প্রসেনজিৎ ঘোষ:

“ম্যায় আকেলা হি চলা থা, জানিব এ মঞ্জিল মাগর/ লোগ সাথ সাথ আতে গায়ে ঔর কারমা বানতা গায়া।”–কবিতা, গজল মুশায়রার জগৎ থেকে সিনেমা জগতে গীতিকার রূপে পদার্পণের এক দীর্ঘ কর্মজীবনে নতুন নতুন সৃষ্টিমাধুরী দিয়ে আপামর ভারতবাসীর মনের বারান্দার এক প্রিয় বাসিন্দা হয়ে গেছেন মজরূহ সুলতানপুরী। পেশায় হাকিমি থেকে গীতিকার হওয়ার এই দীর্ঘপথে বহুবার বহু প্রতিকূলতা এসেছে কিন্তু সমস্ত প্রতিকূলতাকে তিনি অতিক্রম করে গেছেন নিজের দৃঢ়চেতা মানসিকতা দিয়ে। পিতৃদত্ত নাম আসরার হুসেন খান তবে তিনি মুসায়রার জগতে প্রবেশ করেন মজরূহ সুলতানপুরী নামের আড়ালে। সুলতানপুরে জন্ম তাই সেই জন্মস্থানকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সুলতানপুরী আর জীবনে বহু আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছেন তাই মজরূহ যার অর্থ আহত।
১৯১৯ সালের ১লা অক্টোবর উত্তরপ্রদেশের সুলতানপুরে তাঁর জন্ম হয়। আর, ২০০০ খ্রীস্টাব্দের ২৪শে মে বান্দ্রায় শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন। পুলিস সাব-ইনস্পেকটরের পুত্র আসরার প্রথাগত শিক্ষার বদলে পেয়েছিলেন দরগাই নিজামিয়ানির সাত বছরের পাঠ। আরবি এবং ফারসী ভাষায় পারদর্শিতার পাশাপাশি পেয়েছিলেন ‘আলিম’ ডিগ্রী। ইউনানি চিকিৎসাবিদ্যা শিখেছিলেন লখনউ এর তকমীল-উ-তিব কলেজে। পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন হাকিমি। সেই সঙ্গে তিনি তাঁর কাব্য চর্চা চালিয়ে মেতে থাকেন। বিভিন্ন মুসায়রায় যান গজল পাঠ করতে। ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে থাকেন। বিভিন্ন কবি-বন্ধু পেলেন, তাঁদের মধ্যেই ছিলেন বিখ্যাত উর্দু কবি জিগর মোরাদাবাদি। ১৯৪৫ সালে বোম্বাই (বর্তমানে মুম্বাই ) এ যান মুশায়েরাই অংশ নিতে। সেখানে প্রশংসা পান তৎকালীন সময়ের নামী প্রযোজক এ.আর কারদারের। তাঁর সূত্রেই এক নতুন জীবনে পদার্পণ করেন মজরূহ সুলতানপুরী।
“যব উসনে গেসু বিখরাঈ, বাদল আয়ে ঝুমকে।…”
কারদারের আগ্রহে জিগর মোরাদাবাদির পরামর্শে মজরূহ সুলতানপুরী পৌছে যান বোম্বাই-এর সিনেমা পাড়ায়। জিগর মোরাদাবাদি তাঁকে পাঠান সেইসময়ের দিকপাল সংগীত পরিচালক নৌশাদের কাছে। নৌশাদ একটি গানের সুর দিয়ে তার ওপর গান লিখতে বলেন মজরূহকে। তিনি সেই সুরের মাপে লিখেদিলেন – “যব উসনে গেসু বিখরাঈ, বাদল আয়ে ঝুমকে।” নৌশাদ মুগ্ধ হয়ে তাঁকে গীতিকার হিসাবে চুক্তিবদ্ধ করে নেন ‘সাজাহান’ ছবির জন্য। মজরূর কলম থেকে ঝরে পড়তে থাকে অমর সব গীত – ‘কর লিজিয়ে চলকে মেরি জন্নাত কে নজারে।’ বা ‘যব দীল হি টুট গয়া’। এইসব জনপ্রিয় গানের সূত্রে তিনি গীতিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান।
“সাঁই ইতনা দিজেএ, যামে কূটুম্ব সামায়ে/ ম্যায় ভি ভূখা না রাহু, সাধুন ভুখা যায়ে।” (দোহা- কবীর)
–এই সাম্য সকলের; এবং অধিকার প্রাপ্তির প্রতি জাগরণ ঘটানোই যে কমিউনিজমের মূল মন্ত্র, সেই মন্ত্রেই দীক্ষিত হন মজরূহ সুলতানপরী। বোম্বাই শহরে আসার পর যুক্ত হয়ে যান বামপন্থী আন্দোলনের ধারায়। প্রগতিশীল গোষ্ঠীর সদস্য হন, যে গোষ্ঠীতে ছিলেন সাহির লুধিয়ানভী, বলরাজ সাহানী প্রমূখ।
তিনি লেখেন-
“রোজ বো রোজ ইসি কৌসিস মে হূ / কি গজল কে পসমন্তর মে
মার্কসবাদ কো রাখকার সিয়াসি/ সমাজী ঔর ইসকিয়া সায়েরী কর সাকু”
বোম্বাই-এর প্যারেড এলাকায় এক বামপন্থী সভা তাঁর আমন্ত্রণ ছিল। সেই সভার জন্য তিনি কংগ্রেস বিরোধী কবিতা লেখায় তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয় আর্থার জেলে, সঙ্গে বন্দী হন বলরাজ সাহানী।
তাঁদের দুজনকে ক্ষমা চাইলে মুক্তি দেওয়া হবে বলা হলেও তাঁরা ক্ষমা চাননি। ফলত দু’বছরের জেল হয়। এইসময় মুক্তি পাই তাঁর গীতমূর্ছনায় সমৃদ্ধ ছবি ‘আন্দাজ’। জেলবন্দী থাকা কালীন অবর্ণনীয় অর্থনৈতিক দৈন্যের মুখে পড়তে হয় মজরূহ পরিবারকে। এই অনটনের সময় তাঁকে রাজকাপুর সাহায্য করেন। কিন্তু সাহায্য হিসাবে দিলে মজরূহ টাকা নেবেন না জেনে, রাজকাপুর তাঁকে দিয়ে একটা গান লেখান। বিনিময়ে দিয়েছিলেন ১০০০ টাকা। মজরূহ লিখেছিলেন বিখ্যাত সেই গান ” ইক দিন বিক জায়েগা মাটি কে মোল / জগ মে রহ জায়েঙ্গে প্যারে তেরে বোল। ” পরবর্তীকালে ‘ধরম করম’ ছবিতে এই গানটি স্থান পায়।
জেল থেকে বেরিয়েও বামপন্থী কাজকর্ম তিনি ছাড়েননি। তবে ভেঙে যায় নৌশাদ-মজরূহ জুগলবন্দী। নৌশাদ, সাকিল বদায়ুনি ছিলেন অন্য রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী, তাই তাঁদের সঙ্গে জুটি থাকেনি। তবে অন্যান্য সঙ্গীতকারদের সঙ্গে জুটি বেঁধে তিনি অমর সব গান লিখতে থাকেন। তাঁর গীতকে আশ্রয় করেই অনেক সংগীত পরিচালকের প্রথম সংগীতজীবন শুরু হয়। যেমন– খৈয়াম ‘ফুটপাত’ ছবিতে; ও.পি নাইয়ার ‘আরপার’ ছবিতে; ঊষা খান্না ‘দিল দেকে দেখো’; লক্ষীকান্ত প্যায়ারেলাল ‘দোস্তি’; রাহুল দেব বর্মন ‘তিসরী মঞ্জিল’; আনন্দ মিলিন্দ ‘কয়ামত সে কয়ামত তক’ ইত্যাদি।
প্রেমের বিভিন্নতর রূপের প্রকাশ দেখা যায় তাঁর গানে। তাঁর গানে জীবনের অনেক অমূল্য দর্শন ফুটে ওঠে। তাঁর গানের লেখা মনকে উদাসীনতার চরমে যেমন নিয়ে যায়, তেমনি কিছু গান মনের মধ্যে হাসির ফোয়ারা জাগায়। বিভিন্ন ধারার লেখার এক সঙ্গম যেন মজরূহ সুলতানপুরীর গান।
তাঁর কিছু অমর গান, যেমন–
“এ রাতে এ মৌসম”…
“হাম বেখুদি মে তুমকো পুকারে”…
“তেরি আখোকে সিবা”…
“হাম ইন্তেজার করেঙ্গে”…
“লাগি ছুটেনা আব তো সানম”…
“তাসবির তেরে দিলমে”…
“ওয়াদিয়া মেরা দামনা”…
–প্রভৃতি গানের মধ্যে মনটা বারবার হারিয়ে যায়।
কিছু কিছু গান আবার মনের দরজায় আঘাত দিয়ে মনটাকে ব্যথায় জর্জরিত করে তোলে। যেমন–
“বড়ি শুনি শুনি হ্যা…”
“সামে গম কী কসম…”
“পাথ্থর কে সানম…”
কলেজ জীবনের প্রায় প্রতিটি ছেলের গলায় একসময় গুনগুন করে উঠত “পাপা কেহতা হ্যা বড়া নাম করেগা/ বেটা হামারা এইসা কাম করেগা’। বা প্রথম প্রেমে পরা যুবক যুবতীর মনের কথা- “পহেলা নশা…”। বা প্রেমের প্রেমিকা একে অপরকে প্রভাবিত করতে অনেকে বেছে নিত- “গুম হ্যায় কিসিকে পেয়ার মে দিল সুবা সাম”। অথবা- “রাজা কো রানী সে প্যার হো গায়া”।
দুষ্টুমি ভরা প্রেমের অফুরান চঞ্চলতা ফুটে ওঠে এমন গানও তিনি লিখেছেন–
“দেখমে থো ভলে হো, পর হো বরি চঞ্চল…”
“আচ্ছা জি ম্যায় হারি চলো মান যায়ো না…”
“ওহ! ছোড়দো আঁচল জমানা ক্যায়া কহেগা…”
“হাল ক্যায়সা হ্যায় জনাব কা…”
“ইক লেড়কি ভিগি ভাগি সি…”
তিনি একদিকে লিখেছেন– ‘জ্বলতে হ্যায় জিসকে লিয়ে’, ‘হম বেখুদিমে’, ‘হমারে বাদ অব মেহফিল মে আফশানে বায়াঁ হোঙ্গে’, ‘রাহি মনবা দুখকি চিন্তা কিউ সাতাতি হ্যায়/ দুখতো আপনা সাথি হ্যায়’ — এমন সব দার্শনিক বোধসম্পন্ন লাইন, তিনি আবার লিখেছেন– ‘পাঁচ রুপাইয়া বারা আনা’, ‘সি এ টি ক্যাট’ – প্রভৃতি হালকা রসিকতার গান। আসলে তিনি সিনেমার চরিত্র অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের গান লিখেছেন।
সচীন দেববর্মন – মজরূহ সুলতানপুরী এক অমর জুটি। সত্তরটি সিনেমার গান দিয়েছেন এই জুটি, যার বেশিরভাগ খুবই জনপ্রিয়। যেমন, সচীনকর্তার গলায়–
“শুনো মেরে বন্ধু রে…”
“মেরি দুনিয়া হ্যায় মা তেরে আঁচল মে…” ইত্যাদি।
“রহে না রহে হাম… বনকে কলি বনকে সবাঁ বাগ-এ -ওয়াফামে…”
‘মিশলেযান’ গ্রন্থের লেখক মজরুহ সুলতানপুরী দীর্ঘদিন সিনেমার প্রয়োজনে, সিনেমার বিষয় বা দৃশ্যায়ন অনুযায়ী গান লিখতে লিখতে ভিতরে ভিতরে কোথাও হয়তো অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। একটি ইন্টারভিউতে বলেছিলেন– “কতদিন খুশি হওয়ার মতো একটা গজল লিখিনি। বছরে দু-তিনটি ছবির গান না লিখলে হাঁড়ি চড়বে না বলেই লিখতে হয়। এতদিন আমি দুনিয়া পাল্টানোর কথা বলেছি, আজ পরিবারের কারণেই ফিল্মের জন্য কম্পোমাইজ করতে হচ্ছে।” বলা বাহুল্য তাঁর সেই কষ্ট তিনি তাঁর গানে ফুটিয়ে তোলেন। যেমন–
“হম হ্যা মতায়ে কুচ-ও বাজার কি তরহা/ উঠতি হ্যায় হার নিগাহে খরিদারকি তরহি।
মজরূহ লিখ রাহা হ্যায় বো অহল -বফা কা নাম/ হম ভি খরে হুয়ে গূনেগার কি তরহা।”
এইভাবেই হয়তো এক বড় মাপের স্রষ্টা কখনো কখনো বাস্তব জীবনের কঠিন কথাকে আশ্রয় করে বাঁচতে গিয়ে নিজের ভিতরে ‘মজরুহ’ হতে থাকেন। কিন্তু মজরূহ সুলতানপুরী যা লিখেছেন তাতেই তাঁর নামটি শ্রোতার হৃদয়ে খোদাই করা হয়ে গেছে। প্রেম ও প্রতিবাদের কবি, দিকপাল গীত রচয়িতা মজরূহ সুলতানপুরী লিখেগেছেন– “রহে না রহে হাম মহকা করেঙ্গে, বনকে কলি বনকে সবা বাগ-এ-ওয়াফামে”- তিনি না থাকলেও তাঁর গানের এই মধুর নির্যাস ভেসে বেড়াবে আগামি দিনের সকল মানুষের মনের বাতাসে। পেয়েছেন উর্দু সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘গালিব পুরস্কার’। পেয়েছেন ‘ইকবাল সম্মান’। প্রথম গীতিকার হিসাবে তিনি পান ‘দাদাসাহেব ফালকে অ্যাওয়ার্ড’। জাতীয় পুরস্কার পান ‘দোস্তি’ ছবির জন্য। কিন্তু তিনি আসল পুরস্কার পেয়েছেন আসলে শ্রোতার মনে অধিষ্ঠিত হয়ে। তিনি নিজে যেমন মজরূহ, দর্শককেও তাঁর গানের মজরূহ প্রেমিক বানিয়েছেন।