লাল শাড়ি

আস্তাইন বিল্লা

সামনে ঈদ। আবার বাড়ির কর্তারও বাড়ি ফেরার সময় হয়ে এল।  হাত চালিয়ে কুঠার চালাচ্ছে রেণুকা বিবি।  তিন বছরের একটি শীর্ণ প্যাকাটির মত শিশু পিঠের সঙ্গে  ন্যাকড়া দড়ি  দিয়ে বাঁধা। রোগা জীর্ণ শিশুটি কেঁদেই চলেছে। এ যেন তার জীবনের কঠোরতর সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার প্রস্তুতি। এখন থেকেই সহ্যক্ষমতা করায়ত্ব না করলে চলবে কেন! জন্ম তার কঠিনের মধ্যে। যে কঠিন দিনদিন বাড়বে আরো, কমবে না। পাশে বকের মত গলা তুলে ভাঙা পা ছড়িয়ে দুর্গন্ধযুক্ত মাছ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে ব্যস্ত  রেণুকার বড় ছেলে সুজন। এদিকে পাড়ার পঞ্চায়েত মেম্বার হারাম মণ্ডলের ছেলে সদ্য থার্ড ডিভিশনে মাধ্যমিক পাশ করেছে৷ বাপ খুশি হয়ে এন্ড্রয়েডে মোবাইলও কিনে দিয়েছে৷ দুনিয়ায় সব কিছু মুঠোয় এসেছে তাতে৷  এই তো সেদিন রেণুকা তার স্বামীর সঙ্গে কত খোশগল্প করল, এমনকি চুমুও খেল। অবশ্য হারাণ মন্ডলের ছেলে কথা বলার দরুন দশ টাকা নিয়েছে৷ রেণুকার অভাব থাকা সত্ত্বেও টাকা খরচ করতে পিছুপা হয়নি। হাটে কাঠ বিক্রি করেই টাকা সংগ্রহ করেছিল। পিছুপা হবেই বা কেন অত দূরের মানুষকে এত কাছে এনে দিয়েছে। এ কি কম সৌভাগ্যের!

রেণুকার স্বামী থাকে মহারাষ্ট্রের নাসিকে। এই কদিন পর ঈদে ফেরার কথা৷ সেখানে রাজমিস্ত্রির কাজে জোগানদার হিসাবে শ্রম দেয়৷  বিনিময়ে আড়াইশো টাকা। অবশ্য এ কাজ তার ঠিক পোষায় না। তার পূর্বপুরুষেরা বনে-জঙ্গলে কাঠ কেটে জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল। এদিকে আবার সরকার কাঠ কাটার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সব মিলিয়ে তার মত উলুখাগড়ার এইসব  জোগানদার কাজ  পোষায় না বলে চলবে কেন!  সে যে কপাল করে হা-ঘরে জন্মেছে। তাই হারাণ মন্ডলের ছোটভাইয়ের সঙ্গে নাসিকে যাওয়া। ছোটভাইটি ঠিকাদার সেখানে।

রেণুকা বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে কাঠ কাটতে থাকে হাঁপানি থাকা সত্ত্বেও। আর ভাবতে থাকে সুজনের আব্বা অনেক টাকা নিয়ে ফিরবে।  সামনে ঈদ।  কত গোছানো স্বপ্ন৷  সুজন এবং তার ছোটভাইয়ের জন্য নতুন জামা। তার নিজের আবার অনেকদিনের স্বপ্ন, চুমকি বসানো ব্লাইজ এবং টুকটুকে লালরঙের তাঁতের শাড়ি। তাদের সংসারে সবচেয়ে বড় ভাবনা সুজনের ভাঙা পা আর তার মায়ের হাঁপানি।  বাড়ির লোক বলেও গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে এসে কলকাতায় মস্ত বড় ডাক্তার দেখাবে৷  এদিকে ঘরের দরমাও ভেঙে গেছে। সেদিন ছোট ছেলেটাকে দরমার ফাঁক দিয়ে শেয়ালে টানছিল। এইসব ভাবনার মধ্যেই ডাক দিয়ে ওঠে হারাণের ছেলে—

অ সুজনের মা। তোমার ভাতার কালু যে ফির‍্যা আসে নাসিক থেক্যা।

এহেন খুশির সংবাদ শুনেই সুজনের মায়ের ঘাম কপালে রোদের আলো পড়ে চিকচিক করে৷  ফর্সা গাল আপেলের মত লাল হয়ে উঠেছে৷  কিন্তু পরক্ষণেই যখন হারাণের ছেলে বলে যে–

দ্যাশে করুনা না কি যেন বালা আস্যাছে।  তাই লেবাররা নিজ দ্যাশে চল্যা আসছে। খবরে বলছে সরকার টেনও বন্ধ করে দিছে। তাই পথে হাট্যা আসছে। 

এহেন কুশলে মহিলা গম্ভীর অথচ শান্তস্বরে বলে–

ও ক্যামন আছ? দেখন যাব না? 

না তাদের যে মোবাইল নাই।  দেখন যাইব না। 

হতাশ হয়ে রেণুকা মুখ নীচু করে অদৃশ্য ভবিষ্যতের আশঙ্কায়। হঠাৎ করে মাথা ঘুরতে থাকে তার৷ খুঁটি ধরে বসে যায় কাদাযুক্ত ঘরের বারান্দায়৷ তারপর অঝোরে কাঁদতে থাকে।  এতদিনের স্বপ্নও কাঁদতে থাকে রেণুকার সুরে সুরে। জগত সম্পর্কে সে যেন জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে।  এমত অবস্থায় মরার উপর খাড়ার ঘা।  পঞ্চায়েত পক্ষ মাইক নিয়ে ঘোষণা করতে থাকে এই মর্মে যে, আগামী চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আপনারা নিরাপদ অবস্থানে আশ্রয় নিন। সাবধানে থাকুন। গাছের তলায় থাকবেন না।  ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সব ঘোষণা কিছুই কানে যায় না রেণুকার৷ স্বামী শোকে বিহ্বল অবস্থা তার। পাড়ার সকলেই যখন হইচই করতে করতে গ্রাম ছাড়তে শুরু করে তখনই হুঁশ ফেরে তার৷ জানতে আগ্রহী হয়ে পাশের বাড়ি সেরাজুলের বউকে জিজ্ঞাসা করে– ‘লোক সকলি কোতি যায়?’

তখন উগ্রভাবে সেরাজুলের বউ জবাব দেয় –

মাগির ঢং কত! গাঁয়ে কত কিছু উড়্যা গেল কিছুই যাননা বুঝি!  ঝড় গো। আল্লার ঝড়।

একথা শুনে তাদের অনুকরণ করে দু’সন্তান নিয়ে হাঁটতে শুরু করে রেণুকা তখনই পিছনে হাঁকতে থাকে হারাণ মন্ডল। চীৎকার করে বলে –‘ও রেণু’।  সে এভাবে বরাবর নাম ধরে আদর করেই ডাকে৷ ডাকবেই বা না কেন! এ পাড়ায় মধ্যে কম সুন্দরী নয় কালুর বউ! শরীরখানা যেন দুধে আলতা মেশানো। ঘুরে তাকাতেই হারাণ বলে ওঠে কাঁদো কাঁদো হয়ে–

তোর ভাতার যে আর নাই। রাস্তায় লরিতে পিশে দিছেরে।  সে আর নাই। 

আর এ খবর শুনেই মূর্ছা যায় রেণুকা। পেটে বাঁধা ছেলেটি জোরে কাঁদতে থাকে৷ সকলে ধরে নিয়ে যায় স্কুলের বিল্ডিংয়ে। সেখানে অজস্র মানুষের ভিড়ে একপাশে জায়গা পায়  সেরাজুল এবং দয়া করে সে রেণুকার ব্যবস্থাও করে দেয়। সে স্বামীর শোকে এখন মৃতপ্রায়। ছেলেরা বাপ এবং খিদের যন্ত্রণায় ক্ষিপ্ত হয়ে মায়ের উপর কিল চড় মারতে থাকে৷ এ এক নতুন উপদ্রব! বিহ্বল অবস্থায় বসে থাকে রেণুকা। জগত সম্পর্কে সে যেন জ্ঞানহারা। আর খিদে অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ে দু’সন্তান। গভীর রাতে হু হু করে বৃষ্টি আর ঝড় বইতে থাকে৷ সকলেই প্রায় নিজেদের পরিবারের খেয়ালে হইচই করতে থাকে স্কুল বিল্ডিং জুড়ে। অথচ একজন নীরব জন্তুর মত কাতরাচ্ছে। কেউ দেখে না! বৃষ্টি আর ঝড়ের মধ্যে সকালের আলো ফোটে। তখন সেরাজুলের বউ গায়ে হাত দিয়ে ডাকে–

ও কালুর বহু। তোমার ছেল্যারা কই!  ঝড়ে লইল না কি! 

রেণুকা কোনো উত্তর না দিয়ে শীর্ণ হাত আকাশের দিকে তুলে চীৎকার বলে উঠল–

ওই যে। যার জিনিস সে ফিরায়্যা লইছে।  তারপর মুখ ঘুরিয়ে ঘুমানোর ভান করে৷  কাপড়ের যে অর্ধেকাংশ শরীরে ছিল সেটাও ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে সে। ঈশ্বর কি সবকিছু দেখলেন! না কি দেখেও চোখ বুঁজে গা ঝাড়া দিলেন! তিন দিন পর রক্তমাখা কাপড়ে বাঁধা লাশ ফিরে এল রেণুকার কোলে। সে স্বপ্ন দেখেছিল লাল শাড়ির। আজ দেখা যায় স্বামীর রক্তে লাল হয়ে উঠেছে তার সাদা থানখানি। 

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *