গল্প ক্যাফে

রকি

মেয়েটা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কফি শেষ করে নিজের রুমের দিকে তাকিয়ে ঝটপট কাজে লেগে পড়লো, সাপ্তাহিক সাফাই অভিযানে। এক কামরার রুমটা খুব কম ভাড়াতেই পেয়েছে। বেশ স্বাধীনতা আছে। বাড়িওয়ালীও বেশ মিশুকে। জানুয়ারি শেষ হলেও এখনো ওয়েদারে হালকা ঠান্ডা ঠান্ডা আছে। স্নানের জন্য সবে গিজার অন করেছে তখনি ফোনটা এলো, কলেজের সিনিয়ার বিজয় দা।

– হ্যাঁ বিজয়দা বলো।

– তুলি তুই জব খুঁজছিলি, একটা জবের খবর আছে, একদম তোর জন্যই জবটা। তোর আবৃত্তির গলা দারুণ। কাল কলেজ থেকে সোজা “গল্প ক্যাফে”তে চলে যাস। অ্যাড্রেস আমি সেন্ড করে দেবো।

পুরোটাই ব্ল্যাঙ্ক, মাথার উপর দিয়ে গেলো। কী জব, কীসের জব কিছুই মাথায় ঢুকলো না। তার উপর একা একা ক্যাফেতে যেতে বললো। তুলি একটু চিন্তায় পড়ে, ক্যাফেতে কেন? বিজয়দা কি প্রপোজ-ট্রপোজ করবে? সিনিয়রগুলোর মতি গতি কিছুই বোঝা যায় না। যাই হোক তার একটা জব দরকার এটাও সত্য।

পরেরদিন কলেজ থেকে বেরিয়ে, ইনবক্সে পাঠানো বিজয়দার ঠিকানা দেখে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে পৌঁছে গেলো ‘গল্প ক্যাফে’তে। ভিতরে ঢুকেই বইপাগল মেয়েটা জায়গাটাকে ভালোবেসে ফেললো। ডাগর ডাগর চোখ মেলে চারদিকে দেখতে লাগলো। মোট দশটা টেবিল আর চারদিকে ডিজাইনার বুক শেলফে দেশী বিদেশী বই এর সমাহার। লাইব্রেরি বলে প্রায় ভুল করছিলো তখনই একটা ভরাট গলা বললো

– কিছু বলবেন

– আ.. আ.. আমাকে এ এখানে বিজয়দা আসতে ব.. বলেছে। জবের ব্যাপারে।

সুদর্শন যুবকটার দিকে তাকিয়ে ভেবলে যাওয়া তুলি কোনোরকমে কথাগুলো বলে।

-ওয়েল, আমি অভীক। অভীক বসু। আর আমার মনে হয় বিজয় ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেনি, তাই আপনার মতো ভুল মানুষকে পাঠিয়েছে।

– ম ম মানে? বুঝলাম না

একটু বিরক্তির সাথে অভীক বললো–এই ক্যাফে আমার স্বপ্ন, মাত্র একসপ্তাহ হলো ওপেনিং হয়েছে। আমার দরকার একজনকে যে সুন্দর, সাবলীলভাবে শ্রোতাদের সামনে গল্প বলতে পারবে। কিন্তু আপনি যে কথাই বলতে শেখেননি মিস..

রাগটাকে দমন করে তুলি বললো–তুলি, তুলি সেন। আর আশাকরি এটা ইন্টারভিউ নয়। কথা বলতে পারি কিনা, গল্প শোনাতে পারবো কিনা সেটা টেস্টের পরেই বোঝা যাবে তাই নয় কি?

গম্ভীর গলায় অভীক বললো

– তাহলে টেস্ট এর আগে কয়েকটা বিষয় ক্লিয়ার করে নিই। এই গল্প ক্যাফেটা অনেক স্বপ্ন নিয়ে বানিয়েছি। এখানে মানুষজন খেতে আসবে তার সাথে সাথে বই পড়ার সু্যোগ থাকবে। আর যেটা ইউনিক ব্যাপার হবে কাস্টমার সুযোগ পাবে লাইভ গল্প শোনার। লাইভ ব্যান্ড আছে, লাইভ ডান্স আছে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট এ। আমার গল্প ক্যাফেতে লাইভ গল্প শোনানো হবে বিভিন্ন বই থেকে পড়ে। তার জন্য আমার এমন একজনকে দরকার যে গল্পটা সুন্দর করে পরিবেশন করবে। অ্যাম আই ক্লিয়ার?

– হ্যাঁ।

– দশমিনিট সময় দেওয়া হল। আপনি মেন্টালি প্রিপারেশন নিয়ে নিন। আজ কিছু ইনভাইটেড গেস্ট আসবেন। তাদের সামনে গল্প পড়বেন আজ।

-ওকে! আই নিড আ কাপ অফ কফি। নার্ভাস ভাবে বলেই নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করলো। কফিতে চুমুক দিতে দিতে তুলি ভাবতে লাগলো এতো সুন্দর একটা ক্যাফে, এতো ইউনিক ভাবনা যার মাথা থেকে বেরিয়েছে সে কিনা এরকম কাটখোট্টা, গম্ভীর একটা মানুষ।

দশ মিনিট পরে ছোট্ট স্টেজ মতো জায়গাটায় তুলির হাতে তুলে দেওয়া হলো সুচিত্রা ভট্টাচার্যের নীল ঘুর্ণি। তখনো ক্যাফেতে কেউ আসেনি। চেয়ারে বসে মাইক্রোফোন মুখের কাছে নিয়ে তুলি পড়া শুরু করলো

“ঝড়ের গতিতে ডিনার সারছিলো দয়িতা। খাওয়া নয় গলাধঃকরণ। রুটি ছিড়ছে, মুখে তুলছে, জল খাচ্ছে ঢকঢক। বিষম লাগলো হঠাৎ, সামলাতে গিয়ে বুক আবার ধড়াস। বোধিসত্ত্ব আজ আবার তাড়াতাড়ি চলে যাবেন না তো?”

এই পর্যন্ত পড়ে বই থেকে মুখ তুলে তাকালো। দেখলো একটা টেবিলে দুজন গেস্ট এসেছেন। আর দূর থেকে শ্যেনদৃষ্টিতে অভীক তাকিয়ে আছে। না, জবটা পেতেই হবে। সত্যিই জবটা একদম পারফেক্ট তার মতো বই পাগলের জন্য। একবুক শ্বাস নিয়ে আবার শুরু করলো পড়া। আর কোনো দিকে তাকালো না তুলি। সাবলীল গতিতে গল্প শুনিয়ে যেতে লাগলো, একদম গল্পের মধ্যে ঢুকে গেলো। আস্তে আস্তে সব গেস্ট চলে এসেছে। একবার মাত্র বই থেকে মুখ তুলে দেখেছে, সবাই টুকটাক খাবারের সাথে সাথে তার দিকে তাকিয়ে আছে, শুনছে তার গল্প বলা।

“বেজার মুখে খাতায় ফোন নাম্বারটা এন্ট্রি করলো দয়িতা… বিয়ে ঠিক হয়েছে দয়িতার। দামী লোভনীয় সুপাত্র। “

প্রথম পর্ব শেষ করে মুখ তুললো তুলি। দূর থেকে ইশারায় তুলিকে থামতে বলে, স্টেজের কাছে গিয়ে অভীক মাইক নিজের হাতে নিলো।

– লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান, গল্প ক্যাফের নতুন সংযোজন গল্পের আসর আজ কেমন লাগলো জানাবেন, আজ এই পর্যন্তই। কাল থেকে রোজ সন্ধ্যা ছটা থেকে আটটা আপনাদের পছন্দের মেনুর সাথে সাথে শুনতে পাবেন বিভিন্ন লেখকের গল্প। আপনাদের গল্প শোনাবেন তুলি সেন। গিভ আ বিগ হ্যান্ড ফর মিস তুলি।

একটা ছোট্ট হাততালির ঝড়ের সাথে সাথে তুলি বুঝতে পারলো জবটা তার ফাইনাল হয়ে গেছে। এক এক করে আমন্ত্রিত অতিথিরা বিদায় নিতে  অভীক তুলিকে বললো–আপনার গলার স্বর খুব সুন্দর, তবে পড়াটা একটু ফাস্ট হয়ে যাচ্ছিলো। একটু খেয়াল রাখবেন আর কাল থেকে ঠিক ছ’টায় চলে আসবেন।

ব্যাগটা পিঠে নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তুলি ভাবতে লাগলো কি সুন্দর বই দিয়ে সাজানো ক্যাফে। কত সুন্দর ভাবনা, মানুষ খেতে খেতে গল্প শুনবে। আবার গল্পের আসর ছাড়া অন্য সময়ে যারা আসবে তারা প্রিয় লেখকের বই হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে খেতে পারবে। একদম ইউনিক আইডিয়া। বইপাগলদের জন্য স্বর্গ। সবথেকে বড় কথা জবটা খুব পছন্দ হয়তে তার, টাইমিংটাও দারুণ। সন্ধ্যে ছটা থেকে আটটা। তবে ক্যাফের ওনারটাকে একদম পছন্দ হয়নি। এইরে, একটা প্রশ্ন করতেই ভুলে গেছে, স্যালারি কত হবে। রাতে শুয়ে শুয়ে তুলি অতোসুন্দর ক্যাফেটার সাথে গোমড়া মুখো অভীককে মেলাবার চেষ্টা করে। ওইরকম রসকষহীন একটা মানুষের মাথায় এতো সুন্দর একটা আইডিয়া কিভাবে আসতে পারে সেটা ভেবে পায় না তুলি। পরদিন কলেজে মন বসে না তুলির, শুধু মনে হতে থাকে কতক্ষনে ক্যাফেতে যাবে, কতক্ষণে গল্প পড়া শুরু করবে। কলেজ শেষে পৌঁছে যায় ক্যাফেতে। ছটা বাজতে বেশ কিছুটা বাকি, তাই ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নেয়। ফ্রেশ হবার পরে ওয়েটার ওকে এককাপ গরম কফি দিয়ে যায়। মনে মনে তুলি ভাবে গোমড়ামুখো হলেও মায়া দয়া আছে মালটার। ওর যে এক কাপ কফির খুব দরকার কি করে যেন বুঝে গেছে গোমড়ামুখোটা। আজ বেশ কিছু কাস্টমার এসেছে। টুক টাক খাওয়া দাওয়া করছে, কেউ বই নিয়ে উল্টে পালটে দেখছে। কোণের দিকে টেবিলে এক প্রবীণ কফি আর স্নাক্স নিয়ে বসে একমনে অ্যালবেয়ার কামু পড়ছে। তুলি ভালো করে দেখলো যারা এখানকার কাস্টমার সবাই বই ভালোবাসে। এরা শুধু খাবার জন্য আসে না। আসে কিছুটা সময় কাটাতেও। মাইক্রোফোনে অভীকের কন্ঠে ঘোষনা শোনা যায়–আজ গল্প পাঠের আসরে মিস তুলি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বিকেলের মৃত্যু থেকে গল্প  পড়ে শোনাবেন।

ঘোষণার পর তুলি বই হাতে মাইক্রোফোনের দিকে এগিয়ে যায়। চেয়ারে বসে দেখলো উপস্থিত সকলের চোখ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। এমনকি কোণের টেবিলের প্রবীণ ভদ্রলোকটিও বই থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে। কালকের থেকে আজ হটাত করে নার্ভাস ফিল করতে লাগলো। তারপর মনে জোর এনে পড়তে শুরু করলো। প্রথমে দু এক যায়গায় হোচট খাবার পরে, ধীরে ধীরে সাবলীল ছন্দে পড়তে থাকলো। বারো নাম্বার পৃষ্ঠার শেষটায় গিয়ে একটু থমকে গেলো তুলি, তারপর আবার পড়া শুরু করলো–

“ববি থমকে গেলেন। তারপর গম্ভীর মানুষটার মুখে এক আশ্চর্য হাসি ফুটলো। ববিকে কখনো কোনও দিনও হাসতে দেখেনি লীনা। সে অবাক হয়ে দেখলো লোকটার হাসি চমৎকার। নিষ্পাপ, সরল।”

এই পর্যন্ত পড়ে নিজের অজান্তেই অভীকের দিকে চোখ চলে গেলো। দেখলো অভীক তার দিকে তাকিয়ে আছে, ঠিক যেন কসাই এর্ দৃষ্টিতে। মালটাকে হাসতে দেখে না মোটেও,  সবকিছু যেন মাপা। এক্সপ্রেশনগুলো যেন রোবট রোবট। অথচ এই লোকের ব্রেন চাইল্ড এই ক্যাফে, ভাবতেও অবাক লাগে। আজকের সেশন শেষ করার পরে যখন ব্যগ পিঠে নিয়ে বেরোবে তখনি গোমড়ামুখো এসে বললো–আপনার ভয়েসটা সুন্দর কিন্তু আমি যেটা চাইছি সেটা হচ্ছে না, মাঝে মাঝে আটকে যাচ্ছেন, এই ভাবে চললে শ্রোতা কিভাবে গল্পের সাথে একাত্ম বোধ করবে, ভুলগুলো তাড়াতাড়ি শুধরে নিন। শালা খড়ুশ যতই সুন্দর করে গল্প শোনাই এর পছন্দ হবে না ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো তুলি।

রাতের খাবারের পরে ফোনটা ঘাঁটতে ঘাঁটতে তুলি ভাবতে লাগলো অভীককে নিয়ে ভাবতে লাগলো, বড়ো বেশী গম্ভীর আর নাকউঁচু পাবলিক। কতই বা বয়স হবে আঠাশ-তিরিশ। অথচ এই বয়সের ছেলেরা এইরকম রামগড়ুরের ছানা হয় না। সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ আছে কি? মনে তো হয় না, সবটাও বিজনেস ট্যাক্টিস। আচ্ছা বিবাহিত না আবিবাহিত? অবিবাহিত হলে সিংগেল কি?  যা সুদর্শন সিংগেল থাকার চান্স কম, আবার এইরকম গোমড়াথোরিয়ামের গার্লফ্রেন্ড থাকাটাও আশ্চর্য। তবে কিছু অভীক এর মধ্যে কিছু একটা আছে যেটা বেশ আকর্ষণ করে। নিজের মনে এই সব ভাবতে ভাবতে ফিক করে হেসে ফেলে তুলি। ওকে নিয়ে বড় বেশি গবেষণা করছি, আর না। এই বলে পাশবালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

সকালে ঘুমটা ভাঙলো একটু দেরিতে। গা হাতে ব্যাথা, মাথাটাও ভারী হয়ে আছে। আজ আর বেরোবার ইচ্ছা গেলো না তুলির। ভীষন ল্যাদ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। তুলি একবারে বিকেলেই বেরিয়ে ক্যাফে যাওয়া মনস্থির করলো। শুয়ে শুয়ে ফেসবুক অন করলো। নোটিফিকেশনে নতুন আঠাশটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এর সব থেকে উপরে অভীক বসু নামটা জ্বলজ্বল করছে। রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করে, প্রোফাইল এর পোস্ট মর্টেম শুরু করলো। গোমড়ামুখোর ছবিগুলো বেশ ঘ্যামা। আর কয়েকটা ছবিতে খুব সুন্দর করে হাসছে। প্রতিটা ছবিতে মেয়েদের কমেন্ট উপচে পড়েছে। বেশ কিছু স্ট্যাটাস মারাত্মক রকমের সুন্দর। তুলি মনে মনে ভাবলো–এ ছেলের সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা আছে নিশ্চয়, না হলে এতো কাব্যিক স্ট্যাটাস আসে কিভাবে। নাহ, পুরো প্রোফাইল ব্যোমকেশের নজরে খুঁজেও কোথাও কোন রিলেশনশিপের প্রমাণ পেলো না তুলি। উলটে প্রোফাইল ঘাটার পর একটা অন্যরকম ভালোলাগা তৈরি হলো। “দূর আমার কেনো ভালো লাগতে যাবে ওই রামগড়ুরের ছানাকে” বেশ জোরের সাথেই উচ্চারণ করলো তুলি। নিজেকে নিজে সাফাই দিতে দেখে একটু হেসে ফেললো।

যথারীতি আজকেও বেশ সুন্দর করে গল্পটা পড়ে শেষ করলো। শ্রোতারা বেশ জোরে জোরে হাততালি দিলো। কিন্তু গোমড়ামুখোর মুখ থেকে কোনো প্রশংসা শুনতে না পেয়ে একটু হতাশ হলো তুলি। তুলির ভীষণ ভীষণ ইচ্ছা করছে ওর সাথে মন খুলে একটু আড্ডা মারার। মানুষটা কেমন সেটা জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু অভীক যেন বড় বেশী নিজেকে গুটিয়ে রাখে। হু শালা নাক উঁচু বুর্জোয়া মাল বলে– বাড়ি যাবার তাড়া খুব, শেষ দুটো পাতা ঝড়ের গতিতে কেন পড়লেন। শালা, মুখ দিয়ে কি একটুও প্রশংসা বেরোয় না! নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে বাড়ির পথে পা বাড়ালো তুলি।

রাতের খাবারের পর ফেসবুক অন করলো তুলি, দেখলো বই পড়ার অভ্যাস নিয়ে বেশ বড় একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে অভীক। এটাও কি বিজনেস ট্যাক্টিস? উহু,  এতো আবেগভরা লেখা শুধু মাত্র বিজনেসের জন্য হতে পারে না। প্রথমে লাইক দিয়েও আবার লাভ রিয়েকশন দিলো তুলি। যে মানুষটাকে সামনাসামনি দেখে সেই মানুষটাকেই ফেসবুকে কতটা অচেনা লাগে। কত মিষ্টি, সুন্দর, লাগে। একেকটা স্ট্যাটাস তো একদম তুলির মনকে ছুয়ে নেয়। এ কি ডক্টর জোকিল এন্ড মিস্টার হাইড?  ভাবতে ভাবতে তুলি গভীর ঘুমে ডুবে যায়।

প্রতিটা দিন তুলির বেশ সুন্দর ভাবে কাটতে থাকে। কলেজের পর গল্প ক্যাফেতে গল্প পড়াটা ওকে একবুক অক্সিজেন যোগায়। বেশ কিছু রেগুলার কাস্টমার ও তৈরি হয়েছে এই কুড়ি পঁচিশ দিনের মধ্যেই। যারা শুধু মাত্র গল্পের টানে আসে। দ্বিতীয় দিনের দেখা সেই প্রবীনের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। সেশন শেষ হলে প্রবীণ হাতছানি দিয়ে ডাকে, রোজ ওর সঙ্গে একটু বকবক করে তার পর বাড়ি ফেরে তুলি। আবার কোনো দিন বিদেশী সাহিত্যের কোনো একটা বইতে ডুব দেয়।

এদিকে রোজ অভীক কিছু একটা নিয়ে কথা শোনাতে ছাড়ে না। রাগ হয়, বিরক্তি লাগে আবার ভালোও লাগে। এই তো পরশুদিন অভীক কিছুই ভুল ধরেনি, সেটাও ভালো লাগেনি তুলির। তুলি বুঝে উঠতে পারে না গোমড়ামুখো ছেলেটার প্রতি কিসের এতো আকর্ষন তার।

শনিবার ওর হাতে তুলে দেওয়া হয় বুদ্ধদেব গুহর বাবলি। অভীক বলে আমার ফেভারিট বইগুলোর মধ্যে একটা। এতে একটুও ভুল বরদাস্ত করবো না, মাথায় রেখো। বাবলি হাতে নিয়ে চোখটা চকচক করে উঠেছিলো তুলির। বাবলি যে তার ভীষণ প্রিয়। কিন্তু অভীকের হুমকিতে মনটা একটু তেতো হয়ে গেলো।

পড়া শুরু করলো তুলি।  একটা পাতায় এসে হঠাৎ গলাটা আপনা থেকেই একটু জোরে হয়ে গেলো তুলির–

“অভী যেন আদেশের সুরে বললো, থামাতে বলছি, থামান।

বাবলি এই স্বরে অভ্যস্ত ছিল না। অভী যে ওকে আদেশ করতে পারে, বাবলি ভাবতে পারে নি। কিন্তু বাবলির খুব ভালো লাগল। বাবলিকে ছোটবেলা থেকে ওকে কেউ কখনো আদেশ করে নি। কারো আদেশ মানার মধ্যে যে এত আনন্দ তা ওর জানা ছিল না।”

এর পরে আবার নরমাল ভয়েসে পড়তে লাগল। সেশন শেষ হতেই, অভীক রে রে করে তেড়ে আসলো, 

-এটা কি হলো? নিজেকে কি মনে করেন? একটা গল্পও কি সুন্দর করে পড়া যায় না ! ওই ভাবে ষাঁড়ের মতো চিৎকার করে পড়ার কি ছিলো? কবে ঠিক করে পড়বেন? এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো অভীক। তুলি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ থেকে অনবরত জল ঝরে পড়ছে। এতো যা কিছু বলতো সব ফেরার সময় বলতো। আজ স্টেজ ছাড়ার আগেই সমস্ত শ্রোতার সামনে বলেছে। তুলি লজ্জা অপমানে মাথা তুলতে পারছে না। পা নড়ছে না একটুও। টেবিলে বেশ কয়েকজন যারা, শুধুমাত্র ওর গল্পের টানে আসে। তাদের দিকে মুখ তুলে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছে। অভিমান, লজ্জা, রাগ সব মিলিয়ে দলা পাকানো কষ্টগুলো দুচোখে বাঁধ মানছে না।

কোনো রকমে ব্যগ কাঁধে নিয়ে মাথা নিচু করে বাড়ির পথে হাঁটা দেয় তুলি। রাতের খাবার না খেয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুম আসে না, এপাশ ওপাশ করতে করতে শেষে ফেসবুক অন করে। মেসেঞ্জারে একটা ছোট্ট মেসেজ পাঠিয়েছে অভীক।

“আজকের আমার ব্যবহারের জন্য দুঃখিত। ক্ষমাপ্রার্থী।”

মেসেজ সিন করে কোনো রিপ্লাই করে না তুলি। ভোরের দিকে ঘুমটা এসেছিলো। ঘুম থেকে উঠে প্রতিজ্ঞা করে গল্প ক্যাফেতে না যাবার।

কিন্তু বিকেল হতেই কেমন যেন ছটফট করতে থাকে তুলি। রুমের মধ্যে মন বসে না। শুধু মনে হতে থাকে আমার গল্প শুনতে অনেকেই আসে। গোমড়ামুখোর জন্য তাদের কেন বঞ্চিত করবো! বেশ কিছুক্ষণ নিজের সাথে যুদ্ধের পর রেডি হয়ে  ধীরে ধীরে ক্যাফের দিকে হাটা লাগায়। ক্যাফের সামনে গিয়ে ইতস্তত করে, শেষে সিদ্ধান্ত নেয় আর ওখানে যাবে না। কিন্তু নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তার পা দুটোই যেন ভিতরে ঢুকে গেলো। কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা ভিতরে গিয়ে বই হাতে নিয়ে গল্প শুরু করে দিলো। রোবটের মতো যান্ত্রিক ভাবে পড়াটা শেষ করে বেরিয়ে আসছিলো তখনি অভীকের আদেশ শুনতে পেলো, যাবেন না। কাস্টমার খালি হওয়া অবধি যাবেন না আপনি। বাবলির মতো তুলিকেও কেউ ছোটোবেলা থেকে আদেশ করেনি। আর আদেশ মানতে মোটেও আনন্দ হচ্ছে না। মনে মনে অভীককে হুকোমুখো বলে চুপ চাপ চেয়ারে গিয়ে বসে।

এক এক করে সব কাস্টমার বেরিয়ে যাবার পরে অভীক বলে আজকেরটা আবার পড়ুন। তুলি লম্বা শ্বাস নিয়ে পড়া শুরু করে। সবে মাত্র দশ বারো লাইন পড়েছে, অভীক বলে–হচ্ছে না, একদম হচ্ছে না। গল্পের মধ্যে ঢুকে যান, ক্যারেকটার এর সাথে একাত্ম হন। এই প্রথম অভীক তুলির সাথে সুন্দর করে কথা বললো। এক এক করে বড়ো লাইট গুলো অফ করতে লাগলো ছোকরা কর্মচারিটা।

তুলি আবার পড়া শুরু করে। খুব সুন্দর ভাবে পড়তে থাকে। একটু দম নিয়ে বিরানব্বই নাম্বার পৃষ্ঠাতে যখন পড়ছে তুলি তখন আর তুলি নেই, এতোটাই গল্পের সাথে একাত্ম হয়ে গেছে।

“তুমি আমাকে ভালোবাস সত্যি?

অভী থমকে দাঁড়ালো।

অবাক হয়ে বলল, মিথ্যা?

তারপর বলল, হঠাৎ এ সন্দেহ? এতদিন পরে? এতকিছুর পরে?

বাবলি আবারও বলল, আমাকেই বাসো? একা আমাকে?”

অভীক কখন তুলির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তুলি বুঝতে পারেনি, অভীক ভরাট কন্ঠে উচ্চারন করলো–

“অভী বাবলিকে দুহাতে ওর বুকের মধ্যে পিষে ফেলে বললো, হিংসুটি, মেয়ে মাত্রই হিংসুটি।

তারপর বলল, বাসি বাসি বাসি। তোমাকে, একা তোমাকেই ভালোবাসি।”

এই অবধি উচ্চারণ করে অভীক থামলো। হতচকিত তুলি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে পরের লাইনটা শুরু পড়লো–

“আর কাউকে না তো? একটুও না?  বাবলি ভুরু তুলে বলল।”

তুলি মনেপ্রাণে কামনা করতে লাগলো পরের লাইনটা সত্যি ঘটুক এখনই, তিরতির করে কাঁপতে লাগলো তার ঠোঁট। আরো কাছে ঘেঁসে এলো অভীক, তার পরে সত্যিই সে তুলিকে টেনে নিলো বুকে…

“অভী ওর ঠোঁট বন্ধ করে দিল চুমোর  শিলমোহরে………”

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *