জেনোসাইডের দোরগোড়ায় ভারত

মহঃ আরিফ সরকার

সাম্প্রতিককালের বিশ্ব রাজনীতির গতিপথ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সারা পৃথিবী জুড়েই উগ্রজাতীয়তাবাদী দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রায় গোটা ইউরোপ একই পথে চলেছে যেমন ইতালির লীগ, জার্মানির এ এফ ডি, স্পেনের ভক্স, অস্ট্রিয়ার ফ্রিডম পার্টি, পোল্যান্ডের কনফেডারেশন পার্টির মত উগ্রবাদী দলগুলোর সমর্থক অত্যন্ত দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুকূল আবহাওয়া পাওয়ার ফলে কনফেডারেট পতাকা হাতে কেকেকে আর নব্য নাৎসিদের মিছিল দেখা যাচ্ছে। একইভাবে প্রায় গোটা লাতিন আমেরিকা জুড়ে বামপন্থী দলগুলোকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে একের পর এক দেশে দক্ষিণপন্থী দলগুলো ক্ষমতায় এসেছে।  ব্লু ওয়েভের দাপটে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, চিলি প্রভৃতি দেশে আজ দক্ষিনপন্থীদের রাজত্ব । স্পষ্টতই বিশ্বরাজনীতির মঞ্চ এখন উগ্রজাতীয়তাবাদী দক্ষিণপন্থীদের দখলে।

ভারতে এই একই রাজনৈতিক ধারা চলছে তো বটেই বরং তা সবচেয়ে আগ্রাসী রূপধারণ করেছে। ভারতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিজেপি এবং তার মাদার অর্গানাইজেশন আরএসএএস যে গতিতে এবং যে পন্থায় তাদের দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে এগোচ্ছে তা এক সময় ভারতের মত মজবুত সাংবিধানিক স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত  গণতান্ত্রিক দেশে অভাবনীয় মনে হলেও আজ চূড়ান্ত বাস্তব। এই বিজেপি আরএসএস তাদের নীচ রাজনৈতিক চক্রান্ত সফল করার জন্য যে হীন পন্থা অবলম্বন করেছে  তা ভারতবর্ষের সাংবিধানিক কাঠামো এবং সংখ্যালঘু মানুষের প্রাণকে চূড়ান্ত বিপদের মুখে দাঁড় করিয়েছে।  রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা হিসাবে যে ব্যাপক মুসলিম বিদ্বেষী প্রচার চালানোর হয়েছে তাতে  ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে আজ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিস্থিতি উদ্ভূত হয়েছে।

ভারতবর্ষে অতীতে বহুবার বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা ঘটলেও এখনকার মত ভয়াবহ পরিস্থিতি এর আগে কখনো হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে তা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় আগামীদিনের পরিস্থিতি মাস মার্ডার বা গণহত্যাতেও আটকে থাকার মত নয়, ভারতে মুসলিমদের জেনোসাইড হতে চলেছে।

জেনোসাইড স্টাডিসের বিশেষজ্ঞ এবং জেনোসাইড ওয়াচ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর গ্রেগরি স্ট্যানটন জেনোসাইডের দশটি ধাপকে চিহ্নিত করেছেন। যা তত্ত্বগত ভাবে আন্তর্জাতিক মহলে গৃহীত এবং জেনোসাইড প্রতিরোধে এক গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র বলে স্বীকৃত।

জেনোসাইডের বিভিন্ন ধাপ অনেক সময় একই সাথে মিলেমিশে কার্যকরী থাকে। সব সময় সরলরৈখিক পথ অনুসরণ না করলেও কোনো একটি দেশে জেনোসাইড হবার মত পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে তা স্পষ্ট বোঝা যায় এই মডেল অনুসরণ করলে। এবার দেখা যাক বর্তমান ভারতের প্রেক্ষাপটে প্রফেসর গ্রেগরি স্ট্যানটনের দেওয়া জেনোসাইডের বিভিন্ন ধাপগুলো নিয়ে আলোচনা করলে কী পাওয়া যায়।

প্রথম ধাপ, বিভাজন (classification ) :

যে সমস্ত সংস্কৃতিতে জনগোষ্ঠীর দুটি অংশে পরস্পরের মধ্যে বিভাজনের প্রবণতা স্পষ্ট থাকে তারা জেনোসাইডের প্রথম ধাপে পা দিয়েছে বলা যায়।  অতীতে রুয়ান্ডায় হুতু-তুতসি, নাৎসি জার্মানিতে জার্মান – ইহুদি,  বসনিয়া হার্জেগোভিনাতে সার্ব – মুসলিম ইত্যাদি ভাগে বিভাজিত হওয়া এবং তার ক্রমপরিণতি আমরা দেখেছি।

ভারতে এই বিভাজনের ক্ষেত্র দেশ স্বাধীন হবার সময় থেকেই প্রস্তুত ছিল। অসাম্প্রদায়িক সাংবিধানিক কাঠামো, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এই বিভাজনের ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ দিতে পেরেছিল। কিন্তু বর্তমানে আর এস এস – বিজেপি দীর্ঘ পরিকল্পনা মাফিক এই এই হিন্দু-মুসলমান  বিভাজনের ক্ষেত্রটা ক্রমশ বাড়িয়ে মুসলিমদের নাগরিকত্বহীন করার বা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিনত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে চলেছে। caaর মত আইন বা nrc করে নাগরিকত্বের প্রমাণ চাওয়ার উদ্যোগ এই পরিকল্পনারই অংশ।

দ্বিতীয় ধাপ, চিহ্নিতকরণ (symbolization) :

জনগোষ্ঠীকে জাতি ধর্ম বর্ণ বা ভাষার ভিত্তিতে বিভক্ত করার পর অবদমিত অংশকে চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয় এই পর্যায়ে। যেমন খেমাররুজ কম্বোডিয়ার পূর্ব প্রান্তের লোকেদের জন্য নীল স্কার্ফ পরা,  নাৎসিরা ইহুদিদের জন্য হলুদ তারা চিহ্ন এবং বসনিয়ার সর্পসহাতে মুসলিমদের সাদা আর্ম ব্যান্ড পরতে বাধ্য করা হয়েছিল। এই পর্যায়ে জাতিগত সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য গুলোকেও আক্রমণ করা হয়।

পরোক্ষভাবে ভারতে আজ একই কাজ করা হচ্ছে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাকে পাকিস্তান বলা বা হিন্দুদের দোকানে-বাড়িতে  গেরুয়া পতাকা লাগিয়ে এলাকার সংখ্যালঘু মুসলিমদের সম্পত্তি  চিহ্নিতকরণের কাজ চলছে। শব্দ দূষণের অভিযোগে আজানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার চেষ্টা বা হালাল মাংসের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির যে চেষ্টা চলছে তা আসলে এই ধর্মীয় সংস্কৃতির উপর আক্রমণ ছাড়া কিছু নয়।

তৃতীয় ধাপ, বঞ্চনা (discrimation) :

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়  এই ধাপের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে নাগরিকত্ব ইস্যু উঠে আসা। ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয় যখন নাগরিকত্ব দেওয়ার শর্ত হয়ে ওঠে তখন  নিশ্চিত করে বলা যায় তৃতীয় ধাপ ইতিমধ্যে চলে এসেছে। নাৎসি জার্মানিতে এভাবেই ১৯৩৫ সালের নুরেম্বার্গ আইনে ইহুদিদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছিল বা মায়ানমারে ১৯৮২র নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়নি বহু শতাব্দী ধরে গণহত্যা, নিপীড়ন অত্যাচারের পর আমেরিকায় ১৯২৪ এ নেটিভ আমেরিকানদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। কারো মৌলিক অধিকার যা সংবিধান দ্বারা নিশ্চিত করা হয় তা কেড়ে নেবার উপায় হলো তার নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া। এই নাগরিকত্ব কেড়ে নেবার চক্রান্তের অংশই হলো nrc।

ভারতে কিছুদিন আগে পাশ হওয়া সিটিজেনসিপ অ্যামান্ডমেন্ট অ্যাক্ট এই ধর্মীয় বিভাজন মেনেই তৈরি। এখানে সুপরিকল্পিত ভাবে ইসলাম ধর্মাবলম্বী উদ্বাস্তুদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। এই প্রসঙ্গে জাতিপুঞ্জের জেনোসাইড প্রতিরোধে বিশেষ পরামর্শদাতা আদামা দিয়েং বলেছেন  CAA “is contrary to India’s obligations under international human rights law, in particular on non-discrimination”

যদিও ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে এই বঞ্চনা দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে মুসলিমদের ঘর ভাড়া দেওয়া থেকে, সম্পত্তি কেনা প্রায় সর্বক্ষেত্রে কম বেশি এক অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি ছিলই এইসব দীর্ঘ বঞ্চনার তালিকায় caa সর্বপ্রথম সাংবিধানিক স্বীকৃতি। স্বভাবতই এতে উৎসাহিত হয়ে বঞ্চনার মাত্রা আরও বেড়েছে এবং লাগাম ছাড়া হয়ে উঠেছে। উত্তর প্রদেশের দেওরিয়ার বিধায়ক সুরেশ তিওয়ারি প্রকাশ্যে মুসলিমদের থেকে সবজি কেনা বন্ধ করতে ডাক দিয়েছিল। চেন্নাইয়ের জৈন বেকারি এন্ড কনফেকশনারির বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল “শুধুমাত্র জৈন কারিগর দ্বারা তৈরি, দোকানে কোনো মুসলিম কর্মচারী নেই”। মুসলিম কর্মচারীদের কাজে না নেওয়া এখন ভারতের কোনো কোম্পানির বিজ্ঞাপনের বিষয়, এমন কিছু যা কোম্পানির ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়াতে সাহায্য করছে। মধ্যপ্রদেশের এক আইনজীবী দীপক বুন্দুলে পুলিশি হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন অভিযোগ জানানোর পর পুলিশ ক্ষমাপ্রার্থনা করে কিন্তু ক্ষমাপ্রার্থনার বয়ান ছিল ” আমরা আপনাকে মুসলিম ভেবেছিলাম “।  এভাবেই প্রশাসনের সমস্ত মহলে মুসলিম হলেই তাকে হেনস্থা করার নিয়ম হয়ে গেছে। বর্ণবাদী দক্ষিন আফ্রিকাকে হার মানানো এই বঞ্চনা ভারতে এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

চতুর্থ ধাপ, অমানবিকীকরণ (dehumanization) :

এই পর্যায়ে প্রকাশ্যে মনুষ্যেতর প্রাণীর  মতো ব্যবহার করা শুরু হয়। যেমন নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের এই পর্যায়ে পোকামাকড়ের সাথে তুলনা করা হতো। এই সময়ই প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর তীব্রতর হয়, যেমন রেডিও রোয়ান্ডা  দীর্ঘদিন ধরে প্ররোচনামূলক উত্তেজক বক্তব্য প্রচার করে আসছিল তুৎসিদের  বিরুদ্ধে। রেডিও রোয়ান্ডা লাইভ রেডিও অনুষ্ঠানে তুৎসিদের আরশোলার সাথে তুলনা করে।

ভারতের মেইনস্ট্রিম সংবাদমাধ্যমের প্রচার এক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ক্রমাগত উত্তেজক প্রচারে কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন আক্রমনেরর ঘটনা ইতিমধ্যেই ঘটেছে। যা রুয়ান্ডার গণহত্যায় রেডিও রুয়ান্ডার ভূমিকার কথা মনে করায়। চরম ঘৃণা বিদ্বেষ তো ছড়িয়েই চলেছে এমনকি করোনার মত মহামারী ছড়ানোর জন্যও মুসলিমদের দায়ী করে আসছে। নিজামুদ্দিন মার্কাজে আটকে পরা লোকেদের এবং মার্কেজ কর্তাদের ভুল পরিকল্পনাকে করোনা জিহাদ বলে প্রচার করা হল।  কাট মুল্লা, কাটার বাচ্চা, দেশদ্রোহী এসব তকমার  তো ছিলই সাথে এখন “করোনা” বলে বিদ্রুপ করা যোগ হয়েছে।

পঞ্চম ধাপ,  সংগঠিতকরণ (organization) :

মূলত সংঘটিত বাহিনীর দ্বারাই হয়ে এসেছে।  বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী বা কোনো মিলিশিয়া এই হত্যালীলা চালিয়েছে নাৎসি আইনজ্যাটগ্রুপেন, এস এস,  বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনা, কাম্বোডিয়ার খেমাররুজ ইত্যাদি।  ভারতে আরএসএস  ইতিমধ্যেই তাদের প্রশিক্ষিত বাহিনী তৈরি করে ফেলেছে।  এছাড়াও বজরং দল, দুর্গা বাহিনী, রনবীর সেনা,  কর্ণী সেনার মত সংগঠিত বাহিনী আছে যারা নিয়মিত সামরিক প্রশিক্ষণ নেয় এবং আধুনিক অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত।   

ভারতীয় সেনাবাহিনী আবার তিন বছরের সামরিক প্রশিক্ষণের কথা ঘোষণা করেছে ইচ্ছুক জনসাধারণের জন্য, কিন্তু এর কোনো সুস্পষ্ট কারন বলা হয়নি। ভারতীয় সেনায় ইতিমধ্যেই পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বাহিনী আছে আবার নতুন করে এই প্রশিক্ষণ দেওয়ার কারণ স্পষ্ট নয় কিন্তু দেশের ঘটনা প্রবাহ যেদিকে ইঙ্গিত করছে তা অত্যন্ত ভয়ানক। প্রসঙ্গত  কাশ্মীরে ভারতীয় সেনার বিরুদ্ধে মানবাধিকার হরনের অভিযোগ উঠেছে একাধিকবার, কর্নেল পুরোহিতের মত অফিসার ছিল মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলার অন্যতম অভিযুক্ত।          

ষষ্ঠ ধাপ, মেরুকরণ (polarisation) :

জেনোসাইড সংগঠিত করার জন্য বিভাজন যথেষ্ট নয়, চূড়ান্ত বিদ্বেষমূলক প্রচার চালিয়ে মেরুকরণ করা প্রয়োজন। আর এই পথে সর্বপ্রথম বাধা সৃষ্টি করে উদারচিন্তার মানুষেরা। তাই প্রথম আক্রমণ নেমে আসে তাদেরই উপর। মাল্লেসাপ্পা মাদিভল্লপা কার্লবুর্গি, গোভিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র দাভোলকর, গৌরী লঙ্কেশের হত্যা এই মেরুকরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর জন্যই। কঠোর দমননীতি নেওয়া হয় ছাত্র আন্দোলন দমন করার জন্য। দিল্লির জামিয়াতে ছাত্র ছাত্রী দের উপর পুলিশের নির্বিচার লাঠি চার্জ লাইব্রেরি ঢুকে ছাত্র ছাত্রীদের নজিরবিহীন ভাবে মারা, জে এন ইউয়ের ছাত্র সংগঠনের সভাপতি ঐশী ঘোষের উপর শারীরিক আক্রমণ আসলে জেনোসাইডের মেরুকরণ পর্যায়ে রাজনৈতিক বিরোধিতাকে নির্মূল করে দেওয়ার যে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা দেখা যায় এ তারই নিদর্শন। এমনকি মুক্তমনা ব্লগার, কুনাল কামরার মত স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ানদেরও হুমকি থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কুৎসা রটনা কোনো কিছুই বাদ যায়নি। আইনের অপপ্রয়োগ করে প্রতিবাদীদের দমন করে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে যা এই পর্যায়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, সারা পৃথিবী জুড়ে যখন প্যানডেমিকের জন্য মানবিক কারনে বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হচ্ছে তখন ভারত সরকার গর্ভবতী মহিলাকেও জেলে ভরতে দ্বিধাবোধ করছেনা, শাহীনবাগের আন্দোলনকারী সাফুরা জারগরকে গর্ভবতী অবস্থায় শুধু গ্রেফতার করেই ক্ষান্ত হয়নি সোশ্যাল মিডিয়াতে তার গর্ভবতী হওয়া নিয়ে চলছে কুৎসিত রসিকতা, যা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে তার পরিবার বিয়ের ছবি প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। UAPA ধারায় ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন সাফুরা জারগর, মিরন হায়দার, উমর খালিদ, ইসরাত জাহান, মাসাত জেহরা, গোহর গিলানি, পীরজাদা আসিক, গুলফিসা, আসিফ ইকবাল থানে, সার্জিল ইমাম,  খালিদ সাইফি, সিফা উ রহমান সমেত প্রায় সমস্ত শাহীনবাগের আন্দোলনকারী নেতৃত্ব। দিল্লির সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান জাফারুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধেও fir করা হয়েছে। প্রফেসর আনন্দ তেলতুম্বেকে গ্রেফতার করা, ডাঃ মাধবী মিত্তলকে তার ক্লিনিকে তালা লাগিয়ে হয়রানি করা সবই এক সুতোয় গাঁথা।

সপ্তম ধাপ, প্রস্তুতি (preparation) :

এই পর্যায়ে জেনোসাইড সংগঠিত করার জন্যে যুক্তি সাজানো শুরু হয়।  নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা শুরু হয় কেন এই আক্রমণ অত্যাবশ্যক। নাৎসি  জার্মানিতে যে প্রচার ছিল “ফাইনাল সলিউশন “।   এই প্রস্তুতি পর্ব  চলে দেশরক্ষা, আত্মরক্ষা, প্রতিরক্ষা, দেশপ্রেম, সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ  ইত্যাদির মোড়কে।  সংগঠিত বাহিনীর সামরিক প্রশিক্ষণের সাথে মানসিক ভাবে তাদের তৈরি করা হয় আক্রমণের জন্য। রামরাজ্য, অখণ্ড ভারত, হিন্দু রাষ্ট্র এই “হিডেন এজেন্ডা” আর লুকোনো নয়, এখন প্রকাশ্যে আলোচনার বিষয়।  গাজয়া ই হিন্দের গল্পে ছেয়ে গেছে হোয়াটস্যাপ, লাভ জিহাদ থেকে সাম্প্রতিক করোনা জিহাদের প্রোপাগাণ্ডা চালিয়ে মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করা হচ্ছে। বিশ্বাস করানোর চেষ্টা চলছে যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে না গেলে দেশের সমস্যা মিটবে না। তৎকালীন ত্রিপুরার রাজ্যপাল, প্রাক্তন বিজেপি নেতা তথাগত রায় ” civil war” এর কথা টুইট করেছিল।  মুসলমানদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে নামার এই ইঙ্গিত হলো নাৎসি  “final solution” এর ভারতীয় রূপ।                         

অষ্টম ধাপ, উৎপীড়ন (persecution) :

পর্যায়ে অবদমিত গোষ্ঠীর উপর সরাসরি নির্যাতন শুরু হয়। দাঙ্গা, অপহরণ, আইন বহির্ভূত হত্যা, সম্পত্তির বাজেয়াপ্তকরন, কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে আবদ্ধকরন শুরু হয়।

সমগ্র ভারতে সংগঠিত উৎপীড়ন শুরু না হলেও বিচ্ছিন্ন ভাবে উৎপীড়নের ঘটনা ঘটে চলেছে। দিল্লিতে এবং বাংলার ভদ্রেশ্বরে দাঙ্গা, উত্তর প্রদেশে প্রতিবাদীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তি, আসামে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী করা সবই ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। নির্বাচনী জনসভাতেও বিজেপি নেতা অনুরাগ ঠাকুর সহ বিভিন্ন নেতাকে স্লোগান দিতে শোনা যায় ” দেশ কি গদ্দারো কো, গোলি মারও শালো কো”।   

নবম ধাপ, উন্মূলন (extermination) :

এই পর্যায়ে গণহত্যা শুরু হয় যাকে আইনত জেনোসাইড বলা যায়। হত্যাকারীর কাছে এটা “উন্মূলন” কারণ তার কাছে মৃতেরা মানুষ হিসাবেই বিবেচিত হয়না। বেলজিয়ামের রাজা লিওপোল্ড, দক্ষিন আফ্রিকার সিসিল রোডস, কনকুইস্টেডর ফ্রান্সসিসকো পিজারোর ক্ষেত্রে নির্বিচার গণহত্যা কখনো জেনোসাইড হিসাবে বিবেচিত হয়নি এক্ষেত্রে জেনোসাইড ও গণহত্যার ফারাকের কথাই বলা হয়। ইতিহাসে এই ব্যাপক হত্যালীলার কথা কার্যত ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে  আইনত এসব হত্যাকাণ্ড জেনোসাইডের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না বলে।

জেনোসাইডের লক্ষ্য থাকে কোনো জনগোষ্ঠীকে একেবারে নির্মূল করে দেওয়ার। যেমনটা নাৎসি জার্মানি, রোয়ান্ডা, বসনিয়াতে হয়েছে। আধুনিক যুগে জেনোসাইডের অন্যতম বৈশিষ্ট্য গণধর্ষণ, গুজরাট দাঙ্গাতেও যা দেখা গিয়েছিল । মহিলা আন্দোলনকারীদের বারবার ধর্ষণের হুমকি দেওয়া আসলে জেনোসাইডের প্রস্তুতির কথাই বোঝায়।           

আর, বর্তমান ভারতের পরিস্থিতি বোঝাতে এখানে একজনের বক্তব্যই যথেষ্ট, তিনি ডঃ গ্রেগরি স্ট্যানটন, তার বক্তব্য অনুযায়ী ভারতের কাশ্মীর এবং আসামের মানুষ জেনোসাইডের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে।

দশম ধাপ, অস্বীকার (denial) :

সমস্ত জেনোসাইড শেষ হয় অস্বীকার করার মাধ্যমে আর তাতেই পোঁতা থাকে পরবর্তী জেনোসাইডের বীজ। মৃতদেহ গণকবর দিয়ে, বুলডোজার দিয়ে মৃতদেহ থেঁতলে দিয়ে, পুড়িয়ে দিয়ে, প্রমাণ লোপাটের সমস্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যায় অপরাধীরা। আসামের নেলী গণহত্যা, হাসিমপুরার গণহত্যা,১৯৮৪র শিখ গণহত্যা, গুজরাট গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে হলে আজ ভারতে জেনোসাইড হবার মত পরিস্থিতি তৈরি হত না। স্বাধীনতার পরে যে বেশ কয়েকটা গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে সে কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয় যা জেনোসাইডের মঞ্চ প্রস্তুত করেছে।        

বসনিয়ান- অস্ট্রেলিয়ান নৃতত্ত্ববিদ হারিজ হ্যালোভিক জেনোসাইডের আরেকটি ধাপ সংযোজিত করেন আগের দশটি ভাগের সাথে। তিনি এই একাদশতম পর্যায়ের নাম দিয়েছেন ” Triumphalism” যার বাংলা মানে এক্ষেত্রে অনেকটা বীরবন্দনার কাছাকাছি। জেনোসাইডের অপরাধীদের বীরের সম্মান প্রদর্শন করা পরবর্তী জেনোসাইডের পথ সুগম করে। আধুনিক যুগের ইতিহাসে এর উদাহরণ পাওয়া যায় আল-জাজিরার একটি সমীক্ষা থেকে, সেখানে দেখা যায় বসনিয়া জেনোসাইডের সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী র ্যাডোভান কার্ডাজিককে এখনো  সর্পসকা এবং সার্বিয়ার প্রায় ৭৪% মানুষ দেশনায়ক মনে করে এবং সম্মান করে।

এটা এক মারাত্মক প্রবনতা, অপরাধী কে বীরের মর্যাদা দেওয়া মানে তার অপরাধকে শুধু সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়াই নয় সেটাকেই আদর্শ হিসাবে মান্য করা। যেমন আর এস এস স্বাধীন ভারতের প্রথম সন্ত্রাসবাদী নাত্থুরাম গোডসেকে আদর্শ মানে। এছাড়া গুজরাট দাঙ্গায় জড়িত বাবু বজরঙ্গি, মায়া কোডনানিকে বীরের সম্মান দিয়ে এসেছে। একই ধারা বজায় রেখেছে শম্ভুলাল রেগারের মত নৃশংস খুনির মূর্তি বানিয়ে, ট্যাবলো বের করে।

এবার দেখা যাক ইতিহাসে সবচেয়ে সংগঠিত ভাবে জেনোসাইড হয়েছিল সেই নাৎসি জার্মানির সাথে বর্তমান ভারতের শাসকদলের কর্মপদ্ধতির কিছু মিল পাওয়া যায় কিনা। জার্মানিতে যেভাবে হিটলারকে কেন্দ্র করে একটা কাল্ট তৈরি করা হয়েছিল তেমন ভাবেই মোদি কেন্দ্রীক একটা কাল্ট তৈরি হচ্ছে। একই ভাবে উগ্রজাতীয়তাবাদ প্রচার, কমিউনিস্টদের দেশের শত্রু ঘোষণা করা, দেশের সংখ্যালঘুর প্রতি বিদ্বেষ তৈরি করা, ভীষণ অর্গানাইজড প্রোপাগাণ্ডা মেসিনারী তৈরি করা, নিজেদের সশস্ত্র বাহিনী তৈরি করা, বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের কে খুন করে দেওয়া কিছুই নতুন নয় এসব একেবারে কপিবুক ফ্যাসিজম।

জেনোসাইডের ধাপগুলো আলোচনা করতে গিয়ে দেখা গেছে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যা একই সাথে একাধিক পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য বহন করে। এবং ভারতের বিভিন্ন রাজ্য জেনোসাইডের বিভিন্ন ধাপে আছে। যেখানে আর এস এস – বিজেপির ক্ষমতা একচ্ছত্র বা রাষ্ট্রীয় পীড়ন প্রচন্ড সেখানে ইতিমধ্যেই জেনোসাইডের দিকে অনেকটা এগিয়ে গেছে আবার যেখানে আরএসএসকে রাজনৈতিক বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে সেখানে তারা খুব বেশি এগোতে পারেনি যেমন কেরালায়। কাশ্মীরের প্রসঙ্গ সেভাবে আলোচনা করা যায়নি আইনি সমস্যা এড়িয়ে চলতে এবং সেখানকার যথেষ্ট খবর বাইরে আসছেনা বলে। এখানে বর্ণনা দেওয়া প্রতিটি ঘটনা মিডিয়াতে এসেছে, সবারই জানা কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন মনে হলেও এই ঘটনাগুলো যে বিচ্ছিন্ন নয় বরং একটা বৃহৎ বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ধাপ সেটা অনেকের চোখ এড়িয়ে গেছে। অনেকেই ভাবেন আধুনিক যুগে এরকম জেনোসাইড হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তারা ভুলে যান অতীতে জেনোসাইড হয়েছে এই টিভি ক্যামেরা-জাতিসংঘেরর নাকের ডগাতেই। United States Commission on International Religious Freedom ইতিমধ্যেই ভারতকে বিশেষ আশঙ্কার দেশের তালিকার যোগ করতে প্রস্তাব রেখেছে। Genocide watch ভারতের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছে। জাতিসংঘ বেশ কয়েকবার ভারতের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।  এখনো সমবেত হয়ে চেষ্টা করলে আমরা এই বিপর্যয় এড়াতে পারি। কিন্ত “ভারতে গণহত্যা হবে না” এরকম মিথ্যা নিরাপত্তার আশ্বাসের ঘেরাটোপে নিজেকে রেখে দিলে বিপদ যে শুধু বাড়বেই তা নয়, ত্বরান্বিত  হবে। ভারতে যে জেনোসাইড যে হতে চলেছে এই তত্ত্ব আমার নয়, জেনোসাইড বিশেষজ্ঞদের। কাজেই denial ঝেড়ে ফেলে সংগঠিত প্রতিরোধের পথে নামতে হবে।

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *