সহজিয়ার পরম সুহৃদ অধ্যাপক কমলেশ ভৌমিক স্মরণে

কুন্তল ঘোষ

২০২১ সালের আগস্ট মাসে যখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শেষের পথে, যে মারণ ঢেউ সামলাতে গিয়ে এদেশের সরকার ও প্রশাসনের কঙ্কালসার চেহারাটা বেরিয়ে পড়েছে। তখন, চেনা-পরিচিত, বন্ধু-আত্মীয় বহু মানুষ যখন অকালে একে একে চলে যাচ্ছেন আমাদের অনেকেরই চারপাশ থেকে। তার মধ্যে কে করোনা আর কে স্রেফ আয়ুষ্মান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চরম ব্যর্থতার শিকার, তা যখন বুঝে ওঠাই দুষ্কর, সেই সময় কেই বা রেখেছি সদ্য অশীতিপর গেইল ওমবেটের চলে যাওয়ার খবর? ক’জন বাঙ্গালীই বা জানেন ভগিনী নিবেদিতারই মত এদেশের দরিদ্র মানুষের মধ্যে এই স্বাধীনতোত্তর ভারতবর্ষে বছরের পর বছর কাজ করে গেছেন এই বিদেশিনী। দলিত, পিছিয়ে পড়া জনজাতি, দরিদ্র মুসলমানদের মধ্যে তার কাজের ক্ষেত্র মারাঠাভূমি বলেই কি এই অজ্ঞানতা? কিন্তু দেখুন, যারা খবর রাখার তাঁরা কিন্তু রাখেন। রবীন্দ্রনাথের মত বুদ্ধিজীবী হয়ত একজনই হন। কিন্তু সহজিয়া পত্রিকা পেয়েছিল অন্ততঃ কিছুদিনের জন্য এমন একজন সমাজসচেতন ও সংবেদনশীল বুদ্ধিজীবীকে যিনি ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’-এর লয়ে সদ্য প্রয়াতা গেইল ওমবেট ও তার অবদানকে আমাদের চিনিয়ে দিয়েছিলেন সহজিয়ার পাতায়। তিনি অধ্যাপক কমলেশ ভৌমিক, কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে বিগত ১৩-ই এপ্রিল, ২০২৩ মধ্যরাতে যিনিও আবার আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন বিদেশে তাঁর মেয়ের কাছে কয়েকদিন কাটাতে গিয়ে। সহজিয়ার আত্মপ্রকাশের পর প্রথম সংখ্যা হাতে পেয়েই তিনি নিজে থেকে খোঁজ নেন পত্রিকার পিছনে কারা আছেন। সহজিয়ার মতো একটি পত্রিকার অভাব এই বাংলায় তিনি অনুভব করেন এবং সহজিয়ার মাধ্যমে তিনি আশার আলো দেখতে শুরু করেন। কোভিড সময়েই তিনি সহজিয়ার সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্যদের সঙ্গে ‘গুগুল মিট’-এর মাধ্যমে বাঙালি মুসলিম সমাজের মধ্য থেকে উঠে আসা মুক্তচিন্তার মানুষদের কাজের ক্ষেত্র নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করেন এবং সহজিয়া পত্রিকাকে সবরকম সহযোগিতা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। তারপর থেকে আমৃত্যু সহজিয়া পত্রিকার অন্যতম উপদেষ্টা থাকেন। সহজিয়া পত্রিকা তার সূচনালগ্ন থেকে বিজ্ঞান মনস্ক আধুনিক মানবিক সমাজের কথা বলতে অঙ্গীকার করে একদিকে যেমন বিজ্ঞানের তথ্য ও যুক্তির প্রসার করতে চেয়েছে, অন্যদিকে বিভিন্ন সময়ে এক একটি উন্নত সমাজের পতনের কারণগুলিও অনুসন্ধান করতে চেয়েছে। তাই সহজিয়ার অনুরোধে লেখেন “বাগদাদে বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ“।

যেমন গেইল ওমবেটকে চিনিয়েছেন, সেভাবেই কমলেশ ভৌমিক একজন সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী হিসাবে নিজের জাত চিনিয়েছেন বারেবারে। ফেরা যাক আরেক ১৩-ই এপ্রিলের কথায়। ২০১৪ সাল তখন। রাইট টু এডুকেশন, পঃ বঃ-এর পক্ষ থেকে কলকাতার উপকন্ঠে চকেরভেড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে আম্বেদকর ও জ্যোতিরাও ফুলের জন্মজয়ন্তী পালন করার কর্মসূচীতে অংশ নিতে গিয়ে কমলেশদা অনুভব করলেন যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাংলায় মারাঠী মহাত্মা ফুলের পরিচিতি অতি সামান্য, এবং একটা কারণ অবশ্যই বাংলা ভাষায় ফুলে সম্পর্কে প্রামাণ্য লেখাপত্রের অভাব। যেমন ভাবা তেমন কাজ — এটাই ছিল তাঁর চরিত্র। কোন কাজ ফেলে রাখার মানুষ তিনি নন। ফলে  নেহাই পত্রিকায় শুরু হল জ্যোতিরাও ফুলের জীবন ও কর্মকান্ড নিয়ে তাঁর ধারাবাহিক রচনা, যার পরিণতি একটি প্রমাণ সাইজের বই যা নিষ্পলক পত্রিকা গোষ্ঠি আর কয়েকদিনের মধ্যেই প্রকাশ করবে। আবার স্টিফেন হকিং-এর কর্ম ও জীবন সম্পর্কে উৎসাহীদের কৌতুহলও তিনি মিটিয়েছেন অক্লেশে বাংলায় আরো একটি চমৎকার বই লিখে।  দেহব্যবসার বৈধতাদান কেন্দ্রিক বিতর্ক থেকে নয়া শিক্ষানীতি — এমন বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয়াবলীতে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধসম্ভার রেখে গেছেন তিনি। সে কথায় পরে আসছি।

বর্তমানে যা বাংলাদেশের অংশ, সেই ঢাকায় আজ থেকে প্রায় ৭৮ বছর আগে, 1945 সালের 23শে জুলাই,  জন্ম নেন শ্রী কমলেশ ভৌমিক। তাঁর যখন বয়েস দু বছর, সে সময়ে দেশ স্বাধীন হল ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে।  1947 সালের আগস্টের মধ্যরাতে সেই স্বাধীনতার আনন্দ উৎসব একই সাথে ডেকে আনল ধর্মীয় দাঙ্গা এবং দেশ ভাগের দুঃস্বপ্নও, যা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের “সভ্য” শাসনের অধীনে ইতিমধ্যেই লুণ্ঠিত নিঃশেষিত ভারতবর্ষকে দেওয়া বিদায়ী “উপহার”। দেশভাগের কারণ এবং ফলশ্রুতি এদেশে লুজ কনফেডারেশনের বদলে রাজ্যের হাতে অতি সীমিত ক্ষমতা দিয়ে কেন্দ্রীভূত শাসনের মডেল, যার শেষ পরিণতি ভারতীয় ভাগ্যাকাশে ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্রের আজকের অশনি সংকেত। এই গোটা পর্যায়টাই আবর্তিত হয়েছে কমলেশ ভৌমিক ও তাঁর বয়সী মানুষদের জীবনকে ঘিরে।

দুবছরের বালক কমলেশ তার পরিবারের সাথে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত তার জন্মভূমি ছেড়ে চলে এল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলা নদীয়ার হাবিবপুরে। সেখানকার স্কুলের পাঠ শেষ করে রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালনাধীন বেলুড় বিদ্যামন্দির কলেজে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালইয়ের স্নাতকোত্তর পাঠ সাঙ্গ করে, রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ লাগোয়া সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের গবেষণাগারে প্রবেশ। তখন তাঁর বয়েস ২৪ মাত্র। ষাটের দশকে, তিনি যখন ছাত্র ছিলেন, সম্ভবত তাঁর কলেজে পড়ার সময়কালে, তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে এসেছিলেন, এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য মেহনতী মানুষের চলমান লড়াইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই নদীয়ায় তাঁর এলাকার একজন কমিউনিস্ট নেতা, সম্ভবতঃ গৌর কুন্ডু, নামটি উল্লেখ করতেন, যিনি তাঁকে এই আর্থ-সামাজিক দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায়ের লড়াইয়ে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। সাহা ইন্সটিটিউট-এ কমলেশ ভৌমিক যাঁর তত্ত্বাবধানে গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন, সেই বিনায়ক দত্ত রায়, তিনিও যে শুধু একজন কৃতী পদার্থবিদ ছিলেন, তা নয়। 1950-এর দশকে কণা পদার্থবিদ্যা নিয়ে বাঘা বাঘা নোবেলজয়ীদের মাঝে বিচরণ করে প্রিন্সটনে পিএইচডি করেছিলেন বিনায়ক দত্ত রায়। কিন্তু শুধু তাই নয়, তিনিও ছিলেন একজন সাম্যবাদী ধারার সংগ্রামী মানুষ, যিনি যে কোন অন্যায় দেখলেই স্থান-কাল-পাত্র বিচার না করেই জ্বলে উঠতেন এবং তার জন্য সংগ্রাম-সংগঠনও গড়ে তুলেছেন।  

কমলেশ ভৌমিক এই সমস্ত দিক থেকেই ছিলেন তার একজন যোগ্য উত্তরসূরী। তিনিও নিজেকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন কেবল একজন চমৎকার বহুমুখী বিজ্ঞানী হিসেবেই নয়, একজন দরদী বুদ্ধিজীবী, একজন গভীর মানবতাবাদী এবং চারপাশের দুর্গন্ধযুক্ত সমস্ত কিছুর আপোষহীন সমালোচক হিসেবে, তা সে নিজের কর্মক্ষেত্রেই হোক বা তার বাইরের জগতে বৃহত্তর সমাজের মধ্যেই হোক। ১৯৯৮ সালে যখন পোখরানে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ করে ভারত সরকার, তখন তার প্রধান কান্ডারী যে ডিপার্টমেন্ট অব এটোমিক এনার্জি, তারই অন্যতম সংস্থা (স্বশাসিত) সাহা ইন্সটিটিউট-এ অধ্যাপনার চাকরি করেন তিনি। কিন্তু সেই মুহূর্তের সেই উগ্রজাতীয়তাবাদী উন্মাদনাকে উপেক্ষা করে, শ্রী ভৌমিক কর্মস্থলেই প্রতিবাদী সভা আয়োজন করেন, সহকর্মীদের সংগঠিত করেন। আবার একজন পদার্থবিদ হিসেবেও, তাঁর মাস্টারমশাই বিনায়কদার মতই তিনিও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি বিনায়ক দত্ত রায়ের তত্ত্বাবধানে উচ্চ শক্তির পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে তাঁর গবেষণা জীবন শুরু করেন এবং তার পরবর্তী পর্যায়ে একটি সম্পূর্ণ নতুন বিষয় গবেষণার জন্য বাছাই করলেন — জীবপদার্থবিদ্যা বা বায়োফিজিক্স। এই যাত্রা অতি রোমাঞ্চকর। আজ যখন এই লেখা লিখছি, তখন রুশ সেনানায়ক এক প্রিগোঝিন যেমন রোমহর্ষক গৃহযুদ্ধে নেমেছে যুদ্ধবাজ ও স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট পুটিনের বিরুদ্ধে, ইউক্রেনের দিশা বদল করে তিনি এখন মস্কো অভিমুখে, সেদিন ও এক প্রিগোঝিন, যিনি ১৯৭৭-এ রসায়নের নোবেল পুরস্কার বিজেতা, তিনি কমলেশ ভৌমিকের মত পদার্থবিদদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন দিশা বদল করে পদার্থবিদ্যার জ্ঞানভান্ডার কাজে লাগিয়ে প্রাণের রহস্য, বিবর্তনের রহস্য উন্মোচনে। শ্রী ভৌমিক এটা এত ভালোভাবে নিজেই চর্চা করে শিখে ফেললেন যে তিনি ভারতের সর্বাধিক নামজাদা মেডিকেল ইনস্টিটিউটগুলিতে, যেমন দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেস (AIIMS), পরে ব্যাঙ্গালোরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেস (NIMHANS)-এ ওই বিষয়ে লেকচারার ও এসিস্টেন্ট প্রফেসর পদে নিযুক্ত হন। তিনি এই ইনস্টিটিউটগুলিতে ডাক্তারি ছাত্রদের কয়েকটি এমডি থিসিসের তত্ত্বাবধানও করেন। এরপর যখন তিনি শিক্ষক হিসাবে সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স (SINP)-এ ফিরে এসে থিওরি ডিভিশনে যোগ দেন, তখন সেখানে তিনি নিউরোবায়োলজিতে গাণিতিক মডেলিংয়ে পিএইচডি ছাত্রছাত্রীদের তত্ত্বাবধান করেন। সেখান থেকে আবার কিছুকাল পরে তিনি ইলেকট্রনিক্স বিভাগে চলে যান। এখানে তিনি সম্পূর্ণ নতুন একটি গবেষণার বিষয়ে নিজেকে আবারো নিযুক্ত করেন যা কম্প্যুটার সায়েন্সের এবং অধুনা অতি প্রচারিত তথ্যবিজ্ঞানের (Data Science)-এর কাছাকাছি বিষয়। তিনি সিলিকন নিউরন এবং সিলিকন ভিশনের মত কৃত্রিম মেধা বা AI-এর খুব সমসাময়িক ধারণাগুলি নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন এবং  নিউরোমর্ফিক ইমেজ প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে একজন গবেষক ছাত্রের (বর্তমান লেখক) ডক্টরেট থিসিসের তত্ত্বাবধান করেন। এভাবেই কণাপদার্থবিদ্যা থেকে, জীবপদার্থবিদ্যা হয়ে তিনি চলে আসেন সিগন্যাল প্রসেসিং, ইনফর্মেশন প্রসেসিং ও তথ্যবিজ্ঞানের –এর জগতে। SINP থেকে অবসর নেওয়ার পরেও তিনি গবেষণা চালিয়ে যান এবং তার তত্ত্বাবধানে লিখিত পিএইচডি থিসিসগুলি ইনফোর্মেশন জ্যামিতি ও মনোজগতের পদার্থবিদ্যা বা সাইকোফিজিক্স-এর গন্ডীতে প্রবেশ করে। এই গবেষণা ও চর্চারই প্রতিফলন সহজিয়ার পাতায় ‘মানুষের অনুভূতি’-এর বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যা, এবং মস্তিষ্ক ও গণকযন্ত্র বা কম্প্যুটারর তুলনামূলক আলোচনা। শুধু দক্ষ পদার্থবিদ ও প্রতিবাদী সংগ্রামী মানুষ-ই নন,  কমলেশ ভৌমিক সেই বিরল প্রজাতির মানুষ যিনি অনায়াসে নিজের বহু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লুকিয়ে রেখে অত্যন্ত মামুলি কোন অবদানের জন্য অন্যান্য সহকর্মী এবং ছাত্রদের দক্ষতার ভূয়সী প্রশংসা করতে পারেন। শিক্ষক হিসাবেও তিনি ছিলেন বিনায়ক দত্তরায়ের ঘরানার। এদের কাছে আপনি যে কোনো বিষয় বুঝতে যান, তা যে তাদের সব সময়ের চর্চার বিষয়ই হতে হবে, তাও কিন্তু নয় — তথাপি দেখা যেত যে তারা খুব দ্রুত সেখান থেকে মূল বিষয়গুলো বের করে খুব স্পষ্ট ভাষায় আপনার সামনে উপস্থাপন করবেন। বিনায়কদার তো তুলনাই নেই, ফিজিক্স থেকে কিভাবে শেক্সপীয়ারে অতি সাবলীলভাবে ঢুকে পড়া যায়, তা চোখে না দেখলে অবিশ্বাস্যই মনে হবে। আসলে যাকে মানুষ বলে, “জন্মগত শিক্ষক”, এঁরা ছিলেন তাই। আর কমলেশদা তো একদম নীরবে স্টেজের পিছনে কাজ করতে জানতেন। এই গুণের জন্য একজন প্রতিবাদী মানুষ হলেও, যখন জীবনের গতিপথে প্রশাসনিক দায়িত্ব নিতে হয়েছে, সেখানেও তিনি অত্যন্ত সফল। যে কোনও সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে গেলে তিনি তাঁর সাধ্যের সর্বোচ্চ দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করতে কখনও পিছুপা হননি। সহজিয়া পত্রিকা যেমন ভাষা তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে মাননীয় রাধাপদ দাস রচিত একটি প্রবন্ধ “আর্য কোনও জাতি নয়, আবার ভারতের আদিবাসিন্দাও নয়” পেয়ে সেটিকে আধুনিক বিজ্ঞানের জেনেটিক্স প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে। অতি দ্রুততায় তৈরি করে দেন “মানুষের উদ্ভব এবং পরিযান” নিয়ে একটি প্রবন্ধ। সেখানেও দ্বর্থহীনভাবে ঘোষণা করেন ভাষাতত্ত্বের সাহায্যে দাঁড় করানো প্রমাণগুলি অনেক বেশি  অকাট্য

বারাসাতে যে রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্থাপন করে, একেবারে প্রথম ইঁট গাঁথা থেকে তার সমস্ত শিক্ষণ ও প্রশাসনিক দায়িত্ব বর্তায় প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক অশোকরঞ্জন ঠাকুর ও প্রথম রেজিস্ট্রার অধ্যাপক কমলেশ ভৌমিকের ওপর। নিজস্ব ঘর নেই, কর্মী নেই। সম্বল বারাসাত গভর্নমেন্ট কলেজের খানকতক ঘর। তারই একটা ঘরে একটা সিলিং পাখা ভাগ করে বসতেন দুজন আদর্শবাদী কর্মী পুরুষ, ভিসি ও রেজিস্ট্রার।  মাস্টার্স কোর্স পড়তে আসছেন যারা তারা অনেকেই তাদের পরিবারের first generation learner, একটা বড় অংশ বারাসাতের আশেপাশের গ্রামগুলি থেকে আসা মুসলিম পরিবারের মেয়েরা। সমস্ত বিল্ডিং থেকে নতুন নিয়মকানুন, নতুন সিলেবাস , নতুন শিক্ষক নিয়োগ, সব বিষয়ে তাদের অ-আ-ক-খ থেকে শুরু করতে হল। বিজ্ঞানের কোর্সের জন্য ল্যাবরেটরি প্রস্তুত করা সময়সাপেক্ষ। কুছ পরোয়া নেই। ভিসি-রেজিস্ট্রারের পাশে হাজির তাদের বহু প্রাক্তন সহকর্মী — বিশেষতঃ পদার্থবিদ্যায় কোলকাতার অন্যতম সেরা শিক্ষকরা; এমনকি কমলেশ ভৌমিকের পূর্বোল্লিখিত মাস্টারমশাই সত্তরোর্ধ স্বনামধন্য বিনায়ক দত্ত রায় পর্যন্ত ছুটে এসেছেন, সুদূর গড়িয়ার বাড়ি থেকে বারাসাতে। ছোট-বড় অজস্র সমস্যা শ্রী ভৌমিক হাসিমুখে অত্যন্ত পারদর্শিতার সাথে সমধান করেছেন এই পর্বে, যার ফলশ্রুতিতেই আজ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে সম্পূর্ণ নতুন এই রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়টি। শুধু প্রশাসনিক দায়িত্ব-ই বা কেন, শিক্ষক হিসাবেও তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুল দায়িত্ব পালন করেছেন। পদার্থবিদ্যা ও ক্যম্পুটার সায়েন্স — দুই বিভাগেই তিনি নিয়মিত ক্লাস নিয়েছেন। এর আগে West Bengal University of Technology-তে তিনি গণিত ও স্ট্যাটিস্টিক্সের ক্লাস নিয়েছেন; ক্লাস নিয়েছেন কলকাতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে,  এবং পরে কেন্দ্রীয় সরকারে আরেকটি স্বশাসিত সংস্থা National Institute of Pharmaceutical Education and Research (NIPER)-এও।

আমাদের এখানকার শিক্ষাজগতের নিয়মানুসারে অবসরগ্রহণের পর ৭০ বছর বয়স অবধি কোন শিক্ষককে ছাত্রদের পড়ানোর জন্য আমন্ত্রণ করা যায়, তার পরে আর নয়। ২০১৫ সালে ৭০ বছর পূর্ণ হওয়ার পর ঘুরে ঘুরে ছাত্র পড়ানোর ব্যস্ততা তার কমল, মনে প্রাণে শিক্ষক এই মানুষটি দুঃখ পেলেন, কিন্তু বিনিময়ে  তার কাজের বহুমুখীনতা প্রকাশ পেল আরো নানা দিকে। স্টিফেন হকিংয়ের মৃত্যুর পরে,  তিনি   এই অনন্যসাধারণ লড়াকু বিজ্ঞানীর গবেষণার কাজ ব্যাখ্যা করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সভাঘরে একটি চমৎকার বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং পরে হকিং-এর জীবনের উপর বাংলায় একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনী লিখেছিলেন যা Center for Studies in Science and Society (সেস্টাস) থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া আরো বহু সামাজিক-বৈজ্ঞানিক-রাজনৈতিক বিষয়ে তিনি এই পর্বে বক্তৃতা দেন ও লেখালেখি করেন যা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সহজিয়ার প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই তিনি ছিলেন তার বন্ধু। সাম্প্রতিক সময়ে তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলির বিষয় ছিল স্কুলশিক্ষা, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রগুলিতে কেন্দ্রীয় সরকার অনুসৃত নয়া শিক্ষানীতির বিশদ বিশ্লেষণ ও তার ক্ষুরধার সমালোচনা।

তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলি (প্রায় ৬ মাস) শ্রী ভৌমিক আনন্দে কাটিয়েছিলেন তাঁর পরিবারের প্রিয়জনদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।  তিনি সেদেশে থাকাকালীনই একদা তাঁর ভিয়েতনাম ভ্রমণ ও সেই দেশটি সম্পর্কে নানা অভিজ্ঞতার পাশাপাশি ইতিহাস-ভূগোল-রাজনৈতিক উপলব্ধির সঙ্গে বেড়ানোর হাতছানিতে ভরা তাঁর লেখা একটি বই – “চল যাই ভিয়েতনাম” — নেহাই প্রকাশ করেছিল ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউটের অডিটোরিয়ামে। বিনায়ক দত্ত রায়, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যদের হাতে গড়া বিজ্ঞানী-বিজ্ঞানকর্মী-গবেষক ছাত্রদের যৌথ মঞ্চ জ্যাকারি ছিল তাঁর অতি প্রিয় সংগঠন। বিদেশ থেকে ফিরেই জ্যাকারির সহযোদ্ধাদের সঙ্গে চকলেট সহযোগে দেখা করার কথা ছিল তাঁর। সে ফেরা আর হল না। বিদেশের মাটিতেই দেহ রাখলেন তিনি, যিনি তার অতীব পাণ্ডিত্য সত্ত্বেও, চিরকাল ছিলেন এদেশের মাটি, মানুষ আর তার অজস্র গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মিলেমিশে।

 [লেখক বর্তমানে আই এস আই, কলকাতায়, মেশিন ইনটেলিজেন্স ইউনিটের সহযোগী অধ্যাপক। সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এ তিনি যখন ডক্টরেট করেন, তখন তাঁর গাইড ছিলেন অধ্যাপক কমলেশ ভৌমিক।]

Website | + posts