বাগদাদে বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ

কমলেশ ভৌমিক

সহজিয়া মূদ্রণ: জুলাই, ২০২১, ঈদ সংখ্যা

ভূমিকা

ইতিহাসের অগ্রগতির সাথে সাথে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন দেশ বিজ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। নগরসভ্যতার প্রথম উন্মেষ ঘটেছিল ইরাকে এবং তার প্রায় সাথে সাথেই বা হয়ত একটু আগেই আফ্রিকায় মিশরে। সেই সময় মিশরে অনেকগুলি স্বাধীন ছোট ছোট জনপদ, ধীরে ধীরে একটি কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্রগঠনের প্রয়াস নিচ্ছিল। নীল নদের অববাহিকায় উৎপাদিত ফসল ছিল এই জনপদগুলির মূল চালিকাশক্তি। অধিক পরিমাণে উন্নত জাতের ফসল পাওয়ার জন্য সৃষ্টি হয়েছিল উন্নত সেচব্যবস্থার। কখন বন্যা আসবে তার হিসাব করতে গিয়ে তারা পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক গতি প্রায় নির্ভুলভাবে কষে ফেলল। মিশরীয়রাই প্রথম ৩৬৫ দিনে বছর আর ৩০ দিনে মাসের সৃষ্টি করেছিল। ফসলের হিসাব রাখার জন্য সৃষ্টি হল পাটিগণিতের ও ভগ্নাংশের। কিছু বীজগণিতের ধারণাও শুরু হয়েছিল। নীলনদের বন্যার পর নিজেদের জমি সঠিকভাবে খুঁজে বার করার জন্য জন্ম নিল জ্যামিতির। তারা বৃত্তের ক্ষেত্রফল বার করতে জানত। বিভিন্ন ধরণের পিরামিডের আয়তন ও পৃষ্ঠদেশের ক্ষেত্রফলও হিসাব করতে পারত। তখনও সমাজে মেয়ে পুরুষের ভেদাভেদ ছিল না বা ক্রীতদাসপ্রথা শুরু হয় নি। বিজ্ঞানের আলোচনায় সবাই অংশ নিত। তাই বিজ্ঞান সাবলীল গতিতে এগিয়ে যেতে পেরেছিল। পরবর্তী কালে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার অধিকর্তা নিজেকে গোটা দেশের অধীশ্বর বা ফারাও হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। শুরু হয় বিভিন্ন রাজবংশের। এই সময় থেকেই মিশরে বিজ্ঞানের অগ্রগতি থমকে দাঁড়িয়ে গেল। এরপর মিশরের ফারাওরা আরও কয়েক হাজার বছর দাপটে রাজত্ব করেন বটে, কিন্তু বিজ্ঞানের আর কোনও লক্ষণীয় সংযোজন চোখে পড়ে না। সেই সময় কিছু লোক রাজাদের অন্তর্কলহের সুযোগ নিয়ে রাজাদের সাহায্যে সমাজে নিজেদের জন্য একটা উচ্চ শ্রেণী বা পুরোহিত সম্প্রদায় তৈরি করে ফেলল। সুকৌশলে সমাজের সাধারণ লোকেদের ভেতর এই ধারণা গড়ে দেওয়া হল যে রাজা হলেন ঈশ্বরের প্রতিভূ আর পুরোহিতরা হলেন ঈশ্বরের কাছের লোক। পুরোহিতরা বলল, “সব বিষয়ে প্রশ্ন করতে নেই। বিপদে পড়লে আমাদের কাছে এস। আমরা ভগবানের অভিশাপ থেকে তোমাদের মুক্ত করব। অন্যথা মৃত্যুর পর কঠিন শাস্তির জন্য প্রস্তুত থেকো।” এই পরিবেশে  বিজ্ঞানের গবেষণা অসম্ভব। বিজ্ঞানের সাধনা মিশর থেকে অন্যত্র চলে গেল। মনে রাখা প্রয়োজন, বিজ্ঞান বিকাশের প্রথম শর্ত হল: যে কোন লোকের যে কোন বিষয়ে প্রশ্ন করার অধিকার সুরক্ষিত থাকতে হবে। এই স্বাধীনতা যে সমাজ দেয় না, সেখানে বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটতেই পারে না। এছাড়াও বিজ্ঞানের পরিবেশের জন্য আরও কিছু শর্ত আছে। সেগুলি ধীরে ধীরে আলোচনায় আনছি।

মিশর থেকে বা মিশর-ব্যাবিলন-সুমের থেকে বিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু চলে গেল গ্রীসে। মিশরের মত গ্রীসও ছিল কয়েকটি ছোট ছোট নগর রাষ্ট্রের সমষ্টি। যদিও আদিম সমাজে স্বীকৃত স্ত্রী-পুরুষের সমান অধিকার ততদিনে সামাজিক ধারণা থেকে বিসর্জিত হয়ে গেছে, কিন্তু গ্রীসেও কোন পরাক্রমশালী সম্রাট বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছিল না। তাই স্বাধীন চিন্তা করার কিছুটা পরিবেশ ছিল। বলা হয় গ্রীসের স্বর্ণযুগ ছিল ৫০০ থেকে ৩০০ খ্রীঃ পূঃ। এই সময়েই জন্মেছিলেন, সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল এবং চিকিৎসক হিপোক্রেটিস। স্বর্ণযুগের বেশ আগে থেকেই নতুন ধরণের চিন্তাধারা প্রকাশ পাচ্ছিল। ৬০০ খ্রীঃ পূর্বাব্দে থেলস্‌ (Thales) প্রকৃতির ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন, সব প্রাকৃতিক ঘটনাই কেবলমাত্র পদার্থের ধর্মের ওপর নির্ভর করে, কোন ঐশ্বরিক শক্তির ওপর নির্ভর করে না। এই প্রথম বস্তুবাদের ভিত্তিস্থাপন হল। একের পর এক জন্ম নিলেন অ্যানাক্সিমাণ্ডার (Anaximander), জেনোফেন্স (Xenophanes), পিথাগোরাস (Pythagoras), পারমেনিডেস (Parmenides)।  স্বর্ণযুগে সক্রেটিস তার ছাত্রদের ডেকে বললেন, “কারও কোন কথা বিশ্বাস করবে না, এমন কি আমার কথাও নয়। বার বার প্রশ্ন করবে। প্রয়োজন হলে বিতর্ক করবে। যুক্তিবাদের মাপকাঠিতে সত্যের বিচার করবে।” সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ভয় পেল যে পরবর্তি প্রজন্ম যদি যুক্তিবাদের ওপর ভিত্তি করে চলে, তাহলে তাদের সব প্রতিপত্তি শেষ হয়ে যাবে। তারা সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দিল। তার সুযোগ্য ছাত্র প্লেটো বিজ্ঞানকে জনসাধারণের মধ্যে আরও প্রসারিত করলেন। বিজ্ঞান একটা সামগ্রিক চেহারা নিল প্লেটোর ছাত্র অ্যারিস্টটলের হাতে। এর পর এলেন ইউক্লিড, আর্কিমেডিস। অ্যারিস্টার্কাস বললেন পৃথিবী সূর্য্যের চারদিকে ঘোরে, সূর্য্য স্থির থাকে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে শুরু হল গ্রীসে বিজ্ঞানের অবক্ষয়। মোটামুটি তৃতীয় থেকে চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে বিজ্ঞান অপসারিত হয়ে অপবিজ্ঞানের যুগের সূচনা হল। ঐতিহাসিকরা গ্রীসে বিজ্ঞানচর্চার বিলুপ্তিকরণের জন্য দায়ী তিনটি প্রধান কারণের উল্লেখ করেন। (১) ক্রীতদাসপ্রথা, (২) নারীদের সামাজিক মর্যাদার বিলোপ এবং (৩) ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক বৈষম্য। গ্রীক সাম্রাজ্যের পতনের পর পরাক্রমশালী রোমান সম্রাটরা দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীর এক বৃহৎ অংশ নিজেদের শাসনে রাখতে পেরেছিলেন বটে, কিন্তু বিজ্ঞানের সে রকম কোনও বিকাশ এই যুগে হয় নি। খুব সম্ভব অতিরিক্ত ক্রীতদাস-নির্ভর সমাজে বিজ্ঞান চর্চার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়।

বিজ্ঞান সাধনার কেন্দ্রবিন্দু চলে আসে গ্রীস থেকে ভারতে। সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই ভারতবর্ষে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যথেষ্ট এগিয়ে ছিল। কিন্তু বিজ্ঞানের স্ফূরণ শুরু হয় ৫০০ খ্রী পূর্বাব্দে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের পর। বুদ্ধদেবের সব চাইতে বড় অবদান হল, তিনি সাধারণ মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সুযোগ এনে দিয়েছিলেন। বৌদ্ধযুগে সব চাইতে উন্নতি ঘটেছিল চিকিৎসা শাস্ত্রে। চরক, সুশ্রুত, নাগার্জুন, জীবক চিকিৎসা বিজ্ঞানে অসাধারণ বিপ্লব এনে দিয়েছিলেন। পৃথিবীতে প্রথম শল্য চিকিৎসার প্রবর্তন করেন সুশ্রুত। ঐ সময় অধ্যাপকরা নিজের হাতে শব ব্যবচ্ছেদ করে মানবদেহ সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করার জন্য ছাত্রদের উৎসাহ দিতেন। গণিত, বিশেষ করে বীজগণিত, ত্রিকোনমিতি এবং জ্যোতির্বিদায় লক্ষণীয় অগ্রগতি ঘটে। ইতিমধ্যে শুরু হয়ে যায় বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয় আর সেই সাথে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরুত্থান। ব্রাহ্মণরা ক্ষমতা হস্তগত করার পর তাদের প্রধান শত্রু হিসাবে বৌদ্ধদের চিহ্নিত করে। বিজ্ঞানীদের মধ্যে সব চাইতে জনপ্রিয় ছিলেন বৌদ্ধ চিকিৎসকরা এবং জ্যোতির্বিদরা। তাই এদের সামাজিক মর্যাদা নীচে নামিয়ে আনা হল। বলা হল, সামাজিক অনুষ্ঠানে এদেরকে বসতে দেওয়া হবে মেষপালকদের সাথে। জ্যোতির্বিদদের অপসারিত করে, সেখানে জ্যোতিষচর্চাকে প্রাধান্য দেওয়া হল। বিজ্ঞান আবার দেশান্তরী হল।

বাগদাদে বিজ্ঞানের সূচনা

পঞ্চম শতাব্দীতে রোম সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপ প্রায় হাজার বছরের জন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে প্রবেশ করেছিল। বিস্তীর্ণ শুষ্ক আরবভূমিতে দুটি নগর সভ্যতা  ম্যাকোরাবা এবং ইয়াথ্রিবের পত্তন হয়েছিল। এদের বর্তমান নাম হল যথাক্রমে মক্কা ও মেদিনা। এই দুই শহর ছাড়া আরবের মরুভূমিতে ইতস্তত ঘুরে বেড়াত বিপুল সংখ্যায় বিভিন্ন যাযাবর উপজাতি। এদের ভেতর ভাষাগত, ধর্মগত এবং স্বভাবগত বৈসাদৃশ্য ছিল প্রচণ্ড। নিজেদের ভেতর এরা ক্রমাগত কলহে লিপ্ত হয়ে থাকত। শহর দুটিতেও এই উপজাতিদের বিভিন্ন ধরণের মন্দির থাকত। এই অদ্ভুত বিশৃঙ্খল পরিবেশে অন্যতম প্রভাবশালী উপজাতি কুরাইশ গোত্রের বনি হাশিম বংশে আনুমানিক ৫৭০ খ্রীষ্টাব্দে জন্ম নিলেন হযরত মহম্মদ (সা:) বা হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন মেষপালক। পরে বড় হয়ে তিনি ব্যবসায়ী হন। অত্যন্ত সত্যবাদী এবং বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী হিসাবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তার প্রচণ্ড শারীরিক শক্তি, লোকবল বা অর্থবল কিছুই ছিল না। তখনকার দিনের মানদণ্ডেও তাকে অশিক্ষিত বলাই সমীচীন। কিন্তু তার ছিল এক অসামান্য মানসিক শক্তি, যার সাহায্যে তিনি প্রবলতম প্রতিপক্ষকেও তার প্রবর্তিত আদর্শের দিকে আকৃষ্ট করতে পারতেন। খ্রীষ্টান ও ইহুদীদের মত তিনিও একেশ্বরবাদী ছিলেন এবং শেষ বিচারের দিনকে মান্যতা দিতেন। ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রেরিত দূতের মাধ্যমে তিনি জানতে পারলেন যে তিনিই শেষ নবী। তার একমাত্র কর্তব্য হল ঈশ্বরের বাণীগুলি সাধারণের মধ্যে প্রচার করার। ৬১০ খ্রীষ্টাব্দে তিনি প্রচার শুরু করলেন এক নতুন ধর্মের, যার নাম ইসলাম ধর্ম। ইসলাম শব্দের অর্থ (ঈশ্বরের কাছে) আত্মনিবেদন। (আরবীয় ভাষায় এর উচ্চারণ অ্যাল ইসলেইম, কিন্তু বর্তমান প্রবন্ধে সমস্ত শব্দবন্ধে সঠিক আরবীয় উচ্চারণ রাখা যাবে না। সেজন্য মার্জনা চাইছি।) এই ধর্মের আশ্চর্য্ আকর্ষণে যাযাবার গোষ্ঠীগুলি একত্রিত হয়ে এক শক্তিশালী, ধর্মপরায়ণ ও যোদ্ধা জাতির সূচনা করল। মাত্র দুশ বছরের মধ্যে ইসলামের বাণী সুদূর রাশিয়া থেকে সিন্ধু সীমান্ত, ইউরোপ থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিস্তৃত অঞ্চলে পৌঁছে গেল এবং দলে দলে সাধারণ মানুষ এই নতুন ধর্মকে গ্রহণ করল। খলিফারা (শেষ নবীর উত্তরাধিকারী) ছিলেন যুগপৎ রাজ্যশাসন এবং ধর্মীয় অনুশাসনের সর্বোচ্চ পদাধিকারী, কাজেই ইসলামিক সাম্রাজ্যে সব চাইতে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। প্রথম চারজন খলিফা ছিলেন র‍্যাসিদান (al-Rashidun) বা হযরত মহম্মদ (সা:)-এর কাছে সঠিকভাবে শিক্ষিত প্রত্যক্ষ অনুগামী। ৬৩২ খৃষ্টাব্দে শেষ নবীর দেহান্তের পর থেকে ৬৬১ সাল অবধি তারা এই সাম্রাজ্য শাসন করেন। এরপর আসেন উমায়াদ রাজবংশ। পরে ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দে আব্বাসিদ রাজবংশ উমায়াদ রাজবংশকে পরাজিত করে ইসলাম সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হয় এবং তাদের রাজধানী দামাস্কাস থেকে বাগদাদে স্থানান্তরিত করে। ৮০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যেই বাগদাদ শহর বিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে বিখ্যাত হয়ে উঠল। অদ্ভুত ঘটনা হল, এই পাঁচ দশকের মধ্যে বাগদাদে কোনও উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিকের জন্ম হয় নি। তাহলে কিসের সুবাদে হঠাৎ বাগদাদ বিজ্ঞানে এত বিখ্যাত হল? এর উত্তরটাও খুব অদ্ভুত। বাগদাদ বিজ্ঞানের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছিল অনুবাদ সাহিত্যের মাধ্যমে বা অনুবাদ আন্দোলনের জোয়ারে। দেখা গেল হঠাৎ বিজ্ঞান ও দর্শনের প্রাচীন পুঁথিগুলি আরবি ভাষায় অনুদিত হতে থাকল এবং সেই বই পড়ার জন্য সাধারণের মধ্যে প্রবল আগ্রহ দেখা দিল। এর কারণ কি? বিভিন্ন ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন তত্ত্ব দিয়ে এই অদ্ভুত ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আমার কাছে তার একটিও গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় নি। আমি এই অভূতপূর্ব ঘটনার একটি ঐতিহাসিক কারণ নীচে দিচ্ছি। তবে এই বিশ্লেষণ সম্পূর্ণভাবে লেখকের ব্যক্তিগত। তা সঠিক হতেও পারে, নাও হতে পারে।

আমার মনে হয় বাগদাদে বিজ্ঞান আন্দোলনের মূল অনুপ্রেরণা এসেছিল ধর্ম থেকে। ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া আদেশগুলি হযরত মহম্মদ (সা:) তাঁর শিষ্যদের বলতেন। তারা সেগুলি কন্ঠস্থ করত এবং আবৃত্তি করত। এই আদেশগুলি পরবর্তীকালে কুর্‌আন ,সব চাইতে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। আরবি ভাষায় কুর্‌আন অর্থ আবৃত্তি। হযরত মহম্মদ (সা:) যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন এই ধর্মগ্রন্থ শুধুমাত্র শ্রুতি ও স্মৃতির মাধ্যমে ধরে রাখা হত, ঠিক যেমন বেদের সম্বন্ধে শোনা যায়। তৃতীয়  খলিফা উঠম্যান আইবন্‌ আফেইন (Uthman ibn `Affan) ৬৪৪ থেকে ৬৫৬ সাল রাজত্ব করেন। তার নেতৃত্বে কোরাণের ১১৪টি সুরা লিপিবদ্ধ করা হয়। শেষ নবীর আদেশ ছিল কোরাণের প্রচলন যেন সাধারণ মানুষের ভাষায় করা হয়। বুদ্ধদেবও তার ধর্মোপদেশ সংস্কৃতে প্রচার না করে সাধারণের ভাষা পালিতে প্রচার করার আদেশ দেন। শেষ নবীর নির্দেশ মাথায় রেখে প্রবল প্রতাপান্বিত খলিফা ধর্মগ্রন্থটি আরবি ভাষায় লেখার নির্দেশ দেন। সত্যি কথা বলতে কি, ষষ্ঠ শতাব্দীতে আরবি ভাষা বা লিপি কোনটাই সুষ্ঠুভাবে গড়ে ওঠে নি। তখন আরামিক বা সেমিটিক লিপির প্রচলন ছিল। যেহেতু আরবি ভাষা আরবের মরুভূমিতে ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো যাযাবর উপজাতিদের কাছের ভাষা ছিল, তাই খুব তাড়াতাড়ি সাধারণ মানুষ এই ভাষা রপ্ত করে নিতে পারল। এইবার লিপি নির্বাচন। দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতাব্দীতেই ন্যাবাটিয়ান উপজাতি (Nabataean tribes) একটি লিপি ব্যবহার করত। এরা দক্ষিণ সিরিয়া, জর্ডান বা সিনাই অঞ্চলে বসবাস করত। এদের লিপি থেকেই জন্ম হল আরবি লিপির। সব চাইতে পবিত্র গ্রন্থটি যেহেতু আরবি ভাষা ও লিপিতে লেখা, তাই সাধারণ লোকের মধ্যেও এই ভাষা ও লিপি বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ল। আরবের জনগণের যে বিশাল অংশের এতকাল শিক্ষার সম্বন্ধে কোন কৌতূহল ছিল না, তারাও অবিশ্বাস্য গতিতে আরবি ভাষায় লিখতে ও পড়তে শিখে গেল। ঈশ্বরের নির্দেশগুলি যেমন কুর্‌আনে লিপিবদ্ধ হল, ঠিক তেমনি শেষ নবীর কথোপকথনগুলি আর একটি পবিত্র পুস্তকে লিপিবদ্ধ হল, যাকে হাডিথ বা হাদীশ বলে অভিহিত করা হয়। কুরান এবং হাডিথে বার বার বলা হয়েছে প্রশ্নের মাধ্যমে পৃথিবীকে বোঝো এবং জানো। পরবর্তী যুগে মৌলবাদীরা যতই প্রাধান্য পাক না কেন, একেবারে গোড়ায় এই ধর্ম ছিল খুব খোলামেলা, সাধারণের ধর্ম। উচ্চনীচ ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে নিয়ে একসাথে এগিয়ে যাওয়ার ধর্ম। এই ধরণের পরিবেশে বিজ্ঞান সহজেই বিকশিত হয়, তাই বিজ্ঞানের প্রতি ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের একাংশের একটা সহজাত আকর্ষণ গড়ে ওঠা খুব আশ্চর্য ঘটনা নয়। উমায়াদদের সময় থেকেই কিছু কিছু অনুবাদ শুরু হয়ে গিয়েছিল। আরবি ভাষায় প্রাচীনতম অনুবাদ গ্রন্থ সিন্ধহিন্দ সম্ভবত এই সময় লেখা হয়েছিল। এটি ছিল ভারতীয় গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ আর্যভট্টের ‘সিদ্ধান্ত’ নামক গ্রন্থের অনুবাদ। কিন্তু অনুবাদ আন্দোলনের জোয়ার তখনও আসে নি। অনুমান করা হয়, চীন থেকে কাগজ তৈরির পদ্ধতি জেনে তার অনুকরণে শণজাতীয় কিছু গাছের সাহায্যে কাগজ বানানোর কল অর্থাৎ পেপার মিল প্রথমে সমরকন্দে এবং পরে বাগদাদে স্থাপিত হয়। এর ফলে প্যাপাইরাস বা পার্চমেন্টের তুলনায় অনেক অল্প মূল্যে কাগজ পাওয়া যেতে শুরু করল। উন্নত ধরণের কালি এবং আঠা তৈরি হল। সেই সঙ্গে এল চামড়া দিয়ে বই বাঁধানোর প্রযুক্তি। অনুবাদের জোয়ার আসার পেছনে এ সবেরই অবদান অসামান্য। সব চাইতে বেশী অনুবাদের কাজ করা হয় হারুণ-আল-রশিদের রাজত্বকালে। প্রথমে সংস্কৃত এবং পল্লবী ভাষায় লেখা, যথাক্রমে ভারত ও পারস্যের বইগুলি অনুবাদ করা হচ্ছিল। এর মধ্য থেকে তারা গ্রীক বইগুলির সন্ধান পায়। তখন মূল গ্রীক বইগুলি সংগ্রহ করে তারা আরবি ভাষায় অনুবাদ করে। যদি তারা এই কাজগুলি না করত, তাহলে প্রাচীন জ্ঞানের বহু অমূল্য ভাণ্ডার বিস্মৃতির অতল তলে হারিয়ে যেত। বাগদাদের শিক্ষিত সমাজের মধ্যে সেই সময় ধর্ম নিয়ে কোনও গোঁড়ামি একেবারেই ছিল না। অনুবাদকদের বেশীর ভাগ ছিলেন হয় খ্রিষ্টান অথবা ইহুদি। তারা রাজ দরবারে এবং সম্ভ্রান্ত সমাজে যথেষ্ট সম্মান পেতেন। এই সব অনুবাদের ফলে আরবের অনুসন্ধিৎসু জনগণ সারা বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারের সন্ধান পেল। ফলে তারা নিজেরাও বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করল। ৭৫০ থেকে ১০৫০ খ্রিষ্টাব্দ ছিল ইসলামীয় বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ। আরবি ভাষাই সারা পৃথিবীতে বিজ্ঞানের ভাষা হিসাবে সমাদৃত হল। বাগদাদ, দামাস্কাস এবং আলেকজান্দ্রিয়া বিজ্ঞানের পীঠস্থান হিসাবে গড়ে উঠল।

ইউরোপের কিছু ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন যে বাগদাদে অনুবাদ সাহিত্যের জোয়ার বইয়ে দেওয়া ছাড়া সেখানকার অধিবাসীরা বিজ্ঞানে বিশেষ কোনও অবদান রেখে যান নি। বর্তমান প্রবন্ধের পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলি পড়লেই বোঝা যাবে যে এই বক্তব্য সম্পূর্ণ ভুল। বাগদাদে বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গভীর বিজ্ঞান সাধনার পরিচয় তদানীন্তন আরবের বৈজ্ঞানিকরা রেখে গেছেন। সব চাইতে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে এই সময় শুধুমাত্র নতুন বৈজ্ঞানিক তথ্যই আবিষ্কৃত হয় নি, বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গীও আমূল পাল্টে গিয়েছিল। একদম শুরুতে যখন মিশরে বিজ্ঞানের অগ্রগতি হয়েছিল, তখন সমগ্র জনসাধারণের সামগ্রিক উন্নতির দিকে লক্ষ্য রেখেই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলি হত। পরবর্তীকালে যখন রাজা ও পুরোহিতদের প্রাধান্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত হল, তখন থেকে বিজ্ঞান ব্যবহার হত একমাত্র অভিজাত সম্প্রদায়ের সুবিধার জন্য। মিশরে আদিম সাম্যবাদী সমাজের পতনের কয়েক হাজার বছর পর পুনরায় ‘জনগণের বিজ্ঞান’ আবার আত্মপ্রকাশ করল বাগদাদে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এই প্রথম একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটল। সাধারণ মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে বিজ্ঞান ওতপ্রোতভাবে মিশে গেল। এর আগে রাজগায়ক, রাজনর্তকী সমাজে স্বীকৃত ছিল। এরা যেমন অভিজাতদের আমোদের জন্য নাচগান করত, তেমনি সাধারণ লোকের মধ্যেও এই সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিয়েছিল। রাজকবি বা লেখকদের কথাও শোনা যায়। সেই সব অমূল্য সৃষ্টি সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন ভাবে অনুসৃত হয়ে সাধারণ মানুষের আনন্দ বর্দ্ধন করত। কিন্তু রাজবৈজ্ঞানিকের কথা কোথাও শোনা যায় না। এই প্রথম রাজসভায় বৈজ্ঞানিকরা সমাদৃত হলেন। তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হল, তাদের আবিষ্কৃত তথ্য যে কোনও লোকের সাথে আলোচনা করার এবং জনসাধারণের মধ্যে বিস্তৃত করে দেওয়ার। দুটো পরম সত্য সমগ্র সমাজে স্বীকৃত হল। এক, বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য জনসাধারণের মঙ্গল সাধন, মুষ্টিমেয় কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির মনোরঞ্জন করা নয়। দুই, বিজ্ঞানের আলোচনাকে মন্ত্রগুপ্তির হাত থেকে মুক্তি দেওয়া হল। বিজ্ঞানের দ্বার খুলে দেওয়া হল সবার জন্য। যে কোনও লোক এই আলোচনায় অংশ গ্রহণ করতে পারতেন এবং নিজের মতামত দিতে পারতেন।

নিঃসন্দেহে বাগদাদে বিজ্ঞান ও দর্শনের রচনাগুলির অনুবাদের প্রথম জোয়ারে ঘটনাপ্রবাহ মূলত অভিজাত সমাজের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। কাগজের ওপর সুদৃশ্য হাতের লেখায় রঙীন কালিতে তুলির টানে অনুবাদের পাতাগুলি এমনিতেই যে কোনও মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারত। তার ওপর সেগুলি যখন মরক্কো চামড়া দিয়ে দৃষ্টিনন্দন করে বাঁধানো হত এবং বাইরের ঘরে সাজিয়ে রাখা হত, সেই দৃশ্যশোভা অনায়াসে অতিথিদের নজর কাড়ত। একমাত্র অর্থবান লোকেরাই এই ধরণের পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে আত্মশ্লাঘা উপভোগ করতে পারতেন। শাসকের কড়া আদেশ অনুযায়ী সমস্ত অনুবাদ শুধু আরবি ভাষাতেই লেখা হত। পবিত্র কুর্‌আন যেহেতু আরবি লিপিতে এবং ভাষায় লেখা, তাই এই লিপি পড়া ও বোঝার ক্ষমতা জনসাধারণের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। ফলে বিজ্ঞান ও দর্শনের ওপরে লেখা প্রাচীন ধ্রুপদী রচনাগুলির আরবি অনুবাদও সাধারণের বোধগম্যতার একেবারে বাইরে চলে গেল না। তারা চেষ্টা করলে এই সব অনুবাদ পড়তে পারত। হয়ত বুঝতে পারত, হয়ত পারত না। কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে এই বইগুলি হাতে পাওয়ার জন্য এক অভূতপূর্ব আগ্রহের সৃষ্টি হল। শুরু হল সাধারণ গ্রন্থাগারের অভ্যুত্থান। আগ্রহী ব্যক্তিরা এসে গ্রন্থাগারে বসে দামী পাণ্ডুলিপিগুলি পড়ার সুযোগ খুঁজতেন। প্রথমে কিছু অর্থবান বদান্য ব্যক্তি এর সূচনা করেন। পরে এগুলি এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে স্বয়ং খলিফা রাজকীয় গ্রন্থাগার খোলেন। হারুন-আল রশিদ এর সূচনা করেন, কিন্তু এই প্রচেষ্টা পূর্ণ রূপ পায় খলিফা আল-মামুনের সময়। তিনি ছিলেন হারুন-আল রশিদের উপপত্নীর পুত্র এবং আব্বাসিদ রাজবংশের সপ্তম খলিফা। তার স্বপ্ন ছিল পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার আহরণ করে সেগুলি আরবিতে অনুবাদ করে একই ছাদের তলায় তিনি এক বিশাল গ্রন্থাগারের সৃষ্টি করবেন। এই জন্য তিনি প্রস্তুত করেন বেয়ত আল-হিকমা বা জ্ঞানের প্রাসাদ। আরবিতে হিকমা শব্দের অর্থ জ্ঞান, যেখান থেকে হাকিম বা জ্ঞানী শব্দের উৎপত্তি। তার দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে বাগদাদের অনেক অধিবাসী গ্রন্থ সংগ্রহ করতে শুরু করেন, যার ফলে এই শহরের নাম হয় জ্ঞানের নগরী বা মেদিনাৎ আল-হিকমা। আমি এই জন্যই বলেছি যে অনুবাদ সাহিত্যের প্লাবন বা সাধারণ লোকের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার, দুটো ঘটনারই মূল চালিকাশক্তি ছিল শেষ নবীর প্রচারিত ধর্মের প্রতি বিশ্বাসীদের ঐকান্তিক আগ্রহ।

বাগদাদে বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ

ভূগোল ও জ্যোতির্বিদ্যা

বাগদাদে বিজ্ঞানের যে শাখাগুলি সর্বপ্রথম বিকশিত হয়েছিল, সেগুলি হল ভূগোল এবং জ্যোতির্বিদ্যা। কারণ এর পেছনে ধর্মীয় সমর্থন ছিল। প্রার্থনা করার সময় মক্কা ঠিক কোন দিকে অবস্থিত, সেটা জানতে হয়। এই জন্য প্রয়োজন ভূগোল। তাছাড়া কখন কখন প্রার্থনা করা উচিত তা নির্দ্ধারণ করার জন্য সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের মুহূর্তগুলি সঠিকভাবে নিরূপণ করতে হয়। বছরের কোন দিনগুলি পবিত্র তার হিসাব রাখার জন্য সূর্য এবং চন্দ্রের গতিপথ নির্ভুল ভাবে অঙ্ক কষে নির্ণয় করতে হয়। এইজন্য বেশ বড় মাপের জ্যোতির্বিজ্ঞানের এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট গণিতের অগ্রগতি অপরিহার্য। এই অগ্রগতি একমাত্র বাগদাদেই সম্ভবপর হয়েছিল, অন্য কোথাও আগে হয় নি। তার মূল কারণ প্রাচীন জ্ঞানচর্চায় বরাবরই গুরুবাদের প্রাধান্য ছিল। বিশ্বাস করা হত যে আমার গুরু বা তার গুরু যা বলে গেছেন, তাকেই অভ্রান্তভাবে বিশ্বাস করা উচিৎ, অন্যথা সঠিকভাবে জ্ঞানলাভ করা যায় না। বাগদাদে অনুবাদ সাহিত্যের ফলে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রভাবশালী বিজ্ঞানী এবং তাদের শিষ্যদের কাজ একযোগে সেখানকার বিজ্ঞানীদের সম্মুখে উন্মুক্ত হল। এর ফলে বিজ্ঞান চর্চায় প্রধান বাধা গুরুবাদ অপসারিত হল। দেখা গেল ব্যবিলনীয় বিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্যের সাথে গ্রীক বৈজ্ঞানিকদের দেওয়া তথ্যের প্রচুর ফারাক আছে। এরা কেউই অভ্রান্ত নন। সবার দেওয়া তত্ত্ব ও তথ্যকেই সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে তবেই গ্রহণ করা উচিত। প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্য্যন্ত জ্যোতির্বিদ্যা এবং ভূগোলে সব চাইতে বিখ্যাত অবদান হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে টলেমীর (Ptolemy) লেখা দুটো বই। এদের ল্যাটিন নাম হল আলমাজেস্ট এবং জিওগ্রাফিয়া। টলেমী খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে রোম-অধিকৃত মিশরে আলেকজান্দ্রিয়া শহরের অধিবাসী ছিলেন।

অনেকে মনে করেন যে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের সমুদ্রযাত্রার পর ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা জানতে পারলেন যে পৃথিবী সমতল নয়, এর আকৃতি গোলকের মত। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। গ্রীক বৈজ্ঞানিকরা নিঃসন্দেহ ছিলেন যে পৃথিবী গোলকাকৃতি। তারা বিভিন্ন পদ্ধতিতে এর পরিধিও মেপেছিলেন। অ্যারিস্টটল ও পরে আর্কিমেডিসের পরিমাপ প্রায় বর্তমান পরিমাপের কাছাকাছি। টলেমীর লেখা ভূগোলের অমনিবাস Geographia যখন আরবিতে অনূদিত হল, তাতে দেখা গেল বিভিন্ন পদ্ধতিতে পরিমাপ করলে ভিন্ন ভিন্ন পরিধির মাপ পাওয়া যায়। বিরক্ত হয়ে খলিফা আল্‌ মামুন স্থির করলেন, তিনি নিজের উদ্যোগে পুনর্বার পৃথিবীর পরিধি পরিমাপ করাবেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি দুটো অভিযান পাঠালেন। অভিযাত্রীদের সাথে রইলেন সেই সময়কার বিখ্যাত জ্যোতির্বিদরা, যেমন সানাদ, ইয়াহিয়া, আল্‌ জওহরি, খালিদ আল্‌ মারওয়াররুধি। প্রথম অভিযান হয়েছিল বর্তমান ইরাকের উত্তর-পশ্চিমে। দ্বিতীয় অভিযান হয়েছিল বর্তমানের মধ্য সিরিয়ায়। পরীক্ষার ফলাফল দেখে তারা সিদ্ধান্ত নেন পৃথিবীর পরিধি ২৪৫০০ মাইল। আল্‌ বিরুনির লেখা কিতাব্‌ তাহ্‌দিদ আল্‌ আমাকিন (The determination of coordinates of the cities)-এ লেখা আছে যে সানাদ আইবন্‌ আলি তদানীন্তন খলিফা আল্‌ মামুনের অনুমতিক্রমে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গী অবলম্বন করে আর একটি অভিযান করেছিলেন। এবারে তিনি উঁচু পাহাড়ের ওপরে উঠে দিগবলয়ের কৌণিক পরিমাপ মেপে পৃথিবীর ব্যাসার্দ্ধ নির্ণয় করেন। আজ পর্য্যন্ত এই পরিমাপই নির্ভুল বলে স্বীকৃত হয়ে আসছে। গোলকাকৃতি পৃথিবীর প্রথম মানচিত্র তৈরী শুরু হয় আব্বাসিদদের সময়ই। অনেক বিখ্যাত ভূগোলবিৎদের যৌথ প্রচেষ্টায় প্রথম মানচিত্র সৃষ্টি হয়। বর্তমানে তা হারিয়ে গেছে। কিন্তু শোনা যায় কলম্বাস তার অভিযানের টাকা সংগ্রহ করার সময় এই মানচিত্রটি দেখিয়ে জনসমর্থন পান। পরে একটি বই লেখা হয় সুরত-আল্‌ আর্থ (পৃথিবীর ছবি)। এতে পাঁচশ নগরীর অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ দেওয়া আছে। তাছাড়া অসংখ্য নদী, পাহাড় ও সমুদ্রের সঠিক অবস্থান দেখানো আছে। মানচিত্র তৈরি করার বিজ্ঞান (cartography) এই সময় সৃষ্টি হয়। মানচিত্র প্রস্তুত করার জন্য  দুটো ভিন্ন ধরণের প্রণালী বাগদাদেই আবিষ্কৃত হয়। এতে আল্‌ বালখি, আইবন্‌ সিনা, আল্‌ বিরুনি, আইবন্‌ খালদুন এবং বিখ্যাত ভ্রমণকারি আইবন্‌ বতুতা অংশগ্রহণ করেন। এই সর্বপ্রথম গাণিতিক ভূগোলের সৃষ্টি হয়।

সব চাইতে চমকপ্রদ কাজ হয় জ্যোতির্বিদ্যায়। পরীক্ষামূলক এবং তাত্ত্বিক উভয় বিভাগেই উচ্চ পর্যায়ের গবেষণা করা হয়। আগেই বলেছি অষ্টম শতাব্দী পর্য্যন্ত জ্যোতির্বিদ্যায় সব চাইতে বিখ্যাত বই ছিল টলেমির আলমাজেস্ট (almagest)। প্রায় ৭০০ বছর বাদে বইটি আরবিতে অনুবাদিত হয়। বাগদাদের বিজ্ঞানীরা মনে করতেন তাদের অনুবাদ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সংগ্রহ ইউক্লিডের লেখা এলিমেন্টস এবং দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ পুস্তক হল আলমাজেস্ট। বইটি বারোটি খণ্ডে বিভক্ত ছিল। মনে রাখা দরকার, তখনও পর্যন্ত প্রায় সবাই ভূকেন্দ্রিক বিশ্বে বিশ্বাস করত। কিন্তু তারকা বা গ্রহের মহাকাশে ভ্রমণের নিখুঁত বিবরণ তদানীন্তন জ্যোতিষীরা কয়েকশ বছর ধরে নিরলসভাবে সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। কাজেই ভূকেন্দ্রিক বিশ্বের তত্ত্বগুলি এমনভাবে সাজাতে হত, যাতে সমস্ত পরিমাপগুলি সঠিকভাবে মিলে যায়। এই তত্ত্ব অনুযায়ী নক্ষত্র ও গ্রহদের গতিপথ মোটামুটিভাবে ভালোই মিলে যেত। কিন্তু যত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিমাপ নেওয়া হল, ততই গোলমালগুলি নজরে আসতে শুরু করল। পরবর্তীকালে কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের তত্ত্ব এই সব তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

খলিফা আল্‌ মামুনের সময় বাগদাদের খ্যাতি দিকে দিকে রটে গেছে। কাজেই বিভিন্ন স্থান থেকে সত্যিকারের জ্ঞানপিপাসুরা এখানে এসে খলিফার “জ্ঞানের প্রাসাদে” প্রবেশের অনুমতি পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করত। একে একে প্রতিভাবানরা প্রাসাদে জমায়েত হল। প্রথমে খলিফার নজর কাড়লেন আল্‌ আব্বাস আল্‌ জওহারি। তারপর এলেন আরও তরুণ ইহুদী সন্তান সানাদ আইবন্‌ আলি আল্‌ ইয়াহুদি। সুদুর পারস্য থেকে এলেন ইয়াহিয়া আইবন্‌ আবি মন্‌সুর। সবারই প্রাথমিক পরীক্ষা দিতে হত যে তারা টলেমির আলমাজেস্ট কতটা গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন। এতগুলি রত্নকে হাতে পেয়ে আল্‌ মামুন স্থির করলেন যে জ্যোতির্বিদ্যায় যে সব পরস্পরবিরোধী তথ্য আছে, তার একটা নিস্পত্তি ঘটাতে হবে। তিনি নিজেই অবজারভেটরি নির্মাণ করবেন। প্রথম বীক্ষণাগার তৈরি হল শহরের উত্তর-পূর্ব দিকে। আর এক তরুণ জ্যোতির্বিদ এদের সাথে যোগদান করলেন, যার নাম হল আল্‌ ফারঘিনি। পরবর্তীকালে এর খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। সব চাইতে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে খলিফা এদের ওপর নতুন গবেষণাগার তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সবার ওপরে যাকে রেখেছিলেন তিনি জ্যোতির্বিদ নন, তিনি একজন গণিতজ্ঞ যার নাম আল্‌ খোয়ারিজ্‌মি। আল্‌ মামুন উপলব্ধি করেছিলেন জ্যোতির্বিদ্যার সাথে গণিতের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সঠিক গণিত সৃষ্টি না করতে পারলে জ্যোতির্বিদ্যার অগ্রগতি অসম্ভব। প্রথম বীক্ষণাগারের সাফল্য দেখে আল্‌ মামুন আর একটি গবেষণাগার দামাস্কাসের অদূরে স্থাপন করেন। ইতিমধ্যে ৮৩০ খৃষ্টাব্দে প্রবীণ জ্যোতির্বিদ ইয়াহিয়া মারা যান। তখন দ্বিতীয় গবেষণাগারের দায়িত্ব দেওয়া হয় খালিদ আল্‌ মারওয়াররুধির ওপর। এই সব পরীক্ষা নিরীক্ষার পর যে সব তথ্য পাওয়া যেত, সেগুলিকে সারণি আকারে লেখা হত, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় টেবিল। আরবি ভাষায় একে বলা হত জি্‌জ। প্রচুর তথ্য নিয়ে প্রকাশিত হল আল্‌ জি্‌জ আল্‌ মুমতাহান্‌। পরবর্তী এক হাজার বছর ধরে এই বইটি জ্যোতির্বিদ্যায় প্রধান রেফারেন্স বই হিসাবে স্বীকৃত হত। ৯৬৪ সালে আব্‌দ্‌ আল্‌ রহমান আল্‌ সুফি একটি বই লেখেন The book of fixed stars। খালি চোখেই তিনি অ্যান্ড্রোমেডা গ্যালাক্সি এবং লার্জ ম্যাগেলানিক ক্লাউড দেখে সেগুলি সঠিক স্থানে চিহ্নিত করেছিলেন, যদিও গ্যালাক্সি সম্বন্ধে তখনও কোন ধারণা জন্মায় নি।

সেই সময় টেলিস্কোপ আবিস্কৃত হয় নি। বিভিন্ন ধরণের কৌণিক মাপের জন্য সেক্সটান্ট ব্যবহৃত হত। এই সময়ই আরবের বৈজ্ঞানিকদের অসামান্য অবদান অ্যাস্ট্রোল্যাব নামক যন্ত্রটি। যদিও এই যন্ত্রের প্রাচীন সংস্করণ গ্রীক বিজ্ঞানেই ছিল, কিন্তু এর সার্বিক উন্নতি হয় আরবের বৈজ্ঞানিকদের হাতে। আরবদেশীয় এক বৈজ্ঞানিক তার একটি লেখায় দেখিয়েছেন যে তখনকার অ্যাস্ট্রোল্যাবের সাহায্যে প্রায় এক হাজার রকম ভৌগোলিক এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিমাপ করা যেত। সেই বিশাল তালিকা এই ছোট প্রবন্ধে দেওয়া সম্ভবপর নয়। উদাহরণস্বরূপ এর সাহায্যে সঠিকভাবে কোনও স্থানের অক্ষাংশ নির্ণয় করা যেত। সেইজন্য সামুদ্রিক অভিযানে এই যন্ত্রটি অপরিহার্য ছিল। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় হিসাব করা, মহাকাশে রাশিগুলির অবস্থান ও যে কোন সময়ে সূর্য ও চন্দ্র কি রাশিতে থাকবে ইত্যাদি জটিল বিষয়গুলি এই যন্ত্রের সাহায্যে কষে ফেলা যেত। সময়ের সাথে সাথে যন্ত্রটির অনেক পরিবর্তন হতে থাকে। কিন্তু যার হাতে এই যন্ত্রটি প্রায় আধুনিক রূপ পরিগ্রহণ করেছিল, তিনি একজন মহিলা বৈজ্ঞানিক মারিয়াম আল্‌ আস্ট্রুলাবি। তিনি দশম শতাব্দীতে উত্তর সিরিয়ায় জন্মেছিলেন। সেই সময় আরবের মহিলারা অনেকেই উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। বৈজ্ঞানিকদের মধ্যেও অনেক মহিলার নাম পাওয়া যায়। শোনা যায় নবম শতাব্দীতে মরক্কোয় প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছিলেন একজন মহিলা শিক্ষাবিদ, নাম ফতিমা আল্‌ ফিহরি। সারা দুনিয়ার বিদ্যোৎসাহীরা এখানে পড়তে আসতেন।

পৃথিবী যে লাট্টুর মত পাক খায়, সেই ঘটনা গ্রীক বৈজ্ঞানিকদের নজর এড়ায় নি। এর ফলে পৃথিবীর মেরুরেখা (axis) ঘুরতে থাকে। মেরুবিন্দুটি ছোট বৃত্তাকারে আবর্তিত হয়। মেরুরেখাটি একটি শঙ্কুর আকার ধারণ করে। এই ঘটনাকে বলা হয় পৃথিবীর অয়নচলন (precession of the equinoxes)। টলেমি লিখেছিলেন মেরুবিন্দু অয়নচলনের জন্য প্রতি ১০০ বছরে ১ ডিগ্রী আবর্তিত হয়। আরবীয় জ্যোতির্বিদ আইবন্‌ ইউনুস বহু বছর ধরে তথ্য সংগ্রহ করে দেখলেন যে টলেমির হিসাব ঠিক নয়। মেরুবিন্দু প্রতি ৭০ বছরে ১ ডিগ্রী আবর্তিত হয়। আসলে দুটো হিসাবই ঠিক। সূর্য এবং চন্দ্রের আকর্ষণে সময়ের সাথে সাথে অয়নচলনের পরিমাণ পরিবর্তিত হতে থাকে। কিন্তু পৃথিবী-কেন্দ্রিক বিশ্বের তত্ত্বে এই পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়। আইবন্‌ ইউনুস এবং পরবর্তীকালে আইবন্‌ আল্‌-সাতিরের দেওয়া এই হিসাবগুলিই কোপার্নিকাস তার সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের তত্ত্বে কাজে লাগিয়েছিলেন। অর্থাৎ আরবীয় বৈজ্ঞানিকদের সংগৃহীত তথ্যই আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার জন্ম দিয়েছে। ২০১৭ সালে একটি বিখ্যাত Astronomy Journal-এ Shannon Stirone লিখেছেন জ্যোতির্বিদ্যায় আরবের বিজ্ঞানীরা যে অমূল্য অবদান রেখে গেছেন তার তালিকা এত দীর্ঘ যে সেই প্রচেষ্টা না করাই ভালো। তিনি প্রবন্ধটি শেষ করেছেন এই বলে যে আজকে প্রায় দ্বিশতাধিক তারকা এবং চাঁদের পিঠের ২৪টি আগ্নেয়গিরি মধ্যযুগের আরবের বিজ্ঞানীদের নামে নামকরণ হয়েছে। তবুও মনে হয় অনেকেই এখনও স্বীকৃতি পান নি।

গণিতশাস্ত্র

গণিতে প্রথম যে বিষয়টির কথা মনে আসে, তা হল পাটিগণিত। বিভিন্ন সংখ্যাকে কিভাবে লিখিত চিহ্নে রূপান্তরিত করা যায়, সে সম্বন্ধে ব্যবিলনীয় পণ্ডিত থেকে গ্রীক ও ভারতীয় পণ্ডিতদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ ছিল। আরবের বিজ্ঞানীরা ভারতীয় পদ্ধতিকেই নির্বাচন করেন এবং পরে তার ওপর কিছু নতুনত্ব সৃষ্টি করেন। সংখ্যা লেখার এই পদ্ধতি পরে ইউরোপে ছড়িয়ে পরে। একেই বলা হয় আরবীয়-হিন্দু সংখ্যা। এখনও সারা বিশ্বে এই সংখ্যা লেখার পদ্ধতিই চালু আছে। আরবে পাটিগণিতের ওপর প্রথম বই লেখা হয় ৯৫২ সালে। দামাস্কাসের আল্‌ উক্লিদিসির লেখা বইটির নাম আল্‌ হিসাব আল্‌ হিন্দি। আরবি ভাষায় হিসাব অর্থ সংখ্যা গণনা পদ্ধতি। ফলে বইটির বিষয়বস্তু হল ভারতীয় মতে কিভাবে হিসাব করতে হয়। উক্লিদিসির গ্রন্থটি বেশ সমৃদ্ধ। এখানে তিনি দশমিক বিন্দু ব্যবহার করেছিলেন। ইউরোপীয় ভাষায় এর অনুবাদ খুব জনপ্রিয় হয়।

তবে মধ্যযুগের আরবীয় গণিতজ্ঞদের মধ্যে এখনও যার নাম সারা পৃথিবীতে সমাদৃত, তিনি হলেন আল্‌ খোয়ারিজ্‌মি। তিনি জন্মেছিলেন মধ্য এশিয়ায় জরথ্রুষ্ট মতাবলম্বী অগ্নি উপাসকদের পরিবারে। অসাধারণ প্রতিভাধর এই বিজ্ঞানী জ্ঞান অর্জনের স্পৃহায় বাগদাদে চলে আসেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি খলিফা আল্‌ মামুনের নজরে পরেন। তখন জ্যোতির্বিদ্যা ছিল বাগদাদে মুখ্য বিজ্ঞান। আল্‌ খোয়ারিজ্‌মি কিছুদিনের মধ্যেই তাতে বুৎপত্তি লাভ করেন এবং নবনির্মিত বীক্ষণাগারের অধিকর্তা নির্বাচিত হন। তিনি বুঝেছিলেন যে জ্যোতির্বিদ্যার জন্য যে গণিতের প্রয়োজন, তা তখনও সৃষ্টি হয় নি। সমতলের ত্রিকোণমিতি (Trigonometry) ভারতবর্ষে বেশ কিছুটা এগিয়েছিল। খোয়ারিজ্‌মি বুঝলেন যে জ্যোতির্বিদ্যার জন্য গোলকের ত্রিকোণমিতি (spherical trigonometry) সৃষ্টি করা দরকার। তিনি এই বিষয়ে কাজ শুরু করলেন। পরবর্তীকালে অন্যান্য গণিতবিশারদরা বিষয়টির আরও অগ্রগতি ঘটালেন। কিন্তু তার যে কাজের জন্য তিনি জগৎ বিখ্যাত হয়ে থাকবেন তা হল বীজগণিত। তার বইয়ের মুখবন্ধে বীজগণিতের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে তিনি যা লিখেছিলেন, তা সত্যিই আকর্ষণীয়। তার মতে সবারই এই শাস্ত্রের দরকার, কারণ সম্পত্তির ভাগাভাগিতে, জমির সীমানা নির্ধারণ করার জন্য, ব্যবসার জন্য, খাল খোঁড়ার সময় জমি মাপার জন্য বা অন্যান্য জ্যামিতিক সমস্যা সমাধানের জন্য সব সময় বীজগণিতকে ব্যবহার করতে হবে। অর্থাৎ গণিত ভাববাদী দর্শন নয়, এর মূল প্রোথিত আছে মানুষের দৈনন্দিন চাহিদার ওপর। তার এই বইটির নাম আল্‌ জেবর্‌ ওয়া আল্‌ মুগাবালা। অর্থ The reduction and the cancellation। তার মতে সমীকরণের সমাধানের জন্য দুটো প্রণালীর মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ধরা যাক সমীকরণটি হল 5x-2=8। প্রথমে ঋণাত্মক চিহ্ন এখান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। একেই বলা হয় আল্‌ জেবর্‌ বা লঘুকরণ বা reduction। এই প্রণালীতে সমীকরণ দাঁড়াল 5x=10. এবার দ্বিতীয় প্রণালী হল আল্‌ মুগাবিলা বা মুখোমুখি মোকাবিলা। ফলে সমাধান হল x=2। এই ধরণের গণিতে একটি অজ্ঞাত বস্তু (যেমন x) থাকে। উদ্দেশ্য হল x-এর সঠিক মান নির্দ্ধারণ করা।সমীকরণে x-এর সূচক (power) বিভিন্ন সংখ্যা হতে পারে, যেমন x, x2, x3, x4 ইত্যাদি। যদি অজ্ঞাত রাশির বৃহত্তম সূচক দুই হয়, তবে সমীকরণকে বলা হয় দ্বিঘাত সমীকরণ (quadratic equation)। খোয়ারিজ্‌মি যে কোনও দ্বিঘাত সমীকরণের সমাধানের পদ্ধতি সুস্পষ্টভাবে তার বইতে বর্ণনা করেছেন। কয়েকটি নির্বাচিত ত্রিঘাত ও চতুর্ঘাত সমীকরনেরও সমাধান দিয়েছেন। খোয়ারিজ্‌মির বইটি সংক্ষেপে ইউরোপে আল-জেবর বলা হত। এই থেকেই আলজেব্রা (algebra) শব্দের সৃষ্টি। তাছাড়া ল্যাটিন অনুবাদে বইটির নাম দেওয়া হয়েছিল আলকারিসমি বা অ্যালগরিতমি বা অ্যালগরিসমি। এই শব্দগুলি থেকেই সৃষ্টি হয়েছে অ্যালগরিদম (algorithm) শব্দের, যার অর্থ কয়েকটি বিশেষ নির্দেশ যা পর পর মেনে চললে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। সেই লক্ষ্য কেক তৈরি করা হতে পারে বা একটা বৃত্তে স্পর্শক টানার পদ্ধতিও হতে পারে। একটা বইয়ের নাম থেকে গণিতের একটি বিশেষ বিভাগের (algebra) নামকরণ বোধহয় আর কখনও হয় নি। তাছাড়া বর্তমানে কম্পুটার বিজ্ঞানে অ্যালগরিদম একটি অতি পরিচিত শব্দ। এরও সৃষ্টি ঐ বইয়ের নাম থেকেই।

সেই যুগের আর এক অসামান্য প্রতিভাশালী গণিতজ্ঞ ছিলেন উমার খৈয়াম। পারস্যের এই বিজ্ঞানী ওমর খৈয়াম নামে বেশী পরিচিত। তার লেখা প্রেমের কবিতাসংগ্রহ রুবায়েত ১৮৫৯ সালে Edward Fitzgerald অনুবাদ করেন। ১৮৮০ সালের মধ্যে গোটা ইউরোপে এবং আমেরিকায় তার কবিতার খ্যাতি ছড়িয়ে যায়। শতাধিক ভাষায় রুবায়েতের অনুবাদ হয়। কিন্তু তার কবিতাপ্রেমীরা অনেকেই জানেন না যে তিনি অঙ্কশাস্ত্রে বিপুল অবদান রেখে গেছেন। তিনি ইউক্লিডের সমান্তরাল রেখার পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধকে স্বীকার না করে যে সব অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছান, সেগুলিকে বলা যেতে পারে অ-ইউক্লিডিয় জ্যামিতির (Non-Euclidean Geometry) প্রাথমিক পদক্ষেপ। ওমরের আর একটি বিখ্যাত কাজ দুটি মানের সমতা ও অসমতা নির্ণয়। বিষয়টি অঙ্কের দিক থেকে বেশ জটিল বলে এখানে বেশী আলোচনা করলাম না। ওমর খৈয়াম ত্রিঘাত সমীকরণের সাধারণ সমাধান নিয়ে প্রচুর কাজ করেন। তিনি দেখান যে লম্ব বৃত্তাকার শঙ্কুর (right circular cone) বিভিন্ন তলের ছেদের (section) সাহায্য নিয়ে জ্যামিতির মাধ্যমে এই সমীকরণগুলির সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তিনি শঙ্কুচ্ছেদের (conic section) ওপর নির্ভর করে ত্রিঘাত সমীকরণগুলিকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করেন এবং তাদের সমাধানের পথগুলি বলে দেন। এই সমাধানগুলি কিন্তু সংখ্যাসূচক সমাধান, বীজগাণিতিক সমাধান নয়। বিখ্যাত বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক George Sarton-এর মতে মধ্যযুগের ইসলামীয় গণিতে এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ গবেষণা। ওমর অবশ্য তার অঙ্কের বইগুলি আরবি ভাষায় না লিখে তার নিজের দেশ পারস্যের ভাষায় লিখেছিলেন।

এ কথা ভাবলে ভুল হবে যে ইসলামের স্বর্ণযুগের পর বাগদাদে বিজ্ঞানে নতুন গবেষণা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রাজানুগ্রহ না থাকলেও কয়কজন ব্যক্তিগত ভাবে তাদের জ্ঞানার্জনের প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। যেমন পঞ্চদশ শতাব্দীতে এক দক্ষ গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ ছিলেন আল্‌ দিন জামসিদ আল্‌ কাসি। ইনি জ্যামিতিতে সুপণ্ডিত ছিলেন, তাই সমস্ত গণনা প্রথমে একটি জ্যামিতিক সমস্যার আকারে পরিবর্তিত করে নিতেন। তারপর জ্যামিতির সম্পাদ্য ও উপপাদ্য ব্যবহার করে সেগুলির সমাধান বের করতেন। আল্‌ কাসি প্রথম লক্ষ্য করেন যে সব গণনার উত্তর সব সময় নির্ভুল হয় না। হয়ত সঠিক উত্তরের কাছাকাছি হয়, কিন্তু আরও গভীরে গেলে আরও কম ভুল হয়। এখান থেকেই তিনি গণনাতে কতটা ভুল হতে পারে, তা নির্দ্ধারণ করতে সক্ষম হলেন। ‘ভুলের পরিমাণ মাপা’ গণিতে একটি নতুন দিগন্ত, একে বলা হয় error estimation। তিনি আরও দেখালেন যে একই গণনা যখন সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর ভাবে পুনর্বার করা হয়, তখন ভুলের পরিমাণও কমে যায়। এইভাবে তিনি সৃষ্টি করলেন পুনরাবৃত্তিক গণন পদ্ধতি বা iterative calculation, যা আজকের কম্পুটারের গণনায় এক অপরিহার্য অংগ হয়ে উঠেছে। জ্যামিতির সাহায্য নিয়ে আল্‌ কাসি পাইয়ের (π) মান ষোল দশমিক সংখ্যা অবধি নির্ভুল গণনা করেছিলেন। মধ্যযুগের আরব গণিতজ্ঞ আরও অনেকে ছিলেন। সবার কাজ এই ছোট প্রবন্ধে বলা সম্ভবপর নয়। তাই এই অধ্যায়ে আপাতত ইতি টানছি।

চিকিৎসাবিদ্যা

ষষ্ঠ শতাব্দীতে ইসলামের প্রচার শুরু হওয়ার আগে দক্ষিণ-পূর্ব ইরানে বর্তমানের খুজেস্থান প্রদেশে গোন্দেশাপুর ছিল জ্ঞানার্জনের জন্য সেই সময়কার এক বিখ্যাত কেন্দ্র। তখন ঐ অঞ্চল সাস্‌সানিদ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাইজানটাইন সম্রাটদের দমন ও পীড়নের জন্য খ্রিষ্টানরা যখন স্বদেশ থেকে  বিতাড়িত হয়ে নতুন আশ্রয়ের জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তখন সাস্‌সানিদ সম্রাটরা তাদের পারস্য সাম্রাজ্যে সাদরে অভ্যর্থনা করেন। খ্রিষ্টানদের মধ্যে বেশ কিছু জ্ঞানী গুণী মানুষ ছিলেন। তাদের নিয়ে পারস্য সম্রাটের অনুগ্রহে গোন্দেশাপুরে এক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ধর্মতত্ত্ব, দর্শন ইত্যাদির সাথে এখানে বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ানো হত। সম্রাট প্রথম খুশরুর আগ্রহে গ্রীক ও সিরিয়াক ভাষায় লেখা পুস্তকগুলি পল্লবি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। সম্রাট ভারত ও চীন্ দেশে লোক পাঠিয়ে সেখান থেকে জ্ঞানীদের নিমন্ত্রণ করে নিজের দেশে নিয়ে আসেন এবং ঐ দেশের বিখ্যাত পুস্তকগুলিকেও অনুবাদ করান। তখনই হিপোক্রেটিস, গ্যালেন, চরক, শুশ্রুত ইত্যাদি বিদগ্ধ চিকিৎসাবিজ্ঞান তাদের নজরে আসে। ফলে গোন্দেশাপুর বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা বিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য এক প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে আল্‌ মামুনের নেতৃত্বে জ্ঞানের প্রাসাদ সৃষ্টির কথা যখন বাইরে প্রচারিত হয়, তখন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা চিকিৎসক ও অধ্যাপকরা বাগদাদে চলে আসেন। চিকিৎসা বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র গোন্দেশাপুর থেকে বাগদাদে স্থানান্তরিত হয়ে যায়। এই ভূমিকা এখানে দিলাম, কারণ মনে রাখা দরকার ইসলামীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার মূল উৎস ছিল পারস্যের গোন্দেশাপুরের বিশ্ববিদ্যালয়।

ইসলাম ধর্মে চিকিৎসার ওপর গবেষণায় কিছু সুবিধা আছে আবার অসুবিধাও আছে। সুবিধা হল যে এই ধর্মে সবাইকে নিজের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে বলা হয়েছে। যে অংগভঙ্গীতে প্রার্থনা করার নির্দেশ আছে তাতে মনের পবিত্রতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শরীরের নমনীয়তাও বাড়ে। প্রতি বছর নবম মাসে রোজা করার নির্দেশও যদি যথাযথভাবে পালন করা হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে শরীর সুস্থ থাকবে। হাডিথে বলা আছে, শরীর অসুস্থ হলে যেন চিকিৎসক দেখানো হয়। কাজেই ধর্মের দিক থেকে চিকিৎসার ওপর কোনও নিষেধ নাই। কিন্তু একটা বিরাট বাধা হল এই ধর্মে শব ব্যবচ্ছেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। কাজেই মানুষের দৈহিক গঠনতন্ত্রের (human anatomy) বিষয়ে কোনও গবেষণাই করা সম্ভবপর নয়। এই বাধা সেই সময়ের বিজ্ঞানীরা এক অদ্ভুত কৌশলে অপসারিত করেছিলেন। তারা নিজের হাতে কোনও শব ব্যবচ্ছেদ করতেন না। কিন্তু হিপোক্রেটিস, গ্যালেন এবং শুশ্রুতের পুস্তকগুলির পল্লবী অনুবাদ গোন্দেশাপুর থেকে তারা নিয়ে এসেছিলেন। গ্যালেনের অ্যানাটমির বইটি তারা সহজেই আরবি ভাষায় অনুবাদ করে ফেললেন। হাতে একটি অ্যানাটমির বই এবং তার সাথে শুশ্রুতের প্রণীত শল্য চিকিৎসার নিয়মাবলী থাকার ফলে তারা খুব তাড়াতাড়ি কান, চোখ বা নাকের ওপর শল্য চিকিৎসা করার বিষয়ে রপ্ত হয়ে উঠলেন। প্রাচীন কালে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্ররা গুরুগৃহে বসবাস করে গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী নিজেকে শিক্ষিত করে তুলত। গোন্দেশাপুরের বিশ্ববিদ্যালয় একসাথে অনেক শিক্ষকের সমাহার করে ছাত্রদের সমস্ত শিক্ষকের কাছে পাঠ নেওয়ার পাঠক্রম শুরু করে। অর্থাৎ এখানেই সর্বপ্রথম চিকিৎসা বিজ্ঞানের মহাবিদ্যালয় সৃষ্ট হয়। বাগদাদে এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে চিকিৎসার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে হাসপাতালের সাথে যুক্ত করা হয়। এখানে ছাত্ররা শিক্ষকদের উপস্থিতিতে রোগীদের পরীক্ষা করত এবং চিকিৎসা করত। এইভাবে তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ চিকিৎসক হিসাবে গড়ে তুলত। প্রথমে হাসপাতালে অভিজাত শ্রেণীর লোকেরাই আসত। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা দ্রুত বুঝতে পারলেন যে শুধু অভিজাত ব্যক্তিদের চিকিৎসা করলে তাদের গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। তারা বুঝতে চাইছিলেন সাধারণ লোকের মধ্যে কি ধরণের রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং কি ভাবেই বা তার অবসান ঘটানো যায়। তাই হাসপাতালের দ্বার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হল। যে কোনও ব্যক্তি অসুস্থ হলে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারতেন এবং খুব কম ব্যয়ে বা বিনাব্যয়ে চিকিৎসার সুবিধা পেতেন। যথার্থ অর্থে যাকে সরকারি হাসপাতাল বলা হয়, তার জন্ম হয়েছিল এই বাগদাদে। কেউ যেন মনে না করেন যে বাগদাদের প্রসিদ্ধ চিকিৎসকরা শুধুমাত্র প্রাচীন পুঁথির ওপর ভরসা করে রোগী দেখতেন। সেই সময় তারা চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপর নিরলস গবেষণা করতে থাকেন। যার ফলস্বরূপ বেশ কয়েকটি অমূল্য চিকিৎসা শাস্ত্র এই সময় রচিত হয়। অষ্টম শতাব্দীতে ইমাম আল্‌ রিধা একটি মেটেরিয়া মেডিকা রচনা করেন, যা আল্‌ মামুনের নির্দেশে সোনালী কালি দিয়ে লেখা হয়। বইটি “সোনালি প্রবন্ধ” নামে বিখ্যাত। নবম শতাব্দীতে আল্‌ তাবারি একটি পাঁচ খণ্ডের মেডিকাল এনসাইক্লোপিডিয়া লেখেন, নাম ফিরদৌসি আল্‌ হিকমা। লক্ষণীয় তিনি মানসিক রোগের ওপর দীর্ঘ আলোচনা করেছেন এবং এই ধরণের রোগ থেকে চিকিৎসার সাহায্যে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যায়, তা বর্ণনা করেছেন। দশম শতাব্দীর আল্‌ তামিমি শরীরে বিষক্রিয়া ঘটলে কি ধরণের ওষূধে তা নিরাময় করা যায়, সে সম্বন্ধে একটি বৃহৎ বই লিখেছিলেন। ঐ দশম শতাব্দীতেই আর একটি বিখ্যাত বই লেখা হয়, কিতাব আল্‌ মালিকি। লেখক আল্‌ মাজুসি। পরবর্তিকালে সম্রাট কনস্টানটাইনের নির্দেশে বইটির অনুবাদ করা হয় এবং সমগ্র ইউরোপে বইটি শল্য চিকিৎসার পাঠ্য পুস্তক হিসাবে অনুমোদিত হয়। দশম থেকে একাদশ শতাব্দী পর্য্যন্ত চিকিৎসা জগতের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন আল্‌ রাজি। এর লেখা মেডিকাল বইগুলি ল্যাটিনে অনুবাদ করা হয় এবং সপ্তদশ শতাব্দী পর্য্যন্ত তাকে ইউরোপে একমাত্র চিকিৎসা-বিশেষজ্ঞ হিসাবে গণ্য করা হত। এছাড়া অবশ্য তিনি উদ্ভিদ ও প্রাণীবিজ্ঞান নিয়েও কয়েকটি বই লিখেছিলেন। আল-রাজি বাগদাদের দুটো সরকারি হাসপাতালের অধ্যক্ষ ছিলেন। এই হাসপাতালে গরীব সাধারণ মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হত। তিনিই প্রথম লক্ষ্য করেন যে কিছু ব্যাধি আছে যেগুলি একজনের থেকে আর একজনের ভেতর সংক্রামিত হতে পারে। তিনি সংক্রামক ব্যাধি সম্বন্ধে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করেন এবং বিশেষভাবে বসন্ত ও হামরোগের কারণ খোঁজার চেষ্টা করেন। তিনি লিখেছেন যে অধিকাংশ রোগের কারণ হল পুষ্টির অভাব। প্রথমে রোগীকে সঠিক পুষ্টি দাও। যদি তাতে সে ভাল হয়, তাহলে ওষুধ দিও না। যদি একটা ওষুধেই কাজ হয়, তাহলে অনর্থক বেশী ওষুধ দিও না। তিনি হাসপাতালের ঘরগুলি এমনভাবে তৈরি করান যাতে প্রত্যেক ঘরে নির্মল বাতাস আসে এবং ঘরগুলির অভ্যন্তর সঠিক তাপমাত্রায় থাকে। আল্‌ রাজি যত রোগী দেখতেন, তাদের রোগলক্ষণ, রোগ নিরাময়ের পদ্ধতি সম্বন্ধে তার নিজের অভিজ্ঞতা খাতায় লিখে রাখতেন। পরে বিশ্ববন্দিত চিকিৎসক যেমন হিপোক্রিটাস, চরক ইত্যাদির মতামত ছোট করে পাশে লিখে প্রতিটি রোগীর জন্য একটি করে নোট তৈরি করতেন। এইভাবে অগণিত রোগীদের বর্ণনা নিয়ে আল্‌ হাওয়াই নামে তার আর একটি বিশাল বই ছিল। বইটি ২৩ খণ্ডে বিভক্ত। অষ্টাদশ শতাব্দীতেও ইউরোপের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে আল্‌ হাওয়াইয়ের  একাধিক অনুবাদ থাকত। চিকিৎসা বিজ্ঞানে বইটি অপরিহার্য বলে মনে করা হত। আল্‌ রাজি দশ খণ্ডে বিভক্ত একটি এনসাইক্লোপিডিয়া লেখেন, নাম কিতাব আল্‌ মনসুরি। বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানকে যে ভাবে ভাগ করা হয়, তার একটা খসড়া এই বইয়ের খণ্ডগুলিতে দেখা যায়। খণ্ডগুলির নাম যথাক্রমে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, প্যাথলজি, মেটেরিয়া মেডিকা, সার্জারি, টক্সিকোলজি ইত্যাদি। এই বইটিও ইউরোপে প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবে সম্মান পেয়ে এসেছে। দশম শতাব্দীর শেষভাগে আরবের চিকিৎসা বিজ্ঞানে আর এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন আইবন্‌ সিনা বা ইউরোপে যাকে বলা হয় আভিচেন্না। অনেকের মতে ইনিই আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক। বর্তমান উজবেকিস্তানে এর জন্ম। ইনি প্রথম লক্ষ্য করেন যে অনেক সংক্রামক ব্যাধি বাতাসের মাধ্যমেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে। সন্তান প্রসব করার সময় ফরসেপ ব্যবহার করা ইনিই প্রচলন করেছিলেন। মানসিক রোগের চিকিৎসার ওপর তার অনেক অবদান আছে। হৃদযন্ত্র ও কিডনীর বেশ কিছু সমস্যায় কিভাবে চিকিৎসা করা দরকার সেই বিষয়েও তিনি পথিকৃৎ। তিনি প্রমাণ করেন যে ক্ষয়রোগ একটি সংক্রামক ব্যাধি। তার দুটো বই পাশ্চাত্য জগতে আলোড়ন তোলে। অষ্টাদশ শতাব্দীতেও কিছু ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বইগুলি পাঠ্যপুস্তক হিসাবে ব্যবহার করা হত। বই দুটির ইংরেজি নাম The canon of medicine এবং The book of healing।

বিজ্ঞানে ইসলামীয় বিজ্ঞানীদের অবদান সম্বন্ধে আলোচনা এখানেই শেষ করছি। এছাড়া পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, জীববিদ্যা এবং উদ্ভিদবিদ্যায় অনেক কাজ তখন হয়েছিল। স্থানাভাবে সেগুলি এখানে সংকলিত করতে পারলাম না। সবশেষে এক বিরাট প্রশ্ন। এত উন্নত, এত যুক্তিবাদী সমাজ কিভাবে পশ্চাদমুখি হয়ে গেল? ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন দিক থেকে এর কারণ অন্বেষণ করার চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ মনে করেন দ্বাদশ শতাব্দীতে আব্বাসিদ সাম্রাজ্য ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল, তার ওপর ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মোঙ্গল আক্রমণ এবং খ্রিষ্টানদের স্পেন অধিকার হওয়ার পর ইসলাম দুনিয়া আর পৃথিবীতে তাদের প্রভুত্ব বজায় রাখতে পারছিল না। এই রাজনৈতিক দুর্বলতাই তাদের বিজ্ঞানে অবক্ষয়ের কারণ। খুব সম্ভব এই বিশ্লেষণ সত্যি নয়। এর বহু আগেই ইসলাম সমাজে যুক্তিবাদের বিপরীত ধর্মী একটা দর্শন ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছিল। খলিফা আল-মামুন বা খলিফা আল- মন্সুর বিশ্বাস করতেন মুতাজিল দর্শনে বা মধ্যপন্থায়। মুতাজিলপন্থীরা মনে করতেন একমাত্র যুক্তির সাহায্যেই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা উচিৎ, অন্ধবিশ্বাসের মাধ্যমে নয়। এতটা যুক্তিবাদ সাধারণ লোকেরা ভালভাবে মেনে নিতে পারছিল না। অনেক সময়ই মনে হত এর ফলে হয়ত কোরানের অভ্রান্ততা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। পরবর্তী খলিফারা মুতাজিলবাদীদের ঢালাও সমর্থনের জায়গা থেকে সরে আসতে শুরু করেন। নবম শতাব্দীর শেষভাগে আল-আসয়ারি যুক্তিবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেন। আসয়ারি দর্শনের মূল কথা হল, শুধু শুধু এত প্রশ্ন করার কোনও অর্থ হয় না। সমস্ত সত্য একমাত্র কোরানে নিহিত আছে। গ্রীক, ভারতীয় বা পারস্য দেশ থেকে আসা বিদেশী দর্শনগুলি মানুষের চিন্তাধারার বিকৃতি ঘটাচ্ছে। দ্রুত আসয়ারিরা জনপ্রিয় হয়ে উঠল। ঐ শতাব্দীতেই দর্শনের পুস্তকের অনুলিখন আইনত দণ্ডনীয় করা হল। দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে মুতাজিলবাদ আরব থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। বেশ কিছুদিন অন্ধকারে প্রচ্ছন্ন থাকার পর, বিজ্ঞান তার স্থান খুঁজে পেল ইউরোপে। তার পরের ইতিহাস সবাই জানেন।

উপসংহার

সবার শেষে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই। এই প্রবন্ধের ভূমিকাতে দেখিয়েছি যে বিজ্ঞান গবেষণার জন্য এক বিশেষ ধরণের সামাজিক পরিবেশ দরকার। এমন এক পরিবেশ যেখানে কেউ কাউকে প্রশ্ন করতে ভয় পাবে না। সমস্ত কিছুই নিজের যুক্তিবাদের নিরীখে যাচাই করে নেবার স্বাধীনতা থাকবে। যদি সাধারণ লোককে বোঝানো হয় যে প্রশ্ন করার দরকার নেই, শাস্ত্রে যা লেখা আছে, তাকেই অভ্রান্ত বলে বিশ্বাস কর, তাহলে সেখানে কিছুতেই বিজ্ঞান চর্চা হতে পারে না। এছাড়া আরও কিছু সামাজিক অবস্থান আছে যা বিজ্ঞানের প্রগতিকে সাহায্য করে। যেমন স্ত্রী পুরুষের সমান অধিকার থাকা দরকার। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বিশাল আর্থিক ব্যবধান যেন না থাকে। যারা রাষ্ট্র চালাচ্ছেন তাদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি সহমর্মিতা থাকা দরকার। যদি তারা নিজেরাই অপবিজ্ঞানের প্রচার করতে শুরু করেন, তাহলে সেই দেশে কখনই বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্ভবপর নয়। এই প্রেক্ষিতে আজকের ভারতবর্ষের দিকে তাকালে কি দেখতে পাব?

আমাদের প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালে মুম্বাইতে রিলায়েন্স হাসপাতালের উদ্বোধন করার সময় বলেছিলেন গণেশের হাতির মাথা প্লাস্টিক সার্জারির নিদর্শন। তিনি আরও বলেন কর্ণ ছিলেন একজন টেস্ট টিউব বেবি। Junior HRD মন্ত্রী সত্যপাল সিং ২০১৮ সালে আউরাঙ্গাবাদে একটি বক্তৃতায় বলেন যে ডারউইনের বিবর্তনবাদ সম্পূর্ণ ভুল, কারণ আজ পর্যন্ত বানর থেকে মানুষের জন্মের ঘটনা কেউ প্রত্যক্ষ করতে পারে নি। তার মতে এরপর থেকে স্কুলে ও কলেজে বিবর্তনবাদ পড়ানো বন্ধ করতে হবে। ২০১৭ সালে রাজস্থানের শিক্ষামন্ত্রী বাসুদেব দেবনানি একটি বক্তৃতায় বলেন গরু একমাত্র প্রাণী যারা নিশ্বাস নেবার সময় অক্সিজেন গ্রহণ করে আবার প্রশ্বাস ফেলার সময় অক্সিজেন ত্যাগ করে। ২০১৫ সালে বিজ্ঞান কংগ্রেসে একজন অবসরপ্রাপ্ত পাইলট একটি পেপার পাঠ করেন, যার মূল বক্তব্য ছিল যে এরোপ্লেন তৈরির সমস্ত তথ্যই ঋষি ভরদ্বাজের “বৃহৎ বিমান শাস্ত্রে” লেখা আছে। ভারতীয় বিদ্যা ভবনের শিক্ষকরা সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন যার নাম ‘ভারতীয় বিদ্যা সার’। বইটিকে AICTE সমস্ত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তক হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর মুখবন্ধে বলা হয়েছে “বৃটিশরা দুশো বছরের ওপর আমাদের পরাধীন করে রেখে তারা যা শেখাতে চায়, তাই আমাদের শিখিয়েছে। এখন সময় এসেছে তার পরিবর্তন করার। সেই উদ্দেশ্যে বইটি লেখা হয়েছে।” বইয়ে একটি অধ্যায় আছে, যার নাম অবাস্তব বনাম বাস্তব। যেমন অবাস্তব হিসাবে বলা হয়েছে যে অনেকে বিশ্বাস করেন যে রাইট ভ্রাতৃদ্বয় ১৯০৩ সালে প্রথম বিমান তৈরির সূত্র আবিষ্কার করেন। কিন্তু বাস্তব হল বৈদিক যুগে মহর্ষি ভরদ্বাজ যন্ত্রসর্বস্ব নামে একটি পুস্তক লেখেন। তার একটি অধ্যায়ে বিমান তৈরির সূত্র দেওয়া আছে। অতএব রাইট ভাইদের ৫০০০ বছর আগে ভারতবর্ষে বিমান আবিষ্কার হয়েছিল। অবশ্য যন্ত্রসর্বস্ব বইটি এখন আর পাওয়া যায় না, কিন্তু যথেষ্ট প্রমাণ আছে যে বইটি ছিল। আর একটি অবাস্তব শিক্ষা হল ব্যাটারির আবিস্কর্তা হিসাবে ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক ড্যানিয়েলের নাম বলা হয়। এও বলা হয় বিদ্যুতের তথ্য প্রথম দেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। দুটো বক্তব্যই ভুল। কারণ মহর্ষি অগস্ত্যের অগস্ত্যসংহিতা পুস্তকে এগুলির বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। আরও একটি তথাকথিত অবাস্তব বিশ্বাসের কথা বলে প্রসঙ্গটি শেষ করব। অনেকেই মনে করেন স্যার আইজাক নিউটন ১৬৬৬ সালে মাধ্যাকর্ষণের সূত্র আবিষ্কার করেন। কিন্তু তা অবাস্তব। বাস্তব ঘটনা হল এই সূত্র বহু আগে ভারতবর্ষে আবিষ্কৃত হয়েছিল। এমন কি ঋগ্বেদেও তার উল্লেখ আছে। আমাদের বর্তমান কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল নিশঙ্ক, যার ওপর নতুন শিক্ষানীতির সঠিক রূপায়নের দায় ন্যস্ত করা আছে, তিনি গত বছর ২০১৯ সালের ১৮ই আগস্ট আর এস এস অনুমোদিত একটি উৎসবে (জ্ঞানোৎসব) ভাষণ দিয়েছেন। ঐ উৎসবে আর এস এস প্রমুখ, আর এস এসের নেতাগণ ছাড়াও অনেকগুলি আই আই টি ও এন আই টির ডাইরেক্টররা এবং UGC ও AICTEর প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। নিশঙ্ক আই আই টির ডাইরেক্টরদের বলেন মাধ্যাকর্ষণ সূত্র যে সত্যিই ভারতে বহু হাজার বছর আগেও জানা ছিল সেই তত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য তারা যেন অবিলম্বে কিছু প্রোজেক্ট শুরু করে দেন। এই উৎসবের এক সপ্তাহ আগে মুম্বাইয়ে  আই আই টির সমাবর্তনে ভাষণ দেবার সময় নিশঙ্ক দাবী করেছিলেন পরমাণু তত্ত্বের প্রথম আবিষ্কর্তা হলেন চরক। কিন্তু এখানে এসে তিনি ঘোষণা করলেন পরমাণু তত্ত্বের আবিষ্কার করেছিলেন কোন এক ঋষি প্রণব। এই ধরণের লোকেরা কিভাবে শিক্ষানীতিতে বিজ্ঞান প্রসারের কথা বলবেন? এরা চরমভাবে বিজ্ঞানবিরোধী। এদের কীর্তিকলাপের তালিকা অসীম। সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের আক্রমণের সময় এরা একের পর এক অবৈজ্ঞানিক প্রচার করে গেছেন। যেমন বলা হল গোমূত্র ও গোবর খেলে করোনা সেরে যায়। প্রচুর লোক আমাজনে অনলাইন অর্ডার দিয়ে গোমূত্র আনালেন। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় কামধেনু আয়োগ গঠিত হয়েছে। সেখান থেকে দাবী করা হচ্ছে “১৯৮৪ সালে ভোপালে গ্যাস দুর্ঘটনায় ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু যাঁদের মাটির ঘরের দেওয়ালে গোবর লেপা ছিল, তাঁদের কোনও ক্ষতি হয়নি”। আরও এক অদ্ভুত দাবী তারা করেছেন। তাদের মতে কোনও এক জায়গায় দীর্ঘদিন ধরে গবাদি পশু জবাই করা হলে সেই মরণ-আর্তনাদের ‘প্রভাব’ পড়ে ভূস্তরের উপর। এর ফলে সৃষ্ট হয় ‘আইনস্টাইনিয়ান পেন ওয়েভ’। তার দীর্ঘস্থায়ী ফল হিসেবেই নাকি ভূমিকম্প হয়। বলা বাহুল্য  ‘আইনস্টাইনিয়ান পেন ওয়েভ’-এর নাম বিজ্ঞানী মহলে সম্পূর্ণ অপরিচিত। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘওয়াল গত জুলাই মাসে দাবি করলেন স্থানীয় একটি পাঁপড়, যার নাম ভাবিজি পাঁপড়, করোনা প্রতিষেধক হিসাবে কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে। দুঃখের বিষয় তার কিছুদিন বাদে মেঘওয়াল নিজেই করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। ২৩শে জুন, ২০২০তে গুরু রামদেব ও আচার্য্য বালকৃষ্ণ  কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন এবং কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী নিতিন গডকড়ীর উপস্থিতিতে সাংবাদিক বৈঠক করে জানালেন পতঞ্জলী কোম্পানি করোনার ওষুধ আবিষ্কার করে ফেলেছে। তারা তাদের ওষুধ সেখানে প্রদর্শন করে জানান যে ২৮০ জন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির ওপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে শতকরা ১০০ জন এক সপ্তাহের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছেন। রামদেব জানান, হু-র কাছ থেকেও ছাড়পত্র পেয়ে গিয়েছেন তাঁরা। এমনকি সেখানে টাঙানো ব্যানারেও পরিষ্কার ভাষায় লেখা ছিল, করোনিল হু-র কাছ থেকে ওষুধজাতীয় পণ্যের শংসাপত্র (সিওপিপি) পেয়েছে এবং হু-র গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিসেস (জিএমপি) বিভাগ থেকেও অনুমোদন পেয়েছে। তৎক্ষণাৎ হু জানিয়ে দেয় যে এই রকম কোনও ছাড়পত্র তারা দেন নি। রামদেব আরও জানিয়েছিলেন যে উত্তরাখণ্ড সরকারের অনুমোদন অনুসারে তারা এই ওষুধ বাজারে বিক্রি করছেন। উত্তরাখণ্ডের ড্রাগ কন্ট্রোলার প্রকাশ্য বিবৃতি দিলেন যে পতঞ্জলিকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল ইমিউনিটি বাড়াবার ওষুধের জন্য, করোনার ওষুধের জন্য নয়। ২৯শে জুন কিছু লোক রাজস্থানে আদালতে ৫ জনের বিরুদ্ধে জুয়াচুরি (৪২০ ধারা) , আপত্তিজনক বিজ্ঞাপনের (৪ ও ৭ সেকশন) অভিযোগ আনেন। এই ৫ জন হল, রামদেব, বালকৃষ্ণ , জয়পুরের National Institute of Science & Research (NIMS)-এর অধিকর্তা বি এস টোমার, তার পুত্র অনুরাগ টোমার এবং ঐ সংস্থার উচ্চপদস্থ বৈজ্ঞানিক অনুরাগ ভার্সনে। কারণ দাবী করা হয়েছিল ওষুধের clinical trial নাকি NIMS-এ  হয়েছিল। কোর্ট থেকে নির্দেশ দেওয়া হল এরা সবাই যেন অবিলম্বে clinical trial-এর বিশদ তথ্য কোর্টে পেশ করেন। বেগতিক দেখে ৩০শে জুন রামদেব জানালেন যে তাদের বক্তব্য লোকে ভুল বুঝেছে। তারা করোনার কোন ওষুধ আবিষ্কার করে নি। এত বড় একটা জালিয়াতি করা সত্ত্বেও কিন্তু কারও বিরুদ্ধে কোনও শাস্তির নির্দেশ এল না।

হায়, কি দুর্ভাগা আমাদের দেশ। বোঝাই যাচ্ছে এই ধরণের শক্তি যদি ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত থাকে, তাহলে স্বাধীন ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার যে দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল, তা চিরতরে বিনষ্ট হবে।♣

[লেখক পরিচিতিঃ ভূতপূর্ব অধ্যাপক, সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, সুবক্তা ও সুলেখক। অবসরের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান ও পাঠক্রম নির্মাণের কাজে যুক্ত থেকেছেন। একাধিক বই সম্পাদনা করেছেন। সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থঃ স্টিফেন হকিং (একটি বৈজ্ঞানিক জীবনী)]

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *