গেইল ওমবেট— এক মহিয়সী নারীর আত্মত্যাগের কাহিনী

কমলেশ ভৌমিক

ভারত পাটাণকার

পুণে মহারাষ্ট্রের এক সুন্দর শৈলশহর। এর মনোরম আবহাওয়া, সুদৃশ্য প্রাকৃতিক শোভা সব সময় আমাদের আকর্ষণ করে। আধুনিক কালে তার সাথে যুক্ত হয়েছে অনেকগুলি বিখ্যাত শিক্ষায়তন ও আই টি হাব্। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে পুণের অসামান্য অবদান আছে। উনবিংশ শতাব্দী থেকেই বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারক সাম্য ও স্বাধীনতার জন্য এখানে জীবনপাত করেছেন। তাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শত শত তরুণ যুবক প্রত্যক্ষ স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মবলিদান দিয়েছেন। এদেরই এক অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি ছিলেন বাবুজি পাটাণকার, পরবর্তীকালে যাকে ‘ক্রান্তিবীর’  উপাধি দেওয়া হয়। ১৯৪০ সাল নাগাদ সাতারা জেলায় একটা প্রচেষ্টা নেওয়া হয় তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে একটি সমান্তরাল সরকার গড়ে তোলার, যার নাম দেওয়া হয়েছিল প্রতিসরকার। পুণের শতাধিক যুবক এই প্রতিসরকারের সমর্থনে নিজেদের ঘরবাড়ী ছেড়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াতেন। তারা অবহেলিত জনগণের সার্বিক উন্নতির জন্য সামাজিক আন্দোলন করতেন। সেই সঙ্গে তাদের হাতে থাকত পিস্তল ও রিভলভার। প্রয়োজন হলে তারা ব্রিটিশের পুলিশের বিরুদ্ধেও অস্ত্র ধরতে দ্বিধা করতেন না। এমনই একজন যোদ্ধা ছিলেন বাবুজি পাটাণকার। বাবুজি জন্মেছিলেন সাতারার এক অখ্যাত গ্রাম কাসেগাঁও-এর এক কৃষি পরিবারে। 

ঐ সাতারা জেলাতেই ইন্দোলি গ্রামে জন্মেছিলেন আর এক স্বাধীনতা যোদ্ধা দিনকর রাও নিকম্। ১৯৩০ সাল থেকেই তিনি কংগ্রেসের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। সত্যাগ্রহ করার জন্য জেলে যান। জেলেতে তার সাথে বিখ্যাত মারাঠি কম্যুনিষ্ট নেতাদের সাথে পরিচয় হয়। তাদের সাথে আলোচনার ফলে দিনকর কম্যুনিষ্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এবং মার্ক্সবাদকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেন। দিনকরের কন্যা ইন্দুমতী (যাকে সবাই ইন্দুতাই বলে ডাকত) শিশুকাল থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিবেশের মধ্য দিয়ে বড় হতে থাকেন। তার মা সরস্বতী তাকে যথাসাধ্য আগলে রাখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ১৯৪২-এর “ভারত ছাড়” আন্দোলনে যোগ দেন। শুধু তাই নয়। তিনি অনেক মহিলাকে এই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধও করেন। তার প্রাত্যহিক কাজকর্ম ছিল এই রকম। সকালে উঠে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে তাদের অভাব অভিযোগ জেনে সেগুলি যথাসাধ্য প্রতিকার করতেন। রাতের অন্ধকারে তিনি গোপনে প্রতিসরকারের যোদ্ধাদের কাছে পিস্তল ও রিভলভার পৌঁছে দিতেন। এই সময় ১৯৪৩ সালে তার সাথে বাবুজির পরিচয় ঘটে। দুজন দুজনের প্রেমে পড়েন। অবশেষে ১৯৪৬ সালের ১লা জানুয়ারি তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। 

বাবুজি ও ইন্দুতাই ১৯৪৯ সালে অরুণা আসফ আলির নেতৃত্বে গঠিত মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী সমাজবাদী পার্টির সভ্য হন। ঐ বছরেই ৫ই সেপ্টেম্বর বাবুজির একমাত্র সন্তান ভারতের জন্ম হয়। পরে ১৯৫২ সালে বাবুজি ও ইন্দুতাই দুজনেই ভারতীয় কম্যুনিষ্ট পার্টিতে যোগদান করেন। বাবুজি প্রকাশ্য সভায় তদানীন্তন ভারত সরকারের নিন্দা করে বলেন যে স্বাধীনতার পরও নিম্নবর্গীয় হিন্দু, দলিত বা গরিব মুসলমানদের সামাজিক অবস্থানের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। তার এই ধরণের বক্তব্যে বিরক্ত হয়ে ১৯৫২ সালে স্থানীয় প্রভাবশালী উচ্চবর্ণের নেতারা ভাড়াটে গুণ্ডা পাঠিয়ে বাবুজিকে হত্যা করে। ফলে দু বছরের শিশু সন্তানকে বড় করে তোলার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে এসে পড়ে তার মা ইন্দুতাইয়ের ওপর। ইন্দুতাই একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। অবসর পাওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ঐ বুনিয়াদী স্কুলেই শিক্ষকতা করে গেছেন। সকালে ও বিকালে তিনি তার শ্বশুর ও শাশুড়ির সাথে তাদের চাষের জমিতে চাষ আবাদ করতে যেতেন। ইতিমধ্যে ইন্দোলিতে তার পৈত্রিক বাসস্থান কম্যুনিষ্ট পার্টির সদর দপ্তর হয়ে উঠেছিল। এবার কাসেগাঁওয়ে তাদের বাড়িও কম্যুনিষ্ট পার্টির অফিসে রূপান্তরিত হতে শুরু করল। সামান্য শিক্ষকতা থেকে সংসার চালালেও ইন্দুতাই তার সমাজ সংস্কারের কাজে বিন্দুমাত্র শৈথিল্য দেননি। বাবুজি বেঁচে থাকাকালীন তারা দুজনে কাসেগাঁও গ্রামে প্রথম উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজাদ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। স্থানীয় কৃষি শ্রমিকদের সংগঠিত করে তিনি অনেক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তিনি স্ত্রীমুক্তি সংঘর্ষ চালাওয়াল নামে একটি নারী জাগরণ সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন এবং আজীবন তাকে পরিচালনা করেন। এছাড়া তিনি “পরিত্যক্তা” নামক একটি সংগঠন সৃষ্টি করেন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজের পরিত্যক্ত মহিলাদের একত্র করে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এই প্রচেষ্টা বিশেষভাবে সাফল্য অর্জন করে। এত কাজের মধ্যেও কিন্তু তার সন্তানকে এতটুকু অবহেলা তিনি করেন নি। ভারত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি শিবাজী বিশ্ববিদ্যালয়ের মিরাজ মেডিকাল কলেজ থেকে ডাক্তারী পাশ করেন। কিন্তু চিকিৎসাবিদ্যাকে কখনও নিজের পেশা হিসাবে গ্রহণ করেননি। তিনিও তার মা ও বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সমাজসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। যখন থেকে ভারত প্রত্যক্ষভাবে সমাজ আন্দোলন করতে শুরু করলেন, তখন থেকে তার মা ইন্দুমতি ছেলের সমস্ত গঠনমূলক কাজে আপ্রাণ সহযোগিতা করে গেছেন। অতি সম্প্রতি ২০১৭ সালে অল্প রোগভোগের পর ৯১ বছর বয়সে ইন্দুমতি তার কাসেগাঁওয়ের বাড়িতেই মারা গেছেন। 

Gail Omvedt

(গেইল ওমবেট) 

গেইলের মা-বাবা স্কান্ডিনেভিয়ান কোনও একটি দেশ থেকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে মিনিয়াপোলিসে এসে বসবাস শুরু করেন। কি কারণে তারা নিজের দেশ ছেড়ে আমেরিকায় এসেছিলেন তা বর্তমান লেখকের জানা নেই। ওখানেই ২রা আগষ্ট ১৯৪১ সালে তাদের কন্যাসন্তান Gail Marie Omvedt-এর জন্ম হয়। তার মা ডরোথি কোনও চাকরি করতেন না। বাবা জ্যাক ছিলেন পেশায় আইন ব্যবসায়ী। তবে তিনি প্রধানত মামলা লড়তেন স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ানদের পক্ষে। [এরপর থেকে বাংলায় গেল্ না লিখে ইংরাজীতে Gail ব্যবহার করব। তাহলে বাংলা শব্দ “গেল”-এর সাথে ভুল বোঝাবুঝি হবে না।] কার্লটন কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর Gail ভারতের গ্রামীণ সমাজের ওপর গবেষণা করার জন্য ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পেয়ে ১৯৬৩ সালে ভারতে আসেন। কিছুদিন ভারতে কাটিয়ে গ্রামীণ সমাজের ওপর কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তিনি লাভ করেন। এই গবেষণার কাজ তার খুব ভাল লেগেছিল, কিন্তু তাকে পরবর্তী উচ্চশিক্ষার জন্য নিজের দেশে ফিরে যেতে হয়। দেশে ফিরে তিনি বার্কলের কালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী এবং পরে সমাজবিজ্ঞানে ডক্টরেট করেন। প্রথমবার ভারতবর্ষে এসে Gail দেখেছিলেন বহুজন সম্প্রদায়, বিশেষভাবে দলিতদের, কি পরিমাণ সামাজিক অত্যাচার সহ্য করে বেঁচে থাকতে হয়। মানুষের প্রতি মানুষের এই অবজ্ঞা ও অপমান তার মনকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল। কালিফোর্নিয়া থাকাকালীন তিনি স্থির করেন আবার ভারতবর্ষে গিয়ে তিনি ভারতের অবহেলিত সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর যেসব নির্দয় সামাজিক অপমান চাপিয়ে দেওয়া হয় সেগুলির বিস্তৃত বিবরণ ও ব্যাখ্যাসহ তার অসমাপ্ত গবেষণা সম্পূর্ণ করবেন। তাই ১৯৭০ সালে তিনি আবার ভারতে ফিরে আসেন। এখানে থেকেই তার থিসিস ‘Cultural Revolt in a Colonial Society: The Non-Brahman Movement in Western India, 1873-1930’ সম্পূর্ণ করেন। থিসিসটি পরে পুস্তকাকারে ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয়। ভেবেছিলেন গবেষণার কাজ সমাপ্ত করে আবার নিজের দেশে ফিরে যাবেন। কিন্তু সে সম্ভাবনা আর কোনওদিনই ঘটেনি। Gail তার গবেষণার কাজের জন্য দলিত সমাজের সাথে এমন একাত্ম হয়ে মিশে গিয়েছিলেন যে ধীরে ধীরে কখন তিনি তাদের একজন পরমাত্মীয় হয়ে উঠেছেন, তা নিজেও টের পান নি। দলিত, গরীব মুসলমান বা পিছিয়ে পড়া জনজাতিদের ওপর সামাজিক অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে শুরু করলেন। এইসব আন্দোলনে অংশ নেওয়ার সময় একটি প্রতিবাদী মিছিলে তিনি পরিচিত হলেন সমাজসংস্কারক ডাক্তার ভারত পাটাণকারের সাথে। ভারত পাটাণকার মার্ক্সবাদের ওপর প্রচুর পড়াশুনা করেছেন। বৌদ্ধদর্শনের ওপরও তার সুগভীর জ্ঞান। আবার এত সমৃদ্ধ দর্শনে অভিজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও তিনি জ্যোতিবা ফুলের মতাদর্শের সাথে সম্পূর্ণ সহমত। ঠিক এই রকম একটি মানুষের সাক্ষাৎ পাওয়া বোধহয় Gail-এর মনের গভীরে সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা হিসাবে লুকিয়ে ছিল। এই রকম স্পষ্টবাদী, নির্ভীক, শিক্ষিত অথচ নিরহঙ্কারী, নির্লোভ ব্যক্তিত্বকেই হয়ত তিনি মনে মনে খুঁজছিলেন। Gail ভারত পাটাণকারের প্রেমে পড়ে গেলেন। ১৯৭৬ সালে তারা বিবাহ করলেন।

ছবি ১: Gail Omvedt ১৯৭০ সাল নাগাদ ভারতবর্ষে

বিবাহের পর 

বিয়ের পর Gail কাসেগাঁও গ্রামে তার শাশুড়ির কাছে চলে এলেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এই প্রত্যন্ত গ্রামের শ্বশুরের ভিটা ছেড়ে কোথাও যাননি। সমস্ত আন্দোলন এবং সাংগঠনিক কাজকর্ম তিনি এই বাড়িকে কেন্দ্র করেই করতেন। Gail তার শাশুড়ি ইন্দুমতিকে খুব ভালবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন। তার অনেক লেখাতে তিনি ইন্দুতাইয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। ইন্দুমতি যে সব সংগঠন তৈরি করেছিলেন, যেমন স্ত্রীমুক্তি সংঘর্ষ চালাওয়াল বা পরিত্যক্তা, ধীরে ধীরে সেগুলির পরিচালনার দায়িত্ব Gail নিয়ে নিলেন। ইন্দুতাইও বৌমাকে মেয়ের অধিক স্নেহ করতেন। বিয়ের কয়েক বছর বাদে Gail তার আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ছাড়ার জন্য আবেদন করেন। অবশেষে ১৯৮৩ সালে তিনি পুরোপুরি ভারতীয় নাগরিকত্ব পান। ভারত পাটাণকারের সাথে একত্রে তিনি একটি নতুন সংগঠন “শ্রমিক মুক্তি দল” সৃষ্টি করেন। এই সংগঠনের প্রধান কাজ হল মহারাষ্ট্রের দশটি জেলায় কৃষক এবং শ্রমিকদের ওপর যে যে দুর্দশা নেবে আসে তার প্রতিকার করা। তা সে প্রাকৃতিক দুর্যোগ খরা বা বন্যা হোক, বা মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগই হোক। বিভিন্ন জায়গায় জমি অধিগ্রহণ করে কৃষকদের বাস্তুচ্যুত করার বিরুদ্ধে তারা অনেক আন্দোলন করেছেন। অনর্থক বাঁধ তৈরি করে গরীব মানুষের বিপদ সৃষ্টি করার বিরুদ্ধেও তারা প্রচুর কাজ করেছেন। অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে তাদের প্রাপ্য পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ফুলে এবং আম্বেদকরের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এবং মার্ক্সবাদকে লড়াইয়ের হাতিয়ার করে ভারত পাটাণকার ও Gail আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে Gail যখন কার্লটন কলেজে পড়ছিলেন, তখন তার একজন শিক্ষিকা ছিলেন Eleanor Zelliot। তিনিই বোধহয় প্রথম শ্বেতকায়া আমেরিকান মহিলা যিনি ভারতবর্ষে এসে এখানে বসবাস করে এখানকার জাতিভেদ প্রথার সমস্যা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। হয়তো তার জীবন Gailকে অনুপ্রাণিত করেছিল। Gail কার্লটন কলেজে তার মাস্টার থিসিস ১৯৬৩ সালে জমা দিয়েছিলেন, যার শিরোনাম ছিল Caste, Conflict and Rebellion। এই থিসিসের জন্যই তিনি ভারতে গবেষণার জন্য ফুলব্রাইট ফেলোশিপ পান। থিসিসটি বার্কলের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালে অনুমোদিত হয়। গেল্ ওম্ভেট্ দলিতদের সমস্যা নিয়ে প্রচুর বই এবং অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন। তার বইগুলির আংশিক তালিকা নিচে দিলাম। 

Dalit Vision (1975) 

We Shall Smash This Prison: Indian Women in Struggle (1979) 

Land, caste, and politics in Indian states (1982) 

Violence against Women (1990)

Reinventing Revolution: New Social Movements and the Socialist Tradition in India(1993)

Gender and Technology: Emerging Asian Visions (1994)

Dalits And The Democratic Revolution: Dr. Ambedkar And The Dalit Movement In Colonial

India (1994)

Dalit Visions: the Anticaste movement and Indian Cultural Identity (1995)

Growing Up Untouchable in India: A Dalit Autobiography (2000) (বসন্ত মুনের লেখার অনুবাদ) 

Cutivator’s Whipcord (ফুলের লেখা সেতকারাইচা আসুদের অনুবাদ) 

Buddhism in India: Challenging Brahminism and Caste (2003)

Jyotirao Phule and the ideology of social revolution in India—critical quest (2004) 

Ambedkar: Towards an Enlightened India (2005)

Seeking Begumpura: The Social Vision of Anticaste Intellectuals (2008)

Understanding Caste-from Buddha to Ambedkar and beyond (2011) 

Songs of Tukoba (2012) (অনুবাদ) 

Dalits and the Democratic Revolution (2013)

ছবি ২:  অস্পৃশ্য জাতির মেয়েদের সাথে একসাথে বসে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন Gail Omvedt

বিয়ের অব্যবহিত পরে Gail মহিলা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মহিলাদের অধিকার ও সম্মান অর্জনের জন্য Gail যে সব আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেখানে তার আদর্শ পুরুষ ছিলেন আম্বেদকর ও জ্যোতিবা ফুলে। আর লড়াইয়ের পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিল মার্ক্সবাদের দর্শন। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয় তার লেখা “আমরা এই কারাগার চুরমার করব: সংগ্রামী ভারতীয় মহিলারা”। এই বই কোনও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নয়। Gail প্রত্যক্ষভাবে প্রতিটি নারীমুক্তি আন্দোলনে অংশ নিতেন। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তিনি এই বইটি লেখেন। Gail-এর নারী আন্দোলনগুলি শহুরে নারীবাদী আন্দোলন নয়। তিনি কাজ করতেন সমাজের সব চাইতে পিছিয়ে পড়া অংশের মধ্যে। তাদের সাথে একাত্ম হয়ে যেতেন। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সমাজের কাছে এমনিতেই অবহেলিত, কিন্তু তাদের মধ্যে মেয়েরা আবার অতিরিক্ত অবহেলিত। তাই তার বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন চাষী পরিবারের একজন মেয়ের জবানবন্দী, যে বলছে তাকে মাঠের কাজ ত’ করতেই হয়, তার ওপর ঘরের সব কাজ সামলাতে হয়। দ্বিতীয় অধ্যায়ে একজন মহিলা শ্রমিক জানাচ্ছেন যে ইউনিয়ন ছাড়া কোন উপায় নেই। এখন ইউনিয়ন তাদের মা। তৃতীয় অধ্যায়ে একজন ছাত্রী জানাচ্ছে যে লেখাপড়া শিখলেও তার নিজের বিষয়েও কোনও রকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার তার অনুমতি নেই। পরের অধ্যায়ে এক বামপন্থী কর্মী স্বীকার করছেন যে তারাও মহিলাদের বিশেষ অসুবিধাগুলি সঠিক প্রেক্ষিতে কখনও দেখেননি। এইভাবে একের পর এক অধ্যায়ে নারী আন্দোলনের পটভূমিকা সৃষ্টি করার পর লেখিকা আহ্বান জানাচ্ছেন নারী মুক্তি আন্দোলন ছাড়া কোনও গত্যন্তর নাই। সবাইকে এই আন্দোলনে সামিল হতেই হবে। পরবর্তীকালে ২০০৮ সালে বিখ্যাত কবি ও লেখিকা মীনা কাণ্ডাস্বামীর কাছে একটি ইন্টারভিউ দেবার সময় Gail বলেন “জাতিভেদপ্রথা ততদিনই টিকিয়ে রাখা যাবে, যতদিন পর্যন্ত মেয়েদের যৌনতা সম্পূর্ণভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বশীভূত থাকবে। মারাঠিতে একটা প্রচলিত কথা আছে রোটি-বেটি-ব্যবহার, যার অর্থ রুটি এবং মেয়েদের নিজের জাতির মধ্যেই আদানপ্রদান করতে হবে। স্বজাতির বাইরে যদি কেউ কোনও মেয়েকে ভোগ করে, তাহলে সেই মেয়েটি এবং তার জাতি কলুষিত হবে। কাজেই মেয়েদের যৌনতা যাতে অপবিত্র না হয়, সেই দায়িত্ব পুরুষদের। এ সম্বন্ধে মনু খুব স্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, মেয়েরা প্রথম জীবনে থাকবে পিতার অধীনে, পরে যৌবনে থাকবে স্বামীর অধীনে, যখন তারা বৃদ্ধা হবে তখন থাকবে তার ছেলেদের অধীনে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোনওভাবেই মেয়েরা স্বাধীনতা অর্জন না করতে পারে।” আরও অনেক পরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রচুর শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও Gail সাবিত্রীবাই ফুলে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নারীবাদী কনফারেন্সে উদ্বোধনী বক্তৃতায় বলেন “জল, বায়ু, সূর্যালোক, অরণ্য ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদে আমাদের জন্মগত অধিকার। মেয়েদের আন্দোলনের মাধ্যমে এই সব সম্পদে অধিকার ফিরে পাওয়া এবং তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব মেয়েদেরই গ্রহণ করতে হবে। মেয়েদের উদ্যোগে সৃষ্টি করতে হবে কমিউনের (commune) যেখানে সমভাবাপন্ন পরিবারেরা একত্রে বসবাস করে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাজকে আরও উন্নত স্তরে পৌঁছে দেবে। তিনি ইন্দুতাইয়ের পরিত্যক্তা আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে বলেন, মেয়েরা যদি এই আন্দোলনকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে তারা দেশের কাছে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার একটি বিকল্প স্থাপন করতে পারবে। নারী আন্দোলন নিয়ে শুধুমাত্র তাত্ত্বিক কচকচি না করে তার ব্যবহারিক প্রয়োগের উদাহরণ আমাদের দেখাতেই হবে।” এই বক্তৃতাই বোধহয় Gail-এর সর্বশেষ সাধারণ সভার ভাষণ ছিল। 

ছবি ৩:  একদম বাম দিকে চিত্রপরিচালক সোমনাথ ভাগামারে, তার বামে Gail Omvedt, তার পাশে নাতনি নিয়া, মেয়ে প্রাচী ও জামাই তেজস্বী। একদম বাঁ দিকে ভারত পাটাণকার।

স্পষ্টবক্তা Gail

Gail ভাবের ঘরে কখনও চুরি করেন নি। তিনি মনে মনে যা সঠিক বলে মনে করতেন, সেই কথাই প্রকাশ্যে বলতেন। যাদের বিরুদ্ধে বলছেন তারা যদি সমাজের চোখে খুব সম্মানীয় ব্যক্তিও হন, তাতে তার কিছু এসে যেত না। এ বিষয়ে তিনি ছিলেন মহাত্মা ফুলের আদর্শ শিষ্যা। Gail-এর স্পষ্টবাদীতার অনেক উদাহরণ আছে। এখানে শুধু একটা ঘটনা উল্লেখ করব। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে দরিদ্র জনসাধারণ বা আদিবাসীরা যখন তাদের নিজেদের প্রচেষ্টায় আত্মরক্ষার জন্য কোন আন্দোলন গড়ে তোলে, প্রায়শই তার অন্তিম পর্বে কোনও উচ্চবর্ণের ব্যক্তি এসে নিজেকে ঐ আন্দোলনের নেতা বলে ঘোষণা করে আন্দোলনের কৃতিত্ব আত্মসাৎ করে নেয়। ১৯৭০ সালের গোড়ার দিকে গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশে প্রবাহিত নর্মদা নদীতে বাঁধ তৈরীর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এই পরিকল্পনাতে ঠিক করা হয়েছিল গুজরাটে অবস্থিত সর্দার সরোবর বাঁধের উচ্চতা অনেকটা বাড়ানো হবে এবং নর্মদা নদীর ওপর আরও ৩০টি বৃহৎ, ১৩৫টি মাঝারি এবং ৩০০০ ছোট বাঁধ করা হবে। এই কাজের জন্য ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক থেকে বিশাল অর্থসাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে ঐ নদীর  দুই পারের গ্রামবাসীরা শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। তারা বুঝতে পারছিলেন যে এই বাঁধ তৈরী করা হলে তাদের প্রাত্যহিক জীবিকা অসম্ভব ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেককেই বাসস্থান থেকে উৎখাত হতে হবে। এদের অধিকাংশই ছিলেন গরীব আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের লোক। তারা চাইছিলেন সরকার থেকে যেন অঙ্গীকার করা হয় যে তারা উৎখাত হয়ে যাবার পর, তাদের সমপরিমাণ কৃষিযোগ্য জমি ও বাঁধের জলের ব্যবহার করার সুযোগ দেওয়া হবে। সরকার এই ধরণের কোন দায়িত্ব নিতে রাজী হয় না। আস্তে আস্তে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এক বিরাট আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনে ধীরে ধীরে অনেক সমাজসেবী সংস্থা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যোগদান করতে থাকেন। গড়ে ওঠে “নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন”। আন্দোলনের ঢেউ সুপ্রিম কোর্ট এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক অবধি পৌঁছে যায়। এর ফলে বাঁধের কাজ থামিয়ে দিতে সরকার বাধ্য হয়। এই আন্দোলনের শেষভাগে এতে যুক্ত হন মেধা পাটকার ও বাবা আমতে। সংবাদপত্রে প্রচার করা হয় যে এটা মেধা পাটকারের আন্দোলন। মেধাকে এই সমাজসেবার জন্য Right Livelihood Award দেওয়া হয়। অরুন্ধতী রায় এবং আমির খান মেধার সমর্থনে বিবৃতি দেন। এই বিবৃতি দেখে Gail অসন্তুষ্ট হয়ে অরুন্ধতী রায়কে আট পাতার এক বিশাল চিঠি লেখেন। সেই চিঠির অংশবিশেষ নীচে দিচ্ছি। 

প্রিয় অরুন্ধতী,

তোমাকে এই সমালোচনামূলক চিঠি লিখতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত। তোমার The God of Small Things আমার খুব ভাল লেগেছে। আণবিক শক্তির বিষয়ে তোমার হস্তক্ষেপ প্রশংসনীয়। আমি ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেসে যখন পড়লাম যে তুমি তোমার বইয়ের রয়ালটির একাংশ দলিত সাহিত্য একাডেমিকে দান করতে চাও, তখন আমি চমৎকৃত হয়েছিলাম। 

কিন্তু বৃহৎ বাঁধ প্রকল্পের বিষয়ে ……………………………………… ইত্যাদি ইত্যাদি 

তোমার উত্তরের প্রতীক্ষায় রইলাম। 

গেল্ ওম্ভেট্ 

কাসেগাঁও 

এই দীর্ঘ চিঠিতে যে যে বিষয়বস্তুর ওপর Gail অরুন্ধতীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, সেগুলি হল: 

(১) নর্মদা বাঁধের বিরুদ্ধে মহারাষ্ট্রে প্রথম আন্দোলন গড়ে তোলে সি পি আই (এম), শ্রমিক মুক্তি দল এবং ধূলে জেলার এক আদিবাসী সংগঠন, যার নাম ছিল শ্রমিক সংগঠন। মেধা অনেক পরে আন্দোলনে যোগ দেন। সেই সময়  মেধা দাবী জানাচ্ছিলেন ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের দেওয়া নির্দেশাবলী যেন যথাযথভাবে মানা হয়। ওই নির্দেশাবলীতে বলা ছিল প্রতি পরিবারের কেবলমাত্র পুরুষপ্রধানরাই ভর্তুকি হিসাবে জমি পাবে, মেয়েরা নয়। মেয়েদের জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত করার বিরুদ্ধে Gail ও তার সহযোদ্ধারা ততদিনে বেশ কিছু আন্দোলন শুরু করে দিয়েছিলেন। মেধা কিন্তু মেয়েদের বঞ্চনার বিষয়কে কোন গুরুত্ব দেন নি। 

(২) তবে ওপরের অভিযোগ খুবই লঘু। এর থেকে অনেক গুরুতর অভিযোগের কথা Gail পরে পেশ করেছেন। তিনি লিখেছেন একটি কবিতার কথা। আদিবাসী শ্রমিক সংগঠনের এক উৎসাহী তরুণ কর্মী ওয়াহারু সোনাবেনে এটি রচনা করেন। ওয়াহারু ছিলেন বিখ্যাত মার্ক্সবাদী নেতা অম্বরসিং মহারাজের ছায়াসঙ্গী। দুর্ভাগ্যক্রমে ওয়াহারু ইংরেজী শেখার সুযোগ পান নি। কবিতাটি মারাঠি ভাষায় লেখা, যদিও কবিতার নাম ইংরেজী “Stage”। Gail তার চিঠিতে কবিতার মাত্র প্রথম চার পংক্তি ইংরেজি অনুবাদ করে পাঠিয়েছেন। 

[কিন্তু কবিতাটি এত সুন্দর যে বর্তমান লেখক সম্পূর্ণ কবিতা পাঠকের সামনে উপস্থিত করার লোভ সামলাতে পারল না। স্বপ্না ব্যানার্জি গুহর ইংরেজি অনুবাদ থেকে আমি নিজেই এর বাংলা অনুবাদ করেছি। বাংলায় কবিতার নাম দিয়েছি “মঞ্চ”।]    

মঞ্চ 

ওয়াহারু সোনাবেনে 

আমরা ত’ মঞ্চে উঠতে যাই নি।

আমাদের কেউ যেতেও বলে নি। 

ওরা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমরা কোথায় বসতে পারি। 

তাই আমরা সেখানেই বসলাম। 

“বা: , খুব ভাল” , ওরা আনন্দধ্বনি করল। 

তারপর ওরা একে একে মঞ্চে উঠে গেল। 

মঞ্চে উঠে তারা বলতে শুরু করল 

ঐ যারা নীচে বসে আছে, তারা কত দুঃখী। 

কিন্তু হায়! আমাদের দুঃখ ত’ শুধু আমাদেরই থাকবে। 

ওরা এই দুঃখ কষ্ট কখনোও পায় নি, পাবেও না। 

আমরা খুব ধন্দে পড়লাম। 

নিজেদের মধ্যে ফিস্ ফিস্ করে কথা বলতে লাগলাম। 

আমরা কি কথা বলছি তারা শোনার চেষ্টা করল। 

অবশেষে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে আমাদের কানের খুব কাছে এসে 

হুঙ্কার দিয়ে বলল, “চুপ করে থাক্। নাহলে …………………” 

Gail-এর বক্তব্য হল এই কবিতাটাই সব চাইতে বড় অভিযোগ। এই আন্দোলনগুলিতে স্থানীয় আদিবাসী বা পিছিয়ে পরা জনজাতিরা বিপুল সংখ্যায় অংশ গ্রহণ করে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে যখন আন্দোলনের কথা প্রচারিত হয়, তখন এদের আত্মত্যাগের কথা কোথাও লেখা থাকে না। সব সময় দেখানো হয় কোনও শিক্ষিত শহুরে (urban elite) ব্যক্তি এই আন্দোলনের পুরোভাগে আছেন। কিন্তু কেন? যাদের জন্য এই আন্দোলন, তাদের ভেতর থেকে কেন কেউ নেতৃত্ব দিতে উঠে আসেন না? না কি তাদের উঠতে দেওয়া হয় না? 

(৩) মেধা যদিও প্রথমদিকে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের নির্দেশাবলী মেনে উৎখাত হওয়া অধিবাসীদের জন্য জমি পাওয়ার আন্দোলনকে মুখ্য বিষয় হিসাবে এগোচ্ছিলেন, কিন্তু এক সময় তিনি সম্পূর্ণভাবে বাঁধ তৈরির বিপক্ষে চলে যান। এমন একটা ধারণা প্রচার করা হয় যেন বাঁধ তৈরি হলেই জনগণের অমঙ্গল হতে বাধ্য। বাঁধের বিষয়ে যে সব আন্দোলনগুলি মহারাষ্ট্র প্রদেশে সত্তরের দশকের গোড়া থেকে শুরু হয়ে গেছে তাদের কেউই কিন্তু বাঁধের বিপক্ষে ছিল না। এইসব আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঁধ তৈরির সময় যেন ক্ষতিগ্রস্ত অধিবাসীদের অসুবিধাগুলি নজরে থাকে। বাঁধ তৈরি হলে যে জল পাওয়া যাবে, সেই জল যেন সমান ভাবে সবার কাছে ভাগ করে দেওয়া হয়। বাঁধ করার কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই, এই ধরণের স্লোগান খুব বিপজ্জনক। যারা বছরের পর বছর জলের অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন, কৃষিকাজ করতে পারছেন না, তাদের দুঃখদুর্দশাকে ছোট করে দেখা খুব অল্পদৃষ্টির পরিচায়ক। Gail বলেন সঠিকভাবে বিচার না করে বাঁধ বানানোর জন্য যারা অন্যায়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তাদের যেমন দেখা দরকার, ঠিক তেমনি যারা খরাকবলিত হয়ে বছরের পর বছর অনাহারে কাটাচ্ছেন, তাদের অসুবিধাগুলিও আন্দোলনের ভেতর রাখতে হবে। কোনওরকম বাঁধ করা চলবে না, এই ধরণের স্লোগান শুধুমাত্র শাসকশ্রেণীর হাতকেই শক্ত করবে। একদিন পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে শাসকশ্রেণী তাদের ইচ্ছামত বাঁধ তৈরির বিষয়ে জনগণের সমর্থন আদায় করে নেবে। 

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে Gail অরুন্ধতী রায়কে এই চিঠি লেখার অনেক বছর বাদে সর্দার সরোবর বাঁধ হয়ে গেছে। সরকার ঠিক যেমনভাবে চেয়েছিল, ঠিক তেমনভাবেই বাঁধ তৈরি হয়েছে। Gail অরুন্ধতীকে যে সাবধান বাণী দিয়েছিলেন, তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছে। খরাকবলিত এলাকার জন্য বাঁধের প্রয়োজন, এই যুক্তি দেখিয়ে ১৯৯৯ সালে কোর্টের অনুমতি পেয়ে বাঁধ তৈরির কাজ শুরু হয় এবং ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাঁধ উদ্বোধন করেন। নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনে তীব্র বিরোধিতা করা হয়েছিল সর্দার সরোবর বাঁধের উচ্চতা বাড়ানোর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে, কারণ উচ্চতা বাড়ালে অনর্থক বিশাল জমি প্লাবিত হয়। বাঁধের উচ্চতা ১৩৮ মিটার থেকে বাড়িয়ে ১৬৩ মিটার করার প্রস্তাব ছিল। অবশেষে ঠিক তাই করা হয়েছে। 

নর্মদা বাঁধ নিয়ে এই বিস্তারিত বর্ণনা দেখে কেউ যেন মনে না করেন যে বর্তমান লেখক Gail-এর অভিমতকে সঠিক এবং মেধা পাটেকার ইত্যাদির মতকে ত্রুটিযুক্ত বলে বোঝাবার চেষ্টা করছেন। এই বিষয়ে কে সঠিক আর কে ভুল তা পরিবেশবিজ্ঞানীরা স্থির করবেন। এত জটিল বিষয় বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা এই লেখকের নেই। আমি এই ঘটনার মাধ্যমে দেখাবার চেষ্টা করেছি যে Gail কি রকম অকুতোভয় ছিলেন। তিনি যা ঠিক বলে মনে করতেন, তাই প্রকাশ্যে বলতেন। 

যবনিকা 

২০২১ সালের ২৫শে আগস্ট গেল্ ওম্ভেট্ কাসেগাঁওয়ে নিজ বাসভবনে ৮০ বছর বয়সে মারা যান। Gail পুণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ্যা বিভাগের প্রধান এবং ফুলে-আম্বেদকর চেয়ার ছিলেন। এছাড়া কোপেনহেগেনের ইনষ্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিসের অধ্যাপক ছিলেন। নয়া দিল্লীর নেহেরু মেমোরিয়াল মিউজিয়ামের অন্যতম কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি সাবিত্রীবাই ফুলে বিশ্ববিদ্যালয়, নর্ডিক ইনষ্টিটিউট অফ এসিয়ান স্টাডিস এবং ইন্দিরা গান্ধী ওপেন ইউনিভার্সিটির বোর্ড মেম্বর ছিলান। তিনি তার গবেষণামূলক কাজের জন্য অনেক সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ২০০২ সালে সাবিত্রীবাই ফুলে পুরস্কার, ২০০৩ সালে ড: আম্বেদকর চেতনা পুরস্কার, ২০১২ সালে এবিপি মহাজন সম্মান, ২০১২ সালে মন্তশ্রী ভীমাভাই আম্বেদকর পুরস্কার, ২০১৫ সালে বিঠল রামজি সিন্ধে পুরস্কার এবং সর্বশেষে ২০১৮ সালে Indian Sociological Society থেকে Lifetime Achievment Award পান। 

২০১৭ সালে তিনি তার প্রিয় শাশুড়িকে হারিয়েছিলেন। ২০২১ সালে তিনি নিজেই চলে গেলেন। মৃত্যুর আগে কয়েক বছর তিনি অসুস্থ ছিলেন। শারীরিক অক্ষমতা সত্ত্বেও বিভিন্ন সভা সমিতিতে তিনি যতদূর সম্ভব অংশগ্রহণ করতেন। মৃত্যুকালে তিনি তার স্বামী ভারত পাটাণকার, মেয়ে প্রাচী, জামাই তেজস্বী এবং নাতনি নিয়াকে রেখে গেলেন। মেয়ে, জামাই এবং নাতনি গত কয়েক বছর ধরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা। সেখানেও তারা বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে আছেন। তাছাড়া প্রাচী নিয়মিত পত্র পত্রিকায় লেখেন। তার ক্ষুরধার লেখার জন্য তিনি ইতিমধ্যেই হিন্দুত্ববাদীদের টার্গেট হয়ে উঠেছেন। 

গেল্ ওম্ভেটের কয়েকটি ইন্টারভিউয়ের ভিডিও এখনও পাওয়া যায়। টাটা ইনষ্টিটিউট অফ সোস্যাল সাইন্সেসের সোমনাথ ভাগামারে Gail এবং ভারতের জীবনী নিয়ে একটি ডক্যুমেন্টারি চিত্র তৈরি করেছেন। সোমনাথের আগের দুটি চলচ্চিত্র “আমি ডাইনি নই” এবং “ভীমা কোরেগাঁওয়ের যুদ্ধ” খুবই খ্যাতিলাভ করেছে। বস্তুত ভীমা কোরেগাঁওয়ের বিষয়ে তার চলচ্চিত্রকেই প্রামাণ্য দলিল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। Gail-এর জীবনের শেষ তিন মাস সোমনাথ অক্লান্ত পরিশ্রম করে ডক্যুমেন্টারিটি করেছেন। শীঘ্রই এটি মুক্তি পাবে। সোমনাথ দুঃখ করে বলেছেন, যদি Gail গান্ধীবাদ বা অন্য কোনও সামাজিক সমস্যা নিয়ে কাজ করতেন, তাহলে এতদিন বিখ্যাত মিডিয়াগুলি তার সম্বন্ধে এত প্রচার করতেন, যে সারা ভারতবাসী তার কাজগুলি নিয়ে গৌরব অনুভব করতে পারতেন। কিন্তু যেহেতু তিনি কাজ করেছেন দলিত, পিছিয়ে পড়া জনজাতি এবং গরীব মুসলমানদের জন্য, তাই তার প্রাপ্য সম্মান তিনি পেলেন না। সাধারণ ভারতবাসীদের কাছে তার অমূল্য অবদান অজানাই থেকে গেল। 

তাই পাঠকদের কাছে লেখকের আবেদন, আসুন আমরা সবাই মিলে এই মহিয়সী মহিলার গৌরবগাথা আমাদের স্মৃতিতে ধরে রাখার জন্য যথাসাধ্য প্রচেষ্টা করি। 

[লেখক পরিচিতিঃ ভূতপূর্ব অধ্যাপক, সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, সুবক্তা ও সুলেখক। অবসরের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান ও পাঠক্রম নির্মাণের কাজে যুক্ত থেকেছেন। একাধিক বই সম্পাদনা করেছেন। সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থঃ স্টিফেন হকিং (একটি বৈজ্ঞানিক জীবনী)]

Website | + posts

One Comment on “গেইল ওমবেট— এক মহিয়সী নারীর আত্মত্যাগের কাহিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *