শিক্ষার বেসরকারীকরণ এবং কিছু আবশ্যিক প্রশ্ন

রাণা আলম

পরিচিত এক মাস্টারমশাই তার সন্তানকে একটি নামী ব্র্যান্ডের বেসরকারী স্কুলে ভর্তি করেছেন। বছরে প্রাথমিক পর্যায়েই খরচ লাখ খানেক মতন। ধাপে ধাপে খরচ বাড়বে। একার চাকরিতে ফ্ল্যাট কিনে জেলা শহরে থাকা মাস্টার মশাই এখন ভাবতে বসেছেন তার সন্তান উঁচু ক্লাসে উঠলে আদৌ তিনি খরচ টানতে পারবেন কিনা।

কিছুদিন আগেই শহর কলকাতার নামী বেসরকারী স্কুলগুলির খরচের হিসেব দেওয়া হয়েছিল দৈনিক সংবাদপত্রে। উচ্চবিত্ত ছাড়া কারুর পক্ষে সে খরচ টানা সম্ভব নয়।

আমাদের রাজ্যে বর্তমানে একাধিক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। অ্যামিটি আর অ্যাডামাস ইউনিভার্সিটিতে সায়েন্সে গ্র্যাজুয়েশনের খরচ ওই লাখ দুয়েক মতন। রাজ্যের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সোসাল সায়েন্সে পিএইচডি করাতে গড়পড়তা কোর্স ফি নেয় ওই লাখ তিনেক টাকার কাছাকাছি।

এইবার যারা সরকারী স্কুল-কলেজে পড়েছেন, তারা নিজেদের পড়ার খরচটা একবার মনে করে দেখুন। কিছুদিন ধরে দেশব্যাপী একটি তর্ক হচ্ছে যে শিক্ষাক্ষেত্রে ভর্তুকি দেওয়া কতটা জরুরী। বিতর্ক শুরু হয়েছিল দিল্লীর জহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তুকি তোলা নিয়ে। বলা হচ্ছে যে যার সঙ্গতি আছে তিনি ভর্তুকি পাবেন না।

প্রথমত, এই ‘ভর্তুকি’ শব্দটার ব্যবহার নিয়ে আপত্তি রইলো। রাষ্ট্র শিক্ষাক্ষেত্রে আর্থিক ছাড় দেয় তার যথেষ্ট কারণ আছে। প্রথম এবং প্রধান কারণটা ( বিএড কোর্সে পড়ানো হয়) হল সুনাগরিক গড়ে তোলা। এবং এই সুনাগরিক বলতে নিছক শান্তশিষ্ট ল্যাজবিশিষ্ট সুবোধ বালক বোঝায় না, বোঝায় এমন কাউকে যে শিক্ষিত হয়ে দেশের উন্নতিতে অংশগ্রহণ করবে।

স্বাধীনতার পর যেসব এডুকেশন কমিশনগুলো গড়ে উঠেছে, তার রিপোর্টের সামারি নেটেই পাওয়া যায়, সময় থাকলে ঘেঁটে দেখতে পারেন, যাবতীয় শিক্ষা পরিকাঠামো গড়ে তোলার উদ্দেশ্যই হল যাতে সেখান থেকে বেরিয়ে শিক্ষার্থীরা দেশের উন্নতিতে অংশগ্রহণ করতে পারে।

সুতরাং, নিশ্চিত থাকুন, এটা কোনোরকম দয়ার দান নয়। নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের আবশ্যিক কর্তব্যের মধ্যেই এটি পড়ে। এইবার আপনার মনে হতে পারে যার সঙ্গতি আছে সে টাকা দিয়েই পড়ুক। কিন্তু এই ‘সঙ্গতি’ শব্দটা ব্যখ্যা করবেন কীভাবে?

প্রাইমারি স্কুলে যিনি পড়ান, তিনিও খাতাকলমে পভার্টি লাইনের বাইরে, সরকার বাহাদুর তাকে যে পরিমাণ সাম্মানিক দিয়ে থাকেন, তাতে সংসার চালিয়ে টাকা দিয়ে ছেলে মেয়েদের পড়াতে হলে পথে বসা ছাড়া গতি থাকতো না। বা ক’জন মধ্যবিত্ত টাকা দিয়ে ছেলে মেয়েদের পড়াতে পারবেন সেটা নিয়েও কিন্তু সংশয় থাকছে।

একটু ভেবে দেখবেন, শিক্ষাক্ষেত্রে যদি সত্যিই আর্থিক ছাড়টুকু তুলে নেওয়া হয়, তাহলে সব থেকে সমস্যায় পড়বেন এই নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্তেরা। আর যারা পভার্টি লাইনের নিচে আছেন তাদের কথা আলাদা করে বলছি না কারণ আজ অব্দি তাদের তুলে আনার মতন প্রাথমিক শিক্ষা পরিকাঠামো আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। যাঁরা উঠে আসেন তাঁরা মূলত নিজেদের যোগ্যতাতেই উঠে আসেন।

প্রশ্ন আসে, টাকা যোগাতেই নাকি এই তথাকথিত ‘ভর্তুকি’ তোলা হচ্ছে। এটা জাস্ট রকের ভাষায় ‘ঢপের কেত্তন’। সরকার মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণায় বাজেট যথেচ্ছ হারে কমিয়েছে গত পাঁচ বছরে। ২০১৫তেই কেন্দ্র সরকার রিসার্চ ইনিস্টিটিউটগুলিকে প্রয়োজনীয় ফান্ডিং এর অন্তত অর্ধেক নিজেদের যোগাড় করতে বলেছিলেন। পুরো শিক্ষাব্যবস্থা যদি বেসরকারীকরণ হয়ে যায়, মোট জনসংখ্যার খুব সামান্য অংশই লেখাপড়া করতে পারবে। বাকিদের বিশাল টাকার লোন নিতে হবে। এটা আসলে ‘আমেরিকান মডেল অফ এডুকেশন’ যেটা আমাদের দেশে চালু করতে চাইছেন কর্তাব্যক্তিরা।

২০১৭ সালেই নীতি আয়োগের মুখ্য কর্তা অমিতাভ কান্ত বলেছিলেন যে সরকারী খরচে স্কুল-কলেজ চালানো ঠিক নয়। তার চেয়ে এগুলো তৈরি করে বেসরকারী সংস্থার কাছে বেচে দিলেই ভালো। এবং এটা তারা শুধু ভেবেছেন তাই নয়, ২০১৯ সালে যে ন্যাশনাল পলিসি অফ এডুকেশনের খসড়া প্রস্তাব প্রকাশ করা হয়েছে তাতে শিক্ষার বেসরকারীকরণের রাস্তা খুলে দেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়েক এটাকেই ‘commoditisation of education’ বলেছেন। তার মতে, “the privatization of education which means handing the education sector to profit making entities. It is a desire to attract direct foreign investment. Likewise in India, policy makers in education sector often talk about ‘the striving for excellence, which is nothing other than making ‘education’ as a commodity.”

রিসার্চ মেথডলজির ক্লাসে ‘প্রায়োরিটি’ বলে একটা শব্দ শেখানো হয়। আমাদের বুঝতে হবে আমাদের ‘প্রায়োরিটি’ কী। তিন হাজার কোটির স্ট্যাচু নাকি উন্নত মানের বিজ্ঞান গবেষণাগার, মন্দির মসজিদ নিয়ে মারপিট নাকি শিক্ষার পরিকাঠামোগত আধুনিকীকরণ করে আমাদের তরুণদের কর্ম-সংস্থানের ব্যবস্থা করা।

অবশ্য, দেশের সব থেকে গরিব লোকগুলো পার্লামেন্টে যায়! একবার ফুল টার্ম মেম্বার থাকতে পারলেই সারাজীবন বিভিন্ন ধরণের ভর্তুকি পায়। দেশের উন্নতিতে তাদের ভূমিকাটা ঠিক সেটা আজ অব্দি বোঝা যায়নি, কিন্তু তাদের বেতন এবং আনুসাঙ্গিক ভাতা বৃদ্ধি নিয়ে রিপাবলিক প্রভাবিত পাবলিকদের কোনোরকম হেলদোল দেখা যায় না। শিক্ষাক্ষেত্রে আর্থিক ছাড় তুলে দিয়ে ধাপে ধাপে সরকার সম্ভবত সে পথেই এগোচ্ছে। এই দেওয়াল লিখন যদি এখনও না পড়তে পারি, তাহলে অদূর ভবিষ্যতেই শিক্ষা শুধুমাত্র উচ্চবিত্তের অধিকার হয়ে দাঁড়াবে।

অবশ্য, যত পড়বেন তত প্রশ্ন জাগবে, আর কে না জানে, হীরক রাজার দেশে প্রশ্ন করা নিষেধ।হয়ত অন্ধ হওয়াটাই আমাদের ভবিতব্য!

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *