ভারতীয় দক্ষিণপন্থা এবং মুসলিম নারী

মনিরুজ্জামান

সফুরা জার্গার জামিয়া মিলিয়া ইস্লামিয়ার স্কলার। ওঁকে গ্রেফতার করা হয় দিল্লি দাঙ্গার সূত্রে। তাঁকে গ্রেফতারের পরে দক্ষিণপন্থী পেজগুলো দ্বারা সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সফুরাকে নিয়ে যৌন কুৎসা। যখন গ্রেফতার করা হয়, সফুরা ছিলেন তিন মাসের গর্ভবতী। বলা হয়, “অবিবাহিত সফুরা শাহিনবাগে গিয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়েন।তার বাচ্চার বাবা কে সেটা জানা যায়নি।”  কোন মহিলা মা হতে চাইলে সেটা তার অধিকার। তিনি বিবাহিত হন অথবা না হন তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। একজন মহিলার মাতৃত্ব কোন কুৎসার বিষয় নয়। কিন্তু এখানে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল, সফুরা আদৌ অবিবাহিত নন। তিনি 2018 থেকে বিবাহিত।  

এমনিতে মহিলা সোশ্যাল এক্টিভিস্ট, জার্নালিস্ট, লেখিকা, ছাত্র নেত্রীরা নিয়মিত নোংরা ব্যক্তি আক্রমনের শিকার হন সামাজিক গনমাধ্যমে। তাঁদের বিভিন্নভাবে চরিত্রহননের চেষ্টা করা হয়। সেটা আরও কঠিন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে পড়ে যদি ওঁরা হন নারী এবং বিশেষত মুসলিম নারী।

 নাজ যোগা শেখাতেন। ওঁকে একবার দেখা যায় বাবা রামদেবের সাথে। আর যায় কোথায়! ফতোয়া ইস্যু হয়ে যায় ওঁর নামে। হ্যারাস করা হতে থাকে ওকে। মুসলিম মেয়ে হয়ে “হিন্দু” যোগা শেখাবে! ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রীকে শেষে ওঁর বাড়ির সামনে পুলিশ দিতে হয়। নাজের অভিযোগ ছিল মুসলিম এবং হিন্দু সবার প্রতি। একদিকে মুসলিম সমাজের থেকে যেমন তিনি হ্যারাস হচ্ছিলেন, তেমনি হিন্দু সমাজের থেকেও তার সমস্যা ছিল যে তার মুসলিম পরিচয়ের জন্য অনেকে তার কাছে যোগা শিখতে দ্বিধাবোধ করতেন। 

মহিলারা  যে সমাজেরই হন না কেন তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মহিলারা অসংখ্য বৈষম্যের সম্মুখীন হন। দক্ষিনপন্থী রাজনৈতিক ভাষ্য যখন সমাজে প্রবল হয়, তখন দেশের সংখ্যালঘু নারীর অবস্থা আরো খারাপ হয়। নারী হল সংখ্যালঘুর মধ্যেও সংখ্যালঘু। কিছু প্রাথমিক উদাহরণ দেখি–

পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ দুইই মুসলিমপ্রধান দেশ। এই দুই দেশেই তাৎক্ষনিক তিন তালাকের মত বর্বর প্রথা অনেকদিন আগেই আইনত নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এই সেদিন অবধি এই প্রথা চালু ছিল। অনেক অনেক মহিলাকে এই তাৎক্ষণিক তিন তালাকের শিকার হতে হয়েছে। যখন এই প্রথা বন্ধ করার কথা এসেছে বাধা এসেছে মুসলিম সমাজ থেকেই।

একইরকমভাবে, ভারতে হিন্দুদের উত্তরাধিকার, বিয়ে, বিবাহ বিবাহবিচ্ছেদের আইন হিন্দু কোড বিল এনে আধুনিকিকরণ করা হয়েছে। এখন হিন্দু নারীরাও পিতার সম্পদের অধিকার পান, তাদেরও বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার আছে। কিন্তু আমাদের পাশের দেশের বাংলাদেশের হিন্দু নারীদের এখনো এইসব অধিকার নেই। তাদের এইসব কিছু এখনো প্রাচীন ধর্মীয় রীতিনীতি হিসেবেই চলে। যখনই হিন্দু পারিবারিক আইনে পরিবর্তনের চেষ্টা হয়েছে, বাধা এসেছে হিন্দু সমাজ থেকেই। 

বর্তমান ভারতে মুসলিম মেয়েদের সমস্যা দ্বিমুখী। একদিকে আপামর সংখ্যাগুরুর মধ্যে বেড়ে চলা ইসলামোফোবিয়ার শিকার হচ্ছে মুসলিম নারীরা। আবার, ইসলামোফোবিয়া বেড়ে চলার জন্য মুসলিম সমাজ আরো অন্তর্মুখী হয়ে পড়ছে। ধর্মীয় বাধানিষেধ ক্রমশ বাড়ছে। ধর্মীয় বাধানিষেধ বাড়লে তার প্রথম শিকার মহিলারাই হন। এখন গ্রামের দিকে গেলে দেখা যাবে ছোট ছোট পাঁচ বছরের মেয়েদেরও হিজাব/বুরখায় মুড়ে দেয়া হচ্ছে।  

সুস্থভাবে বাঁচার জন্য মানুষের কিছু মৌলিক স্বাধীনতা প্রয়োজন যেমন :

নিজের মনের কথা বলার স্বাধীনতা।

ইচ্ছেমত চলাফেরা করার স্বাধীনতা।

ইচ্ছেমত পোশাক পরার স্বাধীনতা।

ইচ্ছেমত কাজ করার স্বাধীনতা।

জীবনসঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতা। ইত্যাদি।

— এইসব প্রতিটি স্বাধীনতাই নানান সামাজিক/দেশীয় আইন/নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সাধারণভাবে আমরা বলতে পারি উক্ত স্বাধীনতাগুলো যে দেশ/সমাজে যত বেশী, সেই দেশ/সমাজ তত উন্নত। সংখ্যালঘুদের এই সমস্ত স্বাধীনতাই কম থাকে। মেয়েদের সেটা আরও কম। মুসলিম মেয়েদের এমনিতেই শিক্ষার হার কম। দেশে যখন ইসলামোফোবিয়া বাড়ছে, মুসলিম বাবা মা আরো বেশি ভয় পাবেন তাদের মেয়েকে বাড়ি ছেড়ে দূরে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে। যারা বিভিন্ন নাইট ডিউটি করেন তাদের ওপর চাপ আসবে তারা যেন নাইট ডিউটি না করেন। অনেকে হয়ত চাকরিই ছেড়ে দেবে।

সমাজের সকলে সমান ধার্মিক নয়। অনেক মুসলিমের ধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞান থাকে না। মুসলিম পরিবারে সবাইকে টুকটাক আরবি পড়তে শেখানো হয়। কিন্তু এইসব চাপও মেয়েদের ওপর বেশি। ছেলেরা শিখতে না চাইলেও তেমন জোর করা হয় না কিন্তু মেয়েদের কুরআন অবধি পড়তে জানতেই হবে। বিয়ে দিতে হবে না!

এই প্রবণতা সময়ের সাথে সাথে কমার কথা ছিল। কিন্তু এখন উল্টে বাড়বে। ধর্ম নির্বিশেষে মেয়েদের একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে নয় বরং সামাজিক সম্পত্তি হিসেবে ভাবা হয়। এর প্রভাব পড়ে তার জীবনসঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতাতেও। দেখবেন একটা ছেলে যদি অন্য ধর্মের মেয়েকে বিয়ে করে সেটাকে একটা অর্জন হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু মেয়েটার দিক থেকে এমনভাবে দেখা হয় যেন তাদের সর্বনাশ হয়ে গেল। কারণ সেই মেয়েদের সম্পত্তি ভাবার প্রবণতা। মুসলিম সমাজ যত অন্তর্মূখী হবে মহিলাদের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতাও তত কমতে থাকবে।

আমরা যখন ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে সরব হচ্ছি তখন নিজের সমাজের পাঁক সম্বন্ধেও আমাদের সচেতন হতে হবে। আমরা যেন মুসলিম মহিলাদের সামাজিক সম্পদ না ভেবে তাদের ব্যক্তি হিসেবে ভাবতে পারি। যে স্বাধীনতা দেশের সংবিধান একজন মুসলিম মহিলাকে দেয়, সেই স্বাধীনতা যেন সামাজিকভাবে হরণ না করা হয়।

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *