মাওলানা বরকতুল্লাহ ভারত ইতিহাসের কে হন?

আলতাফ পারভেজ

[এক.]                       

গত বছর দেখেছিলাম ভারতজুড়ে এক পুরানো রাজনৈতিক বিতর্ক আবার জোরেশোরে চালু হলো। এই বিতর্ক সাতচল্লিশ-পূর্ব রাজনীতির এক বিষয় নিয়ে। ফলে বাংলাদেশ থেকেও তাতে অংশ নেয়ার সুযোগ আছে।

এই বিতর্কে অংশ নিয়ে কলকাতার গবেষক ও শিক্ষক অনিবার্ণ মিত্র  আউটলুক ম্যাগাজিনে এক লেখায় প্রশ্ন তুলেছেন, ভারতের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী কাকে গণ্য করা হবে?

স্বভাবত দাবি উঠেছে, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। ১৯৪৩-এর অক্টোবরে সিঙ্গাপুরে যে অস্থায়ী ‘হুকুমত-এ-আজাদ-হিন্দ’ সরকার প্রতিষ্ঠা হয় তাতে রাষ্ট্রপ্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী উভয় দায়িত্বে ছিলেন নেতাজি। উপমহাদেশজুড়ে নানানভাবে তার স্বীকৃতিও রয়েছে। যদিও এই সরকারের অধীনে কোন সার্বভৌম অঞ্চল ছিল না।

ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি

অনেক ইতিহাসবিদ এখন নেতাজি’র ‘হুকুমত-এ-আজাদ-হিন্দ’-এর ঐতিহাসিক সংগ্রামী ভূমিকা স্বীকার করেও বলতে চাইছেন, এই সরকারের পূর্বেও ব্রিটিশ অধীনতা থেকে উপমহাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে ব্যাপকভিত্তিক আরেকটি প্রবাসী সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯১৫ সালের ১ ডিসেম্বর কাবুলে। যার নাম ছিল, ‘হুকুমত-এ-মুকতার-ই-হিন্দ’। প্রতিষ্ঠার পর অন্তত তিন-চার বছর, ১৯১৯ পর্যন্ত এই সরকার ভারতকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে সামরিক ও কূটনীতিক নানান তৎপরতা চালিয়েছিল। যে সরকারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ এবং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মাওলানা বরকতুল্লাহ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি।

রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ তাঁর জন্মদিনে আফগানিস্তানে “প্রভিসনাল গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া”র মন্ত্রীসভা গঠন করেন

কিন্তু নেতাজির ‘হুকুমত-এ-আজাদ-হিন্দ’ উপমহাদেশের ইতিহাসচর্চায় যেরূপ স্বীকৃতি পেল, রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ, মাওলানা বরকতুল্লাহ এবং ওবায়দুল্লাহ সিন্ধিদের ‘হুকুমত-এ-মুকতার-ই-হিন্দ’ সেরূপ স্বীকৃতি পেল না। এর মাঝে আবার রাজা মহেন্দ্রকে নিয়ে ইতিহাসচর্চার পরিসরে কিছু আলাপ-আলোচনা হলেও মাওলানা বরকতুল্লাহ (পুরো নাম আব্দুল হাফিজ মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ) ইতিহাসে প্রাপ্য সম্মান পেয়েছেন সামান্যই। কিন্তু কেন?

[দুই.]

কেবল ইতিহাসই নয়, নেতাজির ‘আজাদ হিন্দ সরকার’ ইতোমধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের সংগ্রামী রাজনৈতিক আবেগেরও অংশীদার। নানান রাজনৈতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও বহু ডাকটিকিটও প্রকাশিত হয়েছে ঐ সরকারের রাষ্ট্রনৈতিক স্বীকৃতি হিসেবে। কিন্তু যে সংগ্রামী অবস্থান থেকে সর্বত্র আজাদ হিন্দ সরকারকে স্বীকার করা হয়– একই ধরনের রাজনৈতিক অবস্থান থেকেই রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ ও মাওলানা বরকতুল্লাহদের সরকারকে স্বীকৃতি দিতে বাধা কোথায়? আউটলুক ম্যাগাজিনে অনিবার্ণ মিত্র ঠিক এই প্রশ্ন তুলে বলছেন।

১৯৪৩ এবং ১৯১৫-এর উভয় সরকারের লক্ষ্যই ছিল ভারতকে স্বাধীন করা। উভয় সরকারই ছিল অস্থায়ী চরিত্রের এবং তাদের সফলতায় সামান্য হেরফের থাকলেও ভারতীয়দের দ্বারাই উভয় সরকার পরিচালিত হচ্ছিলো। উভয় সরকারই তখনকার বৈশ্বিক পরিসরে ব্যাপক কূটনীতিক স্বীকৃতি ও সহায়তা পাচ্ছিলো। কিন্তু ইতিহাসবিদরা ১৯১৫-এর সরকার নিয়ে অনুসন্ধানে কার্পণ্য করেছেন বলেই স্পষ্ট সাক্ষ্য মেলে। এই উদাসীনতার কারণ কী হতে পারে?

[তিন.]

এটা খুব গতানুগতিক এক প্রশ্ন যে, মাওলানা বরকতুল্লাহকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে উপমহাদেশের মূলধারার ইতিহাসবিদদের উদাসীনতা তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে কি না? কিন্তু রাজনীতিবিদ হিসেবে মাওলানা বরকতুল্লাহ ছিলেন একইসঙ্গে সেক্যুলার ও ইসলামী আন্তর্জাতিকতাবাদী। ভারতের  মুসলমান ঐতিহ্যে অন্য সকল ধর্মের মানুষের সঙ্গে মিলে উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে পাল্টা রাজনৈতিক হেজিমনির চেষ্টায় লিপ্ত থাকাদের মধ্যে অতি সাহসী একজন অবশ্যই বরকতুল্লাহ।

ভারতকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে এই মাওলানা তখনকার বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর প্রধান প্রধান রাজনীতিবিদ অনেকের সঙ্গেই দেখা-সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি সাতটি ভাষায় ওস্তাদ ছিলেন– যা তাঁকে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ গড়ে তুলতে বিশেষ সাহায্য করছিল। ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি যাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেন তার মধ্যে লেনিন ও ট্রটস্কির নামও রয়েছে। রাশিয়ায় তখন তাঁর যে সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে তিনি নিজেকে ‘কমিউনিস্ট নয়, বরং পুঁজিতন্ত্র বিরোধী জিহাদি’ হিসেবে পরিচয় দেন। মার্কস ও ইসলাম বিষয়ে তাঁর সেসময়কার প্রথাবিরোধী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ [`Bolshevism and Islamic Nations’] মূলধারার কমিউনিস্টদের কাছে তাঁকে আজও বিব্রতকর করে রেখেছে। তবে ১৯১৩ সালে স্যানফ্রান্সিসকোতে ভারতীয় কমিউনিস্টদের ‘গদার পার্টি’রও প্রতিষ্ঠাকালীন অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। এইরূপ আন্তর্জাতিক যোগাযোগ গড়তে যেয়েই তিনি এক সময় আফগান বাদশা হাবিবুল্লাহ খানের বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন এবং তাঁর পরিবারের সহযোগিতার আশ্বাসেই রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ ও আরও কয়েকজন বিপ্লবীর যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘হুকুমত-এ-মুকতার-ই-হিন্দ’। মৌলভী বশির ছিলেন এই সরকারের যুদ্ধমন্ত্রী এবং সি. পিল্লাই ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। হাবিবুল্লাহ খানের ভাই নসরুল্লাহ খান প্রবাসী এই ভারতীয় সরকারের একজন বড় উৎসাহদাতা ছিলেন। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব কাবুলের এই প্রবাসী ভারতীয় সরকারকে সেদিন বিশেষভাবে উজ্জীবিত করেছিল। বলশেভিকদের সঙ্গে তারা সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল।

রাজা মহেন্দ্র প্রতাপও ছিলেন বরকতুল্লাহর মতোই একজন আন্তর্জাতিক স্বাধীনতা সংগ্রামী। ১৯১৪ সালে লন্ডনে মহেন্দ্র প্রতাপের সঙ্গে বরকতুল্লাহ’র সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। বরকতুল্লাহ তাত্ত্বিকভাবে মনে করতেন, হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় উপনিবেশ বিরোধী মুক্তি সংগ্রাম অর্থপূর্ণ কোন পরিবর্তন আনতে সক্ষম নয়। এইরূপ চিন্তা করতেন মহেন্দ্র প্রতাপও। এরূপ ভাবনা থেকেই তাঁদের মৈত্রী গড়ে উঠেছিল। তবে এক্ষেত্রে `গদার পার্টি’রও ইন্ধন ছিল। আর ছিল রুশ বলশেভিকদের সহযোগিতার আশ্বাস ছিল।

ভারতীয় ইতিহাসচর্চার আরেক অবহেলিত প্রসঙ্গ গদার পার্টির ভূমিকা। ১৯১৩-তে উত্তর আমেরিকায় সংগঠিত হয়েও মাত্র এক বছরের মধ্যে যেভাবে ভারতভূমিতে তারা উপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা করতে পেরেছিল তার পূর্বাপর এখন সামান্যই আলোচিত হয়। সেটাও কী এই কারণে যে, এই অকুতোভয় বিপ্লবীদের মূল সংগঠকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিখ ছিলেন বলে? উপমহাদেশের ইতিহাসচর্চা নিশ্চয়ই একদিন এসব সংকীর্ণ বিবেচনা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে বলেই আশা করা যায়।

আমরা আবার মূল আলোচনায় ফিরে যাই। ১৯১৫-এ কাবুলে প্রতিষ্ঠিত রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ ও মাওলানা বরকতুল্লাহ’র ‘হুকুমত-এ-মুকতার-ই-হিন্দ’ অস্থায়ী প্রবাসী ভারতীয় সরকার যে বেশি দিন কাজ করতে পারেনি সেটা সবারই এখন জানা। ব্রিটিশ চাপে এক পর্যায়ে আফগান আমির ১৯১৯-এ এই সরকারের কাজ বাধাগ্রস্ত করতে শুরু করেছিলেন। এসময় মহেন্দ্র প্রতাপ জাপান চলে যান। মাওলানা বরকতুল্লাহও অনেক বছর জাপানে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারত বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন। পরে তিনি চলে যান স্যানফ্রান্সিসকো। সেখানেই একটা হাসপাতালে ১৯২৭-এর ২০ সেপ্টেম্বর মারা যান তিনি। ক্যালিফোর্নিয়ায় তাঁর কবর রয়েছে।

মাওলানা বরকতুল্লাহর মৃত্যুর ১৯ বছর পর মহেন্দ্র প্রতাপ জাপান থেকে ভারতে ফিরে আসেন। ১৯৭৯ সালে মৃত্যুর পূর্বে তিনি লোকসভায়ও একবার নির্বাচিত হয়েছিলেন। ইতিহাসবিদদের কাছে মাওলানা বরকতুল্লাহ’র বিপ্লবী জীবনের অনেক তথ্যেরই উৎস ছিলেন মহেন্দ্র প্রতাপ। বস্তুত পক্ষে, তিনি ভারতে ফিরে এসেছিলেন বলেই বরকতুল্লাহ ইতিহাস থেকে একেবারে হারিয়ে যাননি।

শুনেছি, ভোপালের মুসলমান রাজনীতিবিদরা অনেকদিন থেকেই তাদের এই পূর্বপুরুষ মাওলানার কবর ভারতে আনার জন্য দাবি জানিয়ে আসছে। প্রতিবছর বরকতুল্লাহ’র মৃত্যু বার্ষিকীতে এই দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে উচ্চারিত হয় বলেই জানি। স্থানীয় সমাজে যিনি এখনও বিশেষভাবে পরিচিত ‘বরকতুল্লাহ ভোপালী’ নামে। মধ্যপ্রদেশের মুসলমানদের ঐ জনদাবির পাশাপাশি একাডেমিক জগতেও এখন ক্রমে এই প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে, উপমহাদেশের ইতিহাসে মাওলানা আবদুল হাফিজ মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ কীভাবে পরিচিত হবেন?

এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রাচ্যবিদরা কী ভাবছেন?

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *