একটি প্রেমের জন্ম

ফিরোজ আহমেদ

স্কুল ছুটির পর মেজাজটা খিঁচড়ে গেল বর্ণালীর। আজকেও তার সাইকেলের ওপর আরেকটা সাইকেল রাখা। সোনারপুর এর একটি কো-এড স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে বর্ণালী। বাবার বদলির চাকরি। উত্তরবঙ্গ থেকে এবছর-ই কলকাতায় বদলি হয়েছেন তিনি। সোনারপুর এর একটা দুকামরা বাড়ি ভাড়া নিয়েছে তারা। বাবাকে সেকথা জিজ্ঞেসই করে বসেছিল সে– “এত জায়গা থাকতে সোনারপুর কেন বাবা? কলকাতাতেই তো ঘরভাড়া নিতে পারতে। “

“বুঝলি তো ট্রেন লাইনটা আছে, যাতায়াত নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। তাছাড়া এখানে স্কুলও আছে অনেকগুলো। তোর সুবিধেই হবে,” আর বাবা যেটা বলল না সেটা হল কলকাতা থেকে এই মফস্বল শহরের বাড়িভাড়ার খরচটা কম হবে; সেটাও বর্ণালী ভালো ভাবেই বুকে গেল। বর্ণালীও বাড়ির কাছেই একটা স্কুলে ভর্তি হয়েছে। অল্পই রাস্তা, সাইকেলেই যাতায়াত করে সে, মিনিট দশেক লাগে। এমনিতে মফস্বল হলেও সোনারপুর এখন ঘিঞ্জি হয়ে এলাকা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত এলাকাগুলি থেকে, বিশেষ করে গোসাবা, বাসন্তী, কাকদ্বীপ, পাথরপ্রতিম প্রভৃতি অঞ্চলের ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ সোনারপুরে আস্তানা গাড়ছে। টোটো, অটো, রিকশা, বাস, ট্রেকার তার সাথে অগুনতি প্রাইভেট  গাড়ি, রাস্তার ওপরেই সবজি মাছ বিক্রি, বেশ দরদাম করে কেনাকাটা চলছে….. আর আছে স্টেশনের প্যাসেঞ্জারের স্রোত… পুরোটা মিলিয়ে একেবারে ঘেঁটে ঘ যেন।

আর তাই স্কুল ছুটির সাথে সাথেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বর্ণালী। বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে মাকে আজকাল একটু সাংসারিক কাজে সাহায্য করে। ইদানিং দেখছে মা যেন একটু বেশিই ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। কতই বা বয়স হবে। সবে পঞ্চাশের কোঠায় পা দিল। এরমধ্যেই কেমন যেন বুড়িয়ে গেছে। নিজের শখ আহ্লাদের কথা না ভেবে সারাটা জীবন স্বামী আর মেয়ের সেবা করে গেল। বর্ণালীর খুব ইচ্ছে মন দিয়ে পড়াশুনো করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের পায়ে দাঁড়ানো।

আর তাই ওর ক্লাসের মেয়েরা যখন অন্য ছেলেদের সাথে খুনসুটি বা একটু আধটু প্রেম করে, বর্ণালী নিজেকে খোলসের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে। প্রেম করার মত বিলাসিতা করার সময় ও মানসিকতা তার নেই।

বর্ণালী তাড়াতাড়ি বেরোনোর জন্য গ্যারেজের পাশে একটা ফাঁকা জায়গায় দেয়ালে হেলান দিয়ে সাইকেলটা রাখে। স্কুলের মিড ডে মিল রান্নাঘরের পাশে ছাত্রছাত্রীদের সাইকেল রাখার গ্যারেজ। অনেক স্যার ও ওখানে বাইক রাখেন। কিন্তু ছুটির শেষে সাইকেল নিতে বেশ দেরি হয়ে যায়। তাই ও বাইরেই রাখে সাইকেলটা।

আজ সাইকেলটা নিতে গিয়ে দেখল ওর সাইকেলের ওপর আরেকটা সাইকেল রাখা। আর এমন ভাবে রাখা যে ওর সাইকেলটা বেরই করতে পারলো না।  কটমট করে এদিক ওদিক তাকিয়ে সাইকেলের মালিকের হদিশ করতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর লম্বা রোগাটে একটি ছেলে আস্তে আস্তে এল, সাইকেলটি নিল….। বর্ণালী বিরক্তসহকারে জিজ্ঞেস করল “তুমি এখানে রেখেছ কেন সাইকেল? এভাবে কেউ রাখে!” নির্বিকারভাবে ছেলেটি উত্তর দিল, “জায়গাটা তোমার নয়, স্কুলের। আমি যেখানে খুশি সাইকেল রাখব।” তারপর বর্ণালীর উত্তরের প্রত্যাশা না করে তার মুখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যায়। রাগে গজগজ করতে করতে বর্ণালী সাইকেল নিয়ে এবার বাড়ির দিকে রওনা দেয়। আজ অভিজিৎ স্যার প্রচুর হোমওয়ার্ক দিয়েছেন। এরপর যা হয়, হোমওয়ার্কের চাপে সাইকেলের ব্যাপারটা বেমালুম ভুল গেল সে। কিন্তু পরের দিন একই কান্ড। আবার সেই সাইকেল রাখা তার সাইকেলের ওপরে। এবারেও সেই ছেলেটি নির্বিকার চিত্তে ধীরপায়ে এসে সাইকেলটি নিল তারপর নিয়ে বেরিয়ে গেল। পর্নাকে জিজ্ঞেস করতে বলল ছেলেটি নাকি ক্লাস ইলেভেন এ পড়ে।

বেশ কয়েকদিন একই ঘটনা ঘটার পর বর্ণালী একটু সতর্ক হল। পরেরদিন স্কুলে ঢোকার সময় সে আড়চোখে দেখলো ছেলেটি দূরে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে না দিয়ে বর্ণালী সাইকেলটি যথাস্থানে রেখে ক্লাসে না ঢুকে ব্যালকনি থেকে তাকে খেয়াল রাখতে লাগলো। ছেলেটি এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে তার সাইকেল এর কাছে এল, কয়েক সেকেন্ড বর্ণালীর সাইকেলটার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর খুব যত্নসহকারে তার সাইকেলের ওপর সাইকেল টাকে রাখে চলে গেল।

ইতিমধ্যে বৈশাখ মাস পড়ে গেছে। সুয্যিমামা তার উত্তাপ দেখাতে শুরু করে দিয়েছে। সাইকেলের ব্যাপারটায় বর্ণালী অভ্যস্ত হয়ে গেছে যেন। বিরক্তি ক্রমেই উদাসীনতায় পরিণত হয়েছে এখন।

প্রথম ইউনিট টেস্টের বেশ কিছুটা সিলেবাস এখনো বাকি। ভাবতে ভাবতে আজ সাইকেল নিতে গিয়ে দেখল, তার ওপরের সাইকেলটা আজ নেই।  বর্ণালী একটু অবাকই হল। “বেঁচে গেলাম বাবা”.. ভাবতে ভাবতে বর্ণালী বাড়ির দিকে রওনা দিল। আজ অঙ্কের শর্ট প্রশ্নগুলো নিয়ে একটু বসতে হবে। ক্লাস টেস্টে তিনটে অঙ্ক ভুল করায় মধুরিমা ম্যাম বকেছেন। রাতে খাওয়ার পর বর্ণালী মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে রইল। চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে মা বলল “তোর বয়সের মেয়েরা শরীরের কত যত্ন নেয়। তুই তো শরীরের খেয়ালই রাখিস না। পড়ে পড়ে চোখের নীচে গর্ত করে ফেলেছিস। তোকে যে বিয়ে দেব কি করে সেটাই ভাবি!”

বর্ণালী উঠে বসল “শোনো আমি বিয়ে করব না। তোমাদের সাথেই থাকবো। একটা চাকরি ঠিকই জোগাড় করে নেব। তারপর  তোমরা একটু বিশ্রাম নেবে। আমাকে বলছ, আর নিজের চেহারার দিকে কখনো তাকিয়েছ কখনো? ” 

“পাগলী আমার, মেয়েদের তাই বললে চলে?” 

পরের দিন ও স্কুল থেকে বেরোনোর পর দেখল সাইকেলটা আজও নেই। এবার একটু অবাক হল বর্ণালী। তারপর নিজের মনকেই শাসন করল সে। সাইকেল নেই তো তার কি!

‎দিন দশেক কেটে যাওয়ার পর ….ছেলেটির জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল বর্ণালী। কিছু হয়নি তো ছেলেটির!

‎লজ্জার মাথা খেয়ে ছেলেটির ক্লাসের একটি মেয়েকে জিজ্ঞেসই করে ফেলল সে। কিন্তু সেও কোনো হদিস দিতে পারলো না ঠিক। 

‎ইতিমধ্যে প্রথম ইউনিট টেস্টের ব্যস্ততায় এই বিষয়ে আর মনোযোগ দিতে পারেনি বর্ণালী। শেষ দিন ছিল অঙ্ক পরীক্ষা। যথারীতি দুটো শর্ট প্রশ্ন মিস করেছে বর্ণালী। মনটা বেশ খারাপই ছিল। নাঃ, পরেরবার আরো ভালো করে পড়তে হবে তাকে। আকাশের দিকে তাকালো সে। একঝাঁক কালো মেঘ ঘিরে ধরেছে আকাশটাকে। উফ্ যা গরম, অবশেষে কালবৈশাখী এলো বোধ হয়। ছাতাটাও আনেনি আজ। দ্রুত সাইকেলের দিকে পা বাড়ালো সে।

সাইকেল নিতে গিয়ে চমকে উঠল সে। সেই সাইকেল। ঠিক তার সাইকেলের ওপরে একইভাবে রাখা। মুচকি হেসে  বর্ণালী স্বস্তির নিঃশাস ফেলল। ততক্ষণে টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে গেছে… আজ বৃষ্টিতে ভিজবে বলে ঠিক করলো সে!!

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *