অন্তরের আলো

ফাল্গুনী ঘোষ

সিংহবাহনা দেবীর দশহাতে দশ রকম অস্ত্র ছাড়া বাহ্যিক রূপ কম বেশি প্রায় একই রকম। তবে বিভিন্ন সময়ের প্রয়োজনবোধে যেমন তিনি ভিন্ন ভিন্ন রূপে ধরায় অবতীর্ণ হয়েছেন( অসুরের উপদ্রবে), ঠিক তেমনই স্কুটিবাহনা দেবীদেরও অনেক প্রকার বাহ্যিক রূপে আবির্ভূত হতে হয় প্রকৃতির উপদ্রবে। বইয়ের পাতায় পড়া আছে—বারো মাস, ছয় ঋতু। বারো মাস ঠিকই কিন্তু ঋতু— হালকা গরম, মাঝারি গরম, চামড়া পুড়ে যাওয়া গরম, ভ্যাপসা গরম, বর্ষা, শীত—এই তো ছ’টাই ঋতু। এই ছয় ঋতুর প্রধান পোশাক কিন্তু কাপড় মুড়ি দিয়ে (নাক, চোখের ফুটো বাঁচিয়ে রেখে) বিশেষ কায়দায় পেঁচিয়ে নেওয়া। আর কাপড় প্যাঁচানো- হেলমেট পরিহিত অবস্থায় স্কুটিতে চাপবার আগে যেন দস্যুরানী ফুলন দেবী যুদ্ধ জয় করে নামলেন, এবং যুদ্ধ জয় শেষে বাড়ি ফেরার সময় মনে হবে মহাকাশ অভিযান সাঙ্গ করে মাটিতে পদার্পণ করলেন। বর্ষা আর শীতে অবশ্য নারী, পুরুষ ভেদে ভ্রম জন্মে। আর এই বিশেষ পোশাকে আপনি, আমি তো কোন ছাড় স্বয়ং ঈশ্বরেরও সেই নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে চিনে নেবার ক্ষমতা থাকে না।

      এই সময় স্কুলের ছুটি চলছে। ছেলেপিলেরা ঘরে মা, মাসি, পিসী, দিদা, ঠাকমাদের  আদর খাচ্ছে আর আমরা চাট্টি করে পান্তা মুখে ফেলে গরম পোহাচ্ছি।–

      মনটি হল প্যাঁচা পানা                                          

      কড়া রোদে থাকতে মানা—

কিন্তু যতই মানা থাক, কাজে-কম্মে এক আধদিন বেরোতেই হয়। আর তখনই ‘কাপড় প্যাঁচানো’ শুরু। অভ্যাস বড় বালাই কিনা! তো সেরকম কাপড় প্যাঁচানো মুখচোখ নিয়ে স্কুটিবাহনা হয়ে বাড়ি ফিরছি। দেখি এক বৃদ্ধা ভিক্ষার আশায় কড়া রোদ মাথায় নিয়ে হতাশ হয়ে আমাদের বাড়ির দরজায় হাজির। এদিকে আমিও গাড়িটা যথাস্থানে স্থাপন করব। সেই বৃদ্ধাকে বললাম—

       “একটু সরে দাঁড়ান, গাড়িটা ঢুকিয়ে আপনাকে দিচ্ছি।“

    –“ হ্যাঁ মা, এমনিই ভালো হয়ে থাকো। আল্লা তুমার ভালো করুক।“

ব্যাগ হাতড়ে এক টাকার কয়েন দিয়ে ঘরমুখো হতেই বৃদ্ধার ডাক—

   “ মা  এটো তুমি লিয়ে লা।“

 –“ কেন? এক টাকা নেবেন না? আমার ব্যাগে দু টাকার খুচরো নেই তো! একটু দাঁড়ান। ভেতর থেকে এনে দিই।“

— “না গো দু’টাকা কেনে লিবো!! বড় এক টাকা গুল্যা দ্যাও। ছোটোগুল্যা দোকানে লিতে চায় না।“

আবার ব্যাগ খুঁজে বড় এক টাকার কয়েন দিতেই বৃদ্ধা হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ির ভেতর দু-চার পা ঢুকে ব্যাথাভরা আওয়াজে বলতে লাগল—

   “রোজার সময় বড় কষ্ট বুলো! আর একটু পানিও হয় না। রোজার সময়ে তুমাদের কাপড় দেওয়া নাই?”

অভ্যাস শুধু বালাই নয় বোধহয় মানুষ অভ্যাসের দালাল। তাই বৃদ্ধার কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম, রোদে কালচে হয়ে যাওয়া মুখ দেখেও আমার মুখ ফস্কে তীব্র বেগে বেড়িয়ে এল—

“আমরা তো পুজোর সময় দিই।“

মুহূর্তের মধ্যে দ্বিধা, লজ্জা আর অস্বস্তি ঐ ভিখারিনীকে ঘিরে ধরল।–

“হায় আল্লা!! ওরে আমার সোদর রে! কিছু মুনে কোরো না।“

কথাগুলি শেষ হওয়ার আগেই থপথপে পা ফেলে বৃদ্ধা মিলিয়ে গেলেন।

    দরজায় জড়বৎ দাঁড়ানো আমার মনটা চিৎকার করে উঠল—“ দাঁড়ান মা! আমি আমার মায়ের একটা শাড়ি আপনাকে এনে দিই! আপনি নিয়ে যান!”

  ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মনটা বিষাদাচ্ছন্ন হয়ে উঠল—মানুষের ধর্ম আসলে কি?!… ধর্মের গন্ডী এত ক্ষুদ্র কেন?!!

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *