চিঁড়ে-মুড়ির গপ্পো

তানিয়া ইসলাম

সক্কালবেলা নাওয়া হলো কোনোরকমে, খাওয়া হলো না। বেরিয়ে পড়লাম বোনের সাথে। দুই টাঙ্গনকন্যা যাবে আত্রেয়ীর পাড়ে। ভেজা চুল আর মুখে একরাশ কুয়াশা মেখে খালেদা ভাবির বাড়ি একছুটে।

–“কাঁহা তোর বরটা উঠিলি, না নিন্দাছে এখনো?”  খালেদা ভাবির আঁচানো বড়ির থালাটা সরিয়ে টুলটায় বসতে বসতে বললাম। ফুটন্ত ধোঁয়াওঠা বেগুনের তরকারিতে বড়ি ফেলতে ফেলতে বলল —” না রে কাইল রাইত ২ টায় আইছে। এখন ডাকিলে রাগি বোম হবি।”

রাবিদা আমার পাড়ার দাদা। বয়সে আমার থেকে একযুগ বড় হলেও আমার সাথে তার সেই কালের পট যে কালে ‘তেরে নাম’ এর সুবাদে চুলে নাক বরাবর চাঁদি অবধি সরলরেখা টানা হতো। দুই ধারের বটের ঝুরির মতো চুলে বাদামী প্রলেপ ছিল লেটেস্ট ফ্যাশন।

ঘর থেকে আওয়াজ আসছে। রাবিদার ছেলে পড়ছে “ডাকি আমি দিবা রাতি/ পিতা তিনি দীন পতি / মহিষ ও হরিণ / মদীনা কলিকাতা। 

বাল্যপাঠের টানে ঘরে গেলাম। দেখি রাবিদা উঠে পড়েছে। চোখ লাল। বললাম — “টপাটপ রেডি হ। পরীক্ষা আছে চ্যাংড়িটার।”

—“থাম কাইলতেরে ভাত খায়নি তোর দাদা।” ভাবি বারান্দায় ভাত বাড়তে বাড়তে হেঁকে বলল। যেহেতু কাল দেরিতে ফিরেছে, তাই জামাপ্যান্ট কালকের গুলোই পরে আছে। আর একটু বেশী কুঁকড়ে গেছে– এই যা। নিজে ক্যারিব্যাগে টিন থেকে মুড়ি ঢেলে নিয়ে ক্যারিব্যাগের কানদুটো মেলে ধরে ভাবিকে বলল, “কাইল রাইতের ঘুঘনি দে এতে”। ভাবি একবার রাবিদার চোখের দিকে তাকালো আর যন্ত্রের মতো দু’হাতা  ঘুঘনি ফেলল সাদা মুড়ির উপর।  রাবিদা ক্যারিব্যাগ গুটিয়ে রাখল সিটে। আমরাও গাড়িতে। মুখ বাড়িয়ে অভিমানী ভাবীকে হেঁকে বললাম– “দুপহরে ভাত খামো হোটেলত। রাবিদাও খাবি।”

আমাদের প্রতিদিনের রাবিদারা কাজে যায়। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত সবার কপালে জোটে না। কারও চালের অভাবে, কারও সময় আর কারও বা যত্ন করে বেড়ে দেওয়া মানুষের অভাবে৷ একটা পুঁটলি হাজারো বাধ্যবাধকতার সাক্ষী।  চিঁড়ে, মুড়ি চালভাজা  সাথে একটু  পাটালিগুড় একপেট ভাতের বিকল্প যুগে যুগে গরীব বাঙালির কাছে।

রাবিদা আ্যম্বাসেডরের ড্রাইভার। আমরা হু হু শীতের সকালে বেরিয়ে পড়লাম তিনজনে। পেছনের সিটে আমি আর বোন। রাবিদার বাঁদিকের সীটে মুড়ির পুঁটলি দুলছে আপাত মসৃণ রাস্তার চোরাটানে। আমরা পূণর্ভবা পেরিয়ে আত্রেয়ীর কোলে। বোন পরীক্ষার সেন্টারে। বাংলাদেশ বোর্ডারের ভীষণ কাছাকাছি এ শহরে আমি আর রাবিদা পুঁটলি খুলে মুড়ি চিবোচ্ছি। আমার ডানহাতে মুড়ি, বাঁহাতে জুকারদাদার দান। মুখপুস্তিকা। স্ক্রীনে ভাসছে কারা যেন চিঁড়ে, মুড়ির পোটলা দেখেই দেশী বা বিদেশী চেনার সহজ উপায় বাতলায়…

আর আমার ইতিহাস বইয়ের পাতা থেকে বাংলাদেশের কাছাকাছি এই জেলা শহরের বুকজুড়ে থাকা তেভাগার ইতিহাস ফিকে হতে থাকে।

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *