খালিদা খানুম
জাহানারা বিবির হাতের বানানো রুটির সুনাম সবাই জানে। গোল এমন যেন চাঁদ। চাঁদের কলঙ্ক আছে, কিন্তু জাহানারার রুটিতে কোন কালোপোড়া কেউ কোনদিন দেখেনি।
খালার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে তার জা এর মেয়ে জাহানারাকে, মনসুর এই রুটি দেখে এক কাপড়ে বৌ করেছিলো। হাসির রোল উঠেছিল গাঁয়ে, মাথার দোষ হয়েছে মনসুরের, না হলে রুটি দেখে কেউ ওমন দাঁত উঁচু মেয়েকে বিয়ে করে!
মনসুর জানে, মনসুর ভুল করেনি। প্যাটের জন্য রুটি। আর দুনিয়া জানে, প্যাটের জন্যই এই দুনিয়া। প্যাট শান্তি তো দুনিয়া শান্তি।
কিন্তু কখনো কখনো পেট বাড়ে, ভরবে না জেনেও বাড়ে সংখ্যায়। মনসুরের দুনিয়াতেও পেট বাড়লো। বছর বছর। মনসুর পেট চালাতে হিমসিম খায়।
জাহানারা বলে–চলেন রুটির দোকান দি। আপনি তো কন, আমার হাতের রুটির পারা আর কেউ বানাতে পারবে না।
–তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গ্যলছে? পাড়া গাঁয়ে লোকে ঈদে বিনি পয়সায় জেয়াফত চায় তোমার হাতের আলোচালের রুটি গোস্ত খাবার জন্য। পয়সা দিয়ে কিনে খাবে কে?
–তাহলে শহরে চলেন। সেখানে পয়সা দিয়ে কিনবে।
এসব কথা কোন যুগ আগের। তবুও চোখের সামনে ঘোরে মনসুরের। ভোর ভোর বেরিয়ে পড়েছিলো তারা। বড়টারে দাদী কাছে, মেজটারে নানির কাছে দিয়ে, ছোটটারে কাঁখালে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলো রুটির খদ্দেরের খোঁজে।
নাকি রুটির খোঁজে !
এখন ছোটটাও লায়েক। দোকানে খদ্দেরকে গুনেগুনে রুটি দেয়। পয়সা নেয় হিসাব করে। মনসুর বানায় তরকা। আর জাহানারা রুটি বানিয়ে চলে দিস্তা দিস্তা। দম ফেলার ফুরসত নেই। রাস্তার পাশে কয়লায় চুলা। মাথার উপর একটা ত্রিপল। এতটুকুই। তাতেই দু’বিঘা জমি কিনেছে তারা গত পাঁচ বছরে। তিন কামরার পাকা ঘর ধরেছে গতবছর।
রুটি বানাতে বানাতে একদিন শুনলো, দোকানপাট সব নাকি বন্ধ থাকবে। রোগ এসেছে। মানুষ থেকে ছড়াচ্ছে নাকি রোগ।
মনসুর হা হা করে হাসে –শুনলা, মানুষ থেকে রোগ ছড়াচ্ছে। পানি থেকে ছড়ায়, বাতাস থেকে এখন মানুষ থেকে।
জাহানার বলে–হাসিয়েন না। যদি সব বন্ধ থাকে তাহলে কী হবে এখন?
মনসুর বলে–প্যাট কি সরকার বন্ধ করতে পারবে? পারবে না গো। প্যাট থাকলেই রুটি লাগবে।
কিন্তু মনসুর ভুল ভাবে। দিনের পর দিন দোকান বন্ধ। হাতের টাকাও শেষ হয়ে আসে। জাহানারা বলে–বাড়ি চলেন। রেললাইন ধরে দিনরাত হাঁটলে বাড়ি চলে যাবো। কত আর দূর। সাথে কটা রুটি নিয়ে নেবো।
তারা হাঁটে । বাড়ির পানে। ঘরের পানে। কাঁখালে নিয়ে চাঁদের মতো রুটি। হুইসেলের শব্দ আসে। স্বপ্নের মতো। হয়তো স্বপ্ন। পাশ ফিরে শোয় তারা। সামলে রাখে রুটির পোঁটলা। পারে না। ছিটকে যায় চারিদিকে। ছোপ ছোপ হয়ে দাগ পড়ে লাল। ঠিক যেন আকাশের চাঁদ। কলঙ্ক মাখা।