হুমাই সেখের কাঁঠাল আর তার মেয়ের গল্প

নাফিস আনোয়ার

পেল্লাই সাইজের একটা পাকা কাঁঠাল নিয়ে ভিড় বাসটায় উঠলেন হুমাই সেখ।

বর্ষাকাল। অথচ দিনচারেক বৃষ্টির দেখা নেই। মেঘ আছে আকাশে।‌ সেই মেঘ ছেয়ে আকাশের রঙটা ঘোলাটে। তবু তার ভিতর চুঁইয়ে বেরিয়ে আসা ছুপা রুস্তম রোদ জ্বালা ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে বেশ। এমন মেঘ আকাশ থেকে পানি ঝরায় না, গা থেকে পানি বার করে নাস্তানাবুদ করে দেওয়াটাই তার লক্ষ্য। আজকাল আবহাওয়া দপ্তর অস্বস্তি সূচক না কি একটা নতুন  কথা চালু করেছে না! ওই! অস্বস্তি একদম চরমে‌।

তবুও বর্ষাকাল। আর বর্ষাকাল মানে আমাদের রুটের বাসে যন্ত্রণার সীমা নেই। আমাদের বর্ধমান-কাটোয়া রুটের বাসে এই সময় মাছি পর্যন্ত গলে না। গঙ্গায় জল আনতে যাওয়া, বকরিদে বাইরে থেকে বাড়ি ফেরা, চাষের কাজে লেবারদের আনাগোনা এসব তো লেগেই থাকে, তারপর এবার গোদের ওপর বিষফোঁড়া বাসের ছাদে ওঠার সব ব্যবস্থা ভেঙে দিয়েছে প্রশাসন। তাতে প্রশাসনের লাভ হয়েছে দু’ভাবে। ছাদে উঠে জীবনহানির দায় আর থাকছে না তাদের। তারপরেও ছাদে কেউ যদি ওঠে তার থেকে বাসওয়ালাদের  ফাইন করে আছে উপরি লাভের আশা! যাক সে কথা। এতে আমাদের মত ডেলি প্যাসেঞ্জারদের যে একফোঁটাও লাভ হয়নি সেটা বলাই বাহুল্য।

ডেলি প্যাসেঞ্জার, সংক্ষেপে ডেলি, মূর্তিমান বিভীষিকা অনেকের কাছে, মারমুখী লোকজনের আক্রমণের প্রথমলক্ষ্যও তারা আর আমাদের নিজেদের কাছে তা সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন! আমরা জায়গা নিই, অন্যের জায়গা রাখি, নিতান্ত সুযোগ না পেলে সিট ভাগাভাগি করে নিই বাকি সবার সঙ্গে। অর্থাৎ সিট নামক সম্পদের যৌথ মালিকানা আমাদের ‘ডেলি’ সমাজে।

সেদিন ভিড় চরমে। একটা দুরপাল্লার ট্রেন ঢুকেছে বর্ধমানে। এমন দিনে কন্ডাকটারদের পৌষমাস আমাদের সর্বনাশ। একদম ব্যাকসিটে কোনমতে জায়গা নিতে না নিতেই বাসটা ভরে উঠল। আমি বসেছি মাঝখানটায়। এসি ছাড়া এটিএম-এর কাঁচের বদ্ধ  ওই ঘরটায় প্যাচপ্যাচে গরমের মধ্যে কখনও ঢুকেছেন! যদি ঢুকে থাকেন তবে আমারও অবস্থাটি বুঝবেন। শুধু এটিএম থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন আপনি, এখান থেকে বেরোনোর রাস্তা বন্ধ।‌ তবু রুমাল বার করে বারকয়েক ঘাম মুছে নিয়েছি। তারপর অভ্যেস মতো এর মধ্যেও ঘামের বিচিত্র সব গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে চোখ বন্ধ করে ঘুমের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছি। অভ্যেসে কিনা হয়! এমন সময় বর্ধমান ছাড়ার মিনিট পনেরো পরে ক্ষেতিয়া থেকে উঠলেন হুমাই সেখ, অবশ্য তখনও তার নাম জানতাম না আমি। হাল্কা তন্দ্রা মত এসেছিল, পাকা কাঁঠালের গন্ধে সেসব চটকে গেল।         

কাঁঠাল! এ এক বড় বিচিত্র জিনিস! গন্ধের মতো এর চরিত্রটিও খুব উগ্র। যে ভালোবাসে সে সব সমর্পণে ভালোবাসে। যে ঘৃণা করে সে ততোধিক ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান করে তাকে। তাই বুঝি এতো জিনিস থাকতে গানের কলি যিনি লিখেছিলেন তিনি প্রেমের সাথে তুলনা করতে গিয়ে আর কিছু পাননি পেয়েছিলেন শুধু কাঁঠালের আঠা! আর চিরকালীন প্রতিক্ষায় আপনি গাছে কাঠালটিই দেখে গোঁফে তেল দেন, অন্য কোন ফলে গোঁফে তেল দেওয়ার নো চান্স!

শুনেছি পাকা কাঁঠাল নিয়ে কাউকে সচরাচর বাসে উঠতে দেওয়া হয় না। হ্যাঁ শুনেইছি। হয়ত ভূ-ভারতে সেটাই হয়। তবে বর্ধমান কাটোয়া বাস রুট ভূ-ভারতের মধ্যে পড়ে না। এ রুটে হাঁসের প্যাঁকপ্যাঁক মুরগির কোঁককোঁক মাঝেমধ্যেই শোনার অভ্যেস আছে সকলের মায় দুপুরের দিকে ফাঁকা বাসে ছাগলও উঠতে দেখেছি বারকয়েক। না গরু উঠতে দেখিনি! তবে যা দিনকাল পড়েছে তাও দেখে ফেলব অদূর ভবিষ্যতে! তবু ভিড় বাসে হুমাই সেখ একটা আলোড়ন ফেললেন। তাছাড়া অফিস টাইমের বাস, যাকে ডেলিদের বাসই বলা সমীচীন। আর তাঁরা মানে আমরা ডেলিরা সমাজের সেই শ্রেণীর লোক যারা বাড়িতে যেমনই থাকি না কেন বাইরে বেরোবার থাকলে উঁচু বলে নাকটাই বার করি সবার আগে। এঁরা  তো কাঁঠালের গন্ধে নাক সিটকাবেনই। আর কাঁঠাল বোঝাই থলেটা তিনি বসিয়ে দিলেন ঠিক আমার সামনে, পিছনের রডটায় হেলান দিয়ে।   

ও দাদু কাঁঠাল নিয়ে কেউ ভিড় বাসে ওঠে!

আরে কন্ডাকটার কোথায় গেল, এসব অ্যালাউ করে কী করে!

ওরা তো পয়সা পেলে হাতিও ঢুকিয়ে দেবে!   

নামিয়ে দিন… নামিয়ে দিন!

এমনসব মন্তব্যের মাঝে আমিও একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকাই লোকটার দিকে। পরনে আধময়লা আসমানি রঙের পাঞ্জাবি, তাতে হলদেটে ছোপ লেগে এদিকে ওদিকে, নিচে চেককাটা লুঙ্গি, তাতেও নীলের প্রকোপটাই বেশি। লম্বা সাদা দাড়ির ফাঁক দিয়ে দু চারটে কালো দাড়ি লুকোচুরি খেলছে যেন,  তোবড়ানো গাল, রোদে পোড়া তামাটে মুখে বলিরেখাগুলো স্পষ্ট জানান দেয় জীবনের ঝড়ঝাপটার কাহিনী, বয়সের আন্দাজ করা কঠিন তবে তা তিন কুড়ি পেরিয়েছে অবশ্যই। মাথার সাদা চুল দুপাশে সরে গিয়ে অর্ধচন্দ্রাকার টাকটিকে জায়গা করে দিয়েছে অনেকটাই। হুমাই সেখকে এতোটা খুঁটিয়ে দেখেছি পরে, দেখতে বাধ্যই হয়েছি বলা চলে। কিন্তু প্রথমবার তাকিয়ে ওই তোবড়ানো বুড়ো মুখটায় যেটা দেখেছিলাম সেটা হল ফোকলা দাঁতের অমলিন হাসি। সব বিরক্তি, সব কটু বাক্যের সঙ্গে যুঝে যেতে তার সম্বল এই হাসিটাই। ওই হাসি ভরা মুখটা দেখে আমার রাগটাও হঠাৎ থমকে গেল যেন।   

কুনো অসুবিধা করব না বাবারা। আগের বাসটেই উঠতেই দেলো না গো। বলে কাঁঠাল রেখে উটো। যার জন্যে জেছি তাকেই থুয়ে দিয়ে চলে যাব, ইকি কথা! একমুখ হেসে সবাইকে অভয় দেওয়ার চেষ্টা করেন হুমাই সেখ।     

কদ্দুর যাবে গো চাচা? আমি জিজ্ঞেস করি।

কৈচড় নামবো গো বাপ। 

দুপুরের গাড়িতে যেতে পারলে না। অফিস টাইমের বাসে কেউ এতবড় কাঁঠাল নিয়ে চড়ে!

চাষের সময় বাপ। দুপুরের মধ্যে ফিরতি হবে যে। ঘরে তো একা মানুষ আমি আর তোমাদের চাচি। এসময়ে জমিতে কামাই দিলে আল্লা গোনা দেবে গো! হুমাই বুড়ো সেই হেসে হেসে কথা বলে চলে। চালাক মানুষ। কত সহজে চাচা-চাচির সম্পর্ক পাতিয়ে নিল আমার সাথে।

বাস এখন স্পিড নিয়েছে। লোহার রডে ঠেকো দেওয়া কাঁঠালের থলে গড়িয়ে পড়ছে পাশের জনের গায়ে। রেগে যান ভদ্রলোক। পা দিয়ে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করেন থলেটাকে। বুড়ো তখন নিচু হয়ে রডের পাশে গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করেন থলেটা। এবার আপত্তি জানান আমার পাশে বসে থাকা ভদ্রমহিলা। তাঁকে চিনি, আমার মতই স্কুলে পড়ান।

একি একি! কাঁঠালেই আঠা লেগে যাবে তো! চিৎকার করে ওঠেন তিনি। বোঝাই যায় ইনি কাঁঠালের আঠার রসে বঞ্চিত।

আরে কন্ডাক্টর নামিয়ে দিচ্ছে না কেন এসব আপদ। ভদ্রমহিলার ডাকে সাড়া পড়ে যায়।  

না না আর পড়বে না গো মা জননী, এই আমি ধরে আছি। অল্প ঝুঁকে কাঁঠালের থলেটা ততক্ষণে হাতে তুলে নিয়েছে বুড়ো।

কাঁঠাল ভরা থলেটা এখন প্রায় আমার নাকের সামনে। সেই বিকট কাঁঠাল সুলভ গন্ধ আমার নাকেই ঢুকছে সবার প্রথমে। কিন্তু আমার রাগ হয় না। এ যে অনেক কিছু মনে পড়ার গন্ধ। অনেক কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার গন্ধ। উত্তরবঙ্গের পাথুরে খরস্রোতা হলং, তার পাশে টিনের চালের দোতলা বাড়ি আর মস্ত বড় একটা কাঁঠাল গাছ। এমনই একটি ছবি মনের মধ্যে ভেসে উঠে মিলিয়ে যায়। ছবিটা আগের জন্মে দেখা বোধহয়! আম্মা কাঁঠাল পাড়তে লোক ডাকতো যখন বাড়িতে উৎসব লেগে যেত। দরকশাকশি চলত তুমুল। আর আমরা চাতকের মত বসে থাকতাম সেই সমঝোতার দিকে তাকিয়ে। তারপর সব সেরা কাঁঠালগুলো রেখে চলে বাকিগুলো ভ্যানে করে নিয়ে চলে এ যেত লোকটি। এবার ছাড়ানোর পালা। তেল মাখা নিপুন হাতে কাঠালগুলিকে পেড়ে ফেলে বেরিয়ে আসতে সোনালি রঙের একেকটা কোয়া। বছরের প্রথম কাঁঠালের গন্ধে জিব লকলক করত আমাদের। প্রতিবছরই এটা হতো এবং এর পরিণতি কোনদিকে যাবে সেটা জেনেও তা হতো। প্রথমে ভাত ডাল শাকসবজি সব কিছুদিনের জন্য কাঁঠাল হয়ে যেত। তারপর গায়ে মাখার সাবান, টুথপেস্ট, জামাকাপড়েও এক গন্ধ। এরপর পেট ব্যাথা আর কাঁঠালের বীজের তরকারি পেরিয়ে আস্তে আস্তে বিতৃষ্ণা আসত, কাঁঠালের নাম শুনলে রাগ ধরত। তারপর একদিন হঠাৎ সব বন্ধ। পরের বছর আবার একই জিনিস চক্রাকার ফিরে আসত আবার।

উত্তরবঙ্গ ছেড়েছি বহু আগে। ‌সেই ভিটেমাটি ধ্বংস হয়েছে তারও আগে। আম্মা এখন আমার কাছে থাকেন। কাঁঠাল পাড়ার সেসব দিন ভুলে গেছেন বেমালুম। আমাকে দেখলেও কোনদিন চিনতে পারেন কোনদিন পারেন না। বর্ধমান শহরে তেমন কাঁঠাল পাই না। অবশ্য খোঁজও করিনি সেভাবে। বাড়িতে কাঁঠাল ঢোকানো অসম্ভব। আমার গিন্নির কাঁঠালের গন্ধে বমি পায়।

এভাবে কদ্দুর যাবেন, মাজা ধরে যাবে যে! বুড়োকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবশেষে বলি আমি।    

মেয়ের বাড়ি জেছি গো বাপ এটুকুন কষ্ট ঠিক সয়ে নেব। ফের সেই ফোকলা হাসিটা হাসেন হুমাই সেখ।  

ততক্ষণে ভাতাড় এসে পড়েছে। কিছু লোক নামায় একটু খালি হয় বাস। নাসিগ্রাম মোড় থেকে ওঠে আমার বন্ধু আদিল। একসঙ্গে এম.এ. করেছি আমরা, পরে বি.এড-ও, কাটোয়ার স্কুলে পড়ায়। ডানদিকের জানলার ধারের সিটটা বলগোনায় খালি হবে, ওটা বলা আছে ওর জন্য। এই ‘বলে রাখা সিস্টেম’টা আমাদের সমাজতন্ত্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। অন্য যাত্রীদের সাথে এইটাই মূলত বিতর্কের মূলবিন্দু, পয়েন্ট অফ কনফ্লিক্ট, বিশেষত এই লাইনের বাসে যারা নতুন তাদের সাথে। এ রুটে সিটে বসা লোককে জিজ্ঞেস করে আগে থেকে সিটটি ধরে রাখতে হয় নইলে সে যখন উঠবে পিছন থেকে অন্য কেউ ‘দাদা সিটটা আমার’ বলে পাশ কাটিয়ে এসে বসে পড়বে। প্রতিবাদ করতে পারেন নিশ্চয়! কিন্তু জনগণের সমর্থন পাবেন না।

এই রে, এ যে আস্ত কাঁঠাল! উঠেই বলে আদিল। 

চাচা মেয়ের বাড়ি যাচ্ছে রে, কাঁঠাল না নিয়ে গেলে হয়! আমি হেসে বলি।

বাসটা ভাতাড়ে খানিকটা খালি হওয়ায় হুমাই বুড়ো থলেটা একটু নামিয়েছিল কি নামায়নি পাশের ম্যাডাম শাড়িটা সরিয়ে এমন মুখ বিকৃত করলেন যেন কাঁঠাল নয় গোবর লেগে যাবে! অবশ্য গোবর তো ভালো, এখন শুনছি আসল বিশল্যকরণী গোবরই। ম্যাডামের ওই মুখ দেখে বুড়ো আবার ঝুঁকে থলেটা তুলে নিতে বাধ্য হন। ভারি থলেটা তুলতে গিয়ে মুখটা একটু বেঁকে গেলেও হাসিটা মোছে না। বাইরে থেকে হাওয়া আসছে এবার। মনটাও আগের মত খিঁচড়ে নেই আর। একটু গল্প জমাই বুড়োর সাথে। 

তা চাচা এটা তোমার গাছের?

হ্যাঁ গো বাপ। সেবার বানের পর লাগিয়েছিলুন। কিন্তু ফল দিছে ভালই। মেয়ের বাড়ি কি আর খালি হাতে যাব বাপজান!

তা এই চাষের সময় মেয়ের বাড়ি যাবার কিসের তাড়া গো তোমার?

পেত্তেক বছর শ্রাবণ মাসের পঁচিশ তারিখে আমায় যেতে হয় গো বিটির বাড়ি। মেয়ের আজ জন্মদিন কিনা! জন্মদিন কথাটা এমন একটা লোকের মুখ থেকে বেরিয়ে আসাতে চমক লাগে! অনুষ্ঠানেরও আমরা-ওরা আছে। ঈদ আমাদের পুজো ওদের খ্রিস্টমাস সবার এমনই নিয়ম আর কি! সে নিয়ম ভাঙতে চাইলেও ভিতরে ভিতরে থেকে যায়। প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে দেওয়াল তুলে রাখাটাই প্রগতিশীলতার লক্ষণ। 

আর এই কাঁঠালটা হল গিয়ে তোমার জন্মদিনের কেক! এবার সিটে বসতে বসতে বলে আদিল।

গরীব মানুষ গো বাপজান। বাড়িতে যা হয় তাই নিয়ে যাই। আর মেয়ে আমার কাঁঠালের ভারী ভক্ত! 

আমিও কাঁঠালের ভক্ত গো চাচা, অবশ্য এখন আর তেমন খাওয়া হয় না! নিজের লোভের কথা বলেই ফেলি শেষমেশ।

চলো তাইলে মোর সেথে। এমন কাঁঠাল আমাদের গেরামে আর কারুর নাই। একেবারে খাজারুয়া। মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়, স্বাদও তেমনি। গেলবছর আড়াইশো কাঁঠাল এমনে বিক্রি করেছি গো, তারপর গেরামের ছেলেপুলেও মেলা খেইছে! বুড়োর ফোকলা দাঁত খুশিতে ঝিলিক মারে। কথা বলতে পারাটাই তার কাছে আনন্দ।

আমারও লোকটাকে খারাপ লাগছে না আর। সব কথায় এমন হাসি দেওয়া লোক খুব বেশি দেখিনি কিনা! ডেলি প্যাসেঞ্জারদের নির্দয় হতে হয়। বৃদ্ধ থেকে ছেলে মহিলা সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও চুপচাপ চোখ বুঁজে উপেক্ষা করাটাই নিয়ম। এতবছরে এ ট্রেনিং আমারও নেওয়া হয়ে গেছে কবেই। তবু বুড়োকে বসতে দিতে ইচ্ছে করে। আর বলগোনার পর বাস বেশ ফাঁকা হয়ে এসেছে তখন।

ও চাচা একটু বসবে নাকি আমার সিটে! আমিও কৈচড়ই নামবো।

আরে না না বাপ। আমি বেশ আছি। আরে আমার পাকা-চুল দাড়িতে জেওনি গো বাপ। একুনও গাছে চড়ে কাঁঠাল পাড়ি, তুমরা ভদ্দরলোকরা আমার সঙ্গে হেটি পারবেনি। জোরে হেসে ওঠে বুড়ো।

তুই আর চড়াস না বুড়োটাকে ভাই। বাসশুদ্দু লোক কেমন বিরক্ত হয়েছে দেখ! এই সব অশিক্ষিত লোকগুলোর জন্যই আমাদের এত বদনাম। কারও সুবিধা-অসুবিধা দেখবে না, আস্ত কাঁঠাল নিয়ে উঠে পড়ল বাসে, গন্ধে ভূত পালাবে… আমার সার্টের হাতা টেনে ফিসফিসিয়ে বলে আদিল। ‘আমাদের’ বলতে ও ঠিক কী বোঝাচ্ছে তাও বেশ বুঝতে পারি। আমরা-ওরা-তে ভাগ হয়ে আছে বিশ্ব! অবশ্য আদিলের কথাটা খুব একটা ভুল নয়। বুড়োমানুষ বলে সবাই কাঁঠালকাণ্ডের পরেও হুমাই বুড়োকে বিরক্তির সাথেও সহ্য করে নিয়েছে। সে মেনে নেওয়াতেও মিশে আছে আমরা-ওরা-ই। হুমাই সেখের পোশাক তার লম্বা দাড়ি সেই ‘ওরা’কে আরো সুষ্পষ্ট করেছে যেন।

এরপরই বোমা ফাটায় হুমাই সেখ। জানো বাপ এ কাঁঠালের দেশ হল গিয়ে সেই উত্তরবঙ্গের ধুপগুড়ি। নাম শুনেছ!

উত্তরবঙ্গ! আমার নস্টালজিয়া চরমে পৌঁছে যায়। বাস তখন মুসারি ছাড়িয়ে নিগনের পথে।

আরে চাচা বল কী! এবার তোমায় কাঁঠালের ভাগ একে দিতেই হবে, এরও বাড়ি যে ধুপগুড়ি! আমায় দেখিয়ে হেসে বলে আদিল। 

না ধুপগুড়ি না। মাদারিহাট!

আমি ধুপগুড়িতে রেকশো চালিয়েছি পনেরো বছর, ওখেনে ঘরও করিছিলুম। ফালাকাটা বীরপাড়া মাদারিহাট সব চিনি… বলে চলে হুমাই বুড়ো। 

এসব কথাবার্তার মধ্যেই কৈচড় ঢুকে পড়ে বাস। আমি আর ‘আমার দেশের’ কাঁঠালের থলে হাতে হুমাই সেখ নেমে পড়ি বাস থেকে। এখানে নামলেই আমার বড্ড তাড়া। অবশ্য ডেলিদের তাড়াটাই ধর্ম। ট্রেন ধরা, বাস ধরা সব মিনিট মেনে হয় না আমাদের, সেকেন্ড মেনে হয়, তাই ক্রমাগত আমরা ছুটছি না হয় হনহন করে হাঁটছি। তাই হুমাই সেখকে ভুলে যাবারই কথা ছিল বাস থেকে নেমে। ভোলা গেল না। এক রাস্তায় যাব তাই এদিকওদিক তাকাতে থাকা হুমাই সেখকে ডাক দিই আমার সাথে টোটোতে যাবার জন্য। কী যেন ভাবে বুড়ো তারপর সেই দাঁত বার করা হাসিটা আরেকবার চট করে হেসে দিয়ে সে চেপে বসে আমার সাথে। এখানে সবাই আমার পরিচিত, অনেকের আমি স্যারও। তাই টোটোওয়ালা দুজনকে নিয়েই ছেড়ে দেয় গাড়ি। মিনিট দশেকের রাস্তা। আকাশে তখন মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। সবে ধান রোয়া শুরু হয়েছে। কাদাজল মাখা ধানের ক্ষেত মেঘের ছায়ায় সবুজ কালো। তার মাঝে ধান রোপার কাজে ব্যস্ত মানুষগুলোকে সবুজ ঘাসের মাঝে রঙবেরঙের ফুল বলে মন হয়। ঠাণ্ডা হাওয়ায় প্রাণটা জুড়িয়ে যাচ্ছে এখন। বৃষ্টি নামবে অনেকদিন পর। চলতে চলতে বুড়োর নামটা জেনে নিলাম অবশেষে, হোঁচট খেলাম মেয়ের কথা জানতে গিয়ে।        

কয় ছেলেমেয়ে গো তোমার চাচা?

আমার ওই একটিই বিটি গো বাপ।

তাই নাকি। তাই এত আদরের। আমারও একটাই মেয়ে। কী নাম গো তোমার মেয়ের?

শ্যামা।     

সামা?

সামা নয়গো সামা নয়। শ্যামা। মা কালীর যে নাম সেই নাম। শ্যা-মা। হা হা করে ফোকলা দাঁতে আবার হেসে ওঠে বুড়ো। বেকুব হয়ে তার দিকে চেয়ে থাকি আমি।

মোসলমান বাপের হিঁদু মেয়ে কেমনে হল তাই ভাবছ! এ পৃথিবীর সবই তো আল্লার, তবে কে হিঁদু কে মোসলমান বোলো দিকিনি বাপ! বেশ জম্পেশ একটা কথা বলেছে এমন ভাব করে আমার দিকে তাকায় হুমাই সেখ। এমন হেঁয়ালিতে আমার মনের ধন্দ পরিষ্কার হয়নি ভেবে সে বলতে থাকে।

শ্যামার বাপ মা যখন পরপর অসুখে মোলো অর তখন বয়স তিন। ধূপগুড়িতে পাশাপাশি থেকিচি বহুকাল। ওর বাপের চায়ের দোকান ছেলো। অত্টুকুন মেয়েরে বাপমায়ের মৃত্যুর জন্যে দায়ী করল অর কুটুমেরা। চায়ের দোকানটাও তারা হাত করলে তারপর ডাইনি বলে ছোট্ট মেয়েটারে… একরাতে সব রেখে ওকে নিয়ে পাইলে এলুম তুমার চাচির সাথে সলা করে, ধুপগুড়ির ইয়াদ বলতে রয়ি গেল কাঁঠালের কটা বিচি আর বিটিটা… আবার হাসে হুমাই সেখ কিন্তু সেই হাসি মুখটার মধ্যে জ্বলজ্বল করা দুঃখভরা চোখটা নজরে আসে এবার।           

অবশ্য আমাদেরও স্বার্থ ছেলো। ততদিনে  তুমার চাচি প্যাটে বাচ্চা ধরতে নাকাম জানিয়ে দেছিল শিলিগুড়ির ডাক্তার। আল্লা যা করে ভালোর জন্যেই করে। ও বাপ আমারে এখেনে নামিয়ে দাও গো… আসিগো বাপজান। সাবধানে যেও।        আমায় কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নেমে গেল হুমাই সেখ। আমিও কেমন যেন খানিকটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। সম্বিৎ ফিরে তাকিয়ে দেখলাম গ্রামের মেঠো রাস্তায় মিলিয়ে যাচ্ছে হুমাই সেখ। আর তখনই তেড়ে বৃষ্টিটা নামল।

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *