জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপঃ ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে

অতনু কুমার:

সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে গ্যালিলিও নিজের হাতে বানানো দূরবীণে চোখ রেখে সূর্যকে ঘিরে গ্রহমণ্ডলীর বিচরণ পর্যবেক্ষণ করায় চার্চ তথা রাষ্ট্র তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিল। চারশো বছর পরে বিজ্ঞানীরা যখন জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে তেরোশো কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সির ছবি তুললেন, তাঁদের আর্থিক মদত জোগাল দুই মহাদেশের এক গুচ্ছ রাষ্ট্র। মার্কিন রাষ্ট্রপতি স্বয়ং গোটা দুনিয়ার সামনে সেই ছবি প্রদর্শন করলেন আর ধর্মের ধ্বজাধারীরা “ঈশ্বরের মহান সৃষ্টির দৃশ্য দেখে আপ্লুত হয়ে গেল। এই চারশো বছরে যেমন বদল এসেছে রাষ্ট্র ও সমাজের চরিত্রে, তেমনই গ্যালিলিওর দূরবীণও বহু বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নাসার হাতে এসেছে। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ নিয়ে বলতে গেলে চারশো বছরে এক বার চক্কর কেটে আসা জরুরি। 

টেলিস্কোপের আদিপর্ব

টেলিস্কোপের আবিষ্কারক কে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। হ্যান্স লিপার্সি নামে এক ডাচ চশমা বিক্রেতা ‘দূরের বস্তু দেখার যন্ত্রে’র পেটেন্ট চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন। সেই আবেদন গ্রাহ্য হয়নি। কারণ এই রকম যন্ত্রের ধারণা নাকি আগে থেকেই ছিল। তবে টেলিস্কোপকে মহাকাশের দিকে তাক করেছিলেন গ্যালিলিও, সে বিষয়ে কোনও বিতর্ক নেই। গ্যালিলিও যে দূরবীণ দিয়ে বৃহস্পতির উপগ্রহ, চাঁদের পাহাড়, শুক্রের দশা আর সূর্যের কলঙ্ক পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তাতে ছিল দুটো মাত্র লেন্স– একটা উত্তল অবজেক্টিভ, আর একটা অবতল আই পিস। কয়েক বছর পর জোহান কেপলার অবতল বাদ দিয়ে আইপিস হিসেবেও উত্তল লেন্স ব্যবহার করলেন।

একটা টেলিস্কোপের কার্যকারিতা বিচার করা যায় যে সব মাপকাঠি দিয়ে, তাদের মধ্যে অন্যতম হল বিবর্ধন বা ম্যাগনিফিকেশন আর আলোক সংগ্রাহী ক্ষমতা বা লাইট গ্যাদারিং পাওয়ার। বিবর্ধন নির্ভর করে অবজেক্টিভ আর আইপিসের ফোকাস দৈর্ঘ্যের অনুপাতের উপর।  আলোক সংগ্রাহী ক্ষমতা নির্ভর করে টেলিস্কোপের অবজেক্টিভের ব্যাসের ওপর। পৃথিবীর উপর বন্যপ্রাণী বা পর্বতশৃঙ্গ দেখার জন্য বিবর্ধন বেশি প্রয়োজন। কিন্তু মহাকাশ পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ হল আলোক সংগ্রাহী ক্ষমতা। বহু দূরের নক্ষত্র থেকে লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ পাড়ি দিয়ে ধুঁকতে থাকা আলোকরশ্মির যতটা বেশি পরিমাণ আমরা ধরতে পারব, তত ঐ নক্ষত্রকে ভাল ভাবে দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে। উনিশ শতকের অন্তে জর্জ হ্যালে ইয়র্ক মানন্দিরে যে দূরবীণটি বসান তার অবজেক্টিভ লেন্সের ব্যাস ছিল এক মিটার। 

মহাকাশ পর্যবেক্ষণের আগে টেলিস্কোপকে শক্তপোক্ত ভাবে মাটির সঙ্গে বসাতে হয়। আকাশের বিভিন্ন বিন্দুতে টেলিস্কোপের অবজেক্টিভকে নিখুঁত ভাবে তাক করতে হয়। পৃথিবীর আহ্নিক গতির কারণে সমস্ত মহাকাশের সব কিছুই ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীকে আপাত প্রদক্ষিণ করে। কাজেই যে নক্ষত্র, গ্যালাক্সি বা নেবুলা কে দেখা হচ্ছে, তার অবস্থানকে যাতে টেলিস্কোপ অনুসরণ করতে পারে সেই ব্যবস্থাও থাকা চাই। এই গোটা ব্যাপারটাকে বলা হয় মাউন্টিং। কম্পন বা অন্য কোনও কারণে সামান্য গোলযোগও টেলিস্কোপে বিবর্ধিত হয়ে পর্যবেক্ষণে ভুল হওয়ার কারণ হতে পারে। তাই টেলিস্কোপের মাউন্টিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন লেন্সের আকার এবং ওজন যত বড় হবে, টেলিস্কোপ মাউন্ট করা তত অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই অবজেক্টিভ হিসেবে লেন্সের জায়গা নিয়ে নিল আয়না। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের অবজেক্টিভ লেন্স নয়, প্রাইমারি মিররের ব্যাস– আমরা শুনলাম সাড়ে ৬ মিটার। লেন্সের আর একটা সমস্যা হল বহুরঙা বিকৃতি বা ক্রোমাটিক অ্যাবারেশান। লেন্সের মধ্য দিয়ে যে হেতু আলোকরশ্মি প্রতিসরিত হয় এবং লেন্সের উপাদানের প্রতিসরাঙ্ক যে হেতু আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের উপর নির্ভর করে, তাই বস্তুর নানা রঙের প্রতিবিম্ব নানা জায়গায় তৈরি হয়। দর্পণ থেকে আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হয়, তাই এই সমস্যা থাকে না। অন্য আর এক ধরনের বিকৃতি– একরঙা বিকৃতি বা মনোক্রোমাটিক অ্যাবারেশানের সমস্যা এড়ানো যায় অধিবৃত্তাকার দর্পণ ব্যবহার করে। 

প্রতিফলক দূরবীন

প্রতিফলক দূরবীণ বা রিফ্লেক্টরের প্রথম দুটো নকশা বানিয়ে ছিলেন স্কটিশ গণিতজ্ঞ জেমস গ্রেগরি এবং স্যার আইজ্যাক নিউটন সপ্তদশ শতকের মাঝের দিকে। গ্রেগরির নকশাটাকে অনেকটা বদল করেন ফরাসি ক্যাথলিক যাজক ক্যাসেগ্রেন। এর পর টেলিস্কোপের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য নাম হল উইলিয়ম হার্শেল। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সপ্ত বর্ষব্যাপী যুদ্ধ চলাকালীন উনিশ বছর বয়সে জার্মানি থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ইংল্যান্ডে ঠাঁই বাঁধা এই সঙ্গীতজ্ঞ অবসর সময়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের বইয়ে ডুবে থাকতেন। স্থানীয় এক দর্পণ নির্মাতার কাছে তালিম নিয়ে নিজেই একের পর এক প্রতিফলক দূরবীণ বানাতে শুরু করলেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়টা পরিচিত ৪০ ফুটের টেলিস্কোপ নামে। তার ব্যাস ছিল ১২০ সেন্টিমিটার এবং ফোকাস দৈর্ঘ্য ১২ মিটার। নিজের বোনের সঙ্গে যৌথ ভাবে ইউরেনাস, ইউরেনাস এবং শনির দুটো উপগ্রহ, বেশ কিছু ধূমকেতু আবিষ্কার ছাড়াও তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হল গোটা উত্তর আকাশের জরিপ করা। তখনও ফটোগ্রাফি আসেনি, টেলিস্কোপে চোখ রেখে কাগজে ছবি আঁকতে হত। এ ভাবে প্রায় দু’ হাজার নেবুলার তালিকা তিনি প্রস্তুত করেন। হার্শেলের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র পিতার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যান দক্ষিণ আকাশের জরিপ করে।

৪০ ফুটের টেলিস্কোপ ৫০ বছর ধরে দুনিয়ার বৃহত্তম টেলিস্কোপের আসন ধরে রেখেছিল। ইতিমধ্যে ফটোগ্রাফিক প্লেটের আবিষ্কার টেলিস্কোপের ইতিহাসে একটা বড়সড় বাঁক এনে দিল। এত দিন অবধি টেলিস্কোপের মাধ্যমে খালি চোখে পর্যবেক্ষণ, পরিমাপ ও ছবি আঁকার কাজ করতে হচ্ছিল। ফলত বিবর্ধন বেশি রাখার জন্য ব্যাসের পাশাপাশি টেলিস্কোপের দৈর্ঘ্যও বড় করার দরকার পড়ছিল। চোখের জায়গা ক্যামেরা নিতেই বিবর্ধনের গুরুত্ব কমে গেল। টেলিস্কোপের দৈর্ঘ্য তুলনামূলক ভাবে কম রেখে প্রাইমারি মিররের ব্যাস বাড়ানোর দিকে জোর দেওয়া গেল। স্পেনের লা পালমা দ্বীপের জিটিসি এই মুহূর্তের বৃহত্তম সিঙ্গল অ্যাপারচার অপটিকাল টেলিস্কোপ, যার ব্যাস ১০.৮ মিটার। এ ছাড়া ভূপৃষ্ঠের উপর অন্য যে অপটিকাল টেলিস্কোপগুলো এই মুহূর্তে কাজ করছে, তাদের মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত কেক ১ (ব্যাস ১০ মিটার), হ্যালে টেলিস্কোপ (৫.০৮ মিটার), ককেশাসে বিটিএ-৬ (ব্যাস ৬ মিটার) ইত্যাদি। 

বাতাসের জানালা

বিংশ শতকে মহাকাশ চর্চায় আর একটা দিক খুলে গেল রেডিও অ্যাস্ট্রোনমির আত্মপ্রকাশের ফলে। হার্জ, জগদীশ বসু ও মার্কনির সৌজন্যে রেডিও তরঙ্গ ও মাইক্রোওয়েভকে পাকড়াও করার প্রযুক্তি তত দিনে মানুষের করায়ত্ত। তিরিশের দশকে বেল টেলিফোন ল্যাবরেটরিতে কর্মরত রেডিও ইঞ্জিনিয়ার কার্ল জ্যানস্কি পার্থিব রেডিও তরঙ্গের নয়েজের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে করতে অকস্মাৎ ধনুরাশির দিক থেকে আগত কিছু রেডিও তরঙ্গ খুঁজে পেলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন স্যার স্টানলি হে সূর্যের মধ্যে রেডিও উৎস খুঁজে পেলেন। যুদ্ধ শেষের পর একের পর এক বড় বড় রেডিও টেলিস্কোপ তৈরি হল। রেডিও তরঙ্গ দৃশ্যমান আলোর চেয়ে কোটিগুণ লম্বা, তাই রেডিও টেলিস্কোপের প্রাইমারি মিররও অনেক বড় হয়। চিনের গুয়াংজো প্রদেশে একটা প্রাকৃতিক কার্স্ট ল্যান্ডফর্মের উপর ৩০ টা ফুটবল মাঠের সমান জায়গা নিয়ে কাজ করছে ৫০০ মিটার অ্যাপার্চার স্ফেরিক্যাল টেলিস্কোপ। এখানে একটু বলে রাখা ভালো,  মাইক্রোওয়েভ, রেডিও তরঙ্গ, দৃশ্যমান আলো, অতি বেগুনি রশ্মি, এক্স রশ্মি বা গামা রশ্মি সবই আসলে তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ। তফাৎ শুধু সেই তরঙ্গের দৈর্ঘ্যের। বিষয়টি চিত্র ১ এর মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। আলোকে যদিও শুধুই তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ বলা যায়না, তা আবার ফোটনের অসংখ্য কণার প্রবাহও বলতে হয়, তবে সেই আলোচনায় আমরা আপাতত যাবো না। 

এত দিন অবধি মহাকাশ থেকে আসা দৃশ্যমান আলো নিয়েই জ্যোতির্বিদরা খুশি ছিলেন। জ্যানস্কির আবিষ্কারের পর খেয়াল হল মিটার থেকে সেন্টিমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রেডিও তরঙ্গ যদি মহাকাশ থেকে আসতে পারে, তবে আর একটু ছোট মাইক্রোওয়েভ, অবলোহিত রশ্মি বা আর একটু বড় রেডিও ওয়েভ কেন আসবে না? দৃশ্যমান আলোর চেয়ে ছোট অতি বেগুনি রশ্মি, পরমাণুর আকারের এক্স রশ্মি বা আরও ছোট গামা রশ্মিই বা কী দোষ করল? এখানেই লুকিয়ে আছে বায়ুমণ্ডলের খেলা। মহাকাশ থেকে আগত  তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের বেশিরভাগটাই বায়ুমণ্ডলের কোনও না কোনও স্তর শোষণ করে নেয়। তবে মহানুভব বায়ুমণ্ডল দুটো জানলা ছেড়ে রেখেছে, যেখান দিয়ে বাইরের আলো ভিতরের পৃথিবীতে আসে। আমাদের অসীম সৌভাগ্য যে, এই দুটো জানলার মধ্যে একটা জানলার মধ্যে আমাদের দৃশ্যমান আলো– বেগুনি থেকে লাল একদম খাপে খাপ বসে যায়। এইখানে জানলাটা না থাকলে কী দিন কী রাত, নিকষ কালো অন্ধকার আমাদের ঘিরে থাকত। আর একটা জানলা দিয়ে ছোট রেডিও তরঙ্গ ঢুকতে পারে। অর্থাৎ যেটা বোঝা গেল, তড়িৎ চুম্বকীয় বর্ণালীর বাকিটা ভূপৃষ্ঠে বসে পাওয়া সম্ভব নয়। এখন আমরা কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্য নিয়ে আগ্রহী, তার উপর নির্ভর করছে ভূপৃষ্ঠ থেকে কতটা উপরে উঠতে হবে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে অবলোহিত রশ্মি শোষিত হয় জলীয় বাস্প এবং কার্বন ডাই অক্সাইড দ্বারা। অন্য দিকে অতি বেগুনি রশ্মি এবং আরও ছোট তরঙ্গগুলোকে অনেক উপরে শোষণ করে নেয় ওজোন, অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন। আবার বড় রেডিও তরঙ্গ গুলো বিক্ষিপ্ত হয় আয়নস্ফিয়ার থেকে। তাই পর্বতশৃঙ্গে উঠে, বেলুনের সাহায্যে বা এরোপ্লেনে টেলিস্কোপ বসিয়ে অবলোহিত রশ্মির নাগাল পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু অতি বেগুনি রশ্মিকে ধরতে গেলে মহাশূন্যে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। শুধু তাই নয়, বায়ুমণ্ডলের স্তরে প্রতিসরণ দৃশ্যমান আলোকেও প্রভাবিত করে। টেলিস্কোপের আর একটা গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হল নির্ণায়ক ক্ষমতা বা রিজলভিং পাওয়ার। খালি চোখে আমরা যে সব নক্ষত্র দেখতে পাই, তারা বেশির ভাগই আসলে একাধিক তারার সমন্বয়। নির্ণায়ক ক্ষমতা যত বেশি হবে, টেলিস্কোপ তত কম ব্যবধানে থাকা তারাদের পৃথক ভাবে চিনতে পারবে। বায়ুমণ্ডলের বাধা নির্ণায়ক ক্ষমতাকেও কমিয়ে দেয়।     

আকাশ থেকে মহাকাশে

টেলিস্কোপকে বায়ুমণ্ডলের আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা উঠেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই। ১৯২৩ সালে জার্মান বিজ্ঞানী হেরমান ওবার্থ লেখেন কী ভাবে রকেটের সাহায্যে একটা টেলিস্কোপকে ভূ-কেন্দ্রিক টেলিস্কোপে স্থাপন করা যায়। সোভিয়েত বিজ্ঞানী শল্কোভস্কি এবং মার্কিন বিজ্ঞানী গডার্ড এর সাথে ওবার্থ রকেট সায়েন্সের পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সামরিক গবেষণার সুবাদে রকেট বিজ্ঞানেরও অগ্রগতি ঘটল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন মেতে উঠল মহাকাশ দখলের ঠান্ডা যুদ্ধে। ষাটের দশকে চার্জ কাপল্ড ডিভাইস বা সিসিডি-র আবিষ্কার বিপ্লব ঘটাল টেলিস্কোপ ডিটেক্টরের প্রযুক্তিতে। এর মধ্যে মার্কিন পদার্থবিদ এবং পর্বতারোহী লাইম্যান স্পিৎজার বায়ুমণ্ডলের বাধা পেরিয়ে মহাকাশে একটা বড় টেলিস্কোপ পাঠানোর প্রস্তাব করলেন। স্পিৎজারের স্বপ্ন বাস্তবের রূপ পেল ১৯৯০ সালে, যখন হাবল স্পেস টেলিস্কোপ তার কক্ষপথের উদ্দেশ্যে রওনা হল। হাবল প্রথম স্পেস টেলিস্কোপ নয়। ষাটের দশক থেকেই আমেরিকান, সোভিয়েত, ইউরোপিয়ান, ভারতীয়, জাপানি স্পেস এজেন্সিগুলোর তরফে বহু স্পেস টেলিস্কোপ পাঠানো হয়েছে। স্পিৎজারের নামেই নাসা একটা স্পেস অবজারভেটরি পাঠায় ২০০৩ সালে। হাবল এবং স্পিৎজার নাসার ফোর গ্রেট অবজার্ভেটরির অংশীদার। বাকি দুই শরিক হল চন্দ্র এক্স রে অবজারভেটরি এবং কম্পটন গামা রে টেলিস্কোপ। আমাদের চোখে যেমন শুধুমাত্র দৃশ্যমান বর্ণালীই ধরা পড়ে, ইলেকট্রনিক ডিটেক্টরও তেমনি তড়িৎচুম্বকীয় বর্ণালীর একটা নির্দিষ্ট পরিসরেই কাজ করতে পারে। স্পিৎজার, হাবল, চন্দ্র এবং কম্পটন– এই চার টেলিস্কোপের মাধ্যমে যথাক্রমে অবলোহিত, দৃশ্যমান ও অতি বেগুনি, এক্স রশ্মি এবং গামা রশ্মি– তড়িৎচুম্বকীয় বর্ণালীর বিস্তৃত পরিসরে মহাকাশে অনুসন্ধান চালানোর উদ্দেশ্যেই নাসার এই পরিকল্পনা। 

প্রথম না হলেও আকারে, প্রযুক্তি ব্যবহারে এবং কর্মকাণ্ডের বহুমুখীনতায় হাবল অনন্য। ভূপৃষ্ঠ থেকে খালি চোখে যতটা অনুজ্জ্বল তারাকে দেখা যায়, তার চেয়ে দশ কোটি গুণ কম উজ্জ্বল নক্ষত্রকে শনাক্ত করতে পারা এবং তার আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করা, কয়েক মাইক্রোসেকেন্ড কৌণিক দূরত্বে থাকা ঘটনাকে পৃথক করার মতো সূক্ষ্ম সিসিডি ক্যামেরা এবং বর্ণালী বীক্ষণ যন্ত্র আছে হাবল টেলিস্কোপে। বত্রিশ বছর ধরে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও বিশ্বতত্ত্বে হাবল যে অবদানগুলো রেখেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল হাবল ধ্রুবকের মান তথা মহাবিশ্বের বয়স নির্ধারণ করা। আগের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী মহাবিশ্বের বয়স অনুমান করা হয়েছিল হাজার থেকে দু’হাজার কোটি বছরের মধ্যে। হাবল বলল, মহাবিশ্বের বয়স ১৩৭০ কোটি বছর। প্রায় একশো বছর আগে এডউইন হাবলের গবেষণা প্রমাণ করেছিল মহাবিশ্ব প্রসারণশীল। আজ তাঁর নামাঙ্কিত স্পেস টেলিস্কোপের তথ্য বেশ কিছু ভূপৃষ্ঠের টেলিস্কোপের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে প্রমাণ করল মহাবিশ্বের প্রসারণ ক্রমবর্ধমান। হাবলের নামকরণ সার্থক। এ ছাড়া সৌরমণ্ডলের ভিতর ও বাইরের বহু আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে হাবলের তথ্য থেকে। এর মধ্যে আছে গ্যালাক্সির বিবর্তন লক্ষ্য করা, প্লুটোর উপগ্রহের সন্ধান দেওয়া, কুইপার বেল্টের বরফ জাতীয় গ্রহাণু আবিষ্কার করা ইত্যাদি। এই বছরের মার্চ মাসে প্রাচীনতম নক্ষত্র এরেনডেল আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করে হাবল। এই লেখাটা লেখার সময়েই দেখলাম ২৮০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের এই তারার ছবি তুলেছে হাবলের উত্তরসূরী জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। অথচ নিজের কক্ষপথে স্থাপন হতে না হতেই নজরে আসে হাবলের প্রাইমারি মিররে একটা গণ্ডগোল রয়ে গেছে, দর্পণের আকৃতি যথাযথ হয়নি৷ সৌভাগ্যক্রমে হাবল হল একমাত্র স্পেস টেলিস্কোপ যার কাছে মহাকাশচারীরা গিয়ে সার্ভিসিং করে আসতে পারেন। তিন বছর বাদে প্রথম সার্ভিসিং মিশন ভূপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৭ কিলোমিটার উচ্চতায় ভূসমলয় কক্ষপথে প্রদক্ষিণরত হাবলের কাছে গিয়ে দর্পণ মেরামত করে আসেন। এর পর আরও চারটি সার্ভিসিং মিশন পাঠানো হয়েছে৷

হাবল এর পরবর্তী প্রজন্ম 

মহাবিশ্বের যত গভীরে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে, অর্থাৎ যত প্রাচীন মহাজাগতিক ঘটনা ও বস্তুকে চাক্ষুষ করার চেষ্টা হয়েছে, তত দেখা গেছে ওই সমস্ত ঘটনা ও বস্তু থেকে আগত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ক্রমশ অবলোহিত রশ্মির দিকে সরে যাচ্ছে। এর কারণ মহাবিশ্বের প্রসারণ। হাবলের সূত্র অনুযায়ী, সমস্ত দূরের গ্যালাক্সি আমাদের থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছে। যে গ্যালাক্সি যত দূরে, তার দূরে সরে যাওয়ার গতিবেগও তত বেশি। এখন ডপলার এফেক্টের কারণে কোন তরঙ্গের উৎস দূরে সরে গেলে সেই উৎস থেকে আগত তরঙ্গের দৈর্ঘ্য বেড়ে যায়৷ যে জন্য স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকলে দূরে চলে যাওয়া ট্রেনের বাঁশি ভোঁতা শোনায়। সুতরাং আদিম মহাবিশ্বের আলো পেতে হলে আমাদের খুঁজতে হবে বর্ণালীর অবলোহিত অংশে। অবলোহিত রশ্মি দিয়ে দেখার আরও কিছু সুবিধা আছে। যেমন দৃষ্টিপথের সামনে থাকা মহাজাগতিক ধুলো দৃশ্যমান আলো শোষণ করে নেয়, কিন্তু অবলোহিত রশ্মি প্রায় অবাধে ধুলোর মেঘ পার হয়ে যায়। তা ছাড়া গ্রহ, উপগ্রহের মতো তথাকথিত অনুজ্জ্বল বস্তু দৃশ্যমান আলো বিকিরণ না করলেও অবলোহিত রশ্মি বিকিরণ করে। এই সব কারণে নেক্সট জেনারেশন স্পেস টেলিস্কোপের পরিকল্পনা হয় হাবলের প্রথম সার্ভিসিং মিশন সফল ভাবে কাজ শেষ করার পরই, পরবর্তীকালে যার নামকরণ হবে নাসার প্রাক্তন অধিকর্তা জেমস ওয়েবের নামে। মহাবিশ্বের প্রথম আলোক উৎসের সন্ধান করা, গ্যালাক্সির জন্ম ও বিবর্তন, নক্ষত্র ও গ্রহমণ্ডলীর গঠনের প্রক্রিয়া, বহির্গ্রহ সমূহের বায়ুমণ্ডলের ভৌত-রাসায়নিক বিশ্লেষণ, ভিনগ্রহে প্রাণের তল্লাশ করার দায়ভার বর্তাল নতুন টেলিস্কোপের কাঁধে। 

যতটা সহজে বললাম, ততটা সহজে অবশ্য জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের উৎক্ষেপণ সম্ভব হয়নি। কখনও প্রযুক্তির আধুনিকীকরণের জন্য, কখনও বাজেটের জন্য, কখনও কোভিড অতিমারীর ধাক্কায় বারে বারে বিলম্বিত হয়েছে ওয়েবের যাত্রা। ২০১১ সালে তো ওয়েব প্রকল্প মার্কিন কংগ্রেসে বাতিল হওয়ার উৎক্রম হয়। ওয়েবের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল  নিকৃষ্ট ব্যবস্থাপনা, দুর্বল পরিকল্পনা, আকাশকুসুম প্রত্যাশা এবং অবশ্যই ব্যয়বাহুল্যের। ওয়েবের বাজেট প্রভাব ফেলছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যান্য প্রকল্পের উপরেও। একটা সময় নেচার পত্রিকা মন্তব্য করে, ‘‘ওয়েব টেলিস্কোপ গোটা অ্যাস্ট্রোনমিকে গিলে খাবে।’’ ২০২১-এর ২৫শে ডিসেম্বর ওয়েব যখন অবশেষে আরিয়ন-৫ রকেটের ঘাড়ে চেপে অতলান্তিকের তীরে ফ্রেঞ্চ গুয়ানা থেকে যাত্রা শুরু করল তত দিনে প্রকল্পের বাজেট হাজার কোটি ডলার প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে।  

এখন মুশকিল হল শুধু গ্রহ নক্ষত্র নয়, যে কোনও বস্তুই তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে অবলোহিত রশ্মির বিকিরণ করে। টেলিস্কোপের নিজের দেহ থেকে বিকিরিত অবলোহিত রশ্মি যাতে ডিটেক্টরের চোখে না পড়ে, সে জন্য টেলিস্কোপকে অত্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রায় রাখা প্রয়োজন। আগের ইনফ্রারেড টেলিস্কোপগুলোকে শীতল রাখা হত তরলীকৃত হিলিয়ামের সাহায্যে। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপকে মাইনাস ২২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখে তার পাঁচ স্তর বিশিষ্ট সানশিল্ড। সানশিল্ডের এক একটা স্তরের বেধ মাথার চুলের সমান। ওয়েব কিন্তু হাবলের মতো পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে না। পৃথিবী থেকে পনেরো লক্ষ কিলোমিটার দূরে, সূর্য এবং পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ বল যেখানে সাম্যাবস্থায় থাকে, সেই রকম ল্যাগরাঞ্জ বিন্দু এল-২কে একটা ছোট কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করছে ওয়েব। পৃথিবী ও সূর্যের সাপেক্ষে ওয়েবের আপেক্ষিক অবস্থান একই রকম থাকার ফলে সানশিল্ডের কৌণিক অবস্থানের বদল ঘটানোর প্রয়োজন হয় না। এই সানশিল্ডের একটা পরত ছিঁড়ে যাওয়ার জন্য একাদশতম বার  ওয়েবের উৎক্ষেপণের তারিখ পিছিয়ে যায়। সানশিল্ড ছাড়া জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মূল অংশ আরও তিনটি–  টেলিস্কোপের অপটিকাল সিস্টেম, নানা ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির সেট যার পোশাকি নাম ইন্টিগ্রেটেড সায়েন্টিফিক ইনস্ট্রুমেন্ট মডিউল বা আইএসআইএম এবং এই সব কিছুকে যে বহন করছে সেই মহাকাশযান। সব মিলিয়ে ওজন দাঁড়িয়েছে ৬.২ টন। টেলিস্কোপের প্রাইমারি মিরর তৈরি হয়েছে সোনার প্রলেপযুক্ত বেরিলিয়াম নির্মিত আঠারোটি ষড়ভুজাকৃতি আয়না দিয়ে, যাদের সম্মিলিত সংগ্রাহী ক্ষেত্রফল ২৫ বর্গমিটার। হাবলের তুলনায় ওয়েবের আলোক সংগ্রাহী ক্ষমতা ৬ গুণ বেশি। অবলোহিত টেলিস্কোপ হিসেবে স্পিৎজারের সঙ্গে তুলনা করলে যা দাঁড়ায় ৩৪ গুণ। আইএসআইএম এর মধ্যে রয়েছে ক্যামেরা ও বর্ণালী বীক্ষণ যন্ত্র, যাদের কাজ অপটিকাল সিস্টেমে গৃহীত নিকট ও মধ্য অবলোহিত রশ্মি দিয়ে ছবি তোলা ও আপতিত আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করা এবং ফাইন গাইডিং সেন্সর, যার কাজ টেলিস্কোপকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর দিকে নির্দেশ করা।

২০২২ সালের ২৪শে জানুয়ারি, অর্থাৎ পৃথিবী থেকে রওনা হওয়ার মাসখানেক পরে ওয়েব তার এল-২ ল্যাগ্র্যাঞ্জ বিন্দুতে নিজের কক্ষপথে পৌঁছয়। যাত্রাপথেই ওয়েব আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে আয়না, সানশিল্ড এবং অন্যান্য অঙ্গগুলোকে কাজের জন্য প্রস্তুত করে নেয়। গ্রহ নক্ষত্রের ছবি তোলার আগে ফুলের পাপড়ির মতো মেলে ধরা আয়নার একটা সেলফি তুলেও পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়। ১২ই জুলাই তারিখে ওয়েবের তোলা ছবি এবং বর্ণালী বিশ্লেষণের তথ্য জনসমক্ষে পেশ করলেন বিজ্ঞানীরা। ওয়েবের তোলা প্রথম দফার ছবিগুলোর মধ্যে যেমন রয়েছে সাড়ে সাত হাজার আলোকবর্ষ দূরে করিনা নেবুলায় নক্ষত্রের জন্মমুহূর্ত, আড়াই হাজার আলোকবর্ষ দূরে মৃত্যুপথযাত্রী নক্ষত্র থেকে নিক্ষিপ্ত গ্যাস ও ধুলোর নেবুলা, তিরিশ কোটি আলোকবর্ষ দূরে পাঁচটি গ্যালাক্সির মহাজাগতিক নৃত্য, তেরোশো কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের ছবি, তেমনই রয়েছে এগারোশো আলোকবর্ষ দূরে ওয়াম্প-৯৬ নক্ষত্রকে আবর্তনরত গ্যাসীয় বহির্গ্রহের বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের স্বাক্ষর আর আমাদের ঘরের কাছে পৃথিবীর বড়দা বৃহস্পতি ও তার চাঁদ ইউরোপার অদেখা ছবি। পরের দফায় পঞ্চাশ কোটি আলোকবর্ষ দূরে কার্টহুইল গ্যালাক্সির ছবি দেখিয়েছে ওয়েব। মনে করা হয়, একটা স্পাইরাল গ্যালাক্সির সঙ্গে একটা ছোট গ্যালাক্সির সংঘর্ষের পরিণতিতে জন্ম নিয়েছে গাড়ির চাকার মতো দেখতে এই গ্যালাক্সি। এই সব ছবি কিন্তু চোখের পলকে ওঠেনি। তার আঠারোটি দর্পণখণ্ড বারো ঘণ্টা ধরে তাকিয়েছিল লক্ষ্যবস্তুর দিকে। যত বেশি সময় ধরে পর্যবেক্ষণ হবে, তত বেশি পরিমাণে আলো ঢুকবে– এই হল হিসেব। এই ধরনের ছবিকে বলা হয় ডিপ ফিল্ড ইমেজ। ছবি টবি তুলে মিডিয়ায় দিয়ে ওয়েব বিশ্রাম নিচ্ছে এমন নয়। কাছের ও দূরের, মহাকাশের বিভিন্ন অংশের তথ্য সে সংগ্রহ করে চলেছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গিয়ে কাজ করছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। এখন অপেক্ষা, মহাবিশ্বের কোন কোন রহস্যের উন্মোচন হয় ওয়েবের হাত ধরে।

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *