্জুনাথ, আসামের অজিত আচার্যি, ওড়িশার ছবি মহান্তি ও ধুর্জটি দাশ (সম্প্রতি মারা গেছেন), কেরালার মিনি, প্রমুখ আরও অনেক। সবার নাম এখন এত বছর বাদে আর মনেও নেই। গান ছাড়া কবিতা আবৃত্তির জন্যও নাম নিলাম। তারপরই অকস্মাৎ আমার মনে পড়ল, আরে, ছায়াদি তো ভালো গান গাইতে পারেন। ওনাকে বলি। টপ্পাঙ্গের রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি খুব ভালো জানেন এবং গাইতে ভালোবাসেন।

ছায়াদি ওরফে ছায়া মুখার্জী, আমি যখন দলের কাজ শুরু করি এআইডিএসও-র নেতা ছিলেন। আমার থেকে বয়সে অনেক বড় হলেও এই সব প্রস্তাবের তোড়ে ছেলেমানুষ হয়ে যেতেন। গান সূত্রে আমার সঙ্গে প্রচুর সংলাপ এবং তর্ক হত। তিনি রাজি হয়েই বললেন, তোমরা আশুবাবু (অনেক কাল আগে প্রয়াত নেতা, দিল্লির তখন রাজ্য সম্পাদক এবং পরে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, কমরেড আশুতোষ ব্যানার্জী)-কে বলেছ? উনি কিন্তু খুব ভালো ক্লাসিক্যাল জানেন।

ধরলাম আশুদাকেও (কীভাবে ধরেছিলাম সবিস্তার বলে কারও ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না; সে এক বিশাল ঝকমারি ব্যাপার ছিল। একে তিনি ছিলেন ভীষণ রাশভারি মানুষ। যে কোনো বিষয়ে কথা বলতে গেলে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হত। আমার উপর সেই দিনে ন্যস্ত দলীয় সব কাজ আমি সেরে ফেলেছি কিনা, সেই ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে কথা বলার মধ্যে অনেক ঝুঁকি ছিল। সেই সব ঝক্কি মেনেই আমি গিয়ে পৌঁছলাম তাঁর কক্ষে)। তিনি নানা ওজর আপত্তির পরে রাজি হলেন এই শর্তে যে কৃষ্ণ (কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তী, তখন দক্ষিণ ভারতের চারটি রাজ্যের দলের সাংগঠনিক দায়িত্বে, পরে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য—পরে নেতৃপদ থেকে বহিষ্কৃত ও সম্প্রতি প্রয়াত)-কেও গাইতে হবে।

কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তীকেও গিয়ে আর্জি শোনালাম। তিনিও সম্মত হলেন, তবে দাবি করলেন, তাপস দত্ত (শ্রমিক নেতা কমরেড তাপস দত্ত, পরে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বহু বছর আগে মারা গেছেন)-কে মঞ্চে তুলতে হবে।

সন্ধেটা সেদিন দারুণ জমে গিয়েছিল। বিকেল পাঁচটায় শুরু হয়ে রাত নটায় খাবার ঘন্টা পড়ার পরেও আসর ভাঙতেই চাইছিল না।

তো এতে কী হল?

হল কদিন পরে। কলকাতায় ফেরার কয়েক দিন পরে আমি আর বিপ্লবদা (কমরেড বিপ্লব চক্রবর্তী—গত বছর মারা গেছেন) তালতলার কাছে ফুটপাতের এক চায়ের দোকানে বসে সেদিনের সেই সোনাঝরা সন্ধ্যার গল্প করছি। এমন সময় আমাদের এক নেতা (ইনিও প্রয়াত—বিশেষ কারণে এঁর নাম বলছি না) এসে আমাদের সঙ্গে চা-পানে যোগ দিয়ে বললেন, যতই গলা বাড়িয়ে বল না কেন, কাজটা তোমাদের খুব ভালো হয়নি। আমি সিসি-র কাছে কমপ্লেইন করেছি।

বিপ্লবদা ঘাবড়ে গেলেন, কমপ্লেইন? কেন? কী নিয়ে?

এই আপনারা যে কাণ্ড করে এসেছেন, যা নিয়ে এখন কথা বলছেন, তা নিয়ে!

সে কী, গান বাজনা করে ভুল কিছু করেছি?

নেতা বললেন, গান বাজনা করে ভুল করেননি, গান খুব ভালো কাজ। কিন্তু যে সব গান বাজনা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমার এবং অনেকেরই আপত্তি আছে।

আমি কিঞ্চিত আহত এবং বিস্মিত হয়ে বললাম, কেন সেখানে সকলেই ভালো ভালো গান করেছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, ক্লাসিক্যাল গান, ভজন, কীর্তন, কবীরের গান, ওড়িয়া, কর্ণাটকি, কেরালীয় লোকসঙ্গীত, বাংলার ভাওয়াইয়া, সারি, বাউল, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, আসামের বিহু, তাছাড়া ভগত সিং নিয়ে গান, ভগৎ সিং সিনেমার দেশাত্মবোধক গান, আবার বিভিন্ন ভাষায় গণসঙ্গীত—এই সবই তো হয়েছে।

তিনি আমার উদ্দেশে বললেন, আমাদের আপত্তিও এই সব বেশির ভাগ গান নিয়েই। তুমি বাড়িতে বসে যত খুশি এরকম গান শোনো, কারও বলার কিছু নেই। কিন্তু মার্ক্সবাদ লেনিনবাদ বিষয়ক একটা প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক শিক্ষাকেন্দ্রে বসে ধর্মীয় আধ্যাত্মিক গান, বুর্জোয়া মানবতাবাদী গান, স্বদেশি গান, লোকসঙ্গীত, এই ধরনের গান গাওয়া উচিত বলে আমি মনে করি না। আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁরাও অনেকেই আমার মতে সায় দিয়েছেন।

বিপ্লবদা খুব হতাশ হয়ে জিগ্যেস করলেন, তবে ওখানে কী গান গাওয়া যেত বলে আপনি অনুমোদন করেন?

একমাত্র গণসঙ্গীত। সর্বহারা শ্রেণির সংগ্রামের গান। জাতীয় আন্তর্জাতিক। শ্রমিক বিপ্লবের একটা অধ্যয়ন কেন্দ্রে বসে বিপ্লবীরা সর্বহারা বিপ্লবের গান গাইবেন—এটাই প্রত্যাশিত। আপনারা সেই প্রত্যাশা নষ্ট করেছেন। করে আবার মজা লুটেছেন। সর্বহারা সংস্কৃতির দিক থেকে এটা একটা গর্হিত অপরাধ বলে আমার ধারণা। অথচ আপনারা এখনও সেই আনন্দে মজে আছেন।

বিপ্লবদা শেষ চেষ্টা করলেন, কিন্তু আপনি দেখেছেন, দলের অন্তত তিন জন চার জন সিনিয়র নেতা আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। ওনারা শুধু গান গেয়েছেন, তাই নয়, গোটা অনুষ্ঠানটা এক সঙ্গে আমাদের পাশে বসে খুব উপভোগ করেছেন। প্রত্যেকেই হল থেকে বেরনোর সময় অশোককে পিঠ চাপড়ে দিয়ে গেছেন। একটা চমৎকার উদ্যোগ নিয়েছে বলে।

নেতা তাঁর অবস্থানে অবিচল, সিনিয়র হলেও সেই নেতারাও ভুল করেছেন বলে আমি মনে করি। তাঁদের সম্পর্কেও আমি সিসি-তে আমার অভিযোগ জানিয়েছি।

চা পান শেষ করে সেই নেতা একটু পরে উঠে চলে গেলেন। বিপ্লবদা আমাকে গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে জিগ্যেস করলেন, কী হবে তাহলে এবার, অশোক?

আমি নিশ্চিন্ত মনে বললাম, মজা।

এটা নিয়ে একটা হইচই হবে না?

না। আমার বিশ্বাস, উনি সিসি-তে বা অন্য নেতাদের মধ্যে এমন একজনকেও পাবেন না, যিনি অবসর সময়ে এই ধরনের গান শোনেন না। এই জাতীয় গান উপভোগ করেন না। আর আমরা কোনো রাজনৈতিক সভার আগে, ক্লাশের আগে সেই সব গানের চর্চা করিনি। করেছি একটা স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার অনুষ্ঠান হিসাবে। উনি খুব একটা ভোট পাবেন বলে আমার বিশ্বাস হয় না।

<দুই> কথা বনাম সুর

সত্যিই সেই ঘটনা নিয়ে দলের মধ্যে আর কিছু ঘটেনি। আমাকেও নেতৃত্বের তরফে কিছুই বলা হয়নি। All was quiet in the upper front! এদিক ওদিক এক আধটু ফিসফিসানির বাইরে কোনো স্তরেই কেউ কিছু বলেননি। মনে হয় সেই নেতা খুব একটা কল্কে পাননি কারও কাছেই।

কিন্তু এই যে একজন অন্য ক্ষেত্রে সফল মার্ক্সবাদী নেতার মাথায় গান সম্পর্কে এরকম একটা (আমার মতে) সংকীর্ণ ভাবনা এল, এর ভিত্তি কী? আজ মনে হচ্ছে, এর মূলে অনুসন্ধান চালানো দরকার।

প্রথমেই বলি, আসলে শিল্প সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় মার্ক্সীয় ঘরানায় যত আলোচনা আছে, সঙ্গীত নিয়ে (আমার জানায়) তার তিলাংশও নেই। আমেরিকান মার্ক্সবাদী সিডনি ফিঙ্কেলস্টাইনের দুটো বইতে ভারি চমৎকার আলোচনা থাকলেও (এবং জলার্ক পত্রিকার পুরনো দুটো সংখ্যায় বাংলা অনুবাদে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল), তাতেও গানের সামাজিক তাৎপর্য ও বিষয়বস্তু নিয়ে যেটুকু কথা আছে, সুর বৈচিত্র্য নিয়ে তেমন কিছু বলা নেই।

নেই, কেন না সমস্যা আছে। সঙ্গীত এমন একটা শিল্প মাধ্যম যার আবেদন আমাদের কানের কাছে, শ্রবণ অনুভূতির কাছে। বাকি প্রায় সমস্ত শিল্পই আমরা আস্বাদন করি প্রধানত এবং/অথবা একমাত্র চোখের সাহায্যে। গল্প উপন্যাস (চোখ দিয়ে) পড়ি, ছবি ভাস্কর্য নাটক সিনেমা নাচ দেখি, ইত্যাদি। গান দেখা যায় না। শুনতে হয়। গানে কথা থাকলে তা পড়া যায়, কিন্তু পড়ে গানের কিছুই বোঝা যায় না। আর যখন শুনি, তখন পড়ি না।

সঙ্গীত মানুষের খুব প্রাচীন শিল্প সৃষ্টি। সমাজতত্ত্ববিদরা মনে করেন, প্রকৃতিতে পশুপাখির নানা রকম ডাক শুনে শুনেই মানুষের মনেও সুরেলা শব্দ উৎপাদনের প্রেরণা জেগেছিল। মানুষের স্বরযন্ত্র এমন যে সে নানা রকম শব্দ উৎপাদন ও উচ্চারণ করতে পারে। তার ভিত্তিতেই সুর। প্রকৃতপক্ষে নাচ গান আর অভিনয় একটা যূথক্রিয়া হিসাবেই আদিতে মানব জাতি—অন্তত, অধিকাংশ মানব গোষ্ঠী—আয়ত্ত করেছিল। কালক্রমে, সমাজ বিকাশের ধারায় এক সময় এগুলো এক এক করে পৃথক শিল্প হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। করলেও আজও নাচের সঙ্গে গান মিলেমিশে আছে। নাচও আসলে এক রকমের অভিনয়। নৃত্যনাট্যে নাচ গান আর অভিনয়কে আবার এক সঙ্গে পরিবেশন করার আয়োজন ঘটে। অর্থাৎ, সেই আদি যৌথতা আজও তাদের ছেড়ে যায়নি।

আদিম কালের মানুষের জীবন যাত্রার নানা পরতে ছিল সুর ও ছন্দের অঙ্গাঙ্গী অবস্থান। কাজ করতে করতে ছন্দবদ্ধ আওয়াজ করা, সুর ভাঁজা, এবং তার মধ্যে কখনও কখনও কিছু শব্দ বসিয়ে দেওয়া—অর্থহীন বা অর্থযুক্ত—যা সুরকে ধরে রাখতে সাহায্য করবে—এই প্রক্রিয়ায় গানের জন্ম। সেই গান ছিল যূথগীতি, যৌথ কাজের আর্তি এবং পরে সেই কাজের আরতি। আমরা আজ যাকে লোকসঙ্গীত বলি, আসলে যা সঙ্গীতের আদি রূপ, তার জন্ম সম্ভবত এইভাবেই হয়েছিল। ব্রিটিশ মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদ ক্রিস্টফার কডওয়েল তাঁর Illusion and reality বইতে এই ভাবেই বিষয়টাকে সামনে এনেছেন। পরে জর্জ টমসনও এই ধারায় আরও কথা যোগ করেছিলেন তাঁর Marxism and Poetry বইতে। পড়ে অবশ্য তিনি এই বইটাকে বাতিল করে দেন। কিছু মানব গোষ্ঠী আজও সেই প্রাচীন ধারা ধরে রেখেছে। অন্যান্যরা সঙ্গীতের নানা পর্যায়ের বিকাশ ঘটিয়েছে।

সঙ্গীতে কথাংশ তার অনুষঙ্গ। অত্যাবশ্যক নয়। আধুনিক কালে কথার যত গুরুত্ব, যত অতীতের দিকে তাকাব, দেখব সেই গুরুত্ব নেই। এমনকি প্রাচীন লোকগীতিতে কথা থাকলেও তার প্রায়শ কোনো অর্থ থাকত না। ছন্দোবদ্ধ কথা হলেই তা দিয়ে গান রচনা করা যেত। সুরই সঙ্গীতের প্রাণ বলেই যন্ত্রের সাহায্যে নিখুঁত সুর সৃষ্টি আমাদের কাছে এত আবেদন নিয়ে আসে। মানুষের গলার আওয়াজ মোটামুটি এক রকমের। নারী, পুরুষ আর শিশু কণ্ঠের পার্থক্যের বাইরে আর বিশেষ আলাদা নয়। যদিও শিল্পী ভেদে কণ্ঠ ও গায়কিতে নানা রকম প্রভেদ অবশ্য দৃষ্ট। যন্ত্র তা নয়। যন্ত্রভেদে স্বর এত বিভিন্ন যে যাদের গান শোনার অভ্যাস আছে, তাঁরা আওয়াজ শুনেই বলে দিতে পারবেন—সেতার না এস্রাজ, বেহালা না বাঁশি।

আমার কথাটা আমি আর একবার গুছিয়ে বলে রাখি: যন্ত্রসঙ্গীতে সুরটাই সব বা আসল—বিষয়টাকে এমন ভাবে দেখলে হবে না। সঙ্গীতে সুরটাই সব বা আসল বলেই যন্ত্রসঙ্গীতের এত আবেদন।

এই অবধি যদি বুঝে ফেলা যায়, কিংবা মেনে নেওয়া যায়, তাহলে আমরা আলোচ্য বিতর্কে একটা বড় পদক্ষেপ নিতে পারব। সেটা হল, সুরকে ভাববাদী-বস্তুবাদী, যুক্তিবাদী-অযৌক্তিক, ধর্মীয়-নাস্তিক, সামন্তবাদী-আধুনিক, বুর্জোয়া-শ্রমিক—ইত্যাদি আমাদের সুপরিচিত দ্বন্দ্ব-দ্বিত্বে ফেলে বিচার করতে পারব না। সুরের যা কিছু প্রকরণ তার সমগ্র ভাণ্ডারটা মানব জাতি বিগত কয়েক সহস্রাব্দে ইতিমধ্যেই তৈরি করে ফেলেছে। মানুষ যে ভাবগত চেতনা নিয়ে যে আঙ্গিকের গানই রচনা করুক না কেন, তা এই প্রকরণ-কৌমুদীর সমগ্রের মধ্যেই থাকতে বাধ্য।

তাহলে সঙ্গীতে এত বৈচিত্র্য আসে কোত্থেকে?

আসে স্বরের বৈচিত্র্যের ভিত্তিতে। এবং সে এক বিশাল সংখ্যা। আমরা যখন হারমনিয়াম বা পিয়ানোর এক অষ্টকে ক্রমোচ্চতর কম্পাঙ্কের ভিত্তিতে বারোটা স্বরের কথা বলি, আসলে তার মধ্যে বারো হাজার স্বরও আছে বলে ধরে নিতে পারি। সা এবং কোমল রা-এর মধ্যেই অসংখ্য স্বরের অস্তিত্ব রয়েছে। আবার সেই অষ্টকের আগেও অসংখ্য স্বর, পরেও। এই বিশাল স্বর ভাণ্ডার থেকে বাছাই করে শিল্পী সুর নির্মাণ করেন। ফলে বৈচিত্র্যের কোনো সমস্যা নেই শুধু নয়, সূর্য ঠান্ডা হয়ে যাওয়া অবধিও হবে না।

এই সুরের কাঠামো, কমরেড স্তালিন তাঁর “মার্ক্সবাদ ও ভাষা সমস্যা” সংক্রান্ত পুস্তিকায় ভাষা বা বিজ্ঞানকে যেমন বলেছিলেন, অনেকটা উৎপাদিকা শক্তির মতো। ভাষার যেমন কোনো শ্রেণি চরিত্র হয় না, ট্র্যাক্টরের যেমন পুঁজিবাদ সমাজবাদ হয় না, তেমনই সঙ্গীতের সুরের কোনো শ্রেণিগত বা সামাজিক স্তরগত বিশ্লেষণ করা যায় না। সামন্ততান্ত্রিক যুগের গানে রাজা জমিদারদের স্বার্থ রক্ষাকারী সুর থাকবে, কিংবা ধনতন্ত্র যে সমস্ত গানকে প্রোমোট করবে, তাতে ধনতন্ত্রের কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষিত হবে, এমনটা বললে তা অতি সরল বা হাস্যকর হয়ে দাঁড়াবে। একই ভাবে গানের সুরে ভাববাদ বস্তুবাদ কিংবা অধ্যাত্মবাদ যুক্তিবাদ ইত্যাদি খোঁজা এবং দেখানো কার্যত টেলিস্কোপ দিয়ে কৃষ্ণগহ্বর দেখার মতোই সহজ কাজ।

হ্যাঁ, গানের কথা-ভাগ থাকলে তাকে সাহিত্যের মতো করেই বিশ্লেষণ করা সম্ভব। তার সামাজিক শ্রেণি স্বার্থগত অবস্থান দেখানো যাবেই। এই কথাভাগ আমরা সহজেই বুঝতে পারি বলেই সুর নিরপেক্ষভাবে একটা গানকে সামন্ততান্ত্রিক, কিংবা ধর্মীয় কিংবা গণসঙ্গীত বলে চিহ্নিত করতে পারি। এই সনাক্তকরণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুল হয় না। তবে কেউ যদি ভাবেন, গানের কথা দিয়ে যখন তার শ্রেণি অবস্থান চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে, তখন তা বুঝি সুরের গায়েও লেগে আছে। শ্যামাসঙ্গীতের শুধু কথাতে নয়, সুরেও সামন্ততন্ত্র ধর্ম আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি জুড়ে রয়েছে। কিন্তু সঙ্গীতের বিচারে এই ভাবনার মতো ভুল আর কিছুই নেই।

কিন্তু সুরের এই ক্ষমতা আছে যে একটা বিশেষ জাতের গানের ভাবকে যেমন তা খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারে, তার পাশাপাশি সেই ভাব নিরপেক্ষভাবে তা মানুষের সঙ্গীতবোধে (সুরশ্রাব্যতায়) সদর্থক আবেদন জাগাতে সক্ষম হয়।

এক ধরনের সুর ভক্তিভাব জাগিয়ে দেয়। একটা বিশেষ ধাঁচের বাজনাতে যুদ্ধের বা লড়াইয়ের ভাব জেগে ওঠে। এর ভিত্তিতেই নাটকে সিনেমায় বিভিন্ন দৃশ্যের সপক্ষে আবহ সঙ্গীতের প্রয়োগ করা হতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিত-বান্ধব সুর মাত্রই তার সার্থকতার জন্যই আমাদের কাছে বরণীয় হয়ে ওঠে। ভালো লাগে।

বিপরীত ক্রমে বলা যায়, গানটি যে ভাবকে তুলে ধরতেই তৈরি হয়ে থাকুক, মানুষের কান তার সুরের মধ্যে এক রকম সার্বজনিক পরিতৃপ্তি লাভ করতে পারে। সব ক্ষেত্রেই হবে, যে কোনো গানেই হবে এমন নয়। সুরের গঠনের উপর নির্ভর করে কিছু গানের ক্ষেত্রে এটা হতে পারে। ভালো গান হলে হবে। অন্য গানে হবে না।   

এটা কেন হয়?

এটা কীভাবে সম্ভব হয়?

এই ক্ষেত্রে আমরা কার্ল মার্ক্সের একটা মন্তব্য থেকে সূত্র পেতে পারি। মার্ক্স ১৮৪৪ সালে পারি শহরে থাকাকালীন রচিত অর্থনীতি ও দর্শন সংক্রান্ত একটা অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপিতে বলেছিলেন, বহির্বাস্তবের সঙ্গে ক্রিয়া করতে করতেই মানুষের যাবতীয় মননশীলতা (গান শুনবার কান, শিল্প বুঝবার চোখ, ইত্যাদি) তৈরি হয়, কিন্তু তা শুধু তার সমকালের অর্জন নয়; এই মানসিক কাঠামো শুধু ব্যক্তি বিশেষের সমসাময়িক পরিবেশ থেকে গড়ে ওঠে না, মানুষ যুগে যুগে যা কিছু সৃষ্টি করে তা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যায় উত্তরাধিকার হিসাবে। তাই ব্যক্তির মনন গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে “আজ পর্যন্ত বিশ্ব মানব জাতির ইতিহাস”।

এই সূত্র অনুযায়ী, আমাদের সঙ্গীত আস্বাদনের ক্ষমতাটি একটি ঐতিহাসিক ভাবে বিকশিত ক্রমপুঞ্জীভূত মনন মণ্ডল, যা মানুষ যা কিছু সৃষ্টি করেছে তাকে সনাক্ত ও উপভোগ করতে পারে।

সঙ্গীতেরও বিকাশ এই প্রক্রিয়ায় হয়েছে। আজকের দিনে যা রাগসঙ্গীত, তাও এক কালের লোকসঙ্গীত থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এই কারণেই বাউল গানের গায়ন আত্মসাত করে এক গুচ্ছ গান রচনা করা সম্ভব হয়েছিল। নজরুল এই ভাবেই মধ্য প্রাচ্যের অনেক রকম গানের আদলে নিজস্ব গান তৈরি করলেন। হেমাঙ্গ বিশ্বাস উত্তর বঙ্গ ও আসামের নানাবিধ লোকসঙ্গীতের সুরে গণসঙ্গীতে রচনা করেছিলেন। সঙ্গীত এইভাবেই সামাজিক ইতিহাস থেকে উপাদান নিয়ে এগোতে থাকে। এগোচ্ছেও।

তাই আজকে যিনি গান শুনবেন, তাঁকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তিনি ইতিহাসের থেকে রস নিংড়ে নেবেন, নাকি সমকালের সেরা গানকটাই শুনবেন।

কিন্তু যিনি গান রচনা করবেন, তাঁর পক্ষে ইতিহাসকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তাঁকে এক পা এগোতে হলেও পেছনের সঙ্গীত কৃতি জানতে বুঝতে হবে। যন্ত্রেই সুর তুলুন আর কথা ভিত্তিক গানই তৈরি করুন (কিংবা একটা গীতিতে সুরারোপ করুন), সুরের প্রকরণ আসবে কিন্তু সেই ইতিহাসের সঞ্চয় থেকেই। সেই সব প্রকরণের কথার ভেতরে এক কালের ভাববাদ অধ্যাত্মবাদ ধর্ম ভক্তিবাদ অন্তর্লীন হয়ে আছে। সুরেও তার প্রভাব নিশ্চয়ই পড়েছিল। আবার সেই প্রকরণকে নানা সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ায় কাজে লাগিয়েই বস্তুবাদী যুক্তিবাদী রোমান্টিক বা সংগ্রামী সঙ্গীতের সুর তৈরি হবে।   

সমাজ জীবনে আজ ধর্মের প্রাসঙ্গিকতা চলে গেছে, ইতিহাসটুকু থেকে গেছে। সেই ইতিহাসের মধ্যে সঙ্গীতের ভাষা ও সুরের ক্রমবিকাশের কাহিনিও নিহিত রয়েছে। ইতিহাসের এই অন্তর্ধৃতির কারণেই একজন অনীশ্বর ব্যক্তিও বাউল গান শুনে, শ্যামাসঙ্গীত শুনে, ইসলামি গজল শুনে, লালন গীতি শুনে নান্দনিক তৃপ্তি পান। সেই তৃপ্তি কোনো আধ্যাত্মিক প্রেরণা লাভের নয়, ঈশ্বর বিশ্বাসীর নয়; এর জাত একেবারেই আলাদা। এর মধ্যে আছে পূর্বসূরি মানুষের সৃষ্টির প্রতি, বিভিন্ন যুগে কালে তাদের হাতে গড়া বাণী ও গীতির দ্রবণ শিল্পের প্রতি উত্তরপ্রজন্মের বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জনিত আস্বাদন। যেমন করে একজন আধুনিক শিল্পী প্রাচীন কালের শিল্পীর হাতে তৈরি অ্যাদোনা বা সরস্বতীর মূর্তির কারুকাজ দেখে আনন্দে উদ্বেল হয়ে পড়েন, বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি কেউ ভেঙে ফেললে শোকাহত হন, আলাউদ্দিন খাঁর বাড়িতে ভাঙচুর হলে কিংবা বিসমিল্লা খানের বাড়ি প্রোমোটারি করতে দিলে তাঁদের সঙ্গীতের অবদান ঐশ্বর্যের কথা ভেবেই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। তুলনা যদি করতেই হয় তো আর একবার কার্ল মার্ক্সকে স্মরণ করে বলব, এ অনেকটা ঘরে পরিবারে নিত্য দৃষ্ট অপত্য স্নেহের মতন। শিশুর হাতের কাজ দেখে যেমন করে পিতামাতা আনন্দ পান। তাকে কেউ বে-আক্কেলে হয়ে ভেঙে দিলে যেমন করে দুঃখ পান!

<তিন> দেওয়াল নয়

আমরা যুক্তিবাদী বস্তুবাদী অধুনামনস্করা মনে মনে একটা ভাগ করে নিয়েছি। লালনগীতি শোনা যাবে, কেন না ওতে আধ্যাত্মিক ছলেও হিন্দু মুসলিম বা নানা জাতের মানুষের মিলনের কথা আছে। রামপ্রসাদী বাউল ভাটিয়ালি পল্লীগীতি সারি ভাওয়াইয়া ময়মনসিংহের গীতি বিহু ভাদু তুসু ইত্যাদি গান শোনা যাবে, কেন না এই সব লোকগীতিতে সাধারণ মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন আছে। আবার, অতুলপ্রসাদ রজনীকান্ত রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্ম সঙ্গীত শোনা যাবে, কেন না এনারা উনিশ-বিশ শতকের নবজাগরণের ফসল, কিছু দুর্বলতা থাকলেও এনারা নানা দিকে নানা ভাবে আমাদের এগিয়ে দিয়েছেন। নজরুলের কৃষ্ণ নিয়ে গানগুলোও শুনতে দোষ নেই, কেন না, কৃষ্ণ সেই সব গানে প্রায় মর্ত্য মানব। কিন্তু নজরুলের বা পান্নালালের শ্যামা সঙ্গীত, মীরার ভজন, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, ইত্যাদি শোনা পাপ। কারণ, সে সব বড্ড বেশি ভাববাদী ভক্তিবাদী। ধর্ম এবং কুসংস্কার খুব প্রকট সেই সব গানে।

মনোলোকের এই ভাগাভাগিটা ভুল। ভুল, প্রথমত এই জন্য যে, এর মধ্যে আমরা গানের বিকাশের ইতিহাসপথকে মাঝে মাঝে কেটে দিয়েছি। আমাদের মনোগত বাসনা মতো। যারা শুধুই গান শোনেন, তাদের জন্য এই বিভাজনে সমস্যা নেই। আমরা সকলেই পছন্দ মতো গান শুনি। কারও পক্ষেই দুনিয়ার সমস্ত গান শোনার সময় এবং সুযোগ নেই। কিন্তু গানের বিকাশের দিক থেকে এই ভাগটা সত্যও নয়, সম্ভবও নয়। সুরের প্রকরণের বিচারে আদ্যন্ত ভক্তিগীতি আর কঠোর গণসঙ্গীতের মধ্যে বিশেষ কিছু বা বিরাট কিছু পার্থক্য নেই। অনেকটা যেমন একটা ধর্মীয় বিশ্বাসের সমর্থনে লেখা একজন ধর্ম বিশ্বাসী লেখকের প্রবন্ধ আর একটা বৈজ্ঞানিক মননের সপক্ষে লেখা একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের প্রবন্ধের ভাষায় ভাষাশৈলীর প্রকরণগত দিক থেকে বিশেষ কোনো বড় আকারের পার্থক্য নাও থাকতে পারে। বিবেকানন্দ নিয়ে দুজনে দুটো একই বিষয়ক একই মাপের প্রবন্ধ লিখলে হয়ত ৮৩ শতাংশ শব্দই কমন পড়বে। তথাপি, ভাব প্রকাশে যুক্তির ঘনঘটায় দুটো একেবারে স্বতন্ত্র জিনিস হয়ে যাবে। গানের সুরের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এমন।

সুরের এই ধারাবাহিকতার কারণেই আমাদের মতো কঠোর যুক্তিবাদীদের পক্ষেও নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত কিংবা মীরার ভজন ভালো লাগবার কথা। এই ভালো লাগাটা কালী ভক্তিতে নয়, কৃষ্ণপ্রেমেও নয়, কালী বা কৃষ্ণ উপলক্ষ করে যে সুর কাঠামো তৈরি হয়েছে তার প্রতি। সেই সব গান শুনে আমাদের মনে দেব দ্বিজে সামান্যতমও ভক্তিভাব জাগে না, কেন না, সেই সব গানের কথা ভাগের কোনো আবেদনই আমাদের যুক্তিশীল মনের কাছে নেই।

দ্বিতীয়ত, এই বিষয়য়টাতে আরও মনোযোগ দিতে হবে: রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসঙ্গীত, পান্নালালের শ্যামাসঙ্গীত আর রাঢ় বঙ্গের ভাদুর গানের মধ্যে মৌল দার্শনিক দিক থেকে প্রায় কোনো পার্থক্যই নেই। সমস্তটাই ভাববাদ পৃক্ত। তথাপি আমরা যে একটা ভাববাদী গুচ্ছকে অন্য ভাববাদী গুচ্ছের তুলনায় বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করেছি, তার কারণ এই দর্শনের প্রশ্নকে কার্যত আমরা উপেক্ষা করেছি। অজ্ঞাতসারে আমরা ভাববাদের বিরোধী হতে চেয়েও সঙ্গতিপূর্ণ থাকতে পারিনি। বা পারি না।

আর তৃতীয়ত, কথাহীন যন্ত্রসঙ্গীতে যখন ভক্তিবাদী গানেরই সুর বাজবে, আমরা তখন কী করব? বড় বড় শিল্পীদের সেতারে সানাইতে এস্রাজে বেহালায় সারেঙ্গীতে যে অধিকাংশ সুর সমগ্র জমা হয়ে আছে, আমরা তাকে বাদ দেবই বা কী করে বা কী বলে, আর শুনবই বা কোন ভরসায়? ইউরোপে রেনেশাঁসের প্রাবল্যের কারণে সঙ্গীতের বড় অংশ থেকে ভক্তিভাব উবে গিয়েছিল। আর আমাদের দেশে রেনেশাঁসের দুর্বলতার কারণে সঙ্গীতের পনের আনাতেই ভক্তি প্রধান। সাহিত্য কাব্য নাটকে যেটুকু ধর্মমোহ থেকে মুক্তি ঘটেছে, সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তার প্রায় কিছুই হয়নি। যন্ত্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তাই। আর তাই বলে যদি একেও সত্যিই বাদ দিতে যাই, সঙ্গীত সম্ভারের প্রায় সমস্তটাই বাদ দিতে হবে।

তাই বলছিলাম, উপরোক্ত মনোবিভাজনটা সম্পূর্ণতই ভ্রান্ত।

আসলে ইতিহাসের দিক থেকে দেখলে, ভাদু তুসু সারি ভাওয়াইয়া সারি ভাটিয়ালি বাউল কীর্তন খেয়াল কাওয়ালি গজল ভজন ইত্যাদির সুর প্রকরণ রবীন্দ্রসঙ্গীতে নজরুলের গানে মিশে আছে। ভক্তিগীতিতে, দেশাত্মবোধক গানে এবং প্রেমের গীতিকাব্যে। সব কিছুই সবাই নিয়েছেন এমন নয়, কিন্তু সবাই মিলে সেই প্রাচীন সম্পদকে আত্মস্থ ও নিঃশেষ করে ফেলেছেন। তাঁদের সেই সুর প্রকরণ থেকে নিয়ে এক কালে দুই বাংলায় আধুনিক গান বেতারের গান সিনেমার গান তৈরি হয়েছে। আজকের দিনের সব রকমের গানও সেইভাবেই তৈরি হবে। আজকের দিনে অনেকেই বিদেশি নানান গানের সুরও আত্মস্থ করার চেষ্টা করে চলেছেন। তারও বহু গানেই কথাংশে দার্শনিক দিক থেকে আমাদের হয়ত আপত্তি থাকবে। তবুও সুরের আবেদন পৌঁছে যাবে। যাবেই।

ইতিহাসের আরও একটা প্রবণতা পাঠককে লক্ষ করতে বলি। দেখবেন, আজকের দিনের সার্থক শিল্পীরা আর কেউ কীর্তনে বাউলে বিহুতে ফিরে যাচ্ছেন না। লালনের গানে কবিরের ভজনে কিংবা এমনকি রবীন্দ্রনাথ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ব্রহ্ম সঙ্গীতেও ফিরে যাচ্ছেন না। কেন? তাঁরা সকলেই কঠোর যুক্তিবাদী বস্তুবাদী বলে? না, তাঁরা যাচ্ছেন না, কেন না, যাওয়ার উপায় নেই। ভাববাদী, ধর্মে বিশ্বাসী হলেও উপায় নেই। বাউল বা বিহু গান করার সুরের প্রকরণ সমস্তই প্রায় নিঃশেষিত। শুধু বাউলে বা বিহুতেই নয়, পরবর্তীকালের গানেও তা ব্যবহৃত হয়ে অন্তর্ধৃত হয়ে গেছে। এখন যদি কেউ সেই সব গান তৈরি করে শোনাতে চান, তা বড্ড কৃত্রিম শোনাবে। ভাবের গভীরতা ফুটে বেরবে না। পূর্ববঙ্গীয় বা মানভূমিয়া ভাষায় একটা করে গান লিখে সুর দিলেই তা লোকসঙ্গীত হবে না। কেন না, জীবন সমাজ আর সেই জায়গায় নেই যেখানে এরকম গানের প্রসূতি ছিল, আঁতুরঘর ছিল, আবেদন ছিল।

<চার> আধার আঙ্গিক দ্বন্দ্ব

কিছু কিছু স্বাভাবিক ভাবে উত্থিত সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর দিয়ে রাখি।

শিল্প সাহিত্যে আধার আর আঙ্গিকের দ্বন্দ্ব-সম্পর্ক নিয়ে একটা পরিচিত থিসিস আছে। মার্ক্সবাদী মহলে সেই থিসিস খুবই জনপ্রিয়। গানও যেহেতু একটা শিল্প, এরও নিশ্চয়ই আধার-আঙ্গিক সত্তার অস্তিত্ব আছে। সেগুলি কীভাবে চিনব?

অনেকে মনে করেন, গানের ক্ষেত্রে সুর হচ্ছে তার বহিরঙ্গ, কথাভাগ হচ্ছে তার মর্মবস্তু। কথাযুক্ত গানের বিচারের সময় এই রকম শ্রেণিকরণ খুব সুবিধাজনক হয় বলে এর এক ধরনের সহজ আবেদন আছে। বিশেষ করে মার্ক্সবাদীদের কাছে। কিন্তু এরকম বিচার কি সঠিক?

না। ভালো করে তলিয়ে ভাবলেই আমরা বুঝতে পারব, গানের সিংহভাগই যেখানে কথাহীন, শুধুই সুর, সেখানে আমরা তাহলে মর্মবস্তু পাব কোথায়? নাকি, সেই সব সঙ্গীতে শুধু আঙ্গিক আছে, আধার বলে কিছু নেই?

আসলে কথাভাগ হচ্ছে সঙ্গতের মতো—তবলা, বাঁশি, করতাল, ইত্যাদি যন্ত্রানুষঙ্গের মতো। এই সবের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে সুসঙ্গে সুর তার যাদু দেখাতে, থুরি, শোনাতে থাকে। ফলে যে কারণে তবলা বা নাল গানের আধার নয়, সেই একই কারণেই কথাও গানের আধার হতে পারে না। সুরের মধ্যেই গানের আধার, সুরের মধ্যেই গানের আঙ্গিক। সুরের যে ভাব, সুরের মধ্যে যে আবেগের প্রকাশ এবং/অথবা আবেদন, সুরের যে ওঠাপড়া খেলা—তাই তার আধার। আর যে প্রকরণ, ব্যাকরণ, নিয়ম নীতি, ইত্যাদি মেনে সুরটা তৈরি হয়েছে, যে কাঠামোর মাধ্যমে সুরটা সঙ্গীত হওয়ার মর্যাদা এবং স্বীকৃতি লাভ করেছে, সে হল গিয়ে তার আঙ্গিক।

বুঝবার সুবিধার জন্য আমি এখানে দুটো উদাহরণ দিতে চাই। বৈজুবাওরা সিনেমায় নওশাদের সুরে মহম্মদ রফির কণ্ঠে গীত দরবারিতে “এ দুনিয়া কে রাখওয়ালে” সঙ্গীতের অসম্ভব জনপ্রিয়তা তার সুরের আবেদনের জোরেই। হিন্দি ভাষাটা বা গানের পুরো বক্তব্য না জানলেও, রাগের ব্যাকরণ না বুঝলেও, সুরের জন্যই সেই গানের চমৎকারিত্ব আস্বাদন করতে কারও অসুবিধা হয় না। আবার তখনও গানটাকে ভক্তিগীতি হিসাবে চিনতেও সমস্যা নেই। আধারে আছে ভক্তিভাব, আঙ্গিকে দরবারি কানাড়ার ওঠানামা। ১৯৭৪ সালে যেদিন এসইউসিআই নেতা কমরেড সুবোধ ব্যানার্জী মারা গেলেন, পরের দিন সন্ধ্যায় এক শোকসভায় শুরুতে প্রশান্ত চক্রবর্তী একটা গান লিখে সেই দরবারিতেই পরিবেশন করলেন—“মানুষের মুক্তির যজ্ঞেতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রবে তব নাম — ”। সভার প্রায় সকলেরই হৃদয়ের গহীনে তার ঢেউ পৌঁছেছিল, চোখে জল টেনে এনেছিল। আবার বলি, সে গানের আধারে এক প্রয়াত কমরেডের স্মরণে গণসঙ্গীত, তার আঙ্গিকে দরবারি কানাড়ার রাগ প্রকরণ। 

তাই বলে গানের কি রকমফের নেই? আছে। কোথায় কী ধরনের অনুষ্ঠানে কোন জাতীয় গান গাওয়া যাবে, তারও প্রকারভেদ আছে। একটা স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যে সমস্ত গান স্বাভাবিক লাগবে, একটা শ্রাদ্ধের আসরে, কারও স্মরণসভায় কিংবা রাজনৈতিক সভায় সেই সব গান চলবে না। নতুন বিবাহিত দম্পতির সম্বর্ধনা সভায় নিশ্চয়ই কেউ আন্তর্জাতিক সঙ্গীত পরিবেশন করবে না। রাজনৈতিক অধ্যয়নের ক্লাশের শুরুতে কাউকে শ্যামাসঙ্গীত বা ইসলামি গান গাইতে কোনো নেতা বলবেন বলে মনে হয় না। সুতরাং গানের শ্রেণিবিচার বাদ দেবার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু সুরের বিচারের সঙ্গে এই শ্রেণিবিচারকে যোগ বা যুক্ত করতে গেলে বিপদ আছে। ছেলেমানুষি বা যান্ত্রিকতার দোষ এড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে।

<পাঁচ> ঘুর পথে শিক্ষা

একেবারে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, সোভিয়েত রাশিয়ার মাটিতে ১৯২০ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে শতাধিক বছর আগে, সমাজতন্ত্রের রাজনীতি অর্থনীতির পাশাপাশি সংস্কৃতি নির্মাণের কালে কমরেড লেনিনকে অনুরূপ একটা প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হয়েছিল। সর্বহারা সংস্কৃতির নির্মাণ প্রসঙ্গে। হুবহু না মিললেও আমরা তাঁর সেদিনের সেই আলোচনা থেকে আলোচ্য প্রসঙ্গে ঘুরপথে খানিক দিশা পেতে পারি—অন্তত আমরা যারা মার্ক্সবাদে আস্থা রাখি এবং সমাজতন্ত্র সাম্যবাদ ইত্যাদি অ্যাজেন্ডায় বিশ্বাস করি এই লকডাউনের বাজারেও। তাই এই ক্ষুদ্র প্রস্তাবটি শেষ করার আগে আমি সেদিনের লেনিনের প্রাসঙ্গিক আলোচনা খানিক তুলে আনতে চাই।

জার তন্ত্র এবং কেরেন্সকি সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে নভেম্বর বিপ্লবের পর যখন শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সমাজতন্ত্রের নির্মাণ চলছে, তার পরিপূরক হিসাবে উপরকাঠামোতে সর্বহারা শ্রেণির সংস্কৃতি (শিল্প সাহিত্য সঙ্গীত) সৃষ্টি করতে হবে, কোত্থেকে শুরু হবে? প্রশ্নটা এসেছিল এই ভাবে: এত কালের পুরনো সংস্কৃতি ছিল সামন্ততান্ত্রিক বুর্জোয়া ইত্যাদি শোষক শ্রেণির সংস্কৃতি। সেই শ্রেণি শোষণ আজ অবসিত। সুতরাং পুরনো যুগের সেই সব শিল্প সাহিত্য সঙ্গীত থেকে আমাদের আর নেবার কিছু নেই। সর্বহারা শ্রেণি তার নিজের সংস্কৃতি নিজের মতো করে গড়ে তুলবে। এই নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে সেকালে এক শক্তিশালী আন্দোলনও গড়ে উঠেছিল সর্ব-কৃতি (proletcult) নামে।

লেনিন অবাক হয়ে দেখলেন, কী কাণ্ড—তিনি যে এত পুশকিন, গোগোল, তলস্তয়, তুর্গেনিভ, দস্তয়ভস্কি, শেকভ, সালতিকভ-শ্চেদ্রিন, প্রমুখ সাহিত্যিকের ভক্ত, চাইকভস্কির পিয়ানোর সুর শোনেন অবসর পেলেই—এই আন্দোলন সফল হলে সে সব আর পড়াও যাবে না, শোনাও যাবে না। ১৯২০ সালে কমসোমল (Young Communist League)-এর তৃতীয় কংগ্রেসে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি এই বিষয়টাকে তুলে নিলেন। নানা দিক থেকে বিচার বিশ্লেষণ করে পুরনো সমাজের শিক্ষা সংস্কৃতি বিজ্ঞান প্রযুক্তির কী আমরা নেব, কী নেব না, চিড়ে চিড়ে ব্যাখ্যা করে বললেন:

We must bear this in mind when, for example, we talk about proletarian culture. We shall be unable to solve this problem unless we clearly realize that only a precise knowledge and transformation of the culture created by the entire development of mankind will enable us to create a proletarian culture. The latter is not clutched out of thin air; it is not an invention of those who call themselves experts in proletarian culture. That is all nonsense. Proletarian culture must be the logical development of the store of knowledge mankind has accumulated under the yoke of capitalist, landowner and bureaucratic society. All these roads have been leading, and will continue to lead up to proletarian culture, . . .

লেনিন বলার পরও কি এই সমস্যার সমাধান হয়েছিল? না হয়নি।

১৯৩০-এর দশক থেকে শুধু শিল্প সাহিত্য নয়, বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে (তাঁর নিজের প্রদত্ত ফরমুলার বিরুদ্ধে গিয়েই) বুর্জোয়া বিজ্ঞান বনাম সর্বহারা বিজ্ঞানের আদলে “পশ্চিমা বিজ্ঞান” বনাম “রুশি বিজ্ঞান”-এর এক বহুগ্রাসী শ্লোগান উঠে গেল। এমনকি ইউরোপ আমেরিকার বিজ্ঞানীদের কাজের প্রশংসা করলে কিংবা বিদেশের কোনো পত্রপত্রিকায় একজন সোভিয়েত বিজ্ঞানীর প্রশংসা বেরলেও দেশের ভেতরে তাঁর অবস্থা সঙ্গীন হয়ে যেত। তিন দশক ধরে এর ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক তাণ্ডব চলেছিল। আধুনিক জিনতত্ত্বকে খারিজ করে দিয়ে লাইসেঙ্কোর অপবিজ্ঞান যে স্তালিন এবং সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির জবরদস্ত মদতে প্রায় তিন দশক জমিয়ে রাজত্ব করে গেল, তারও কারণ, জিনতত্ত্ব এসেছিল রাশিয়ার বাইরে থেকে, আর অপবিজ্ঞানটা ছিল নিজেদের ঘরের জিনিস। অর্থাৎ, বিজ্ঞানকে তাঁরা শ্রেণিসম্পদ হিসাবেই দেখেছেন, উৎপাদিকা শক্তি হিসাবে দেখতে পারেননি। স্তালিন নিজের বইতে একথা বলা সত্ত্বেও কাজের বেলায় মারাত্মক ভুল করেছিলেন।

দুঃখের হলেও সত্য, আজও কমিউনিস্টদের এক বড় অংশই স্তালিনের প্রথম সঠিক শিক্ষাটা ভুলে থাকেন, আর অন্যত্র ভুল ভাল কাজগুলিকেই শিক্ষণীয় বলে মনে করেন। সেই ঘরানায় যাঁরা বড় হবেন, তাঁদের সকলেরই মনে হবে, সঙ্গীতের জগতে সুরেরও শ্রেণিচরিত্র আছে, শ্রেণিগত প্রকরণ আছে। থাকতেই হবে, কেন না, মার্ক্সবাদ নাকি শ্রেণি স্বার্থ ছাড়া কোনো সামাজিক সত্তাকেই স্বীকার করে না।

এরকম যান্ত্রিক ভুল সিদ্ধান্তকে বাতিল করতে পারলে এবং সোভিয়েত দেশের সেই সব ঝড় থেকে কিঞ্চিত শিক্ষা নিলেও সঙ্গীতের ক্ষেত্রে আমরা হয়ত ধরতে সক্ষম হব, সুরের সমগ্র সঞ্চয় সমস্ত মানব জাতির যৌথ সম্পদ। দেশে এবং কালে। তার উপর যেমন এল সালভাদর কিংবা তাঞ্জানাইকার দাবি আছে, তেমনই আজকের মানুষেরও কীর্তন ভজন গজলের উপর পূর্ণত দাবি রয়েছে। আজকে যাঁরা আধুনিক কালের গান সৃজন করবেন, তাঁরা কেউ বোধ হয় কীর্তন গজল ভজনে ফিরে যাবেন না (কিছু ব্যতিক্রমী হাস্যরসের গান বাদ দিলে)। কিন্তু তাঁরা যাই সৃষ্টি করুন, তার ভেতরে গজল ভজন রাগপ্রধান লেপ্টে থাকবে। একটা সৌধ নির্মাণের পরে যেমন তার ভেতরে ইট চুন বালি সিমেন্ট অদৃশ্য অন্তর্লীন হয়ে মিশে থাকে। সুতরাং সঙ্গীতের ইতিহাস ও বিজ্ঞান বুঝলে সেই লেপ্টে থাকা উপকরণগুলিকে ভালোবাসতে শিখতে হবে। গান শিখি বা না শিখি, গান বোঝার এই শিক্ষাটা সবাইকেই নিতে হবে। অন্তত গান ভালোবাসলে।

জানি না, সব কথা সবাইকে বোঝাতে পারলাম কিনা।

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *