চলচ্চিত্র ও ধারাবাহিকে বাংলার মুসলমান

আশরাফুল আমীন সম্রাট

কার্ল মার্কসের একটি বিখ্যাত কথা আছে, “তারা নিজেরা নিজেদের উপস্থাপিত করতে পারে না, তাই তাদের উপস্থাপিত করা আবশ্যক” (দ্য এইটিন্থ ব্রুমেয়ার অব লুই বোনাপার্ট)। এই যেমন, বাঙালী মুসলমান। নিজেদের কথা নিজেরা বলার ক্ষমতা এই জনগোষ্ঠীর প্রায় ছিল না। তাই এ যাবৎকাল তাদের “উপস্থাপিত” করার দায়ভার ছিল উচ্চবর্ণের বাবুশ্রেণির কিছু সাহিত্যিক, নাট্যকার, ঐতিহাসিকদের. তাঁদের হাতে বাংলার মুসলিম সমাজ যেভাবে চিত্রায়িত হয়েছে সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে।

পঞ্চাশ ষাট বছর আগে নাটক বা যাত্রাপালায় মুসলিম চরিত্র মানেই সে কেমন দেখতে হবে তার একটা ছক বাঁধা থাকত। ছবিটা ঠিক ছোটবেলায় আব্দুল মাঝির মতো — “ছুঁচলো তার দাড়ি, গোফ তার কামানো, মাথা তার ন্যাড়া।” সঙ্গে যোগ হয়েছে পরনে লুঙ্গি, কাঁধে গামছা, গলায় তক্তি । দুঃখজনক এটাই যে মুসলিম ও মুসলিমসমাজকে বিশেষভাবে চিনিয়ে দেওয়ার এহেন পরিচিতির রাজনীতি আজও বহমান।

সাহিত্য সংস্কৃতি, পত্র পত্রিকা থেকে শুরু করে গণমাধ্যমের মধ্য দিয়ে আমরা-ওরার এই নির্মাণ আজকের নয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “আনন্দমঠ” থেকে সেই ধারা চলে আসছে। স্বয়ং রবি ঠাকুরও এই অবচেতনা থেকে বেরোতে পারেন নি। তাঁর “লোকহিত” প্রবন্ধে তিনি মুসলমান সমাজের প্রতি বঞ্চনা ও অবজ্ঞার দলিল পেশ করেছেন। মুসলিম সমাজের প্রতি রবি ঠাকুরের দরদ নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠার কথায় নয়, কিন্তু এখানে দেখা যায় তিনি হিন্দু সমাজকে “আমরা” ও মুসলিম সমাজকে “ওরা” হিসাবে দেখেছেন। রবি ঠাকুরের মতো মানুষের কাছে অবশ্যই এটা ইচ্ছাকৃত নয়, অবচেতনভাবেই হয়ে গেছে। আসলে, সংখ্যাগুরু মানুষজন তাঁদের অবচেতনায় সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ‘ওরা’ হিসাবে ভাবতেই অভ্যস্থ। সাহিত্য, সংস্কৃতি, গনমাধ্যম, সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ধারাবাহিক অপরিকরণের ফলশ্রুতিতে “অপর” হয়ে থাকা ধর্মসামাজিক গোষ্ঠী এক ধারে মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রান্তিক হয়ে যায়। এভাবেই, একটু একটু করে।

বাঙালি মুসলমানের সমাজ-সাংস্কৃতিক জীবনে ঈদ, বকরিদ, শবেবরাতের মত উৎসব গুলোই ধরা যাক। এগুলো ধর্মীয় পরিসর থেকে বেরিয়ে কোনদিনই সার্বজনীন হয়ে উঠতে পারল না। মুসলমানদের পরব হয়েই রয়ে গিয়েছে। আলখাল্লা মুসলমানদের পোশাক, সেমাই, লাচ্ছা, হালুয়া মুসলমানদের খাবার। আতর মুসলমানের সুগন্ধি। এসব গুলোই যেন মূলধারার মতো স্বাভাবিক “আমাদের” নয়, অস্বাভাবিক, অন্যদের অন্যকিছু। প্রান্তিক বাঙালি মুসলমানদের সমাজজীবন সম্পর্কে প্রতিবেশি সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের এখনও অজ্ঞতা রয়ে গেছে। এই অজ্ঞতা থেকেই অবিশ্বাস তৈরি হয়। সেই অবিশ্বাস “আমরা” আর “ওরা”র মাঝখানে সুবিশাল প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

এখনও দৈনিক পত্রিকায় ঈদের দিনে দুই শিশুর কোলাকুলির ছবি সহ “খুশির ঈদ” শিরোনামে বুঝিয়ে দিতে হয় ঈদের দিনটি মুসলমানরা কিভাবে পালন করে। এই বোঝানোর কাজটা শেষ হয়না। প্রতি বছরই বজায় থাকে। এখনও অনেক প্রতিবেশি সম্প্রদায়ের মানুষকে বুঝিয়ে দিতে হয় ঈদুজ্জোহা আর ঈদুলফিতরের তফাৎ। ব্যক্তিগতভাবে বহুবার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি, “ভাই তোদের রমজান কবে ?”। প্রশ্নকর্তা জানেন না যে রমজানের কোনো “কবে” হয় না, রমজান একটি মাস। “এফতার কবে” জাতীয় প্রশ্নও শুনেছি। এগুলো সংখ্যালঘু মনকে কতটা রক্তাক্ত করে প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের মানুষ বুঝে উঠতে পারেন না। মনে মনে সংখ্যালঘুরা গভীরভাবে অভিমানী হয়ে পড়ে। এই অভিমান বড় ভাই এর প্রতি ছোট ভাই এর অভিমান।

সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য হল যে তার মতো (পড়ুন শহুরে এলিটদের মতো) যে বা যারা নয় তাদের বিশেষভাবে চিহ্নিতকরণেরর টুকরোটাকরা উপকরণ খুঁজে নেওয়া। তার পোষাক, খাদ্যাভাস, তার চলন, তার কথা বলা, সব কিছুর মধ্য দিয়ে সেই অন্বেষণ চলে। সেই উপকরণ গুলো এক জায়গায় জড়ো করে একটা প্রতিমূর্তি তৈরি করে সেটাকে সেই জনগোষ্ঠীর পরিচিতি হিসাবে চাপিয়ে দেওয়া, এটাই হয়ে থাকে। ঠিক একই কায়দায় আদিবাসী, দলিত ও গ্রামের মানুষরাও বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়। যেমন আদিবাসী হলেই যেন সে মাতাল হবে, ছোটবড় সবাইকে তুইতোকারি করবে। উপর্যুপরি, যারা মূলধারার সংখ্যাগুরু এলিট সংখ্যাগুরুর মতো নয় তারা ‘স্বাভাবিক’ নয়। তাই সাহিত্য, নাটক, যাত্রাপালা থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র, এমন কি হাল আমলের সান্ধ্যকালীন ধারাবাহিকেও  সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও দলিতদের বিশেষ ছকে বেঁধে দেওয়ার সেই দৃষ্টান্ত স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান।

এমনিতে বাংলা চলচ্চিত্র বা ধারাবাহিকে মুসলিম, দলিত হিন্দু বা আদিবাসীদের তেমন ঠাঁই হয় না। হলেও সেটা বীভৎস অচলাধ্যাসনির্ভর। পূর্বতন সাহিত্যিক নাট্যকাররা সংখ্যলঘু মুসলিম সমাজের যে ছবি এঁকে দিয়ে গেছেন সেই আঁকের উপর আঁক বুলিয়ে এখনও কাজ চলছে। ফলতঃ দিনের পর দিন মুসলিম ব্যক্তিবিশেষ ও সমাজের চিত্রটা আরও ভয়ংকর হচ্ছে।

কিছু বছর আগের বাংলা সিনেমায় একটা সাধারণ প্রবণতা লক্ষ্য করতাম। সেখানে একটা বা দুটি চরিত্র থাকত মুসলিম। হয় সে বনেদি হিন্দু বাড়ির চাকর, কিংবা পারিবারিক বন্ধু । তার থুতনি আলো করা সুন্নতি দাড়ি, মাথায় টুপি, সে পরহেজগার। মাঝেমধ্যেই তার নামাজরত মুনাজাতের ছবি, নেপথ্যে আজানের সুর ভেসে আসছে। তার প্রতি বাক্যে অযাচিত আরবি- উর্দু শব্দের ভিড়, এমন শব্দ যা বাঙালি মুসলিম দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারই করে না। সে ঐ পরিবারের জন্য “জান কুরবান” দেবে, কিন্তু মান দেবে না। এই চিত্রায়ন সংখ্যাগুরুর প্রতি সংখ্যালঘুর দাস মনোবৃত্তির প্রতিফলন। সম্পর্কটা এখানে বন্ধুত্বের নয়, প্রভু এবং দাসের। প্রভু চায় না ধর্মের নিগড়ে আষ্টেপিষ্টে বাধা পড়ে থাকা ‘দাস’ তার ‘প্রভুর’ প্রতি কর্তব্য ভুলে যাক, তাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া আর কী!

মুসলিম ব্যক্তিবিশেষ ও সমাজের এহেন প্রতিমূর্তি নির্মাণে মুসলিম সমাজ নিয়ে যতটা না অজ্ঞতা আছে তার থেকে অনেক বেশি আছে অবজ্ঞা, ব্যঙ্গ আর বস্তাপচা অচলাধ্যাস — এরা মধ্যযুগীয়, বর্বর, গুন্ডাবৎ, অস্ত্রধারী, রক্তচক্ষু, মানুষের মতো দেখতে, হিংস্র মাংসল প্রাণী যারা তাদের সমাজজীবনে রক্তের হোলি খেলায় মেতে থাকে।

সাম্প্রতিক অতীতে সৃজিত মুখার্জির জুলফিকার সিনেমার পরতে পরতে ষ্টিরিওটাইপের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায়। সিনেমার শুরুই হচ্ছে এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যেন রবি ঠাকুর সুভাষ বোসের সম্প্রীতির বাংলাকে রক্তাক্ত করেছে খিদিরপুর মেটিয়াবুরুজের মানুষজন। চরিত্র গুলোর চোখে সুরমা, গুলাবি উর্দুভাষী, সুন্নতি দাড়ি রেখেই মাফিয়াগিরি করছে। মুসলিম সমাজে চোর, ডাকাত, গুন্ডা, মাফিয়া নেই তা নয়, কিন্তু মাথায় ফেজ টুপি ও সুন্নতি দাড়ি রেখে তারা মাফিয়ারাজ চালাবে নাকি! ভীষনই কিম্ভূতকিমাকার ও হাস্যকর ঠেকেছে এ ধরনের চিত্রায়ন ও চরিত্রায়ন। মুসলিম বসতি বলতেই এঁদো গলি, বোমা বারুদ, অস্ত্রশস্ত্র, ঘিঞ্জি গলির ঘেঁটোবদ্ধ জীবন। এভাবেই গল্পটা চলছে দিনের পর দিন।

বীরষা দাশগুপ্তর ছবি “শুধু তোমারই জন্য” তে মুসলিম চরিত্র সিরাজ চৌধুরি একজন প্রতারক। সে ধর্মরক্ষার তাগিদে প্রেমিকার সাথে প্রতারণা করেছে। আরবি নামধারী চরিত্র মানেই তার কৃতকর্মের সঙ্গে ইনিয়ে বিনিয়ে ধর্মের একটা সমীকরণ টেনে দেওয়া হয়। মুসলিম মানেই “মীরজাফরের জাত”, তারা চরিত্রগতভাবে “বেইমানই” হবে। সিরাজদুল্লার বিরুদ্ধে  ষড়যন্ত্রে লিপ্ত শুধু মীরজাফর ছিল না, উমিচাঁদ জগৎ শেঠরাও ছিল। কোন হিন্দু ভাইকে কি শুনতে হয় “বেইমান উমিচাঁদের জাত” বা কোন  মাড়োয়াড়ী ভাইকে “বেইমান  মাড়োয়াড়ীর জাত” ? না, শুনতে হয় না। কিন্তু মুসলমান  জনগোষ্ঠীর  মানুষজনকে শুনতে হয় “মীরজাফরের জাত”। অথচ আশরফ মুসলমান মীরজাফরের সঙ্গে নিম্নবিত্ত বাঙালি মুসলমানদের তিনকূলে কোনও সম্পর্ক নেই। সংখ্যাগুরুর কুকর্মের দায় শুধু ব্যক্তিবিশেষের। কিন্তু সংখ্যালঘু মুসলিম ব্যক্তিবিশেষের কুকর্মের দায় ব্যক্তিসহ গোটা মুসলিম জনগোষ্ঠীর। এখানেই দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য হয়ে যায়।

অপর্ণা সেনের ছবি “মিষ্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার” এ প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাহুল বোস। ছবিতে তিনি একজন মুসলিম। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা পরিস্থিতিতে তিনি আছেন একজন ক্যামেরম্যানের ভূমিকায়। কেবল অপর্ণা সেনের এই ছবিটি ছাড়া সাম্প্রতিক অতীতে টালিগঞ্জে আর কোন সিনেমা হয়েছে বলে আমার জানা নেই যেখানে ষ্টিরিওটাইপের উর্দ্ধে উঠে দৈনন্দিন জলভাতের পথচলতি মুসলমানকে দেখানো হয়েছে।

মুসলিম প্রতিমূর্তির পুরোনো ছকেই কয়েকটি বাংলা ধারাবাহিক শুরু হয়েছে ইদানিং। সেখানে পুরুষ গুলো প্রায় সবাই চোখে সুরমা লাগানো খলনায়ক, রক্তচক্ষু, উগ্র, নারীবিদ্বেষী। তারা নারীদের পায়ের তলায় পিষে রাখতে চায়। পরিবারে নারীরা সাংঘাতিক রকমের নির্যাতিত লাঞ্ছিত অবহেলিত পদদলিত। নারী অবস্থাপন্ন মুসলিম পরিবারের হলে চুমকি বসানো ঝকমকে চুড়িদার, কান বের করে রেখে মাথার চুল ঢাকা। গরীব মুসলিম নারী হলে আটপৌরে ঘরানার শাড়ি, মাথা ঢাকা। এক একটি পরিবার যেন এক একটি অন্ধকূপ।

একটি ধারাবাহিকে দেখা যায় দুটি আপাত বিরোধী সমাজের সহবস্থান। একদিকে ঝাঁ চকচকে আলো ঝলমল সম্ভনাময় পাশ্চাত্য আধুনিকতায় পুষ্ট উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজ যেখানে প্রতিনিয়ত উচ্চাকাঙ্খার উদযাপন চলে। আর অন্য দিকে মধ্যযুগীয় বর্বর অন্ধকার ধর্মোন্মাদ এঁদো মুসলিম সমাজ যারা নিরেট নির্বোধ। মুসলীম সমাজ কতটা অন্ধকারময় সেটা ক্ষণে ক্ষণে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য প্যারামিটার হিসাবে শহুরে এলিট হিন্দু সমাজকে পাশাপাশি রাখা হয়েছে। দর্শক নিজেই সেটা মেপে দেখে নিতে পারবে আর কী! এহেন অন্ধকার মুসলিম সমাজ থেকে গল্পের নায়িকা শবনবের উদ্ধারকর্তা আধুনিক সমাজের প্রতিভূ একজন সংখ্যাগুরু এলিট যুবক।

সম্প্রতি এক বাংলা ধারাবাহিকে দেখা যাচ্ছে, মেধাবী ছাত্রী শবনম দুঃখভরে তার বন্ধুকে এক দৃশ্যে বলছে, “আমার আব্বু চায় না আমি পড়াশোনা করি, পরিবারের মেয়ে পড়াশোনা করলে গোটা পরিবার জাহান্নামে যাবে”। ডাক্তারি পড়ুয়া মেয়েকে পড়াশোনা ছাড়িয়ে তিনি তিন সন্তানের পিতা এক দোজবরের সঙ্গে তার বিয়ে দিতে চান। ছুরি হাঁসোয়া নিয়ে পিতাসহ শিক্ষাবিমুখ গোটা মুসলিম সমাজ শবনমকে খুন করবে বলে তেড়ে যাচ্ছে। শেষে হিন্দু সমাজে আশ্রিত হয়ে সে অন্ধকার থেকে ‘মুক্তি’ পাচ্ছে। ছোট ছোট দৃশ্যে খুব ‘সুন্দর’ করে সাধারণ জনমানসের বদ্ধমূল ভ্রান্ত ধারণাগুলোকে পোক্ত করা হচ্ছে।

বাংলার মুসলিম সমাজ সম্পর্কীয় ধারনায় স্ক্রিপট রাইটার এবং পরিচালক কোন প্রাগৈতিহাসিক সময়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি আটকে রেখেছেন জানা নেই। কিন্তু অধুনা বাস্তবতা হল বাংলার মুসলিম সমাজে শতাংশের হিসাবে পড়ুয়া ছাত্রের তুলনায় ছাত্রী বেশি। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক ও হাই মাদ্রাসার পরিসংখ্যান ঘাঁটলেই বোঝা যাবে। শিক্ষা মিশন গুলোর  সাম্প্রতিক সাফল্যের খতিয়ানে সেই স্ক্রিপ্ট রাইটার ও  পরিচালকদের একটু চোখ রাখতে বলব। আরও মেঠো বাস্তবতা হল কোন গরিব মুসলমান পিতার কন্যা পড়াশোনায় ভাল হলে কন্যাগর্বে গর্বিত পিতা পাঁচকান করে বলে বেড়াবে যে তার মেয়ের পরীক্ষার রেজাল্ট খুব ভাল। কিন্তু সিনেমা ধারাবাহিকে তার উল্টো প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। বাস্তবতা ও নির্মিত প্রতিমূর্তির এতখানি অমিল পুরো সমাজটাকে আরও বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

এমনভাবে চিত্রায়িত করা হচ্ছে সমাজটাকে যেন পুরো সমাজটাই শিক্ষা বিমুখ। নারী শিক্ষার প্রতি আরও বেশি বিমুখ। অথচ এই ধারণাটি সর্বৈব মিথ্যে। আধুনিক শিক্ষা মিশনকে কেন্দ্র করে বাংলার মুসলিম সমাজে যে শিক্ষার জোয়ার এসেছে চিত্রপরিচালকেরা কি দেখতে পান না? মনে বাসা করে থাকা ব্যাঙ্গচিত্রের উপর আঁক বুলিয়ে আর কত দিন ? এখনও তারা মুসলিম ব্যক্তিবিশেষ ও সমাজকে সাদা আর কালো দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে অভ্যস্ত। ধূসরতার কোন জায়গা নেই। মুসলিম মানে হয় অতি সৎ অতি ধার্মিক প্রভুভক্ত, নইলে ফেজটুপিধারী চোখে সুরমা লাগানো দাড়িওয়ালা মাফিয়া। হয় খুব ভাল, নাহলে খুব খারাপ। মাঝখানে কিছু নেই।

মুসলিমদের জন্য শুধু চাকর, মেকানিক, অতি ধার্মিক বা গুন্ডার চরিত্র জোটে। এরা চাকরিবাকরিও করে না, ব্যাবসাপাতিও করে না। এদের সমাজজীবনে কোন সেকুলারিত্ব নেই। সমাজ জীবন বলেও কিছু নেই। পুরোটাই ধর্মের নিগড়ে বাঁধা ধর্মীয় জীবন। এরা পরিবারসহ রেস্তোরাঁতেও যায় না, সিনেমাও দেখে না, বিকেল বেলা পার্কেও যায় না, শপিং এও যায় না, আড্ডাও মারে না। মাজার-মসজিদ থেকে ঘর, ঘর থেকে মাজার-মসজিদ এতেই গোটা জীবনটা চক্কর কাটে। এরা নিরেট নির্বোধ, ধর্মবোধ ছাড়া কিছু নেই। এরা বেপরোয়া। হাতে লাঠি বা চাপাতি ধরেই থাকে। হুটহাট বিয়ে থা করে নেয়। হুটাহাট তালাকও দিয়ে দেয়।

সমাজটা পুরোপুরিভাবে কৌমভিত্তিক। মৌলানা আলেমদের মস্তিস্ক দুষ্টু বুদ্ধির আঁতুড়ঘর। সমাজের সবাই ভেড়ার মতো তাদের কুমন্ত্রনায় চলে। এমনটাই ধ্যানধারনা। কিন্তু বাস্তবতা হল সমাজে মৌলবিরা আশেপাশের বা দূরবর্তী গ্রাম থেকে পেটের দায়ে আসা ধর্মীয় শ্রমিক, মোটেই “ধর্মীয় গুরু” নয়। ওরা পরান্নভোজী, মুসল্লিদের দানের পয়সায় সংসার চলে। সমাজে এরা যতটা না সম্মানীয় তার থেকে অনেক বেশি করুণা ও দয়ার পাত্র। মাস গেলে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা বেতন জোটে। বুঝুন, মুসলিম সমাজে তাদের সম্মানের বহর! কিন্তু সাম্প্রতিক বাস্তবতার তোয়াক্কা না করে বানানো সিনেমা ধারাবাহিকের মধ্য দিয়ে শুধু অচলাধ্যাস গুলো ছবি হয়ে টিভি স্ক্রীনে বারবার ভেসে উঠছে। এই সমাজে আমার নিত্য দিনের উঠবোস। আজ অব্দি যত মৌলবির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে প্রায় সবাই সদাহাস্য, ভদ্র ও মৃদুভাষী। কিন্তু তবুও রাজনীতি বিমুখ দরিদ্র ছাপোষা মৌলবিদের ধারাবাহিক ও সিনেমার দর্শক-শ্রোতারা চিনছে সমাজের মূল খলনায়ক হিসাবে।

মুসলিম সমাজ মনোলিথিক নয়। সবাই এক সুরে গান গায় না, এক স্বরে কথা বলে না। ভিন্ন সুর, ভিন্ন স্বর এই সমাজেও আছে। হিন্দু সমাজের মতো মুসলিম সমাজেও আছে ধার্মিক মুসলমান, ধর্মউদাসীন মুসলমান, আছে অধার্মিক, নাস্তিক্য ভাবধারার মানুষ। অনস্বীকার্যভাবে মধ্যযুগীয় মানসিকতার মুসলমান যেমন রয়েছে তেমনি সর্বধর্ম সমন্বয়ের স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমানও আছে। সাধারন মুসলমান যে সাধারন হিন্দুর মতোই সুখ দুঃখ প্রেম বিচ্ছেদ নিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করে, ডালভাত খায়, পরিবার নিয়ে রেস্তোরাঁয় যায়, সিনেমা দেখে, এই বাস্তব চিত্রটা জনমানসে ভাসে না। প্রতিমূর্তি ও বাস্তবতার এই অমিল দুই প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের মনোসামাজিক জীবনে সব থেকে বড় ক্ষতিকর। এই নির্মিত প্রতিমূর্তিটা এতটাই কায়েমি যে চোখের সামনে স্বাভাবিক দৈনন্দিন জলভাতের পথচলতি মুসলমান দেখেও সাধারণ জনমানসে বাসা বেঁধে থাকা নেতিবাচক প্রতিমূর্তির বিনির্মাণ ঘটে না। এহেন নেতিবাচক প্রতিমূর্তি যতদিন না ভাঙবে ততদিন মনোসমাজ আমরা-ওরা থেকে নির্বাণ পেয়ে শুধু “আমরা” হয়ে উঠতে পারবে না। আমরা কেন ভাবব না যে সাধারণ বাঙালি মুসলমানের যাপন অনেকগুলি পরিচয় নিয়ে। তার শ্রেণি পরিচিতি, তার পেশা পরিচিতি, তার ভাষা ও আঞ্চলিক পরিচিতি, তার নিজস্ব ভাবাদর্শ, সব কিছু বাঙালি মুসলমানের ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে শুধু তার ধর্মীয় পরিচিতিই বড় হয়ে যাবে কেন ? প্রশ্নটি রইল।

Website | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *