মুসলিম বিয়ের গান নিয়ে দু-চার কথা

আফরিন কাজী

জাতির শিকড় সন্ধানের জন্য লোকসংস্কৃতির চর্চা অত্যন্ত জরুরি। বাংলার যতটা জায়গা জুড়ে ভৌগোলিক বিস্তার সেই সব জায়গায় লোকসংস্কৃতির ভিত খুবই শক্তিশালী। লোকসংস্কৃতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের আত্মপরিচয়। লোকগানের আকর্ষণ শক্তিও খুবই প্রবল। জীবনের কথা বড়ো সহজ করে বলে লোকগান। লোকায়াত সংস্কৃতির সচেতনতা আমাদের একে অপরের মধ্যে জারিত করে দেওয়াটা জরুরি। লোকসংগীতের বহু ধারার মধ্যে একটি ধারা হলো মুসলিম বিয়ের গান। মুসলিম বিয়ের গান বাংলা লোকসঙ্গীতের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে ভীষণ ভাবে । যদিও এখন অনেকটাই ভাঁটা পড়েছে মুসলিম বিয়ের গানে। এখন বরং আধুনিক গানের জনপ্রিয়তাই বেশি। আরো একটি সমস্যা প্রায় চিরকালীন । শরীয়তপন্থীরা মনে করেন ইসলামে গান নাচ হারাম, কিন্তু সুর তো পাখি, সুর তো বাতাসের মতো ভেসে বেড়ায় তাকে কোনো ভাবেই কোনো ধর্মীয়, বা ভৌগোলিক কাঁটা তার দিয়ে বেঁধে ফেলা যায় না। ‘হারামনি’ গ্রন্থে মনসুর উদ্দিন সংগৃহিত বিয়ের গানের উল্লেখ আছে। ড. ওয়াকিল আহমেদ- বাংলার লোক সংস্কৃতি (১৯৭৪), মোমেন চৌধুরী- বাংলাদেশের লৌকিক আচার অনুষ্ঠান জন্ম ও বিবাহ (১৯৮৮), হাসান হাফিজুর রহমান ও আলমগীর জলিল( সম্পাদিতও) -উত্তর বঙ্গের মেয়েলি গীত (১৩৬৯), শামসুজ্জামান খান ( সম্পাদিত) -বাংলাদেশের লোক ঐতিহ্য(১৯৮৫)– এই সব গ্রন্থগুলিতে বহু মেয়েলি আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে বিয়ের গানেরও উল্লেখ আছে। সুন্দরবনের মুসলিম মেয়েদের বিবাহ গীতির কথা ‘ব্রিটিশ রাজত্ত্বে সুন্দরবন’ গ্রন্থে লিখেছেন শশাঙ্ক মণ্ডল।

খুশিতে ঝলমল, আলো-রোশনাইয়ের বিয়ের উৎসবে বিবাহ উদযাপনকে ঘিরে বাংলা লোকসাহিত্যে মুসলিম অন্তঃপুরবাসিনী নারীদের  রচিত সব গীত গাথার পরিচয় পাওয়া যায়। যেখানে সেই গানের স্রষ্টাও নারী আর  কুশীলবও নারী। প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেই সব গান মুখে মুখে চলে আসছে। আঞ্চলিক ভাষায় রচিত  সেই সব গানের মধ্যে ধরা থাকে বর কনের নানান মেজাজ। সেই সব গানের মধ্যে যেমন থাকে আনন্দ বিতরণের উপকরণ, সঙ্গে থাকে সেই সময়ের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটের এক কল্পচিত্র। যেমন ছোট বেলায় আমাদের কুসুম গ্রামের বাড়িতে শোনা একটি গীতের কথা এখানে না বললেই নয়–

‘আমার ছেলে লালের বিহা দিব / সোনার কড়ি গুনে নিব।…’

— অবলীলায় পণের কথা বলা বোধহয় লোকায়তো গানেই সম্ভব। আর তা বলেন কোনো পুরবালা। পুরবালার দল সুর করে কী অসম্ভব শিল্প মনস্কতার পরিচয় দেন তাঁদের রচিত বিবাহ গীত গুলিতে তা ভাবলে অবাক হতে হয়। বিয়ের প্রতিটি আচার ,অনুষ্ঠানের সংগে সাযুজ্য রেখে গান রচনা মনকে বিস্মিত করে। বিয়ের গানে নানা বিধ সামাজিক, পারিবারিক, রাজনৈতিক সমস্যার কথাও বলা থাকে। গ্রামীণ নারী সমাজ পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় নানা  পক্ষপাতিত্ত্ব মূলক অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন পুরবালার দল তাঁদের রচিত গীতে, গানে। মুসলিম বিয়ের গানে যেমন রসসিক্ত নারী মনের পরিচয় মেলে তেমনি নারীর প্রতিবাদী মানসিকতারও সন্ধান পাওয়া যায়। নারী মনের নানা ভাবের প্রকাশ ঘটে  এই বিয়ের গানে। গান গুলির সুরের চলনও এমনই হয় যাতে সব নারীরা সহজে গলা মেলাতে পারেন। আরো একটা কথা আমার মনে হয়েছে শরীয়ত পন্থীদের তোলা চোখ রাঙানি, বিধি নিষেধ উপেক্ষা করেই যুগ যুগ ধরে মুসলিম বিয়ের গানে পরম আদরে সোহাগে আল্লাহ রসূলের সঙ্গে রাধা কৃষ্ণ, শিব পার্বতী ও উপজীব্য হয়ে ওঠে। যেখানে মা তার কন্যা সন্তানের মঙ্গল কামনায় গেয়ে ওঠেন–

‘আল্লাহ আমার সোনার ময়নার / সোনার কপাল সোনা দিয়া বাঁধাইও।                                         দরুদ শরীফ পইড়ে কন্যা শ্বশুর বাড়ি যাইও।।’

আবার একটু চটুল মজা আনতে হৈ হৈ করে পুরবালার দল গেয়ে ওঠেন–                                             ‘মামী তাই বটে, তাই বটে / বাবলা গাছে ঝিঙ্গের ফুল ফোটে।

মামীর কপালে উটা কি? / ভাগ্না টায়রা পইরেছি।।’

মুসলমান পুরবালার দল হাজার প্রতিকূলতার মধ্যে এভাবেই মুসলিম বিয়ের গানের  ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন। সুর সদা বহমান আধুনিক মনস্কতার পরিচয় এখন তার উপস্থাপনাতেও ঘটেছে। তবু আজও কোনো কোনো গ্রামের আনাচে কানাচে ভেসে বেড়ায় সেই সাবেকি বিয়ের গানের সুর যা  মনকে কাঁদায়, ভাসায় আর ভাবায় একান্তে।

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *