স্বাধীনতা দিবস উদযাপন অথবা ওসমানের উপাখ্যান

মনিরুজ্জামান মানিক

চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। মাস্টারে মাস্টারে খুড়তুতো! সমভাবাপন্ন লোকেরা একজায়গায় হলে আবহাওয়াটা যে একটু চরমভাবাপন্ন হবে সেটাই স্বাভাবিক। এ স্টেশন ও স্টেশন মিলিয়ে এ পর্যন্ত আটজন মাস্টার আপ ট্রেনের এক কামরায় একসঙ্গে কর্মক্ষেত্রে চলেছেন। ভোর সাড়ে পাঁচটা। বহরমপুরে এরাইভালের রাইট টাইম পাঁচটা পয়ত্রিশ।

–শম্ভুদা উঠবে জায়গা রাখিস সমর। মালটা জায়গা না পেলে খিস্তি মারবে কিন্তু।

কথাটা বললেন যিনি তিনি সুদীপ।

–এই মরেছে! আগে বলবে তো! আগের স্টপেই একটা গোছে রাখতাম। ফাঁকা ছিল।

একটু এদিকওদিক করে সটান সিঙ্গেল সিটে বসে থাকা লোকটাকে বলল–আপনি নামবেন? 

লোকটার হাতে একটা নাইলনের ব্যাগ। চোপসানো গাল, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, চেহারা দেখে যে বয়স দাঁড় করানো যায় হিসেবে তা পুজবে বলে মনে হয় না। এ বয়স যে হাড়ভাঙা খাটুনির ছাপমাত্রই,  পেশির দিকে খেয়াল করলেই সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়।

–লালগোলা

একটা খাটো উত্তর জানিয়ে হাতের নাইলনের ব্যাগটা হুকে আটকে চেপে বসল সিটে। ভোরের দিকে হাওয়াটা বড় গায়ে লাগে। অন্যান্য দিন জানালার ধারে বসলে কাঁচটা নামিয়ে দেয় ওসমান। এই সমস্ত মানুষদের আগে এ ট্রেনে কখনো দেখেনি সে। কাঁচ নামালে যদি কিছু বলে। না থাক। ভদ্দরলোক মানুষ তারা। মনের ভিতর এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ট্রেন এসে থামল বহরমপুর।

–ওই তো শম্ভুদা! জানলা দিয়ে হাতটা দেখাও বিমল।

বিমল শুধু হাতই দেখালো না সাথে একটা অপ্রয়োজনীয়  জবরদস্ত হাঁক ছাড়ল–

এই যে শম্ভুদাআআআআ…এদিকেএএএএএ…

অপ্রয়োজনীয় জবরদস্ত হাঁকটা নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় ছিল   না। বোঝা গেল হাঁকটা তাঁর ব্যক্তিত্ত্বের সাথে অত্যন্ত সাবলীলভাবে যায়। কামরায় এসেই–

–ঘুম কামাই দিয়ে এদ্দূর ঠেঙ্গিয়ে সাতসকালে ভাল্লাগে ভাই! হেডমাস্টারটা শালা গোঁয়ারের ভগ্নিপতি! বলে কিনা আসতেই হবে! বলেন তো সুদীপবাবু কোনো মানে হয়? আরে স্থানীয় স্যরদের নিয়ে হ্যাপাটা মেরেদেনা শালা!

ভদ্রলোকের বয়সের সাথে আদব কায়দাটা বেশ বেমানান। পেশার সঙ্গে ভাষাটা আরও বেশি।

‘জায়গা কই? জায়গা কই?’ বলে উচ্চস্বরে যেভাবে চেঁচালেন সে আওয়াজ ট্রেনের হকারদের থেকেও অনেক বেশী বানিজ্যিক।

একজন বলল–শম্ভুদা না থাকলে জমে না। কামরাটা এতক্ষণ মরার বাড়ি মরার বাড়ি লাগছিল। এইবার জমবে।

তারপর শম্ভুদা, বৌদি খাবার বেঁধে দিয়েছেতো? আজ কিন্তু মিড ডে মিল অফ।

–শোন ভাই, আমি ওসব হাঙ্গার স্ট্রাইক-ফাঙ্গার স্ট্রাইকে নেই। পাতি কথায় যেটুকু পারি উসুল করে নেব, উসুল। নো আন্দোলন। নো মুভমেন্ট। যদ্দিন পুরো ডিএ না পাচ্ছি তদ্দিন ভরপেট মিড ডে মিল খাচ্ছি খাবো। কোনো শালা আটকাতে পারবে না।

ব্যাগ থেকে এলুমিনিয়ামের একটা টিফিনবাক্স বার করে চোখের সামনে ম্যাজিসিয়ানদের মতো বার দুয়েক ঘুরিয়ে বলল–

পরটা আর আলুরদম। সাথে ডিমের ঝুরি।

আবার জাদুকরের মতো কায়দায় ধীরে টিফিনবাক্সটা ব্যাগে পুরে চেনটা আটকে দিল।

ট্রেন এসে থামল মুর্শিদাবাদ। চোখটা একটু এঁটে এসেছিলো ওসমানের। এ স্টেশন থেকে উঠে যিনি যোগ দিলেন তার বয়স অল্প। হাসি-হাসি মুখ। সকলের উদ্দেশ্যে বললেন– হ্যাপি ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে।

–শুধু মুখে কেন ভাই এক কাপ চা হোক না!

–বেশ তো চা আসুক, হবে।

কেউ একজন বলল–

আর হ্যাপি! ট্রান্সফারটা হলে বাঁচি। জীবন নটা ছটা হয়ে গেল। কোনো স্বাধীনতা আছে?

স্বাধীনতা দিবস! ওসমানের মনে পড়ে গেল তার এতটুকু মেয়েটা একটা পতাকা বানিয়ে দিতে বলেছিল। কাগজের উপর রঙ করে। স্কুল যাবার সময় নিয়ে যাবে। ইস! বেমালুম ভুলে গেলাম! যাককে আজ কাজ হলে বরং একটা কিনেই নিবো বাজার থেকে। একটু বড় সাইজের। কাপড়ের। একেবারে নতুন। থেকে যাবে। বছর বছর বাড়িতেই তুলব। কত পড়বে? পঞ্চাশ? না ষাট? দুশো থেকে ষাট বাদ গেলে তো দেড়শোও টিকবে না। মজুরের পয়সাটা কটাটাকা বাড়তো তো ভালো হতো। দুশো দিতেই কত হুজ্জৎ করে লোকে!

লালবাগ থেকে জিয়াগঞ্জ। সরকারের পক্ষে। বিপক্ষে। কোনদল ভালো? তৃনমূল না বিজেপি? বাংলায় সিপিআইএমের পুনরায় উত্থান আদৌ কতটা সম্ভব তার দূরদৃষ্টি সম্পন্ন দার্শনিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ! এরই মধ্যে কোন ফাঁকে একবার আইপিএল থেকে উঁকি মেরে গেছে বিরাট কোহলি। বিরাট কোহলি এলে রসিক নাগররা অনুষ্কাকে টেনে আনবেন এনি হাউ। তা তিনি বিজ্ঞাপনের শুটিঙেই থাকুন অথবা সিনেমায়।

শেষ দশ মিনিট এককাট্টা যে ঝড়টা উঠেছিল তার গুমোট বহুদিনের। সরকারের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে যে তুলোধুনো করা হলো সে তুলোর লেপে হিমালয়েরও ঠান্ডা না লাগার কথা। কিন্তু এসবের কোনোকিছুই ততটা কানে আসেনি ওসমানের। মরমে আসা তো দূরের কথা। ওরা শিক্ষিত মানুষ, সে মূর্খ!

জিয়াগঞ্জে নামলেন যিনি তিনি যাবার আগে বলে গেলেন–

সরকার এবার ডিএ দিবেই, তোমরা দেখো নিও। একধাক্কায় অনেক টাকা!

এই শেষ কথাটা কানে এলো ওসমানের। একেবারে চুম্বকের মতো আকর্ষণে। টাকা! সরকার দিবে! টাকার তার বড়ই প্রয়োজন। বাড়িতে রুগ্ন বিবি। ছোট্ট মেয়েটা অপুষ্টিতে দিনকে দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। সংসারে বড়ই টান। এবার আর শিক্ষিত-মূর্খ, বড়লোক-ছোটলোক  ব্যবধানের সাত সতেরো কিচ্ছুটি হিসেব করল না ওসমান। বেহুসের মতো বলে বসল–

আচ্ছা, দরখাস্ততে মেম্বারের কি সহি লাগবে?

প্রশ্নটা যেহেতু নির্দিষ্ট করে কাওকেই করা হয়নি আর বেকুব চাহনিতেও কাকে তার কোনো স্পষ্ট ইঙ্গিতও নেই তাই উত্তরের হাল ধরতে একটু দেরিই হল।

সুদীপবাবু ফোনে কারো সঙ্গে একটা কথা বলছিলেন। শম্ভুবাবুর বকেয়া ঘুমের একটা ঢুলুঢুলু ঘোর। সমর এইমাত্র ফেসবুকে একটু বেড়িয়ে নিচ্ছে। মুর্শিদাবাদ থেকে ওঠা সুদর্শন যুবক বললেন–

কিসের দরখাস্ত?

পঞ্চায়েতে দিবো। মেম্বারটা ভালো না। টাকা সব খেয়ে নেয়। বুথ দখল করে ছাপ্পা দিয়ে জিতেছে। ভোটই দিতে দেয়নি লোককে।

সমর ফেসবুক থেকে চোখটা সামান্য সরিয়ে একটা সন্দেহ প্রকাশ করল–

পাগোল নাকি?

এইবার আবার চুপসে গেল ওসমান। খুব লজ্জিত হল সে। নিজের উপর নিজেই ক্ষুন্ন হল মনে মনে। ওদের সাথে কথা বলতে হলে লেখাপড়াটা জানা দরকার। তা যখন নাই তো চুপ থাকতে পারিস না!

লোকটাকে পাগল মনে হয় না! এটা সমরের বাড়াবাড়ি! বৃত্তান্তটা জানা দরকার। কথায় প্লট আছে মনে হচ্ছে। বললেন সন্তোষবাবু।

এই অদ্ভুত মজার কোনো মানে হয়? এই সমস্ত আচরণের জন্য এদের সাথে টাচ রেখে চলি কেবল। ভাল্লাগে না। যুবক মনে মনে ভাবল আপদগুলো বিদেয় হলে লোকটার বিষয়টা একটু শুনে নিবো। মুখে বলল–ছাড়ো না সন্তোষদা, কি হচ্ছে!

জিয়াগঞ্জে সমর আর শম্ভুদা নেমে পড়লেন। পরের স্টপে বিদেয় হবে সুদীপবাবু আর সন্তোষ। দল যত ভাঙছে আড্ডার মেজাজে উষ্ণতা কমে আসছে তত। উদ্দেশ্যহীন আড্ডারসের তরল চিরটাকাল এইভাবেই জমতে জমতে  একটা সময় এসে বরফে পরিণত হয়। অন্তঃসারশুন্য বরফ! যার চাঁই দিয়ে হকারের একটা পেপসিও হয় না কোনোদিন।

ফোনের কথা শেষ করে সুদীপবাবু বললেন–

চলো সন্তোষ উঠি। স্টেশন এসে গেল।

হ্যাঁ, চলো…

একবার বামদিকে আরেকবার ডানদিকে কোমরটা মটকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন সন্তোষ। কাঁধে ব্যাগটা ঠিক মতো সেট করলেন।বললেন–

বসে বসে কোমর পিঠ সব লেগে গেছে।

চলি ভাই। কোনট্রেনে ব্যাক করছো?

–দেখি, স্কুলে একটু অনুষ্ঠান মতো করছি। ওই একটু কবিতা আবৃত্তি, গান আরয়কি…

–ওহ্! পারো বটে তোমরা! এনার্জি আছে বলতে হবে।

সুদীপবাবু তাড়া দিলেন–

সন্তোষ, ট্রেন ঢুকে গেল কিন্তু।

হ্যাঁ চলো, আসি ভাই ট্রেন ঢুকে গেল।

অবশিষ্ট আপদ কটা বিদেয় হবার পর স্বভাবতই পরিবেশ এখন আগের তুলনায় অনেক বেশী নিরাপদ। এইবার সেই লোকটার সমস্যাটা অবাধে জেনে নেওয়া যেতে পারে। সমাধান কিছু থাকলে সেটাও সাচ্ছন্দ্যে বাতলে দেওয়া যায়।

কামরায় ভিড়টা এখন অনেকটাই পাতলা। হু হু করে গাড়ি টানছে। লম্বা রেসের প্রতিযোগিতায় শেষটায় যেমন একটা মরিয়া ঝড় ওঠে ঠিক তেমন। প্রথম হওয়ার দৌড়! আর একটু! টান! টান!

যুবক ফাঁকা পড়ে থাকা সিটের অনেকটা সরে এসে সেই লোকটাকে অভয়ের সুরে জিজ্ঞেস করল–আচ্ছা, আপনি কিসের দরখাস্তের কথা বলছিলেন তখন?

লোকটা থ মেরে বসে থাকল। উত্তরের বিনিময় মুখটা কেবল একটু হাঁ হল। এ হাঁ-তেই তার সমস্ত হাপিত্যেশ ধরা পড়ে। কি ভয়ংকর সে হাঁ যা পৃথিবীর সমস্ত সুখ সাচ্ছন্দ্যকে অনায়াসে গিলে ফেলতে পারে।

যুবক বলল–

আপনার ভয় নেই  নির্ভয়ে আমাকে বলতে পারেন। কিসের দরখাস্ত? বলুন।আমি বলে দিচ্ছি কি করতে হবে। কার সই লাগবে, সব। আপনি বলুন।

আরে আরে! ট্রেন ঢুকে গেছে! নামতে হবে নামতে হবে। তাড়াতাড়ি হুক থেকে ব্যাগটা নামিয়ে দ্রুত পায়ে নামবার মুখে এগিয়ে গেল ওসমান।

দুই  

সর্বনাশ! সাড়ে ছ’টা! অ্যালার্ম কি তাহলে বাজেনি?

রান্নাঘর থেকে বৌ সাধুভাষায় জানালেন–বাজিয়াছে, এবং বারকয়েক বাজিয়াছে। অত্যাচার জ্ঞান করিয়া তুমি তাহার গলা টিপিয়া হত্যা করিয়াছ।

তড়িঘড়ি  আলনা থেকে টি শার্টটা নামিয়ে গায়ে চড়ালেন দীপঙ্কর। সাধুভাষায় যে ইঙ্গিত বহন করছে তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় চা কপালে নাই। সুতরাং কথা না বাড়িয়ে তড়িঘড়ি পা বাড়ানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে উপলক্ষে খাসির মাংসর একটা আবদার ছিলো। বেলা বাড়লে এ অঞ্চলে সেটা পাওয়া যে মুশকিল তা তার বৌও জানে। তাছাড়া গতরাত্রের ব্লু প্রিন্টে ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে সেলিব্রেশনের যে খসড়া হয়েছিল তাতে সাধের বাগানে একটা লেবারও লাগানোর কথা। লেবাররা ফাঁকিবাজ। কাজটা থেকে ভালোভাবে দেখে নেওয়া দরকার। এইসমস্ত ঠাসা কর্মসূচির কারনে স্কুল ইন্সপেক্টর দীপঙ্কর সমাদ্দারকে তার অফিসে পতাকা উত্তোলন এবং বিদ্যালয়গুলিতে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন হচ্ছে কি না তার ইন্সপেকশনটা বাতিল করতে হল।

যেতে যেতে রাস্তাতেই একটা ফোন করতে হলো তাকে–

হ্যালো ধীরেনবাবু…

আজ আমি আসছি না, একটা বিশেষ কাজে আটকে পড়েছি। শিক্ষাবন্ধু আর অফিসের স্টাফরা মিলে পতকা উত্তোলনটা সেরে নিবেন। কাল দেখা হবে।

ওপ্রান্তে ধীরেনবাবু ভদ্রলোককে কথা শেষ হলে কাঁচা খিস্তি দিলেন না ধূপ ধূনা দিয়ে পুজো করলেন তা কে জানে!

স্টেশনের পাশে সমরের চায়ের দোকান। এখানেই লেবাররা সাতসকালে এসে জড়ো হয়।ৎমালিক মনিবরা সব এসে ঘর গেরস্থালীর কাজের জন্য দর করে তাদের নিয়ে যায়। ওসমান আর কার্তিক এখনও পর্যন্ত কাটেনি।

–আজ কার মুখ দেখে যে উঠেছিলাম ওসমান ভাই! দাও একটা বিড়ি দাও।

ওসমান বিড়ির বান্ডিল থেকে একটা বিড়ি বার করে কার্তিক কে এগিয়ে দিল।

–আজ আর সাইত হবে না মুনে হয়!

 বলে প্যাকেট থেকে আরও একটা বিড়ি বার করে কানের কাছে ধরে একটু পাকিয়ে নিয়ে পিছন দিকে জোরে জোরো দুটো ফু মারল। তারপর ঠোঁটে সেট করে দেশলাই জ্বাললো। নিজেরটা ধরিয়ে আগুনটা কার্তিকের দিকে এগিয়ে দিল। এ পর্যন্ত বাসি পেটে চারটা বিড়ি ফোঁকা হয়ে গেছে ওসমানের। এটা নিয়ে পাঁচ নম্বর। আত্মা ভরে বিড়িতে একটা টান মেরে অর্ধেক ধোঁয়া নাক আর অর্ধেক ধোঁয়া মুখ দিয়ে ছেড়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ল।

জোরকদমে পায়ে হেঁটে সমরের চায়ের দোকান পর্যন্ত আসতে এস আই দীপঙ্কর সমাদ্দারের সময় লাগলো সাড়ে সাত মিনিটের একটু বেশি।

–একটা লেবার লাগত…

কেউ কি আছে?

হালে পানি পেয়ে ডাঁটসে উঠে দাঁড়ালো দুজনই। কার্তিক আর ওসমান। দুজনেই একসঙ্গে বলল আছে আছে।

–দুজন নয়,আমার একটা লাগবে।

গায়েগতরের দিক দিয়ে ওসমানই এগিয়ে। জহুরী নজর তাই তার ওপরেই ফোকাস ফেললো অবধারিতভাবে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে কাজের হিসেবটা বুঝিয়ে দিলেন–

শোন ভাই,কাজ তেমন কিছু না। সামান্যই। একটুখানি বাগান আমার। এই বর্ষায় আগাছাতে একেবারে ভরে গেছে।  আগাছাগুলো তুলে একটু নিড়িয়ে দিতে হবে। ব্যাস। কত নিবি বল?

যে কোনোকিছুতেই দামদর করা ভদ্রলোকেদের একটা স্বাভাবিক অভদ্রতা! অভিজ্ঞতার পাঠশালায় পাঠ নেয়া দিনমজুররা প্রায় প্রত্যেকেই এ ব্যাপারে অনার্স। ওসমানও তাই।

সে বললো–আড়াইশ দিবেন।

–আড়াইশোওওওও!

ভদ্রলোক যেভাবে আঁৎকে উঠলেন তাতে হার্ট অ্যাটাক হবার জোগাড়। বাঁচিয়ে দিলো কার্তিকটা।

–চলেন চলেন, দুশো তিরিশ দিবেন চলেন-

বলে তার ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে পা এগোতে লাগল কার্তিক। ওসমান চুপ। এগোতে এগোতে কথা হতে লাগল–

না না একেবারে দু’শ কর, বেশি হয়ে যাচ্ছে, একটু কাজ।

–এত কমে পারব না দাদা,আমরা কি খাবো? আলু ষাট টাকা কেজি, পেয়াজ সত্তর…

শেষমেশ কততে রফা হলো সেটা আর কানে এলো না। তারা এখন দৃশ্যান্তরে। শব্দও মিলিয়ে গেল হাওয়ায়। চারিদিক থেকে বাংলা হিন্দি দেশাত্মবোধক গান আছড়ে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের ঢেউ এর মতো। চুড়ান্ত রকমের হতাশ হয়ে সমরের চায়ের দোকানের ভিতরের বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়ল ওসমান। পকেট হাতড়ে বিড়ির প্যাকেটটা বার করতেই।দোকানদার সমর বলল–

ভোর থেকে তো বিড়িই ফুঁকে যাচ্ছেন।একটা চা খান।

ওসমান বলল–না ভাই থাক।

আরে কাল দিবেন পয়সা, কি আছে। রোজই তো আসেন। চেনা লোক।

কাঁচের বোয়াম থেকে একটা বিস্কুট বার করে হাতে দিল সমর।

–আজ আর আপনার জুটবে না মনে হচ্ছে। বেলা তো পার হয়ে গেল।

বিস্কুট খাওয়া হলে কাপে চা দিল সমর।

ওসমান বলল–

হয়েই তো গেছিল। শালা কার্তিক!

ক্রাইসিসের বাজারে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে বেচারা কার্তিকও যা শালা কার্তিকও তাই। চার্লস ডারউইনের স্ট্রাগল ফর এক্সিসটেন্স তত্ত্বে এ ব্যাপারটা উহ্য আছে। ওসমান ডারউইনের তত্ত্ব না বুঝলেও কার্তিকের জ্বালাটা বোঝে। তার মতো কার্তিকেরও একটা পেট আছে। রাগ অভিমানের ইমারত এখানে মজবুত ভিতে প্রতিষ্ঠিত নয়। তাই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তেও বড়বেশি সময় লাগে না। বিপদেআপদে কতবার পাশেও তো দাঁড়িয়েছে কার্তিক।

দুটো দশের ট্রেন ধরেই ওরা ফেরে। ওসমানের আজ আর কোনো কাজ জুটলো না। অন্যান্য দিন কাজ না জুটলে দশটার ট্রেন ধরে ফিরে যায়। আজ নিবুনিবু আশার আলো নিভল দশটার ট্রেনটা চলে যাবার পর। কার্তিক প্লাটফর্মে ঢুকেই দেখল ওসমান বসে আছে। পাশে নাইলনের ব্যাগটা দাঁড় করানো।

–ওসমান ভাই, কাজ হয়েছে তাহলে? যাক বাবা!

ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে বসে পড়ল পাশে।

ওসমানের মুখে কোনো রা নাই। রা না থাকার কারণটা কার্তিক  খুব ভালোভাবেই জানে।

–রাগ করোনা ভাই। বেঁচে গেছো। শালা হারামির হদ্দ বজ্জাত লোক। কাজের হিসেব দেখালো কিচ্ছু না। আর কাজই ফুরায়  না। এটা হয়ে গেলে বলে ওটা করে দে। ওটা হয়ে গেলে বলে এটা। চা তো দিলেই না, এক মিনিট চোখের আড়াল পর্যন্ত হয় না শালা যে একটা বিড়ি ধরিয়ে খাই।

ওসমান এবার তার ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে হনহন করে  সামনের দিকে এগিয়ে গেল।

-যাশ্লা! এরকম তো কতই হয়। এত ধরলে আর খেতে হবে না।

ওসমানের রিঅ্যাকশানে কার্তিকের মুখের বুলিটা এরকম হলেও বুকের ভিতরটা একটু খচখচ করছেই। সে খচখচানিতে নিশ্চিতভাবেই ন্যায় অন্যায় পাপ পুণ্যর কোনো বালাই নেই। থাকবার কথাও না। কিন্ত সহানুভূতি আছে ষোলআনা। আছে অকৃত্রিম ভালোবাসা। উপায়ান্তর না দেখে আজকের মতো হাল ছাড়লো কার্তিক।

ট্রেন ছাড়লো পাক্কা দুটো দশ। কার্তিক যে বগিতে উঠলো তার তিনচার বগি সামনে উঠলো ওসমান। জানালার ধারের একটা সিঙ্গেল সিটের দখল নিয়ে ব্যাগটা হুকে আঁটকে ধপ করে বসে পড়ল। এমন দিন তো হরহামেশাই হয়। খালি হাত আর শুকনো মুখে বাড়ি ফেরা! এ আর নতুন কি ঘটনা! কিন্তু আজ তার জানে লেগে আছে জাতীয় পতাকা। সমরের চায়ের দোকানের পাশে, কি একটা ক্লাবে, পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠান  ঠাঁই দাঁড়িয়ে দেখেছে। শহীদদের আত্মবলিদানের আবেগঘন বক্তৃতা ভূত হয়ে চেপে বসেছে মাথায়।

কার্তিক জিয়াগঞ্জ নামবে। নামবার মুখে মুখোমুখি হলো ওসমান। চুপিসারে কখন যে এসে এ কামরায় সিঁধিয়েছে মালুমই পায়নি কার্তিক। অকপটে বলল–

শটাকা ধার দে তো কার্তিক। আজ আর কাজ পায়নিরে!

যাক, রাগ পড়লো তাহলে।

বাজে বকিস না। দিবি কিনা বল?

আরে ওসমান ভাই, তুমি আমার মায়ের পেটের ভাই নও ঠিকই কিন্তু ভাইই তো! এই নাও। কাল আসছো তো?

হ্যাঁ।

মাথা নাড়ালো ওসমান।ট্রেন থামলে নেমে পড়ল কার্তিক।

সারাদিন কিচ্ছু খাওয়া হয়নি ওসমানের। গতকাল রাতের বাসি রুটি ব্যগেই ধরা আছে। দুপুরে একবার জোর খিদে পেয়েছিল। কিন্তু আমল দেয়নি। পেটের ভিতর ইদুরগুলো দৌড়াদৌড়ি করবার পর যখন বুঝল লাভ নাই, তখন আপনা হতেই ক্ষান্ত হয়েছিল তারা। এখন আর খিদে নেই। আনন্দের তাড়া খেয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। ট্রেন থেকে নেমে বাজার ঘেঁটে পঁয়তাল্লিশ টাকা দিয়ে চার বাই তিন সাইজের কাপড়ের একটা পতাকা কিনেছে। তার এতটুকু মেয়ে বিনি সেটা দেখলে কতটা খুশি হবে মনে মনে আন্দাজ করে আনন্দিত হয়।

আনন্দে যেমন খিদের মৃত্যু ঘটে। খিদেতে তেমন আনন্দেরও মৃত্যু ঘটতে পারে। জীবনের এই সার সত্য আপাতত এই মুহূর্তে তাকে কোনোভাবেই ঘায়েল করতে পারছে না।

উন্মাদনা জাত দ্রব্য মাত্রই তাই। তা সে ভাব-ই হোক বা বস্তু। গেটের মুখ থেকেই ডাক দিল–

বিনি… বিনি… কই রে? কোথায় গেলি? এদিকে আই। কাল পতাকা বলেছিলি না? দেখে যা এত্তবড়ো পতাকা!

কোথায় ছিলো তার ঠিকঠিকানা নাই, বাপের গলা পেয়ে প্লেনের গতিতে বিনি এসে হাজির।

কই? কই? দেখি দেখি। স্কুলের মতো ওঠাবো। তুমি আর মা বন্দেমাতরম বলবে। তারপর জাতীয় সঙ্গীত হবে। আমার মুখস্ত আছে·

জনগনমন অধিনায়ক জয় হে…বলতে বলতে বাপের হাত থেকে কাগজে মোড়া জাতীয় পতাকাটা নিয়ে খুলে চৌকিতে সাট করল।বিনির মা বলল–

হায় আল্লা! দাম কত?

ওসমান পঞ্চাশটা টাকা বৌয়ের হাতে এগিয়ে দিয়ে বলল–

পয়তাল্লিশ।

কাজ হয়নি আজ। কার্তিকের কাছে একশো টা টাকা ধার নিয়েছি। কাল কাজ হলে শোদ দিয়ে দিবো। এটা রাখ।

চৌকিতে বসে পড়লো ওসমানের বৌ।

লোকটা পাগল হয়ে গেছে!

লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে!

বাড়িতে আটা নাই!

চিৎকার করে বলল–

এই দামে এক কেজি আটা হয় জানো? খাবে কি?

ওসমান তার বিড়ি খাওয়া খয়েরী দাঁত বার করে বলল–

কাল রাতের রুটি। দিয়েছিলি না? সব ধরা আছে। আজ রাতে তিনজনের হয়ে যাবে। হবে না? এই নে ব্যাগে আছে।

হ্যাঁচকা টানে ব্যাগটা হাত থেকে নিয়ে রাগে দুঃখে চোখের সামনে থেকে কেটে পড়ল।

        তিন

ঘুম আসছেনা ওসমানের। পেটে খিদে থাকলে কারইবা ঘুম আসে? দুটো শুকনো রুটিতে কি আর পেট ভরে? একবার এপাশ একবার ওপাশ, উসখুস করতে লাগলো বিছানায়! ভোর ভোর উঠতে হয় বলে সন্ধ্যা সন্ধ্যা ঘুমিয়ে পড়ে সে। ঘর থেকে বেরিয়ে মাঝে মাঝেই উঠোনে গিয়ে বিনি দেখে আসছে বাঁশের কঞ্চির মাথায় আঁটকে দেয়া পতাকাটা। এর মধ্যে পাঁচবার এসে বলা হল–

আব্বা,পতাকা তো উড়ছে না!

পাঁচবারই ওসমান মেয়েকে বুঝিয়েছে–

ঠিক উড়বে। হাওয়া এলেই উড়বে। দেখতে থাক।

খিদেটা যত চড়ে বসছে ঘুমটা ততই উড়ে যাচ্ছে ওসমানের।

এবার বিনি এসে অনুযোগের সুরে বলল–

স্কুলেরটা কেমন পতপত করে উড়ছিল, এটা কেন এখনও উড়ছে না আব্বা? ওসমান একটা কড়া ধমক দিয়ে বলল– একটা চড় খাবি বিনি! দেখছিস না এখানে হাওয়া নেই! বারবার এক কথা!

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *