কৃষি বিল এবং এর প্রভাব

অরিন্দম মজুমদার

দিল্লীতে চলা কৃষক আন্দোলন এবং তাকে কেন্দ্র করে জনমানসে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে তা অন্তত অনেক মনুষকে চাষবাসের মত ভুলে যাওয়া একটা বিষয় নিয়ে আবার আগ্রহী করে তুলেছে। কিন্তু অনেক প্রশ্ন অনেকের ভিতর ঘোরাফেরা করছে। প্রথমত বিলটাতে খারাপ কি আছে। শুধু ওই পাঞ্জাব হরিয়ানার কৃষকরাই কেন আন্দোলন করছে? কেন অন্য রাজ্যে সেরকম আন্দোলন চোখে পড়ছে না? কর্পোরেটরা যদি চাষীদের কাছ থেকে খাদ্যশস্য কেনে তাতে চাষীর ক্ষতির কোনো সম্ভাবনা আছে কি?  পাঞ্জাবের কৃষকরা নাকি ধনী কৃষক, তাহলে তাদের কি ক্ষতি হচ্ছে এই আইনে। আসুন বিষয় গুলোকে ধরে ধরে আলোচনা করা যাক।

প্রথমেই একটি বিষয়ের দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। হয়ত অনেকেই জেনে থাকবেন যে টাটারা বিগ বাস্কেট নামে একটি অনলাইন খাদ্যশস্য বিতরণকারী সংস্থাকে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা দিয়ে তার ৮০ শতাংশ শেয়ার কিনে নিতে চলেছে। অর্থাৎ এই খাদ্যশস্য চাষীদের কাছ থেকে কিনে বিক্রী করার ব্যবসায় শুধুমাত্র আাদানী বা আম্বানীর মত গুজরাটি ব্যবসায়ীরাই নয়, প্রায় সব বড় কর্পোরেট মাঠে নেমেছে একসাথে। আর নামবেই না বা কেন? বিশ্বের সবথেকে ধনী লোকটির নাম এখন শেফ বেজোস, আমাজনের মালিক। অর্থাৎ তেল বা অস্ত্র ব্যবসা নয়। পৃথিবীতে সব থেকে ধনী হওয়ার, সব থেকে বেশী ফায়দা লোটার জায়গা এখন রিটেল বা খুচরো ব্যবসা। আর এই সোনার খনির খুব সোনায় তোলা হয়েছে ভারতে। ভারতে মুদীর দোকান বা ফুটপাথে বসে সব্জী বিক্রীর যে বাজার তার সামগ্রিক পরিমান প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার। আর তার মধ্যে অনলাইন খাদ্যশস্য বা সব্জী বিক্রির বাজার মাত্র ৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এখনও ভারতের প্রায় ৯৯ শতাংশ খাদ্যশস্যের বাজারই হল মুদীর দোকানি বা ফুটপাথে বসা ব্যবসায়ীদের হাতে। বিগত ৩-৪ বছরে যে ভাবে ইন্টারনেটের ব্যপক ব্যবহার শুরু হয়েছে তাতে এই অনলাইন খুচরো ব্যবসার বৃদ্ধির হার ৪০০ শতাংশে পৌচছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বড় কর্পোরেটদের খাদ্যশস্যের বাজারে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নিয়ে এসেছে এই তিনটি কৃষিবিল।

কি লেখা আছে এই বিলগুলোতে। এই তিনটি আইনের নাম হল, 

১) Farmers’ Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Act, 2020 

২) Farmers (Empowerment and Protection) Agreement on Price Assurance and Farm Services Act, 2020

৩) Essential Commodities (Amendment) Act, 2020

এই লেখাটি যারা পড়ছেন, তাদের সবার কাছে আমি অনুরোধ করব যে একবার এই বিলগুলি ইন্টারনেট থেকে পড়ে নিন। খুব বড় নয়। মাত্র ৩-৪ পাতা করে। এবার এক এক করে আলোচনা করে নেওয়া যাক বিল গুলিতে কি আছে। 

প্রথম বিলটিতে মুলত APMC বা সরকারি মান্ডির বাইরে আলাদা করে চাষীর সাথে ব্যবসা করার রাস্তার কথা বলা হয়েছে। এই বিলটি বলছে যে মান্ডির বাইরে চাষীর কাছ থেকে যদি কেও শস্য কেনে অথবা চাষী যদি নিজে গিয়ে কোন গুদামে তার ফসল দিয়ে আসে তাহলে সেই আদান প্রদানের উপর কোন রকম ট্যাক্স রাজ্য সরকার লাগাতে পারবে না। আবার এই একই আইন বলছে যে শুধুমাত্র একটা প্যান কার্ড আছে এমন যে কোন লোকই চাষীর কাছ থেকে খাদ্যশস্য কিনতে বৈধ। আর রাজ্যসরকার গুলি তাদের অন্য কোন লাইসেন্স দিতে পারবে না। এই প্রথম আইন আরও বলছে যে আন্তঃরাজ্য বেচাকেনায় রাজ্য সরকার গুলির কোন নিয়ন্ত্রন থাকবে না। এই আইনের মানেটা কি তাহলে। এর মানে ধরুন, চেন্নাই বা মুম্বাই বন্দরের কাছাকাছি কোন এক সংস্থা এক বড় গুদাম বানাতে পারে। যেখানে সে সারা ভারতের যেকোন রাজ্য থেকে খাদ্যশস্য কিনে এনে মজুত করতে পারে। সেই কেনা বেচার উপর রাজ্য সরকার কোন ট্যাক্স বসাতে পারবে না। এবার সেই গুদামে মজুত খাদ্য শস্য রফ্তানি কারি সংস্থা বিশ্ব বাজারের দাম ওঠা নামা অনুযায়ী বিদেশে রফ্তানি করতে পারবে, কোন বাধা ছাড়া। 

আচ্ছা কতটা খাদ্যশস্য মজুত করতে পারে কোন সংস্থা। এর জন্য আপনাকে দেখতে হবে তৃতীয় আইনটি। আর এর উত্তর হল অফুরন্ত। মানে তৃতীয় আইনটি বলছে যে যেকোন মজুতদার যত খুশী খাদ্য শস্য জমা করতে পারে। আগে অবশ্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য হিসাবে চাল, গম, ডাল, তেল এবং তেল উৎপাদনকারি শস্য গুলিকে গন্য করা হত। এবং এদের মজুতের উপর নিয়ন্ত্রন ছিল। এখন আর কোন নিয়ন্ত্রন নেই। এখন যে কেও যত খুশী এগুলোকে মজুত করতে পারে। তাছাড়াও বর্তমান আইনের নিয়ম অনুযায়ী সে বাধ্যও নয় এটা জানাতে যে কত খাদ্য দ্রব্য সে মজুত রেখেছে। অর্থাৎ এই তিন নম্বর আইনের বলে যে কোন পুঁজিপতি যত খুশি মজুত করে প্রকাশ্যে মজুতের পরিমান না জানিয়ে এক মিথ্যা চাহিদার পরিবেশ তৈরী করতে পারে। দাম সারা বছর বাড়িয়ে রাখতে পারে। আর নিজেই সেই বেশী দামের সুযোগ নিতে পারে। এমন কি এই মজুত হতে পারে সম্পূর্ণ রুপে আপনার রাজ্যের বাইরে যার উপর আপনার রাজ্য সরকারের কোন নিয়ন্ত্রন নেই। 

তিন নম্বর আইনে মজুতের উপর শুধু মাত্র একটি পরিস্থিতিতেই নিয়ন্ত্রনের কথা বলা আছে । আর তা হল পচে যাওয়া খাদ্য দ্রব্যের ১০০% এবং না পচে যাওয়া শস্যের ৫০% মুল্য বৃদ্ধি হলে। অর্থাৎ ৩০ টাকার আলু ৬০ টাকা না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্র সরকার মজুতের উপর কোন নিয়ন্ত্রন আরোপ করবে না। এখন সমস্যা হল, এই মুল্য বৃদ্ধির হিসাব এক বছর অন্তর সময় নিয়ে হিসাব করা হয় সাধারনত। তার মানে এই বছর আলু ৩০ টাকা থেকে ৫৫ টাকা হলে কোন নিয়ন্ত্রন হবে না, কারন তা ১০০% র কম মুল্য বৃদ্ধি। পরের বছর ৫৫ টাকা থেকে ১০০ টাকা হলে তাতেও কোন নিয়ন্ত্রন আরোপিত হবে না। কারন তাও ১০০% এর কম মুল্য বৃদ্ধি। তার পরের বছর ১৯০টাকা হলেও আলুর মজুত নিয়ন্ত্রন করা হবে না। অর্থাৎ আগামী ৪ বছরে আলুর দাম যদি ৩০ টাকা থেকে ১৯০ টাকা অব্দি পৌছয় তাতে কোন ভাবেই এই আইন আলুর মজুতের উপর বা রফ্তানির উপর নিয়ন্ত্রন নিয়ে আসতে দেবে না। যেখানে ৭% মুল্য বৃদ্ধি হলেই মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যায় সেখানে এই ১০০% বা ৫০ % পর্যন্ত মুল্যবৃদ্ধি হতে দেবে বিনা বাধায়। 

এবার আসা যাক দ্বতীয় আইনে। এই আইন বলছে যে চাষী এবং কোন কোম্পানীর ভিতর চুক্তি হলে কিভাবে তা কার্যকর হবে। চুক্তিচাষের সাধারন নিয়মাবলীর উল্লেখ আছে এই আইনে। কিন্তু সমস্যটা হচ্ছে এই আইনের ১৯ নম্বর ধারাকে নিয়ে। চাষী এবং কোম্পানীর ভিতর কোন রকম বিবাদ হলে তা কি ভাবে মেটানো যাবে তা বলা হয়েছে এই আইনে। প্রথমে এই বিবাদ মেটানোর জন্য স্থানীয় স্তরে একটি কমিটি বানাতে বলা হয়েছে। সেই কমিটিতে বিবাদের মিমাংসা না হলে চাষী বা কোম্পানী সাব-জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে, মানে লোয়ার কোর্টে বিচার চাইতে পারেন। কিন্তু এই ১৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে যে বিচার চলা কালীন কোন পক্ষই উচ্চতর আদালত থেকে কোন স্থগিতাদেশ আনতে পারবেন না। এটি নিয়েই সব থেকে বড় প্রশ্ন তৈরী হচ্ছে। অর্থাৎ নিম্ন আদালতে যদি বড় কম্পানীর উকিলরা টাকার জোরে কোন কৃষক বিরোধী রায় বেড় করে নিতে পারেন, সে ক্ষেত্রে প্রায় কৃষকের কিছুই করার নেই। তবে একটি বিষয় নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে কিছু ভ্রান্ত প্রচারও হচ্ছে যে এই আইন নাকি চাষীর জমি কেরে নেওয়ার আইন। অর্থাৎ চাষী যদি টাকা ধার নিয়ে চাষ করে শোধ দিতে না পারে তাহলে কোম্পানী গুলি তাদের জমি নিয়ে নিতে পারে। দ্বিতীয় আইনটিতে এটি খুব স্পষ্ট করেই লেখা আছে যে চাষীর সঙ্গে টাকা পয়সাগত কোন দেওয়া নেওয়া জমি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা যাবে না। 

তবে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই তিনটি আইনে কোথাও মিনিমাম সাপোর্টিং প্রাইস(MSP) বা নূন্যতম সহায়ক মুল্য নিয়ে একটি কথাও লেখা নেই। বিজেপি বার বার চাষীদের কাছে এই বলে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে যে মান্ডির বাইরে তাদের কাছ থেকে পূঁজিপতিরা মান্ডির থেকেও বেশী দামে নাকি ফসল কিনে নেবে। কিন্তু এই আইনগুলিতে কোথাও তার নিশ্চয়তার কথা নেই। কৃষক নেতাদের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বারবার মিটিংএও এই বিষয়টাই কৃষক নেতারা তুলেছিলেন। কিন্তু একবারের জন্য এই নূন্যতম সহায়ক মূল্য নিয়ে একটি বারের জন্যও কোন আইন আনতে রাজি হননি অমিত শাহ। তার মানে কর্পোরেটদের উদ্দেশ্যটা খুব পরিষ্কার। তারা নূন্যতম সহায়ক মূল্যের থেকে কমেই কিনতে চায়। আর এটা তারা নিশ্চিন্তে করতে পারবে কারন এই আইন তাদেরকে বিপুল পরিমান খাবার মজুত করার এবং তার পরিমান প্রকাশ না করার অধিকার দিয়েছে। অর্থাৎ ধান কেনার সময় কর্পোরেটরা বেশ কিছু লক্ষ্য কুইন্টাল ধান বাজারে ছেড়ে দিয়ে ধানের দাম ফেলে দিতে পারে। আবার ধান কেনার সময় পেরিয়ে গেলে অতিরিক্ত ধান বিদেশে রপ্তানী করে ধানের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। আর যেকোন মোনোপলি ব্যবসাতে এটাই হয়ে থাকে। তাই যে সমস্ত বিজেপি সমর্থক বা চাষীরা এই আশায় বসে আছেন যে এই আইন চাষীদের বেশী দাম দেওয়ার জন্য আনা হয়েছে তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। কেননা সেটা করার হলে অমিত শাহরা এই তিনটি আইনে অন্তত একবার নূন্যতম সহায়ক মূল্য কথাটা উল্লেখ করত।  

তাহলে এতক্ষন আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার ভাবে বুঝতে নিশ্চয় পারছেন যে এই তিনটে আইনে এমন কিছুই নেই যা সরাসরি চাষীকে উপকৃত করতে পারে। বরং এই তিনটি আইন বানানো হয়েছে সম্পূর্ণ এই দিকে তাকিয়ে যে চাষীদের কাছ থেকে কর্পোরেটরা যেন বিনা বাধায় যত খুশি খাদ্যশস্য কিনে মজুত করতে পারে। তাহলে সমস্ত আন্দোলন শুধু পাঞ্জাব হরিয়ানা অঞ্চলেই কেন হচ্ছে? পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতের পূর্ব দিকের রাজ্যগুলিতে এর প্রভাব সেরকম লক্ষ্য করা যাচ্ছে না কেন? কারন কয়েকটা হিসাব থেকেই পাওয়া যাবে। সবুজ বিপ্লবের পর পাঞ্জাব হরিয়ানা অঞ্চলে মান্ডি ব্যবস্থার যথেষ্ট পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল। এই মান্ডি গুলো থেকে রাজ্য সরকার ট্যাক্স পেত বলে যে রাজ্য সরকার যখনই এসেছে ক্ষমতায় তারা কেও মান্ডি ব্যবস্থা ভেঙে দেয় নি। তার ফল স্বরুপ এই মান্ডিগুলোতেই নূন্যতম সহায়ক মূল্যে ফসল বিক্রি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই রাজ্যগুলোর কৃষকদের। পাঞ্জাবে যত ফসল উৎপাদিত হয় তার প্রায় ৮৬% ফসল নূন্যতম সহায়ক মূল্যেই বিক্রি হয়। সেখানে পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যাটা ১০ শতাংশও নয়। ধানের ৬০ কেজি বস্তা পিছু যেখানে সহায়ক মূল্য ১১৩০টাকা সেখানে এই বছরও বেশীর ভাগ চাষীই তাদের বেশীর ভাগ ধান ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা বস্তায় বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। এমন অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের চাষীরা বুঝেই উঠতে পারছেন না যে এই নূন্যতম সহায়ক মূল্য তুলে দেওয়ার ফল কি হতে চলেছে। উল্টে বিজেপি সমানে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে যে চাষীরা এবার থেকে ফড়ে বা মিল মালিকদের যে টাকায় ধান বিক্রি করত তার থেকে অনেক বেশী দামে ধান বা ফসল বিক্রি করতে পারবে কর্পোরেটদের। পাঞ্জাবে যেখানে এক একটি কৃষক পরিবারের গড় আয় মাসে ১৮০০০ টাকা সেখানে পশ্চিমবঙ্গে সেটা মাত্র ২৫০০ টাকা। তাছাড়াও FCI যত খাদ্যশস্য কেনে সারা ভারতে তার ৫০%ই কেনা হয় পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ থেকে। তাই চাষ কোন লাভজনক জীবিকা নয় পশ্চিম বঙ্গে। চাষের সাথে যে সমস্ত ক্ষুদ্র কৃষকরা জড়িত তাঁরা ছদ্ম বেকার ছাড়া কিছু নন। মাসে ৫০০০ টাকার কোন চাকরি পেলেও লোকে আর চাষ করে না পশ্চিমবঙ্গে। সেই পরিস্থিতি ফসলের দামের জন্য আন্দোলনে নামা তাদের কাছে একান্তই অপ্রাসঙ্গিক বিষয়। অনেকে হয়ত ভাবছেন তাহলে সিঙুর নন্দীগ্রামে কি হল। আসল সত্যি এটাই যে ওঠা ছিল জমি রক্ষার আন্দোলন। জমি মানুষের একটা সম্পদ। বিশেষ করে সেই জমি যদি হাই রোডের ধারে হয়। সবাই জানে সেই জমির দাম ব্যঙ্কে রাখা টাকার থেকে অনেক দ্রুত বাড়ে। তাই জমি খুব মুল্যবান সম্পদ। কিন্তু কৃষি খুব অলাভজনক জীবিকা।    

যাই হোক, তাহলে কৃষি বিলের এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কি করনীয়? আর বিজেপি বিরোধী রাজ্য সরকার গুলিই বা কি করতে পারে।

বিজেপি বিরোধী রাজ্য সরকার গুলি কি করতে পারে তা করে দেখিয়েছে কংগ্রেস শাসিত পাঞ্জাব। যেহেতু প্রথম কৃষি বিলে বলা  হয়েছে যে কৃষি মান্ডির বাইরে সরকার ট্যাক্স নিতে পারবে না বা ফসল কেনার উপর কোন বিধি নিষেধ কার্যকর করতে পারবে না, তাই পাঞ্জাব বিধানসভা একটি বিল পাশ করেছে যে যেন গোটা রাজ্যকেই কৃষি মান্ডি ঘোষণা করা হয়। এই বিলে আদৌ রাষ্ট্রপতি সই করবেন কিনা সেটা নির্ভর করছে ভারতের আরও কত রাজ্য এই রকম বিল তাদের বিধান সভায় পাশ করাতে পারছে। কিন্তু সারা রাজ্যকে কিষান মান্ডি ঘোষনা করার মানেটা কি? মানে এটাই যে রাজ্যের সমস্ত ফসল সরকার নিজে কিনে নেবে। এটা কি করা সম্ভব? আসুন পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকিয়ে দেখা যাক। পশ্চিমবঙ্গের উৎপাদিত সমস্ত ধানের আনুমানিক পরিমান ১৩ কোটি কুইন্টাল। আর আলু প্রায় ১০-১২ কোটি কুইন্টাল। অর্থাৎ ১১৩০ টাকা প্রতি ৬০ কেজি এই হিসাবেই যদি কেনা হয় তাহলে পশ্চিমবঙ্গে সমস্ত ধান এবং আলু সরকার কিনে নিতে পারে প্রায় ৪০০০০ কোটি টাকায়। যে পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক বাজেট ব্যায় বরাদ্দ প্রায় ২লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বিষয়টা খুব সহজ না হলেও খুব অসম্ভবও নয়। আর এই ৪০০০০ কোটি টাকা সরকার দান করে দিচ্ছে না। মানুষের কাছে বিক্রির মাধ্যে এর ৯০% টাকাই উঠে আসবে। শুধু দরকার বছর ৫-৬ সময় নিয়ে ধীরে ধীরে পরিকাঠামো তৈরী করা এবং এই ব্যবস্থাকে কার্যকর করা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ভোটের আগে আর বিধানসভা খোলারই সাহস করছেন না। যদি রাতারাতি তার সরকার পরে যায়। তাহলে পাঞ্জাবের মত বিল তিনি কিভাবে পাশ করাবেন। 

আমরা কি করতে পারি? বর্তমান পরিস্থিতিতে পাঞ্জাবের মত গুটিকয়েক রাজ্য বাদ দিয়ে ভারতবর্ষে কৃষক আর কর্পোরেটের মাঝে কোন সরকার নেই। সারা দেশ জুড়ে আজ কৃষক আর কর্পোরেটের মাঝে আছে কৃষকদের ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নগুলিকেই কিছু করতে হবে। এই সময় কৃষকদের আরও বেশী সংঘবদ্ধ করা একান্ত প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রবন্ধের শুরুতেই একটা বিষয়ের উল্লেখ করেছিলাম যে ভারতের কৃষি পণ্যের মাত্র 1% মাত্র কর্পোরেট মাধ্যমে কেনা বেচা হয় আর বাদবাকি 99% এখনও ছোট বড়ো মুদিখানা বা সব্জি দোকানের মাধ্যমে হয়। এই 99% বাজারের দখল করতে কর্পোরেট রা যে পরিমাণ বদ্ধপরিকর হয়ে নেমে পড়েছে সেটাই ফুটে উঠেছে বিজেপির কৃষি বিলের মধ্যে। 99% কৃষিপণ্যের বাজার দখল করতে কর্পোরেট রা ইন্টারনেট ও স্মার্ট প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে ও আরও বেশি বেশি করবে। সরকার যদি এগিয়ে না আসে তাহলে কৃষকদের এই প্রযুক্তির সম্পূর্ন সুফল নেওয়া এই মুহূর্তে নিজেদের একক প্রচেষ্টায় সম্ভব নয়, তবে সমষ্টিগত উপায়ে কিছুটা সম্ভব।  আর সেটা করা যেতে পারে সমবায় তৈরী করার মাধ্যমে। সমবায় করে কিছু আশু পদ্ধতির নির্মাণ করতে হবে আর তার সঙ্গে কৃষকদের এযাবৎকালের মধ্যে অনেক অনেক বেশি পরিমাণ রাজনৈতিক হয়ে উঠতে হবে, যাতে রাজ্যে রাজ্যে সরকারগুলো তাদের নীরব নিষ্ক্রিয় অবস্থা থেকে কৃষি বিপণন ব্যবস্থায় সরাসরি ভূমিকা নিতে এগিয়ে আসতে বাধ্য হয়।  পশ্চিমবঙ্গে বর্গা আন্দোলনের ফলে ছোট ছোট জমির কৃষক তৈরী হওয়ার পর তাদের কে নিয়ে সমবায় বানানোর প্রচেষ্টাটা যে একেবারে একসময় হয় নি তা নয়। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা ছিল উৎপাদনভিত্তিক। মানে ছোট ছোট চাষ করার পরিবর্তে বড় করে চাষ করার চেষ্টা। কিন্তু পাশাপাশি লাগোয়া জমির সমস্ত কৃষকে এক করতে পারা একটা সমস্যার বিষয় ছিল। এবং সেই ধরনের সমবায় খুব একটা সফল হয় নি। এখন য়ে ধরনের সমবায় প্রয়োজন তাহল মূলত ফসল সংগ্রহের সমবায়। ভবিষ্যতে চিরকাল আমাদের দাবী থাকবে যে সরকার এই সমবায়গুলি থেকে সরাসরি ফসল কিনে বিক্রীর রিটেল সিস্টেম তৈরী করুক। যদি সেই দাবী আাদায় করতে না পারা যায় নিকট ভবিষ্যতে তাহলে অন্তত এই সমবায়গুলি কর্পোরেট এবং চাষীর মাঝে একটা দেওয়াল হয়ে দাঁড়াক। আর যদি সত্যিই কিছু প্রগতিশীল মানুষ এগিয়ে আসেন এবং উদ্যোগ নেন তাহলে এটা ভাবাও অসম্ভব নয় যে আমুলের মত বা ইউরোপে কুপের মতো এই সমবায়গুলিরই যৌথ রিটেল চেন তৈরী করা যাবে। যারা বাজারে চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠে আাসবে বিগ-বাস্কেট বা জিও-মার্টের।  

========================== সমাপ্ত =======================================

+ posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *