আর্য কোনও জাতি নয়, আবার ভারতের আদিবাসিন্দাও নয়

রাধাপদ দাস

[এই প্রবন্ধের একই সাথে সহজিয়াতে প্রকাশিত অধ্যাপক কমলেশ ভৌমিকের প্রবন্ধটিও অবশ্যপাঠ্য, লিঙ্ক – https://sohojia.baarta.in/2021/12/30/origin-and-migration-of-homo-sapiens/ ]

আর্য কারা বা আর্যদের আদি বাসস্থান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা বিতর্ক চলছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক, দার্শনিক সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এই বিষয়টি নিয়ে নানা মতামত দিয়ে থাকেন, বিশেষ করে নিজেদের মতের সমর্থনের নানা যুক্তিকে( বাস্তবে সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ)  খাড়া করে তা প্রতিষ্ঠা করতে চান। ফলে মানুষের মধ্যে এই আর্য ধারণা সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নানা রকমের সমস্যাও তৈরি হয়েছে। এই মুহূর্তে সব থেকে বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে বিষয়টি, তা হল এর রাজনীতিকরণ। জার্মানির হিটলার যেমন সংকীর্ণ স্বার্থে উগ্র জাতীয়তাবাদি দৃষ্টিভঙ্গিতে এই আর্য জাতির তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর এক নৃসংশতম ইতিহাস তৈরি করেছেন, আমাদের ভারতবর্ষেও এই আর্য সমস্যাকে নিয়ে এক মিথ্যা তত্ত্ব ও তথ্যকে ভিত্তি করে উগ্র জাতীয়তাবাদের স্রোত তৈরির চেষ্টা চলছে। ফলে বহু মানুষ নানা ভাবেই বিভ্রান্ত ও হয়ে পড়ছেন। মুলত এই বিভ্রান্তি দূর করার জন্য চার জন বিখ্যাত দার্শনিক মিলে চারটি দৃষ্টি কোন থেকে একখানা বইও লিখে ফেলেছেন। (ভারতবর্ষ: ঐতিহাসিক সূচনা ও আর্য ধারণা – রোমিলা থাপার, জোনাথান মার্ক কেনোয়ার, মাধব এম দেশপাণ্ডে ও শিরীন রত্নাগর।) বইএর শুরুতে রোমিলা থাপার উল্লেখ করেছেন,“আর্য সম্বন্ধে ভারতীয় চিন্তা চেতনার আলোচনায় ঐতিহাসিকগণের মতামতের অপেক্ষা অধিকাংশ সময় অরবিন্দ, বিবেকানন্দ, দয়ানন্দ ও তিলকের মন্তব্য পেশ করা হত, যাঁরা প্রথমত দার্শনিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। অনেকক্ষেত্রেই এঁরা প্রাচীন হিন্দু চেতনার যে ঐতিহ্য তাকেই উপস্থিত করতেন একথা ভুলে গিয়ে যে, তাঁরা মূলত ঔপনিবেশিক কথোপকথনের মধ্যে দাঁড়িয়েই এই বিতর্ক তুলে ধরছেন”। রোমিলা থাপার তাঁর  এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে জার্মানির হিটলারের ন্যায় ভারতেও আজ উগ্র জাতীয়তাবাদি শক্তির আর্যতত্ত্ব সম্পর্কে  মূল উৎস যোগায় যে সমস্ত ধারণা, তার মূলে কুঠারাঘাত করলেন।

আর্য সম্পর্কে চিন্তা, চেতনা, ধারণা বা যুক্তিলাভের জন্য প্রথমেই আমাদের জানা দরকার যে , কোনও সময়ের ইতিহাস জানার জন্য সবথেকে সহজ লভ্য যে উপাদান ঐ সময়কার  লিখিত কোনও  তথ্য, তা  এখনও আমাদের কাছে নেই। বিখ্যাত ঐতিহাসিক রিচার্ড সলোমন, যিনি মূলত ভারতের প্রাচীন লিপি নিয়ে গবেষনা করছেন, তিনিতাঁর এপিগ্রাফি ইন ইন্ডিয়া গ্রন্থে দেখিয়েছেন:“But practically nothing is known of what might have happened in the long period between (very roughly) 1750 and 260 B.C. Certain bits of evidence have been proposed as missing links between the proto-historic and historical writings”। কারন ১৭৫০ খ্রিঃ পূর্বাব্দ থেকে ২৬০ খ্রিঃ পূর্বাব্দ পর্যন্ত সময় কালে অর্থাৎ প্রায় ১৭০০ বছরের ভারতে, কোনও লিপির সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। ভারতের সব থেকে প্রাচীন লিপি যা সিন্ধু সভ্যতার মানুষ ব্যবহার করত (৩৫০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দ থেকে ১৭৫০ খ্রিঃপূর্বাব্দ পর্যন্ত) সেই সিন্ধু লিপি এখনও পাঠ করা সম্ভব হয়নি। ভারতের সব থেকে প্রচীন লিপি যা পাওয়া গেছে এবং পাঠ করা সম্ভব  হয়েছে তা হল ব্রাহ্মী লিপি। ২৫০ খ্রিঃ পূঃ নাগাদ মৌর্য সম্রাট অশোকের সময় এই লিপির প্রচলন ছিল। আর ভারতের সংস্কৃত ভাষার প্রাচীনত্ব নিয়ে যে এত প্রচার করা হয়, আর্যরা যে সংস্কৃত ভাষায়  কথা বলতেন,  সেই সংস্কৃত ভাষার লিপির প্রচলন হয়েছে তারও প্রায় ৪৫০ বছর পরে, প্রায় খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে, আর এই সংস্কৃত ভাষার প্রসার ঘটে তারও প্রায় ২০০-৩০০ বছর পরে প্রায় খ্রিষ্টিয় চতূর্থ বা পঞ্চম শতকে। “Sanskrit was adopted as an epigraphic medium in the 2nd century A.D and its use became widespread in the forth and fifth century”অতএব এই ১৭৫০ খ্রিঃ পূঃ থেকে খ্রিস্টীয় ৫ম শতক, প্রায় ২২৫০ বছর পর আর্যরা কথা বলত যে ভাষায়, সেই সংস্কৃত ভাষার লিখিত রূপ বা লিপির প্রচলন হল। অর্থাৎ যাদের আমরা আর্য ভাষাভাষী মানুষ বলব তাদের সম্পর্কে এটা জানা আছে যে তাদের কার্যকলাপের ২২৫০ বছরের কোন লিখিত ইতিহাস নেই। আর আর্য সভ্যতা বা ঋক বৈদিক সংস্কৃতি সম্পর্কে যে এত কথা বলা হয়, অর্থাৎ বৈদিক সভ্যতার রীতি নীতি, আচার আচরণ, সামাজিক বা রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে জানার যে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম সেই ঋক বেদ ( ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব) প্রথম লেখা হয় তাদের ভারতে আগমনের প্রায় ২৫০০ বছর পরে। আমরা সবাই জানি বেদের অপর নাম শ্রুতি। যা শুনে শুনে মনে রাখা হত সেই বিষয়গুলি এই ভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মুখে মুখে প্রায় ২৫০০ বছর মানুষের মধ্যে টিকে থাকার পর তা লিখিত রূপ  পায়। ফলে তার মধ্যে কতটা সত্য ঘটনা আছে, নতুন সংযোজন বা বিয়োজন কী হয়েছে এই সব সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সঠিক ভাবে পেতে হলে আমাদের অবশ্যই বিশিষ্ট ঐতিহাসিকদের স্মরণাপন্ন হতে হবে। আর এক্ষেত্রে এই দীর্ঘ সময়ের যেহেতু কোন লিখিত ইতিহাস ছিল না তাই প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের উপরই বেশি করে নির্ভরশীল হতে হবে। আর্য সম্পর্কে কোনও তথ্য আহরণের ক্ষেত্রে উপরিউক্ত এই বিষয়গুলি আমরা যদি না গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করি তাহলে আমরা যে কোনও সময় ভুল তথ্যের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সাথে সাথে উগ্র জাতীয়তাবাদের খপ্পরেও পড়ে

যেতে পারি।

এখন আমরা দেখে নেব আর্য কারা। আর্য ‘জাতি’ বলে মানুষের মধ্যে যে  ধারণার ব্যপক প্রসার হয়েছে বা প্রসার ঘটিয়ে দেওয়া হয়েছে এর পিছনে যুক্তি বা সত্যতা কতটা আছে। প্রকৃত অর্থে ‘আর্য’ কোন জাতিবাচক শব্দ নয়, আর্য হল একটি ভাষাগত ধারণা। সংস্কৃত, ল্যাটিন, জার্মান, গ্রিক, গথিক, ক্যলটিক ও পারসিক প্রভৃতি ভাষার শব্দমণ্ডলির মধ্যে এক মূলগত সাদৃশ্য দেখা যায়। তার ভিত্তিতে অনুমান করা হয়, বিভিন্ন সদৃশ শব্দগুলির মূলে যে শব্দ বা ধ্বনি, তা কোন একটি ভাষার মধ্যে প্রথমে ব্যবহার করা হত। বলা হয় যে সেরকম একটি মূলভাষা থেকে এই ভাষাগুলোর উৎপত্তি। এই ভাষাগুলোকে একসাথে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বলা হয়। আর এই সব ভাষায় যারা কথা বলে তাদের একত্রে আর্য বলে। ১৮৪৭ সালে বিখ্যাত জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার অতি দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, আর্য বলতে ভাষা বোঝায়, অন্য কিছু নয়। ‘বৈজ্ঞানিক ভাষায় জাতি অর্থে আর্য শব্দের ব্যবহার অনুপযুক্ত। এই শব্দের অর্থ ভাষা এবং ভাষা ব্যতিরেকে অন্যকিছু হতেই পারে না’।ঋকবেদে প্রাপ্ত ‘আর্য’ শব্দের অর্থ ‘সুজন’ অথবা সম্ভ্রান্ত বংশীয় ব্যক্তি যিনি সংস্কৃত ভাষায় কথা বলেন এবং বৈদিক রীতিনীতি সঠিক পদ্ধতিতে পালন করেন। ভারতবর্ষ থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত ভাষা পরিবারটিকে বোঝানোর জন্য ভাষাবিদগণ সংস্কৃত, ল্যাটিন, গ্রিক প্রভৃতি ধ্রুপদী ভাষার অভ্যন্তরীন সম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টায় এক বিশেষ পরিভাষা ব্যবহার করেন ইন্দো-ইউরোপীয়। ঠিক আবেস্তা গ্রন্থের ভাষাকে যেমন ‘ইন্দো-ইরানীয়’ বলে বর্ণনা করা হয়, তেমনি ইন্দো-ইউরোপীয় অন্যতম শাখা এবং ঋকবেদ ও তার পরবর্তী গ্রন্থাবলীর ভাষা সংস্কৃতকে ইন্দো-আর্য বলা হয়। বিখ্যাত ঐতিহাসিক মাধব এম দেশপাণ্ডে দেখিয়েছেন, “দুর্ভাগ্যবশত ‘আর্য’ পরিভাষাটি যে ভাষা সম্পর্কিত, তা দ্রুত জনমানস থেকে মুছে যায় এবং ধীরে ধীরে একটি জনগোষ্ঠিকে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে। যেহেতু এক ব্যক্তির ভাষার সঙ্গে তার পূর্ব পুরুষের ভাষার পার্থক্য থাকতেই পারে, তাই ব্যক্তির গোষ্ঠিগত পরিচয় বা বংশানুক্রমিক ঐতিহ্য অনুষারে ‘আর্য’ নামকরণ শুধু ভ্রান্তিকর নয় তথ্যগত ভাবে অশুদ্ধ”।কিন্তু আর্য কথাটি জাতিবাচক আর্থে  ব্যবহারের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় ঊনবিংশ শতক থেকে। দেশপাণ্ডে তাঁর ‘আর্য  উৎপত্তি: ভাষাতাত্ত্বিক যুক্তিতর্কের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন,“পশ্চিমি ঐতিহাসিকগণ, এমনকি নাৎসীগণও জাতিগত অর্থে এই ‘আর্য’ কথাটি বারে বারে ব্যবহার করতে থাকেন। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের  শ্বেতবর্ণযুক্ত মানুষ শ্রেষ্ঠত্ত্বের দাবিতে আর্য পরিভাষার ব্যবহার ঐ এক অর্থে করে চলেছেন। শুধুমাত্র ইউরোপেই নয়, ভারতেও উনবিংশ ও বিংশ শতক থেকে এই আর্য পরিভাষাকে জাতিগত অর্থে ব্যবহার বেশ লক্ষণীয়।”

আর্যরা যে ভারতের আদি বাসিন্দা নয়, তারা ভারতের উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে খ্রিঃ পূর্ব ১৫০০ অব্দ নাগাদ, ঐতিহাসিকরা নানা তথ্যের মাধ্যমে তা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। ভারতের প্রাচীন নগর কেন্দ্রিক সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতারাও যে আর্য নয়, সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার না হলেও ঐতিহাসিকরা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের দ্বারা তা দেখাতে সমর্থ হয়েছেন। এই আর্যদের সাথে এই নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার মানুষজনের কোন সম্পর্ক ছিল না। আবার ভারতের আদি বাসিন্দা যে আদিবাসী সম্প্রদায় ও দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় জাতির সাথে বৈদিক গোষ্ঠীর কোন মিল নেই সেটাও আজ ঐতিহাসিকদের কাছে প্রায় পরিষ্কার। বিশিষ্ঠ প্রাবন্ধিক অশোক মুখোপাধ্যায় (সাধারণ সম্পাদক, সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সায়েন্স অ্যান্ড সোসাইটি, কলকাতা) তাঁর ‘প্রাচীন ভারতের ইতিহাস: বিশ্বাস বনাব যুক্তিতর্ক’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, “সিন্ধু সভ্যতার অবসান বা ধ্বংসকালে (আনুমানিক ২০০০-১৫০০ অব্দ) যারা দলে দলে এসে এই একই অঞ্চলে ও তার আশপাশে অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল, নৃতত্ত্ববিদদের মতে তারা ছিল আলপিনয়েড, (alpinoid) দিনারিক (dinaric) আর্মেনয়েড (armenoid) ও নার্ডিক( nardic) নৃজাতি গোষ্ঠির বংশধর। ঐতিহাসিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের সাপেক্ষে আমরা তাদের সাধারণ ভাবে বৈদিক জনজাতি সমূহ ( vedic tribe) হিসাবেই একমাত্র চিহ্নিত করতে পারি (যদিও এদের মধ্যে কারা বৈদিক সাহিত্য রচনায় অংশগ্রহন করেছিল তা এখন নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব নয়)। কারণ, তারা তখন একটা কোনও বিশুদ্ধ জনজাতির লোক ছিল না। তাদের মধ্যে ছিল বহুরকম জনজাতি (tribe), প্রত্যেকটা জনজাতি আবার অনেক গণ (clan) গোত্র (phratry) প্রবর বা বংশ (kin) ইতাদিতে বিভক্ত ছিল।”এখন আমরা দেখে নেব, ইতিহাসবিদরা কোন কোন তথ্য ও যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছেন যে আর্যরা ভারতের আদি বাসিন্দা নয়, বিদেশ থেকে আসা অন্যান্য যাযাবর সম্প্রদায় (গ্রিক, শক, হুন কুষান)-এর মতো এরাও একটা যাযাবর সম্প্রদায়।

আর্যদের যাযাবর বৃত্তির কারণে ভারতে আগমনের পিছনে ঐতিহাসিকদের যুক্তি হল, ভারতের প্রাচীন নগরকেন্দ্রিক সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতারা যদি আর্য হত তাহলে ৩৫০০-১৫০০ পর্যন্ত যে মানুষরা নগর সভ্যতা নির্মান করে বসতি স্থাপন করতে পারল তারপর হঠাৎ করে তাদের নগর সভ্যতার বিলোপ ঘটে গিয়ে গ্রামিক সভ্যতার বিকাশ কেন হল? পৃথিবীর অগ্রগতির ইতিহাস যদি দেখা যায় তাহলে আমরা দেখতে পাব বিবর্তনের মাধ্যমে মানব সভ্যতার অগ্রগতি ক্রমশ আরো উন্নত হয়েছে। মানব সমাজের যে সম্প্রদায় পোড়া ইটের ব্যবহার, উন্নত পয়ঃপ্রণালী, রাস্তাঘাট সহ উন্নত নাগরিক জীবন যাপন করত তারা হঠাৎ করে সেই সব ভুলে গিয়ে গ্রামীন পশুচারণ বৃত্তি গ্রহণ করেছে—এটা কখনও সম্ভব হতে পারেনি।

দ্বিতীয়ত পোড়া ইটের ব্যবহার, সিন্ধু সভ্যতার মানুষ ইট পুড়িয়ে ঘরবাড়ি বানাতে জানত এবং পৃথিবীর সমসাময়িক আর কোন সভ্যতার মানুষ সেই সময় পোড়া ইটের ব্যবহার জানত না। বিখ্যাত ঐতিহাসিক রামশরন শর্মা তাঁর বিখ্যাত  ‘ইন্ডিয়া:এনসিয়েন্ট পাস্ট’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন,“when Harappa used burnt bricks, at the same time Egypt used dried bricks and Mesopotemia baked bricks.’’কিন্তু আর্য সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে তা ছিল এক অজানা বিষয়। শুধু তাই নয়, আর্যরা ভারতে আসার সময়কাল হিসাবে যে ১৫০০ খ্রিঃ পূঃ নাগাদ ধরা হয় তারও প্রায় ১২০০ বছর পর ভারতে আবার ইটের ব্যবহারের চিহ্ন পাওয়া গেছে। ঐতিহাসিকরা দেখিয়েছেন,হরপ্পা-উত্তর ভারতে ইটের ব্যবহারের প্রথম চিহ্ন পাওয়া যায় আনুমানিক ৩০০ খ্রিঃ পূঃ নাগাদ গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলে। যদিও এর প্রচলন শুরু হয় খ্রিঃ পূঃ ২০০ অব্দ নাগাদ।সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের সাথে যদি সামান্যতম কোনও যোগাযোগ থাকত তাহলে এরা সেই ১৫০০ খ্রিঃ পূঃ থেকেই শুধু ইটের ব্যবহার জানত তাই নয় ভারতে তাজমহল বানানোর জন্য শাহাজাহান(১৬৪০ খ্রিঃ) পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত না; তার থেকেও আরো ভালকিছু ইমারত তার কয়েক হাজার বছর আগেই আমরা দেখতে পেতাম, বর্তমানে যা ঐতিহাসিক স্থান হিসাবে পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নিত। সেখানে তাজমহলের মতো কোনও মুসলিম ছোঁয়াও থাকত না। ফলে যোগীর দলবলকে তাজমহলের মতো নিদর্শনকে ভেঙেফেলার হুমকিও দিতে হত না।

তৃতীয়ত, সিন্ধু সভ্যতার মানুষ ঘোড়ার ব্যবহার জানত না, সমগ্র সিন্ধু সভ্যতা এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যের ফলে কোথাও ঘোড়ার হাড়ের বা জীবাশ্মের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। অথচ আর্যদের সঙ্গীই ছিল ঘোড়া। ঐতিহাসিকরা তা নানা ভাবে প্রমাণ করে দেখিয়েওছেন। পৃথিবীতে ঘোড়ার অবির্ভাব ও বিস্তার নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন তাঁরা দেখিয়েছেন যে প্রায় ছয় লক্ষ বছর আগে দক্ষিণ উরালের পার্বত্য এলাকা ও ব্ল্যাক সি এলাকায় প্রথম ঘোড়ার জীবাশ্মের সন্ধান পাওয়া যায়। তার পর তিন লক্ষ বছর আগে দক্ষিন সাইবেরিয়া অঞ্চল,৬০০০ খ্রিঃপূঃ উরাল অঞ্চল, ইউরেশিয়া অঞ্চলে ঘোড়ার চিহ্ন পাওয়া যায় ২০০০খ্রিঃপূঃ নাগাদ।১০ রিচার্ড মিডো, যিনি ঘোড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি দেখিয়েছেন যে ২০০০ খ্রিঃপূঃ নাগাদ ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম ঘোড়ার চিহ্ন পাওয়া যায়। তিনি আরো দেখিয়েছেন যে বালুচিস্থানের বোলান গিরিপাসের কাচি সমতল এলাকায় প্রথম প্রকৃতপক্ষে ঘোড়ার চিহ্ন পাওয়া যায় ১৭০০ খ্রিঃপূঃ নাগাদ। পরবর্তি কালের প্রত্নতাত্বিক বহু উদাহরনে ভারতে বহু ঘোড়ার চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে।১১ হরিয়ানার ভগবানপুরাতে চিত্রিত ধূসরমৃৎপাত্রের সাথে ঘোড়ার হাড়ের সন্ধান পাওয়া গেছে, যার সময় কাল ১৬০০ থেকে ১০০০ খ্রিঃ পূঃ মধ্যে।১২ঋক বৈদিক মানুষদের কাছে ঘোড়া কত পরিচিত এক পশু ছিল তা বোঝানোর জন্য ঐতিহাসিক রামশরন শর্মা দেখিয়েছেন যে “ঋক বেদে asva (ঘোড়া) ২১৫ বার,  go (গরু) ১৭৬ বার vrasbha (ষাঁড়) ১৭০ বার উল্লেখ আছে, কিন্তু রাইনোসর বা বাঘের কোন উল্লেখ নেই।১৩ এখানে একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে যে সিন্ধু সভ্যতার যে সমস্ত প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে সেখানে কিন্তু বাঘ বা রাইনোসরের উল্লেখ পাওয়া গেছে। যদি সিন্ধু সভ্যতা ও ঋক বৈদিক সভ্যতার মানুষ একই হত তাহলে কেন তাদের সাহিত্যে বাঘ বা রাইনোসরের একবারের জন্যও উল্লেখ থাকল না? ঐতিহাসিকরা এই বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সাহায্যে এটা জানা সম্ভব হচ্ছে যে সিন্ধু সভ্যতার সময়কালে ভারতে ঘোড়ার কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি;সুতরাং সেই সময় ভারতে ঘোড়ার উপস্থিতি থাকাও সম্ভব নয়। আর আর্যদের ভারতে অনুপ্রবেশের সাথে সাথেই ভারতে ঘোড়ার উপস্থিতির নানা প্রত্নতাত্ত্বিক চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে। রোমিলা থাপার “History of early India from origin to AD 1300” গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে “Horse and chariot were introduced from central Asia in the 2nd millennium BC”।১৪ অতএব এই ঘোড়ার উপস্থিতির চিহ্ন থেকে ঐতিহাসিকরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন যে সিন্ধু অধিবাসীদের সাথে আর্যদের কোনও সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং নৃজাতিগত যোগাযোগ ছিল না। মধ্য এশিয়া থেকে তারা ঘোড়া ও রথ সহযোগে উত্তর পশিম দিক দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। আর যে রথ আর্য ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গী ছিল সেই রথের ব্যবহার প্রথম দেখা যায় ২০০০খ্রিঃ পূঃ নাগাদ এশিয়া মাইনর অঞ্চলে, এর পর ইজিয়ান অঞ্চলে ১৫০০ খ্রিঃ পূঃ নাগাদ, ক্রীটে দেখাযায় ১৪৫০ খ্রিঃ পূঃ নাগাদ, আর ইজিপ্টে ১৫৫০ খ্রিঃপূঃ নাগাদ প্রথম আমেন হোটেপের সময়।১৫

চতুর্থত, লিপির আবিষ্কার ও তা পাঠ করার ফলে আর্যদের ভারতে আদি বাসিন্দার তত্ত্বকে একেবারে নস্যাত করে দিয়েছে। এই লেখার শুরুতে আমরা দেখেছি  যে ভারতের প্রাচীন সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার এখনও সম্ভব হয়নি। তার পর প্রায় ১৫০০ বছর ভারতের মানুষ যে লিখতে জানত তার কোনও সাহিত্যগত বা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এখনও ঐতিহাসিকদের কাছে নেই। একেবারে অশোকের শাসনকালে ২৫০ খ্রিঃপূঃ নাগাদ ব্রাহ্মীলিপিই হরপ্পা-উত্তরকালের ভারতের প্রথম লিপি, যার সন্ধান পাওয়া যায় এবং যা পাঠ করা সম্ভব হয়েছে। আর্যদের প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋকবেদ কয়েশ বছর ধরে মুখে মুখেই মানুষের মধ্যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চালু ছিল; তারপর তা লিখিত রূপ পায়। সেই কারণেই বেদের অপর নাম শ্রুতি তা আমরা সবাই মোটামুটি জানি। তাই ঐতিহাসিক সুকুমারী ভট্টাচার্য ‘ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে খ্রিঃ পূঃ পঞ্চম শতক থেকে খ্রিস্টীয় একাদশ শতকের মধ্যে রচিত কোনও ভাষ্য আমরা পাইনি। সম্ভবত সেগুলি থাকলেও বিলুপ্ত হয়ে গেছে।১৬ যে সমস্ত ভাষ্যকারদের রচনা আমাদের কালে এসে পৌঁছেছে তাদের মধ্যে তুলনামুলক ভাবে খ্যাতকীর্তি ব্যক্তিদের নাম হল স্কন্দস্বামী, নারায়ণ, উদ্গীথ, হস্তামলক, উবট (১১শ শতাব্দী), বেঙ্কট মাধব (১২শ), আনন্দ তীর্থ (১২-১৩শ), আত্মানন্দ (১৩শ), সায়ণ (১৪শ), রাবণ (১৬শ), দেবস্বামী, ভট্টভাস্কর, হরদত্ত, সুদর্শন সুরী, ভবস্বামী, শ্রীনিবাস, ভাস্কর মিশ্র, মাধবদেব, মাধবমিশ্র।১৭ তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নিই যে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা আর্য ছিল, তাহলে যারা লিখতে জানত, প্রায় ১ হাজার বছর ধরে লিখতে পারার পর হঠাৎ করে সেই সভ্যতার মানুষ লিখতে ভুলে গেল তা কখনও সম্ভব হতে পারে? এই তত্ত্ব দিয়ে একমাত্র গাঁজাখোরি গল্প বানানো যায়, ঐতিহাসিক যুক্তিতর্কে যে এটা গ্রাহ্য হতে পারে না তা যে কোনও মানুষই বুঝতে পারেন।

বিশ্ববিখ্যাত ইতিহাসবিদ রিচার্ড সলোমন, “Indian Epigraphy: A guide to the study of Inscriptions in Sanskrit, Prakrit and the other Indo-Aryan Languages” নামে ১৯৯৮ সালে এই বিষয়ের উপর ৪০১ পাতার একখানা বই লিখে ফেললেন। তার তৃতীয় অধ্যায়ে আর্যদের ব্যবহারের ভাষা যে সংস্কৃত বলে দাবি করা হয় সেই সংস্কৃত ভাষার উদ্ভব, বিবর্তন ও তার লিপির উদ্ভব ও লিখিত রূপের ব্যবহার কিভাবে ধাপে ধাপে হয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের সাহায্যে তিনি তা উল্লেখ করেছেন। তিনি আরো দেখিয়েছেন, এই সংস্কৃত ভাষার বিকাশ লাভ করে খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে চতুর্থ শতকের মধ্যে।১৮ তাই এই সংস্কৃত ভাষায় লিপির ব্যবহার প্রথম দেখা যায় খ্রিঃ পূঃ প্রথম শতকে অযোদ্ধা, ঘোসুন্ধি এবং হাথিবাদা স্টোন লিপিতে।১৯ আর একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক রামশরন শর্মা ‘India’s ancient past’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন “Sanskrit was adopted as an epigraphic medium in the 2nd century AD. And its use became widespread in the fourth and fifth century’’২০ ঐতিহাসিকদের এই প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ও গবেষণার ফলেই যা আজ সবার কাছে পরিষ্কার যে আর্যরা ভারতে প্রবেশ করে ১৫০০ খ্রিঃপূঃ নাগাদ; তারপর প্রায় ১৯০০ বছর পর মোটামুটি লিপি উদ্ভাবন করে তাদের কথ্যভাষার লিখিতরূপ তারা দিতে পেরেছে। এই বাস্তব সত্যকে আর এখন অস্বীকার করার জায়গা নেই।

আমরা আগেই দেখেছি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের একটি সদস্য হল সংস্কৃত। ঐতিহাসিকদের ব্যখ্যা অনুসারে মধ্য এশিয়া থেকে অভিবাসনের মাধ্যমে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর মানুষেরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি গোষ্ঠী ইউরোপে পৌঁছায় এবং অপর গোষ্ঠী ইরানে, সেখান থেকে আবার একটি গোষ্ঠী বিভাজিত হয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারত আক্রমণ করে। এই ভাষা পরিবারের মানুষদের মধ্যে যে ভাষাগত বেশ সাদৃশ্য এখনও টিকে আছে ঐতিহাসিকরা তা ভাষাতাত্ত্বিক দিক দিয়ে প্রমাণও করেছেন। বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী পি সসেটি যিনি ১৫৮১ থেকে ১৫৮৮ পর্যন্ত গোয়ায় বসবাস করেন তিনি দেখিয়েছেন যে সংস্কৃত ও ইতালীয় ভাষার মধ্যে বহু শব্দগত সাদৃশ্য বর্তমান। বিশেষকরে ছয় থেকে নয় অবধি সংখ্যাবাচক শব্দ, দেবতা, সর্প সহ আরো বেশ কয়েকটি শব্দে এই রকম মিল পাওয়া যায়।২১ আর এক ফরাসী ভাষা বিজ্ঞানী পি. ক্যোরডু ১৯৪৭ সালে ফ্রেঞ্চ একাডেমিকে সংস্কৃত, গ্রীক, ও ল্যাটিন ভাষার মধ্যবর্তী সাদৃশ্য জানান এবং বলেন যে এই সাদৃশ্য মানুষের আদিম ভাষার অভিজ্ঞান স্বরূপ। তিনি উভয় ভাষার মধ্যে তুলনা করে দেখিয়েছেন, যেমন- সংস্কৃত দানম ‘উপহার’ দেবাস ‘দেবতা’, জানু ‘হাঁটু’, মধ্যস ‘মধ্য’, এগুলোর ল্যাটিন হল দোনম (Donum), দেউস (deus), জেনু (Genu),ইত্যাদি।২২ আর একজন ঐতিহাসিক স্টুয়ার্ট পিগট তিনি ‘প্রিহিস্টোরিক ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে “Today we can recognize the Indo-European group of languages as a relatively junior member of the Old World linguistic family, evolving at a time when such languages as Sumerian and those in the Hamitic and Semitic groups were of respectable antiquity”২৩। তিনি আরো দেখিয়েছেন ox বা ষাঁড়কে লাঙল বা চাষের কাজে লাগানো হত, ইজিপ্ট, সুমের ও মেসোপটেমিয়া সভ্যতায়ও একই কালচার ছিল, আর এরা উভয়েই একই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের সদস্য ছিল। এখানে কোথাও yak বা চমরি গাই-এর উল্লেখ নেই।২৪ আর্যদের ব্যবহারের রথ ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দ (wheel), Latin- rota, German- rad, lithuanian– ratas, ইত্যাদি। এই রকম বহু শব্দ ব্যাখ্যা করে তাঁরা দেখিয়েছেন যে এই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের মধ্যে এক আত্মিক সম্পর্ক ছিল।২৫ আর সংস্কৃত হল এই ভাষা পরিবারের মধ্যে একেবারে নবীন সদস্য।২৬ আবার খ্রিঃ পূঃ চতূর্দশ শতকে মিট্টানি-ইট্টাইট চুক্তিতে যে ইন্দো-ইরানীয় শব্দ পাওয়া যায় তা ঋকবেদের ভাষার থেকেও প্রাচীন।২৭ আবার ঋকবেদের বহু জিনিস যে প্রাচীন নানা গ্রন্থে পাওয়া গেছে ঐতিহাসিকরা তা ব্যখ্যা করে দেখিয়েছেন, যেমন রামশরন শর্মা তিনি ‘ইন্ডিয়াস এনসিএন্ট পাস্ট’  গ্রন্থে  দেখিয়েছেন “The Rig Veda has many things in common with the Avesta, which is the oldest text in the Iranian language. The two texts use the same terms for several gods and even for social classes”২৮।তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের লিপি প্রথম পাওয়া গেছে ২২০০ খ্রিঃ পূঃ ইরাক থেকে। তার পর এইরকম উদাহরণ পাওয়া যায় ১৯০০-১৭০০ খ্রিঃপূঃ হিট্টাইট লিপি আনাতোলিয়া (তুরস্ক) থেকে। এর পর মাইসোনিয়ন লিপি পাওয়া যায় ১৪০০ খ্রিঃ পূঃ গ্রিস থেকে। আর্য নামের প্রথম সন্ধান পাওয়া যায় ১৬০০ খ্রিঃ পূঃ নাগাদ ইরাকের কাসাইট লিপি, ১৪০০ খ্রিঃপূঃ নাগাদ সিরিয়ার মিট্টানি লিপি থেকে।২৯ কিন্তু ভারতের সংস্কৃত ভাষার লিপির কোনও উদাহরণ ঐ সময় তো দূরের কথা, তারও প্রায় ১৫০০ বছর পরে পাওয়া গেছে। এই রকম বহু প্রমাণ সাপেক্ষে অন্যান্য ঐতিহাসিকের মতো রামশরন শর্মাও দেখিয়েছেন যে, “The Aryans migrated to India in several waves. The earliest wave is represented by the Rig Vedic people, who came to the subcontinent in about 1500 BC”৩০

ভারতে এই আর্য ভাষা ভাষী মানুষদের বাণিজ্যিক কাজকর্মের কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক উদাহরণ এখনও পাওয়া যায়নি। অথচ সিন্দু অধিবাসীরা যে নানা বাণিজ্যিক কাজ কর্মে লিপ্ত ছিল তার বহু প্রমান ঐতিহাসিকরা পেয়েছেন। ২৪০০- ২১৫০ খ্রিঃপূঃ নাগাদ কিছু হরপ্পীয় সীল মোহর সুমের ও নিম্ন মেসোপটেমিয়ায় পাওয়া গেছে, সুমেরিয় গ্রন্থে মেলুহার সাথে বাণিজ্যের উল্লেখ আছে,আর ঐতিহাসিকরা এই মেলুহা পশ্চিম ভারতে অবস্থিত বলে উল্লেখ করেছেন।৩১ আর এই বানিজ্যের সাথে যুক্ত ছিল বৈদূর্যমণি, জেডপাথর, আম্যাজনিয় মণি ইত্যাদি যা সিন্ধু সভ্যতার মানুষ ব্যবহার করত।৩২ আর একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক যিনি দীর্ঘদিন ধরে হরপ্পার নানা খোঁড়া খুঁড়ি থেকে শুরু করে বিভিন্ন গবেষণার প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন সেই জোনাথন কেনোয়ার তাঁর ‘The Ancient City of Harappa’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, “Texts from Mesopotomian cities state that “onion”, cotton, hardwood, pearls, carnelian, peacock and Monkey were imported from the land of Meluhha, which can be identified as the Indus velley”৩৩। কিন্তু আর্যরা যে এই সমস্ত মূল্যবান জিনিস ব্যবহার করত তার কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এখনও পাওয়া যায়নি, এছাড়া বাণিজ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ওজন ও পরিমাপ পদ্ধতি, যা সিন্ধু সভ্যতার মানুষ যেব্যবহার করত তার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও পাওয়া গেছে; কিন্তু আর্যভাষী মানুষের এই রকম জিনিসের ব্যবহারের কোনও নিদর্শন বা উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায়নি।

এই রকম বহু প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক উপাদানের সাহায্যে ঐতিহাসিকরা দেখাতে সমর্থ হয়েছেন যে আর্য কোনও জাতি নয়, আবার এরা ভারতের আদি বাসিন্দাও নয়। অতি প্রাচীন কাল থেকে এরা যে ভারতে বসবাস করে আছে তার যেমন কোনও নিদর্শন বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি, সেই রকম আবার এরা ভারত থেকে পৃথিবীর অনান্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তারও কোন উল্লেখ নেই, উলটে এরা যে ভারতের বাইরে থেকে উত্তর পশ্চিম দিক দিয়ে ১৫০০ খ্রিঃ পূঃ নাগাদ প্রবেশ করেছে ঐতিহাসিকরা তা প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন। শুধু ভারত কেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নানা নিদর্শনে তার উল্লেখও আছে। ভারতের একজন বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক জ্যোতিবা ফুলের নাম আমরা সবাই জানি, যিনি পিছিয়ে পড়া মানুষদের কল্যানে সারা জীবন কাজ করে গেছেন। তিনি বলেছেন যে “the Sanskrit-speaking Brahmans were descended from the Aryans who were alien to India, and that the indigenous peoples of the lower castes were therefore the rightful inheritors of the land”৩৪। আমার জাতিই পৃথিবীর অন্যান্য জাতির থেকে শ্রেষ্ঠ এই উগ্র মানসিকতাই হচ্ছে যে কোনও সমাজ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এক বড়ো বিপদ। অন্যান্য জাতিগুলোর ইতিহাসের কোনও খোঁজ বা চর্চা না করেই  বলতে থাকব শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শনসহ সমস্ত কিছুতেই আমার জাতিটাই সেরা আর অনান্য জাতি গুলোর সবই নিকৃষ্ট, এই মানসিকতাই উগ্র জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা। যা শুধু নিকৃষ্ট জাতীয়তাবাদের জন্ম দেবে তা নয়, তা সাম্রাজ্যবাদেরও জন্মদাতা। সঙ্গে সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে অন্যান্য জাতিগুলির উপর অত্যাচার নিপীড়ন নামিয়ে নিয়ে আসে, যার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ জার্মানির হিটলার। আমাদের ভারতেও হিটলারের মতো এক উগ্র জাতীয়তাবাদী মানসিকতা তৈরি হচ্ছে সেই আর্য  জাতির ভ্রান্ত ধারণাকে কেন্দ্র করে। ফলে অন্যান্য জাতিগুলোর বিরুদ্ধে তৈরি হচ্ছে এক বিদ্বেষের মানসিকতা, এই মানসিকতার প্রসার ঘটছে অনেকটাই সরকারি প্রচেষ্টায় বা পৃষ্টপোষকতায়। এটা সম্ভব হচ্ছে প্রকৃত ইতিহাসকে আড়ালে রেখে, ভুলিয়ে দিয়ে বা বিকৃত করে। সরকারি প্রচেষ্টায় আগামী প্রজন্মকে দেশের প্রকৃত ইতিহাস থেকে দূরে সরিয়ে রেখে মিথ্যা, বিকৃত, অর্ধসত্য ইতিহাস তুলে ধরে যুক্তিভিত্তিক মানসিকতা ও বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তার উপর নানা আক্রমণ নেমে আসছে। এই রকম এক সংকটজনক সময়ে দেশ তথা সমাজের প্রকৃত ইতিহাস চর্চা সেই সত্যকে আরো বেশি বেশি মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিয়ে প্রকৃত সত্যকে টিকিয়ে রাখার সাথে সাথে সমাজে জ্ঞান বিজ্ঞানের সঠিক চর্চাকে টিকিয়ে রাখার মধ্যেই আছে এই উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ভিত্তি। ♣

তথ্যসূত্র

১। রোমিলা থাপার, জোনাথান মার্ক কেনোয়ার, মাধব এম দেশপান্ডে, শিরীন রত্নাগর (২০১৪), ভারতবর্ষ: ঐতিহাসিক সূচনা ও আর্য ধারণা; ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, দিল্লি; পৃষ্ঠা ১৭-১৮।

২। Richard Solomon (1998), Indian Epigraphy: A guide to the study of inscription in Sanskrit, Prakrit, and the other Indo-Aryan languages; Oxford University Press; p. 10.

৩। R. S. Sharma (2009), India’s Ancient Past; Oxford University Press; p. 33.

৪। রোমিলা থাপার ও অন্যান্য (২০১৪), পৃষ্ঠা ৪।

৫। ঐ, পৃঃ ৮১

৬। ঐ, পৃঃ ৮০

৭। অশোক মুখোপাধ্যায় (২০১৮), প্রাচীন ভারতের ইতিহাস:  বিশ্বাস বনাম যুক্তি-তথ্য; সেস্টাস, পৃঃ ১৯-২০

৮। Sharma (2009), op. cit.; p. 96.

৯। রামশরণ শর্মা (২০১১), প্রাচীন ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস; ওরিয়েন্ট ব্ল্যাক সোয়ান, পৃঃ ২১।

১০। Sharma (2009), op. cit.; p. 118.

১১। Ibid, p. 118-119.

১২। Ibid, p. 119.

১৩। Ibid, p. 117.

১৪। Romila Thapar (2001), History of early India from origin to AD 1300; Penguin Book, p. 108

১৫। Stuart Piggot (1950), Pre-Historic India; Penguin Book, p. 275

১৬। সুকুমারী ভট্টাচার্য (১৯৬০), ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য; পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা; পৃঃ ৩৭।

১৭। ঐ, ঐ। 

১৮। Solomon (1998), Op. cit.; p. 72.

১৯। Ibid, p. 86.

20. Sharma (2009), op. cit.; p. 33. 

২১। রোমিলা থাপার ও অন্যান্য (২০১৪), পৃষ্ঠা ৮৩। 

২২। ঐ, পৃঃ ৮২-৮৩।

২৩। Piggot (1950), Op. cit.; p. 245.

২৪। Ibid, p. 265.

২৫। Ibid, p. 276.

২৬। Ibid, p. 245.

২৭। রোমিলা থাপার ও অন্যান্য (২০১৪), পৃষ্ঠা ২২।

২৮। Sharma (2009), op. cit.; p. 128. 

২৯। Ibid, p. 129.

৩০। Ibid, p. 129.

৩১। শর্মা (২০১১), পূর্বোক্ত; পৃঃ ১২৬।

৩২। ঐ, ঐ।

৩৩। J. Mark Kenoyer (1996), Asian Art and Culture. A. M. Sackler Gallery, Smithsonian Institution, Spring 1996; p. 87.

৩৪। Cited by Thapar (2001), Op. cit.; p. 14.

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *